উইকিবই bnwikibooks https://bn.wikibooks.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE MediaWiki 1.45.0-wmf.7 first-letter মিডিয়া বিশেষ আলাপ ব্যবহারকারী ব্যবহারকারী আলাপ উইকিবই উইকিবই আলোচনা চিত্র চিত্র আলোচনা মিডিয়াউইকি মিডিয়াউইকি আলোচনা টেমপ্লেট টেমপ্লেট আলোচনা সাহায্য সাহায্য আলোচনা বিষয়শ্রেণী বিষয়শ্রেণী আলোচনা উইকিশৈশব উইকিশৈশব আলাপ বিষয় বিষয় আলাপ রন্ধনপ্রণালী রন্ধনপ্রণালী আলোচনা TimedText TimedText talk মডিউল মডিউল আলাপ ব্যবহারকারী:R1F4T/খেলাঘর 2 18619 85454 85414 2025-06-30T15:48:55Z R1F4T 9121 85454 wikitext text/x-wiki ;পর্যালোচনা পরিসংখ্যান {| class="wikitable sortable" ! # !! পর্যালোচক !! পর্যালোচনা সংখ্যা |- | ১ || MS Sakib || ২৭৪ |- | ২ || MdsShakil || ২৬৭ |- | ৩ || NusJaS || ২৫১ |- | ৪ || Mehedi Abedin || ১৬৩ |- | ৫ || R1F4T || ১৬০ |- | ৬ || Tahmid || ১৪০ |- | ৭ || Yahya || ১৩৮ |- | ৮ || Ishtiak Abdullah || ১০৭ |- | ৯ || Maruf || ৪ |- ! colspan="2" | মোট পর্যালোচিত পৃষ্ঠা || ১৫০৪টি |} serfnmpsx7t87v9j73hz75tbavkympo 85474 85454 2025-06-30T17:54:07Z R1F4T 9121 85474 wikitext text/x-wiki ;পর্যালোচনা পরিসংখ্যান {| class="wikitable sortable" ! # !! পর্যালোচক !! পর্যালোচনা সংখ্যা |- | ১ || MS Sakib || ২৭৪ |- | ২ || MdsShakil || ২৭১ |- | ৩ || NusJaS || ২৫১ |- | ৪ || Mehedi Abedin || ১৬৮ |- | ৫ || R1F4T || ১৬০ |- | ৬ || Tahmid || ১৪০ |- | ৭ || Yahya || ১৩৮ |- | ৮ || Ishtiak Abdullah || ১০৭ |- | ৯ || Maruf || ৪ |- ! colspan="2" | মোট পর্যালোচিত পৃষ্ঠা || ১৫১৩টি |} 3np7o8vdnc4rqcq4ovebkhzsmt6vhqc পদার্থবিজ্ঞান পড়ার নির্দেশিকা/মৌলিক এককসমূহ 0 18932 85491 60207 2025-07-01T04:24:56Z Fahimul Islam Polok 9529 /* আলোকবর্ষ */ 85491 wikitext text/x-wiki =পরিমাপের এস. আই পদ্ধতি= ==মৌলিক এককসমুহ== নিম্নের এককগুলো হলো মৌলিক একক যেগুলোর উপর অন্যান্য এককগুলো নির্ভর করে। ===সময়=== সময়কে দুইটি ঘটনার মধ্যবর্তী কাল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এসআই পদ্ধতিতে সেকেন্ড(s) হল সময়ের মৌলিক একক। একটি সিজিয়াম পরমাণুর 9,192,631,770টি দোলন সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সময়কে 1 সেকেন্ড বলে। সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী নিজ কক্ষপথে 86400 সেকেন্ড একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। এটি গড় সৌরদিন হিসেবে পরিচিত এবং এক দিনের 86400 ভাগের এক ভাগকে 1 সেকেন্ড বলে। ===দৈঘ্য=== এসআই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের মৌলিক একক হলো মিটার (m) এবং এটিকে 1/299,792,458 সেকেন্ডে শূন্য মাধ্যমে আলো কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর সাহায্যে বোঝা যায় শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে 299,792,458 মিটার। ===ভর=== আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতি বা এসআই পদ্ধতিতে বরের মৌলিক একক হল কিলোগ্রাম এবং ফ্রান্সের ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল ডেস পয়েডস এট মেসুরস এ রাখা একটি প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সংকর দন্ডের ভর আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। এই দন্ডটির একটি কফি মেরিল্যান্ড এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ড এবং টেকনোলজি তে রাখা হয়েছে। ===তড়িৎ প্রবাহ=== আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতিতে (এসআই পদ্ধতি) তড়িৎ প্রবাহ পরিমাপের মৌলিক একক অ্যাম্পিয়ার(A)। যদি অসীম দৈর্ঘ্যের দুটি সরল সমান্তরাল পরিবাহী ভ্যাকুয়ামে 1 মিটার (m) দূরে রাখা হয় তবে এদের মধ্যে প্রতি মিটারে 2×10^-7 N এর সমান আকর্ষণ বল তৈরি হবে। ===তাপমাত্রা=== কেলভিন (K), তাপমাত্রার মৌলিক একক। পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রার 1/273.16 অংশকে 1 কেলভিন বলে। ===পদার্থের পরিমাণের একক=== ১.মোল (mol) হচ্ছে এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে (এসআই) পদার্থের পরিমাণ পরিমাপের একক। একে কার্বনের একটি আইসোটোপ কার্বন-১২ (12C) এর ১২ গ্রামে পরমাণুর সংখ্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ২.এক মোল পদার্থ বা এক মোল কণাকে ৬.০২২১৪০৭৬×১০২৩টি কণা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা হতে পারে পরমাণু, অণু, আয়ন, অথবা ইলেকট্রন। ===দীপন তীব্রতা=== ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অফ ইউনিট (SI) এর আলোকিত তীব্রতার একক ক্যান্ডেলা (cd), এটি একটি উৎসের প্রদত্ত আলোকিত তীব্রতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয় যা 540 × 1012 Hz frequency'র একরঙা আলো বিকিরণ নির্গত করে। এবং একই দিকে তীব্রতা রাখে প্রতি স্ট্রেডিয়ান ঘনকোনে 1/683 ওয়াট। ==যৌগিক বা লব্ধ একক== এই এককগুলো দুই বা ততধিক মৌলিক একক নিয়ে গঠিত। ===চার্জ বা আধান=== চার্জ বা আধানের এসআই একক হলো কুলম্ব (C)। এটি অ্যাম্পিয়ার(A) এবং সেকেন্ডের(s) গুণফলের সমান: <math>1 \ \mathrm{C} = 1 \ \mathrm{A} \cdot \mathrm{s}</math> ===বেগ=== বেগের জন্য এসআই একক m/s বা মিটার পার সেকেন্ডে। ===বল=== বলের এসআই একক হল নিউটন (N), স্যার আইজ্যাক নিউটনের নামানুসারে। <math>1N=1 \ \mathrm{kg} \cdot \mathrm{m}/\mathrm{s}^2</math> ===কাজ বা শক্তি=== কাজ বা শক্তির এসআই একক হল জুল (J)। এক কেজি ভরের বস্তুকে এক মিটার সরণ ঘটাতে কৃতকাজ বা যে শক্তির প্রয়োজন হয় তাকে এক জুল বলা হয়। ===চাপ=== চাপের এসআই একক হল প্যাসকেল (Pa)। মৌলিক এককগুলোর সাহায্যে লিখলে <math>\mathrm{N} / \mathrm{m}^2</math> অথবা <math>\mathrm{kg} / \mathrm{m} \cdot \mathrm{s}^2</math>। ==গুণিতক বা উপসর্গ== {| class="wikitable" !উপসর্গ |এক্সা |পেটা |টেরা |গিগা |মেগা |কিলো |হেক্টো |ডেকা |&nbsp; |ডেসি |সেন্টি |মিলি |মাইক্রো |নানো |পিকো |ফেমটো |এটো |- !প্রতীক |E |P |T |G |M |k |h |da |&nbsp; |d |c |m |&micro; |n |p |f |a |- !10<sup>n</sup> |10<sup>18</sup> |10<sup>15</sup> |10<sup>12</sup> |10<sup>9</sup> |10<sup>6</sup> |10<sup>3</sup> |10<sup>2</sup> |10<sup>1</sup> |10<sup>0</sup> |10<sup>-1</sup> |10<sup>-2</sup> |10<sup>-3</sup> |10<sup>-6</sup> |10<sup>-9</sup> |10<sup>-12</sup> |10<sup>-15</sup> |10<sup>-18</sup> |- |} =জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে পরিমাপের একক= এসআই এককগুলো সরসময় ব্যবহার করার জন্য সুবিধাজনক নয়, এমনকি বড় (এবং ছোট) উপসর্গগুলোর সাথেও। তাই জ্যোতির্বিদ্যার জন্য নিম্নলিখিত এককগুলো ব্যবহার করা হয়: ==জুলীয় বা জুলিয়ান বর্ষ== জুলীয় বর্ষপঞ্জীতে গড়ে ৩৬৫.২৫ দিনে এক বছর এবং একদিনে 60×60×24=86400 সেকেন্ড। অতএব 1 জুলিয়ান বছর 31,557,600 সেকেন্ডের সমান। ==আলোকবর্ষ== এক জুলিয়ান বছরে শূন্য মাধ্যমে আলো যে দৃতিতে অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। "বছর" শব্দের কারণে আলোকবর্ষকে অনেকে প্রায়ই সময়ের একক হিসাবে ভুল করে। তবে এটি দৈর্ঘ্যের (দূরত্ব) একক এবং 9,460,730,472,580,800 মিটারের সমান। jx6k80pp5wcst4izvljp5ybathn2csn 85492 85491 2025-07-01T04:25:11Z Fahimul Islam Polok 9529 /* আলোকবর্ষ */ 85492 wikitext text/x-wiki =পরিমাপের এস. আই পদ্ধতি= ==মৌলিক এককসমুহ== নিম্নের এককগুলো হলো মৌলিক একক যেগুলোর উপর অন্যান্য এককগুলো নির্ভর করে। ===সময়=== সময়কে দুইটি ঘটনার মধ্যবর্তী কাল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এসআই পদ্ধতিতে সেকেন্ড(s) হল সময়ের মৌলিক একক। একটি সিজিয়াম পরমাণুর 9,192,631,770টি দোলন সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সময়কে 1 সেকেন্ড বলে। সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী নিজ কক্ষপথে 86400 সেকেন্ড একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। এটি গড় সৌরদিন হিসেবে পরিচিত এবং এক দিনের 86400 ভাগের এক ভাগকে 1 সেকেন্ড বলে। ===দৈঘ্য=== এসআই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের মৌলিক একক হলো মিটার (m) এবং এটিকে 1/299,792,458 সেকেন্ডে শূন্য মাধ্যমে আলো কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর সাহায্যে বোঝা যায় শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে 299,792,458 মিটার। ===ভর=== আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতি বা এসআই পদ্ধতিতে বরের মৌলিক একক হল কিলোগ্রাম এবং ফ্রান্সের ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল ডেস পয়েডস এট মেসুরস এ রাখা একটি প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সংকর দন্ডের ভর আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। এই দন্ডটির একটি কফি মেরিল্যান্ড এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ড এবং টেকনোলজি তে রাখা হয়েছে। ===তড়িৎ প্রবাহ=== আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতিতে (এসআই পদ্ধতি) তড়িৎ প্রবাহ পরিমাপের মৌলিক একক অ্যাম্পিয়ার(A)। যদি অসীম দৈর্ঘ্যের দুটি সরল সমান্তরাল পরিবাহী ভ্যাকুয়ামে 1 মিটার (m) দূরে রাখা হয় তবে এদের মধ্যে প্রতি মিটারে 2×10^-7 N এর সমান আকর্ষণ বল তৈরি হবে। ===তাপমাত্রা=== কেলভিন (K), তাপমাত্রার মৌলিক একক। পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রার 1/273.16 অংশকে 1 কেলভিন বলে। ===পদার্থের পরিমাণের একক=== ১.মোল (mol) হচ্ছে এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে (এসআই) পদার্থের পরিমাণ পরিমাপের একক। একে কার্বনের একটি আইসোটোপ কার্বন-১২ (12C) এর ১২ গ্রামে পরমাণুর সংখ্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ২.এক মোল পদার্থ বা এক মোল কণাকে ৬.০২২১৪০৭৬×১০২৩টি কণা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা হতে পারে পরমাণু, অণু, আয়ন, অথবা ইলেকট্রন। ===দীপন তীব্রতা=== ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অফ ইউনিট (SI) এর আলোকিত তীব্রতার একক ক্যান্ডেলা (cd), এটি একটি উৎসের প্রদত্ত আলোকিত তীব্রতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয় যা 540 × 1012 Hz frequency'র একরঙা আলো বিকিরণ নির্গত করে। এবং একই দিকে তীব্রতা রাখে প্রতি স্ট্রেডিয়ান ঘনকোনে 1/683 ওয়াট। ==যৌগিক বা লব্ধ একক== এই এককগুলো দুই বা ততধিক মৌলিক একক নিয়ে গঠিত। ===চার্জ বা আধান=== চার্জ বা আধানের এসআই একক হলো কুলম্ব (C)। এটি অ্যাম্পিয়ার(A) এবং সেকেন্ডের(s) গুণফলের সমান: <math>1 \ \mathrm{C} = 1 \ \mathrm{A} \cdot \mathrm{s}</math> ===বেগ=== বেগের জন্য এসআই একক m/s বা মিটার পার সেকেন্ডে। ===বল=== বলের এসআই একক হল নিউটন (N), স্যার আইজ্যাক নিউটনের নামানুসারে। <math>1N=1 \ \mathrm{kg} \cdot \mathrm{m}/\mathrm{s}^2</math> ===কাজ বা শক্তি=== কাজ বা শক্তির এসআই একক হল জুল (J)। এক কেজি ভরের বস্তুকে এক মিটার সরণ ঘটাতে কৃতকাজ বা যে শক্তির প্রয়োজন হয় তাকে এক জুল বলা হয়। ===চাপ=== চাপের এসআই একক হল প্যাসকেল (Pa)। মৌলিক এককগুলোর সাহায্যে লিখলে <math>\mathrm{N} / \mathrm{m}^2</math> অথবা <math>\mathrm{kg} / \mathrm{m} \cdot \mathrm{s}^2</math>। ==গুণিতক বা উপসর্গ== {| class="wikitable" !উপসর্গ |এক্সা |পেটা |টেরা |গিগা |মেগা |কিলো |হেক্টো |ডেকা |&nbsp; |ডেসি |সেন্টি |মিলি |মাইক্রো |নানো |পিকো |ফেমটো |এটো |- !প্রতীক |E |P |T |G |M |k |h |da |&nbsp; |d |c |m |&micro; |n |p |f |a |- !10<sup>n</sup> |10<sup>18</sup> |10<sup>15</sup> |10<sup>12</sup> |10<sup>9</sup> |10<sup>6</sup> |10<sup>3</sup> |10<sup>2</sup> |10<sup>1</sup> |10<sup>0</sup> |10<sup>-1</sup> |10<sup>-2</sup> |10<sup>-3</sup> |10<sup>-6</sup> |10<sup>-9</sup> |10<sup>-12</sup> |10<sup>-15</sup> |10<sup>-18</sup> |- |} =জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে পরিমাপের একক= এসআই এককগুলো সরসময় ব্যবহার করার জন্য সুবিধাজনক নয়, এমনকি বড় (এবং ছোট) উপসর্গগুলোর সাথেও। তাই জ্যোতির্বিদ্যার জন্য নিম্নলিখিত এককগুলো ব্যবহার করা হয়: ==জুলীয় বা জুলিয়ান বর্ষ== জুলীয় বর্ষপঞ্জীতে গড়ে ৩৬৫.২৫ দিনে এক বছর এবং একদিনে 60×60×24=86400 সেকেন্ড। অতএব 1 জুলিয়ান বছর 31,557,600 সেকেন্ডের সমান। ==আলোকবর্ষ== এক জুলিয়ান বছরে শূন্য মাধ্যমে আলো যে দ্রুতিতে অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। "বছর" শব্দের কারণে আলোকবর্ষকে অনেকে প্রায়ই সময়ের একক হিসাবে ভুল করে। তবে এটি দৈর্ঘ্যের (দূরত্ব) একক এবং 9,460,730,472,580,800 মিটারের সমান। oy1653p8ohrw3j0wie08zvcxivg95mi মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস/আমেরিকান বিপ্লব 0 24888 85471 78070 2025-06-30T17:25:53Z Mehedi Abedin 7113 85471 wikitext text/x-wiki == পটভূমি == প্রথম নজরে ব্রিটিশ বাহিনীর সব সুবিধা ছিল বলে মনে হতে পারে। যুদ্ধের শুরুতে তাদের কাছে কামান এবং গোলাবারুদের মজুত ছিল। উপনিবেশবাসীদের কাছে ছিল স্থানীয় কারখানায় তৈরি একক-শট রাইফেল। এই বন্দুকগুলো লোড করতে সময় লাগত এবং সহজেই ভুল গুলি চালাতে পারত বা বিস্ফোরিত হতে পারত। ১৭৭৫ সালে ওয়াশিংটন যখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে প্রতি সৈন্যের জন্য মাত্র নয় রাউন্ড গোলাবারুদের জন্য যথেষ্ট বারুদ ছিল।<ref>McCullough, David. ''1776.'' New York: Simon and Schuster, 2005. p. 28</ref> ব্রিটিশদের একটি বড় পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল। এটি প্রাচীন রোমের মতো প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের খাদ্য, পোশাক এবং অস্ত্রের সরবরাহ ভালো ছিল। কিন্তু মার্কিনদের প্রশিক্ষণের অভাবের মানে ছিল যে তারা ইউরোপীয়দের মতো সমবেত হত না। তারা বরং স্নাইপারদের উপর নির্ভর করত। এরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি ছিল। তারা গুলি ছুঁড়ত এবং তারপর আবার লোড করত যখন তাদের প্রতিবেশীরা গুলি চালাত। তারা এটি ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের সময় শিখেছিল। স্নাইপাররা মার্কিনদের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। == যুদ্ধের শুরু (১৭৭৫ - ১৭৭৮) == === লেক্সিংটন এবং কনকর্ড === [[Image:Battle_of_Lexington.jpeg|thumb|300px|right|লেক্সিংটনে সংঘর্ষ।]] ব্রিটিশ সরকার জেনারেল থমাস গেজকে ম্যাসাচুসেটসে অসহনীয় আইন কার্যকর করতে এবং অধিকার সীমিত করতে নির্দেশ দেয়।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=124</ref> গেজ কনকর্ডে অবস্থিত উপনিবেশের অস্ত্রের মজুত জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিলে গেজের সৈন্যরা কনকর্ডের দিকে যাত্রা করে। পথে লেক্সিংটন শহরে পল রিভিয়ার এবং অন্যদের মাধ্যমে আগাম সতর্ক করা মার্কিনরা সৈন্যদের থামানোর চেষ্টা করে। কোন পক্ষ প্রথম গুলি চালিয়েছিল তা কেউ জানে না। কিন্তু এটি লেক্সিংটন গ্রিনে ব্রিটিশ এবং মিনিটম্যানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে। খোলা মাঠে ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যদের অপ্রতিরোধ্য সংখ্যার মুখোমুখি হয়ে মিনিটম্যানরা দ্রুত পরাজিত হয়। তবুও গ্রামাঞ্চলে সতর্ক সংকেত ছড়িয়ে পড়ে। উপনিবেশের মিলিশিয়ারা ছুটে আসে। তারা ব্রিটিশদের উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে যখন তারা কনকর্ডের দিকে যায়। কনকর্ডে উপনিবেশবাসীরা সৈন্য জড়ো করে। তারা সেখানে ব্রিটিশদের সঙ্গে শক্তির সাথে যুদ্ধ করে। তারা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। তারপর তারা অস্ত্রাগারের জিনিসপত্র দখল করে। ব্রিটিশরা বোস্টনে ফিরে যায়। তারা সব দিক থেকে অবিরাম এবং তীব্র গুলির মুখে পড়ে।<ref>http://origins.osu.edu/milestones/april-2015-shot-heard-round-world-april-19-1775-and-american-revolutionary-war</ref> বোস্টনের উপকণ্ঠে কামানের সমর্থন সহ একটি শক্তিশালী কলাম না থাকলে ব্রিটিশদের প্রত্যাহার সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে পরিণত হতো। পরের দিন ব্রিটিশরা জেগে উঠে দেখে বোস্টন ২০,০০০ সশস্ত্র উপনিবেশবাসী দ্বারা ঘেরা। তারা শহরটির অবস্থিত উপদ্বীপে প্রসারিত চারপাশের জমি দখল করে। === বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ === [[Image:Bunker_hill.jpg|thumb|বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ।]] {{quote|text=তাদের চোখের সাদা অংশ না দেখা পর্যন্ত গুলি করো না।|sign=কর্নেল উইলিয়াম প্রেসকট |source=যুদ্ধের আগে নির্দেশ<ref>https://www.wbur.org/radioboston/2010/06/17/bunker-hill-stories</ref>}} যুদ্ধের কার্যক্রম একটি ''যুদ্ধ'' থেকে একটি ''অবরোধ''-এ পরিণত হয়। এখানে একটি সেনাবাহিনী অন্যটিকে একটি শহর বা নগরীতে আটকে রাখে। (যদিও ঐতিহ্যগতভাবে, ব্রিটিশরা অবরুদ্ধ ছিল না। কারণ রাজকীয় নৌবাহিনী বন্দর নিয়ন্ত্রণ করত এবং জাহাজের মাধ্যমে সরবরাহ আসত।) ম্যাসাচুসেটস মিলিশিয়ার প্রধান জেনারেল আর্টেমাস ওয়ার্ড অবরোধের প্রাথমিক তদারকি করেন। তিনি ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি তার বাহিনীকে চার্লসটাউন নেক, রক্সবারি এবং ডরচেস্টার হাইটসে অবস্থান করান। ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ বিদ্রোহী জেনারেল থমাস গেজের অধীনে প্রায় ৪,০০০ ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যের মুখোমুখি হয়। বোস্টন এবং এর খুব কম অংশ ব্রিটিশ সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জেনারেল গেজ ১৭ জুন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি ব্রিডস হিল এবং বাঙ্কার হিলে উপনিবেশবাসীদের উপর আক্রমণ করেন। যদিও ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের তুলনায় প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তারা অবশেষে আমেরিকান বাহিনীকে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অনেক উপনিবেশী সৈন্যের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর শীঘ্রই বোস্টনের আশেপাশের এলাকা ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। তবে যে ক্ষয়ক্ষতি তারা ভোগ করে, তাতে তারা শহরের অবরোধ ভাঙতে পারেনি। উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রাথমিক পরাজয় সত্ত্বেও এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে তারা ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা রাখে। সেই সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে বিশ্বের সেরা বলে মনে করা হতো। === শান্তির শেষ সুযোগ === দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৫ সালের ৫ জুলাইয়ে শান্তির জন্য একটি পিটিশন গ্রহণ করে। এটির নাম '''অলিভ ব্রাঞ্চ পিটিশন'''। কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করে। এটি লন্ডনে পৌঁছায় যখন বাঙ্কার হিলের যুদ্ধের খবর আসে। রাজা পিটিশন পড়তে বা এর দূতদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=3881</ref> সংসদ প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করে। এটি উপনিবেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে।<ref>https://sites.austincc.edu/caddis/colonial-rebellion/</ref> === বোস্টনের জন্য যুদ্ধ === ব্রিটিশদের জাহাজে প্রবেশাধিকার থাকলেও শহর ও সেনাবাহিনী খাদ্যের অভাবে ছিল। লবণাক্ত শুয়োরের মাংসই ছিল প্রধান খাদ্য। দ্রব্যের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। মার্কিন বাহিনী শহরে কী ঘটছে তা কিছুটা জানত। কিন্তু জেনারেল গেজের কাছে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপের কোনো কার্যকর তথ্য ছিল না। ১৭৭৫ সালের ২৫ মে ৪,৫০০ সৈন্য এবং তিনজন নতুন জেনারেল বোস্টন হারবারে পৌঁছান। নতুন নেতারা ছিলেন মেজর জেনারেল উইলিয়াম হাও, ব্রিগেডিয়ার জন বারগয়েন এবং হেনরি ক্লিনটন। গেজ শহর থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৭৭৫ সালের ৩ জুলাইয়ে জর্জ ওয়াশিংটন নতুন মহাদেশীয় সেনার দায়িত্ব নিতে আসেন। মেরিল্যান্ডের মতো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে বাহিনী ও সরবরাহ আসে। ডরচেস্টার নেকে পরিখা তৈরি করা হয়। এটি বোস্টনের দিকে প্রসারিত হয়। ওয়াশিংটন বাঙ্কার হিল এবং ব্রিডস হিল পুনরায় দখল করেন। এতে কোনো বাধা আসেনি। তবে এই কার্যক্রম ব্রিটিশদের দখলের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। [[Image:Henry_Knox.PNG|thumb|upright|হেনরি নক্স মহাদেশীয় সেনাদের ব্রিটিশদের পরাজিত করতে ব্যবহৃত কামান সরবরাহে সহায়তা করেন।]] ১৭৭৫-১৭৭৬ সালের শীতে হেনরি নক্স এবং তার প্রকৌশলীরা জর্জ ওয়াশিংটনের নির্দেশে স্লেজ ব্যবহার করে ফোর্ট টিকনডেরোগা থেকে ৬০ টন ভারী কামান সংগ্রহ করেন। নক্স এই স্লেজ ব্যবহারের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ১৮ দিনে কামানগুলো সেখানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু হিমায়িত কানেকটিকাট নদী পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগে। ১৭৭৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে তারা কেমব্রিজে ফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিংটন অবিশ্বাস্য প্রতারণা ও গতিশীলতার কৌশলে রাতারাতি কামান এবং কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে ডরচেস্টার হাইটস দখল করেন। বাহিনী বোস্টনের উপর নজর রাখে। জেনারেল জন টমাস এলাকাটি সুরক্ষিত করেন। ব্রিটিশ নৌবহর একটি দায় হয়ে পড়ে। এটি অগভীর বন্দরে নোঙর করা ছিল। এর চালনার সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি ডরচেস্টার হাইটসের মার্কিন কামানের মুখোমুখি হয়। জেনারেল হাও যখন কামানগুলো দেখেন, তিনি বুঝতে পারেন শহর ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে শহর শান্তিপূর্ণভাবে খালি করার অনুমতি চান। বিনিময়ে, তারা শহর পুড়িয়ে দেবে না। ওয়াশিংটন সম্মত হন। তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। তার কাছে কামান ছিল, কিন্তু গানপাউডার ছিল না। পুরো পরিকল্পনাটি ছিল একটি দুর্দান্ত প্রতারণা। ১৭৭৬ সালের ১৭ মার্চ ব্রিটিশরা নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে অবরোধ শেষ হয়। মিলিশিয়ারা বাড়ি ফিরে যায়। এপ্রিলে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনার বেশিরভাগ বাহিনী নিয়ে নিউ ইয়র্ক নগরী সুরক্ষিত করতে যান। === ইথান অ্যালেন ও ফোর্ট টিকনডেরোগা === [[Image:Fort_Ticonderoga_1775.jpg|thumb|left|300px|ইথান অ্যালেন টিকনডেরোগা দুর্গ দখল করছেন।]] ব্রিটিশরা ফোর্ট টিকনডেরোগাকে তুলনামূলকভাবে গুরুত্বহীন একটি চৌকি মনে করত। তখন পর্যন্ত সংঘর্ষ মূলত ম্যাসাচুসেটসে ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সৈনিক ইথান অ্যালেনের নজর ছিল এই দুর্গের উপর। অ্যালেন ভার্মন্টে একটি আঞ্চলিক মিলিশিয়া গড়ে তুলেছিলেন। নাম ছিল গ্রিন মাউন্টেন বয়েজ। এটি একটি কার্যকর যুদ্ধশক্তি হয়ে ওঠে। ভার্মন্ট নিউ ইয়র্ক উপনিবেশের দাবিদার ছিল। কিন্তু অ্যালেন আরও স্বাধীনতা চাইতেন। ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে কানেকটিকাট মিলিশিয়ার কমান্ডার বেনেডিক্ট আরনল্ড অ্যালেনের কাছে আসেন। আরনল্ড ঘোষণা করেন যে তিনি ফোর্ট টিকনডেরোগার কামান দখলের জন্য নিযুক্ত হয়েছেন। দুজনের মধ্যে তীব্র আলোচনার পর তারা সম্মত হন যে দুই মিলিশিয়া একসঙ্গে দুর্গ আক্রমণ করবে। এটি ভালো হয়েছিল। কারণ দুই বাহিনী একসঙ্গে ছোট ছিল। এটি ব্রিগেডের শক্তির অনেক কম ছিল। ১০ মে মার্কিন সম্মিলিত বাহিনী দুর্গ দখল করে। তারা অস্ত্র সহ কামান দখল করে। এগুলো গরু দিয়ে টেনে বোস্টনে নিয়ে যাওয়া হয়। == কারণকে শক্তিশালী করা == সেই সময়ের গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিপ্লব সম্মানিত মানুষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধারণাকে প্রচার করে। উত্তর ও দক্ষিণের সংবাদপত্র উত্তেজক গল্প এবং উৎসাহব্যঞ্জক খোদাই প্রকাশ করে। থিয়েটার নাটকীয় প্রতিবাদে অবদান রাখে। এর মধ্যে ছিল মেরি ওটিস ওয়ারেনের সৃষ্টিকর্ম। গান বাজানো এবং গাওয়া হতো ক্লান্ত মনোবল উত্সাহিত করতে। === থমাস পেইনের ১৭৭৬ === ১৭৭৬ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজ থমাস পেইন ''কমন সেন্স'' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই রাজতন্ত্রবিরোধী প্রকাশনা মার্কিন স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে। এটি বাইবেল ও প্রজাতান্ত্রিক গুণাবলীর উদাহরণ ব্যবহার করে। এটি যুক্তি দেয় যে কোনো মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য রাজারা কখনোই ভালো নয়। ১৭৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ''দ্য আমেরিকান ক্রাইসিস'' নামে পুস্তিকার সিরিজ প্রকাশ শুরু করেন। এটি সৈন্যদের বিপ্লবের কারণে জড়ো হতে আহ্বান জানায়। প্রথম পুস্তিকাটি শুরু হয় উদ্দীপক কথায়: "এই সময়গুলো মানুষের আত্মাকে পরীক্ষা করে"। === স্বাধীনতার ঘোষণা === [[Image:Flag at Independence Hall.jpg|thumb|upright|ইন্ডিপেনডেন্স হলে প্রথম পতাকা উত্তোলন। ক্লাইড ও. ডিল্যান্ডের চিত্রের প্রতিলিপি।]] যখন সামরিক শত্রুতা বাড়তে থাকে, দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা জর্জ ওয়াশিংটনকে মহাদেশীয় সেনার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওয়াশিংটন যুদ্ধের সময় এই পদের জন্য তার বেতন ত্যাগ করেন। (তিনি উপনিবেশের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি এই পছন্দের সামর্থ্য রাখতেন।) ১৭৭৬ সালের জুনে দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা মনে করে গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি প্রেরণা প্রয়োজন। এটি '''স্বাধীনতার ঘোষণা'''র খসড়া তৈরি করতে পাঁচজনের একটি কমিটি গঠন করে। তারা ছিলেন জন অ্যাডামস, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, রবার্ট লিভিংস্টন, রজার শেরম্যান ও থমাস জেফারসন। জেফারসন এই দলিলের প্রধান লেখক হন। যদিও ব্রিটিশ রাজা আর তার অধিরাজ্যের নীতির জন্য মূলত দায়ী ছিলেন না, স্বাধীনতার ঘোষণা তাকে স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করে। এটি বিদ্রোহের অধিকারকে এমন কথায় ন্যায্যতা দেয় যা ইউরোপীয় আলোকিত যুগ প্রশংসা করত: "আমরা এই সত্যগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করি, যে সকল মানুষ সমানভাবে সৃষ্ট।" মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ে এই দলিলে স্বাক্ষর করে। তবে এই সময়ে স্বাক্ষরগুলো দেখায় যে তারা স্বাধীনতা চায়। তারা একা এটি অর্জন করতে পারেনি। === আর্মি ব্যান্ড === একটি সুশৃঙ্খল সৈন্যদলের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তার সামরিক ব্যান্ড। ব্রিটিশ এবং হেসীয় সৈন্যরা ড্রামের তালে ড্রিল করত। এটি মাসকেটের গোলাগুলির শব্দের উপরে মার্চের ছন্দ বহন করত। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগের একটি উপায় প্রদান করত। "১৭৭৮ সাল নাগাদ সৈন্যরা সাধারণ সময়ে প্রতি মিনিটে ৭৫টি ২৪ ইঞ্চি পদক্ষেপে মার্চ করত। দ্রুত সময়ে মার্চ করার সময় এটি প্রায় দ্বিগুণ (প্রতি মিনিটে ১২০ পদক্ষেপ) হতো।"<ref>Anon. "Middle-brook Order, June 4, 1777: What It Really Says about the Quality of Revolutionary War Field Music." Paper read at School of the Musician, Brigade of the American Revolution, April 4, 1989. Revised February 12, 2011. Copyright 1989, 2011 HistoryOfTheAncientsDotOrg. http://historyoftheancients.wordpress.com/2012/09/06/1195/</ref> ফাইফ (একটি তীক্ষ্ণ বাঁশি) এবং ড্রামের সঙ্গীত সৈনিকদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করত। যদি বিদ্রোহীরা ভালো সরবরাহ না পেত, তবে তাদের অন্তত উচ্চ মনোবল থাকত। ''মিডল-ব্রুক অর্ডার''-এর মাধ্যমে জর্জ ওয়াশিংটন নির্দেশ দেন যে প্রত্যেক অফিসারকে তার সৈন্যদের জন্য সামরিক সঙ্গীতের ব্যবস্থা করতে হবে। সীমিত সংখ্যক যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও।<ref>Anon, "Middle-brook Order.</ref> ব্যান্ডগুলো দিনের শুরু ও শেষ ঘোষণা করতে, যুদ্ধে সৈন্যদের নির্দেশ দিতে এবং মনোবল উত্সাহিত করতে ব্যবহৃত হতো। === বিপ্লবে জনপ্রিয় সঙ্গীত === বিপ্লবের দুটি প্রধান গানের একটি ছিল স্তোত্র ''চেস্টার''। এটি ১৭৭০ সালে "দ্য নিউ ইংল্যান্ড সলম সিঙ্গার' এ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৭৭৮ সালে এটি সংশোধিত হয়। এর লেখক ও সুরকার উইলিয়াম বিলিংস বাইবেলের (''লেট টাইরান্টস শেক দেয়ার আয়রন রড'') এবং সমসাময়িক (''হাও এবং বারগয়েন এবং ক্লিনটন টু,/ উইথ প্রেসকট এবং কর্নওয়ালিস জয়নড'') দুটির সমন্বয় তৈরি করেন। আরেকটি ছিল গান ''ইয়াঙ্কি ডুডল''। এটি সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের একটি সুর থেকে অভিযোজিত। এটি মূলত ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের প্রাদেশিকবাদী আচরণ নিয়ে তামাশা করতে ব্যবহার করত। কিন্তু এটি মার্কিন বিদ্রোহীদের একটি থিমে পরিণত হয়। == কানাডা == ১৭৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল রিচার্ড মন্টগোমেরির নেতৃত্বে উপনিবেশবাসীরা কানাডা আক্রমণ করে। প্রথমে আক্রমণ সফল হয়। মন্টগোমেরি ফোর্ট সেন্ট জিন ও মন্ট্রিল শহর দখল করেন। ৩০ ডিসেম্বর তিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কুইবেক শহরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি বিপর্যয়কর হয়। মন্টগোমেরি যুদ্ধে নিহত হন। এটি কানাডার শেষ বড় পদক্ষেপ ছিল। যদিও বেনেডিক্ট আরনল্ড এবং অন্যান্য জেনারেলরা কানাডার উপকূলে আক্রমণ করেন বা সীমান্তে অভিযান চালান। == যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট == যুদ্ধের প্রথম বছরগুলোতে অসংখ্য পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও উপনিবেশবাসীরা বেশ কয়েকটি বড় বিজয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। === নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সি === ১৭৭৬ সালের জুলাইয়ে জেনারেল উইলিয়াম হাও এবং ৩০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে পৌঁছান। এই বড় সেনাবাহিনী লং আইল্যান্ডের যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের মার্কিন বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং পরাজিত করে। প্রায় পুরো সেনাবাহিনী বন্দী হওয়ার পর ওয়াশিংটন নিউ ইয়র্ক থেকে দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যাহার করেন। অবশেষে কন্টিনেন্টাল আর্মিকে পেনসিলভানিয়ায় শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়। হাও ওয়াশিংটনের বাহিনীকে তাড়া করে যুদ্ধ শেষ করতে পারতেন। কিন্তু হাও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। তিনি বাড়ি থেকে এত দূরে অনেক সৈন্য হারানোর ভয় করতেন। ব্রিটেন ট্রেন্টনের ব্রিটিশ দুর্গ পাহারা দেওয়ার জন্য জার্মান ভাড়াটে সৈন্য (হেসীয়) নিয়োগ করে। হাও এই প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেন। তিনি বসন্ত পর্যন্ত মহাদেশীয় সেনার উপর আবার আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটনও পরিস্থিতির সুযোগ নেন। তবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি মনে করতেন, বড়দিনের রাতে হেসীয়রা ভারী ভোজ ও মদ্যপানের পর সবচেয়ে দুর্বল থাকবে। ১৭৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাতে ওয়াশিংটন তার সৈন্যদের ৯ মাইল দূরে এবং ডেলাওয়্যার নদী পার করে হেসীয়দের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য নিয়ে যান। নদী পার করা কঠিন ছিল। পার হওয়ার শুরুতে শিলাবৃষ্টি ও তুষারঝড় শুরু হয়। বাতাস প্রবল ছিল। নদীতে বরফের টুকরো ভাসছিল। পার হতে তিন ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। তবুও ওয়াশিংটন আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটন যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ভাড়াটে সৈন্যরা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল। তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর খুব কম সময় ছিল। মাত্র এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর সকালে মহাদেশীয় আর্মি ট্রেন্টনের যুদ্ধে জয়ী হয়। মার্কিনদের মাত্র ৪ জন আহত হয় এবং ০ জন নিহত হয়। বিপরীতে, ২৫ জন হেসীয় নিহত, ৯০ জন আহত এবং ৯২০ জন বন্দী হয়। এই বিজয় সৈন্যদের মনোবল বাড়ায়। এটি পুনরায় তালিকাভুক্তির দিকে নিয়ে যায়। কিছু ইতিহাসবিদ এমনকি মনে করেন ট্রেন্টন বিপ্লবকে বাঁচিয়েছিল। ২ জানুয়ারিতে ব্রিটিশরা ট্রেন্টন পুনরুদ্ধার করতে আসে। তারা বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে এটি করে। ওয়াশিংটন আবারও একটি চতুর প্রত্যাহারের নেতৃত্ব দেন। তিনি প্রিন্সটনে অগ্রসর হন। প্রিন্সটনের যুদ্ধে মহাদেশীয় সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পিছনের রক্ষীদের আক্রমণ করে। তারা ব্রিটিশদের নিউ জার্সি থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যুদ্ধের সময়, নতুন বিশ্ব [[w:1775–1782 North American smallpox epidemic|1775–1782 উত্তর আমেরিকার গুটিবসন্ত মহামারী]] দ্বারা বিধ্বস্ত হচ্ছিল। যৌবনে এই রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া<ref>https://washingtonpapers.org/strongly-attacked-george-washington-encounters-smallpox/</ref> এবং বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের কাছ থেকে রোগটি সেনাবাহিনীর উপর যে প্রভাব ফেলতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করা হওয়ায়<ref name="locsmallpox">https://www.loc.gov/rr/scitech/GW&smallpoxinoculation.html</ref> জর্জ ওয়াশিংটন লিখেছিলেন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের চেয়ে এই রোগের কারণে মহাদেশীয় সেনাদের অক্ষম হওয়ার বিষয়ে বেশি ভয় করতেন।<ref name="locsmallpox"/> ৫ ফেব্রুয়ারিতে জর্জ ওয়াশিংটন গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবের কারণে বড় ধরনের ব্যাঘাতের পর সৈন্যদের প্রথম গণ টিকাদানের নির্দেশ দেন।<ref name="locsmallpox"/> এই নীতি সৈন্যদের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এটি গণ সংক্রমণ ছড়াতে বাধা দেয়।<ref name="locsmallpox"/> === সারাটোগার যুদ্ধ === [[Image:Surrender_of_General_Burgoyne.jpg|thumb|left|250px|বারগয়েন মহাদেশীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।]] ১৭৭৭ সালের গ্রীষ্মে ব্রিটিশ জেনারেল জন বারগয়েন এবং জেনারেল হাও ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীকে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে পরাজিত করার পরিকল্পনা করেন। হাও উত্তরে অগ্রসর হন। তিনি ব্র্যান্ডিওয়াইন এবং জার্মানটাউনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। অবশেষে তিনি ফিলাডেলফিয়া দখল করেন। কিন্তু বারগয়েন এত ভাগ্যবান ছিলেন না। মহাদেশীয় সেনাদের তৈরি প্রাকৃতিক ফাঁদে বিলম্বিত হয়ে তার সৈন্যরা কানাডা থেকে অ্যালবানির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে তার বাহিনী সারাটোগায় পৌঁছায়। সেখানে একটি বিশাল মার্কিন সেনাবাহিনী সৈন্যদের আক্রমণ করে। অক্টোবরে জেনারেল বারগয়েন তার সমস্ত বাহিনী মার্কিনদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জেনারেল হাও পেনসিলভানিয়ায় তার বিজয় সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন। সারাটোগার যুদ্ধ যুদ্ধের প্রধান উত্থানের ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত হয়। এটি ফ্রান্সকে বোঝায় যে আমেরিকাকে গ্রেট ব্রিটেনকে উৎখাত করতে হবে। ফরাসি সাহায্য তখন উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রবর্তিত হয়। এই যুদ্ধটি ব্রিটিশদের উত্তরে শেষ অগ্রগতি ছিল। ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মে নিউ জার্সির মনমাউথের যুদ্ধের পর সমস্ত যুদ্ধ দক্ষিণে সংঘটিত হয়। === ইরোকুইয়ের পরাজয় === ইরোকুই কনফেডারেসি তার শীর্ষে ইউরোপীয় শক্তির সমকক্ষ ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের পর থেকে এটি হ্রাস পাচ্ছিল। মিত্রসংঘের উপজাতিগুলো বিপ্লবে কাকে সমর্থন করবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। ওনেইডা এবং তুসকারোরা মার্কিনদের সমর্থন করে। মোহক, ওনোনডাগা, কায়ুগা এবং সেনেকা ব্রিটিশদের সমর্থন করে। ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত মিত্রসংঘ একত্র থাকতে সক্ষম হয়। সারাটোগার যুদ্ধের পর, ব্রিটিশদের সমর্থনকারী চারটি উপজাতি নিউ ইয়র্ক এবং পেনসিলভানিয়া জুড়ে মার্কিন বসতিগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। একটি পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ অনুসৃত হয়। ইরোকুই মার্কিন দুর্গ এবং শহরগুলোতে আক্রমণ করত। তারপর মার্কিনরা ইরোকুই গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিত। ১৭৭৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন জেনারেল সুলিভানকে ইরোকুই জাতিকে ধ্বংস করতে পাঠান। নিউটাউনের যুদ্ধে ইরোকুইদের পরাজিত করার পর সুলিভানের সেনাবাহিনী একটি ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালায়। তারা পদ্ধতিগতভাবে কমপক্ষে চল্লিশটি ইরোকুই গ্রাম ধ্বংস করে। এই ধ্বংস সেই শীতে ফোর্ট নায়াগ্রার বাইরে হাজার হাজার ইরোকুই শরণার্থীদের জন্য বড় দুর্দশা সৃষ্টি করে। অনেকে অনাহারে বা হিমশীতল অবস্থায় মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা কানাডার ব্রিটিশ অঞ্চল এবং নায়াগ্রা ফলস এবং বাফেলো এলাকায় পালিয়ে যায়। এভাবে ইরোকুই মিত্রসংঘের ৭০০ বছরের ইতিহাস শেষ হয়। == যুদ্ধের সমাপ্তি (১৭৭৮ - ১৭৮১) == সারাটোগায় পরাজয়ের পর ব্রিটিশদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরা বিপ্লবে তাদের সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। ১৭৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের সঙ্গে জোট গঠন করে। স্পেন এবং ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্রও আমেরিকান পক্ষে যোগ দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ ধার দেয় এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়। === ভ্যালি ফোর্জ === [[File:Washington_and_Lafayette_at_Valley_Forge.jpg|thumb|ভ্যালি ফোর্জে ওয়াশিংটন এবং লাফায়েতের একটি চিত্র।]] ব্রিটিশদের দ্বারা ফিলাডেলফিয়া দখলের পর ওয়াশিংটন তার অনুসারীদের নিয়ে ১৭৭৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভ্যালি ফোর্জে যান। এটি একটি প্রতিরক্ষাযোগ্য কাছাকাছি এলাকা ছিল। তিনি ১২,০০০ সৈন্য এবং ৪০০ বেসামরিক নাগরিকের জন্য শিবির তৈরি করেন। এটি তখন উপনিবেশের চতুর্থ বৃহত্তম বসতি ছিল।<ref>https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/valley-forge-history-and-significance.htm</ref> বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের মাধ্যমে মহান ফ্রেডরিক প্রাশীয় প্রোটেজ ব্যারন ভন স্টুবেনকে কংগ্রেসে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তাকে ভ্যালি ফোর্জে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৭৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে সেখানে পৌঁছান।