উইকিবই
bnwikibooks
https://bn.wikibooks.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE
MediaWiki 1.45.0-wmf.8
first-letter
মিডিয়া
বিশেষ
আলাপ
ব্যবহারকারী
ব্যবহারকারী আলাপ
উইকিবই
উইকিবই আলোচনা
চিত্র
চিত্র আলোচনা
মিডিয়াউইকি
মিডিয়াউইকি আলোচনা
টেমপ্লেট
টেমপ্লেট আলোচনা
সাহায্য
সাহায্য আলোচনা
বিষয়শ্রেণী
বিষয়শ্রেণী আলোচনা
উইকিশৈশব
উইকিশৈশব আলাপ
বিষয়
বিষয় আলাপ
রন্ধনপ্রণালী
রন্ধনপ্রণালী আলোচনা
TimedText
TimedText talk
মডিউল
মডিউল আলাপ
উইকিশৈশব:কাজের দুনিয়া/অগ্নিনির্বাপক
100
10144
85544
36587
2025-07-01T22:38:18Z
FireDragonValo
11769
Changed colors of the Canadian flag to the Pantone version as recommended by the government of Canada.
85544
wikitext
text/x-wiki
{| border="0" cellspacing="0" cellpadding="5" align="center"
|[[চিত্র:Firemensatwork.jpg|600px]]
<div style="font-size: 12px;" align="center">
| style="background:#AF0000" valign="top"| <center><div style="font-size: 40px;"> <br/>'''কানাডা'''</div>
<br>
[[চিত্র:LocationCanada.png|250px]]
{{clear}}
<br>
-------------
<br>
<center><div style="font-size: 36px; line-height: 150%"> '''দমকলকর্মী'''</div>
<div style="font-size: 20px;" align="left">
<br>
'''দমকলকর্মী আগুন নেভান। এখানে দমকলকর্মীরা আগুন নেভাচ্ছেন।'''</div>
<br>
<div style="font-size: 20px;" align="left">''তোমার কী মনে হয়? আগুন কিভাবে লেগেছে?''</div>
<br>
[[চিত্র:Flag_of_Canada (Pantone).svg|200px|কেন্দ্র|কানাডার পতাকা]]
কানাডার পতাকা</Center>
|}
{{chapnav|Baker|সার্জন|Wikijunior:World at Work}}
[[fr:Wikijunior:Le monde au travail/Pompier]]
3ggjuh51t6bz4q4elpyi5z38qi670c4
ব্যবহারকারী:R1F4T/খেলাঘর
2
18619
85537
85474
2025-07-01T15:43:43Z
R1F4T
9121
85537
wikitext
text/x-wiki
;পর্যালোচনা পরিসংখ্যান
{| class="wikitable sortable"
! # !! পর্যালোচক !! পর্যালোচনা সংখ্যা
|-
| ১ || MS Sakib || ২৭৪
|-
| ২ || MdsShakil || ২৭২
|-
| ৩ || NusJaS || ২৫১
|-
| ৪ || Mehedi Abedin || ১৭৬
|-
| ৫ || R1F4T || ১৬৭
|-
| ৬ || Tahmid || ১৪০
|-
| ৭ || Yahya || ১৩৮
|-
| ৮ || Ishtiak Abdullah || ১০৭
|-
| ৯ || Maruf || ৪
|-
! colspan="2" | মোট পর্যালোচিত পৃষ্ঠা || ১৫২৯টি
|}
rrilf4e9wuvafk9q4ziv0yltb5ptt4b
ব্যবহারকারী আলাপ:Sheikh Mehedi Hassan
3
19214
85512
85409
2025-07-01T14:53:42Z
Mehedi Abedin
7113
/* মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস/ইউরোপীয় ইতিহাস */ নতুন অনুচ্ছেদ
85512
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ১০:৪০, ৩ জুন ২০২৪ (ইউটিসি)
== স্বাক্ষরকৃত নিবন্ধ তৈরি ==
সুধী, শুভেচ্ছা নিন। গত ২ দিন পূর্বে [[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪/বইয়ের তালিকা|এই তালিকায়]] [[কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত্তি/কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা]] পাতাটির নামের পাশে আমি সাক্ষর করেছিলাম। তবে বাস্তব জীবনে কিছুটা ব্যস্ত থাকায় সেটি শুরু করতে পারি নি। আজ সেটি তৈরি করতে গিয়ে দেখি আপনি সেটি আগেই তৈরি করে ফেলেছেন। যাইহোক, আমি সেই তালিকা থেকে আমার স্বাক্ষর অপসারণ করে ফেলব। কিন্তু স্বাক্ষরকৃত পাতাগুলো স্বাক্ষরকারীকে জানানো ব্যতিত তৈরি করবেন না। পরেরবার থেকে তালিকা থেকে কোনো পাতা শুরু করার পূর্বে অন্য কেউ এতে স্বাক্ষর করেছেন কিনা সেটি দেখে নিবেন। উইকিতে আপনার যাত্রা শুভ হোক। ধন্যবাদ। [[ব্যবহারকারী:Tanvir 360|Tanvir 360]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Tanvir 360|আলাপ]]) ০৬:৪৫, ১৪ জুন ২০২৪ (ইউটিসি)
== স্বাক্ষরিত পাতা তৈরি ==
দুঃখিত, আমি উইকিতে খুব বেশিদিন হয়নি যুক্ত হ
ে
্ত হয়েছি,তাই স্বাক্ষরের ব্যাপারটি এখ,পাতাটি লাল হওয়ায় ভেবেছি কেউ করেনি,তাই এটি তৈরি করে ফেলেছি। ক্ষমাপ্রার্থী নো বুঝতে পারিনি [[ব্যবহারকারী:Sheikh Mehedi Hassan|Sheikh Mehedi Hassan]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Sheikh Mehedi Hassan|আলাপ]]) ০৬:৫৩, ১৪ জুন ২০২৪ (ইউটিসি)
== উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪: তথ্য প্রদানের অনুরোধ ==
{| style="margin: 1em 4em;"
|- valign="top"
| [[চিত্র:Wikibooks Writing Contest.svg|146px|link=উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪]]
| <div style="background-color:#f4f3f0; color: #393D38; padding: 0.4em 1em;border-radius:10px;">
সুপ্রিয় Sheikh Mehedi Hassan,<br>[[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪|উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪]]-এ অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, আপনার জমা দেয়া এক বা একাধিক পাতা প্রতিযোগিতায় গৃহীত হয়েছে। আপনাকে অভিনন্দন! আয়োজক দল পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ করছে। তাই আমরা আপনাকে '''[https://docs.google.com/forms/d/e/1FAIpQLSfbU0XnUtQltWCaC59XqYCfjFicHrveyMOi_wW_g-I4FRnJMA/viewform?usp=sf_link এই ফর্মটি পূরণ করতে] অনুরোধ করছি'''। যদি আপনি ইতোমধ্যেই ফর্মটি পূরণ করে থাকেন, তাহলে দয়া করে দ্বিতীয়বার পূরণ করবেন না। আপনার সম্পাদনা-যাত্রা শুভ হোক। প্রতিযোগিতার আয়োজক দলের পক্ষে —[[ব্যবহারকারী:MdsShakil|শাকিল]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:MdsShakil|আলাপ]]) ১০:২১, ২৯ জুলাই ২০২৪ (ইউটিসি)
</div>
|}
<!-- https://bn.wikibooks.org/w/index.php?title=%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80:MdsShakil/%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%98%E0%A6%B0&oldid=69589-এর তালিকা ব্যবহার করে বার্তাটি ব্যবহারকারী:MdsShakil@bnwikibooks পাঠিয়েছেন -->
== উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪ পদক ==
{| style="background-color: #fdffe7; border: 1px solid #fceb92;"