<ref name="valleyforgepark">https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/vonsteuben.htm</ref><ref>https://www.mountvernon.org/library/digitalhistory/digital-encyclopedia/article/frederick-the-great/</ref> === সমুদ্রে === সমুদ্রেও যুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিনরা "প্রাইভেটিয়ার"দের কমিশন দেয়। তারা সামরিক হোক বা না হোক, সব ব্রিটিশ জাহাজ আক্রমণ ও ধ্বংস করতে পারত। সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাইভেটিয়ারদের একজন জন পল জোন্স সমুদ্রে মার্কিনদের জন্য বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জন করেন। এমনকি তিনি ব্রিটেনের উপকূলেও আক্রমণ করেন। [[Image:Yorktown80.JPG|thumb|250px|ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশ আত্মসমর্পণ গ্রহণ করছেন বেনজামিন লিঙ্কন, পিছনে ওয়াশিংটন।]] === যুদ্ধ দক্ষিণে === একটি প্রতারণার চেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন এর স্থপতি ব্রিটিশ মেজর জন আন্দ্রে ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ধরা পড়েন। ফোর্ট টিকনডেরোগার নায়কদের একজন বেনেডিক্ট আরনল্ডকে নিউ ইয়র্কের ফোর্ট ক্লিনটনের (বর্তমানে ওয়েস্ট পয়েন্ট) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঘুষের বিনিময়ে আরনল্ড দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা করেন। তিনি দুর্গটি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা জানার পর তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পালিয়ে যান। ব্রিটেন উত্তর থেকে মনোযোগ দক্ষিণে সরিয়ে নেয়। সেখানে আরও ভৃত্যবাদী বাস করত। তারা প্রথমে খুব সফল হয়। তারা ওয়াক্সহস, চার্লসটন এবং ক্যামডেনে মার্কিনদের পরাজিত করে। দক্ষিণে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার লর্ড কর্নওয়ালিস মার্কিনদের তাড়া করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। নাথানিয়েল গ্রিন তার সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি ভাগ ড্যানিয়েল মরগানের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেন। মরগান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অর্ধেকের কমান্ডার বানাস্ট্রে টারলেটনকে কাউপেনসে টেনে আনেন। সেখানে তারা ব্রিটিশদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্য অর্ধেক, যা এখনও কর্নওয়ালিসের নিয়ন্ত্রণে ছিল, গিলফোর্ড কোর্ট হাউসের যুদ্ধে মার্কিনদের পরাজিত করে। তবে, এটি কর্নওয়ালিসের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী বিজয় ছিল। তিনি ভার্জিনিয়ার ইয়র্কটাউনে পুনর্গঠনের জন্য পিছু হটতে বাধ্য হন। ব্রিটিশরা ইয়র্কটাউনে আছে এবং একটি ফরাসি নৌবহর আসছে শুনে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনা এবং ফরাসি সৈন্যদের নিয়ে ইয়র্কটাউনে যান। তারা ব্রিটিশদের ঘিরে ফেলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ শহরটি অবরোধের মুখে পড়ে। নিউ ইয়র্কে থাকা ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ হেনরি ক্লিনটন কর্নওয়ালিসকে আশ্বাস দেন যে তিনি শীঘ্রই মুক্তি পাবেন। তবে ফরাসি নৌবহর ব্রিটিশ ত্রাণবাহী বাহিনীকে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা আরও কয়েকদিন ধরে প্রতিরোধ করে। কিন্তু মিত্র বাহিনী ইয়র্কটাউনের কাছাকাছি চলে আসে। তাদের কামান ব্রিটিশ প্রতিরক্ষার অনেক কিছু ধ্বংস করে। ১৭৮১ সালের ১৯ অক্টোবরে কর্নওয়ালিস ৭,০০০-এরও বেশি লোক বিশিষ্ট তার পুরো সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেন। বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনে ব্রিটিশরা এই পরাজয়ে বিধ্বস্ত হয়। সংসদ "উপনিবেশগুলোতে" সমস্ত আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য ভোট দেয়। ওয়াশিংটন তার সেনাবাহিনীকে নিউ ইয়র্কের নিউবার্গে নিয়ে যান। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীতে একটি বিদ্রোহ থামান। ১৭৮৩ সালে যুদ্ধের সমাপ্তিতে বড় সংখ্যক ভৃত্যবাদী এবং তাদের পরিবার ইংল্যান্ডে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানাডা এবং অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশে স্থানান্তরিত হয়। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হারানো সম্পত্তি এবং জমির জন্য দাবি জমা দেয়। অনেক দাবি ইংরেজ সরকার ক্ষতির প্রমাণের অভাবে বা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে গ্রহণ করেনি। সম্পত্তি এবং জমি মার্কিন সম্প্রদায় দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়। তারপর সর্বোচ্চ দরদাতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। ১৭৮২ সালে আইসল্যান্ডের একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের জলবায়ুগত প্রভাবের কারণে ভৃত্যবাদীরা কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে ঠান্ডা শীতের একটির সম্মুখীন হয়। এটি ১৭৮৩-১৭৮৪ সালে কম ফসলের কারণ হয়। অনাহার, রোগ এবং কষ্ট ছিল প্রচুর। অনেকে তাদের স্বল্প উৎপাদনে টিকে থাকার পরিবর্তে প্রতিশোধের হুমকি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। == প্যারিসের চুক্তি (১৭৮৩) == ইয়র্কটাউনের পর ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমনের আশা হারায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং স্পেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। '''প্যারিসের চুক্তি''' ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর সীমানা উত্তরে কানাডার সীমান্ত থেকে পশ্চিমে মিসিসিপি নদী এবং দক্ষিণে ফ্লোরিডার উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটেনকে ফ্লোরিডা স্পেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারা কানাডা ধরে রাখে। কংগ্রেসকে বলা হয় রাজ্যগুলোকে ভৃত্যবাদীদের হারানো বা চুরি হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দিতে। (তবে, অনেক ভৃত্যবাদী বিপ্লবের সময় পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করতে ফিরে আসেনি।) {{chapnav|সংবিধানের পথে|প্রারম্ভিক বছরে সংবিধান}} == বিপ্লব ও ধর্ম == === বিপ্লবে ক্যাথলিক === গ্রেট ব্রিটেনে ক্যাথলিক ধর্মের জটিল পরিস্থিতি তার উপনিবেশগুলোতে ফলাফল তৈরি করেছিল। আমেরিকান বিপ্লবের সময়, মূল ১৩টি উপনিবেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৬% ছিল ক্যাথলিক। ক্যাথলিকদের ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে দেখা হতো। আইরিশ ক্যাথলিকরা, যারা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, দ্বিগুণভাবে অভিশপ্ত ছিল। আয়ারল্যান্ডে তারা ব্রিটিশ আধিপত্যের শিকার ছিল। আমেরিকায় ক্যাথলিকদের কিছু উপনিবেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল। যদিও তাদের বিশ্বাসের প্রধান রোমে বাস করতেন, তারা লন্ডন ডায়োসিসের ক্যাথলিক বিশপ জেমস ট্যালবটের অফিসিয়াল প্রতিনিধিত্বের অধীনে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে, বিশপ ট্যালবট ব্রিটিশ ক্রাউনের প্রতি তার বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন। (যদি তিনি অন্যথা করতেন, ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকরা সমস্যায় পড়ত। ক্যাথলিকবিরোধী মনোভাব তখনও প্রবল ছিল।) তিনি কোনো ঔপনিবেশিক পুরোহিতকে কমিউনিয়ন পরিবেশন করতে নিষেধ করেন। এটি বিশ্বাসের চর্চাকে অসম্ভব করে তোলে। এটি ঔপনিবেশিক বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করে। কন্টিনেন্টাল আর্মির ফরাসিদের সঙ্গে জোট বাধলে বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে। যখন ফরাসি নৌবহর রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে পৌঁছায়, উপনিবেশটি ১৬৬৪ সালের আইন বাতিল করে। এটি ক্যাথলিকদের নাগরিকত্বের অনুমতি দেয়। (এটি সাংবিধানিক বিল অফ রাইটসের বিধানের পূর্বাভাস দেয়। এটি ক্যাথলিকবিরোধী আইনগুলো বাতিল করবে।) যুদ্ধের পর, পোপ একজন আমেরিকান বিশপ, জন ক্যারল, তৈরি করেন। তিনি মেরিল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারী ক্যারলদের বংশধর ছিলেন। তিনি রোমের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগকারী একটি আমেরিকান ডায়োসিস তৈরি করেন। === অ্যাঙ্গলিকানিজম থেকে এপিস্কোপালিয়ানিজম === একদিকে ঔপনিবেশিক চার্চ অফ ইংল্যান্ড ব্রিটিশ সরকারের একটি অঙ্গ এবং এর সঙ্গে সহযোগী ছিল। এর পুরোহিতরা রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিত। বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় অ্যাঙ্গলিকান চার্চকে অর্থ প্রদান করত। যদিও সেই রাজ্যগুলোতে অন্যান্য বিশ্বাসের অনুমতি ছিল, অ্যাঙ্গলিকানকে অফিসিয়াল (প্রতিষ্ঠিত) চার্চ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করত। তবুও, থমাস জেফারসন সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে তাদের পিউ ভাড়া করতেন। (জেফারসনের নিজের বিশ্বাস লো চার্চ ছিল। তিনি খ্রিস্টধর্মের অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন।) বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু যুদ্ধের পর, চার্চকে একটি নতুন ভূমিকা খুঁজে নিতে হয়। কিছু লয়ালিস্ট পুরোহিত কানাডায় চলে যান। অন্যদের নতুন সরকারের প্রতি শপথ নেওয়ার পর থাকতে দেওয়া হয়। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত চার্চ আর ছিল না। এমনকি সংবিধান তৈরির আগে, যা চার্চ এবং রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিয়ে আসে, আমেরিকানরা কোনো অতিরিক্ত ফি দিতে চায়নি। বুক অফ কমন প্রেয়ার, যা সেই চার্চের উপাসনার ফর্ম ছিল, নতুন এপিস্কোপাল চার্চের জন্য বাস্তবিকভাবে সংশোধিত হয়। এতে মানুষ রাজার পরিবর্তে “সিভিল রুলার্স” এর জন্য প্রার্থনা করত। কিন্তু অনেক চার্চ ভবন বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভার্জিনিয়া এবং অন্যান্য রাজ্যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য জায়গা ছিল। == নতুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক সরকার == [উইকিপিডিয়া থেকে কপি করা] '''কনফেডারেশনের আর্টিকলস''', আনুষ্ঠানিকভাবে '''কনফেডারেশন এবং পারপেচুয়াল ইউনিয়নের আর্টিকলস''', ছিল ১৩টি প্রতিষ্ঠাতা রাজ্যের মধ্যে একটি চুক্তি। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে সার্বভৌম রাজ্যগুলোর একটি কনফেডারেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এটি এর প্রথম সংবিধান হিসেবে কাজ করে।<ref>{{cite book| last = Jensen| first = Merrill| title = The Articles of Confederation: An Interpretation of the Social-Constitutional History of the American Revolution, 1774–1781| year = 1959| publisher = University of Wisconsin Press| isbn = 978-0-299-00204-6| pages = xi, 184 }}</ref> ১৭৭৬ সালের মাঝামাঝি কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস এটির খসড়া শুরু করে। ১৭৭৭ সালের শেষে একটি অনুমোদিত সংস্করণ রাজ্যগুলোতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ১৭৮১ সালের প্রথম দিকে সমস্ত ১৩টি রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন সম্পন্ন হয়। এমনকি এখনও অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও, আর্টিকলস কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসকে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা, ইউরোপের সঙ্গে কূটনীতি পরিচালনা এবং আঞ্চলিক বিষয় এবং নেটিভ আমেরিকান সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদান করে। তবুও, আর্টিকলস দ্বারা সৃষ্ট সরকারের দুর্বলতা মূল জাতীয়তাবাদীদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। [কে?] {{wikisource|The Articles of Confederation}} == পাদটীকা == {{reflist}} == পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন == ১. এই লেখক/সুরকাররা কারা ছিলেন এবং তারা কীসের জন্য পরিচিত ছিলেন? (মেরি ওটিস ওয়ারেন, থমাস জেফারসন, থমাস পেইন, উইলিয়াম বিলিংস।) ২. লেক্সিংটন এবং কনকর্ডের যুদ্ধগুলো কীভাবে আমেরিকান যোদ্ধাদের প্রাথমিক শক্তি এবং দুর্বলতা দেখায়? ৩. এই এবং পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাধীনতার ঘোষণার একটি কপি পরীক্ষা করুন। এর বাগ্মিতা (শব্দের পছন্দ) কীভাবে আমেরিকান বিদ্রোহের উদ্বেগগুলো সমাধান করে? এটি কীভাবে একটি বিষয় তৈরি করতে প্রকৃত ঘটনা থেকে বিচ্যুত হয়? {{BookCat}} {{status|100%}} {{BookCat}} pqa74x10ej0fekvxei89dxsh13lovlu 85472 85471 2025-06-30T17:46:33Z Mehedi Abedin 7113 85472 wikitext text/x-wiki == পটভূমি == প্রথম নজরে ব্রিটিশ বাহিনীর সব সুবিধা ছিল বলে মনে হতে পারে। যুদ্ধের শুরুতে তাদের কাছে কামান এবং গোলাবারুদের মজুত ছিল। উপনিবেশবাসীদের কাছে ছিল স্থানীয় কারখানায় তৈরি একক-শট রাইফেল। এই বন্দুকগুলো লোড করতে সময় লাগত এবং সহজেই ভুল গুলি চালাতে পারত বা বিস্ফোরিত হতে পারত। ১৭৭৫ সালে ওয়াশিংটন যখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে প্রতি সৈন্যের জন্য মাত্র নয় রাউন্ড গোলাবারুদের জন্য যথেষ্ট বারুদ ছিল।<ref>McCullough, David. ''1776.'' New York: Simon and Schuster, 2005. p. 28</ref> ব্রিটিশদের একটি বড় পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল। এটি প্রাচীন রোমের মতো প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের খাদ্য, পোশাক এবং অস্ত্রের সরবরাহ ভালো ছিল। কিন্তু মার্কিনদের প্রশিক্ষণের অভাবের মানে ছিল যে তারা ইউরোপীয়দের মতো সমবেত হত না। তারা বরং স্নাইপারদের উপর নির্ভর করত। এরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি ছিল। তারা গুলি ছুঁড়ত এবং তারপর আবার লোড করত যখন তাদের প্রতিবেশীরা গুলি চালাত। তারা এটি ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের সময় শিখেছিল। স্নাইপাররা মার্কিনদের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। == যুদ্ধের শুরু (১৭৭৫ - ১৭৭৮) == === লেক্সিংটন এবং কনকর্ড === [[Image:Battle_of_Lexington.jpeg|thumb|300px|right|লেক্সিংটনে সংঘর্ষ।]] ব্রিটিশ সরকার জেনারেল থমাস গেজকে ম্যাসাচুসেটসে অসহনীয় আইন কার্যকর করতে এবং অধিকার সীমিত করতে নির্দেশ দেয়।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=124</ref> গেজ কনকর্ডে অবস্থিত উপনিবেশের অস্ত্রের মজুত জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিলে গেজের সৈন্যরা কনকর্ডের দিকে যাত্রা করে। পথে লেক্সিংটন শহরে পল রিভিয়ার এবং অন্যদের মাধ্যমে আগাম সতর্ক করা মার্কিনরা সৈন্যদের থামানোর চেষ্টা করে। কোন পক্ষ প্রথম গুলি চালিয়েছিল তা কেউ জানে না। কিন্তু এটি লেক্সিংটন গ্রিনে ব্রিটিশ এবং মিনিটম্যানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে। খোলা মাঠে ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যদের অপ্রতিরোধ্য সংখ্যার মুখোমুখি হয়ে মিনিটম্যানরা দ্রুত পরাজিত হয়। তবুও গ্রামাঞ্চলে সতর্ক সংকেত ছড়িয়ে পড়ে। উপনিবেশের মিলিশিয়ারা ছুটে আসে। তারা ব্রিটিশদের উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে যখন তারা কনকর্ডের দিকে যায়। কনকর্ডে উপনিবেশবাসীরা সৈন্য জড়ো করে। তারা সেখানে ব্রিটিশদের সঙ্গে শক্তির সাথে যুদ্ধ করে। তারা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। তারপর তারা অস্ত্রাগারের জিনিসপত্র দখল করে। ব্রিটিশরা বোস্টনে ফিরে যায়। তারা সব দিক থেকে অবিরাম এবং তীব্র গুলির মুখে পড়ে।<ref>http://origins.osu.edu/milestones/april-2015-shot-heard-round-world-april-19-1775-and-american-revolutionary-war</ref> বোস্টনের উপকণ্ঠে কামানের সমর্থন সহ একটি শক্তিশালী কলাম না থাকলে ব্রিটিশদের প্রত্যাহার সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে পরিণত হতো। পরের দিন ব্রিটিশরা জেগে উঠে দেখে বোস্টন ২০,০০০ সশস্ত্র উপনিবেশবাসী দ্বারা ঘেরা। তারা শহরটির অবস্থিত উপদ্বীপে প্রসারিত চারপাশের জমি দখল করে। === বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ === [[Image:Bunker_hill.jpg|thumb|বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ।]] {{quote|text=তাদের চোখের সাদা অংশ না দেখা পর্যন্ত গুলি করো না।|sign=কর্নেল উইলিয়াম প্রেসকট |source=যুদ্ধের আগে নির্দেশ<ref>https://www.wbur.org/radioboston/2010/06/17/bunker-hill-stories</ref>}} যুদ্ধের কার্যক্রম একটি ''যুদ্ধ'' থেকে একটি ''অবরোধ''-এ পরিণত হয়। এখানে একটি সেনাবাহিনী অন্যটিকে একটি শহর বা নগরীতে আটকে রাখে। (যদিও ঐতিহ্যগতভাবে, ব্রিটিশরা অবরুদ্ধ ছিল না। কারণ রাজকীয় নৌবাহিনী বন্দর নিয়ন্ত্রণ করত এবং জাহাজের মাধ্যমে সরবরাহ আসত।) ম্যাসাচুসেটস মিলিশিয়ার প্রধান জেনারেল আর্টেমাস ওয়ার্ড অবরোধের প্রাথমিক তদারকি করেন। তিনি ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি তার বাহিনীকে চার্লসটাউন নেক, রক্সবারি এবং ডরচেস্টার হাইটসে অবস্থান করান। ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ বিদ্রোহী জেনারেল থমাস গেজের অধীনে প্রায় ৪,০০০ ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যের মুখোমুখি হয়। বোস্টন এবং এর খুব কম অংশ ব্রিটিশ সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জেনারেল গেজ ১৭ জুন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি ব্রিডস হিল এবং বাঙ্কার হিলে উপনিবেশবাসীদের উপর আক্রমণ করেন। যদিও ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের তুলনায় প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তারা অবশেষে আমেরিকান বাহিনীকে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অনেক উপনিবেশী সৈন্যের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর শীঘ্রই বোস্টনের আশেপাশের এলাকা ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। তবে যে ক্ষয়ক্ষতি তারা ভোগ করে, তাতে তারা শহরের অবরোধ ভাঙতে পারেনি। উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রাথমিক পরাজয় সত্ত্বেও এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে তারা ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা রাখে। সেই সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে বিশ্বের সেরা বলে মনে করা হতো। === শান্তির শেষ সুযোগ === দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৫ সালের ৫ জুলাইয়ে শান্তির জন্য একটি পিটিশন গ্রহণ করে। এটির নাম '''অলিভ ব্রাঞ্চ পিটিশন'''। কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করে। এটি লন্ডনে পৌঁছায় যখন বাঙ্কার হিলের যুদ্ধের খবর আসে। রাজা পিটিশন পড়তে বা এর দূতদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=3881</ref> সংসদ প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করে। এটি উপনিবেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে।<ref>https://sites.austincc.edu/caddis/colonial-rebellion/</ref> === বোস্টনের জন্য যুদ্ধ === ব্রিটিশদের জাহাজে প্রবেশাধিকার থাকলেও শহর ও সেনাবাহিনী খাদ্যের অভাবে ছিল। লবণাক্ত শুয়োরের মাংসই ছিল প্রধান খাদ্য। দ্রব্যের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। মার্কিন বাহিনী শহরে কী ঘটছে তা কিছুটা জানত। কিন্তু জেনারেল গেজের কাছে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপের কোনো কার্যকর তথ্য ছিল না। ১৭৭৫ সালের ২৫ মে ৪,৫০০ সৈন্য এবং তিনজন নতুন জেনারেল বোস্টন হারবারে পৌঁছান। নতুন নেতারা ছিলেন মেজর জেনারেল উইলিয়াম হাও, ব্রিগেডিয়ার জন বারগয়েন এবং হেনরি ক্লিনটন। গেজ শহর থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৭৭৫ সালের ৩ জুলাইয়ে জর্জ ওয়াশিংটন নতুন মহাদেশীয় সেনার দায়িত্ব নিতে আসেন। মেরিল্যান্ডের মতো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে বাহিনী ও সরবরাহ আসে। ডরচেস্টার নেকে পরিখা তৈরি করা হয়। এটি বোস্টনের দিকে প্রসারিত হয়। ওয়াশিংটন বাঙ্কার হিল এবং ব্রিডস হিল পুনরায় দখল করেন। এতে কোনো বাধা আসেনি। তবে এই কার্যক্রম ব্রিটিশদের দখলের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। [[Image:Henry_Knox.PNG|thumb|upright|হেনরি নক্স মহাদেশীয় সেনাদের ব্রিটিশদের পরাজিত করতে ব্যবহৃত কামান সরবরাহে সহায়তা করেন।]] ১৭৭৫-১৭৭৬ সালের শীতে হেনরি নক্স এবং তার প্রকৌশলীরা জর্জ ওয়াশিংটনের নির্দেশে স্লেজ ব্যবহার করে ফোর্ট টিকনডেরোগা থেকে ৬০ টন ভারী কামান সংগ্রহ করেন। নক্স এই স্লেজ ব্যবহারের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ১৮ দিনে কামানগুলো সেখানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু হিমায়িত কানেকটিকাট নদী পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগে। ১৭৭৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে তারা কেমব্রিজে ফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিংটন অবিশ্বাস্য প্রতারণা ও গতিশীলতার কৌশলে রাতারাতি কামান এবং কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে ডরচেস্টার হাইটস দখল করেন। বাহিনী বোস্টনের উপর নজর রাখে। জেনারেল জন টমাস এলাকাটি সুরক্ষিত করেন। ব্রিটিশ নৌবহর একটি দায় হয়ে পড়ে। এটি অগভীর বন্দরে নোঙর করা ছিল। এর চালনার সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি ডরচেস্টার হাইটসের মার্কিন কামানের মুখোমুখি হয়। জেনারেল হাও যখন কামানগুলো দেখেন, তিনি বুঝতে পারেন শহর ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে শহর শান্তিপূর্ণভাবে খালি করার অনুমতি চান। বিনিময়ে, তারা শহর পুড়িয়ে দেবে না। ওয়াশিংটন সম্মত হন। তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। তার কাছে কামান ছিল, কিন্তু গানপাউডার ছিল না। পুরো পরিকল্পনাটি ছিল একটি দুর্দান্ত প্রতারণা। ১৭৭৬ সালের ১৭ মার্চ ব্রিটিশরা নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে অবরোধ শেষ হয়। মিলিশিয়ারা বাড়ি ফিরে যায়। এপ্রিলে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনার বেশিরভাগ বাহিনী নিয়ে নিউ ইয়র্ক নগরী সুরক্ষিত করতে যান। === ইথান অ্যালেন ও ফোর্ট টিকনডেরোগা === [[Image:Fort_Ticonderoga_1775.jpg|thumb|left|300px|ইথান অ্যালেন টিকনডেরোগা দুর্গ দখল করছেন।]] ব্রিটিশরা ফোর্ট টিকনডেরোগাকে তুলনামূলকভাবে গুরুত্বহীন একটি চৌকি মনে করত। তখন পর্যন্ত সংঘর্ষ মূলত ম্যাসাচুসেটসে ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সৈনিক ইথান অ্যালেনের নজর ছিল এই দুর্গের উপর। অ্যালেন ভার্মন্টে একটি আঞ্চলিক মিলিশিয়া গড়ে তুলেছিলেন। নাম ছিল গ্রিন মাউন্টেন বয়েজ। এটি একটি কার্যকর যুদ্ধশক্তি হয়ে ওঠে। ভার্মন্ট নিউ ইয়র্ক উপনিবেশের দাবিদার ছিল। কিন্তু অ্যালেন আরও স্বাধীনতা চাইতেন। ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে কানেকটিকাট মিলিশিয়ার কমান্ডার বেনেডিক্ট আরনল্ড অ্যালেনের কাছে আসেন। আরনল্ড ঘোষণা করেন যে তিনি ফোর্ট টিকনডেরোগার কামান দখলের জন্য নিযুক্ত হয়েছেন। দুজনের মধ্যে তীব্র আলোচনার পর তারা সম্মত হন যে দুই মিলিশিয়া একসঙ্গে দুর্গ আক্রমণ করবে। এটি ভালো হয়েছিল। কারণ দুই বাহিনী একসঙ্গে ছোট ছিল। এটি ব্রিগেডের শক্তির অনেক কম ছিল। ১০ মে মার্কিন সম্মিলিত বাহিনী দুর্গ দখল করে। তারা অস্ত্র সহ কামান দখল করে। এগুলো গরু দিয়ে টেনে বোস্টনে নিয়ে যাওয়া হয়। == কারণকে শক্তিশালী করা == সেই সময়ের গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিপ্লব সম্মানিত মানুষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধারণাকে প্রচার করে। উত্তর ও দক্ষিণের সংবাদপত্র উত্তেজক গল্প এবং উৎসাহব্যঞ্জক খোদাই প্রকাশ করে। থিয়েটার নাটকীয় প্রতিবাদে অবদান রাখে। এর মধ্যে ছিল মেরি ওটিস ওয়ারেনের সৃষ্টিকর্ম। গান বাজানো এবং গাওয়া হতো ক্লান্ত মনোবল উত্সাহিত করতে। === থমাস পেইনের ১৭৭৬ === ১৭৭৬ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজ থমাস পেইন ''কমন সেন্স'' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই রাজতন্ত্রবিরোধী প্রকাশনা মার্কিন স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে। এটি বাইবেল ও প্রজাতান্ত্রিক গুণাবলীর উদাহরণ ব্যবহার করে। এটি যুক্তি দেয় যে কোনো মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য রাজারা কখনোই ভালো নয়। ১৭৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ''দ্য আমেরিকান ক্রাইসিস'' নামে পুস্তিকার সিরিজ প্রকাশ শুরু করেন। এটি সৈন্যদের বিপ্লবের কারণে জড়ো হতে আহ্বান জানায়। প্রথম পুস্তিকাটি শুরু হয় উদ্দীপক কথায়: "এই সময়গুলো মানুষের আত্মাকে পরীক্ষা করে"। === স্বাধীনতার ঘোষণা === [[Image:Flag at Independence Hall.jpg|thumb|upright|ইন্ডিপেনডেন্স হলে প্রথম পতাকা উত্তোলন। ক্লাইড ও. ডিল্যান্ডের চিত্রের প্রতিলিপি।]] যখন সামরিক শত্রুতা বাড়তে থাকে, দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা জর্জ ওয়াশিংটনকে মহাদেশীয় সেনার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওয়াশিংটন যুদ্ধের সময় এই পদের জন্য তার বেতন ত্যাগ করেন। (তিনি উপনিবেশের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি এই পছন্দের সামর্থ্য রাখতেন।) ১৭৭৬ সালের জুনে দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা মনে করে গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি প্রেরণা প্রয়োজন। এটি '''স্বাধীনতার ঘোষণা'''র খসড়া তৈরি করতে পাঁচজনের একটি কমিটি গঠন করে। তারা ছিলেন জন অ্যাডামস, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, রবার্ট লিভিংস্টন, রজার শেরম্যান ও থমাস জেফারসন। জেফারসন এই দলিলের প্রধান লেখক হন। যদিও ব্রিটিশ রাজা আর তার অধিরাজ্যের নীতির জন্য মূলত দায়ী ছিলেন না, স্বাধীনতার ঘোষণা তাকে স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করে। এটি বিদ্রোহের অধিকারকে এমন কথায় ন্যায্যতা দেয় যা ইউরোপীয় আলোকিত যুগ প্রশংসা করত: "আমরা এই সত্যগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করি, যে সকল মানুষ সমানভাবে সৃষ্ট।" মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ে এই দলিলে স্বাক্ষর করে। তবে এই সময়ে স্বাক্ষরগুলো দেখায় যে তারা স্বাধীনতা চায়। তারা একা এটি অর্জন করতে পারেনি। === আর্মি ব্যান্ড === একটি সুশৃঙ্খল সৈন্যদলের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তার সামরিক ব্যান্ড। ব্রিটিশ এবং হেসীয় সৈন্যরা ড্রামের তালে ড্রিল করত। এটি মাসকেটের গোলাগুলির শব্দের উপরে মার্চের ছন্দ বহন করত। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগের একটি উপায় প্রদান করত। "১৭৭৮ সাল নাগাদ সৈন্যরা সাধারণ সময়ে প্রতি মিনিটে ৭৫টি ২৪ ইঞ্চি পদক্ষেপে মার্চ করত। দ্রুত সময়ে মার্চ করার সময় এটি প্রায় দ্বিগুণ (প্রতি মিনিটে ১২০ পদক্ষেপ) হতো।"<ref>Anon. "Middle-brook Order, June 4, 1777: What It Really Says about the Quality of Revolutionary War Field Music." Paper read at School of the Musician, Brigade of the American Revolution, April 4, 1989. Revised February 12, 2011. Copyright 1989, 2011 HistoryOfTheAncientsDotOrg. http://historyoftheancients.wordpress.com/2012/09/06/1195/</ref> ফাইফ (একটি তীক্ষ্ণ বাঁশি) এবং ড্রামের সঙ্গীত সৈনিকদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করত। যদি বিদ্রোহীরা ভালো সরবরাহ না পেত, তবে তাদের অন্তত উচ্চ মনোবল থাকত। ''মিডল-ব্রুক অর্ডার''-এর মাধ্যমে জর্জ ওয়াশিংটন নির্দেশ দেন যে প্রত্যেক অফিসারকে তার সৈন্যদের জন্য সামরিক সঙ্গীতের ব্যবস্থা করতে হবে। সীমিত সংখ্যক যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও।<ref>Anon, "Middle-brook Order.</ref> ব্যান্ডগুলো দিনের শুরু ও শেষ ঘোষণা করতে, যুদ্ধে সৈন্যদের নির্দেশ দিতে এবং মনোবল উত্সাহিত করতে ব্যবহৃত হতো। === বিপ্লবে জনপ্রিয় সঙ্গীত === বিপ্লবের দুটি প্রধান গানের একটি ছিল স্তোত্র ''চেস্টার''। এটি ১৭৭০ সালে "দ্য নিউ ইংল্যান্ড সলম সিঙ্গার' এ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৭৭৮ সালে এটি সংশোধিত হয়। এর লেখক ও সুরকার উইলিয়াম বিলিংস বাইবেলের (''লেট টাইরান্টস শেক দেয়ার আয়রন রড'') এবং সমসাময়িক (''হাও এবং বারগয়েন এবং ক্লিনটন টু,/ উইথ প্রেসকট এবং কর্নওয়ালিস জয়নড'') দুটির সমন্বয় তৈরি করেন। আরেকটি ছিল গান ''ইয়াঙ্কি ডুডল''। এটি সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের একটি সুর থেকে অভিযোজিত। এটি মূলত ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের প্রাদেশিকবাদী আচরণ নিয়ে তামাশা করতে ব্যবহার করত। কিন্তু এটি মার্কিন বিদ্রোহীদের একটি থিমে পরিণত হয়। == কানাডা == ১৭৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল রিচার্ড মন্টগোমেরির নেতৃত্বে উপনিবেশবাসীরা কানাডা আক্রমণ করে। প্রথমে আক্রমণ সফল হয়। মন্টগোমেরি ফোর্ট সেন্ট জিন ও মন্ট্রিল শহর দখল করেন। ৩০ ডিসেম্বর তিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কুইবেক শহরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি বিপর্যয়কর হয়। মন্টগোমেরি যুদ্ধে নিহত হন। এটি কানাডার শেষ বড় পদক্ষেপ ছিল। যদিও বেনেডিক্ট আরনল্ড এবং অন্যান্য জেনারেলরা কানাডার উপকূলে আক্রমণ করেন বা সীমান্তে অভিযান চালান। == যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট == যুদ্ধের প্রথম বছরগুলোতে অসংখ্য পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও উপনিবেশবাসীরা বেশ কয়েকটি বড় বিজয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। === নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সি === ১৭৭৬ সালের জুলাইয়ে জেনারেল উইলিয়াম হাও এবং ৩০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে পৌঁছান। এই বড় সেনাবাহিনী লং আইল্যান্ডের যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের মার্কিন বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং পরাজিত করে। প্রায় পুরো সেনাবাহিনী বন্দী হওয়ার পর ওয়াশিংটন নিউ ইয়র্ক থেকে দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যাহার করেন। অবশেষে কন্টিনেন্টাল আর্মিকে পেনসিলভানিয়ায় শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়। হাও ওয়াশিংটনের বাহিনীকে তাড়া করে যুদ্ধ শেষ করতে পারতেন। কিন্তু হাও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। তিনি বাড়ি থেকে এত দূরে অনেক সৈন্য হারানোর ভয় করতেন। ব্রিটেন ট্রেন্টনের ব্রিটিশ দুর্গ পাহারা দেওয়ার জন্য জার্মান ভাড়াটে সৈন্য (হেসীয়) নিয়োগ করে। হাও এই প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেন। তিনি বসন্ত পর্যন্ত মহাদেশীয় সেনার উপর আবার আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটনও পরিস্থিতির সুযোগ নেন। তবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি মনে করতেন, বড়দিনের রাতে হেসীয়রা ভারী ভোজ ও মদ্যপানের পর সবচেয়ে দুর্বল থাকবে। ১৭৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাতে ওয়াশিংটন তার সৈন্যদের ৯ মাইল দূরে এবং ডেলাওয়্যার নদী পার করে হেসীয়দের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য নিয়ে যান। নদী পার করা কঠিন ছিল। পার হওয়ার শুরুতে শিলাবৃষ্টি ও তুষারঝড় শুরু হয়। বাতাস প্রবল ছিল। নদীতে বরফের টুকরো ভাসছিল। পার হতে তিন ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। তবুও ওয়াশিংটন আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটন যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ভাড়াটে সৈন্যরা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল। তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর খুব কম সময় ছিল। মাত্র এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর সকালে মহাদেশীয় আর্মি ট্রেন্টনের যুদ্ধে জয়ী হয়। মার্কিনদের মাত্র ৪ জন আহত হয় এবং ০ জন নিহত হয়। বিপরীতে, ২৫ জন হেসীয় নিহত, ৯০ জন আহত এবং ৯২০ জন বন্দী হয়। এই বিজয় সৈন্যদের মনোবল বাড়ায়। এটি পুনরায় তালিকাভুক্তির দিকে নিয়ে যায়। কিছু ইতিহাসবিদ এমনকি মনে করেন ট্রেন্টন বিপ্লবকে বাঁচিয়েছিল। ২ জানুয়ারিতে ব্রিটিশরা ট্রেন্টন পুনরুদ্ধার করতে আসে। তারা বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে এটি করে। ওয়াশিংটন আবারও একটি চতুর প্রত্যাহারের নেতৃত্ব দেন। তিনি প্রিন্সটনে অগ্রসর হন। প্রিন্সটনের যুদ্ধে মহাদেশীয় সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পিছনের রক্ষীদের আক্রমণ করে। তারা ব্রিটিশদের নিউ জার্সি থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যুদ্ধের সময়, নতুন বিশ্ব [[w:1775–1782 North American smallpox epidemic|1775–1782 উত্তর আমেরিকার গুটিবসন্ত মহামারী]] দ্বারা বিধ্বস্ত হচ্ছিল। যৌবনে এই রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া<ref>https://washingtonpapers.org/strongly-attacked-george-washington-encounters-smallpox/</ref> এবং বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের কাছ থেকে রোগটি সেনাবাহিনীর উপর যে প্রভাব ফেলতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করা হওয়ায়<ref name="locsmallpox">https://www.loc.gov/rr/scitech/GW&smallpoxinoculation.html</ref> জর্জ ওয়াশিংটন লিখেছিলেন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের চেয়ে এই রোগের কারণে মহাদেশীয় সেনাদের অক্ষম হওয়ার বিষয়ে বেশি ভয় করতেন।<ref name="locsmallpox"/> ৫ ফেব্রুয়ারিতে জর্জ ওয়াশিংটন গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবের কারণে বড় ধরনের ব্যাঘাতের পর সৈন্যদের প্রথম গণ টিকাদানের নির্দেশ দেন।<ref name="locsmallpox"/> এই নীতি সৈন্যদের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এটি গণ সংক্রমণ ছড়াতে বাধা দেয়।<ref name="locsmallpox"/> === সারাটোগার যুদ্ধ === [[Image:Surrender_of_General_Burgoyne.jpg|thumb|left|250px|বারগয়েন মহাদেশীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।]] ১৭৭৭ সালের গ্রীষ্মে ব্রিটিশ জেনারেল জন বারগয়েন এবং জেনারেল হাও ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীকে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে পরাজিত করার পরিকল্পনা করেন। হাও উত্তরে অগ্রসর হন। তিনি ব্র্যান্ডিওয়াইন এবং জার্মানটাউনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। অবশেষে তিনি ফিলাডেলফিয়া দখল করেন। কিন্তু বারগয়েন এত ভাগ্যবান ছিলেন না। মহাদেশীয় সেনাদের তৈরি প্রাকৃতিক ফাঁদে বিলম্বিত হয়ে তার সৈন্যরা কানাডা থেকে অ্যালবানির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে তার বাহিনী সারাটোগায় পৌঁছায়। সেখানে একটি বিশাল মার্কিন সেনাবাহিনী সৈন্যদের আক্রমণ করে। অক্টোবরে জেনারেল বারগয়েন তার সমস্ত বাহিনী মার্কিনদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জেনারেল হাও পেনসিলভানিয়ায় তার বিজয় সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন। সারাটোগার যুদ্ধ যুদ্ধের প্রধান উত্থানের ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত হয়। এটি ফ্রান্সকে বোঝায় যে আমেরিকাকে গ্রেট ব্রিটেনকে উৎখাত করতে হবে। ফরাসি সাহায্য তখন উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রবর্তিত হয়। এই যুদ্ধটি ব্রিটিশদের উত্তরে শেষ অগ্রগতি ছিল। ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মে নিউ জার্সির মনমাউথের যুদ্ধের পর সমস্ত যুদ্ধ দক্ষিণে সংঘটিত হয়। === ইরোকুইয়ের পরাজয় === ইরোকুই কনফেডারেসি তার শীর্ষে ইউরোপীয় শক্তির সমকক্ষ ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের পর থেকে এটি হ্রাস পাচ্ছিল। মিত্রসংঘের উপজাতিগুলো বিপ্লবে কাকে সমর্থন করবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। ওনেইডা এবং তুসকারোরা মার্কিনদের সমর্থন করে। মোহক, ওনোনডাগা, কায়ুগা এবং সেনেকা ব্রিটিশদের সমর্থন করে। ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত মিত্রসংঘ একত্র থাকতে সক্ষম হয়। সারাটোগার যুদ্ধের পর, ব্রিটিশদের সমর্থনকারী চারটি উপজাতি নিউ ইয়র্ক এবং পেনসিলভানিয়া জুড়ে মার্কিন বসতিগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। একটি পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ অনুসৃত হয়। ইরোকুই মার্কিন দুর্গ এবং শহরগুলোতে আক্রমণ করত। তারপর মার্কিনরা ইরোকুই গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিত। ১৭৭৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন জেনারেল সুলিভানকে ইরোকুই জাতিকে ধ্বংস করতে পাঠান। নিউটাউনের যুদ্ধে ইরোকুইদের পরাজিত করার পর সুলিভানের সেনাবাহিনী একটি ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালায়। তারা পদ্ধতিগতভাবে কমপক্ষে চল্লিশটি ইরোকুই গ্রাম ধ্বংস করে। এই ধ্বংস সেই শীতে ফোর্ট নায়াগ্রার বাইরে হাজার হাজার ইরোকুই শরণার্থীদের জন্য বড় দুর্দশা সৃষ্টি করে। অনেকে অনাহারে বা হিমশীতল অবস্থায় মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা কানাডার ব্রিটিশ অঞ্চল এবং নায়াগ্রা ফলস এবং বাফেলো এলাকায় পালিয়ে যায়। এভাবে ইরোকুই মিত্রসংঘের ৭০০ বছরের ইতিহাস শেষ হয়। == যুদ্ধের সমাপ্তি (১৭৭৮ - ১৭৮১) == সারাটোগায় পরাজয়ের পর ব্রিটিশদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরা বিপ্লবে তাদের সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। ১৭৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের সঙ্গে জোট গঠন করে। স্পেন এবং ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্রও আমেরিকান পক্ষে যোগ দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ ধার দেয় এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়। === ভ্যালি ফোর্জ === [[File:Washington_and_Lafayette_at_Valley_Forge.jpg|thumb|ভ্যালি ফোর্জে ওয়াশিংটন এবং লাফায়েতের একটি চিত্র।]] ব্রিটিশদের দ্বারা ফিলাডেলফিয়া দখলের পর ওয়াশিংটন তার অনুসারীদের নিয়ে ১৭৭৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভ্যালি ফোর্জে যান। এটি একটি প্রতিরক্ষাযোগ্য কাছাকাছি এলাকা ছিল। তিনি ১২,০০০ সৈন্য এবং ৪০০ বেসামরিক নাগরিকের জন্য শিবির তৈরি করেন। এটি তখন উপনিবেশের চতুর্থ বৃহত্তম বসতি ছিল।<ref>https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/valley-forge-history-and-significance.htm</ref> বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের মাধ্যমে মহান ফ্রেডরিক প্রাশীয় প্রোটেজ ব্যারন ভন স্টুবেনকে কংগ্রেসে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তাকে ভ্যালি ফোর্জে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৭৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে সেখানে পৌঁছান।