|rowspan="2" style="vertical-align: middle; padding: 5px;" | [[চিত্র:Wikibooks Writing Contest barnstar.svg|100px]]
|style="font-size: x-large; padding: 3px 3px 0 3px; height: 1.5em;" | '''উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪ পদক'''
|-
|style="vertical-align: middle; padding: 3px;" | সুপ্রিয় Sheikh Mehedi Hassan,<br />বাংলা উইকিবইয়ে সম্প্রতি আয়োজিত, '''[[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪|উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪]]''' শীর্ষক গ্রন্থলিখন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করায় আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্রতিযোগিতায় তালিকাভুক্ত গ্রন্থ/গ্রন্থপৃষ্ঠা তৈরির মাধ্যমে বাংলা উইকিবইয়ের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখায়, শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে আপনাকে এই উইকিপদকটি প্রদান করা হলো। আশা করি বাংলা উইকিবইয়ের পথচলায় আপনার সরব ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদে থাকুন।
<br />শুভেচ্ছান্তে,
<br />'''[[User:MdsShakil|শাকিল হোসেন]]'''
<br />সমন্বয়ক, উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৪
<br />১০:৩৩, ২৪ আগস্ট ২০২৪ (ইউটিসি)
|}
<!-- https://bn.wikibooks.org/w/index.php?title=%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80:MdsShakil/%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%98%E0%A6%B0&oldid=69912-এর তালিকা ব্যবহার করে বার্তাটি ব্যবহারকারী:MdsShakil@bnwikibooks পাঠিয়েছেন -->
== [[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫|উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫: অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ]] ==
{| style="background-color: #f8f9fa; border: 1px solid #ced4da; padding:10px; color: #212529;"
|-
|[[File:Bangla Wikibooks Writing contest 2025 Banner (2).png|frameless|center|300px|link=[[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫]]]]<br/>
সুপ্রিয় Sheikh Mehedi Hassan,
আশা করি এই গ্রীষ্মের এই রৌদ্রোজ্জ্বল তপ্ত আবহাওয়াতেও ভালো আছেন। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, গত ৭ মে থেকে বাংলা উইকিবইয়ে '''[[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫|উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫]]''' শীর্ষক একটি বই লিখন ও অনুবাদ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আপনাকে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। প্রতিযোগিতাটি অভিজ্ঞ, অনভিজ্ঞ ও নতুন ব্যবহারকারী সকলের জন্যই মুক্ত।
অন্যান্য ভাষার উইকিবইয়ের চাইতে বাংলা উইকিবইয়ে অবদানকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম, এমনকি সংখ্যাটি বাংলা উইকিপিডিয়ার তুলনায়ও নগণ্য। অথচ ডিজিটাল বইয়ের এই যুগে বাংলা উইকিবই যথেষ্ট গুরত্বের দাবি রাখে। এজন্য আমাদের আরও স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। আশা করি আপনি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন ও উইকিবইকে সমৃদ্ধ করবেন। বিস্তারিত [[উইকিবই:উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫|প্রকল্প পাতায়]] দেখুন।
'''শীর্ষ অবদানকারীদের জন্য পুরষ্কার'''
* ১ম স্থান অধিকারকারী ― ৬০০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* ২য় স্থান অধিকারকারী ― ৪০০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* ৩য় স্থান অধিকারকারী ― ৩০০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* ৪র্থ স্থান অধিকারকারী ― ২৫০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* ৫ম স্থান অধিকারকারী ― ২০০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* ৬ষ্ঠ থেকে ১০তম স্থান অধিকারকারী (৫ জন) ― ৫০০ টাকার গিফট ভাউচার ও মুদ্রিত সনদপত্র
* কমপক্ষে একটি পাতা গৃহীত হলে ― ডিজিটাল সনদপত্র
প্রতিযোগিতায় আপনাকে স্বাগত।<br />
শুভেচ্ছান্তে, <br /> —[[ব্যবহারকারী:MdsShakil|শাকিল]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:MdsShakil|আলাপ]]) ০৬:৪৪, ১১ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
|}
<!-- https://bn.wikibooks.org/w/index.php?title=%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80:MdsShakil/%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE&oldid=74028-এর তালিকা ব্যবহার করে বার্তাটি ব্যবহারকারী:MdsShakil@bnwikibooks পাঠিয়েছেন -->
== রন্ধনপ্রণালী:চিকেন কোপ্তা ==
রন্ধনপ্রণালীতিতে অনেক ইংরেজি শব্দ আছে যা বাংলা করতে হবে এবং বহিঃসংযোগ,আরও রেসিপি এই অনুচ্ছেদসমূহ সরিয়ে ফেলতে হবে [[ব্যবহারকারী:R1F4T|R1F4T]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:R1F4T|আলাপ]]) ০৬:১২, ১৬ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
:ঠিক করা হয়েছে, আবার চেক করার অনুরোধ করছি [[ব্যবহারকারী:Sheikh Mehedi Hassan|Sheikh Mehedi Hassan]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Sheikh Mehedi Hassan|আলাপ]]) ১২:১৪, ১৮ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
::@[[ব্যবহারকারী:R1F4T|R1F4T]]T ঠিক করা হয়েছে, আবার চেক করার অনুরোধ করছি [[ব্যবহারকারী:Sheikh Mehedi Hassan|Sheikh Mehedi Hassan]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Sheikh Mehedi Hassan|আলাপ]]) ১২:১৪, ১৮ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
:::{{করা হয়েছে|গ্রহণ করা হয়েছে}} [[ব্যবহারকারী:R1F4T|R1F4T]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:R1F4T|আলাপ]]) ১০:৫৬, ২৭ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