<ref name="valleyforgepark">https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/vonsteuben.htm</ref><ref>https://www.mountvernon.org/library/digitalhistory/digital-encyclopedia/article/frederick-the-great/</ref> === সমুদ্রে === সমুদ্রেও যুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিনরা "প্রাইভেটিয়ার"দের কমিশন দেয়। তারা সামরিক হোক বা না হোক, সব ব্রিটিশ জাহাজ আক্রমণ ও ধ্বংস করতে পারত। সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাইভেটিয়ারদের একজন জন পল জোন্স সমুদ্রে মার্কিনদের জন্য বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জন করেন। এমনকি তিনি ব্রিটেনের উপকূলেও আক্রমণ করেন। [[Image:Yorktown80.JPG|thumb|250px|ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশ আত্মসমর্পণ গ্রহণ করছেন বেনজামিন লিঙ্কন, পিছনে ওয়াশিংটন।]] === যুদ্ধ দক্ষিণে === একটি প্রতারণার চেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন এর স্থপতি ব্রিটিশ মেজর জন আন্দ্রে ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ধরা পড়েন। ফোর্ট টিকনডেরোগার নায়কদের একজন বেনেডিক্ট আরনল্ডকে নিউ ইয়র্কের ফোর্ট ক্লিনটনের (বর্তমানে ওয়েস্ট পয়েন্ট) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঘুষের বিনিময়ে আরনল্ড দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা করেন। তিনি দুর্গটি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা জানার পর তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পালিয়ে যান। ব্রিটেন উত্তর থেকে মনোযোগ দক্ষিণে সরিয়ে নেয়। সেখানে আরও ভৃত্যবাদী বাস করত। তারা প্রথমে খুব সফল হয়। তারা ওয়াক্সহস, চার্লসটন এবং ক্যামডেনে মার্কিনদের পরাজিত করে। দক্ষিণে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার লর্ড কর্নওয়ালিস মার্কিনদের তাড়া করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। নাথানিয়েল গ্রিন তার সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি ভাগ ড্যানিয়েল মরগানের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেন। মরগান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অর্ধেকের কমান্ডার বানাস্ট্রে টারলেটনকে কাউপেনসে টেনে আনেন। সেখানে তারা ব্রিটিশদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্য অর্ধেক, যা এখনও কর্নওয়ালিসের নিয়ন্ত্রণে ছিল, গিলফোর্ড কোর্ট হাউসের যুদ্ধে মার্কিনদের পরাজিত করে। তবে, এটি কর্নওয়ালিসের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী বিজয় ছিল। তিনি ভার্জিনিয়ার ইয়র্কটাউনে পুনর্গঠনের জন্য পিছু হটতে বাধ্য হন। ব্রিটিশরা ইয়র্কটাউনে আছে এবং একটি ফরাসি নৌবহর আসছে শুনে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনা এবং ফরাসি সৈন্যদের নিয়ে ইয়র্কটাউনে যান। তারা ব্রিটিশদের ঘিরে ফেলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ শহরটি অবরোধের মুখে পড়ে। নিউ ইয়র্কে থাকা ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ হেনরি ক্লিনটন কর্নওয়ালিসকে আশ্বাস দেন যে তিনি শীঘ্রই মুক্তি পাবেন। তবে ফরাসি নৌবহর ব্রিটিশ ত্রাণবাহী বাহিনীকে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা আরও কয়েকদিন ধরে প্রতিরোধ করে। কিন্তু মিত্র বাহিনী ইয়র্কটাউনের কাছাকাছি চলে আসে। তাদের কামান ব্রিটিশ প্রতিরক্ষার অনেক কিছু ধ্বংস করে। ১৭৮১ সালের ১৯ অক্টোবরে কর্নওয়ালিস ৭,০০০-এরও বেশি লোক বিশিষ্ট তার পুরো সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেন। বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনে ব্রিটিশরা এই পরাজয়ে বিধ্বস্ত হয়। সংসদ "উপনিবেশগুলোতে" সমস্ত আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য ভোট দেয়। ওয়াশিংটন তার সেনাবাহিনীকে নিউ ইয়র্কের নিউবার্গে নিয়ে যান। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীতে একটি বিদ্রোহ থামান। ১৭৮৩ সালে যুদ্ধের সমাপ্তিতে বড় সংখ্যক ভৃত্যবাদী এবং তাদের পরিবার ইংল্যান্ডে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানাডা এবং অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশে স্থানান্তরিত হয়। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হারানো সম্পত্তি এবং জমির জন্য দাবি জমা দেয়। অনেক দাবি ইংরেজ সরকার ক্ষতির প্রমাণের অভাবে বা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে গ্রহণ করেনি। সম্পত্তি এবং জমি মার্কিন সম্প্রদায় দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়। তারপর সর্বোচ্চ দরদাতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। ১৭৮২ সালে আইসল্যান্ডের একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের জলবায়ুগত প্রভাবের কারণে ভৃত্যবাদীরা কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে ঠান্ডা শীতের একটির সম্মুখীন হয়। এটি ১৭৮৩-১৭৮৪ সালে কম ফসলের কারণ হয়। অনাহার, রোগ এবং কষ্ট ছিল প্রচুর। অনেকে তাদের স্বল্প উৎপাদনে টিকে থাকার পরিবর্তে প্রতিশোধের হুমকি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। == প্যারিসের চুক্তি (১৭৮৩) == ইয়র্কটাউনের পর ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমনের আশা হারায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং স্পেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। '''প্যারিসের চুক্তি''' ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর সীমানা উত্তরে কানাডার সীমান্ত থেকে পশ্চিমে মিসিসিপি নদী এবং দক্ষিণে ফ্লোরিডার উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটেনকে ফ্লোরিডা স্পেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারা কানাডা ধরে রাখে। কংগ্রেসকে বলা হয় রাজ্যগুলোকে ভৃত্যবাদীদের হারানো বা চুরি হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দিতে। (তবে, অনেক ভৃত্যবাদী বিপ্লবের সময় পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করতে ফিরে আসেনি।) {{chapnav|সংবিধানের পথে|প্রারম্ভিক বছরে সংবিধান}} == বিপ্লব ও ধর্ম == === বিপ্লবে ক্যাথলিক === গ্রেট ব্রিটেনে ক্যাথলিক ধর্মের জটিল পরিস্থিতি তার উপনিবেশগুলোতে ফলাফল তৈরি করেছিল। মার্কিন বিপ্লবের সময়, মূল ১৩টি উপনিবেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৬% ছিল ক্যাথলিক। ক্যাথলিকদের ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে দেখা হতো। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আইরিশ ক্যাথলিকরা দ্বিগুণ অভিশপ্ত ছিল। আয়ারল্যান্ডে তারা ব্রিটিশ আধিপত্যের শিকার ছিল। আমেরিকায় ক্যাথলিকদের কিছু উপনিবেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল। যদিও তাদের বিশ্বাসের প্রধান রোমে বাস করতেন, তারা লন্ডন ডায়োসিসের ক্যাথলিক বিশপ জেমস ট্যালবটের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের অধীনে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে বিশপ ট্যালবট ব্রিটিশ রাজশাসনের প্রতি তার বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন। (যদি তিনি অন্যথা করতেন তবে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকরা সমস্যায় পড়ত। ক্যাথলিকবিরোধী মনোভাব তখনও প্রবল ছিল।) তিনি কোনো ঔপনিবেশিক পুরোহিতকে কমিউনিয়ন পরিবেশন করতে নিষেধ করেন। এটি বিশ্বাসের চর্চাকে অসম্ভব করে তোলে। এটি ঔপনিবেশিক বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করে। মহাদেশীয় সেনারা ফরাসিদের সঙ্গে জোট বাধলে ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে। যখন ফরাসি নৌবহর রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে পৌঁছায় তখন উপনিবেশটি ১৬৬৪ সালের আইন বাতিল করে। এটি ক্যাথলিকদের নাগরিকত্বের অনুমতি দেয়। (এটি সাংবিধানিক অধিকারের বিধানের পূর্বাভাস দেয় যা এটি ক্যাথলিকবিরোধী আইনগুলো বাতিল করে।) যুদ্ধের পর পোপ একজন মার্কিন বিশপ হিসেবে জন ক্যারলকে নিযুক্ত করেন। তিনি মেরিল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারী ক্যারলদের বংশধর ছিলেন। তিনি রোমের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগকারী একটি মার্কিন ডায়োসিস তৈরি করেন। === অ্যাঙ্গলিকানবাদ থেকে এপিস্কোপালিয়ানবাদ === একদিকে ঔপনিবেশিক চার্চ অফ ইংল্যান্ড ব্রিটিশ সরকারের একটি অঙ্গ এবং এর সহযোগী ছিল। এর পুরোহিতরা রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিত। বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় অ্যাঙ্গলিকান চার্চকে অর্থ প্রদান করত। যদিও সেই রাজ্যগুলোতে অন্যান্য বিশ্বাসের অনুমতি ছিল, অ্যাঙ্গলিকানকে প্রাতিষ্ঠানিক (প্রতিষ্ঠিত) মণ্ডলী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করত। তবুও, থমাস জেফারসন সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে তাদের পিউ ভাড়া করতেন। (জেফারসনের নিজের বিশ্বাস লো চার্চ ছিল। তিনি খ্রিস্টধর্মের অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন।) বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু যুদ্ধের পর চার্চকে একটি নতুন ভূমিকা খুঁজে নিতে হয়। কিছু ভৃত্যবাদী পুরোহিত কানাডায় চলে যান। অন্যদের নতুন সরকারের প্রতি শপথ নেওয়ার পর থাকতে দেওয়া হয়। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত চার্চ আর ছিল না। এমনকি ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিয়ে আসা সংবিধান তৈরির আগে মার্কিনরা কোনো অতিরিক্ত ফি দিতে চায়নি। সেই চার্চের উপাসনার ধরন বুক অফ কমন প্রেয়ার নতুন এপিস্কোপাল চার্চের জন্য বাস্তবিকভাবে সংশোধিত হয়। এতে মানুষ রাজার পরিবর্তে "বেসামরিক শাসক"-এর জন্য প্রার্থনা করত। কিন্তু অনেক চার্চ ভবন বন্ধ হয়ে যায়। তখনো ভার্জিনিয়া ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য জায়গা ছিল। == নতুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক সরকার == [উইকিপিডিয়া থেকে কপি করা] '''কনফেডারেশনের আর্টিকলস''', আনুষ্ঠানিকভাবে '''কনফেডারেশন এবং পারপেচুয়াল ইউনিয়নের আর্টিকলস''', ছিল ১৩টি প্রতিষ্ঠাতা রাজ্যের মধ্যে একটি চুক্তি। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে সার্বভৌম রাজ্যগুলোর একটি কনফেডারেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এটি এর প্রথম সংবিধান হিসেবে কাজ করে।<ref>{{cite book| last = Jensen| first = Merrill| title = The Articles of Confederation: An Interpretation of the Social-Constitutional History of the American Revolution, 1774–1781| year = 1959| publisher = University of Wisconsin Press| isbn = 978-0-299-00204-6| pages = xi, 184 }}</ref> ১৭৭৬ সালের মাঝামাঝি কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস এটির খসড়া শুরু করে। ১৭৭৭ সালের শেষে একটি অনুমোদিত সংস্করণ রাজ্যগুলোতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ১৭৮১ সালের প্রথম দিকে সমস্ত ১৩টি রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন সম্পন্ন হয়। এমনকি এখনও অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও, আর্টিকলস কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসকে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা, ইউরোপের সঙ্গে কূটনীতি পরিচালনা এবং আঞ্চলিক বিষয় এবং নেটিভ আমেরিকান সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদান করে। তবুও, আর্টিকলস দ্বারা সৃষ্ট সরকারের দুর্বলতা মূল জাতীয়তাবাদীদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। [কে?] {{wikisource|The Articles of Confederation}} == পাদটীকা == {{reflist}} == পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন == ১. এই লেখক/সুরকাররা কারা ছিলেন এবং তারা কীসের জন্য পরিচিত ছিলেন? (মেরি ওটিস ওয়ারেন, থমাস জেফারসন, থমাস পেইন, উইলিয়াম বিলিংস।) ২. লেক্সিংটন এবং কনকর্ডের যুদ্ধগুলো কীভাবে আমেরিকান যোদ্ধাদের প্রাথমিক শক্তি এবং দুর্বলতা দেখায়? ৩. এই এবং পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাধীনতার ঘোষণার একটি কপি পরীক্ষা করুন। এর বাগ্মিতা (শব্দের পছন্দ) কীভাবে আমেরিকান বিদ্রোহের উদ্বেগগুলো সমাধান করে? এটি কীভাবে একটি বিষয় তৈরি করতে প্রকৃত ঘটনা থেকে বিচ্যুত হয়? {{BookCat}} {{status|100%}} {{BookCat}} gx07sgx3dg0l23psesch7cq177ask9a 85473 85472 2025-06-30T17:50:51Z Mehedi Abedin 7113 85473 wikitext text/x-wiki == পটভূমি == প্রথম নজরে ব্রিটিশ বাহিনীর সব সুবিধা ছিল বলে মনে হতে পারে। যুদ্ধের শুরুতে তাদের কাছে কামান এবং গোলাবারুদের মজুত ছিল। উপনিবেশবাসীদের কাছে ছিল স্থানীয় কারখানায় তৈরি একক-শট রাইফেল। এই বন্দুকগুলো লোড করতে সময় লাগত এবং সহজেই ভুল গুলি চালাতে পারত বা বিস্ফোরিত হতে পারত। ১৭৭৫ সালে ওয়াশিংটন যখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে প্রতি সৈন্যের জন্য মাত্র নয় রাউন্ড গোলাবারুদের জন্য যথেষ্ট বারুদ ছিল।<ref>McCullough, David. ''1776.'' New York: Simon and Schuster, 2005. p. 28</ref> ব্রিটিশদের একটি বড় পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল। এটি প্রাচীন রোমের মতো প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের খাদ্য, পোশাক এবং অস্ত্রের সরবরাহ ভালো ছিল। কিন্তু মার্কিনদের প্রশিক্ষণের অভাবের মানে ছিল যে তারা ইউরোপীয়দের মতো সমবেত হত না। তারা বরং স্নাইপারদের উপর নির্ভর করত। এরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি ছিল। তারা গুলি ছুঁড়ত এবং তারপর আবার লোড করত যখন তাদের প্রতিবেশীরা গুলি চালাত। তারা এটি ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের সময় শিখেছিল। স্নাইপাররা মার্কিনদের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। == যুদ্ধের শুরু (১৭৭৫ - ১৭৭৮) == === লেক্সিংটন এবং কনকর্ড === [[Image:Battle_of_Lexington.jpeg|thumb|300px|right|লেক্সিংটনে সংঘর্ষ।]] ব্রিটিশ সরকার জেনারেল থমাস গেজকে ম্যাসাচুসেটসে অসহনীয় আইন কার্যকর করতে এবং অধিকার সীমিত করতে নির্দেশ দেয়।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=124</ref> গেজ কনকর্ডে অবস্থিত উপনিবেশের অস্ত্রের মজুত জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিলে গেজের সৈন্যরা কনকর্ডের দিকে যাত্রা করে। পথে লেক্সিংটন শহরে পল রিভিয়ার এবং অন্যদের মাধ্যমে আগাম সতর্ক করা মার্কিনরা সৈন্যদের থামানোর চেষ্টা করে। কোন পক্ষ প্রথম গুলি চালিয়েছিল তা কেউ জানে না। কিন্তু এটি লেক্সিংটন গ্রিনে ব্রিটিশ এবং মিনিটম্যানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে। খোলা মাঠে ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যদের অপ্রতিরোধ্য সংখ্যার মুখোমুখি হয়ে মিনিটম্যানরা দ্রুত পরাজিত হয়। তবুও গ্রামাঞ্চলে সতর্ক সংকেত ছড়িয়ে পড়ে। উপনিবেশের মিলিশিয়ারা ছুটে আসে। তারা ব্রিটিশদের উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে যখন তারা কনকর্ডের দিকে যায়। কনকর্ডে উপনিবেশবাসীরা সৈন্য জড়ো করে। তারা সেখানে ব্রিটিশদের সঙ্গে শক্তির সাথে যুদ্ধ করে। তারা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। তারপর তারা অস্ত্রাগারের জিনিসপত্র দখল করে। ব্রিটিশরা বোস্টনে ফিরে যায়। তারা সব দিক থেকে অবিরাম এবং তীব্র গুলির মুখে পড়ে।<ref>http://origins.osu.edu/milestones/april-2015-shot-heard-round-world-april-19-1775-and-american-revolutionary-war</ref> বোস্টনের উপকণ্ঠে কামানের সমর্থন সহ একটি শক্তিশালী কলাম না থাকলে ব্রিটিশদের প্রত্যাহার সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে পরিণত হতো। পরের দিন ব্রিটিশরা জেগে উঠে দেখে বোস্টন ২০,০০০ সশস্ত্র উপনিবেশবাসী দ্বারা ঘেরা। তারা শহরটির অবস্থিত উপদ্বীপে প্রসারিত চারপাশের জমি দখল করে। === বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ === [[Image:Bunker_hill.jpg|thumb|বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ।]] {{quote|text=তাদের চোখের সাদা অংশ না দেখা পর্যন্ত গুলি করো না।|sign=কর্নেল উইলিয়াম প্রেসকট |source=যুদ্ধের আগে নির্দেশ<ref>https://www.wbur.org/radioboston/2010/06/17/bunker-hill-stories</ref>}} যুদ্ধের কার্যক্রম একটি ''যুদ্ধ'' থেকে একটি ''অবরোধ''-এ পরিণত হয়। এখানে একটি সেনাবাহিনী অন্যটিকে একটি শহর বা নগরীতে আটকে রাখে। (যদিও ঐতিহ্যগতভাবে, ব্রিটিশরা অবরুদ্ধ ছিল না। কারণ রাজকীয় নৌবাহিনী বন্দর নিয়ন্ত্রণ করত এবং জাহাজের মাধ্যমে সরবরাহ আসত।) ম্যাসাচুসেটস মিলিশিয়ার প্রধান জেনারেল আর্টেমাস ওয়ার্ড অবরোধের প্রাথমিক তদারকি করেন। তিনি ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি তার বাহিনীকে চার্লসটাউন নেক, রক্সবারি এবং ডরচেস্টার হাইটসে অবস্থান করান। ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ বিদ্রোহী জেনারেল থমাস গেজের অধীনে প্রায় ৪,০০০ ব্রিটিশ নিয়মিত সৈন্যের মুখোমুখি হয়। বোস্টন এবং এর খুব কম অংশ ব্রিটিশ সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জেনারেল গেজ ১৭ জুন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি ব্রিডস হিল এবং বাঙ্কার হিলে উপনিবেশবাসীদের উপর আক্রমণ করেন। যদিও ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের তুলনায় প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তারা অবশেষে আমেরিকান বাহিনীকে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অনেক উপনিবেশী সৈন্যের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর শীঘ্রই বোস্টনের আশেপাশের এলাকা ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। তবে যে ক্ষয়ক্ষতি তারা ভোগ করে, তাতে তারা শহরের অবরোধ ভাঙতে পারেনি। উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রাথমিক পরাজয় সত্ত্বেও এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে তারা ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা রাখে। সেই সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে বিশ্বের সেরা বলে মনে করা হতো। === শান্তির শেষ সুযোগ === দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৫ সালের ৫ জুলাইয়ে শান্তির জন্য একটি পিটিশন গ্রহণ করে। এটির নাম '''অলিভ ব্রাঞ্চ পিটিশন'''। কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করে। এটি লন্ডনে পৌঁছায় যখন বাঙ্কার হিলের যুদ্ধের খবর আসে। রাজা পিটিশন পড়তে বা এর দূতদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।<ref>https://www.digitalhistory.uh.edu/disp_textbook.cfm?smtID=3&psid=3881</ref> সংসদ প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করে। এটি উপনিবেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে।<ref>https://sites.austincc.edu/caddis/colonial-rebellion/</ref> === বোস্টনের জন্য যুদ্ধ === ব্রিটিশদের জাহাজে প্রবেশাধিকার থাকলেও শহর ও সেনাবাহিনী খাদ্যের অভাবে ছিল। লবণাক্ত শুয়োরের মাংসই ছিল প্রধান খাদ্য। দ্রব্যের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। মার্কিন বাহিনী শহরে কী ঘটছে তা কিছুটা জানত। কিন্তু জেনারেল গেজের কাছে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপের কোনো কার্যকর তথ্য ছিল না। ১৭৭৫ সালের ২৫ মে ৪,৫০০ সৈন্য এবং তিনজন নতুন জেনারেল বোস্টন হারবারে পৌঁছান। নতুন নেতারা ছিলেন মেজর জেনারেল উইলিয়াম হাও, ব্রিগেডিয়ার জন বারগয়েন এবং হেনরি ক্লিনটন। গেজ শহর থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৭৭৫ সালের ৩ জুলাইয়ে জর্জ ওয়াশিংটন নতুন মহাদেশীয় সেনার দায়িত্ব নিতে আসেন। মেরিল্যান্ডের মতো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে বাহিনী ও সরবরাহ আসে। ডরচেস্টার নেকে পরিখা তৈরি করা হয়। এটি বোস্টনের দিকে প্রসারিত হয়। ওয়াশিংটন বাঙ্কার হিল এবং ব্রিডস হিল পুনরায় দখল করেন। এতে কোনো বাধা আসেনি। তবে এই কার্যক্রম ব্রিটিশদের দখলের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। [[Image:Henry_Knox.PNG|thumb|upright|হেনরি নক্স মহাদেশীয় সেনাদের ব্রিটিশদের পরাজিত করতে ব্যবহৃত কামান সরবরাহে সহায়তা করেন।]] ১৭৭৫-১৭৭৬ সালের শীতে হেনরি নক্স এবং তার প্রকৌশলীরা জর্জ ওয়াশিংটনের নির্দেশে স্লেজ ব্যবহার করে ফোর্ট টিকনডেরোগা থেকে ৬০ টন ভারী কামান সংগ্রহ করেন। নক্স এই স্লেজ ব্যবহারের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ১৮ দিনে কামানগুলো সেখানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু হিমায়িত কানেকটিকাট নদী পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগে। ১৭৭৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে তারা কেমব্রিজে ফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিংটন অবিশ্বাস্য প্রতারণা ও গতিশীলতার কৌশলে রাতারাতি কামান এবং কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে ডরচেস্টার হাইটস দখল করেন। বাহিনী বোস্টনের উপর নজর রাখে। জেনারেল জন টমাস এলাকাটি সুরক্ষিত করেন। ব্রিটিশ নৌবহর একটি দায় হয়ে পড়ে। এটি অগভীর বন্দরে নোঙর করা ছিল। এর চালনার সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি ডরচেস্টার হাইটসের মার্কিন কামানের মুখোমুখি হয়। জেনারেল হাও যখন কামানগুলো দেখেন, তিনি বুঝতে পারেন শহর ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে শহর শান্তিপূর্ণভাবে খালি করার অনুমতি চান। বিনিময়ে, তারা শহর পুড়িয়ে দেবে না। ওয়াশিংটন সম্মত হন। তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। তার কাছে কামান ছিল, কিন্তু গানপাউডার ছিল না। পুরো পরিকল্পনাটি ছিল একটি দুর্দান্ত প্রতারণা। ১৭৭৬ সালের ১৭ মার্চ ব্রিটিশরা নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে অবরোধ শেষ হয়। মিলিশিয়ারা বাড়ি ফিরে যায়। এপ্রিলে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনার বেশিরভাগ বাহিনী নিয়ে নিউ ইয়র্ক নগরী সুরক্ষিত করতে যান। === ইথান অ্যালেন ও ফোর্ট টিকনডেরোগা === [[Image:Fort_Ticonderoga_1775.jpg|thumb|left|300px|ইথান অ্যালেন টিকনডেরোগা দুর্গ দখল করছেন।]] ব্রিটিশরা ফোর্ট টিকনডেরোগাকে তুলনামূলকভাবে গুরুত্বহীন একটি চৌকি মনে করত। তখন পর্যন্ত সংঘর্ষ মূলত ম্যাসাচুসেটসে ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সৈনিক ইথান অ্যালেনের নজর ছিল এই দুর্গের উপর। অ্যালেন ভার্মন্টে একটি আঞ্চলিক মিলিশিয়া গড়ে তুলেছিলেন। নাম ছিল গ্রিন মাউন্টেন বয়েজ। এটি একটি কার্যকর যুদ্ধশক্তি হয়ে ওঠে। ভার্মন্ট নিউ ইয়র্ক উপনিবেশের দাবিদার ছিল। কিন্তু অ্যালেন আরও স্বাধীনতা চাইতেন। ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে কানেকটিকাট মিলিশিয়ার কমান্ডার বেনেডিক্ট আরনল্ড অ্যালেনের কাছে আসেন। আরনল্ড ঘোষণা করেন যে তিনি ফোর্ট টিকনডেরোগার কামান দখলের জন্য নিযুক্ত হয়েছেন। দুজনের মধ্যে তীব্র আলোচনার পর তারা সম্মত হন যে দুই মিলিশিয়া একসঙ্গে দুর্গ আক্রমণ করবে। এটি ভালো হয়েছিল। কারণ দুই বাহিনী একসঙ্গে ছোট ছিল। এটি ব্রিগেডের শক্তির অনেক কম ছিল। ১০ মে মার্কিন সম্মিলিত বাহিনী দুর্গ দখল করে। তারা অস্ত্র সহ কামান দখল করে। এগুলো গরু দিয়ে টেনে বোস্টনে নিয়ে যাওয়া হয়। == কারণকে শক্তিশালী করা == সেই সময়ের গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিপ্লব সম্মানিত মানুষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধারণাকে প্রচার করে। উত্তর ও দক্ষিণের সংবাদপত্র উত্তেজক গল্প এবং উৎসাহব্যঞ্জক খোদাই প্রকাশ করে। থিয়েটার নাটকীয় প্রতিবাদে অবদান রাখে। এর মধ্যে ছিল মেরি ওটিস ওয়ারেনের সৃষ্টিকর্ম। গান বাজানো এবং গাওয়া হতো ক্লান্ত মনোবল উত্সাহিত করতে। === থমাস পেইনের ১৭৭৬ === ১৭৭৬ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজ থমাস পেইন ''কমন সেন্স'' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই রাজতন্ত্রবিরোধী প্রকাশনা মার্কিন স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে। এটি বাইবেল ও প্রজাতান্ত্রিক গুণাবলীর উদাহরণ ব্যবহার করে। এটি যুক্তি দেয় যে কোনো মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য রাজারা কখনোই ভালো নয়। ১৭৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ''দ্য আমেরিকান ক্রাইসিস'' নামে পুস্তিকার সিরিজ প্রকাশ শুরু করেন। এটি সৈন্যদের বিপ্লবের কারণে জড়ো হতে আহ্বান জানায়। প্রথম পুস্তিকাটি শুরু হয় উদ্দীপক কথায়: "এই সময়গুলো মানুষের আত্মাকে পরীক্ষা করে"। === স্বাধীনতার ঘোষণা === [[Image:Flag at Independence Hall.jpg|thumb|upright|ইন্ডিপেনডেন্স হলে প্রথম পতাকা উত্তোলন। ক্লাইড ও. ডিল্যান্ডের চিত্রের প্রতিলিপি।]] যখন সামরিক শত্রুতা বাড়তে থাকে, দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা জর্জ ওয়াশিংটনকে মহাদেশীয় সেনার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওয়াশিংটন যুদ্ধের সময় এই পদের জন্য তার বেতন ত্যাগ করেন। (তিনি উপনিবেশের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি এই পছন্দের সামর্থ্য রাখতেন।) ১৭৭৬ সালের জুনে দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা মনে করে গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি প্রেরণা প্রয়োজন। এটি '''স্বাধীনতার ঘোষণা'''র খসড়া তৈরি করতে পাঁচজনের একটি কমিটি গঠন করে। তারা ছিলেন জন অ্যাডামস, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, রবার্ট লিভিংস্টন, রজার শেরম্যান ও থমাস জেফারসন। জেফারসন এই দলিলের প্রধান লেখক হন। যদিও ব্রিটিশ রাজা আর তার অধিরাজ্যের নীতির জন্য মূলত দায়ী ছিলেন না, স্বাধীনতার ঘোষণা তাকে স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করে। এটি বিদ্রোহের অধিকারকে এমন কথায় ন্যায্যতা দেয় যা ইউরোপীয় আলোকিত যুগ প্রশংসা করত: "আমরা এই সত্যগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করি, যে সকল মানুষ সমানভাবে সৃষ্ট।" মহাদেশীয় মহাসভা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ে এই দলিলে স্বাক্ষর করে। তবে এই সময়ে স্বাক্ষরগুলো দেখায় যে তারা স্বাধীনতা চায়। তারা একা এটি অর্জন করতে পারেনি। === আর্মি ব্যান্ড === একটি সুশৃঙ্খল সৈন্যদলের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তার সামরিক ব্যান্ড। ব্রিটিশ এবং হেসীয় সৈন্যরা ড্রামের তালে ড্রিল করত। এটি মাসকেটের গোলাগুলির শব্দের উপরে মার্চের ছন্দ বহন করত। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগের একটি উপায় প্রদান করত। "১৭৭৮ সাল নাগাদ সৈন্যরা সাধারণ সময়ে প্রতি মিনিটে ৭৫টি ২৪ ইঞ্চি পদক্ষেপে মার্চ করত। দ্রুত সময়ে মার্চ করার সময় এটি প্রায় দ্বিগুণ (প্রতি মিনিটে ১২০ পদক্ষেপ) হতো।"<ref>Anon. "Middle-brook Order, June 4, 1777: What It Really Says about the Quality of Revolutionary War Field Music." Paper read at School of the Musician, Brigade of the American Revolution, April 4, 1989. Revised February 12, 2011. Copyright 1989, 2011 HistoryOfTheAncientsDotOrg. http://historyoftheancients.wordpress.com/2012/09/06/1195/</ref> ফাইফ (একটি তীক্ষ্ণ বাঁশি) এবং ড্রামের সঙ্গীত সৈনিকদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করত। যদি বিদ্রোহীরা ভালো সরবরাহ না পেত, তবে তাদের অন্তত উচ্চ মনোবল থাকত। ''মিডল-ব্রুক অর্ডার''-এর মাধ্যমে জর্জ ওয়াশিংটন নির্দেশ দেন যে প্রত্যেক অফিসারকে তার সৈন্যদের জন্য সামরিক সঙ্গীতের ব্যবস্থা করতে হবে। সীমিত সংখ্যক যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও।<ref>Anon, "Middle-brook Order.</ref> ব্যান্ডগুলো দিনের শুরু ও শেষ ঘোষণা করতে, যুদ্ধে সৈন্যদের নির্দেশ দিতে এবং মনোবল উত্সাহিত করতে ব্যবহৃত হতো। === বিপ্লবে জনপ্রিয় সঙ্গীত === বিপ্লবের দুটি প্রধান গানের একটি ছিল স্তোত্র ''চেস্টার''। এটি ১৭৭০ সালে "দ্য নিউ ইংল্যান্ড সলম সিঙ্গার' এ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৭৭৮ সালে এটি সংশোধিত হয়। এর লেখক ও সুরকার উইলিয়াম বিলিংস বাইবেলের (''লেট টাইরান্টস শেক দেয়ার আয়রন রড'') এবং সমসাময়িক (''হাও এবং বারগয়েন এবং ক্লিনটন টু,/ উইথ প্রেসকট এবং কর্নওয়ালিস জয়নড'') দুটির সমন্বয় তৈরি করেন। আরেকটি ছিল গান ''ইয়াঙ্কি ডুডল''। এটি সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের একটি সুর থেকে অভিযোজিত। এটি মূলত ব্রিটিশরা উপনিবেশবাসীদের প্রাদেশিকবাদী আচরণ নিয়ে তামাশা করতে ব্যবহার করত। কিন্তু এটি মার্কিন বিদ্রোহীদের একটি থিমে পরিণত হয়। == কানাডা == ১৭৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল রিচার্ড মন্টগোমেরির নেতৃত্বে উপনিবেশবাসীরা কানাডা আক্রমণ করে। প্রথমে আক্রমণ সফল হয়। মন্টগোমেরি ফোর্ট সেন্ট জিন ও মন্ট্রিল শহর দখল করেন। ৩০ ডিসেম্বর তিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কুইবেক শহরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি বিপর্যয়কর হয়। মন্টগোমেরি যুদ্ধে নিহত হন। এটি কানাডার শেষ বড় পদক্ষেপ ছিল। যদিও বেনেডিক্ট আরনল্ড এবং অন্যান্য জেনারেলরা কানাডার উপকূলে আক্রমণ করেন বা সীমান্তে অভিযান চালান। == যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট == যুদ্ধের প্রথম বছরগুলোতে অসংখ্য পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও উপনিবেশবাসীরা বেশ কয়েকটি বড় বিজয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। === নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সি === ১৭৭৬ সালের জুলাইয়ে জেনারেল উইলিয়াম হাও এবং ৩০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে পৌঁছান। এই বড় সেনাবাহিনী লং আইল্যান্ডের যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের মার্কিন বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং পরাজিত করে। প্রায় পুরো সেনাবাহিনী বন্দী হওয়ার পর ওয়াশিংটন নিউ ইয়র্ক থেকে দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যাহার করেন। অবশেষে কন্টিনেন্টাল আর্মিকে পেনসিলভানিয়ায় শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়। হাও ওয়াশিংটনের বাহিনীকে তাড়া করে যুদ্ধ শেষ করতে পারতেন। কিন্তু হাও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। তিনি বাড়ি থেকে এত দূরে অনেক সৈন্য হারানোর ভয় করতেন। ব্রিটেন ট্রেন্টনের ব্রিটিশ দুর্গ পাহারা দেওয়ার জন্য জার্মান ভাড়াটে সৈন্য (হেসীয়) নিয়োগ করে। হাও এই প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেন। তিনি বসন্ত পর্যন্ত মহাদেশীয় সেনার উপর আবার আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটনও পরিস্থিতির সুযোগ নেন। তবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি মনে করতেন, বড়দিনের রাতে হেসীয়রা ভারী ভোজ ও মদ্যপানের পর সবচেয়ে দুর্বল থাকবে। ১৭৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাতে ওয়াশিংটন তার সৈন্যদের ৯ মাইল দূরে এবং ডেলাওয়্যার নদী পার করে হেসীয়দের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য নিয়ে যান। নদী পার করা কঠিন ছিল। পার হওয়ার শুরুতে শিলাবৃষ্টি ও তুষারঝড় শুরু হয়। বাতাস প্রবল ছিল। নদীতে বরফের টুকরো ভাসছিল। পার হতে তিন ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। তবুও ওয়াশিংটন আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওয়াশিংটন যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ভাড়াটে সৈন্যরা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল। তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর খুব কম সময় ছিল। মাত্র এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর সকালে মহাদেশীয় আর্মি ট্রেন্টনের যুদ্ধে জয়ী হয়। মার্কিনদের মাত্র ৪ জন আহত হয় এবং ০ জন নিহত হয়। বিপরীতে, ২৫ জন হেসীয় নিহত, ৯০ জন আহত এবং ৯২০ জন বন্দী হয়। এই বিজয় সৈন্যদের মনোবল বাড়ায়। এটি পুনরায় তালিকাভুক্তির দিকে নিয়ে যায়। কিছু ইতিহাসবিদ এমনকি মনে করেন ট্রেন্টন বিপ্লবকে বাঁচিয়েছিল। ২ জানুয়ারিতে ব্রিটিশরা ট্রেন্টন পুনরুদ্ধার করতে আসে। তারা বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে এটি করে। ওয়াশিংটন আবারও একটি চতুর প্রত্যাহারের নেতৃত্ব দেন। তিনি প্রিন্সটনে অগ্রসর হন। প্রিন্সটনের যুদ্ধে মহাদেশীয় সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পিছনের রক্ষীদের আক্রমণ করে। তারা ব্রিটিশদের নিউ জার্সি থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যুদ্ধের সময়, নতুন বিশ্ব [[w:1775–1782 North American smallpox epidemic|1775–1782 উত্তর আমেরিকার গুটিবসন্ত মহামারী]] দ্বারা বিধ্বস্ত হচ্ছিল। যৌবনে এই রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া<ref>https://washingtonpapers.org/strongly-attacked-george-washington-encounters-smallpox/</ref> এবং বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের কাছ থেকে রোগটি সেনাবাহিনীর উপর যে প্রভাব ফেলতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করা হওয়ায়<ref name="locsmallpox">https://www.loc.gov/rr/scitech/GW&smallpoxinoculation.html</ref> জর্জ ওয়াশিংটন লিখেছিলেন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের চেয়ে এই রোগের কারণে মহাদেশীয় সেনাদের অক্ষম হওয়ার বিষয়ে বেশি ভয় করতেন।<ref name="locsmallpox"/> ৫ ফেব্রুয়ারিতে জর্জ ওয়াশিংটন গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবের কারণে বড় ধরনের ব্যাঘাতের পর সৈন্যদের প্রথম গণ টিকাদানের নির্দেশ দেন।<ref name="locsmallpox"/> এই নীতি সৈন্যদের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এটি গণ সংক্রমণ ছড়াতে বাধা দেয়।<ref name="locsmallpox"/> === সারাটোগার যুদ্ধ === [[Image:Surrender_of_General_Burgoyne.jpg|thumb|left|250px|বারগয়েন মহাদেশীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।]] ১৭৭৭ সালের গ্রীষ্মে ব্রিটিশ জেনারেল জন বারগয়েন এবং জেনারেল হাও ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীকে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে পরাজিত করার পরিকল্পনা করেন। হাও উত্তরে অগ্রসর হন। তিনি ব্র্যান্ডিওয়াইন এবং জার্মানটাউনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। অবশেষে তিনি ফিলাডেলফিয়া দখল করেন। কিন্তু বারগয়েন এত ভাগ্যবান ছিলেন না। মহাদেশীয় সেনাদের তৈরি প্রাকৃতিক ফাঁদে বিলম্বিত হয়ে তার সৈন্যরা কানাডা থেকে অ্যালবানির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে তার বাহিনী সারাটোগায় পৌঁছায়। সেখানে একটি বিশাল মার্কিন সেনাবাহিনী সৈন্যদের আক্রমণ করে। অক্টোবরে জেনারেল বারগয়েন তার সমস্ত বাহিনী মার্কিনদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জেনারেল হাও পেনসিলভানিয়ায় তার বিজয় সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন। সারাটোগার যুদ্ধ যুদ্ধের প্রধান উত্থানের ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত হয়। এটি ফ্রান্সকে বোঝায় যে আমেরিকাকে গ্রেট ব্রিটেনকে উৎখাত করতে হবে। ফরাসি সাহায্য তখন উপনিবেশবাসীদের জন্য প্রবর্তিত হয়। এই যুদ্ধটি ব্রিটিশদের উত্তরে শেষ অগ্রগতি ছিল। ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মে নিউ জার্সির মনমাউথের যুদ্ধের পর সমস্ত যুদ্ধ দক্ষিণে সংঘটিত হয়। === ইরোকুইয়ের পরাজয় === ইরোকুই কনফেডারেসি তার শীর্ষে ইউরোপীয় শক্তির সমকক্ষ ছিল। কিন্তু ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধের পর থেকে এটি হ্রাস পাচ্ছিল। মিত্রসংঘের উপজাতিগুলো বিপ্লবে কাকে সমর্থন করবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। ওনেইডা এবং তুসকারোরা মার্কিনদের সমর্থন করে। মোহক, ওনোনডাগা, কায়ুগা এবং সেনেকা ব্রিটিশদের সমর্থন করে। ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত মিত্রসংঘ একত্র থাকতে সক্ষম হয়। সারাটোগার যুদ্ধের পর, ব্রিটিশদের সমর্থনকারী চারটি উপজাতি নিউ ইয়র্ক এবং পেনসিলভানিয়া জুড়ে মার্কিন বসতিগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। একটি পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ অনুসৃত হয়। ইরোকুই মার্কিন দুর্গ এবং শহরগুলোতে আক্রমণ করত। তারপর মার্কিনরা ইরোকুই গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিত। ১৭৭৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন জেনারেল সুলিভানকে ইরোকুই জাতিকে ধ্বংস করতে পাঠান। নিউটাউনের যুদ্ধে ইরোকুইদের পরাজিত করার পর সুলিভানের সেনাবাহিনী একটি ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালায়। তারা পদ্ধতিগতভাবে কমপক্ষে চল্লিশটি ইরোকুই গ্রাম ধ্বংস করে। এই ধ্বংস সেই শীতে ফোর্ট নায়াগ্রার বাইরে হাজার হাজার ইরোকুই শরণার্থীদের জন্য বড় দুর্দশা সৃষ্টি করে। অনেকে অনাহারে বা হিমশীতল অবস্থায় মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা কানাডার ব্রিটিশ অঞ্চল এবং নায়াগ্রা ফলস এবং বাফেলো এলাকায় পালিয়ে যায়। এভাবে ইরোকুই মিত্রসংঘের ৭০০ বছরের ইতিহাস শেষ হয়। == যুদ্ধের সমাপ্তি (১৭৭৮ - ১৭৮১) == সারাটোগায় পরাজয়ের পর ব্রিটিশদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরা বিপ্লবে তাদের সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। ১৭৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের সঙ্গে জোট গঠন করে। স্পেন এবং ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্রও আমেরিকান পক্ষে যোগ দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ ধার দেয় এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়। === ভ্যালি ফোর্জ === [[File:Washington_and_Lafayette_at_Valley_Forge.jpg|thumb|ভ্যালি ফোর্জে ওয়াশিংটন এবং লাফায়েতের একটি চিত্র।]] ব্রিটিশদের দ্বারা ফিলাডেলফিয়া দখলের পর ওয়াশিংটন তার অনুসারীদের নিয়ে ১৭৭৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভ্যালি ফোর্জে যান। এটি একটি প্রতিরক্ষাযোগ্য কাছাকাছি এলাকা ছিল। তিনি ১২,০০০ সৈন্য এবং ৪০০ বেসামরিক নাগরিকের জন্য শিবির তৈরি করেন। এটি তখন উপনিবেশের চতুর্থ বৃহত্তম বসতি ছিল।<ref>https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/valley-forge-history-and-significance.htm</ref> বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের মাধ্যমে মহান ফ্রেডরিক প্রাশীয় প্রোটেজ ব্যারন ভন স্টুবেনকে কংগ্রেসে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তাকে ভ্যালি ফোর্জে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৭৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে সেখানে পৌঁছান।<ref name="valleyforgepark">https://www.nps.gov/vafo/learn/historyculture/vonsteuben.htm</ref><ref>https://www.mountvernon.org/library/digitalhistory/digital-encyclopedia/article/frederick-the-great/</ref> === সমুদ্রে === সমুদ্রেও যুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিনরা "প্রাইভেটিয়ার"দের কমিশন দেয়। তারা সামরিক হোক বা না হোক, সব ব্রিটিশ জাহাজ আক্রমণ ও ধ্বংস করতে পারত। সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাইভেটিয়ারদের একজন জন পল জোন্স সমুদ্রে মার্কিনদের জন্য বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জন করেন। এমনকি তিনি ব্রিটেনের উপকূলেও আক্রমণ করেন। [[Image:Yorktown80.JPG|thumb|250px|ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশ আত্মসমর্পণ গ্রহণ করছেন বেনজামিন লিঙ্কন, পিছনে ওয়াশিংটন।]] === যুদ্ধ দক্ষিণে === একটি প্রতারণার চেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন এর স্থপতি ব্রিটিশ মেজর জন আন্দ্রে ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ধরা পড়েন। ফোর্ট টিকনডেরোগার নায়কদের একজন বেনেডিক্ট আরনল্ডকে নিউ ইয়র্কের ফোর্ট ক্লিনটনের (বর্তমানে ওয়েস্ট পয়েন্ট) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঘুষের বিনিময়ে আরনল্ড দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা করেন। তিনি দুর্গটি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা জানার পর তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পালিয়ে যান। ব্রিটেন উত্তর থেকে মনোযোগ দক্ষিণে সরিয়ে নেয়। সেখানে আরও ভৃত্যবাদী বাস করত। তারা প্রথমে খুব সফল হয়। তারা ওয়াক্সহস, চার্লসটন এবং ক্যামডেনে মার্কিনদের পরাজিত করে। দক্ষিণে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার লর্ড কর্নওয়ালিস মার্কিনদের তাড়া করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। নাথানিয়েল গ্রিন তার সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি ভাগ ড্যানিয়েল মরগানের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেন। মরগান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অর্ধেকের কমান্ডার বানাস্ট্রে টারলেটনকে কাউপেনসে টেনে আনেন। সেখানে তারা ব্রিটিশদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্য অর্ধেক, যা এখনও কর্নওয়ালিসের নিয়ন্ত্রণে ছিল, গিলফোর্ড কোর্ট হাউসের যুদ্ধে মার্কিনদের পরাজিত করে। তবে, এটি কর্নওয়ালিসের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী বিজয় ছিল। তিনি ভার্জিনিয়ার ইয়র্কটাউনে পুনর্গঠনের জন্য পিছু হটতে বাধ্য হন। ব্রিটিশরা ইয়র্কটাউনে আছে এবং একটি ফরাসি নৌবহর আসছে শুনে ওয়াশিংটন মহাদেশীয় সেনা এবং ফরাসি সৈন্যদের নিয়ে ইয়র্কটাউনে যান। তারা ব্রিটিশদের ঘিরে ফেলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ শহরটি অবরোধের মুখে পড়ে। নিউ ইয়র্কে থাকা ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ হেনরি ক্লিনটন কর্নওয়ালিসকে আশ্বাস দেন যে তিনি শীঘ্রই মুক্তি পাবেন। তবে ফরাসি নৌবহর ব্রিটিশ ত্রাণবাহী বাহিনীকে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা আরও কয়েকদিন ধরে প্রতিরোধ করে। কিন্তু মিত্র বাহিনী ইয়র্কটাউনের কাছাকাছি চলে আসে। তাদের কামান ব্রিটিশ প্রতিরক্ষার অনেক কিছু ধ্বংস করে। ১৭৮১ সালের ১৯ অক্টোবরে কর্নওয়ালিস ৭,০০০-এরও বেশি লোক বিশিষ্ট তার পুরো সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেন। বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনে ব্রিটিশরা এই পরাজয়ে বিধ্বস্ত হয়। সংসদ "উপনিবেশগুলোতে" সমস্ত আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য ভোট দেয়। ওয়াশিংটন তার সেনাবাহিনীকে নিউ ইয়র্কের নিউবার্গে নিয়ে যান। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীতে একটি বিদ্রোহ থামান। ১৭৮৩ সালে যুদ্ধের সমাপ্তিতে বড় সংখ্যক ভৃত্যবাদী এবং তাদের পরিবার ইংল্যান্ডে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানাডা এবং অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশে স্থানান্তরিত হয়। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হারানো সম্পত্তি এবং জমির জন্য দাবি জমা দেয়। অনেক দাবি ইংরেজ সরকার ক্ষতির প্রমাণের অভাবে বা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে গ্রহণ করেনি। সম্পত্তি এবং জমি মার্কিন সম্প্রদায় দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়। তারপর সর্বোচ্চ দরদাতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। ১৭৮২ সালে আইসল্যান্ডের একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের জলবায়ুগত প্রভাবের কারণে ভৃত্যবাদীরা কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে ঠান্ডা শীতের একটির সম্মুখীন হয়। এটি ১৭৮৩-১৭৮৪ সালে কম ফসলের কারণ হয়। অনাহার, রোগ এবং কষ্ট ছিল প্রচুর। অনেকে তাদের স্বল্প উৎপাদনে টিকে থাকার পরিবর্তে প্রতিশোধের হুমকি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। == প্যারিসের চুক্তি (১৭৮৩) == ইয়র্কটাউনের পর ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমনের আশা হারায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং স্পেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। '''প্যারিসের চুক্তি''' ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর সীমানা উত্তরে কানাডার সীমান্ত থেকে পশ্চিমে মিসিসিপি নদী এবং দক্ষিণে ফ্লোরিডার উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটেনকে ফ্লোরিডা স্পেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারা কানাডা ধরে রাখে। কংগ্রেসকে বলা হয় রাজ্যগুলোকে ভৃত্যবাদীদের হারানো বা চুরি হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দিতে। (তবে, অনেক ভৃত্যবাদী বিপ্লবের সময় পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করতে ফিরে আসেনি।) {{chapnav|সংবিধানের পথে|প্রারম্ভিক বছরে সংবিধান}} == বিপ্লব ও ধর্ম == === বিপ্লবে ক্যাথলিক === গ্রেট ব্রিটেনে ক্যাথলিক ধর্মের জটিল পরিস্থিতি তার উপনিবেশগুলোতে ফলাফল তৈরি করেছিল। মার্কিন বিপ্লবের সময়, মূল ১৩টি উপনিবেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৬% ছিল ক্যাথলিক। ক্যাথলিকদের ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে দেখা হতো। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আইরিশ ক্যাথলিকরা দ্বিগুণ অভিশপ্ত ছিল। আয়ারল্যান্ডে তারা ব্রিটিশ আধিপত্যের শিকার ছিল। আমেরিকায় ক্যাথলিকদের কিছু উপনিবেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল। যদিও তাদের বিশ্বাসের প্রধান রোমে বাস করতেন, তারা লন্ডন ডায়োসিসের ক্যাথলিক বিশপ জেমস ট্যালবটের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের অধীনে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে বিশপ ট্যালবট ব্রিটিশ রাজশাসনের প্রতি তার বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন। (যদি তিনি অন্যথা করতেন তবে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকরা সমস্যায় পড়ত। ক্যাথলিকবিরোধী মনোভাব তখনও প্রবল ছিল।) তিনি কোনো ঔপনিবেশিক পুরোহিতকে কমিউনিয়ন পরিবেশন করতে নিষেধ করেন। এটি বিশ্বাসের চর্চাকে অসম্ভব করে তোলে। এটি ঔপনিবেশিক বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করে। মহাদেশীয় সেনারা ফরাসিদের সঙ্গে জোট বাধলে ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে। যখন ফরাসি নৌবহর রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে পৌঁছায় তখন উপনিবেশটি ১৬৬৪ সালের আইন বাতিল করে। এটি ক্যাথলিকদের নাগরিকত্বের অনুমতি দেয়। (এটি সাংবিধানিক অধিকারের বিধানের পূর্বাভাস দেয় যা এটি ক্যাথলিকবিরোধী আইনগুলো বাতিল করে।) যুদ্ধের পর পোপ একজন মার্কিন বিশপ হিসেবে জন ক্যারলকে নিযুক্ত করেন। তিনি মেরিল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারী ক্যারলদের বংশধর ছিলেন। তিনি রোমের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগকারী একটি মার্কিন ডায়োসিস তৈরি করেন। === অ্যাঙ্গলিকানবাদ থেকে এপিস্কোপালিয়ানবাদ === একদিকে ঔপনিবেশিক চার্চ অফ ইংল্যান্ড ব্রিটিশ সরকারের একটি অঙ্গ এবং এর সহযোগী ছিল। এর পুরোহিতরা রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিত। বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় অ্যাঙ্গলিকান চার্চকে অর্থ প্রদান করত। যদিও সেই রাজ্যগুলোতে অন্যান্য বিশ্বাসের অনুমতি ছিল, অ্যাঙ্গলিকানকে প্রাতিষ্ঠানিক (প্রতিষ্ঠিত) মণ্ডলী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করত। তবুও, থমাস জেফারসন সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে তাদের পিউ ভাড়া করতেন। (জেফারসনের নিজের বিশ্বাস লো চার্চ ছিল। তিনি খ্রিস্টধর্মের অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন।) বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ভবনে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু যুদ্ধের পর চার্চকে একটি নতুন ভূমিকা খুঁজে নিতে হয়। কিছু ভৃত্যবাদী পুরোহিত কানাডায় চলে যান। অন্যদের নতুন সরকারের প্রতি শপথ নেওয়ার পর থাকতে দেওয়া হয়। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত চার্চ আর ছিল না। এমনকি ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিয়ে আসা সংবিধান তৈরির আগে মার্কিনরা কোনো অতিরিক্ত ফি দিতে চায়নি। সেই চার্চের উপাসনার ধরন বুক অফ কমন প্রেয়ার নতুন এপিস্কোপাল চার্চের জন্য বাস্তবিকভাবে সংশোধিত হয়। এতে মানুষ রাজার পরিবর্তে "বেসামরিক শাসক"-এর জন্য প্রার্থনা করত। কিন্তু অনেক চার্চ ভবন বন্ধ হয়ে যায়। তখনো ভার্জিনিয়া ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য জায়গা ছিল। == নতুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক সরকার == [উইকিপিডিয়া থেকে কপি করা] '''মিত্রসংঘ অনুচ্ছেদ''' তথা আনুষ্ঠানিকভাবে '''কনফেডারেশন এবং চিরস্থায়ী সংঘের অনুচ্ছেদ''' ১৩টি প্রতিষ্ঠাতা রাজ্যের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে সার্বভৌম অঙ্গরাজ্যগুলোর একটি মিত্রসংঘ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান হিসেবে কাজ করে।<ref>{{cite book| last = Jensen| first = Merrill| title = The Articles of Confederation: An Interpretation of the Social-Constitutional History of the American Revolution, 1774–1781| year = 1959| publisher = University of Wisconsin Press| isbn = 978-0-299-00204-6| pages = xi, 184 }}</ref> ১৭৭৬ সালের মাঝামাঝিতে মহাদেশীয় কংগ্রেস এটির খসড়া শুরু করে। ১৭৭৭ সালের শেষে একটি অনুমোদিত সংস্করণ রাজ্যগুলোতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ১৭৮১ সালের প্রথম দিকে সমস্ত ১৩টি রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন সম্পন্ন হয়। এমনকি তখনো অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও, অনুচ্ছেদটি মহাদেশীয় কংগ্রেসকে মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা, ইউরোপের সঙ্গে কূটনীতি পরিচালনা এবং আঞ্চলিক বিষয় ও মার্কিন আদিবাসীদের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদান করে। তবুও, অনুচ্ছেদ দ্বারা সৃষ্ট সরকারের দুর্বলতা মূল জাতীয়তাবাদীদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। [কে?] {{wikisource|The Articles of Confederation}} == পাদটীকা == {{reflist}} == পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন == ১. এই লেখক/সুরকাররা কারা ছিলেন এবং তারা কীসের জন্য পরিচিত ছিলেন? (মেরি ওটিস ওয়ারেন, থমাস জেফারসন, থমাস পেইন, উইলিয়াম বিলিংস।) ২. লেক্সিংটন এবং কনকর্ডের যুদ্ধগুলো কীভাবে আমেরিকান যোদ্ধাদের প্রাথমিক শক্তি এবং দুর্বলতা দেখায়? ৩. এই এবং পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাধীনতার ঘোষণার একটি কপি পরীক্ষা করুন। এর বাগ্মিতা (শব্দের পছন্দ) কীভাবে আমেরিকান বিদ্রোহের উদ্বেগগুলো সমাধান করে? এটি কীভাবে একটি বিষয় তৈরি করতে প্রকৃত ঘটনা থেকে বিচ্যুত হয়? {{BookCat}} {{status|100%}} {{BookCat}} ksf0606u7yio1o98yp9l413x9zn1f7l মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস/তৃতীয় পক্ষ 0 25582 85447 79689 2025-06-30T15:25:40Z Mehedi Abedin 7113 85447 wikitext text/x-wiki ==মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় দলসমূহ== যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত, ইতিহাসে এমন সময় ছিল যখন ছোট ছোট তৃতীয় দলসমূহ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং সরকারের উপর প্রভাব ফেলেছিল। <table border="1"> <tr bgcolor="#cccccc"><th><br></th> <th>দল</th><th>রাষ্ট্রপতি প্রার্থী (থাকলে)</th><th>প্রার্থীর পক্ষে প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা</th><th width="350px">মন্তব্য</th></tr> <tr><td>১</td> <td>[[w:Nullifier Party|নালিফায়ার]]</td> <td> *১৮৩২ - জন ফ্লয়েড</td> <td> *১৮৩২ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;০</td> <td> *যদিও জন ফ্লয়েড রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেননি, নালিফায়ার পার্টি তাঁকে সমর্থন করেছিল এবং সাউথ ক্যারোলাইনা তাঁকে তাদের এগারোটি ইলেকটোরাল ভোট দিয়েছিল।</td> </tr> <tr><td>২</td> <td>[[w:Anti-Masonic Party|অ্যান্টি-ম্যাসনিক]]</td> <td> *১৮৩২ - উইলিয়াম উইর্ট ও অ্যামস এলমেকার</td> <td> *১৮৩২ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;১০০,৭১৫</td> <td> *বিরোধপূর্ণভাবে উইর্ট এক সময় ম্যাসন ছিলেন *উইর্ট ভারমন্ট থেকে সাতটি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন</td> </tr> <tr><td>৩</td> <td>[[w:Liberty Party (United States, 1840)|লিবার্টি]]</td> <td> *১৮৪০ - জেমস জি. বার্নি ও থমাস আর্ল *১৮৪৪ - জেমস জি. বার্নি ও থমাস মরিস *১৮৪৮ - গ্যারিট স্মিথ ও চার্লস সি. ফুট *১৮৫২ - উইলিয়াম গুডেল ও স্যামুয়েল এম. বেল *১৮৫৬ - গ্যারিট স্মিথ ও *১৮৬০ - গ্যারিট স্মিথ ও স্যামুয়েল ম্যাকফারল্যান্ড</td> <td> *১৮৪০ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;৬,৭৯৭ *১৮৪৪ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;৬২,১০৩ *১৮৪৮ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;২,৫৪৫ *১৮৫২ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp; *১৮৫৬ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp; *১৮৬০ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;&nbsp;</td> <td></td></tr> <tr><td>৪</td> <td>[[w:Free Soil Party|ফ্রি সোয়েল]]</td> <td> *১৮৪৮ - মার্টিন ভ্যান বিউরেন ও চার্লস এফ. অ্যাডামস *১৮৫২ - জন পি. হেইল ও জর্জ ডব্লিউ. জুলিয়ান</td> <td> *১৮৪৮ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;২৯১,৫০১ *১৮৫২ - &nbsp;&nbsp;&nbsp;১৫৫,২১০</td> <td> *মার্টিন ভ্যান বিউরেন পূর্বে ডেমোক্র্যাট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। *"স্পয়লার" শব্দটি ১৮৪৮ সালের নির্বাচনের পর অপবাদরূপে ব্যবহার হতে শুরু করে। ডেমোক্র্যাটরা ফ্রি সোয়েল পার্টিকে "ফ্রি স্পয়লার" বলত কারণ তারা দাসত্ব-বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের আকৃষ্ট করে ভোটের ১০% এর বেশি লাভ করেছিল।</td> </tr> <tr><td>৫</td> <td>[[w:Prohibition Party|প্রোহিবিশন]]</td> <td> *১৮৭২ - জেমস ব্ল্যাক ও জন রাসেল *১৮৭৬ - গ্রিন ক্লে স্মিথ ও গিডিয়ন টি. স্টুয়ার্ট *১৮৮০ - নিল ডো ও হেনরি এ. থম্পসন *১৮৮৪ - জন সেন্ট জন ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল *১৮৮৮ - ক্লিনটন বি. ফিস্ক ও জন এ. ব্রুকস *১৮৯২ - জন বিডওয়েল ও জেমস বি. ক্র্যানফিল *১৮৯৬ - জোশুয়া লেভারিং ও হেল জনসন *১৯০০ - জন জি. উলি ও হেনরি বি. মেটকাফ *১৯০৪ - সাইলাস সি. সোয়ালো ও জর্জ ডব্লিউ. ক্যারল *১৯০৮ - ইউজিন ডব্লিউ. চ্যাফিন ও অ্যারন এস. ওয়াটকিনস *১৯১২ - ইউজিন ডব্লিউ. চ্যাফিন ও অ্যারন এস. ওয়াটকিনস *১৯১৬ - ফ্রাঙ্ক হ্যানলি ও আইরা ল্যান্ডরিথ *১৯২০ - অ্যারন ওয়াটকিনস ও ডি. লি কলভিন *১৯২৪ - হারম্যান পি. ফ্যারিস ও মারি সি. ব্রেম *১৯২৮ - উইলিয়াম এফ. ভার্নি ও জেমস এ. এজারটন *১৯৩২ - উইলিয়াম ডি. আপশ' ও ফ্রাঙ্ক এস. রেগান *১৯৩৬ - ডি. লি কলভিন ও ক্লড এ. ওয়াটসন *১৯৪০ - রজার বেবসন ও এডগার ভি. মুরম্যান *১৯৪৪ - ক্লড এ. ওয়াটসন ও অ্যান্ড্রু জনসন *১৯৪৮ - ক্লড এ. ওয়াটসন ও ডেল এইচ. লার্ন *১৯৫২ - স্টুয়ার্ট হ্যামব্লেন ও ইনোক এ. হোল্টউইক *১৯৫৬ - ইনোক এ. হোল্টউইক ও এডউইন এম. কুপার *১৯৬০ - রাদারফোর্ড ডেকার ও ই. হ্যারল্ড মান *১৯৬৪ - ই. হ্যারল্ড মান ও মার্ক আর. শ *১৯৬৮ - ই. হ্যারল্ড মান ও রোল্যান্ড ই. ফিশার *১৯৭২ - ই. হ্যারল্ড মান ও মার্শাল ই. আনক্যাফার *১৯৭৬ - বেঞ্জামিন সি. বুবার ও আর্ল এফ. ডজ *১৯৮০ - বেঞ্জামিন সি. বুবার ও আর্ল এফ. ডজ *১৯৮৪ - আর্ল ডজ ও ওয়ারেন সি. মার্টিন *১৯৮৮ - আর্ল ডজ ও জর্জ অরমসবাই *১৯৯২ - আর্ল ডজ ও জর্জ অরমসবাই *১৯৯৬ - আর্ল ডজ ও র‍্যাচেল বুবার কেলি *২০০০ - আর্ল ডজ ও ডব্লিউ. ডিন ওয়াটকিনস *২০০৪ - আর্ল ডজ ও হাওয়ার্ড লিডিক, জিন অ্যামন্ডসন ও লেরয় প্লেটেন *২০০৮ - জিন অ্যামন্ডসন ও লেরয় প্লেটেন *২০১২ - জ্যাক ফেলিউর ও টবি ডেভিস</td> <td> (ভোটের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকবে - এখানে শুধুমাত্র অনুবাদ চাওয়া হয়েছে)</td> <td> *যদিও প্রোহিবিশন পার্টি কখনও রাষ্ট্রপতি পদে জয়লাভ করেনি, এদের মূল ইস্যু মদ নিষিদ্ধকরণ মার্কিন সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। সংশোধনীটি কার্যকর হয় ১৭ জানুয়ারি ১৯২০-এ। *দেশব্যাপী মদ নিষিদ্ধকরণ শেষ হয় সংবিধানের একবিংশ সংশোধনী দ্বারা যা ৫ ডিসেম্বর ১৯৩৩-এ অনুমোদিত হয় এবং অষ্টাদশ সংশোধনীকে বাতিল করে।</td> </tr> <tr><td>৬</td> <td>[[w:Libertarian Party (United States)|লিবার্টেরিয়ান]]</td> <td> *১৯৭২ - জন হসপার্স ও টোনি নাথান *১৯৭৬ - রজার ম্যাকব্রাইড ও ডেভিড পি. বারগল্যান্ড *১৯৮০ - এড ক্লার্ক ও ডেভিড এইচ. কোচ *১৯৮৪ - ডেভিড পি. বারগল্যান্ড ও জেমস এ. লুইস *১৯৮৮ - রন পল ও আন্দ্রে মারু *১৯৯২ - আন্দ্রে মারু ও ন্যান্সি লর্ড *১৯৯৬ - হ্যারি ব্রাউন ও জো জর্জেনসন *২০০০ - হ্যারি ব্রাউন ও আর্ট অলিভিয়ার *২০০৪ - মাইকেল ব্যাডনারিক ও রিচার্ড ভি. ক্যাম্পাগনা *২০০৮ - বব বার ও ওয়েইন অ্যালিন রুট *২০১২ - গ্যারি জনসন ও জিম গ্রে</td> <td> (ভোটের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকবে)</td> <td> *হসপার্স ও নাথান প্রত্যেকে একটি ইলেকটোরাল ভোট পান, যার ফলে নাথান মার্কিন ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন</td> </tr> <tr><td>৭</td> <td>[[w:Green Party of the United States|গ্রিন]]</td> <td> *১৯৯৬ - রালফ ন্যাডার ও উইনোনা লাডিউক *২০০০ - রালফ ন্যাডার ও উইনোনা লাডিউক *২০০৪ - ডেভিড কোব ও প্যাট লা মার্শ *২০০৮ - সিনথিয়া ম্যাককিনি ও রোসা ক্লেমেন্টে *২০১২ - জিল স্টেইন ও চেরি হঙ্কালা</td> <td> (ভোটের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে)</td> <td></td> </tr> <tr><td>৮</td> <td>[[w:Workers World Party|ওয়ার্কার্স ওয়ার্ল্ড]]</td> <td> *গ্লোরিয়া লা রিভা *মোনিকা মুরহেড</td> <td></td> <td></td> </tr> <tr><td>৯</td> <td>[[w:Socialist Workers Party (United States)|সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স]]</td> <td> * ফারেল ডবস *ফ্রেড হ্যালস্টেড *লিন্ডা জেনেস *রোজার ক্যালেরো</td> <td></td> <td></td> </tr> </table> {{chapnav|প্রধান বিচারপতি|লেখকগণ}} baqm5j6inidr1fd58g1mtz4at7ny41e রাজনৈতিক যোগাযোগের উপাদান/প্রচলিত মিডিয়া নির্দেশিকা/মতামত কলাম ও সম্পাদককে চিঠি 0 25886 85448 83677 2025-06-30T15:38:20Z Mehedi Abedin 7113 85448 wikitext text/x-wiki {{DISPLAYTITLE:<span style="display:block;text-align:left;font-size:.6em;font-family:Times;font-style:italic;line-height:1em;">রাজনৈতিক যোগাযোগের উপাদান:</span> <span style="margin-left:5%;font-family:Times;">প্রচলিত গণমাধ্যমের নির্দেশিকা – মতামত নিবন্ধ ও সম্পাদককে লেখা চিঠি</span>}} [[File:Writing a letter.jpg|thumb|alt=কাছ থেকে একটি ফাউন্টেন পেন ও একটি কিছুটা অস্পষ্ট কাগজপত্রের (সম্ভবত একটি সংবাদপত্র) ছবি।|আপনি যেভাবেই চিঠি লিখুন না কেন এই পরামর্শগুলো মেনে চললে তা প্রকাশের সম্ভাবনা বাড়ে।]] একটি সম্পাদককে লেখা চিঠি হলো একটি সংক্ষিপ্ত (প্রায় ২০০ শব্দের) লেখা যা প্রকাশনার সাম্প্রতিক সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট প্রবন্ধ বা বিষয়ের প্রতিক্রিয়ায় লেখা হয়। "অপ-এড" (op-ed) শব্দটি মূলত এসেছে "opposite of the editorial" অর্থে অর্থাৎ "সম্পাদকীয়র বিপরীত", “মতামত-সম্পাদকীয়” নয়। অপ-এড সাধারণত একটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের লেখা (প্রায় ৫০০ শব্দ) যা কোনো প্রকাশনা তাদের সম্পাদকীয় বোর্ডের অবস্থানের বিপরীতে মত প্রকাশের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তবে বর্তমান সময়ে এই বিভাজন অনেকটাই অস্পষ্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পাদককে লেখা চিঠি অনেক বড়ও হতে পারে আবার অপ-এড লেখাও প্রকাশনার পক্ষ থেকে অনুরোধে হওয়া প্রয়োজন নেই কিংবা তা সম্পাদকীয় বোর্ডের বিপরীত মত হওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। আপনি কোন ধরনের পরিস্থিতিতে লিখছেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনার লেখার কাঠামো কেমন হবে। তবুও, সম্পাদক আপনার লেখা পরিবর্তন করে দিতে পারেন। {{clear}} ==বিষয়বস্তু== আপনার পাঠক কারা এবং তারা কীভাবে আপনার উদ্দেশ্যে সহায়তা করতে পারে তা আগে বুঝে নিন। শুধু মত প্রকাশ করবেন না, একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তুলে ধরুন এবং পাঠকদের সামনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় তুলে ধরুন। অবস্থানের পক্ষে কথা বলার মানে হলো আপনার মতামত জানানো এবং পাঠককে বোঝানো এই বিষয়ে তাদের কী করা উচিত। যদি সমস্যা "ক" থেকে থাকে তবে সেটি কীভাবে সমাধান করা যায় তা ব্যাখ্যা করুন। যদি প্রার্থী "ক" কাজের জন্য সেরা ব্যক্তি হন তাহলে কীভাবে তাকে সমর্থন করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিন। সমর্থনের উদাহরণ হতে পারে, প্রচারণা বা কোনো বিষয়ভিত্তিক ওয়েবসাইটে যাওয়া, স্বেচ্ছাসেবক হওয়া, অথবা নির্দিষ্টভাবে ভোট দেওয়া। লেখাটি পুরো পাঠকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে লিখুন, কোনো একক ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নয়। প্রতিটি প্রকাশনার নিজস্ব পাঠকবর্গ থাকে তাই এক লেখাকে একাধিক জায়গায় পাঠানো উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ ''দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস''-এ স্থানীয় কোনো নির্বাচনের বিষয়ে লেখা সময়ের অপচয় ঠিক যেমনটি জাতীয় কোনো ইস্যুতে পক্ষপাতদুষ্ট লেখা স্থানীয় পত্রিকার জন্যও উপযুক্ত নয়। সম্পাদকরা সাধারণত নিছক প্রচলিত বক্তব্যের চেয়ে ব্যক্তিগত অভিমতের প্রকাশ বেশি পছন্দ করেন। নিজের স্বার্থ জড়িত এমন গল্প সম্বলিত চিঠিগুলো প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে।<ref>[[Elements of Political Communication/References#CITEREFWahl-Jorgensen2001|Wahl-Jorgensen, "Letters to the Editor as a Forum"]], ৩১৪–৩১৮।</ref> আপনার মতামত কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরুন। অনেক সময় আমরা তথ্য ও পরিসংখ্যানে ভরা একটি তালিকা তৈরি করতে চাই। কিন্তু সেটিই একটি অপ-এড বা সম্পাদককে লেখা চিঠির মূল উদ্দেশ্য নয়। উপমা, সংক্ষিপ্ত গল্প বা যুক্তিযুক্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্য এসব রেটরিক্যাল কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে আপনার মতের প্রতি আরও সহজে বিশ্বাসী করা যায় যা কেবল পরিসংখ্যানে সম্ভব নয়। ==বিন্যাস== আপনার লেখা ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের মধ্যে হওয়া উচিত। তার চেয়ে ছোট হলে চলবে তবে প্রকাশিত পৃষ্ঠায় এর জায়গা কম থাকবে। ফন্ট মার্জিন কিংবা অন্যান্য বিন্যাসের বিষয়গুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যদি না আপনার নথিপত্রে অপ্রচলিত বা অস্বস্তিকর কোনো মার্কআপ ব্যবহার করা হয়। যদি আপনি পিডিএফ ফাইল বা ডাকযোগে পাঠান তাহলে তা সম্পাদকের জন্য অতিরিক্ত ঝামেলা তৈরি করে ফলে তা প্রকাশের সম্ভাবনা কমে যায়। অনুচ্ছেদ বিভাজন এবং শিরোনাম কীভাবে হবে তা ঠিক করবেন সম্পাদক। ===কীভাবে লিখবেন=== একটি অপ-এড বা সম্পাদকীয় চিঠি লেখার সময় এক বা দুই বাক্যে আপনি যেভাবে বিষয়টি অনুভব করছেন সেটি সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করুন। এরপর কয়েকটি বাক্যে বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করুন। যদিও এটি প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে যদি আপনি এমন একটি জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখছেন যা বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এরপর এক বা দুইটি ছোট অনুচ্ছেদে আপনি কেন এই মত পোষণ করছেন তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করুন। এরপর পাঠকরা এই বিষয়ের জন্য কী করতে পারেন সে বিষয়ে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী পরামর্শ দিন। এই কর্মের আহ্বানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি না থাকলে পাঠকরা হয়তো আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হলেও কিছু করার প্রেরণা পাবেন না। আপনি যদি তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন তাহলে তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নাও নিতে পারেন। লেখার শুরুতে ফিরে যান এবং সংক্ষেপে বলুন আপনি কে এবং প্রাসঙ্গিক যেকোনো তথ্য উল্লেখ করুন। সম্ভব হলে এমন একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে বের করুন যেখান থেকে আপনি বিষয়টিকে দেখতে পারেন এবং সেটি ভূমিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। শেষে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার লিখুন, সম্ভব হলে একটি বাক্যে একটি জোরালো মন্তব্য করুন যা ভূমিকার সেই অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে লেখা হয়। অনেক লেখক প্রভাবশালী ভূমিকা ও উপসংহার লেখা নিয়ে হতাশ হন কিন্তু এই কৌশলটি এই অংশগুলো লেখা সহজ করে তোলে। লেখা জমা দেওয়ার আগে যাচাই করুন নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনার লেখায় আছে কি না: * আপনি কে এবং আপনি বিষয় "ক"-এর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? * বিষয় ক কেন গুরুত্বপূর্ণ? * ক নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? * ক নিয়ে আপনি কেন এভাবে ভাবছেন? * আমরা ক নিয়ে কী করতে পারি? এই গঠনশৈলী অবশ্যই কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে এমন নয়। তবে এটি একজন লেখককে ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের একটি শক্তিশালী লেখা তৈরি করতে সহায়তা করবে। নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যান। ==উদাহরণ== {{hiddenh3|সাধারণ প্রার্থী সমর্থনপত্র}} {{quotation|কয়েকদিন আগে আমি শহর ক-এর আমার আবাসিক এলাকায় দৌড়াচ্ছিলাম, যেখানে আমি গত কয়েক বছর ধরে বাস করছি। ডাকবাক্সের ফাঁক দিয়ে আর ফুটপাথ বেয়ে ওঠার সময়, আমি ''টাউন গ্যাজেট''-এর সামনের পাতায় একটি শিরোনাম দেখতে পেলাম। সেখানে লেখা ছিল "প্রার্থী ক নির্বাচনে প্রার্থী ক-কে চ্যালেঞ্জ করবেন"।<br /><br /> এই নির্বাচন নির্ধারণ করবে কে আমাদের সম্প্রদায়কে আগামী বহু বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এই এলাকার প্রতিনিধিরা এমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর ওপর ভোট দেন, যা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই এসব জরুরি বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।<br /><br /> আমি প্রার্থী ক-এর পক্ষের মানুষ। আমি প্রার্থী খ-এর বিপক্ষে।<br /><br /> প্রার্থী ল বহু বছর ধরে বিভিন্ন বোর্ড ও কমিটিতে কাজ করে তার কমিউনিটির জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা বোর্ডে কয়েক বছর কাজ করা, যা গত বছর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি সব সময় নাগরিকদের সাহায্য করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিপরীতে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বারবার এসব বিষয় এড়িয়ে গেছেন। আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করছি, ভোটাররা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য এই প্রকাশনার ভোটার গাইডটি পড়েন। যে কেউ প্রার্থী ক-এর প্রচার শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন example.com, facebook.com/example, অথবা twitter.com/example-এ গিয়ে।<br /><br /> আমি জানি না আমার কথা প্রার্থীদের প্রচারণার ধরন বদলাতে পারবে কি না। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটি আমার দৌড়ের ধরন বদলে দেবে: এখন থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমি "প্রার্থী ক-কে ভোট দিন" লেখা টি-শার্ট পরে শহর গ-এ দৌড়াবো।<br /><br /> -নাম}} এই উদাহরণটি খুবই সাধারণ, তবে এটি লেখককে নিশ্চিত করে যে তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একইসঙ্গে এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সম্ভব হলে, আপনার ইতিবাচক দিকগুলো নির্দিষ্ট করে বলুন। যেমন, উপরের চিঠিতে "অনেক বছর" কথাটির পরিবর্তে যদি সেই প্রার্থীর আসলে কত বছরের অভিজ্ঞতা আছে তা লেখা যায় (ধরা হয় যদি সেই সময়কাল পদের জন্য যুক্তিযুক্ত হয়), তাহলে তা আরও ভালো হয়। {{hiddenh3|সাধারণ ইস্যুতে সমর্থনপত্র}} {{quotation|প্রিয় সম্পাদক,<br /><br /> উফ! বাইরে কী প্রচণ্ড গরম! এই ধরণের দিনগুলোই আমাদের ঘরের ভেতরে থাকতে বাধ্য করে, আর এয়ার কন্ডিশনারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় স্বস্তি নিতে হয়।<br /><br /> কিন্তু সবাই এমন সুবিধা পান না। মাঝে মাঝে ভাবলে ভয় লাগে, বাইরে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা এইরকম প্রচণ্ড গরমের সময় সূর্যের তাপ থেকে রেহাই পান না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো এমন সময় সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকেন। আমি এখন প্রতিদিন আমার দাদীকে ফোন করি—দেখি তিনি ভালো আছেন কিনা, পানি খাচ্ছেন কিনা।<br /><br /> শহরের আরও অনেক মানুষও কষ্টে আছেন। মনে হয় আমাদের সমাজের উচিত এই সমস্যার একটা সমাধান বের করা। কিন্তু প্রতিবারই এটা আমাদের আশ্চর্য করে দেয়।<br /><br /> এই কারণেই আমি আমাদের শহরে "জেনেরিক হোম ফান্ড গ্রান্ট" নামক অনুদান কর্মসূচির সম্প্রসারণের পক্ষে। শহরটি এই অনুদান প্রদান করে নিম্নআয়ের মানুষদের, যারা নিজের বাসায় উন্নয়নের জন্য যেমন দক্ষ এয়ার কন্ডিশনার বসানোর মতো খরচ চালাতে চান।<br /><br /> আমরা অনেক সময় নিজেদের সুবিধাগুলোকে স্বাভাবিক ধরে নিই। তবে আপনি যখন নিজের ঠাণ্ডা ঘরে বসে আরাম নিচ্ছেন, তখন পাশের বাড়ির মানুষদের কথাও ভাবুন। আজই শহরের ওয়েবসাইট example.com-এ গিয়ে আপনার সিটি কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, আর বলুন তারা যেন এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেন। এটি শুধু দাদীর জন্য নয়; এটা আমাদের পুরো কমিউনিটির জন্য ভালো উদ্যোগ।<br /><br /> -নাম}} এই চিঠিটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনানুষ্ঠানিক হলেও, এটি একটি গুরুতর বিষয়ে সম্মানজনক ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে "কিন্তু" দিয়ে শুরু হওয়া বাক্যটি গম্ভীরতায় একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে, তবে লেখার ধরণটি একই রয়ে গেছে। ==পুনর্মূল্যায়ন== {{quiz|question=নিম্নের কোন বাক্যটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি বিশ্বাস করি প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |b=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |c=ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদে ভোট দিন প্রার্থী ক-কে, ২ নভেম্বর তারিখে। |d=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, এবং আমি ভোটারদের উৎসাহ দিচ্ছি যাতে তারা ২ নভেম্বর তারিখে ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদের জন্য তাকে ভোট দেন। |answer='''ঘ।''' প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্পে মত প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু পাঠকের করার মতো কোনো কাজ উল্লেখ নেই। তৃতীয়টিতে কাজের আহ্বান আছে, কিন্তু মত প্রকাশ নেই।}} {{quiz|question=নিচের কোন সম্বোধনটি সবচেয়ে উপযুক্ত? |a=সাংবাদিক ল, গত মাসে আপনার প্রতিবেদন ছিল পক্ষপাতদুষ্ট… |b=''দ্য মর্নিং''-এর সকল হিস্পানিক পাঠকদের প্রতি,… |c=প্রিয় পাঠকবৃন্দ,… |d=যার উদ্দেশ্যে হতে পারে,… |answer='''গ।''' সম্পাদকীয় চিঠির ক্ষেত্রে সম্বোধন খুব একটা প্রয়োজন হয় না, আর অপ-এডের ক্ষেত্রে কখনই নয়। তবে যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে এমন কিছু ব্যবহার করুন যা সকল পাঠকের জন্য প্রযোজ্য হয় (যেমন "প্রিয় সম্পাদক")। সংবাদপত্রগুলো সাধারণত শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি ছাপায় না।}} {{quiz|question=নিচের কোন ব্যক্তিগত বর্ণনাটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে এই সম্প্রদায়কে সেবা দিয়েছি। এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি ককক৯অ বিবেচনা করবে, যা এই দারুণ কর্মসূচির জন্য অঙ্গরাজ্যের অর্থায়ন কমিয়ে দেবে। |b=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর শেষ ৮ বছর আমি বিভিন্ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবা করেছি, যার মধ্যে ফাউন্ডেশন অ, ফাউন্ডেশন আ, ফাউন্ডেশন খ, এবং আরও অনেক সংস্থা রয়েছে। এই অধিবেশনে সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, এটি একটি চমৎকার কর্মসূচি। |c=এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অঙ্গরাজ্য অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, যেখানে আমি গত ৮ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি। আমি শহর ক-এ ১২ বছর ধরে বাস করছি। |d=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, কিন্তু এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা এই কর্মসূচির অর্থায়ন কমিয়ে দেবে—যার জন্য আমি এত পরিশ্রম করেছি। |answer='''ক।''' দ্বিতীয় বিকল্পে অতিরিক্ত তথ্য রয়েছে যা লেখার প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে। ধরে নেওয়া হয় পাঠক কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতেই আগ্রহী। তৃতীয়টি উল্টোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে: ব্যক্তিগত দিকটি মূল বক্তব্যে যাওয়ার সেতু হওয়া উচিত, উল্টো নয়। চতুর্থটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত মনে হয়, ফলে পাঠক মনে করতে পারে বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে আপনার নিয়ে, ফাউন্ডেশন নয়।}} {{quiz|question=নিচের কোন আবেদন সবচেয়ে কার্যকর? |a=২০০৭–২০০৮ শিক্ষাবর্ষে, ইউআইএল অ্যানাবলিক স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য ১০,১১৭টি পরীক্ষা নিয়েছিল, যার মধ্যে ৬,৪৫৫ জন পুরুষ ও ৩,৬৬২ জন মহিলা ছিল। মাত্র দুটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৮ সালের শরৎ: ১৮,৮১৭টি পরীক্ষা, ৭টি CP। ২০০৯ সালের বসন্ত: ১৬,২৬০টি পরীক্ষা, ৮টি CP। ২০০৯ শরৎ: ৩,১৩৩টি পরীক্ষা, ২টি CP। ২০১০ বসন্ত: ৩,৩০৮টি পরীক্ষা, ০টি CP। ২০১০ শরৎ: ২,০৮৩টি পরীক্ষা, ১টি CP। |b=ভাবুন তো, প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার ছাত্রকে এমন একটি জিনিসের জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা আপনি ধরেই নিয়েছেন তাদের নেই। এটিই মূলত হাইস্কুল স্টেরয়েড পরীক্ষার বাস্তবতা। |c=ভাবুন তো, ২০০৭ সালে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৬,৪৫৫ জন ছেলে ও ৩,৬৬২ জন মেয়েকে এলোমেলোভাবে স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। |d=২০০৭ সালে আমরা কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাইস্কুল ছাত্রদের জন্য ১০,১১৭টি স্টেরয়েড পরীক্ষা চালিয়েছি, আর মাত্র দুটি পজিটিভ পেয়েছি। ২০০৮ সালে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, এরপর আমরা কর্মসূচিটি অনেক কমিয়ে ফেলেছি। |answer='''B.''' যদিও এটি তেমন নির্দিষ্ট নয়, দ্বিতীয় বিকল্পটি প্রথম বাক্যের একটি সংক্ষিপ্ত, আলঙ্কারিক রূপ। প্রয়োজনে বাকি লেখায় গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান যোগ করা যায়।}} ==টীকা== {{reflist}} {{chapnav||Press releases}} __NOTOC__ 4q27nrwhr9vwk076t2pa0ml7dvz75ih 85451 85448 2025-06-30T15:42:49Z Mehedi Abedin 7113 85451 wikitext text/x-wiki {{DISPLAYTITLE:<span style="display:block;text-align:left;font-size:.6em;font-family:Times;font-style:italic;line-height:1em;">রাজনৈতিক যোগাযোগের উপাদান:</span> <span style="margin-left:5%;font-family:Times;">প্রচলিত গণমাধ্যমের নির্দেশিকা – মতামত নিবন্ধ ও সম্পাদককে লেখা চিঠি</span>}} [[File:Writing a letter.jpg|thumb|alt=কাছ থেকে একটি ফাউন্টেন পেন ও একটি কিছুটা অস্পষ্ট কাগজপত্রের (সম্ভবত একটি সংবাদপত্র) ছবি।|আপনি যেভাবেই চিঠি লিখুন না কেন এই পরামর্শগুলো মেনে চললে তা প্রকাশের সম্ভাবনা বাড়ে।]] একটি সম্পাদককে লেখা চিঠি হলো একটি সংক্ষিপ্ত (প্রায় ২০০ শব্দের) লেখা যা প্রকাশনার সাম্প্রতিক সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট প্রবন্ধ বা বিষয়ের প্রতিক্রিয়ায় লেখা হয়। "অপ-এড" (op-ed) শব্দটি মূলত এসেছে "opposite of the editorial" অর্থে অর্থাৎ "সম্পাদকীয়র বিপরীত", “মতামত-সম্পাদকীয়” নয়। অপ-এড সাধারণত একটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের লেখা (প্রায় ৫০০ শব্দ) যা কোনো প্রকাশনা তাদের সম্পাদকীয় বোর্ডের অবস্থানের বিপরীতে মত প্রকাশের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তবে বর্তমান সময়ে এই বিভাজন অনেকটাই অস্পষ্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পাদককে লেখা চিঠি অনেক বড়ও হতে পারে আবার অপ-এড লেখাও প্রকাশনার পক্ষ থেকে অনুরোধে হওয়া প্রয়োজন নেই কিংবা তা সম্পাদকীয় বোর্ডের বিপরীত মত হওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। আপনি কোন ধরনের পরিস্থিতিতে লিখছেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনার লেখার কাঠামো কেমন হবে। তবুও, সম্পাদক আপনার লেখা পরিবর্তন করে দিতে পারেন। {{clear}} ==বিষয়বস্তু== আপনার পাঠক কারা এবং তারা কীভাবে আপনার উদ্দেশ্যে সহায়তা করতে পারে তা আগে বুঝে নিন। শুধু মত প্রকাশ করবেন না, একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তুলে ধরুন এবং পাঠকদের সামনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় তুলে ধরুন। অবস্থানের পক্ষে কথা বলার মানে হলো আপনার মতামত জানানো এবং পাঠককে বোঝানো এই বিষয়ে তাদের কী করা উচিত। যদি সমস্যা "ক" থেকে থাকে তবে সেটি কীভাবে সমাধান করা যায় তা ব্যাখ্যা করুন। যদি প্রার্থী "ক" কাজের জন্য সেরা ব্যক্তি হন তাহলে কীভাবে তাকে সমর্থন করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিন। সমর্থনের উদাহরণ হতে পারে, প্রচারণা বা কোনো বিষয়ভিত্তিক ওয়েবসাইটে যাওয়া, স্বেচ্ছাসেবক হওয়া, অথবা নির্দিষ্টভাবে ভোট দেওয়া। লেখাটি পুরো পাঠকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে লিখুন, কোনো একক ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নয়। প্রতিটি প্রকাশনার নিজস্ব পাঠকবর্গ থাকে তাই এক লেখাকে একাধিক জায়গায় পাঠানো উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ ''দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস''-এ স্থানীয় কোনো নির্বাচনের বিষয়ে লেখা সময়ের অপচয় ঠিক যেমনটি জাতীয় কোনো ইস্যুতে পক্ষপাতদুষ্ট লেখা স্থানীয় পত্রিকার জন্যও উপযুক্ত নয়। সম্পাদকরা সাধারণত নিছক প্রচলিত বক্তব্যের চেয়ে ব্যক্তিগত অভিমতের প্রকাশ বেশি পছন্দ করেন। নিজের স্বার্থ জড়িত এমন গল্প সম্বলিত চিঠিগুলো প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে।<ref>[[Elements of Political Communication/References#CITEREFWahl-Jorgensen2001|Wahl-Jorgensen, "Letters to the Editor as a Forum"]], ৩১৪–৩১৮।