:@[[ব্যবহারকারী:R1F4T|R1F4T]]T এই পাতাটি এবং 'রন্ধনপ্রণালী:ডিমরোল' পাতাটি সংশোধন করা হয়েছে, পুনরায় চেক করার অনুরোধ রইলো। [[ব্যবহারকারী:Sheikh Mehedi Hassan|Sheikh Mehedi Hassan]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Sheikh Mehedi Hassan|আলাপ]]) ১৮:৪৮, ১৯ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
::{{করা হয়েছে|গ্রহণ করা হয়েছে}} [[ব্যবহারকারী:R1F4T|R1F4T]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:R1F4T|আলাপ]]) ১০:৫৮, ২৭ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[সমাজবিজ্ঞানের পরিচিতি/সমাজবিজ্ঞানীয় পদ্ধতি]] ==
এই পাতাটি এআই দিয়ে অনুবাদ করা হলেও পর্যাপ্ত সংশোধন করা হয়নি। প্রতিযোগিতার পর্যালোচনার কাজ সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বে পাতার সমস্যা সমাধান করে আমাকে মেনশন করে জানিয়ে পাতাটিকে পুনঃপর্যালোচনা করাতে পারলে পাতাটি গ্রহণ করানো যেতে পারে। নয়তো বাতিল হবে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৩:১২, ২৬ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[ইন্দ্রিয়তন্ত্র/মাছ]] ==
পাতাটি অসম্পূর্ণ বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছি। তবে প্রতিযোগিতার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগে পাতাটি সম্পূর্ণ করে আমাকে মেনশন করে জানালে এটা গ্রহণ করে নিতে পারবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৩:১৭, ২৬ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[তত্ত্ব শিখন/তথ্যসূত্র]] ==
এই পাতায় বেশকিছু ইস্যু আছে। সাধারণত সূত্রের শিরোনাম ভিন্ন ভাষায় হলে সেটা বাংলা অক্ষরে লিখতে হয়, যেমন You = ইউ। কিন্তু আপনি এখানে শিরোনাম সরাসরি বাংলা করেছেন। ইস্যু সমাধান করে আমাকে মেনশন করলে পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিবো, অবশ্য যদি সমগ্র পর্যালোচনা প্রক্রিয়া সমাপ্ত না হয় সেক্ষেত্রে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৩:১৬, ২৮ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস/ইউরোপীয় ইতিহাস]] ==
পাতার অনুবাদ অসম্পূর্ণ বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছি। প্রতিযোগিতার পর্যালোচনা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগে পাতাটি সম্পূর্ণ করে আমাকে মেনশন করলে পুনঃপর্যালোচনার জন্য বিবেচনা করবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৪:৫৩, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
g2zdemiztrawt0gb1r4tp46hjlu2f91
ব্যবহারকারী:তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী
2
21823
85542
85352
2025-07-01T17:43:48Z
তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী
9680
85542
wikitext
text/x-wiki
লেখক পরিচতি
'''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
'''Tushar Kanti Sannigrahi'''
জন্ম তারিখ: ১ মার্চ ১৯৫৩। জন্মস্থান: পুটিয়াদহ, বাঁকুড়া।
স্থায়ী ঠিকানা: মদনবাগ, সিমলাপাল, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিন- ৭২২১৫১
পিতা: বারিদবরণ ষন্নিগ্রহী, মাতা: সুষমা দেবী।
তুষারকান্তি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেন মেদিনীপুর কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে। সহ-শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেন এই সব স্কুলে; কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। বাসন্তী হাইস্কুল, বাসন্তী, দক্ষিণ ২৪ পরগণা। রাজবলহাট হাইস্কুল, রাজবলহাট, হুগলি। সিমলাপাল মদনমোহন হাইস্কুল, সিমলাপাল, বাঁকুড়া। লেখক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন দুটি স্কুলে - কমলপুর নেতাজি হাইস্কুল, কমলপুর, বাঁকুড়া এবং ভূতশহর হাইস্কুল, ভূতশহর, বাঁকুড়া। লেখক প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নেন ২০১৩ সালে। তারপর আরো তিন বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের (বাঁকুড়া জেলা) একাডেমিক সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন। লেখক পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। লেখালেখি এবং সাংবাদিকতা করা লেখকের অন্যতম নেশা। তার লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দশটি। তার সম্পাদিত পত্রিকা পাঁচটি।
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী একজন ভারতীয় উইকিপিডিয়ান। উইকিপিডিয়াতে সম্পাদিত নিবন্ধের সংখ্যা প্রায় ২২ হাজারের উপর।
'''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী:''' অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। প্রাক্তন সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির মুখপত্র শিক্ষা ও শিক্ষক। উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি। সদস্য: পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি। সম্পাদক: কৃষ্টি কিরণ। ঠিকানা: মদনবাগ,সিমলাপাল, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিন: ৭২২১৫১।
ছোটবেলা থেকেই তুষারকান্তি লেখালেখি শুরু করেন। স্কুলে পড়াশোনা করার সময় তার লেখা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ব্যানার্জিডাঙ্গা হাই স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা 'মুকুলিকা' তে তার প্রথম লেখা প্রবন্ধ ছিল'চাঁদা মামা'। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের মেদিনীপুর কলেজ পত্রিকায় তার লেখা 'ভিটামিন ও তার প্রয়োজনীয়তা' প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবৃত্ত পুনর্মিলন স্মরণীতে প্রবন্ধ 'প্রাণ রসায়নের গোড়ার কথা'প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬-১৯৭৭ সালের প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি'প্রবন্ধটি। তখনকার দিনে এই প্রবন্ধ প্রকাশের পরে কলকাতার বুকে লেখক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনেক লেখক এবং গবেষক এই প্রবন্ধ থেকেই ভাদু গান, টুসু গান এবং লোকসংস্কৃতির উপাদান সংগ্রহ করে তাদের রচনাতে স্থান দেন। ১৯৮৫-১৯৮৬ সালে নিখিল বঙ্গ শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় 'সিমলাপালের লোকসংস্কৃতি' প্রবন্ধ।
শিক্ষকতার সাথে সাথে তুষারকান্তি সাংবাদিকতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, ভূমিলক্ষ্মী, যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী, দি স্টেটসম্যান ,অমৃতবাজার পত্রিকা, দক্ষিণবঙ্গ সংবাদ, বাঁকুড়া বার্তা সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্যাদিতে অনেক প্রতিবেদন, খবরাখবর, চিঠিপত্র, নিবন্ধ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন এবং চিঠিপত্রের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। তিনি প্রায় ১০০ টি কবিতাও লিখেছেন। সেগুলিও সংবাদপত্র, সাময়িকী ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে।
==আমার গর্ব==
'''লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''।
এই বইয়ে তিনজন মনীষীর জীবনী আছে। এরা হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী বিবেকানন্দ।
===ভূমিকা===
উনবিংশ শতাব্দীর নব জাগরণের
পথিক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দারিদ্র,
কুশিক্ষা, দুঃখ দুর্দশার বিরুদ্ধে তিনি জীবন পণ
সংগ্রাম করেছিলেন। নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে
তাঁর মতো দৃঢ়চেতা মানুষ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত কবি। এছাড়াও তিনি
ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীত বিদ। তাঁর সৃষ্টি সাগরের মতোই বিশাল। তাঁর সাহিত্য কর্ম বিশ্বজগতে পরিব্যাপ্ত।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ভাব শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ জড় গ্রস্ত জাতির জীবনে এনে দিলেন উদ্দীপনা ও কর্ম চাঞ্চল্য। তিনি বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছেন, "সব ধর্মই সমান, জীব সেবাই ঈশ্বরসেবা"। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ এই তিনজন মনীষী নিয়েই তুষারকান্তি যন্নিগ্রহীর লেখা প্রবন্ধ সংকলন 'আমার গর্ব' প্রকাশ করা হল। এই মনীষীগণের উজ্জ্বল আদর্শ নতুন ভারত গঠনে আমাদের প্রেরণা দেবে-এটা আমরা আশা করি।
বিনীত-
প্রকাশক: মীরা ষন্নিগ্রহী, সঙ্গীতা ষন্নিগ্রহী (পাত্র),
স্বাগত ষন্নিগ্রহী।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
==পরম পরশ==
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী তাঁর ছাত্রাবস্থায় এবং শিক্ষকতার জীবনে প্রবন্ধ লিখেছেন অনেক। তার মধ্যে বাছাই করা তিরিশটি প্রবন্ধ নিয়ে এই সংকলন। নাম দেওয়া হয়েছে 'পরম পরশ'। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্প ইত্যাদি বিষয় সমূহ উদ্ভাসিত হয়েছে প্রবন্ধ গুলিতে। সহৃদয় পাঠকবর্গ এই প্রবন্ধ পাঠে যদি আনন্দ পান তাহলে আমাদের শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
মদনবাগ, সিমলাপাল, বাঁকুড়া
পিন-৭২২১৫১
জানুয়ারি-২০০৯
'''পরম পরশ (প্রবন্ধ সংকলন)'''
ISBN 978-93-341-3673-9
সূচিপত্র
প্রবন্ধের নাম ।। পৃষ্ঠা সংখ্যা
১) আ-মরি বাংলা ভাষা ১
২) শিক্ষার বিবর্তন ৬
৩) জীবন, মানুষ এবং শিক্ষা ১০
8) প্রকৃতি এবং শিক্ষা ১৩
৫) শিক্ষার উদ্দেশ্য। ১৫
৬) শিক্ষার লক্ষ্য ১৮
৭) শিক্ষার আলো ২০
৮) সর্বশিক্ষা অভিযান ২৫
৯) বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি ২৮
১০) সিমলাপালের লোকসংস্কৃতি ৩৪
১১) লোকউৎসব ভাদু ৪০
১২) বাংলার লোকসাহিত্য। ৪৫
১৩) ছোটগল্প ৪৯
১৪) বই চাই বই ৫২
১৫) আমার বইমেলা ৫৫
১৬) আলোকময় জীবনশৈলী ৫৬
১৭) নেতাজি ও আমরা ৫৯
১৮) চাঁদা মামা ৬০
১৯) বিজ্ঞান বিচিত্রা ৬২
২০) বেগুন মোটেই নির্গুণ নয় ৬৫
২১) প্রাণরসায়নের গোড়ার কথা ৬৬
২২) সয়াবিন কথা ৬৮
২৩) আত্মরক্ষার সূঁচ র্যাফাইড ৬৯
২৪) মানুষের বিপদ এইডস্ ৭০
২৫) ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সবার জন্য স্বাস্থ্য ৭৩
২৬) ভিটামিন ও তার প্রয়োজনীয়তা ৭৫
২৭) ডিমের কথা ৭৯
২৮) ধূমপান না স্বাস্থ্য ৮১
২৯) রেশম শিল্পের সেকাল ও একাল ৮৫
৩০) জোয়ার আসুক রেশম ও লাক্ষা
শিল্পে ৮৮
==কমলকলি==
'''কমলকলি (কবিতা সংকলন):''' এই কবিতা সংকলনে মোট সাতজন কবির কবিতা আছে। কবিরা হলেন;
'''১) তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
'''২) মীনা ঠাকুর'''
'''৩) অজিতকুমার দাশ'''
'''৪) মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়'''
'''৫) নীলাঞ্জন ষন্নিগ্রহী'''
'''৬) শোভনা মিশ্র'''
'''৭) মালবিকা পণ্ডা'''
'''কমলকলি''' সম্পাদনা করেছেন '''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
প্রকাশক: '''কৃষ্টি কিরণ''' (প্রকাশন বিভাগ),সিমলাপাল, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিন- ৭২২১৫১
'''কমলকলি''' আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের বাঁকুড়া জেলা বই মেলাতে।
==স্বর্ণকুমারী দেবী==
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী
ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে বাংলার বুকে ঠাকুর পরিবারের যে কন্যা অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি স্বর্ণকুমারী। সাহিত্য, রাজনীতি জনকল্যাণ, নারীর শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান খুবই উল্লেখযোগ্য।
স্বর্ণকুমারী দেবী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রি এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাদেবীর একাদশতম সন্তান। তাঁর ভাই রবীন্দ্রনাথ স্বর্ণকুমারীর থেকে ছয় বছরের ছোট। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ হলেন দেবেন্দ্রনাথ-সারদা দেবীর চর্তুদশতম সন্তান। এঁদের মোট সন্তান ছিল পনের জন। এ ব্যাপারে একটু আলোকপাত করলে সুবিধে হয়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদা দেবীর সন্তানদের তালিকা-
১) প্রথম সন্তান (কন্যা):
শিশু অবস্থাতেই মারা যায়।
২) দ্বিতীয় সন্তান (পুত্র):
দ্বিজেন্দ্র (১৮৪০-১৯২৬)
৩) তৃতীয় সন্তান (পুত্র)
সত্যেন্দ্র (১৮৪২-১৯২৩)
8) চতুর্থ সন্তান (পুত্র) হেমেন্দ্র (১৮৪৪-১৮৮৪)
৫) পঞ্চম সন্তান (পুত্র)
বীরেন্দ্র (১৮৪৫-১৯১৫)
৬) ষষ্ঠ সন্তান (কন্যা)
সৌদামিনী (১৮৪৭-১৯২০)
৭) সপ্তম সন্তান (পুত্র) জ্যোতিরিন্দ্র (১৮৪৯-১৯২৫)
৮) অষ্টম সন্তান (কন্যা) সুকুমারী (১৮৫০-?)