</ref> আপনার মতামত কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরুন। অনেক সময় আমরা তথ্য ও পরিসংখ্যানে ভরা একটি তালিকা তৈরি করতে চাই। কিন্তু সেটিই একটি অপ-এড বা সম্পাদককে লেখা চিঠির মূল উদ্দেশ্য নয়। উপমা, সংক্ষিপ্ত গল্প বা যুক্তিযুক্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্য এসব রেটরিক্যাল কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে আপনার মতের প্রতি আরও সহজে বিশ্বাসী করা যায় যা কেবল পরিসংখ্যানে সম্ভব নয়। ==বিন্যাস== আপনার লেখা ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের মধ্যে হওয়া উচিত। তার চেয়ে ছোট হলে চলবে তবে প্রকাশিত পৃষ্ঠায় এর জায়গা কম থাকবে। ফন্ট মার্জিন কিংবা অন্যান্য বিন্যাসের বিষয়গুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যদি না আপনার নথিপত্রে অপ্রচলিত বা অস্বস্তিকর কোনো মার্কআপ ব্যবহার করা হয়। যদি আপনি পিডিএফ ফাইল বা ডাকযোগে পাঠান তাহলে তা সম্পাদকের জন্য অতিরিক্ত ঝামেলা তৈরি করে ফলে তা প্রকাশের সম্ভাবনা কমে যায়। অনুচ্ছেদ বিভাজন এবং শিরোনাম কীভাবে হবে তা ঠিক করবেন সম্পাদক। ===কীভাবে লিখবেন=== একটি অপ-এড বা সম্পাদকীয় চিঠি লেখার সময় এক বা দুই বাক্যে আপনি যেভাবে বিষয়টি অনুভব করছেন সেটি সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করুন। এরপর কয়েকটি বাক্যে বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করুন। যদিও এটি প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে যদি আপনি এমন একটি জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখছেন যা বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এরপর এক বা দুইটি ছোট অনুচ্ছেদে আপনি কেন এই মত পোষণ করছেন তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করুন। এরপর পাঠকরা এই বিষয়ের জন্য কী করতে পারেন সে বিষয়ে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী পরামর্শ দিন। এই কর্মের আহ্বানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি না থাকলে পাঠকরা হয়তো আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হলেও কিছু করার প্রেরণা পাবেন না। আপনি যদি তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন তাহলে তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নাও নিতে পারেন। লেখার শুরুতে ফিরে যান এবং সংক্ষেপে বলুন আপনি কে এবং প্রাসঙ্গিক যেকোনো তথ্য উল্লেখ করুন। সম্ভব হলে এমন একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে বের করুন যেখান থেকে আপনি বিষয়টিকে দেখতে পারেন এবং সেটি ভূমিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। শেষে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার লিখুন, সম্ভব হলে একটি বাক্যে একটি জোরালো মন্তব্য করুন যা ভূমিকার সেই অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে লেখা হয়। অনেক লেখক প্রভাবশালী ভূমিকা ও উপসংহার লেখা নিয়ে হতাশ হন কিন্তু এই কৌশলটি এই অংশগুলো লেখা সহজ করে তোলে। লেখা জমা দেওয়ার আগে যাচাই করুন নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনার লেখায় আছে কি না: * আপনি কে এবং আপনি বিষয় "ক"-এর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? * বিষয় ক কেন গুরুত্বপূর্ণ? * ক নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? * ক নিয়ে আপনি কেন এভাবে ভাবছেন? * আমরা ক নিয়ে কী করতে পারি? এই গঠনশৈলী অবশ্যই কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে এমন নয়। তবে এটি একজন লেখককে ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের একটি শক্তিশালী লেখা তৈরি করতে সহায়তা করবে। নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যান। ==উদাহরণ== {{hiddenh3|সাধারণ প্রার্থী সমর্থনপত্র}} {{quotation|কয়েকদিন আগে আমি শহর ক-এর আমার আবাসিক এলাকায় দৌড়াচ্ছিলাম, যেখানে আমি গত কয়েক বছর ধরে বাস করছি। ডাকবাক্সের ফাঁক দিয়ে আর ফুটপাথ বেয়ে ওঠার সময়, আমি ''টাউন গ্যাজেট''-এর সামনের পাতায় একটি শিরোনাম দেখতে পেলাম। সেখানে লেখা ছিল "প্রার্থী ক নির্বাচনে প্রার্থী ক-কে চ্যালেঞ্জ করবেন"।<br /><br /> এই নির্বাচন নির্ধারণ করবে কে আমাদের সম্প্রদায়কে আগামী বহু বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এই এলাকার প্রতিনিধিরা এমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর ওপর ভোট দেন, যা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই এসব জরুরি বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।<br /><br /> আমি প্রার্থী ক-এর পক্ষের মানুষ। আমি প্রার্থী খ-এর বিপক্ষে।<br /><br /> প্রার্থী ল বহু বছর ধরে বিভিন্ন বোর্ড ও কমিটিতে কাজ করে তার কমিউনিটির জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা বোর্ডে কয়েক বছর কাজ করা, যা গত বছর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি সব সময় নাগরিকদের সাহায্য করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিপরীতে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বারবার এসব বিষয় এড়িয়ে গেছেন। আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করছি, ভোটাররা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য এই প্রকাশনার ভোটার গাইডটি পড়েন। যে কেউ প্রার্থী ক-এর প্রচার শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন example.com, facebook.com/example, অথবা twitter.com/example-এ গিয়ে।<br /><br /> আমি জানি না আমার কথা প্রার্থীদের প্রচারণার ধরন বদলাতে পারবে কি না। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটি আমার দৌড়ের ধরন বদলে দেবে: এখন থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমি "প্রার্থী ক-কে ভোট দিন" লেখা টি-শার্ট পরে শহর গ-এ দৌড়াবো।<br /><br /> -নাম}} এই উদাহরণটি খুবই সাধারণ, তবে এটি লেখককে নিশ্চিত করে যে তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একইসঙ্গে এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সম্ভব হলে, আপনার ইতিবাচক দিকগুলো নির্দিষ্ট করে বলুন। যেমন, উপরের চিঠিতে "অনেক বছর" কথাটির পরিবর্তে যদি সেই প্রার্থীর আসলে কত বছরের অভিজ্ঞতা আছে তা লেখা যায় (ধরা হয় যদি সেই সময়কাল পদের জন্য যুক্তিযুক্ত হয়), তাহলে তা আরও ভালো হয়। {{hiddenh3|সাধারণ ইস্যুতে সমর্থনপত্র}} {{quotation|প্রিয় সম্পাদক,<br /><br /> উফ! বাইরে কী প্রচণ্ড গরম! এই ধরণের দিনগুলোই আমাদের ঘরের ভেতরে থাকতে বাধ্য করে, আর এয়ার কন্ডিশনারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় স্বস্তি নিতে হয়।<br /><br /> কিন্তু সবাই এমন সুবিধা পান না। মাঝে মাঝে ভাবলে ভয় লাগে, বাইরে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা এইরকম প্রচণ্ড গরমের সময় সূর্যের তাপ থেকে রেহাই পান না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো এমন সময় সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকেন। আমি এখন প্রতিদিন আমার দাদীকে ফোন করি—দেখি তিনি ভালো আছেন কিনা, পানি খাচ্ছেন কিনা।<br /><br /> শহরের আরও অনেক মানুষও কষ্টে আছেন। মনে হয় আমাদের সমাজের উচিত এই সমস্যার একটা সমাধান বের করা। কিন্তু প্রতিবারই এটা আমাদের আশ্চর্য করে দেয়।<br /><br /> এই কারণেই আমি আমাদের শহরে "জেনেরিক হোম ফান্ড গ্রান্ট" নামক অনুদান কর্মসূচির সম্প্রসারণের পক্ষে। শহরটি এই অনুদান প্রদান করে নিম্নআয়ের মানুষদের, যারা নিজের বাসায় উন্নয়নের জন্য যেমন দক্ষ এয়ার কন্ডিশনার বসানোর মতো খরচ চালাতে চান।<br /><br /> আমরা অনেক সময় নিজেদের সুবিধাগুলোকে স্বাভাবিক ধরে নিই। তবে আপনি যখন নিজের ঠাণ্ডা ঘরে বসে আরাম নিচ্ছেন, তখন পাশের বাড়ির মানুষদের কথাও ভাবুন। আজই শহরের ওয়েবসাইট example.com-এ গিয়ে আপনার সিটি কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, আর বলুন তারা যেন এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেন। এটি শুধু দাদীর জন্য নয়; এটা আমাদের পুরো কমিউনিটির জন্য ভালো উদ্যোগ।<br /><br /> -নাম}} এই চিঠিটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনানুষ্ঠানিক হলেও, এটি একটি গুরুতর বিষয়ে সম্মানজনক ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে "কিন্তু" দিয়ে শুরু হওয়া বাক্যটি গম্ভীরতায় একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে, তবে লেখার ধরণটি একই রয়ে গেছে। ==পুনর্মূল্যায়ন== {{quiz|question=নিম্নের কোন বাক্যটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি বিশ্বাস করি প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |b=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |c=ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদে ভোট দিন প্রার্থী ক-কে, ২ নভেম্বর তারিখে। |d=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, এবং আমি ভোটারদের উৎসাহ দিচ্ছি যাতে তারা ২ নভেম্বর তারিখে ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদের জন্য তাকে ভোট দেন। |answer='''ঘ।''' প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্পে মত প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু পাঠকের করার মতো কোনো কাজ উল্লেখ নেই। তৃতীয়টিতে কাজের আহ্বান আছে, কিন্তু মত প্রকাশ নেই।}} {{quiz|question=নিচের কোন সম্বোধনটি সবচেয়ে উপযুক্ত? |a=সাংবাদিক ল, গত মাসে আপনার প্রতিবেদন ছিল পক্ষপাতদুষ্ট… |b=''দ্য মর্নিং''-এর সকল হিস্পানিক পাঠকদের প্রতি,… |c=প্রিয় পাঠকবৃন্দ,… |d=যার উদ্দেশ্যে হতে পারে,… |answer='''গ।''' সম্পাদকীয় চিঠির ক্ষেত্রে সম্বোধন খুব একটা প্রয়োজন হয় না, আর অপ-এডের ক্ষেত্রে কখনই নয়। তবে যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে এমন কিছু ব্যবহার করুন যা সকল পাঠকের জন্য প্রযোজ্য হয় (যেমন "প্রিয় সম্পাদক")। সংবাদপত্রগুলো সাধারণত শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি ছাপায় না।}} {{quiz|question=নিচের কোন ব্যক্তিগত বর্ণনাটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে এই সম্প্রদায়কে সেবা দিয়েছি। এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি ককক৯অ বিবেচনা করবে, যা এই দারুণ কর্মসূচির জন্য অঙ্গরাজ্যের অর্থায়ন কমিয়ে দেবে। |b=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর শেষ ৮ বছর আমি বিভিন্ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবা করেছি, যার মধ্যে ফাউন্ডেশন অ, ফাউন্ডেশন আ, ফাউন্ডেশন খ, এবং আরও অনেক সংস্থা রয়েছে। এই অধিবেশনে সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, এটি একটি চমৎকার কর্মসূচি। |c=এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অঙ্গরাজ্য অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, যেখানে আমি গত ৮ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি। আমি শহর ক-এ ১২ বছর ধরে বাস করছি। |d=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, কিন্তু এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা এই কর্মসূচির অর্থায়ন কমিয়ে দেবে—যার জন্য আমি এত পরিশ্রম করেছি। |answer='''ক।''' দ্বিতীয় বিকল্পে অতিরিক্ত তথ্য রয়েছে যা লেখার প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে। ধরে নেওয়া হয় পাঠক কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতেই আগ্রহী। তৃতীয়টি উল্টোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে: ব্যক্তিগত দিকটি মূল বক্তব্যে যাওয়ার সেতু হওয়া উচিত, উল্টো নয়। চতুর্থটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত মনে হয়, ফলে পাঠক মনে করতে পারে বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে আপনার নিয়ে, ফাউন্ডেশন নয়।}} {{quiz|question=নিচের কোন আবেদন সবচেয়ে কার্যকর? |a=২০০৭–২০০৮ শিক্ষাবর্ষে, ইউআইএল অ্যানাবলিক স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য ১০,১১৭টি পরীক্ষা নিয়েছিল, যার মধ্যে ৬,৪৫৫ জন পুরুষ ও ৩,৬৬২ জন মহিলা ছিল। মাত্র দুটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৮ সালের অটাম: ১৮,৮১৭টি পরীক্ষা, ৭টি সিপি। ২০০৯ সালের স্প্রিং: ১৬,২৬০টি পরীক্ষা, ৮টি সিপি। ২০০৯ অটাম: ৩,১৩৩টি পরীক্ষা, ২টি সিপি। ২০১০ স্প্রিং: ৩,৩০৮টি পরীক্ষা, ০টি সিপি। ২০১০ অটাম: ২,০৮৩টি পরীক্ষা, ১টি সিপি। |b=ভাবুন তো, প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার ছাত্রকে এমন একটি জিনিসের জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা আপনি ধরেই নিয়েছেন তাদের নেই। এটিই মূলত হাইস্কুল স্টেরয়েড পরীক্ষার বাস্তবতা। |c=ভাবুন তো, ২০০৭ সালে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৬,৪৫৫ জন ছেলে ও ৩,৬৬২ জন মেয়েকে এলোমেলোভাবে স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। |d=২০০৭ সালে আমরা কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাইস্কুল ছাত্রদের জন্য ১০,১১৭টি স্টেরয়েড পরীক্ষা চালিয়েছি, আর মাত্র দুটি পজিটিভ পেয়েছি। ২০০৮ সালে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, এরপর আমরা কর্মসূচিটি অনেক কমিয়ে ফেলেছি। |answer='''খ।''' যদিও এটি তেমন নির্দিষ্ট নয়, দ্বিতীয় বিকল্পটি প্রথম বাক্যের একটি সংক্ষিপ্ত, আলঙ্কারিক রূপ। প্রয়োজনে বাকি লেখায় গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান যোগ করা যায়।}} ==টীকা== {{reflist}} {{chapnav||Press releases}} __NOTOC__ nm04btffsq4ju22sdvi950t5t9axvfy 85453 85451 2025-06-30T15:46:09Z Mehedi Abedin 7113 85453 wikitext text/x-wiki {{DISPLAYTITLE:<span style="display:block;text-align:left;font-size:.6em;font-family:Times;font-style:italic;line-height:1em;">রাজনৈতিক যোগাযোগের উপাদান:</span> <span style="margin-left:5%;font-family:Times;">প্রচলিত গণমাধ্যমের নির্দেশিকা – মতামত নিবন্ধ ও সম্পাদককে লেখা চিঠি</span>}} [[File:Writing a letter.jpg|thumb|alt=কাছ থেকে একটি ফাউন্টেন পেন ও একটি কিছুটা অস্পষ্ট কাগজপত্রের (সম্ভবত একটি সংবাদপত্র) ছবি।|আপনি যেভাবেই চিঠি লিখুন না কেন এই পরামর্শগুলো মেনে চললে তা প্রকাশের সম্ভাবনা বাড়ে।]] একটি সম্পাদককে লেখা চিঠি হলো একটি সংক্ষিপ্ত (প্রায় ২০০ শব্দের) লেখা যা প্রকাশনার সাম্প্রতিক সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট প্রবন্ধ বা বিষয়ের প্রতিক্রিয়ায় লেখা হয়। "অপ-এড" (op-ed) শব্দটি মূলত এসেছে "opposite of the editorial" অর্থে অর্থাৎ "সম্পাদকীয়র বিপরীত", “মতামত-সম্পাদকীয়” নয়। অপ-এড সাধারণত একটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের লেখা (প্রায় ৫০০ শব্দ) যা কোনো প্রকাশনা তাদের সম্পাদকীয় বোর্ডের অবস্থানের বিপরীতে মত প্রকাশের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তবে বর্তমান সময়ে এই বিভাজন অনেকটাই অস্পষ্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পাদককে লেখা চিঠি অনেক বড়ও হতে পারে আবার অপ-এড লেখাও প্রকাশনার পক্ষ থেকে অনুরোধে হওয়া প্রয়োজন নেই কিংবা তা সম্পাদকীয় বোর্ডের বিপরীত মত হওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। আপনি কোন ধরনের পরিস্থিতিতে লিখছেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনার লেখার কাঠামো কেমন হবে। তবুও, সম্পাদক আপনার লেখা পরিবর্তন করে দিতে পারেন। {{clear}} ==বিষয়বস্তু== আপনার পাঠক কারা এবং তারা কীভাবে আপনার উদ্দেশ্যে সহায়তা করতে পারে তা আগে বুঝে নিন। শুধু মত প্রকাশ করবেন না, একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তুলে ধরুন এবং পাঠকদের সামনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় তুলে ধরুন। অবস্থানের পক্ষে কথা বলার মানে হলো আপনার মতামত জানানো এবং পাঠককে বোঝানো এই বিষয়ে তাদের কী করা উচিত। যদি সমস্যা "ক" থেকে থাকে তবে সেটি কীভাবে সমাধান করা যায় তা ব্যাখ্যা করুন। যদি প্রার্থী "ক" কাজের জন্য সেরা ব্যক্তি হন তাহলে কীভাবে তাকে সমর্থন করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিন। সমর্থনের উদাহরণ হতে পারে, প্রচারণা বা কোনো বিষয়ভিত্তিক ওয়েবসাইটে যাওয়া, স্বেচ্ছাসেবক হওয়া, অথবা নির্দিষ্টভাবে ভোট দেওয়া। লেখাটি পুরো পাঠকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে লিখুন, কোনো একক ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নয়। প্রতিটি প্রকাশনার নিজস্ব পাঠকবর্গ থাকে তাই এক লেখাকে একাধিক জায়গায় পাঠানো উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ ''দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস''-এ স্থানীয় কোনো নির্বাচনের বিষয়ে লেখা সময়ের অপচয় ঠিক যেমনটি জাতীয় কোনো ইস্যুতে পক্ষপাতদুষ্ট লেখা স্থানীয় পত্রিকার জন্যও উপযুক্ত নয়। সম্পাদকরা সাধারণত নিছক প্রচলিত বক্তব্যের চেয়ে ব্যক্তিগত অভিমতের প্রকাশ বেশি পছন্দ করেন। নিজের স্বার্থ জড়িত এমন গল্প সম্বলিত চিঠিগুলো প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে।<ref>[[Elements of Political Communication/References#CITEREFWahl-Jorgensen2001|Wahl-Jorgensen, "Letters to the Editor as a Forum"]], ৩১৪–৩১৮।</ref> আপনার মতামত কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরুন। অনেক সময় আমরা তথ্য ও পরিসংখ্যানে ভরা একটি তালিকা তৈরি করতে চাই। কিন্তু সেটিই একটি অপ-এড বা সম্পাদককে লেখা চিঠির মূল উদ্দেশ্য নয়। উপমা, সংক্ষিপ্ত গল্প বা যুক্তিযুক্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্য এসব রেটরিক্যাল কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে আপনার মতের প্রতি আরও সহজে বিশ্বাসী করা যায় যা কেবল পরিসংখ্যানে সম্ভব নয়। ==বিন্যাস== আপনার লেখা ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের মধ্যে হওয়া উচিত। তার চেয়ে ছোট হলে চলবে তবে প্রকাশিত পৃষ্ঠায় এর জায়গা কম থাকবে। ফন্ট মার্জিন কিংবা অন্যান্য বিন্যাসের বিষয়গুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যদি না আপনার নথিপত্রে অপ্রচলিত বা অস্বস্তিকর কোনো মার্কআপ ব্যবহার করা হয়। যদি আপনি পিডিএফ ফাইল বা ডাকযোগে পাঠান তাহলে তা সম্পাদকের জন্য অতিরিক্ত ঝামেলা তৈরি করে ফলে তা প্রকাশের সম্ভাবনা কমে যায়। অনুচ্ছেদ বিভাজন এবং শিরোনাম কীভাবে হবে তা ঠিক করবেন সম্পাদক। ===কীভাবে লিখবেন=== একটি অপ-এড বা সম্পাদকীয় চিঠি লেখার সময় এক বা দুই বাক্যে আপনি যেভাবে বিষয়টি অনুভব করছেন সেটি সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করুন। এরপর কয়েকটি বাক্যে বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করুন। যদিও এটি প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে যদি আপনি এমন একটি জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখছেন যা বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এরপর এক বা দুইটি ছোট অনুচ্ছেদে আপনি কেন এই মত পোষণ করছেন তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করুন। এরপর পাঠকরা এই বিষয়ের জন্য কী করতে পারেন সে বিষয়ে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী পরামর্শ দিন। এই কর্মের আহ্বানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি না থাকলে পাঠকরা হয়তো আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হলেও কিছু করার প্রেরণা পাবেন না। আপনি যদি তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন তাহলে তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নাও নিতে পারেন। লেখার শুরুতে ফিরে যান এবং সংক্ষেপে বলুন আপনি কে এবং প্রাসঙ্গিক যেকোনো তথ্য উল্লেখ করুন। সম্ভব হলে এমন একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে বের করুন যেখান থেকে আপনি বিষয়টিকে দেখতে পারেন এবং সেটি ভূমিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। শেষে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার লিখুন, সম্ভব হলে একটি বাক্যে একটি জোরালো মন্তব্য করুন যা ভূমিকার সেই অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে লেখা হয়। অনেক লেখক প্রভাবশালী ভূমিকা ও উপসংহার লেখা নিয়ে হতাশ হন কিন্তু এই কৌশলটি এই অংশগুলো লেখা সহজ করে তোলে। লেখা জমা দেওয়ার আগে যাচাই করুন নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনার লেখায় আছে কি না: * আপনি কে এবং আপনি বিষয় "ক"-এর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? * বিষয় ক কেন গুরুত্বপূর্ণ? * ক নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? * ক নিয়ে আপনি কেন এভাবে ভাবছেন? * আমরা ক নিয়ে কী করতে পারি? এই গঠনশৈলী অবশ্যই কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে এমন নয়। তবে এটি একজন লেখককে ২০০ থেকে ৫০০ শব্দের একটি শক্তিশালী লেখা তৈরি করতে সহায়তা করবে। নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যান। ==উদাহরণ== {{hiddenh3|সাধারণ প্রার্থী সমর্থনপত্র}} {{quotation|কয়েকদিন আগে আমি শহর ক-এর আমার আবাসিক এলাকায় দৌড়াচ্ছিলাম, যেখানে আমি গত কয়েক বছর ধরে বাস করছি। ডাকবাক্সের ফাঁক দিয়ে আর ফুটপাথ বেয়ে ওঠার সময়, আমি ''টাউন গ্যাজেট''-এর সামনের পাতায় একটি শিরোনাম দেখতে পেলাম। সেখানে লেখা ছিল "প্রার্থী ক নির্বাচনে প্রার্থী ক-কে চ্যালেঞ্জ করবেন"।<br /><br /> এই নির্বাচন নির্ধারণ করবে কে আমাদের সম্প্রদায়কে আগামী বহু বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এই এলাকার প্রতিনিধিরা এমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর ওপর ভোট দেন, যা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই এসব জরুরি বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।<br /><br /> আমি প্রার্থী ক-এর পক্ষের মানুষ। আমি প্রার্থী খ-এর বিপক্ষে।<br /><br /> প্রার্থী ল বহু বছর ধরে বিভিন্ন বোর্ড ও কমিটিতে কাজ করে তার কমিউনিটির জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা বোর্ডে কয়েক বছর কাজ করা, যা গত বছর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি সব সময় নাগরিকদের সাহায্য করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিপরীতে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বারবার এসব বিষয় এড়িয়ে গেছেন। আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করছি, ভোটাররা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য এই প্রকাশনার ভোটার গাইডটি পড়েন। যে কেউ example.com, facebook.com/example, অথবা twitter.com/example-এ গিয়ে প্রার্থী ক-এর প্রচার শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।<br /><br /> আমি জানি না আমার কথা প্রার্থীদের প্রচারণার ধরন বদলাতে পারবে কি না। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটি আমার দৌড়ের ধরন বদলে দেবে: এখন থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমি "প্রার্থী ক-কে ভোট দিন" লেখা টি-শার্ট পরে শহর গ-এ দৌড়াবো।<br /><br /> -নাম}} এই উদাহরণটি খুবই সাধারণ, তবে এটি লেখককে নিশ্চিত করে যে তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একইসঙ্গে এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সম্ভব হলে, আপনার ইতিবাচক দিকগুলো নির্দিষ্ট করে বলুন। যেমন, উপরের চিঠিতে "অনেক বছর" কথাটির পরিবর্তে যদি সেই প্রার্থীর আসলে কত বছরের অভিজ্ঞতা আছে তা লেখা যায় (ধরা হয় যদি সেই সময়কাল পদের জন্য যুক্তিযুক্ত হয়), তাহলে তা আরও ভালো হয়। {{hiddenh3|সাধারণ ইস্যুতে সমর্থনপত্র}} {{quotation|প্রিয় সম্পাদক,<br /><br /> উফ! বাইরে কী প্রচণ্ড গরম! এই ধরণের দিনগুলোই আমাদের ঘরের ভেতরে থাকতে বাধ্য করে, আর এয়ার কন্ডিশনারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় স্বস্তি নিতে হয়।<br /><br /> কিন্তু সবাই এমন সুবিধা পান না। মাঝে মাঝে ভাবলে ভয় লাগে, বাইরে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা এইরকম প্রচণ্ড গরমের সময় সূর্যের তাপ থেকে রেহাই পান না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো এমন সময় সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকেন। আমি এখন প্রতিদিন আমার দাদীকে ফোন করি—দেখি তিনি ভালো আছেন কিনা, পানি খাচ্ছেন কিনা।<br /><br /> শহরের আরও অনেক মানুষও কষ্টে আছেন। মনে হয় আমাদের সমাজের উচিত এই সমস্যার একটা সমাধান বের করা। কিন্তু প্রতিবারই এটা আমাদের আশ্চর্য করে দেয়।<br /><br /> এই কারণেই আমি আমাদের শহরে "জেনেরিক হোম ফান্ড গ্রান্ট" নামক অনুদান কর্মসূচির সম্প্রসারণের পক্ষে। শহরটি এই অনুদান প্রদান করে নিম্নআয়ের মানুষদের, যারা নিজের বাসায় উন্নয়নের জন্য যেমন দক্ষ এয়ার কন্ডিশনার বসানোর মতো খরচ চালাতে চান।<br /><br /> আমরা অনেক সময় নিজেদের সুবিধাগুলোকে স্বাভাবিক ধরে নিই। তবে আপনি যখন নিজের ঠাণ্ডা ঘরে বসে আরাম নিচ্ছেন, তখন পাশের বাড়ির মানুষদের কথাও ভাবুন। আজই শহরের ওয়েবসাইট example.com-এ গিয়ে আপনার সিটি কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, আর বলুন তারা যেন এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেন। এটি শুধু দাদীর জন্য নয়; এটা আমাদের পুরো কমিউনিটির জন্য ভালো উদ্যোগ।<br /><br /> -নাম}} এই চিঠিটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনানুষ্ঠানিক হলেও, এটি একটি গুরুতর বিষয়ে সম্মানজনক ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে "কিন্তু" দিয়ে শুরু হওয়া বাক্যটি গম্ভীরতায় একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে, তবে লেখার ধরণটি একই রয়ে গেছে। ==পুনর্মূল্যায়ন== {{quiz|question=নিম্নের কোন বাক্যটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি বিশ্বাস করি প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |b=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। |c=ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদে ভোট দিন প্রার্থী ক-কে, ২ নভেম্বর তারিখে। |d=প্রার্থী ক এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, এবং আমি ভোটারদের উৎসাহ দিচ্ছি যাতে তারা ২ নভেম্বর তারিখে ম উপজেলার সদর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিশনার পদের জন্য তাকে ভোট দেন। |answer='''ঘ।''' প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্পে মত প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু পাঠকের করার মতো কোনো কাজ উল্লেখ নেই। তৃতীয়টিতে কাজের আহ্বান আছে, কিন্তু মত প্রকাশ নেই।}} {{quiz|question=নিচের কোন সম্বোধনটি সবচেয়ে উপযুক্ত? |a=সাংবাদিক ল, গত মাসে আপনার প্রতিবেদন ছিল পক্ষপাতদুষ্ট… |b=''দ্য মর্নিং''-এর সকল হিস্পানিক পাঠকদের প্রতি,… |c=প্রিয় পাঠকবৃন্দ,… |d=যার উদ্দেশ্যে হতে পারে,… |answer='''গ।''' সম্পাদকীয় চিঠির ক্ষেত্রে সম্বোধন খুব একটা প্রয়োজন হয় না, আর অপ-এডের ক্ষেত্রে কখনই নয়। তবে যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে এমন কিছু ব্যবহার করুন যা সকল পাঠকের জন্য প্রযোজ্য হয় (যেমন "প্রিয় সম্পাদক")। সংবাদপত্রগুলো সাধারণত শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি ছাপায় না।}} {{quiz|question=নিচের কোন ব্যক্তিগত বর্ণনাটি সবচেয়ে কার্যকর? |a=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে এই সম্প্রদায়কে সেবা দিয়েছি। এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি ককক৯অ বিবেচনা করবে, যা এই দারুণ কর্মসূচির জন্য অঙ্গরাজ্যের অর্থায়ন কমিয়ে দেবে। |b=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর শেষ ৮ বছর আমি বিভিন্ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবা করেছি, যার মধ্যে ফাউন্ডেশন অ, ফাউন্ডেশন আ, ফাউন্ডেশন খ, এবং আরও অনেক সংস্থা রয়েছে। এই অধিবেশনে সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, এটি একটি চমৎকার কর্মসূচি। |c=এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা ফাউন্ডেশন খ-এর অঙ্গরাজ্য অর্থায়ন কমিয়ে দেবে, যেখানে আমি গত ৮ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি। আমি শহর ক-এ ১২ বছর ধরে বাস করছি। |d=আমি ১২ বছর ধরে শহর ক-এ বাস করছি। এর মধ্যে ৮ বছর আমি ফাউন্ডেশন খ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, কিন্তু এই অধিবেশনে, সিটি কাউন্সিল এইচবি কককক বিবেচনা করবে, যা এই কর্মসূচির অর্থায়ন কমিয়ে দেবে—যার জন্য আমি এত পরিশ্রম করেছি। |answer='''ক।''' দ্বিতীয় বিকল্পে অতিরিক্ত তথ্য রয়েছে যা লেখার প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে। ধরে নেওয়া হয় পাঠক কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতেই আগ্রহী। তৃতীয়টি উল্টোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে: ব্যক্তিগত দিকটি মূল বক্তব্যে যাওয়ার সেতু হওয়া উচিত, উল্টো নয়। চতুর্থটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত মনে হয়, ফলে পাঠক মনে করতে পারে বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে আপনার নিয়ে, ফাউন্ডেশন নয়।}} {{quiz|question=নিচের কোন আবেদন সবচেয়ে কার্যকর? |a=২০০৭–২০০৮ শিক্ষাবর্ষে, ইউআইএল অ্যানাবলিক স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য ১০,১১৭টি পরীক্ষা নিয়েছিল, যার মধ্যে ৬,৪৫৫ জন পুরুষ ও ৩,৬৬২ জন মহিলা ছিল। মাত্র দুটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৮ সালের অটাম: ১৮,৮১৭টি পরীক্ষা, ৭টি সিপি। ২০০৯ সালের স্প্রিং: ১৬,২৬০টি পরীক্ষা, ৮টি সিপি। ২০০৯ অটাম: ৩,১৩৩টি পরীক্ষা, ২টি সিপি। ২০১০ স্প্রিং: ৩,৩০৮টি পরীক্ষা, ০টি সিপি। ২০১০ অটাম: ২,০৮৩টি পরীক্ষা, ১টি সিপি। |b=ভাবুন তো, প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার ছাত্রকে এমন একটি জিনিসের জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা আপনি ধরেই নিয়েছেন তাদের নেই। এটিই মূলত হাইস্কুল স্টেরয়েড পরীক্ষার বাস্তবতা। |c=ভাবুন তো, ২০০৭ সালে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৬,৪৫৫ জন ছেলে ও ৩,৬৬২ জন মেয়েকে এলোমেলোভাবে স্টেরয়েড পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। |d=২০০৭ সালে আমরা কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে হাইস্কুল ছাত্রদের জন্য ১০,১১৭টি স্টেরয়েড পরীক্ষা চালিয়েছি, আর মাত্র দুটি পজিটিভ পেয়েছি। ২০০৮ সালে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, এরপর আমরা কর্মসূচিটি অনেক কমিয়ে ফেলেছি। |answer='''খ।''' যদিও এটি তেমন নির্দিষ্ট নয়, দ্বিতীয় বিকল্পটি প্রথম বাক্যের একটি সংক্ষিপ্ত, আলঙ্কারিক রূপ। প্রয়োজনে বাকি লেখায় গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান যোগ করা যায়।}} ==টীকা== {{reflist}} {{chapnav||Press releases}} __NOTOC__ am14usi8wrmo9ltdozpy3peyz9jv1f8 দর্শনের সাথে পরিচয়/নৈতিকতা কী? 0 26288 85446 81868 2025-06-30T15:21:32Z Mehedi Abedin 7113 85446 wikitext text/x-wiki নীতিশাস্ত্র একটি শব্দ। অনেকেই মনে করেন নীতিশাস্ত্র সামাজিক রীতিনীতি বা ধর্মীয় আদেশের একটি সেটের সাথে সম্পর্কিত। পেশাদার দর্শনে আমরা সাধারণত এটিকে নীতিশাস্ত্রের সংজ্ঞা হিসাবে বিবেচনা করি না। দার্শনিক নীতিশাস্ত্রকে ভাল এবং মন্দের অধ্যয়ন বলা যেতে পারে। সাধারণত, দার্শনিক নীতিশাস্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা আবিষ্কারের সাথে সম্পর্কিত যা কে বা কী ভাল তা নির্ধারণ করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা অন্যরা যে ব্যবস্থাগুলি প্রস্তাব করেছে তার মূল্যায়নের সাথে সম্পর্কিত। নৈতিক জ্ঞানের সাধনা প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সময় থেকে শুরু হয়েছে, তবে এটি বেশিরভাগই আলোকিত নৈতিক চিন্তাধারার প্রভাব যা আজও নীতিশাস্ত্রকে রূপ দিচ্ছে। নীতিশাস্ত্রের ইতিহাসে অনেক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যার মধ্যে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলও রয়েছেন, তবে আধুনিক প্রভাবগুলির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছে ইমানুয়েল কান্ট, জেরেমি বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, ডি.ডব্লিউ. রস, সি.এল. স্টিভেনসন, আলাসডেয়ার ম্যাকইনটায়ার এবং জন রলসের মতো ব্যক্তিত্ব। নীতিশাস্ত্রে, "ভালো" সংজ্ঞা দেওয়ার উপর একটি উচ্চতর স্থান নির্ধারণ করা হয়। ভালোর সংজ্ঞা, নৈতিক বৈশিষ্ট্যের প্রকৃতি, নৈতিক জ্ঞানের উৎস এবং নৈতিক তথ্যের অবস্থা নির্ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতি নৈতিক তত্ত্বের বিভিন্ন শাখা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নীতিগত দর্শনের তিনটি প্রধান বিভাগকে বলা যেতে পারে ভার্চু এথিক্স, ডিওন্টোলজি এবং কনসিকিউশিয়ালিজম। সমাজ এবং গির্জার নৈতিক আদেশ প্রকৃত দার্শনিক নীতিশাস্ত্র হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করে না। এই শেষ বিবৃতিটি উদ্বেগের কারণ কারণ এটি নেতিবাচক পূর্বাভাসের গন্ধ। প্রথমত, নীতিগত আদেশের সর্বদা নৈতিক অন্তর্নিহিততা থাকে। এটি এড়ানো অসম্ভব। একটি নীতিগত আদেশ কিছু চিন্তাধারার সাথে খাপ খায় না, তবে কিছু চিন্তাধারা ভুল হতে পারে। সমস্ত নীতিশাস্ত্র প্রকৃতিগতভাবে ধর্মীয়, যদি কেউ ধর্মকে ভালো আবিষ্কারের প্রচেষ্টা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। নীতিশাস্ত্র "কী সঠিক?" এই প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত হয়? যে এই প্রশ্নের উত্তর নির্ধারণ করে সে একজন আইন প্রণেতা। আইন সর্বদা ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ, তা সে ঈশ্বরবাদী বা স্বায়ত্তশাসিত হোক। নীতিশাস্ত্র হল সক্রেটিসের কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দার্শনিক প্রচেষ্টা। এটি একটি খুবই সাধারণ প্রশ্ন, যা যেকোনো ব্যক্তির জন্য "আমার কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত?" এর অর্থ হতে পারে। তবে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এই প্রশ্নের সমস্ত উত্তর নীতিগত ধরণের উত্তর নয়। কেউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে কোনও ধরণের যৌক্তিক দ্বন্দ্ব ছাড়াই একজনের আত্ম-আনন্দময় জীবনযাপন করা উচিত। নীতি দার্শনিকরা "অহংকার" নামে পরিচিত এই ধারণাটিও অধ্যয়ন করেন এবং "কেন নীতিবান হবেন?" প্রশ্নটি সক্রেটিসের প্রশ্নের থেকে আলাদা বলেই। এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সক্রেটিসের প্রশ্ন কেবল অ-নৈতিক উত্তরই দেয় না বরং বিভিন্ন নীতিগত তত্ত্ব থেকেও উত্তর দেয়। তার প্রশ্ন কান্টের "আমার কর্তব্য কী?" বা "আমরা কীভাবে সুখী হতে পারি?" এর অহংকারী/উপযোগবাদী প্রশ্নের মতো নয়। সক্রেটিসের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিভিন্ন উপায় রয়েছে এবং "সোফায় বসে টেলিভিশন দেখুন" এর বাধ্যতামূলক উত্তরগুলিও এর সমান উত্তর, তবে নীতিশাস্ত্র যুক্তির মাধ্যমে প্রশ্নের সর্বোত্তম উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। নীতিশাস্ত্র "কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত?" এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই একটি সমাজে বাস করি। সমাজে প্রত্যেকেই একটি স্থান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এমনকি যদি এটি কেবল "অপরিচিত" হয়, এবং সেই অনুযায়ী প্রত্যেকের উপর কর্মের প্রত্যাশা থাকে। একজনের ভাই, বন্ধু এবং পথচারী হিসেবে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে আচরণ করার আশা করা হয়। নীতিশাস্ত্র মূলত ব্যক্তিগত কর্মের এই ক্ষেত্রটির সাথে সম্পর্কিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, নীতিশাস্ত্র তত্ত্বগুলি অন্যদের প্রতি আমাদের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার একটি ব্যবস্থা বিকাশের চেষ্টা করে। বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে যে বাধ্যবাধকতাগুলি সাধারণ তা হল সত্য বলার বাধ্যবাধকতা, দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করার বাধ্যবাধকতা এবং হত্যা না করার বাধ্যবাধকতা। অবশ্যই, বেশিরভাগ তত্ত্ব পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নমনীয়তা প্রদান করে যেমন এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করার ক্ষমতা এবং কারও অন্য কোনও উচ্চতর বাধ্যবাধকতা আছে কিনা। অতীতের নীতিশাস্ত্রগুলি অনেক ধরণের ছিল। অ্যারিস্টটল সদ্গুণের একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন, এমন একটি ধারণা যা ইতিমধ্যেই গ্রীক সংস্কৃতির একটি অংশ ছিল। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিলেন যে, ভালো মানুষ হলো সেই ব্যক্তি যে এমনভাবে জীবনযাপন করে যাতে সে মানুষের লক্ষ্য, অর্থাৎ টেলোসের দিকে এগিয়ে যেতে পারে এবং টেলোসে পৌঁছানোর উপায় হলো সদ্গুণের জীবনযাপন করা। আরেকটি বিশিষ্ট তত্ত্ব হল পরিণতিবাদ। এর নাম থেকেই আগত কারও কর্মের পরিণতির উপর তৈরি এই তত্ত্বে জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদ এবং এর কেন্দ্রবিন্দু অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ পরিণতিবাদ বলবে যে, মানুষকে সাহায্য করা আমাদের বাধ্যবাধকতা কারণ মানুষকে সাহায্য না করার চেয়ে মানুষকে সাহায্য করা ভালো ফলাফল দেয়। উপযোগবাদ নীতিশাস্ত্রকে গণিত করার জন্য এর বাইরে যায়। এটি উপযোগকে পরিমাপ করে, যাকে এটি "সুখ" বা "আনন্দ" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে, একটি নির্দিষ্ট ক্রিয়া উৎপন্ন করবে এবং সেই সংখ্যাটিকে অন্য ক্রিয়া দ্বারা উৎপাদিত উপযোগের পরিমাণের সাথে তুলনা করে। যে কোনও ক্রিয়া সবচেয়ে বেশি উপযোগ তৈরি করে তা হল বাধ্যতামূলক। তৃতীয় একটি সাধারণ নীতি তত্ত্ব হল ডিওন্টোলজি, এবং এর প্রধান সমর্থক হলেন কান্ট। ডিওন্টোলজি হল খুবই সংকীর্ণ অর্থে বাধ্যবাধকতার অধ্যয়ন। এটি কেবল যুক্তি থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করে যে প্রতিটি মানুষ কেবল যুক্তিবাদী সত্তা হওয়ার কারণেই যে বাধ্যবাধকতাগুলি ধারণ করে। কান্ট প্রথমে যাকে তিনি শ্রেণীগত অনুজ্ঞা বলে অভিহিত করেন তার পক্ষে যুক্তি দেন এবং এর থেকে অন্যান্য সর্বজনীন নীতিমালা বের করা সম্ভব, যা "যখন পরিস্থিতিতে X, Y করুন" সূত্র অনুসরণ করে। কান্টের শ্রেণীগত অনুজ্ঞার দুটি সূত্র রয়েছে। প্রথমটি হল কেবলমাত্র সেই নীতিমালা অনুসারে কাজ করা যার দ্বারা আপনি একই সাথে ইচ্ছা করতে পারেন যে এটি একটি সর্বজনীন আইনে পরিণত হওয়া উচিত। দ্বিতীয়টি, যা কান্ট দাবি করেন যে একই অর্থ বহন করে তা হল "এমনভাবে কাজ করা যাতে আপনি সর্বদা মানবতাকে বিবেচনা করেন (তা আপনার নিজের ক্ষেত্রে হোক বা অন্য কারও ক্ষেত্রে) কেবল একটি উপায় হিসাবে নয়, বরং সর্বদা একই সময়ে একটি লক্ষ্য হিসাবে।" নীতিশাস্ত্র বিবেচনা করার সময়, এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে নৈতিকতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার আলোকিতকরণ প্রকল্পটি কিছু বিশিষ্ট সমসাময়িক নৈতিক দার্শনিকদের দ্বারা ব্যর্থ বলে বিচার করা হয়েছে। এই সমসাময়িক দার্শনিকরা মনে করেন যে নীতি কেবল যুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যায় না। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হল আলাসডেয়ার ম্যাকইনটায়ার, রিচার্ড রর্টি এবং বার্নার্ড উইলিয়ামসের দর্শন। ম্যাকইনটায়ার মানুষের টেলোস বা লক্ষ্যের সাথে সম্পর্কিত গুণাবলী অনুসরণ করে জীবনযাপন করার অ্যারিস্টটলীয় ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। রর্টি একজন বাস্তববাদী এবং যুক্তি দেন যে প্রতিটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে আমাদের যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা উচিত তা হল "এটি কি কার্যকর?" তিনি যুক্তি দেবেন যে অপরিচিতদের সাথে অবিশ্বাসের সাথে আচরণ করা এবং প্রতিশ্রুতি পালন করা ভাল নৈতিক নীতি কারণ এগুলি প্রাথমিকভাবে একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য কার্যকর। অবশেষে, উইলিয়ামস সামগ্রিকভাবে নৈতিক তত্ত্ব এবং বাধ্যবাধকতার ধারণার সমালোচনা করেন। তিনি আরও জিজ্ঞাসা করেন যে কেন নীতিশাস্ত্রকে অ-নৈতিক উত্তরের চেয়ে সক্রেটিসের প্রশ্নের একটি ভাল উত্তর হিসাবে নেওয়া হয়। ==প্রকার== '''আদর্শ নীতিশাস্ত্র'' আমাদের কী 'করতে হবে', বা কী জিনিস 'ভালো' করা উচিত সেগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। * কোন আচরণ (বা উদ্দেশ্য) ভাল না খারাপ? * নির্দিষ্ট ধরণের আচরণের জন্য নৈতিক ন্যায্যতা ("যৌক্তিক কারণ") হিসেবে কী ধরণের জিনিস যুক্ত করা যেতে পারে? * অন্য মানুষকে হত্যা করা (হত্যা) কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? যুদ্ধে শত্রুকে হত্যা করা? জাতিগত নির্মূল? আত্মরক্ষার জন্য একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা? একজন দোষী সাব্যস্ত খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া? একজন মারাত্মক অসুস্থ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া? নিজেকে হত্যা করা? গর্ভপাত? বিকৃত ভ্রূণের গর্ভপাত? একটি প্রাণী হত্যা? * পশুদের কি অধিকার আছে? নারী কি? শিশু কি? মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ? * নির্যাতন কি কখনও ন্যায্য? চুরি? মিথ্যা বলা? প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা? * মানুষের জীবনযাপনের সর্বোত্তম উপায় কী? * যুদ্ধের ন্যায্য কারণ কী? "ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ" বলে কি কিছু আছে? * অন্যান্য সময় এবং সমাজের সাংস্কৃতিক অনুশীলনকে কি অনৈতিক বলে নিন্দা করা যেতে পারে? মার্কিন দাসত্ব সম্পর্কে, বিচ্ছিন্নতা এবং বর্ণবাদ সম্পর্কে, চীনা পা ​​বাঁধা সম্পর্কে, আফ্রিকান মহিলা যৌনাঙ্গ বিচ্ছেদ সম্পর্কে, মরমন বা মুসলিম বহুবিবাহ সম্পর্কে কী বলা যায়? * বৈচিত্র্য সহ্য করার জন্য, অথবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধার জন্য সঠিক সীমা কী? এমন কি কোন বিন্দু আছে যেখানে বৈচিত্র্যের প্রতি (যথাযথ) সহনশীলতা বা গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা অনৈতিকতার (অনুপযুক্ত) নিষ্ক্রিয় গ্রহণযোগ্যতা হয়ে ওঠে? সেই বিন্দুটি কী? ''মেটা-নীতিশাস্ত্র'' নীতিশাস্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্নগুলির সাথে সম্পর্কিত। * "ভালো", "সঠিক", "ভুল", "উচিত" এর মতো নীতিগত শব্দগুলির অর্থ কী? * কোন রায়কে "নৈতিক" রায় বলে, যেমন, একটি নান্দনিক রায়, অথবা একটি শিষ্টাচার রায়, অথবা একটি সাধারণ ব্যক্তিগত পছন্দের বিপরীতে? * নৈতিক আইনের ভিত্তি কী? ঐশ্বরিক আদেশ? প্রাকৃতিক আইন? মানব প্রকৃতি? প্রথা? * আমাদের কেন নীতিবান হওয়া উচিত? নৈতিক আচরণের প্রেরণামূলক ভিত্তি কী? নৈতিক আচরণের জন্য কোন "প্রেরণামূলক কারণ" ("কারণকে ন্যায্যতা দেওয়ার" বিপরীতে) তৈরি করা যেতে পারে? * মানুষ কেন নৈতিকভাবে আচরণ করে? * কিছু আচরণ কি এক সমাজ/সংস্কৃতিতে সঠিক এবং অন্য সমাজে ভুল হতে পারে? * আইনের নৈতিক ভিত্তি কী? ''আইনের কি কোন নৈতিক ভিত্তি আছে? ''আইনের কি কোন নৈতিক ভিত্তি থাকা উচিত? ''আইনের কি কোন নৈতিক ভিত্তি থাকা উচিত? আমাদের কি আইনি উপায়ে নৈতিক আচরণ প্রয়োগ করার চেষ্টা করা উচিত? * নৈতিক তথ্য বা সত্যের প্রকৃতি কী? এগুলি কি বস্তুনিষ্ঠ এবং মানুষের বিশ্বাস থেকে স্বাধীন, নাকি এগুলি ব্যক্তি বা সমাজের দ্বারা ব্যক্তিগত এবং নির্মিত? * নৈতিক সত্যগুলি কি কেবল যুক্তির মাধ্যমে আবিষ্কার করা যায়, নাকি এগুলি সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য অন্তর্দৃষ্টি, আবেগ, বা কোনও ধরণের ঐশ্বরিক প্রকাশের প্রয়োজন হয়? ''নীতিশাস্ত্রের ইতিহাস'' নীতিশাস্ত্রের বিষয়ে অতীতে দার্শনিকরা যা লিখেছেন তার অধ্যয়ন নিয়ে আলোচনা করে। আদর্শিক নীতিশাস্ত্র এবং মেটা-নীতিশাস্ত্রের প্রশ্নগুলির মধ্যে সীমানা সর্বদা স্পষ্টভাবে টানা হয় না। নীতিশাস্ত্রের প্রশ্নগুলি সহজেই দর্শনের অন্যান্য ক্ষেত্রে, উদাহরণস্বরূপ আইনের দর্শন এবং ধর্মের দর্শনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এবং অবশ্যই নীতিশাস্ত্রের ইতিহাস অধ্যয়ন নীতিশাস্ত্রের সকল বিষয়ের সাথে জড়িত: প্রায় সকল নীতিশাস্ত্রের প্রশ্ন অতীতে আলোচনা করা হয়েছে, এবং নীতিশাস্ত্র জীবিত এবং ঐতিহাসিক চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি চলমান কথোপকথন হিসাবে অগ্রসর হচ্ছে। == তথ্যসূত্র এবং আরও পঠন == * {{wikipedia-inline|Ethics}} {{BookCat}} p9tsimzjfy6zoi5gfgoufn347fneb69 পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/সম্পদ 0 26496 85465 82436 2025-06-30T16:49:01Z Mehedi Abedin 7113 85465 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} = অতিরিক্ত তথ্য = == আপনার উৎসসমূহ নথিভুক্ত করা == === ভূমিকা === তথ্য উপস্থাপনের সময়, লেখকের প্রায়ই প্রয়োজন হয় বাইরের তথ্য একটি নথিতে সংযুক্ত করার। এই বাইরের তথ্য অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য ও তথ্যভিত্তিক হতে হবে। লেখক বিভিন্ন কারণে বাইরের উৎস ব্যবহার করতে পারেন: * '''লেখকের প্রদত্ত তথ্যকে স্পষ্ট করতে''' * '''লেখকের উল্লেখিত বিষয়ে জোর দিতে''' * '''প্রমাণ করতে যে একটি ধারণার মূল্য আছে''' * '''আপনার প্রকল্পে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের স্বীকৃতি দিতে''' * '''দেখাতে যে আপনার গবেষণা কীভাবে নতুন জ্ঞান ও ধারণার জন্ম দিচ্ছে''' === একটি শৈলী বেছে নেওয়া === নথিভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের শৈলী প্রচলিত আছে। যেহেতু প্রতিটি ধরনের নথির জন্য একটি নির্দিষ্ট স্টাইল উপযুক্ত নয়, তাই কোন শৈলী ব্যবহার করবেন তা নির্ধারণে নথির পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট নথিভুক্ত করার শৈলী নির্ধারণ করে দেয়। আপনি যদি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নথি লিখেন, তাহলে খুঁজে বের করুন তারা কোন স্টাইল পছন্দ করে এবং সেটি অনুসরণ করুন। অনেক প্রতিষ্ঠান স্টাইল নির্দেশিকা তৈরি করে যেখানে নমুনা রিপোর্ট ও নথি থাকে। এসব নির্দেশিকায় উদ্ধৃতির পছন্দ প্রকাশ পায়। অন্যদিকে, কিছু প্রতিষ্ঠান পেশাদারভাবে উন্নীত শৈলী যেমন এপিএ বা এমএলএ ব্যবহার করতে বলে। লেখকের উচিত কিছু গবেষণা করে প্রিয় স্টাইলটি নির্ধারণ করা। === ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি কোথায় বসাবেন নির্ধারণ করুন === ইন-টেক্সট উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে এমএলএ ও এপিএ উভয় শৈলী লেখকের নাম বন্ধনীর মধ্যে উক্ত তথ্যের পর বসানো হয়। এপিএ শৈলী লেখকের নামের সাথে প্রকাশনার সালও উল্লেখ করে। এই ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি পাঠককে নথির শেষে সাজানো বর্ণানুক্রমিক বিবরণীতে নিয়ে যায়। এপিএ ও এমএলএর বিবরণী শৈলী আলাদা হলেও ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি প্রায় একই। ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি পাঠককে জানায় তথ্য কোথা থেকে এসেছে। এটি তখন সহজ হয় যখন একটি নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য (যেমন উদ্ধৃতি বা তথ্য) একটি সূত্র প্রযোজ্য হয়। তবে যদি একাধিক ধারণার জন্য একই উৎস ব্যবহৃত হয়, তাহলে টপিক বাক্যে উদ্ধৃতিটি বসানো উচিত। পরবর্তী বাক্যগুলোতে লেখকের নাম ব্যবহৃত হতে পারে, যাতে পাঠক সহজে বুঝতে পারেন উৎস কে। === এপিএ ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি === এপিএ ইন-টেক্সট উদ্ধৃতি করতে হলে, লেখকের নাম ও প্রকাশের সাল উক্ত তথ্যের পরে বসাতে হবে। এটি সাধারণ বিরামচিহ্নের ভিতরে থাকবে। লেখকের নাম ও সাল-এর মধ্যে কমা বসাতে হবে। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার জন্য '''''p.''''' এবং একাধিক পৃষ্ঠার জন্য '''''pp.''''' ব্যবহার করতে হবে। যেমন: '''যখন দুটি অণু কাছাকাছি আসে, তখন তারা একে অপরকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে (ওয়েড, ২০০৬, p. ৬১)।''' যদি লেখকের নাম উদ্ধৃতির মধ্যে থাকে, তাহলে শুধু সাল ও পৃষ্ঠার সংখ্যা উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করতে হবে। এই উদ্ধৃতির জন্য সাহায্যকারী কয়েকটি ওয়েবসাইট: *সন অফ সাইটেশন মেশিন [http://citationmachine.net/] *ইজিবিব [http://www.easybib.com/] *আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন [http://www.apastyle.org/apa-style-help.aspx] *নুডলটুলস [http://www.noodletools.com/] === অন্যান্য উদ্ধৃতির ধরন === '''(ওয়েড অ্যান্ড হুইটম্যান, ২০০৬)''' দুই লেখক '''(ইওয়ার্ট, প্যারাডাইস, বাটারফাস, ১৯৮৬)''' তিন বা ততোধিক লেখকের প্রথম উদ্ধৃতি '''(ইওয়ার্ট এট আল., ১৯৮৬)''' পরবর্তী উদ্ধৃতিগুলোর জন্য '''(হেন্ডারসন, ১৯৯২, p. ২৪)''' নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার জন্য '''(ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার, ২০০৮)''' সরকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক লেখক '''("হিউম্যান মেটাবোলিজম," ২০০৭)''' নামহীন প্রবন্ধ উদ্ধৃতি '''(হিল, ২০০৩; লর্ন, ২০০১; স্পা, ১৯৯৯)''' একসাথে একাধিক উৎস উদ্ধৃতি '''(জনসন ১৯৯২a)''' একই লেখকের একাধিক উৎস == এপিএ সূত্রের তালিকা লেখা == === মুদ্রিত উৎস === * '''বই, এক লেখক''' অজিক, সি. (১৯৮৩)। আর্ট অ্যান্ড আরডর। নিউ ইয়র্ক: প্যানথিয়ন বুকস। * '''বই, একাধিক লেখক''' টালবার্ট, এস.এইচ., অ্যান্ড বেটজালেল, এ. (১৯৯২)। এলিমেন্টারি মেকানিক্স অফ প্লাস্টিক ফ্লো ইন ফর্মিং। নিউ ইয়র্ক: উইলি। * '''সংকলন বা প্রবন্ধ সংকলন''' রুবিন, বি. অ্যান্ড ল্যাকুয়ার, ডাব্লিউ. (সম্পাদকগণ)। (১৯৮৯)। দ্য হিউম্যান রাইটস রিডার। বোকা র‍্যাটন, এফএল: সিআরসি প্রেস। * '''সরকারি প্রতিবেদন''' ম্যাকলাউড, এস.এ. রুরাল ব্রডব্যান্ড স্টিমুলাস প্রোগ্রাম। পলিটিকাল কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স। ৯২-২৭৩৬। ওমাহা: স্টিমুলাস সার্ভে, ২০০৯। * '''বিশ্বকোষ, অভিধান বা অনুরূপ সূত্র-এমএলএ''' স্ট্রস, শ্যারন। "সি টার্টলস।" এনসাইক্লোপিডিয়া স্মিথসোনিয়ান। ১৯৯৪ সংস্করণ। * '''পুস্তিকা বা ব্রোশিওর-এমএলএ''' মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়। ফুড সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগ। ম্যানেজিং ডায়াবেটিস। মিনিয়াপোলিস: মিনেসোটা, ২০০৫। * '''একটানা পৃষ্ঠা নম্বর বিশিষ্ট জার্নাল প্রবন্ধ-এমএলএ''' ম্যাককর্ন্যাক, ব্রায়ান। "প্রিভ্যালেন্স অফ অ্যাফিড পপুলেশনস ইন ওয়েস্টার্ন মিনেসোটা।" নেচার ২২২ (২০০৩): ৩৬৩-৪২। * '''পৃথকভাবে নম্বরকৃত জার্নাল প্রবন্ধ-এমএলএ''' ক্রেইটন, জর্জ। "রিয়েল ওয়ার্ল্ড অ্যাপ্লিকেশন অফ ইন্টারমলিকিউলার বন্ডস।" কেমিস্ট্রি ইউনিভার্স ১১ (১৯৯২): ৩৫-৩৬। * '''জনপ্রিয় ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ-এমএলএ''' কাউম্যান, হুইটনি। "দ্য টিকিং টাইম ক্লক।" টাইম। ১৫ নভেম্বর ২০০৪: ৫৩-৫৫। * '''সংবাদপত্রের প্রবন্ধ-এমএলএ''' হেনরি, ডেভিন। "বায়োমেড বিল্ডিং ফান্ডিং কুড বি কাট।" পাইওনিয়ার প্রেস ১৩ জুন ২০০৯, জাতীয় সংস্করণ: এ৯। * '''নামহীন প্রবন্ধ-এমএলএ''' "মেকিং এক্সারসাইজ ইয়োর ওন।" ইমপ্রুভ হেলথ। ১২০.১ (২০০৯): ৫৪। === ইলেকট্রনিক উৎস === * '''ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদন-এমএলএ''' আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন। ওয়াচিং ইয়োর কোলেস্টেরল। ২২ অক্টোবর ২০০৭ [http://www.americanheart.org/presenter.jhtml] * '''অনলাইন জার্নাল প্রবন্ধ যা মুদ্রণে নেই''' জনসন, মাইকেল। জিওম্যাট্রিক সিগনিফিকান্স অফ রিফ্রাকশন। জার্নাল অফ ফিজিক্স ৬ ২০০২। ১৮ এপ্রিল ২০০৯ [http://www.astro.uvic.ca/~tatum/goptics.html] * '''ইমেইল-এমএলএ''' ইওয়ার্ট, জুলি। "রেটোরিক ইন দ্য ওয়ার্কপ্লেস।" জেমি বাটারফাসকে ইমেইল। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯। === অন্যান্য উৎস === * '''সাক্ষাৎকার-এমএলএ''' মেটজ, পল। টেলিফোন সাক্ষাৎকার। ১৯ ডিসেম্বর ২০০৭। [http://en.wikibooks.org/wiki/Technical_and_professional_writing মূল পাতা] {{BookCat}} 8epd4h8j105tq85m8usr81b408yffn0 পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নির্দেশাবলি/চিত্র 0 26500 85466 82444 2025-06-30T16:52:14Z Mehedi Abedin 7113 85466 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} == চিত্র নির্দেশনার গুরুত্ব == চিত্র নির্দেশনায় পাঠ্য থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে উভয়ই থাকা ভালো, কারণ শেখার ধরন বিভিন্ন রকম হয়। তবে নির্দেশনার উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। চিত্র নির্দেশনা এমন একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে সহায়তা করে যেটি শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গ্রাফিক্স কোনো কিছুর চেহারা কেমন দেখাতে, কোনো ধাপ সম্পন্ন হলে সেটি কেমন দেখাবে, কীভাবে কিছু তৈরি বা সম্পন্ন হয়, প্রবণতা বা সম্পর্ক দেখাতে, প্রকল্পে প্রাণ আনতে অথবা তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রাফিক্স সহায়ক, কারণ প্রায় সবাই (শিশু ও ভিন্ন ভাষাভাষীরাও) চিত্র নির্দেশনা বুঝতে পারে। এটি বহু ভাষায় পাঠ্য অনুবাদ ও মুদ্রণের খরচও কমিয়ে দেয়। গ্রাফিক্স নির্দেশনায় সহায়ক, কারণ এটি মানুষকে সরাসরি দেখায় যে তাদের কী করতে হবে। === <u>ব্যবসা ও বিপণন:</u> === * ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে। * শেখার সময় দ্রুততর করে। * মানবিক ভিন্নতা কমায়। * নির্দেশনার ব্যবহার ও অনুধাবন বৃদ্ধি করে। * পণ্যের রিটার্ন কমায়। * সংযোজনের সময় হ্রাস করে - গ্রাহকের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। * প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজ করে। * তথ্যকে দৃশ্যায়িত ও সাধারণ প্রবণতায় রূপান্তর করে। * প্রতিবেদন ও স্মারকের বিশ্বস্ততা বাড়ায়। * পেশাদারিত্ব প্রচার করে। * সর্বজনীন বোঝাপড়া নিশ্চিত করে। === <u>শিক্ষা:</u> === * বিমূর্ত ধারণাকে দৃশ্যমান ও বাস্তব করে তোলে। * পূর্বজ্ঞান ও নতুন ধারণার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। * চিন্তা, লেখা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাঠামো প্রদান করে। * চিন্তা ও ধারণাকে কেন্দ্রীভূত করে, যা বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। * শিক্ষার্থীদের চিন্তা পরিষ্কার করতে, তথ্য সংগঠিত ও বিশ্লেষণ করতে, নতুন জ্ঞান একীভূত করতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সাহায্য করে। == ইতিহাস == লিখিত পাঠ্যের অনেক <u>আগে</u> থেকেই বার্তা বা গল্প জানানোর জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দের পরিবর্তে ছবি থেকেই অর্থ তৈরি করার ক্ষমতার কারণে গ্রাফিক্স বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও শব্দ গ্রাফিক্সের অংশ হতে পারে, তবে ছবিগুলোই কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বা বোঝাপড়া তৈরি করে নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে। গুহাচিত্র ও মানচিত্র হচ্ছে এ ধরনের প্রাচীন উদাহরণ; যেকোনো মানুষ এগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কী। আজকের একটি মানচিত্র ১৮শ শতাব্দীর মানচিত্রের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হবে, তবে বার্তাটি একই থাকবে। ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সমুদ্রপথ হয়তো ভিন্ন নাম, সীমানা ও মালিকানায় পূর্ণ থাকবে, তবুও দর্শক বার্তাটি একই রকমভাবে বুঝতে পারবে। == চিত্র নির্দেশনার সাধারণ সমস্যা == {| style="padding:2px; text-align:left; float:right;" |[[চিত্র:Visualinstructions.jpeg|থাম্ব|চিত্র নির্দেশনার একটি উদাহরণ।]] |} যদিও চিত্র নির্দেশনার অনেক সুবিধা রয়েছে, কিছু অসুবিধাও আছে। যখন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না, তখন মানুষ ভিন্নভাবে গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স অস্পষ্ট হতে পারে, যা নির্ধারিত দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, বিশেষত যখন প্রক্রিয়াটি অনেক বিস্তারিত এবং অনেকগুলো একই রকম অংশ জড়িত থাকে। যখন ছবিতে অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ থাকে, তখন কঠিন অংশগুলো ভালোভাবে দেখতে জুম করে দেখানো দরকার হয়। এছাড়া, যদি প্রতিটি অংশ মাপে আঁকা না হয়, তবে একটি বৃত্ত টেবিলের উপরের অংশ অথবা একটি ওয়াশারকেই বোঝাতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স এমনও আছে যেগুলো সবাই বুঝতে পারে না। আপনি যদি এমন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করেন যেখানে বিশেষায়িত গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে এসব গ্রাফিক্স কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রের পাঠকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় ব্যবহার করুন যারা সেগুলো বুঝবে এবং প্রত্যাশা করবে। আপনি যদি গ্রাফিক্স ব্যবহার করেন একটি বিস্তৃত দর্শকদের জন্য (যেমন একটি বোর্ড গেম যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকরাও ব্যবহার করবে), তাহলে নিশ্চিত করুন আপনি যেসব গ্রাফিক্স বেছে নিয়েছেন তা সবাই বুঝতে পারবে। {{BookCat}} ax995qaq43y561p9az9ibei70ur2rqs 85467 85466 2025-06-30T16:52:59Z Mehedi Abedin 7113 85467 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} == চিত্র নির্দেশনার গুরুত্ব == চিত্র নির্দেশনায় পাঠ্য থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে উভয়ই থাকা ভালো, কারণ শেখার ধরন বিভিন্ন রকম হয়। তবে নির্দেশনার উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। চিত্র নির্দেশনা এমন একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে সহায়তা করে যেটি শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গ্রাফিক্স কোনো কিছুর চেহারা কেমন দেখাতে, কোনো ধাপ সম্পন্ন হলে সেটি কেমন দেখাবে, কীভাবে কিছু তৈরি বা সম্পন্ন হয়, প্রবণতা বা সম্পর্ক দেখাতে, প্রকল্পে প্রাণ আনতে অথবা তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রাফিক্স সহায়ক, কারণ প্রায় সবাই (শিশু ও ভিন্ন ভাষাভাষীরাও) চিত্র নির্দেশনা বুঝতে পারে। এটি বহু ভাষায় পাঠ্য অনুবাদ ও মুদ্রণের খরচও কমিয়ে দেয়। গ্রাফিক্স নির্দেশনায় সহায়ক, কারণ এটি মানুষকে সরাসরি দেখায় যে তাদের কী করতে হবে। === <u>ব্যবসা ও বিপণন:</u> === * ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে। * শেখার সময় দ্রুততর করে। * মানবিক ভিন্নতা কমায়। * নির্দেশনার ব্যবহার ও অনুধাবন বৃদ্ধি করে। * পণ্যের রিটার্ন কমায়। * সংযোজনের সময় হ্রাস করে - গ্রাহকের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। * প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজ করে। * তথ্যকে দৃশ্যায়িত ও সাধারণ প্রবণতায় রূপান্তর করে। * প্রতিবেদন ও স্মারকের বিশ্বস্ততা বাড়ায়। * পেশাদারিত্ব প্রচার করে। * সর্বজনীন বোঝাপড়া নিশ্চিত করে। === <u>শিক্ষা:</u> === * বিমূর্ত ধারণাকে দৃশ্যমান ও বাস্তব করে তোলে। * পূর্বজ্ঞান ও নতুন ধারণার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। * চিন্তা, লেখা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাঠামো প্রদান করে। * চিন্তা ও ধারণাকে কেন্দ্রীভূত করে, যা বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। * শিক্ষার্থীদের চিন্তা পরিষ্কার করতে, তথ্য সংগঠিত ও বিশ্লেষণ করতে, নতুন জ্ঞান একীভূত করতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সাহায্য করে। == ইতিহাস == লিখিত পাঠ্যের অনেক <u>আগে</u> থেকেই বার্তা বা গল্প জানানোর জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দের পরিবর্তে ছবি থেকেই অর্থ তৈরি করার ক্ষমতার কারণে গ্রাফিক্স বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও শব্দ গ্রাফিক্সের অংশ হতে পারে, তবে ছবিই নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বা বোঝাপড়া তৈরি করে। গুহাচিত্র ও মানচিত্র হচ্ছে এ ধরনের প্রাচীন উদাহরণ; যেকোনো মানুষ এগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কী। আজকের একটি মানচিত্র ১৮শ শতাব্দীর মানচিত্রের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হবে, তবে বার্তাটি একই থাকবে। ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সমুদ্রপথ হয়তো ভিন্ন নাম, সীমানা ও মালিকানায় পূর্ণ থাকবে, তবুও দর্শক বার্তাটি একই রকমভাবে বুঝতে পারবে। == চিত্র নির্দেশনার সাধারণ সমস্যা == {| style="padding:2px; text-align:left; float:right;" |[[চিত্র:Visualinstructions.jpeg|থাম্ব|চিত্র নির্দেশনার একটি উদাহরণ।]] |} যদিও চিত্র নির্দেশনার অনেক সুবিধা রয়েছে, কিছু অসুবিধাও আছে। যখন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না, তখন মানুষ ভিন্নভাবে গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স অস্পষ্ট হতে পারে, যা নির্ধারিত দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, বিশেষত যখন প্রক্রিয়াটি অনেক বিস্তারিত এবং অনেকগুলো একই রকম অংশ জড়িত থাকে। যখন ছবিতে অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ থাকে, তখন কঠিন অংশগুলো ভালোভাবে দেখতে জুম করে দেখানো দরকার হয়। এছাড়া, যদি প্রতিটি অংশ মাপে আঁকা না হয়, তবে একটি বৃত্ত টেবিলের উপরের অংশ অথবা একটি ওয়াশারকেই বোঝাতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স এমনও আছে যেগুলো সবাই বুঝতে পারে না। আপনি যদি এমন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করেন যেখানে বিশেষায়িত গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে এসব গ্রাফিক্স কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রের পাঠকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় ব্যবহার করুন যারা সেগুলো বুঝবে এবং প্রত্যাশা করবে। আপনি যদি গ্রাফিক্স ব্যবহার করেন একটি বিস্তৃত দর্শকদের জন্য (যেমন একটি বোর্ড গেম যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকরাও ব্যবহার করবে), তাহলে নিশ্চিত করুন আপনি যেসব গ্রাফিক্স বেছে নিয়েছেন তা সবাই বুঝতে পারবে। {{BookCat}} iaxi7d3elfq2m493k0a0va942qboiqs 85468 85467 2025-06-30T16:54:35Z Mehedi Abedin 7113 85468 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} == চিত্র নির্দেশনার গুরুত্ব == চিত্র নির্দেশনায় পাঠ্য থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে উভয়ই থাকা ভালো, কারণ শেখার ধরন বিভিন্ন রকম হয়। তবে নির্দেশনার উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। চিত্র নির্দেশনা এমন একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে সহায়তা করে যেটি শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গ্রাফিক্স কোনো কিছুর চেহারা কেমন দেখাতে, কোনো ধাপ সম্পন্ন হলে সেটি কেমন দেখাবে, কীভাবে কিছু তৈরি বা সম্পন্ন হয়, প্রবণতা বা সম্পর্ক দেখাতে, প্রকল্পে প্রাণ আনতে অথবা তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রাফিক্স সহায়ক, কারণ প্রায় সবাই (শিশু ও ভিন্ন ভাষাভাষীরাও) চিত্র নির্দেশনা বুঝতে পারে। এটি বহু ভাষায় পাঠ্য অনুবাদ ও মুদ্রণের খরচও কমিয়ে দেয়। গ্রাফিক্স নির্দেশনায় সহায়ক, কারণ এটি মানুষকে সরাসরি দেখায় যে তাদের কী করতে হবে। === <u>ব্যবসা ও বিপণন:</u> === * ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে। * শেখার সময় দ্রুততর করে। * মানবিক ভিন্নতা কমায়। * নির্দেশনার ব্যবহার ও অনুধাবন বৃদ্ধি করে। * পণ্যের রিটার্ন কমায়। * সংযোজনের সময় হ্রাস করে - গ্রাহকের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। * প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজ করে। * তথ্যকে দৃশ্যায়িত ও সাধারণ প্রবণতায় রূপান্তর করে। * প্রতিবেদন ও স্মারকের বিশ্বস্ততা বাড়ায়। * পেশাদারিত্ব প্রচার করে। * সর্বজনীন বোঝাপড়া নিশ্চিত করে। === <u>শিক্ষা:</u> === * বিমূর্ত ধারণাকে দৃশ্যমান ও বাস্তব করে তোলে। * পূর্বজ্ঞান ও নতুন ধারণার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। * চিন্তা, লেখা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাঠামো প্রদান করে। * চিন্তা ও ধারণাকে কেন্দ্রীভূত করে, যা বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। * শিক্ষার্থীদের চিন্তা পরিষ্কার করতে, তথ্য সংগঠিত ও বিশ্লেষণ করতে, নতুন জ্ঞান একীভূত করতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সাহায্য করে। == ইতিহাস == লিখিত পাঠ্যের অনেক <u>আগে</u> থেকেই বার্তা বা গল্প জানানোর জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দের পরিবর্তে ছবি থেকেই অর্থ তৈরি করার ক্ষমতার কারণে গ্রাফিক্স বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও শব্দ গ্রাফিক্সের অংশ হতে পারে, তবে ছবিই নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বা বোঝাপড়া তৈরি করে। গুহাচিত্র ও মানচিত্র হচ্ছে এ ধরনের প্রাচীন উদাহরণ; যেকোনো মানুষ এগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কী। আজকের একটি মানচিত্র ১৮শ শতাব্দীর মানচিত্রের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হবে, তবে বার্তাটি একই থাকবে। ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সমুদ্রপথ হয়তো ভিন্ন নাম, সীমানা ও মালিকানায় পূর্ণ থাকবে, তবুও দর্শক বার্তাটি একই রকমভাবে বুঝতে পারবে। == চিত্র নির্দেশনার সাধারণ সমস্যা == {| style="padding:2px; text-align:left; float:right;" |[[চিত্র:Visualinstructions.jpeg|থাম্ব|চিত্র নির্দেশনার একটি উদাহরণ।]] |} যদিও চিত্র নির্দেশনার অনেক সুবিধা রয়েছে, কিছু অসুবিধাও আছে। যখন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না, তখন মানুষ ভিন্নভাবে গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স অস্পষ্ট হতে পারে যা নির্ধারিত দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, বিশেষত যখন প্রক্রিয়াটি অনেক বিস্তারিত হয় এবং অনেকগুলোর একই রকম অংশ জড়িত থাকে। যখন ছবিতে অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ থাকে, তখন কঠিন অংশগুলো ভালোভাবে দেখতে জুম করে দেখানো দরকার হয়। এছাড়া, যদি প্রতিটি অংশ মাপে আঁকা না হয়, তবে একটি বৃত্ত টেবিলের উপরের অংশ অথবা একটি ওয়াশারকেই বোঝাতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স এমনও আছে যেগুলো সবাই বুঝতে পারে না। আপনি যদি এমন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করেন যেখানে বিশেষায়িত গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে এসব গ্রাফিক্স কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রের পাঠকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় ব্যবহার করুন যারা সেগুলো বুঝবে এবং প্রত্যাশা করবে। আপনি যদি একদল বিস্তৃত দর্শকদের জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহার করেন (যেমন একটি বোর্ড গেম যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকরাও ব্যবহার করবে), তাহলে নিশ্চিত করুন আপনি যেসব গ্রাফিক্স বেছে নিয়েছেন তা সবাই বুঝতে পারবে। {{BookCat}} jcv1okggkslge2m9l75mpgnrdbf54qr 85469 85468 2025-06-30T16:54:54Z Mehedi Abedin 7113 85469 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} == চিত্র নির্দেশনার গুরুত্ব == চিত্র নির্দেশনায় পাঠ্য থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে উভয়ই থাকা ভালো, কারণ শেখার ধরন বিভিন্ন রকম হয়। তবে নির্দেশনার উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। চিত্র নির্দেশনা এমন একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে সহায়তা করে যেটি শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গ্রাফিক্স কোনো কিছুর চেহারা কেমন দেখাতে, কোনো ধাপ সম্পন্ন হলে সেটি কেমন দেখাবে, কীভাবে কিছু তৈরি বা সম্পন্ন হয়, প্রবণতা বা সম্পর্ক দেখাতে, প্রকল্পে প্রাণ আনতে অথবা তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রাফিক্স সহায়ক, কারণ প্রায় সবাই (শিশু ও ভিন্ন ভাষাভাষীরাও) চিত্র নির্দেশনা বুঝতে পারে। এটি বহু ভাষায় পাঠ্য অনুবাদ ও মুদ্রণের খরচও কমিয়ে দেয়। গ্রাফিক্স নির্দেশনায় সহায়ক, কারণ এটি মানুষকে সরাসরি দেখায় যে তাদের কী করতে হবে। === <u>ব্যবসা ও বিপণন:</u> === * ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে। * শেখার সময় দ্রুততর করে। * মানবিক ভিন্নতা কমায়। * নির্দেশনার ব্যবহার ও অনুধাবন বৃদ্ধি করে। * পণ্যের রিটার্ন কমায়। * সংযোজনের সময় হ্রাস করে - গ্রাহকের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। * প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজ করে। * তথ্যকে দৃশ্যায়িত ও সাধারণ প্রবণতায় রূপান্তর করে। * প্রতিবেদন ও স্মারকের বিশ্বস্ততা বাড়ায়। * পেশাদারিত্ব প্রচার করে। * সর্বজনীন বোঝাপড়া নিশ্চিত করে। === <u>শিক্ষা:</u> === * বিমূর্ত ধারণাকে দৃশ্যমান ও বাস্তব করে তোলে। * পূর্বজ্ঞান ও নতুন ধারণার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। * চিন্তা, লেখা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাঠামো প্রদান করে। * চিন্তা ও ধারণাকে কেন্দ্রীভূত করে, যা বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। * শিক্ষার্থীদের চিন্তা পরিষ্কার করতে, তথ্য সংগঠিত ও বিশ্লেষণ করতে, নতুন জ্ঞান একীভূত করতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সাহায্য করে। == ইতিহাস == লিখিত পাঠ্যের অনেক <u>আগে</u> থেকেই বার্তা বা গল্প জানানোর জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দের পরিবর্তে ছবি থেকেই অর্থ তৈরি করার ক্ষমতার কারণে গ্রাফিক্স বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও শব্দ গ্রাফিক্সের অংশ হতে পারে, তবে ছবিই নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বা বোঝাপড়া তৈরি করে। গুহাচিত্র ও মানচিত্র হচ্ছে এ ধরনের প্রাচীন উদাহরণ; যেকোনো মানুষ এগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কী। আজকের একটি মানচিত্র ১৮শ শতাব্দীর মানচিত্রের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হবে, তবে বার্তাটি একই থাকবে। ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সমুদ্রপথ হয়তো ভিন্ন নাম, সীমানা ও মালিকানায় পূর্ণ থাকবে, তবুও দর্শক বার্তাটি একই রকমভাবে বুঝতে পারবে। == চিত্র নির্দেশনার সাধারণ সমস্যা == {| style="padding:2px; text-align:left; float:right;" |[[চিত্র:Visualinstructions.jpeg|থাম্ব|চিত্র নির্দেশনার একটি উদাহরণ।]] |} যদিও চিত্র নির্দেশনার অনেক সুবিধা রয়েছে, কিছু অসুবিধাও আছে। যখন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না, তখন মানুষ ভিন্নভাবে গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স অস্পষ্ট হতে পারে যা নির্ধারিত দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, বিশেষত যখন প্রক্রিয়াটি অনেক বিস্তারিত হয় এবং অনেকগুলোর একই রকম অংশ জড়িত থাকে। যখন ছবিতে অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ থাকে, তখন কঠিন অংশগুলো ভালোভাবে দেখতে জুম করে দেখানো দরকার হয়। এছাড়া, যদি প্রতিটি অংশ মাপে আঁকা না হয়, তবে একটি বৃত্ত টেবিলের উপরের অংশ অথবা একটি ওয়াশারকেই বোঝাতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স এমনও আছে যেগুলো সবাই বুঝতে পারে না। আপনি যদি এমন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করেন যেখানে বিশেষায়িত গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে এসব গ্রাফিক্স কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রের পাঠকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় ব্যবহার করুন যারা সেগুলো বুঝবে এবং প্রত্যাশা করবে। আপনি যদি বিস্তৃত দর্শকদলের জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহার করেন (যেমন একটি বোর্ড গেম যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকরাও ব্যবহার করবে), তাহলে নিশ্চিত করুন আপনি যেসব গ্রাফিক্স বেছে নিয়েছেন তা সবাই বুঝতে পারবে। {{BookCat}} fsno3v35wfzh8bf3tjy4wcwpqi6vwdd 85470 85469 2025-06-30T16:55:18Z Mehedi Abedin 7113 85470 wikitext text/x-wiki {{TOCright}} == চিত্র নির্দেশনার গুরুত্ব == চিত্র নির্দেশনায় পাঠ্য থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে উভয়ই থাকা ভালো, কারণ শেখার ধরন বিভিন্ন রকম হয়। তবে নির্দেশনার উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। চিত্র নির্দেশনা এমন একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে সহায়তা করে যেটি শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গ্রাফিক্স কোনো কিছুর চেহারা কেমন দেখাতে, কোনো ধাপ সম্পন্ন হলে সেটি কেমন দেখাবে, কীভাবে কিছু তৈরি বা সম্পন্ন হয়, প্রবণতা বা সম্পর্ক দেখাতে, প্রকল্পে প্রাণ আনতে অথবা তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রাফিক্স সহায়ক, কারণ প্রায় সবাই (শিশু ও ভিন্ন ভাষাভাষীরাও) চিত্র নির্দেশনা বুঝতে পারে। এটি বহু ভাষায় পাঠ্য অনুবাদ ও মুদ্রণের খরচও কমিয়ে দেয়। গ্রাফিক্স নির্দেশনায় সহায়ক, কারণ এটি মানুষকে সরাসরি দেখায় যে তাদের কী করতে হবে। === <u>ব্যবসা ও বিপণন:</u> === * ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে। * শেখার সময় দ্রুততর করে। * মানসিক ভিন্নতা কমায়। * নির্দেশনার ব্যবহার ও অনুধাবন বৃদ্ধি করে। * পণ্যের রিটার্ন কমায়। * সংযোজনের সময় হ্রাস করে - গ্রাহকের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। * প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজ করে। * তথ্যকে দৃশ্যায়িত ও সাধারণ প্রবণতায় রূপান্তর করে। * প্রতিবেদন ও স্মারকের বিশ্বস্ততা বাড়ায়। * পেশাদারিত্ব প্রচার করে। * সর্বজনীন বোঝাপড়া নিশ্চিত করে। === <u>শিক্ষা:</u> === * বিমূর্ত ধারণাকে দৃশ্যমান ও বাস্তব করে তোলে। * পূর্বজ্ঞান ও নতুন ধারণার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। * চিন্তা, লেখা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাঠামো প্রদান করে। * চিন্তা ও ধারণাকে কেন্দ্রীভূত করে, যা বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। * শিক্ষার্থীদের চিন্তা পরিষ্কার করতে, তথ্য সংগঠিত ও বিশ্লেষণ করতে, নতুন জ্ঞান একীভূত করতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সাহায্য করে। == ইতিহাস == লিখিত পাঠ্যের অনেক <u>আগে</u> থেকেই বার্তা বা গল্প জানানোর জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দের পরিবর্তে ছবি থেকেই অর্থ তৈরি করার ক্ষমতার কারণে গ্রাফিক্স বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও শব্দ গ্রাফিক্সের অংশ হতে পারে, তবে ছবিই নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বা বোঝাপড়া তৈরি করে। গুহাচিত্র ও মানচিত্র হচ্ছে এ ধরনের প্রাচীন উদাহরণ; যেকোনো মানুষ এগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কী। আজকের একটি মানচিত্র ১৮শ শতাব্দীর মানচিত্রের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হবে, তবে বার্তাটি একই থাকবে। ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সমুদ্রপথ হয়তো ভিন্ন নাম, সীমানা ও মালিকানায় পূর্ণ থাকবে, তবুও দর্শক বার্তাটি একই রকমভাবে বুঝতে পারবে। == চিত্র নির্দেশনার সাধারণ সমস্যা == {| style="padding:2px; text-align:left; float:right;" |[[চিত্র:Visualinstructions.jpeg|থাম্ব|চিত্র নির্দেশনার একটি উদাহরণ।]] |} যদিও চিত্র নির্দেশনার অনেক সুবিধা রয়েছে, কিছু অসুবিধাও আছে। যখন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না, তখন মানুষ ভিন্নভাবে গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স অস্পষ্ট হতে পারে যা নির্ধারিত দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, বিশেষত যখন প্রক্রিয়াটি অনেক বিস্তারিত হয় এবং অনেকগুলোর একই রকম অংশ জড়িত থাকে। যখন ছবিতে অনেকগুলো বিভিন্ন অংশ থাকে, তখন কঠিন অংশগুলো ভালোভাবে দেখতে জুম করে দেখানো দরকার হয়। এছাড়া, যদি প্রতিটি অংশ মাপে আঁকা না হয়, তবে একটি বৃত্ত টেবিলের উপরের অংশ অথবা একটি ওয়াশারকেই বোঝাতে পারে। কিছু গ্রাফিক্স এমনও আছে যেগুলো সবাই বুঝতে পারে না। আপনি যদি এমন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করেন যেখানে বিশেষায়িত গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে এসব গ্রাফিক্স কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রের পাঠকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় ব্যবহার করুন যারা সেগুলো বুঝবে এবং প্রত্যাশা করবে। আপনি যদি বিস্তৃত দর্শকদলের জন্য গ্রাফিক্স ব্যবহার করেন (যেমন একটি বোর্ড গেম যা শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকরাও ব্যবহার করবে), তাহলে নিশ্চিত করুন আপনি যেসব গ্রাফিক্স বেছে নিয়েছেন তা সবাই বুঝতে পারবে। {{BookCat}} mn4ygnzctm3ug8jt75bhjjn0z806ghc জাপানের ইতিহাস: পুরাণ থেকে জাতিসত্ত্বা/আধুনিক জাপান 0 26659 85455 84051 2025-06-30T15:56:07Z Mehedi Abedin 7113 85455 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব| কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল| একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে, এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত G8 দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব| গ্রেটার টোকিও এরিয়া হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২৭.৩ মিলিয়ন (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাইনিচি কোরিয়ান, জাইনিচি চাইনিজ, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভিয়ানরা অন্যতম। ২০০৩ সালে, জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জনগণ; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে, জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে, ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে, টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান ইউনিভার্সিটি) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে] প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২.৪ মিলিয়ন)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই ৩ মিলিয়ন, টেনরিকিও ২ মিলিয়ন, প্লা কিয়োদান ১ মিলিয়ন, সেকাই কিউসেইকিও, ১ মিলিয়ন, সুকিও মাহিকারি ১ মিলিয়ন, হনমিচি ০.৯ মিলিয়ন, কনকোকিও ০.৫ মিলিয়ন, তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও ০.৪ মিলিয়ন, এন্নোকিও ০.৩ মিলিয়ন (১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও ০.২৫ মিলিয়ন এবং ওমোটো ০.১৫ মিলিয়ন। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি ল্যাটিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে কথিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে, জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং MEXT অনুসারে, ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। OECD দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম, বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ, আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে, সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকার-স্পন্সরিত বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা নির্বাচন করতে স্বাধীন। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতিতে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির ( ''কিঙ্কাকুজি'' )]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহী, প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। d94n9hfscvfnnf2qfi5a4gtrhrxy7hz 85456 85455 2025-06-30T15:59:40Z Mehedi Abedin 7113 85456 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব| কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল| একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে, এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত G8 দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব| গ্রেটার টোকিও এরিয়া হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২৭.৩ মিলিয়ন (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাইনিচি কোরিয়ান, জাইনিচি চাইনিজ, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভিয়ানরা অন্যতম। ২০০৩ সালে, জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জনগণ; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে, জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে, ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে, টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান ইউনিভার্সিটি) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে] প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২.