৯) নবম সন্তান (পুত্র)
পূণ্যেন্দ্র (১৮৫১-১৮৮৭)
১০) দশম সন্তান (কন্যা)
শরৎকুমারী (১৮৫৪-১৯২০)
১১) একাদশ সন্তান (কন্যা)
স্বর্ণকুমারী (১৮৫৫-১৯৩২)
১২)দ্বাদশ সন্তান (কন্যা)
বর্ণ কুমারী (১৮৫৮-১৯৪৮)
১৩) ত্রয়োদশ সন্তান (পুত্র)
সোমেন্দ্র (১৮৫৯-১৯২২)
১৪) চতুর্দশ সন্তান (পুত্র)
রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)
১৫) পঞ্চদশ সন্তান (পুত্র)
বুধেন্দ্র (১৮৬৩-১৮৬৪)
স্বর্ণকুমারীর জন্ম তারিখ ২৮ আগস্ট ১৮৫৫। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পরিবেশেই বাড়িতেই তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। মাত্র তের বছর বয়সে ১৮৬৮ সালে নদীয়া জেলার জমিদার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জানকীনাথ ঘোষালের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। জানকীনাথ বিদেশে ভ্রমণ করার সময় স্বর্ণকুমারী বেশিরভাগ সময় ঠাকুর বাড়িতেই থাকতেন। অবশ্য জানকীনাথ সব সময়ই স্বর্ণকুমারীকে সাহিত্য চর্চা ও সমাজসেবার কাজে উৎসাহ দিতেন। ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ এবং জানকীনাথের উৎসাহ স্বর্ণকুমারীকে সমাজ ' সচেতনতার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কবিতা, সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য ও সমাজ সেবায় স্বর্ণকুমারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। তিনি হয়ে ওঠেন ঔপন্যাসিক, বিশিষ্ট কবি, সঙ্গীতকার এবং অন্যতম সমাজ সংস্কারক। সূত্র-কৃষ্টি কিরণ,২০২৩ পৃঃ ৭
==কৃষ্টি কিরণ==
সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে কৃষ্টি কিরণ সাহিত্য পত্রিকার ষোড়শ বর্ষ, ষোড়শ সংখ্যা।
এতে প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসেবে স্থান পেয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন ও মৃগয়ার কালক্ষেপ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলনের ওপরে একটি গবেষণাধর্মী লেখা। লেখক: মোরশেদুল আলম, সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল রাজবংশ নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী। গ্লুকোমা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করেছেন বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডা. অনুপ মণ্ডল। এছাড়াও কৃষ্টি কিরণে স্থান পেয়েছে অন্যান্য প্রবন্ধ,চারটি ছোটো গল্প এবং সাতাশটি কবিতা।
===কড়চা তে প্রকাশিত===
বাঁকুড়ার সিমলাপাল থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে "কৃষ্টি কিরণ"(সম্পাদক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী)সাহিত্য পত্রিকার ষোড়শ সংখ্যা।এই সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোরশেদুল আলম, চিকিৎসক অনুপ মণ্ডল, রাহুল কর প্রমুখ।এছাড়াও রয়েছে চারটি ছোট গল্প ও ২৭টি কবিতা।
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ।। আনন্দবাজার পত্রিকা,পুরুলিয়া- বাঁকুড়া সংস্করণ।
==ড.সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ==
এই বইটির লেখক তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী। প্রকাশক: কৃষ্টি কিরণ প্রকাশন বিভাগ, ঠিকানা: মদনবাগ, সিমলাপাল, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত, পিন- ৭২২১৫১
==বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল রাজবংশ==
।। বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল রাজবংশ।।
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী
দশম শতাব্দীতে বেশ কিছু বৈদিক ব্রাহ্মণ কনৌজ ত্যাগ করে বৈতরণী নদী পার হয়ে জগন্নাথ দেবের 'চৌদ্দক্রোশী' এলাকায় বসবাস শুরু করেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। তখনকার দিনে এঁদের অধিকাংশরেই পদবি বা উপাধি ছিল দেবশর্মা। দেবশর্মা বা দেবশর্মনঃ ব্রাহ্মণদের সাধারণ উপাধি।
শ্রীপতি মহাপাত্র ছিলেন 'চৌদ্দক্রোশী' এলাকার অর্ন্তভূক্ত বীররামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কনৌজ ব্রাহ্মণদের বংশধর। তাঁর পূর্বপুরুষের উপাধি ছিল দেবশর্মা।
জানা যায় পুরীর গজপতিরাজ মুকুন্দদেবের রাজসভায় প্রধান সেনাপতি ও রাজপুরোহিত হিসেবে শ্রীপতি মহাপাত্র দায়িত্ব পান।
রাজা মুকুন্দদেবের দুই পুত্র নকুড় তুঙ্গ এবং ছকুড় তুঙ্গ পুরী এলাকা ত্যাগ করে শ্রীপতি মহাপাত্রকে সঙ্গে নিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন রাইপুর এলাকার শ্যামসুন্দরপুরে। শ্যামসুন্দরপুরের এলাকা দখল করে রাজা হন ছকুড়তুঙ্গ। ফুলকুশমা এলাকা দখল করে রাজা হন নকুড়তুঙ্গ। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কোনো অজ্ঞাত কারণে ছকুড় তুঙ্গকে হত্যা করা হয়। ফলে নকুড় তুঙ্গ নিজের নাম পরিবর্তন করে নাম নেন ছত্রনারায়ণ দেব। ছত্রনারায়ণ দেব হিসেবেই তিনি এই রাজ্য শাসন করতে থাকেন।এই ঘটনার গোড়াতেই নকুড়তুঙ্গ তথা ছত্রনারায়ণ দেব শ্রীপতি মহাপাত্রের পৌরোহিত্যে পুত্রোষ্টি যজ্ঞ করার ফলেই তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণ করে বলে ধারণা। নাম রাখা হয় চৈতঙ্গ তুঙ্গ। সেই সময় রাজা নকুড় তুঙ্গ বা ছত্র নারায়ণ দেব স্থির করেন সিমলাপাল এলাকা শ্রীপতি মহাপাত্রকে দান করার জন্য।
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাক্ষী রেখে একটি তাম্রপট্টে উড়িয়া হরফে স্বাক্ষর করে সিমলাপাল পরগণা তিনি দান করেন শ্রীপতি মহাপাত্রকে।
তাম্রপট্টের অনুলিপি-
উড়িয়া হরফে লেখা-বাংলা অনুবাদ,
: শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব জিউ:
রাজনগর রাজা নকুড়তুঙ্গদেবের পুত্রষ্টি যজ্ঞকরণ কারণ পুত্র জন্মিল চৈতন্য তুঙ্গ। কারণ-শ্রীপতি মহাপাত্র কুলগুরু প্রধান সেনাপতি। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব পদতলে রক্ষিত তাম্রপট্ট দিয়ে নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর সিমলাপাল দানপত্র করিলেন। আমত্য বিশ্বম্ভর মহাপাত্র, রঘুনাথ পণ্ডা, জগন্নাথ ত্রিপাঠী, পুরুষোত্তম কর, পীতাম্বর মিশ্র দেবগণ,
মামা সূর্যকান্ত রায়, সেনাপতি বিজয় সিংহ, চাঁদ সিংহ, ঈশ্বর ভট্ট, কৃষ্ণ নাপিত, বাসুদেব করণ, শুকদেব করণ। দামোদর করণ ও প্রজাদিগের সামনে গুরুবরণ করিলেন রাজা নকুড় তুঙ্গদেব।
(৮৭০সাল, দোল পূর্ণিমা)
দোল পূর্ণিমার দিন ৮৭০ বঙ্গাব্দে শ্রীপতি মহাপাত্র দানপত্রের মাধ্যমে সিমলাপাল পরগণা পান ঠিকই। কিন্তু সেই সময়ে সিমলাপালের শিলাবতী তীরবর্তী এলাকা ঘন অরণ্যে পরিপূর্ণ ছিল। জনবসতি খুব একটা ছিল না। কেবলমাত্র শিলাবতী নদীর তীরে বাউরি, খয়রা ইত্যাদি সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ বসবাস করতেন।
নদীর তীরের জঙ্গল এলাকা পরিষ্কার করতে, কিছু বাড়ি ঘর তৈরি করতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগে যায়। ফলে গড় সিমলাপালের প্রতিষ্ঠা হয় ৮৭৫ বঙ্গাব্দ বা ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে।
সিমলাপাল রাজবংশে প্রায় ৪৯০ বছরের রাজত্বকালে সিমলাপালে জমিদার বা রাজা ছিলেন মোট ১৮জন।
।।বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল রাজবংশ।।
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী
(দ্বিতীয় পর্ব)
আদি সিমলাপালের সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সিমলাপালের রাজ পরিবারের সদস্যরা। আগেকার দিনে গড় সিমলাপাল হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৭৫ বঙ্গাব্দে বা ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তখন দিল্লির সুলতান ছিলেন বহলাল খান লোদি, উড়িষ্যার গজপতি ছিলেন পুরুষোত্তম দেব , বাংলার শাসক ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ, এবং বন বিষ্ণুপুরের রাজা ছিলেন চন্দ্র মল্ল। প্রাচীন কালে এই সিমলাপাল এলাকা কলিঙ্গ ও উড্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৪৫০ সাল নাগাদ নকুড় তুঙ্গ রাইপুর এলাকায় দলবল সমেত আসেন। তাঁর সেনাপতি ও প্রধান পুরোহিত ছিলেন উৎকল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শ্রীপতি মহাপাত্র। শ্রীপতি মহাপাত্রের বিভিন্ন কর্মকুশলতা ও পুত্রোষ্টি যজ্ঞে সন্তুষ্ট হয়ে নকুড় তুঙ্গ তাকে সিমলাপাল পরগনা দান করেন। সিমলাপাল বা গড় সিমলাপালের প্রথম রাজা শ্রীপতি মহাপাত্র। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৮৭৫ থেকে ৯০২ বঙ্গাব্দ। দ্বিতীয় রাজার নাম রাধামাধব মহাপাত্র। রাজত্বকাল ৯০২ থেকে ৯৩১ বঙ্গাব্দ।
পরবর্তী তৃতীয় রাজার নাম জগন্নাথ মহাপাত্র। রাজত্বকাল ৯৩১ থেকে ৯৫২ বঙ্গাব্দ। চতুর্থ রাজা ছিলেন বাসুদেব মহাপাত্র, রাজত্বকাল ৯৫২ থেকে ৯৬৫ বঙ্গাব্দ। বাসুদেব ছিলেন অপুত্রক। তাই বাসুদেবের মৃত্যুর পর তাঁর কাকা বা খুড়া রাজা হন। তাই সিমলাপাল রাজবংশের পঞ্চম রাজা হিসেবে আমরা পাই বলরাম মহাপাত্রকে। ওঁকে বলা হতো খুড়া বলরাম। রাজত্বকাল ছিল ৯৬৫ বঙ্গাব্দ থেকে ৯৮৭ বঙ্গাব্দ। খুড়া বলরামের পর রাজা হন তাঁর পুত্র মোহনদাস। সেই সময় বনবিষ্ণুপুরের রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর। রাজা মোহনদাস মহাপাত্র পদবি না নিয়ে গ্রহণ করলেন সিংহচৌধুরী পদবি। তিনি হয়ে গেলেন মোহনদাস সিংহচোধুরী এই সময় থেকেই সিমলাপাল রাজবংশে বিশেষ প্রথা চালু হলো। রাজার বড় ছেলের পদবি হবে সিংহচৌধুরী পরবর্তী পুত্রের পদবি হবে সিংহহিকিম, তার পরের পুত্রের পদবি হবে সিংহবড়ঠাকুর। তারপর আরো যদি পুত্র থাকে তাঁদের পদবি হবে সিংহবাবু। সিমলাপালের ষষ্ঠ রাজা মোহনদাস সিংহচৌধুরীর রাজত্বকাল ছিল ৯৮৮ থেকে ১০০০ বঙ্গাব্দ। পরবর্তী রাজা চিরঞ্জীব সিংহচৌধুরী (১ম)। রাজত্বকাল ১০০১ থেকে ১০২২ বঙ্গাব্দ। রাজা চিরঞ্জীব সিংহচৌধুরীর পুত্র ছিলেন তিনজন। এঁদের নাম লক্ষ্মণ, লস্কর এবং বিক্রম। ১০২৩ বঙ্গাব্দে সিমলাপালের জমিদারী তিনভাগে বিভক্ত হয়। সিমলাপালে লক্ষণ পান ৬ আনা অংশ, ভেলাইডিহাতে লস্কর পান ৬ আনা অংশ, বাকি ৪ আনা অংশ পান বিক্রম, যার মৌজার নাম বিক্রমপুর। এটা ১০২৩ বঙ্গাব্দ বা ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। পরবর্তী পর্যায়ে বিক্রমপুরের চার আনা অংশ সিমলাপালের সাথে যুক্ত হয়। ফলে সিমলাপালের অংশ দশআনা হয়ে