৪ মিলিয়ন)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই ৩ মিলিয়ন, টেনরিকিও ২ মিলিয়ন, প্লা কিয়োদান ১ মিলিয়ন, সেকাই কিউসেইকিও, ১ মিলিয়ন, সুকিও মাহিকারি ১ মিলিয়ন, হনমিচি ০.৯ মিলিয়ন, কনকোকিও ০.৫ মিলিয়ন, তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও ০.৪ মিলিয়ন, এন্নোকিও ০.৩ মিলিয়ন (১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও ০.২৫ মিলিয়ন এবং ওমোটো ০.১৫ মিলিয়ন। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি ল্যাটিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে কথিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে, জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং MEXT অনুসারে, ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। OECD দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম, বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ, আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে, সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকার-স্পন্সরিত বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা নির্বাচন করতে স্বাধীন। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। jhvnkpkt19atgjd82r02i0zq8m54h3s 85457 85456 2025-06-30T16:00:18Z Mehedi Abedin 7113 85457 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব| কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল| একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে, এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত G8 দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব| গ্রেটার টোকিও এরিয়া হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২৭.৩ মিলিয়ন (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাইনিচি কোরিয়ান, জাইনিচি চাইনিজ, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভিয়ানরা অন্যতম। ২০০৩ সালে, জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জনগণ; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে, জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে, ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে, টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান ইউনিভার্সিটি) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে] প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২.৪ মিলিয়ন)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই ৩ মিলিয়ন, টেনরিকিও ২ মিলিয়ন, প্লা কিয়োদান ১ মিলিয়ন, সেকাই কিউসেইকিও, ১ মিলিয়ন, সুকিও মাহিকারি ১ মিলিয়ন, হনমিচি ০.৯ মিলিয়ন, কনকোকিও ০.৫ মিলিয়ন, তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও ০.৪ মিলিয়ন, এন্নোকিও ০.৩ মিলিয়ন (১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও ০.২৫ মিলিয়ন এবং ওমোটো ০.১৫ মিলিয়ন। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি ল্যাটিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে কথিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে, জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং MEXT অনুসারে, ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। OECD দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম, বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ, আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে, সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকার-স্পন্সরিত বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা নির্বাচন করতে স্বাধীন। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। hgxre8tjemquz7hb9zmpi5khnevq94z 85458 85457 2025-06-30T16:09:34Z Mehedi Abedin 7113 85458 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব| কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল| একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে, এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত G8 দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব| গ্রেটার টোকিও এরিয়া হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২৭.৩ মিলিয়ন (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাইনিচি কোরিয়ান, জাইনিচি চাইনিজ, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভিয়ানরা অন্যতম। ২০০৩ সালে, জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জনগণ; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে, জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে, ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে, টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান ইউনিভার্সিটি) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে] প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২.৪ মিলিয়ন)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই ৩ মিলিয়ন, টেনরিকিও ২ মিলিয়ন, প্লা কিয়োদান ১ মিলিয়ন, সেকাই কিউসেইকিও, ১ মিলিয়ন, সুকিও মাহিকারি ১ মিলিয়ন, হনমিচি ০.৯ মিলিয়ন, কনকোকিও ০.৫ মিলিয়ন, তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও ০.৪ মিলিয়ন, এন্নোকিও ০.৩ মিলিয়ন (১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও ০.২৫ মিলিয়ন এবং ওমোটো ০.১৫ মিলিয়ন। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি ল্যাটিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে কথিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। agos4hpfq1jdnk0fahamehvtiborz4y 85459 85458 2025-06-30T16:16:34Z Mehedi Abedin 7113 85459 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব| কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল| একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে, এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত G8 দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। d5v4drlyp7e92yk96xgc3uzv0nw2fir 85460 85459 2025-06-30T16:19:08Z Mehedi Abedin 7113 85460 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব| টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো OECD দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো সিস্টেম, বেতনভোগী এবং অফিস মহিলা। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে বা আরও গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি QRIO, ASIMO এবং AIBOও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতাদের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| JAXA জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ তারিখে, এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি H-IIA (মডেল H2A2022) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "SELENE" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেনকে কাগুয়া নামেও পরিচিত, প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব|কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল|একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে ও এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত জি৮ দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। 74su4g901n6vvp62yqo09nzg8qiaytg 85461 85460 2025-06-30T16:24:55Z Mehedi Abedin 7113 85461 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল| বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারে এর অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরিয়ান থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায়, সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| জোমন সুগি, ইয়াকুশিমা দ্বীপে। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব| মাউন্ট ইয়ারি, আগস্টে নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে, যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোঅঞ্চল রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড সিস্টেমের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান তার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল বিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব|টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল এর বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ-লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো ওইসিডি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো ব্যবস্থা, বেতনভোগী এবং অফিস লেডি। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে ও তারও বেশি গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭,০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি কিউআরআইও, এএসআইএমও এবং এআইবিও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতৃত্বের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| জেএএক্সএ জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি এইচ-আইআইএ (মডেল এইচ২এ২০২২) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "সেলেন" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেন কাগুয়া নামেও পরিচিত প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব|কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল|একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে ও এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত জি৮ দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। 7eygig5l0yacbzaotp47lhdjvpy8bbn 85462 85461 2025-06-30T16:31:26Z Mehedi Abedin 7113 85462 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট তাদের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সম্প্রতি ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী G4 দেশগুলির মধ্যে একটি। G8, APEC, "ASEAN Plus Three" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীন প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের EEZ নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JGSDF), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JMSDF) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (JASDF) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল|বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরীয় থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরীয় প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশীয় মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশীয় প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায় সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| ইয়াকুশিমা দ্বীপে জোমন সুগি। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব|আগস্টে মাউন্ট ইয়ারি, নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: এখানে একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু পাওয়া যায়, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোরিজিয়ন রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড ব্যবস্থা উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল ব্রিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এটি এমন একটি দেশ হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে যেটি কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব|টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল এর বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ-লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো ওইসিডি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো ব্যবস্থা, বেতনভোগী এবং অফিস লেডি। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে ও তারও বেশি গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭,০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি কিউআরআইও, এএসআইএমও এবং এআইবিও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতৃত্বের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| জেএএক্সএ জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি এইচ-আইআইএ (মডেল এইচ২এ২০২২) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "সেলেন" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেন কাগুয়া নামেও পরিচিত প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব|কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল|একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে ও এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত জি৮ দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। anvuyjcvrcxn9yckzwpwmvdn3krqyho 85463 85462 2025-06-30T16:36:05Z Mehedi Abedin 7113 85463 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে 660 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি কোড নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে আর মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট জাপানের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী জি৪ দেশগুলির মধ্যে একটি। জি৮, অ্যাপেক, "আশিয়ান প্লাস থ্রি" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও চীনা প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের ইইজেড নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেজিএসডিএফ), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেএমসিডিএফ) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেএসডিএফ) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীকে প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স ব্যবস্থা তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল|বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরীয় থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরীয় প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশীয় মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশীয় প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায় সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| ইয়াকুশিমা দ্বীপে জোমন সুগি। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব|আগস্টে মাউন্ট ইয়ারি, নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: এখানে একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু পাওয়া যায়, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোরিজিয়ন রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড ব্যবস্থা উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল ব্রিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এটি এমন একটি দেশ হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে যেটি কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব|টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল এর বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ-লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো ওইসিডি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো ব্যবস্থা, বেতনভোগী এবং অফিস লেডি। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে ও তারও বেশি গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭,০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি কিউআরআইও, এএসআইএমও এবং এআইবিও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতৃত্বের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| জেএএক্সএ জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি এইচ-আইআইএ (মডেল এইচ২এ২০২২) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "সেলেন" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেন কাগুয়া নামেও পরিচিত প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব|কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল|একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে ও এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত জি৮ দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। nbde3hmcobiiepjxcgb92fwwsr7c6kl 85464 85463 2025-06-30T16:38:37Z Mehedi Abedin 7113 85464 wikitext text/x-wiki জাপান আজ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এই বইয়ে এখন পর্যন্ত যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা এই জাতির উপর ছাপ রেখে গেছে। এখানে পাশ্চাত্য ও আদিবাসী ধারণার মিশ্রণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স ও প্রকৌশলে নেতৃত্বস্থানে আছে। == সরকার ও রাজনীতি == [[চিত্র:Emperor_Akihito_and_empress_Michiko_of_japan.jpg|থাম্ব| সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো। জাপানে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম ধারাবাহিক বংশগত রাজতন্ত্র রয়েছে, যার উত্তরাধিকারসূত্রে কমপক্ষে ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এটি চালু রয়েছে।]] জাপান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। দেশটিতে সম্রাটের ক্ষমতা খুবই সীমিত। একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র এবং জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ক্ষমতা প্রধানত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং ডায়েটের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের হাতে। সাংবিধানিক ভাবে সার্বভৌমত্ব জাপানি জনগণের হাতে ন্যস্ত। সম্রাট কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। জাপানের বর্তমান সম্রাট [[w:আকিহিতো|আকিহিতো]]। জাপানের যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]] সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আছেন। (এই তথ্যটি বইটি লেখার সময় প্রাসঙ্গিক ছিল। উল্লিখিত যুবরাজ [[w:নারুহিতো|নারুহিতো]]<nowiki/>ই বর্তমানে জাপানের সম্রাট।) জাপানের আইনসভা হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতীয় ডায়েট। ডায়েটে ৪৮০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি পরিষদ থাকে। এটি প্রতি চার বছর অন্তর অথবা ভেঙে গেলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। উচ্চকক্ষ হিসেবে ২৪২টি আসন বিশিষ্ট কাউন্সিলর পরিষদ থাকে। এর জনপ্রিয় নির্বাচিত সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে। সমস্ত নির্বাচনী অফিসের জন্য গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সালে উদারপন্থী রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৫৪ বছরের শাসনের পর জাপানের সামাজিক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। জাপানের সম্রাট ডায়েট কর্তৃক তার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়ার পর এই পদটি নিযুক্ত করেন এবং পদে বহাল থাকার জন্য তাকে প্রতিনিধি পরিষদের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার প্রধান (তাঁর জাপানি পদবির আক্ষরিক অনুবাদ "মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী") এবং তিনি প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন, যাদের বেশিরভাগকেই ডায়েটের সদস্য হতে হবে। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়োশিহিকো নোদার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য ডায়েট কর্তৃক শিনজো আবেকে মনোনীত করা হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন, জাপানের সংবিধান স্পষ্টভাবে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়। সম্রাট আকিহিতো একই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। জাপানের আইনসভা জাতীয় ডায়েট থেকে সম্রাটের রাবার স্ট্যাম্প অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ আইনের উৎপত্তি হয়। বর্তমান সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে ডায়েট কর্তৃক পাস করা আইন জারি করতে হবে। বিশেষ করে আইনটি পাসের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে না। জাপানের আদালত ব্যবস্থা চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট এবং তিনটি স্তরের নিম্ন আদালত। জাপানি আইনের প্রধান অংশ হলো ছয়টি বিধান নামক একটি সংগ্রহ। == বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী == [[চিত্র:SM3_from_JDS_Kongo.jpg|বাম|থাম্ব| জেডিএস ''কঙ্গো'' (ডিডিজি-১৭৩) একটি স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল ৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করছে।]] [[চিত্র:Helicopter_carrier_Hyūga_(16DDH).jpg|থাম্ব| জেডিএস ''হিউগা'', দুটি জাপানি মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের একটি।]] বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে জাপান বৃহত্তম সামরিক বাজেট বজায় রাখে। জাপানের তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে আর মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা জোট জাপানের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৬ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মোট ১৯ বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী জি৪ দেশগুলির মধ্যে একটি। জি৮, অ্যাপেক, "আশিয়ান প্লাস থ্রি" এর সদস্য এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বজুড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। জাপান ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের পরে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দাতা। ২০০৯ সালে দেশটি ৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল। জাপান ইরাক যুদ্ধে অ-যোদ্ধা সৈন্য প্রেরণ করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ইরাক থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানি মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স রিমপ্যাক সামুদ্রিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। জাপান তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে: [[w:কুরিল_দ্বীপপুঞ্জ|দক্ষিণ কুরিল দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে রাশিয়ার সাথে, লিয়ানকোর্ট রকস নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে, [[w:সেনকাকু_দ্বীপ|সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ]] নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও চীনা প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) সাথে এবং ওকিনোটোরিশিমার আশেপাশের ইইজেড নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর সাথে। জাপানের নাগরিকদের অপহরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের চলমান বিরোধেরও মুখোমুখি (ছয়-পক্ষীয় আলোচনাও দেখুন)। জাপানের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাপানের সামরিক বাহিনী সীমিত। এটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা বা সামরিক শক্তি ব্যবহারের জাপানের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলত জাপান গ্রাউন্ড সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেজিএসডিএফ), জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেএমসিডিএফ) এবং জাপান এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স (জেএসডিএফ) নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এই বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে জাপানি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীকে প্রথম বিদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। জাপান যাতে জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের মতো বহুজাতিক প্রকল্পে যোগ দিতে পারে, সেজন্য নিপ্পন কেইদানরেন সরকারের কাছে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যেই এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স ব্যবস্থা তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই মুহূর্তে জাপানের কাছে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলির হুমকির সাথে এই নীতিটি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। == প্রশাসনিক বিভাগ == [[চিত্র:Regions_and_Prefectures_of_Japan.svg|থাম্ব|320x320পিক্সেল| ISO 3166-2:JP ক্রম অনুসারে জাপানের প্রিফেকচারগুলির মানচিত্র এবং জাপানের অঞ্চলগুলি]] জাপান সাতচল্লিশটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত, প্রতিটি প্রিফেকচারের তত্ত্বাবধান একজন নির্বাচিত গভর্নর, আইনসভা এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র করে। প্রতিটি প্রিফেকচার আরও শহর, শহর এবং গ্রামে বিভক্ত। {| class="wikitable" |'''হোক্কাইদো''' ----১. হোক্কাইদো |'''তোহোকু''' ----২. আওমোরি ৩. ইওয়াতে ৪. মিয়াগি ৫. আকিতা ৬. ইয়ামাগাতা ৭. ফুকুশিমা |'''কান্তো''' ----৮. ইবারাকি ৯. তোচিগি ১০. গুনমা ১১. সাইতামা ১২. চিবা ১৩. টোকিও ১৪. কানাগাওয়া |'''চুবু''' ----১৫. নিগাতা ১৬. তোয়ামা ১৭. ইশিকাওয়া ১৮. ফুকুই ১৯. ইয়ামানাশি ২০. |নাগানো ২১. গিফু ২২. শিযুওকা ২৩. আইচি |- |'''কানসাই''' ----২৪. মি ২৫. শিগা ২৬. কিয়োটো ২৭. ওসাকা ২৮. হিয়োগো ২৯. নারা ৩০. ওয়াকায়ামা |'''চুগোকু''' ----৩১. তোত্তোরি ৩২. শিমানে ৩৩. ওকায়ামা ৩৪. হিরোশিমা ৩৫. ইয়ামাগুচি |'''শিকোকু''' ----৩৬. তোকুশিমা ৩৭. কাগাওয়া ৩৮. এহিমে ৩৯. কোচি |'''কিউশু এবং ওকিনাওয়া''' ----৪০. ফুকুওকা ৪১. সাগা ৪২. নাগাসাকি ৪৩. কুমামোতো ৪৪. ওইতা ৪৫. মিয়াজাকি ৪৬. কাগোশিমা ৪৭. ওকিনাওয়া |} দেশটি বর্তমানে অনেক শহর, নগর ও গ্রামকে একে অপরের সাথে একীভূত করে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি উপ-প্রিফেকচার প্রশাসনিক অঞ্চলের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। == ভূগোল == [[চিত্র:Satellite_View_of_Japan_1999.jpg|থাম্ব| জাপানের একটি উপগ্রহ চিত্র]] [[চিত্র:Tanuki01_960.jpg|ডান|থাম্ব|220x220পিক্সেল|বন্য তানুকি (জাপানি র‍্যাকুন কুকুর), ফুকুইয়ামা, হিরোশিমা]] জাপান এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত তিন হাজারেরও বেশি দ্বীপের একটি দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দ্বীপগুলি হল হোক্কাইডো, হোনশু (প্রধান দ্বীপ), শিকোকু এবং কিউশু। ওকিনাওয়া সহ রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ হল কিউশুর দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের একটি শৃঙ্খল। একসাথে তারা প্রায়শই জাপানি দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় ৭০% থেকে ৮০% এলাকা বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং কৃষি, শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ হল সাধারণত খাড়া উচ্চতা, জলবায়ু এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধসের ঝুঁকি, নরম ভূমি এবং ভারী বৃষ্টিপাত। এর ফলে মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি হয়েছে। জাপান বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার অবস্থানের কারণে জাপানে ঘন ঘন কম-তীব্রতার কম্পন এবং মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ অনুভূত হয়। প্রতি শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে প্রায়শই সুনামি হয়। ১৯২৩ সালের টোকিও ভূমিকম্পে ১,৪০,০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতম বড় ভূমিকম্পগুলি হল ২০১৬ সালের কুমামোটো ভূমিকম্প, ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ২০০৪ সালের চুয়েতসু ভূমিকম্প। উষ্ণ প্রস্রবণ অসংখ্য এবং এগুলিকে রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। === ভূতত্ত্ব === জাপানের দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নি আংটার একটি আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলি মূলত মধ্য-সিলুরীয় থেকে প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বৃহৎ মহাসাগরীয় আন্দোলনের ফলাফল, যা দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরীয় প্লেট এবং ওকিনাওয়া প্লেটের নীচে ফিলিপাইন সমুদ্র প্লেটের অধীনতা এবং উত্তরে ওখোটস্ক প্লেটের নীচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অধীনতার ফলে ঘটে। জাপান মূলত ইউরেশীয় মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সাথে সংযুক্ত ছিল। ইউরেশীয় প্লেটের চেয়ে গভীর হওয়ায় সাবডাক্টিং প্লেটগুলি জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে নিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে জাপান সাগর খুলে দিয়েছিল। টার্টারি প্রণালী এবং কোরিয়া প্রণালী অনেক পরে খুলেছিল। [[চিত্র:1974_Japan_Sakurajima.jpg|থাম্ব| ১৯৭৪ সালে সাকুরাজিমার অগ্ন্যুৎপাত। জাপানে ১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে]] [[চিত্র:Jomon_Sugi_07.jpg|ডান|থাম্ব| ইয়াকুশিমা দ্বীপে জোমন সুগি। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত গাছ: এটি ৭,২০০ বছর বয়সী বলে অনুমান করা হয়।]] জাপানের জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করে: * হোক্কাইডো: সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে যেখানে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতকাল এবং শীতল গ্রীষ্মকাল রয়েছে। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না, তবে শীতকালে দ্বীপগুলিতে সাধারণত গভীর তুষারপাতের সৃষ্টি হয়। [[চিত্র:Mt.Yarigatake_from_Enzansou.jpg|বাম|থাম্ব|আগস্টে মাউন্ট ইয়ারি, নাগানো প্রিফেকচার]] * জাপান সাগর: হোনশুর পশ্চিম উপকূলে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম বাতাস ভারী তুষারপাতের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে, এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় শীতল থাকে, যদিও ফোহন বাতাসের কারণে কখনও কখনও এখানে অত্যন্ত গরম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। * মধ্য উচ্চভূমি: এখানে একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু পাওয়া যায়, যেখানে গ্রীষ্ম ও শীত এবং দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য থাকে। বৃষ্টিপাত হালকা। * সেতো অভ্যন্তরীণ সাগর: চুগোকু এবং শিকোকু অঞ্চলের পাহাড়গুলি এই অঞ্চলটিকে মৌসুমী বাতাস থেকে রক্ষা করে যা সারা বছর ধরে মৃদু আবহাওয়া বজায় রাখে। * প্রশান্ত মহাসাগর: পূর্ব উপকূলে শীতকাল ঠান্ডা থাকে, সামান্য তুষারপাত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বাতাসের কারণে গ্রীষ্মকাল গরম, আর্দ্র থাকে। * রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ: রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু উপক্রান্তীয়, যেখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ। বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টাইফুন সাধারণ। জাপানে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ °সে (১০৫.৬ °ফা)। ওকিনাওয়াতে প্রধান বর্ষাকাল মে মাসের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং এর জন্য দায়ী স্থির বৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না জুলাইয়ের শেষের দিকে হোক্কাইডোতে পৌঁছানোর আগে উত্তর জাপানে বিলীন হয়ে যায়। হোনশুর বেশিরভাগ অঞ্চলে, জুনের মাঝামাঝি সময়ের আগেই বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতে, টাইফুন প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। === বাস্তুতন্ত্র === জাপানে নয়টি বন ইকোরিজিয়ন রয়েছে। এটি এই দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু এবং ভূগোলকে প্রতিফলিত করে। এগুলি রিউকিউ এবং বনিন দ্বীপপুঞ্জের উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র চওড়া পাতার বন থেকে শুরু করে প্রধান দ্বীপপুঞ্জের মৃদু জলবায়ু অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ প্রশস্ত পাতার এবং মিশ্র বন, উত্তর দ্বীপপুঞ্জের ঠান্ডা, শীতকালীন অংশে নাতিশীতোষ্ণ শঙ্কুযুক্ত বন পর্যন্ত বিস্তৃত। === পরিবেশ === বর্তমানে জাপান নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের অন্যতম নেতা। হোন্ডা এবং টয়োটা হাইব্রিড বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং সর্বনিম্ন নির্গমনের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল। এর কারণ হাইব্রিড ব্যবস্থা উন্নত প্রযুক্তি, জৈব জ্বালানি, হালকা ওজনের উপাদানের ব্যবহার এবং নতুন প্রকৌশল। কিয়োটো প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে, জাপান কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চুক্তির বাধ্যবাধকতা পালন করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে চালু করা কুল ব্রিজ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমানো। জাপান শিল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বড় ধরনের কর্তন করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এটি এমন একটি দেশ হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে যেটি কিয়োটো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতা পূরণে লড়াই করছে। ২০১০ সালের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকে জাপান বিশ্বের ২০তম সেরা স্থানে রয়েছে। == অর্থনীতি == [[চিত্র:The_Tokyo_Stock_Exchange_-_main_room_3.jpg|থাম্ব|টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ]] ২০১০ সালে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে, জাপানের অর্থনীতি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তৃতীয়। ২০০৯ সালে জাপানের সরকারি ঋণ ছিল এর বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৩%। ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, খুচরা বিক্রয়, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ এবং নির্মাণ - এই সবই প্রধান শিল্প। জাপানের শিল্প সক্ষমতা বিশাল এবং মোটরযান, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেশিন টুলস, ইস্পাত এবং অ-লৌহঘটিত ধাতু, জাহাজ, রাসায়নিক, বস্ত্র এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃহত্তম, শীর্ষস্থানীয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কিছু উৎপাদকের আবাসস্থল। মোট দেশজ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশের জন্য পরিষেবা খাত দায়ী। বিগ ম্যাক ইনডেক্স দেখায় যে জাপানি কর্মীরা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বেতন পান। জাপানের কিছু বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, শার্প, নিপ্পন স্টিল, নিপ্পন অয়েল, জাপান টোব্যাকো, টেপকো, মিতসুবিশি, ৭১১, হিটাচি, নিসান, ইওন, টয়োটা সুশো, ফুজিৎসু এবং নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন। এটি বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংকের আবাসস্থল এবং টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (যা তার নিক্কেই ২২৫ এবং টপিক্স সূচকের জন্য পরিচিত) বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ৩২৬টি কোম্পানির আবাসস্থল জাপান, যা ২০০৬ সালের হিসাবে ১৬.৩%। ২০০৮ সালের ব্যবসা করার সহজতা সূচকে জাপান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে এটির সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে ছোট। জাপানি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেইরেৎসু এন্টারপ্রাইজগুলি প্রভাবশালী। জাপানি কর্মপরিবেশে আজীবন কর্মসংস্থান এবং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক কর্মজীবনের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। জাপানি কোম্পানিগুলি "দ্য টয়োটা ওয়ে" এর মতো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য পরিচিত। শেয়ারহোল্ডারদের সক্রিয়তা বিরল। সম্প্রতি, জাপান এই নিয়মগুলির কিছু থেকে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে, জাপান ৩০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে ৫ম সর্বাধিক অস্বচ্ছল। ২০০৫ সালে জাপানের মাথাপিছু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪,২১০ মার্কিন ডলার। জাপানের প্রধান রপ্তানি বাজার হল চীন (১৮.৮৮%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৮.১৩%), তাইওয়ান (৬.২৭%) এবং হংকং (৫.৪৯%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরযান, ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক। জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২২.২%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১০.৯৬%), অস্ট্রেলিয়া (৬.২৯%), সৌদি আরব (৫.২৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪.১২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৯৮%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৩.৯৫%) (২০০৯ সালের জন্য)। জাপানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, জীবাশ্ম জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (বিশেষ করে গরুর মাংস), রাসায়নিক, বস্ত্র এবং তার শিল্পের কাঁচামাল। বাজার ভাগের পরিমাপের দিক থেকে, দেশীয় বাজারগুলি যেকোনো ওইসিডি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো কোইজুমি প্রশাসন প্রতিযোগিতা-বান্ধব কিছু সংস্কার শুরু করেছে এবং সম্প্রতি জাপানে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। জাপানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে অনেক আদিবাসী ধারণা রয়েছে যেমন নেমাওয়াশি, নেঙ্কো ব্যবস্থা, বেতনভোগী এবং অফিস লেডি। জাপানের আবাসন বাজার শহরাঞ্চলে সীমিত জমি সরবরাহ দ্বারা চিহ্নিত। এটি বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম নগর সমষ্টি টোকিওর ক্ষেত্রে সত্য। অর্ধেকেরও বেশি জাপানি শহরতলিতে ও তারও বেশি গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘরগুলিই প্রধান আবাসন ধরণের। জাপানের কৃষি ব্যবসাগুলি প্রায়শই সোপান চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ফসলের ফলন বেশি হয়। জাপানের ১৩% জমি চাষযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার প্রায় ১৫% জাপানে আসে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। জাপানের কৃষি খাত উচ্চ মূল্যে সুরক্ষিত। === বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি === বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষ করে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং জৈব চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে জাপান অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। প্রায় ৭,০০,০০০ গবেষকের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় পনেরোজন নোবেল বিজয়ী, তিনজন ফিল্ডস পদকপ্রাপ্ত এবং একজন গাউস পুরস্কার বিজয়ী তৈরি করেছে। জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদান ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, ভূমিকম্প প্রকৌশল, শিল্প রোবোটিক্স, অপটিক্স, রাসায়নিক, অর্ধপরিবাহী এবং ধাতুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। রোবোটিক্স উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, বিশ্বের শিল্প রোবট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অর্ধেকেরও বেশি (৭৪২,৫০০ এর মধ্যে ৪০২,২০০) জাপানের দখলে। এটি কিউআরআইও, এএসআইএমও এবং এআইবিও তৈরি করেছিল। জাপান বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদক এবং বর্তমানে বিশ্বের পনেরটি বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারকের মধ্যে চারটি এবং বিশ্বের বিশটি বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর বিক্রয় নেতৃত্বের মধ্যে সাতটি এখানে অবস্থিত। [[চিত্র:Kibo_PM_and_ELM-PS.jpg|বাম|থাম্ব| জেএএক্সএ জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশ।]] জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) হল জাপানের মহাকাশ সংস্থা যা মহাকাশ ও গ্রহ গবেষণা, বিমান গবেষণা এবং রকেট ও উপগ্রহের উন্নয়ন পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি অংশগ্রহণকারী এবং ২০০৮ সালে স্পেস শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল (কিবো) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। মহাকাশ অনুসন্ধানে এর পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন ২০১০ সালে শুক্রগ্রহ, আকাতসুকিতে একটি মহাকাশ অনুসন্ধান পাঠানো, ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা বুধের চৌম্বকীয় অরবিটার তৈরি করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে একটি চাঁদের ভিত্তি তৈরি করা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে এটি তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে একটি এইচ-আইআইএ (মডেল এইচ২এ২০২২) ক্যারিয়ার রকেটে চন্দ্র কক্ষপথ অনুসন্ধানকারী "সেলেন" (সেলেনোলজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) উৎক্ষেপণ করে। সেলেন কাগুয়া নামেও পরিচিত প্রাচীন লোককাহিনী "দ্য টেল অফ দ্য ব্যাম্বু কাটার"-এর চন্দ্র রাজকন্যা। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর কাগুয়া হলো সবচেয়ে বড় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর লক্ষ্য হল চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এটি ৪ অক্টোবর চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় চন্দ্র কক্ষপথে উড়ে। == পরিকাঠামো == [[চিত্র:Kansai_International_Airport01n4272.jpg|থাম্ব|কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ প্রকল্প।]] [[চিত্র:JR_East_Shinkansen_lineup_at_Niigata_Depot_200910.jpg|বাম|থাম্ব| জাপানে উচ্চ গতির শিনকানসেন বা ''বুলেট ট্রেন'' পরিবহনের একটি সাধারণ মাধ্যম।]] [[চিত্র:ANA_Boeing_747-481_(JA8962)_in_Pokémon_livery.jpg|ডান|থাম্ব|280x280পিক্সেল|একটি অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ পোকেমন জেট]] ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাপানের জ্বালানির অর্ধেক পেট্রোলিয়াম থেকে ও এক পঞ্চমাংশ কয়লা থেকে এবং ১৪% প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়। জাপানের এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। জাপানের যানবাহন রাস্তার বাম দিকে। উচ্চ-গতির, বিভক্ত, সীমিত-প্রবেশযোগ্য টোল রাস্তার একটি একক নেটওয়ার্ক প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে এবং টোল-সংগ্রহকারী উদ্যোগগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম কম। গাড়ির মালিকানা ফি এবং জ্বালানি শুল্ক শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, মোট ভ্রমণের মাত্র ৫০% দূরত্বের কারণে, গাড়ির ব্যবহার সমস্ত জি৮ দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। জাপানের কয়েক ডজন রেলওয়ে কোম্পানি আঞ্চলিক এবং স্থানীয় যাত্রী পরিবহন বাজারে প্রতিযোগিতা করে; উদাহরণস্বরূপ, ৭টি জেআর এন্টারপ্রাইজ, কিন্টেৎসু কর্পোরেশন, সেইবু রেলওয়ে এবং কেইও কর্পোরেশন। প্রায়শই, এই উদ্যোগগুলির কৌশলগুলিতে স্টেশনের পাশে রিয়েল এস্টেট বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর থাকে। প্রায় ২৫০টি উচ্চ-গতির শিনকানসেন ট্রেন প্রধান শহরগুলিকে সংযুক্ত করে। জাপানি ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত। ১৭৩টি বিমানবন্দর রয়েছে এবং শহরগুলির মধ্যে ভ্রমণের জন্য বিমান একটি জনপ্রিয় উপায়। বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, হানেদা বিমানবন্দর, এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ হল নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (টোকিও অঞ্চল), কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওসাকা/কোবে/কিয়োটো অঞ্চল) এবং চুবু সেন্ট্রেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (নাগোয়া অঞ্চল)। বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে রয়েছে নাগোয়া বন্দর। == জনসংখ্যা == [[চিত্র:Skyscrapers_of_Shinjuku_2009_January.jpg|থাম্ব|বৃহত্তর টোকিও অঞ্চল হল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেট্রোপলিটন এলাকা যেখানে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ বাস করে।]] জাপানের জনসংখ্যা আনুমানিক ১২.৭৩ কোটি (২০১৩)। জাপানি সমাজ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে একজাত, যেখানে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কম। জাপানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাপানি কোরীয়, জাপানি চীনা, ফিলিপিনো, জাপানি ব্রাজিলিয়ান, জাপানি পেরুভীয় অন্যতম। ২০০৩ সালে জাপানে প্রায় ১,৩৬,০০০ পশ্চিমা প্রবাসী ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় জাতিগত গোষ্ঠী হল ইয়ামাতো জাতি; প্রাথমিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আইনু এবং রিউকুয়ান, পাশাপাশি বুরাকুমিনের মতো সামাজিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। জাপানের আয়ুষ্কাল বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি, ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে মানুষের বয়স ছিল ৮৩.১০ বছর। জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধতে পরিণত হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী শিশু বৃদ্ধির প্রভাবে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৫% ছিল ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। [[চিত্র:Shibuya_night.jpg|বাম|থাম্ব| শিবুয়া ক্রসিংয়ের একটি দৃশ্য, যা টোকিওর প্রায়শই জনাকীর্ণ রাস্তার একটি উদাহরণ।]] জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলি বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে, বিশেষ করে কর্মশক্তির জনসংখ্যার সম্ভাব্য হ্রাস এবং পাবলিক পেনশন পরিকল্পনার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি। অনেক জাপানি তরুণ ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে না করা বা পরিবার না রাখা পছন্দ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটি এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে জনসংখ্যাবিদ এবং সরকারি পরিকল্পনাকারীরা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত। দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাকে সহায়তা করার জন্য তরুণ কর্মী সরবরাহের সমাধান হিসেবে কখনও কখনও অভিবাসন এবং জন্ম প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে ২০০৭ সালে জাপান মাত্র ৪১ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করেছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল। জাপানে আত্মহত্যার হার বেশি। ২০০৯ সালে,ল টানা দ্বাদশ বছরের মতো আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। === ধর্ম === [[চিত্র:Itsukushima_Shrine_Torii_Gate_(13890465459).jpg|থাম্ব| শিন্তো ইতসুকুশিমা মন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান]] জাপানে বৌদ্ধ এবং শিনটো ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বোচ্চ অনুমান ৮৪-৯৬%। এটি উভয় ধর্মের একটি বৃহৎ সংখ্যক বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এই পূর্বাভাসগুলো মন্দিরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসরণকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নয়। প্রফেসর রবার্ট কিসালা (নানজান বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শ দেন যে জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করে। চীনের তাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ এবং বৌদ্ধধর্মও জাপানি বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে। জাপানে ধর্ম প্রকৃতিগতভাবে সমন্বয়মূলক, এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অনুশীলন দেখা যায়। যেমন বাবা-মা ও শিশুদের শিন্তো আচার উদযাপন, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনা, খ্রিস্টান গির্জায় দম্পতিদের বিবাহ এবং বৌদ্ধ মন্দিরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এক শতাংশেরও কম খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত আধা শতাংশেরও কম। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক দাবি করেছে দুই শতাংশ (২৪ লাখ)। এছাড়াও, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে জাপানে অসংখ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় (শিনশুকিও) আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সেইচো-নো-ই (৩০ লাখ), টেনরিকিও (২ লাখ), প্লা কিয়োদান (১০ লাখ), সেকাই কিউসেইকিও (১০ লাখ), সুকিও মাহিকারি (১০ লাখ), হনমিচি ৯ লাখ), কনকোকিও ৫ লাখ), তেনশো কোটাই জিঙ্গুকিও (৪ লাখ), এন্নোকিও (৩ লাখ, ১৯৭৮ সালের হিসাবে), কুরোজুমিকিও (২.৫ লাখ) এবং ওমোটো (১.৫ লাখ)। === ভাষা === জনসংখ্যার ৯৯% এরও বেশি মাতৃভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় কথা বলে। এটি একটি সমষ্টিগত ভাষা। জাপানি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে এমন সম্মানসূচক ব্যবস্থা দ্বারা আলাদা। সেখানে ক্রিয়াপদের রূপ এবং নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলো বক্তা এবং শ্রোতার আপেক্ষিক অবস্থা নির্দেশ করে। জাপানি অভিধান শিনসেন-কোকুগোজিতেন অনুসারে, চীনা-ভিত্তিক শব্দগুলি মোট শব্দভান্ডারের ৪৯.১%, আদিবাসী শব্দগুলি ৩৩.৮% এবং অন্যান্য ধার করা শব্দগুলি ৮.৮%। লেখার পদ্ধতিতে কাঞ্জি (চীনা অক্ষর) এবং দুটি সেট কানা (সরলীকৃত চীনা অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিলেবার), পাশাপাশি লাতিন বর্ণমালা এবং আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। জাপানি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রিউকুয়ান ভাষাসমূহ ওকিনাওয়াতে প্রচলিত। তবে বর্তমানে খুব কম শিশুই এই ভাষাগুলি শেখে। আইনু ভাষা মৃতপ্রায়। হোক্কাইডোতে মাত্র কয়েকজন বয়স্ক স্থানীয় ভাষাভাষী অবশিষ্ট রয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কোর্স করতে হয়। == শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য == [[চিত্র:Yasuda_Auditorium,_Tokyo_University_-_Nov_2005.JPG|থাম্ব| জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসুদা অডিটোরিয়াম।]] মেইজি পুনরুদ্ধারের ফলে ১৮৭২ সালে জাপানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা নয় বছর (৬ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) স্থায়ী হয়। প্রায় সকল শিশু তিন বছরের সিনিয়র হাই স্কুলে তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখে এবং এমইএক্সটি অনুসারে ২০০৫ সালে প্রায় ৭৫.৯% উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, ট্রেড স্কুল বা অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রতিযোগিতামূলক, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে। জাপানের দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসিডি দ্বারা সমন্বিত আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন প্রোগ্রাম বর্তমানে ১৫ বছর বয়সীদের জাপানি জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা হিসেবে স্থান দেয়। জাপানে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এটি একটি সরকারি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত ফি সহ আপেক্ষিক সমতা প্রদান করে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে বীমাবিহীন ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৯৭৩ সাল থেকে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি বীমার আওতায় এসেছেন। রোগীরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের চিকিৎসক বা সুবিধা ঠিক করতে পারে। == সংস্কৃতি এবং বিনোদন == [[চিত্র:Genji_emaki_01003_001.jpg|বাম|থাম্ব| বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দ্য টেল অফ গেঞ্জির একটি হাতের লেখার পৃষ্ঠাগুলি]] জাপানি সংস্কৃতি দেশটির আদি জোমোন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমসাময়িক সংস্কৃতি পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রভাবকে একত্রিত করে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি শিল্পের মধ্যে রয়েছে কারুশিল্প (ইকেবানা, অরিগামি, উকিয়ো-ই, পুতুল, বার্ণিশের পাত্র, মৃৎশিল্প), পরিবেশনা (বুনরাকু, নৃত্য, কাবুকি, নোহ, রাকুগো), ঐতিহ্য (খেলা, চা অনুষ্ঠান, বুদো, স্থাপত্য, বাগান, তরবারি) এবং রন্ধনপ্রণালী। ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং পশ্চিমা শিল্পের মিশ্রণের ফলে মাঙ্গা তৈরি হয়, যা সাধারণত জাপানি কমিক বইয়ের একটি বিন্যাস যা এখন জাপানের ভেতরে এবং বাইরে জনপ্রিয়। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য মাঙ্গা-প্রভাবিত অ্যানিমেশনকে অ্যানিমে বলা হয়। জাপানি তৈরি ভিডিও গেম কনসোলগুলি ১৯৮০ এর দশক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। [[চিত্র:Kinkaku_Snow_E4.jpg|থাম্ব|310x310পিক্সেল| স্বর্ণমণ্ডপের মন্দির (''কিঙ্কাকুজি'')]] জাপানি সঙ্গীত সারগ্রাহীতে প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকে বাদ্যযন্ত্র, স্কেল এবং শৈলী ধার করা হয়েছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে কোটোর মতো অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটে। নোহ নাটকের আবৃত্তি চতুর্দশ শতাব্দীর এবং জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত, গিটারের মতো শামিসেন সহ, ষোড়শ শতাব্দীর। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এখন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আধুনিক সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে জে-পপ নামক জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে। কারাওকে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে একটি। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে যে, সেই বছর জাপানিরা ফুল সাজানো বা চা অনুষ্ঠানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি সংখ্যক কারাওকে গেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি ইতিহাসের বই কোজিকি এবং নিহোন শোকি এবং অষ্টম শতাব্দীর কাব্যগ্রন্থ মান'য়োশু, যা সবই চীনা অক্ষরে লেখা। হেইয়ান যুগের প্রাথমিক দিনগুলিতে, কানা (হিরাগানা এবং কাতাকানা) নামে পরিচিত প্রতিলিপি পদ্ধতিটি ফোনোগ্রাম হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশ কাটার গল্পটিকে প্রাচীনতম জাপানি আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই শোনাগনের লেখা "দ্য পিলো বুক" বইয়ে হেইয়ানের রাজদরবারের জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে লেডি মুরাসাকির লেখা "দ্য টেল অফ গেঞ্জি" বইটিকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এডো যুগে সাহিত্য ততটা সামুরাই অভিজাতদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য তখন ছিল চোনিন তথা সাধারণ মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োমিহোন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাঠক এবং লেখকত্বের এই গভীর পরিবর্তন প্রকাশ করে। মেইজি যুগে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক রূপের পতন ঘটে, এই সময়ে জাপানি সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব একীভূত হয়। নাটসুমে সোসেকি এবং মোরি ওগাই ছিলেন জাপানের প্রথম "আধুনিক" ঔপন্যাসিক, তার পরে ছিলেন রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া, জুন'ইচিরো তানিজাকি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা এবং সম্প্রতি হারুকি মুরাকামি। জাপানে দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক আছেন - ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪)। == খেলাধুলা == [[চিত্র:Asashoryu_fight_Jan08.JPG|বাম|থাম্ব| একটি সুমো ম্যাচ]] ঐতিহ্যগতভাবে সুমো জাপানের জাতীয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। এটি দর্শকদের কাছে বেশ একটি জনপ্রিয় খেলা। জুডো, কারাতে এবং আধুনিক কেন্দোর মতো মার্শাল আর্টও দেশটিতে দর্শকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুশীলন এবং উপভোগ করা হয়। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানে অনেক পশ্চিমা খেলাধুলা চালু হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানে পেশাদার বেসবল লীগ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ বেসবল দেশের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় খেলা। জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হলেন ইচিরো সুজুকি। তিনি ১৯৯৪, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন। এখন তিনি উত্তর আমেরিকান মেজর লীগ বেসবলের নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের হয়ে খেলেন। এর আগে সাদাহারু ওহ জাপানের বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। জাপানে তার ক্যারিয়ারে তার সমসাময়িক হ্যাঙ্ক অ্যারনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা হোম রান করেছিলেন তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে জাপান পেশাদার ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলও (সকার) যথেষ্ট অনুসারী অর্জন করেছে। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের একটি ভেন্যু ছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল। জাপান এশিয়ার অন্যতম সফল ফুটবল দল, চারবার এশিয়ান কাপ জিতেছে, সম্প্রতি ২০১১ সালে। জাপানে গলফও জনপ্রিয়। যেমন সুপার জিটি স্পোর্টস কার সিরিজ এবং ফর্মুলা নিপ্পন ফর্মুলা রেসিংয়ের মতো অটো রেসিং। জাপানে ইন্ডিকার রেসিং আনার জন্য হোন্ডা ১৯৯৭ সালে টুইন রিং মোতেগি সম্পন্ন করে। ১৯৬৪ সালে জাপান টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। জাপান দুবার শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে: ১৯৭২ সালে সাপ্পোরোতে এবং ১৯৯৮ সালে নাগানোতে। ২০২০ সালে জাপান আবার টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের কথা রয়েছে। lwwmdhilij24julmw2i1xtz83pan379 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) 0 27197 85477 85329 2025-06-30T22:14:15Z Jonoikobangali 676 85477 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} e8jlvmxxrtq17m2qytqfuoubsh4ofqo 85479 85477 2025-06-30T22:16:38Z Jonoikobangali 676 85479 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} dgzx84icb4rxb2bt30qv7e0jzjxvkkd 85481 85479 2025-06-30T22:31:27Z Jonoikobangali 676 85481 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} 4adym23iz54yea85qu1lwolxr42iskl 85483 85481 2025-06-30T22:35:34Z Jonoikobangali 676 85483 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} fwq3ho3f44lumnkby8kbljt5xvsoz2p 85485 85483 2025-06-30T22:38:08Z Jonoikobangali 676 85485 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} qdsee9bcalbysxc1gukn4upbkayw6aa 85487 85485 2025-06-30T22:40:55Z Jonoikobangali 676 85487 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} dplbwbf65s21nimew8krt9lm54cmge5 85488 85487 2025-06-30T22:47:22Z Jonoikobangali 676 85488 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] [[File:Luipa.jpg|thumb|মহাসিদ্ধ লুইপাদ, তিব্বতি চিত্রকলা]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} q6dp7b3m1mt4gxwyw4hg97rj1pis3sm 85489 85488 2025-06-30T22:50:06Z Jonoikobangali 676 85489 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} dplbwbf65s21nimew8krt9lm54cmge5 85490 85489 2025-06-30T22:51:47Z Jonoikobangali 676 /* অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত */ 85490 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} 0nzw140703smhlclkw7ow0nr8f3z30b 85494 85490 2025-07-01T06:03:44Z Jonoikobangali 676 85494 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} 6ulollp2jf9d9371atw5som235p13au 85496 85494 2025-07-01T06:05:54Z Jonoikobangali 676 85496 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} 2tmf2acg7sr4v3hgfpm5vmhfqn0573b 85498 85496 2025-07-01T09:45:19Z Jonoikobangali 676 85498 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} ex0fvfmwb2v7ymbe3lui9ug7dqqc89w 85500 85498 2025-07-01T10:51:00Z Jonoikobangali 676 85500 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} pul6z9d5bykgbjamds9n3ggevw1q7um 85502 85500 2025-07-01T11:23:18Z Jonoikobangali 676 85502 wikitext text/x-wiki {| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE" |- | style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px"> {{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}} এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা। এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ। |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" |} {| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE" <!-- ### পর্ব ১ ### --> |- | style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div> | style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big> # [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]] ## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]] # [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]] ## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]] ## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]] ### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]] ### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]] ## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]] | style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" | |} ===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক=== # [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]] # [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ অনুবাদ # [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]] ; মহাভারত অনুবাদ # [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]] # [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]] ; ভাগবত অনুবাদ # [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল==== ; মনসামঙ্গল # [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]] # [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]] # [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]] # [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]] ====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস==== # [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]] # [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]] ===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক=== ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর==== ; মনসামঙ্গল # [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]] # [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]] ; চণ্ডীমঙ্গল # [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]] # [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]] # [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]] # [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]] # [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]] ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]] # [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]] # [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]] # [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]] # [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]] # [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]] # [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]] # [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]] # [[/মাধবদাস|মাধবদাস]] # [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]] ====চরিতকাব্য==== # [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]] # [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]] # [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]] # [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]] # [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]] # [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]] ; মহাভারত # [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]] ; ভাগবত # [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]] # [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]] # [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]] ===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক=== ====বৈষ্ণব পদাবলি==== # [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]] # [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]] # [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]] =====বৈষ্ণব পদসংকলন===== # [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]] # [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]] # [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]] # [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]] # [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]] ====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন==== ; মনসামঙ্গল # [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]] # [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]] # [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]] ; ধর্মমঙ্গল # [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]] # [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]] # [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]] # [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]] # [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]] # [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]] ; অন্নদামঙ্গল # [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]] ; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর # [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]] # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]] ; শিবায়ন # [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]] ====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত==== ; রামায়ণ # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]] # [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]] ; মহাভারত # [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]] # [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]] # [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]] ; ভাগবত # [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]] # [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]] # [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]] # [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]] ====শাক্ত পদাবলি==== # [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]] # [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]] # [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]] ====নাথ সাহিত্য==== # [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]] ====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা==== # [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]] # [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]] ====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য==== # [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]] {{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}} {{বর্ণানুক্রমিক|ব}} {{বিষয়|সাহিত্য}} {{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}} a92fjjc0olw6hcr120dg6utzagnwldx ব্যবহারকারী:Ibrahimal1981 2 27227 85445 2025-06-30T15:21:05Z Ibrahimal1981 11768 "= ইবাদাতের গুরুত্ব = ইবাদাত হল আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের প্রকাশ। নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব — সবই ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: **وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون** অ..." দিয়ে পাতা তৈরি 85445 wikitext text/x-wiki = ইবাদাতের গুরুত্ব = ইবাদাত হল আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের প্রকাশ। নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব — সবই ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: **وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون** অর্থ: "আমি জিন ও মানব জাতিকে কেবল আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।" (সূরা যারিয়াত: ৫৬) == ইবাদাতের প্রকারভেদ == * শারীরিক: নামায, রোযা * আর্থিক: যাকাত, কুরবানি * যৌথ: হজ্ব == উপকারিতা == * আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন * আত্মিক পরিশুদ্ধি * গুনাহ মোচন * জান্নাতের পথ সুগম == উপসংহার == ইবাদাতের মাধ্যমে একজন মুসলিম তার দুনিয়া ও আখিরাতকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে। d5932oxtqqzh2euvxbnd4jeon7rylku ব্যবহারকারী আলাপ:শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 3 27228 85449 2025-06-30T15:40:09Z KanikBot 8129 স্বাগতম! 85449 wikitext text/x-wiki == বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত == {{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ১৫:৪০, ৩০ জুন ২০২৫ (ইউটিসি) 77bwon0exrxwy6b540u2iscyk713piu ব্যবহারকারী আলাপ:Ibrahimal1981 3 27229 85450 2025-06-30T15:40:19Z KanikBot 8129 স্বাগতম! 85450 wikitext text/x-wiki == বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত == {{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ১৫:৪০, ৩০ জুন ২০২৫ (ইউটিসি) 77bwon0exrxwy6b540u2iscyk713piu টেমপ্লেট:Only in print 10 27230 85452 2025-06-30T15:44:43Z Mehedi Abedin 7113 "{{#if:{{hide in print|1}}||{{{1|}}}}}<noinclude> {{documentation}} </noinclude>" দিয়ে পাতা তৈরি 85452 wikitext text/x-wiki {{#if:{{hide in print|1}}||{{{1|}}}}}<noinclude> {{documentation}} </noinclude> rm8emca34tsah296fr9jh9dzgyhnfxo বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)/চর্যাপদ 0 27231 85475 2025-06-30T22:08:47Z Jonoikobangali 676 "বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়..." দিয়ে পাতা তৈরি 85475 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। dm9pueawqoak4f3xprms8d2aq843h0x 85476 85475 2025-06-30T22:12:21Z Jonoikobangali 676 85476 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। a8bmq938kraky74g60zqwshtpoa2dlf 85478 85476 2025-06-30T22:16:08Z Jonoikobangali 676 /* রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার */ 85478 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। 2xn8t79vj4sdgop8zk5nyywvae33tv2 85480 85478 2025-06-30T22:30:03Z Jonoikobangali 676 /* কবি */ 85480 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। 2mb9y2e82xl87j2mp0jw4geh7buodyv 85482 85480 2025-06-30T22:35:07Z Jonoikobangali 676 /* লুইপাদ */ 85482 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ad3vxhtnk2w8dp0jnek6hisj9qy6qug 85484 85482 2025-06-30T22:36:37Z Jonoikobangali 676 /* শবরীপাদ */ 85484 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। na3kv2qgnus2323znb4izpmm2cvfi5f 85486 85484 2025-06-30T22:40:22Z Jonoikobangali 676 /* ভুসুকুপাদ */ 85486 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। 4u6wunvmt8z8i4x8qoil1idwc68gb1i 85493 85486 2025-07-01T06:02:35Z Jonoikobangali 676 /* ভুসুকুপাদ */ 85493 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ===সরহপাদ=== লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্‌বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্‌চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। 5u7lo48cojg6vbca97id489ww4qo3n6 85495 85493 2025-07-01T06:05:27Z Jonoikobangali 676 /* সরহপাদ */ 85495 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ===সরহপাদ=== লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্‌বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্‌চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত। ===কাহ্নপাদ=== চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। mbitxynh38yz61yayar4jr42shtg2gk 85497 85495 2025-07-01T09:44:47Z Jonoikobangali 676 /* কাহ্নপাদ */ 85497 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ===সরহপাদ=== লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্‌বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্‌চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত। ===কাহ্নপাদ=== চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়। ===বিরূপপাদ=== বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। n2mr50lti9ioo4wq4arn5ypo4yukkdb 85499 85497 2025-07-01T10:50:00Z Jonoikobangali 676 /* বিরূপপাদ */ 85499 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ===সরহপাদ=== লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্‌বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্‌চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত। ===কাহ্নপাদ=== চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়। ===বিরূপপাদ=== বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ===শান্তিপাদ=== শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। pboen5r6mcvxsucby6dobamjstltoot 85501 85499 2025-07-01T11:22:20Z Jonoikobangali 676 /* শান্তিপাদ */ 85501 wikitext text/x-wiki বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ। চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে। টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্‌গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্‌ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার== ১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্‌পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে। চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্‌-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্‌ঠা-পণট্‌ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না। তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল। চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল। এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্‌। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন। চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.” হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্‌সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্‌” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ==কবি== চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। ===লুইপাদ=== টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===শবরীপাদ=== মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত। ===ভুসুকুপাদ=== অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্‌কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্‌বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা। ===সরহপাদ=== লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্‌বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্‌চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত। ===কাহ্নপাদ=== চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়। ===বিরূপপাদ=== বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ===শান্তিপাদ=== শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে। ===দারিকপাদ=== দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে। ==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব== সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্‌, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্‌”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন। মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্‌।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে। সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্‌ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল: {| class="wikitable" |- | মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত |- | হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য |- | কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্‌ || গ্রাহক শূন্য |- | নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য |} সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্‌গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন: <poem> :: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ। :: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।... :: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। :: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।। </poem> এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্‌গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। er3j9w9hgzo48uhq0u4gdpzvmus7d58