যায়। তাই গড় সিমলাপালকে বলা হয় দশ আনি আর ভেলাইডিহা অংশকে বলা হয় ছয় আনি। লক্ষণের রাজত্বকাল ১০২৩-১০৫৯ বঙ্গাব্দ। লক্ষণের পর সিমলাপালের রাজা হন কৃষ্ণ দাস সিংহচৌধুরী তাঁর রাজত্বকালে ১০৬০ থেকে ১১০০ বঙ্গাব্দ। তারপরে রাজা হন রাধানাথ, রাজত্বকাল ১১০১ থেকে ১১৩৫ বঙ্গাব্দ। এর পরের রাজার নাম বলরাম (দ্বিতীয়)। রাজত্বকাল ১১৩৫ থেকে ১১৮২ বঙ্গাব্দ। পরের রাজা জগন্নাথ, রাজত্বকাল ১১৮২ থেকে ১২০৭ বঙ্গাব্দ। তারপরের রাজা চিরঞ্জীব (দ্বিতীয়) রাজত্বকাল-১২০৭-১২৩৭ বঙ্গাব্দ। পরের রাজা নটবর সিংহচৌধুরী, রাজত্বকাল ১২৩৭-১৩১০ বঙ্গাব্দ। পরবর্তী রাজা হন মানগোবিন্দ, রাজত্বকাল ১৩১০-১৩১৫ বঙ্গাব্দ। সিমলাপাল রাজবংশের পরের রাজা জগবন্ধু সিংহচৌধুরী। রাজত্বকাল ১৩১৬ থেকে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ। তারপর রাজা হন মদনমোহন সিংহচৌধুরী। রাজত্বকাল ১৩৩৪ থেকে ১৩৬১ বঙ্গাব্দ। উল্লেখ্য, সিমলাপালের রাজা মদনমোহনের নামেই সিমলাপাল মদনমোহন হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজা মদনমোহন ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ২৩ আশ্বিন ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে তাঁর পুত্র শ্যামসুন্দর সিংহচৌধুরী পরবর্তী রাজা হিসেবে গণ্য হন। সিমলাপালের সর্বশেষ রাজার রাজত্বকাল মাত্র ছয় মাস স্থায়ী ছিল কারণ, ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ থেকে জমিদারী প্রথা রদ হয়ে যায়। সিমলাপালের শেষ রাজা ছিলেন শ্যামসুন্দর সিংহচৌধুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে সিমলাপাল এলাকার সভ্যতার বিকাশ,শিক্ষা এবং সংস্কৃতির উন্নয়ন, কৃষি ও সেচের ব্যবস্থাপনা, মন্দির ও আশ্রম নির্মাণ অনেকাংশেই রাজ পরিবারের হাত ধরেই হয়েছিল।
(তথ্য সূত্র: স্মারকগ্ৰন্থ, প্রথম বর্ষ- সিমলাপাল বই মেলা: ২০০৮। কৃষ্টি কিরণ, ষোড়শ সংখ্যা,২০২৪,পৃ.১১-১৪)
==সিওল থেকে সিমলাপাল==
।। সিওল থেকে সিমলাপাল ।।
তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী সিমলাপাল, বাঁকুড়া
ছোট্ট দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। জনসংখ্যা মাত্র ৫ কোটি। রাজধানী সিওল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরাজিত হয় জাপান। কোরিয়ার উত্তর ও দক্ষিণে দখল নেয় যথাক্রমে রুশ ও মার্কিন সেনা। ১৯৪৮ সালে তখনকার কোরিয়া দুটি আলাদা রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। রুশ সেনাদের দখলকৃত এলাকার নাম হয় উত্তর কোরিয়া। মার্কিন সেনার দখলে থাকা দক্ষিণ অংশের নাম হয় দক্ষিণ কোরিয়া।
ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবসের কি মিল। তারিখটি ১৫ আগস্ট। শুধু একবছর বাদে প্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (দক্ষিণ কোরিয়া) আত্মপ্রকাশ করে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল থেকে পাড়ি দিয়ে সোজা সিমলাপাল আসেন কিম হুন। পেশায় সাংবাদিক। তিনি কাজ করেন সিওলের মুনহা ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে। বিমান যোগে দমদম। তারপর গাড়িতে করে সিমলাপাল। গত ২০০৭ সালের মার্চ মাসে সিমলাপালের চাঁদপুর গ্রামে গরুর মুরগি খাওয়ার খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদ পত্রে। টেলিভিসনের বিভিন্ন চ্যানেলেও তা দেখানো হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই সংবাদ। মূলত এই সংবাদের জন্যই এই মহিলা সাংবাদিক এখানে আসেন। কার্তিক ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, কার্তিক ঘোষের বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি পেশায় সাংবাদিক। তিনিই গরুর মুরগি খাওয়ার ঘটনা প্রথম জানতে পারেন। ২০০৭ সালের ৩ অক্টোবর সিমলাপালের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেন সাংবাদিক কিম হুন। সঙ্গে এনেছিলেন দোভাষী। তাই ভাষাগত বাধা অনেকটাই অতিক্রম করা যায়। তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন বি ডি ও মতীন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ। সিমলাপাল ফরেস্ট বাংলোতে। একদিন বাদেই ফিরে যান তিনি। সিওলে ফিরে যেয়ে তিনি কি খবর পরিবেশন করলেন তা আমাদের এখনো অজানা।
==ফিরে দেখা:১৯৬৮-১৯৬৯==
ফিরে দেখা।।১৯৬৮ - ১৯৬৯।।
ব্যানার্জিডাঙ্গা হাই স্কুল,ফতেসিংপুর, আমলাগোড়া, মেদিনীপুর
ছাত্রসংসদের বিভিন্ন শাখার ভার যার যার কাছে। সাল-১৯৬৮- ১৯৬৯
সাধারণ সম্পাদক-
শিবদাস মুখোপাধ্যায় (একাদশ শ্রেণী)
সহঃ সাধারণ সম্পাদক-
হরেরাম দত্ত (দশম শ্রেণী)
গ্রন্থাগার বিভাগ-
কাশীনাথ চ্যাটার্জ্জী (দশম শ্রেণী) . তুষারকান্তি দাস (নবম শ্রেণী)
সংস্কৃতি বিভাগ-
শিবশংকর প্রামাণিক (একাদশ শ্রেণী)। , তরুণ কুমার রায় (নবম শ্রেণী)
পত্রিকা বিভাগ-
গোবিন্দকুমার মণ্ডল (একাদশ শ্রেণী) , বুদ্ধদেব ব্যানার্জ্জী ( একাদশ শ্রেণী), তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী (দশম শ্রেণী)
ক্রীড়া বিভাগ-
রতনচন্দ্র দাস (একাদশ শ্রেণী) . হীরালাল ব্যানার্জ্জী (দশম শ্রেণী)
কমনরুম বিভাগ-
অজয়কুমার বাগচি (দশম শ্রেণী) , দিলীপ কুমার প্রতিহার (নবম শ্রেণী)
ব্যায়ামাগার বিভাগ-
শ্যামসুন্দর দে (একাদশ শ্রেণী) রামশঙ্কর সিংহ (নবম শ্রেণী)
==ফিরে দেখা:১৯৭৮==
সিমলাপাল মদন মোহন হাই স্কুল
'''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগ। আমি তখন হুগলি জেলার রাজবলহাট হাইস্কুলের সহ শিক্ষক। থাকতাম স্কুলের মেসে। একদিন ইংরেজি দৈনিক অমৃত বাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম। সিমলাপাল মদনমোহন হাইস্কুলের উচ্চমাধ্যমিক বিভাগে দুজন সহ- শিক্ষক চাই। বিষয় রসায়ন এবং শারীর বিদ্যা। আমার শারীরবিদ্যা। তাই দরখাস্ত পাঠালাম ডাকযোগে। স্কুলটির নাম ছোটবেলা থেকে শুনেছি। এমনকি স্কুলের, পাকাবাড়ি, কাঁচাবাড়ি সবই দেখেছি। আমার মামাবাড়ি শুক্লাবাইদ যাওয়ার সোজা রাস্তা ছিল স্কুলের মাঝ দিয়েই। আমাদের বাড়ি পুটিয়াদহ থেকে গরুর গাড়িতে করে আসতাম শীলাবতী নদী পেরিয়ে লক্ষ্মণপুর। ওখানে বাস ধরে নামতাম স্কুল মোড়ে। তারপর স্কুলের মাঝদিয়ে হেঁটে মামাবাড়ি। ছোটবেলায় আমরা মামাবাড়িতে দেড়- দুমাস ধরে থাকতাম। জগন্নাথপুর প্রাইমারি স্কুলে আমরা নিয়মিত ক্লাশও করতাম। বিকেলে দল বেঁধে চলে আসতাম বড় স্কুল লাগোয়া জঙ্গলে। বনের পালকুল, সিয়াকুল, ভুড়রু, জাম, কুসুম আমরা অনেক খেয়েছি। বনের ধারে ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা লাল মাটির ওপরে এই বড় স্কুল। এই স্কুলে যে শিক্ষকতা করব তা আগে ভাবিনি।
একদিন ইন্টারভিউ লেটার পেলাম। ইন্টার ভিউর দিন আমি রাজবলহাট থেকে ভোরে বেরিয়ে তিন-তিনটে বাস বদলাবদলি করে যখন সিমলাপাল এলাম তখন সূর্য মধ্যগগনে।
প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমাকে আগেই খেয়ে নিতে বললেন। আমার ভাত, মাংস, সবজি ঢাকা দেওয়া ছিল। খেলাম। শারীর বিদ্যা শিক্ষকের প্রার্থী আমি একা। ইন্টারভিউ দিলাম।
একদিন চিঠি এল। চিঠি খুলে দেখি নিয়োগ পত্র। তাতে স্বাক্ষর স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক কল্যাণীপ্রসাদ সিংহচৌধুরীর। চিঠির সাথে মুড়ে দেওযা হয়েছে পরিচালন সমিতির কার্যবিবরণীর হাতে লেখা হুবহু নকল। ৯ নভেম্বর (১৯৭৮) ইস্তাফা দিলাম আগের স্কুলের সহ-শিক্ষকের পদ থেকে। পরদিন ১০ নভেম্বর সিমলাপাল মদনমোহন হাইস্কুলের সহ-শিক্ষকের পদে যোগ দিই।
একই দিনে এই স্কুলে যোগ দেন রসায়নের শিক্ষক বঙ্কিমচন্দ্রসিংহমহাপাত্র।
তখন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৬০০। দশম শ্রেণিতে ৩৮ জন, একাদশ শ্রেণিতে ৪২ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। স্কুলের হস্টেলে থাকত প্রায় ৫০জন ছাত্র।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রচন্দ্র রায়। বেঁটে খাটো মানুষ। নতুন শিক্ষকদের খুব স্নেহ করতেন। স্কুলই ওঁর ধ্যান জ্ঞান। বিদ্যালয়ই মন্দির। সকাল-সন্ধ্যা উনি প্রণাম করতেন এই মন্দিরকে। চরকির মতো গোটা স্কুল পরিদর্শন করতেন। আমরা ক্লাশে কি পড়াতাম তা উনি বারান্দায় পায়চারি করতে করতে লক্ষ্য করতেন।
একদিন আমি হেড স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার আপনি "রবীন্দ্রনাথ" না লিখে "রবীন্দ্র চন্দ্র" লেখেন কেন? উনি বললেন, আরে "রবীন্দ্রনাথ" একজনই, অন্য কারও নাম "রবীন্দ্রনাথ" হয় না। "তাই আমি রবীন্দ্রচন্দ্র"। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে উনি রবীন্দ্র জীবনী নিয়ে বক্তব্য রাখতেন এমন কি হারমোনিয়ামের একটি মাত্র রিড টিপেই অক্লেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে দিতেন।
সহকারী প্রধানশিক্ষক রাজীবলোচন সিংহমহাপাত্র। বিশাল চেহারা। ভোজনপ্রিয় মানুষ। জল ও পান খেতে খেতে প্রভিশন্যাল রুটিন করতেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় ওঁর মাইক লাগত না। ক্লাশে পড়ানোর সময় বহুদূর থেকেও ওঁর গলা শোনা যেত। রাজীব বাবুর চেহারা ও ব্যক্তিত্ব দেখে বই কোম্পানীর লোক ওঁনাকেই প্রধান শিক্ষক বলে মনে করত। হাতে ধরিয়ে দিত বইয়ের নমুনা কপি। বাইরের লোক রাজীব বাবুকেই "স্যার-স্যার" করত। পাশে বসা প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রচন্দ্র রায় রাগে গর গর করতেন, অথচ কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না।
সহ-শিক্ষক গোলোকবিহারী সিংহমহাপাত্র, জয়দেব হোতা, রঘুনন্দন সৎপতি প্রমুখ স্কুলের হস্টেলে থাকতেন।
জয়দেববাবু ছিলেন হৃষ্ট পুষ্ট ও বেশ লম্বা। ধীর গতিতে ক্লাসে পড়াতেন। ছাত্রদের ফুটবল খেলাতেন। কেবলমাত্র গোলের সময় লম্বা বাঁশী বাজাতেন।
"ব্রুশ" কোম্পানীর একজন ভদ্রলোক মোটর বাইকে স্কুলে স্কুলে এসে ফুটবল, নেট, বুট, জার্সি ইত্যাদি বিক্রি করতেন। খেলাধূলার শিক্ষককে ওই কোম্পানী গেঞ্জি উপহার দিত। জয়দেব বাবু সেদিন স্কুলে ছিলেন না। ব্রুশ কোম্পানীর গেঞ্জি গায়ে পরে তার দখল নিয়েছিলেন গোলোকবাবু।
জয়দেব বাবু স্কুলে এসে "গেঞ্জি" গায়ে গোলোকবাবুকে দেখে বেজায় চটেছিলেন।
গোলোক বাবুর হস্টেলের রুমে কোনদিন তালা পড়ত না। চোরের ভয়ে নয়-কেবলমাত্র কুকুরের ভয়ের জন্য দরজার শেকল তোলা থাকত। রুমের মধ্যে মাটির দেওয়ালের একটি কাঠের গোঁজ গাঁথা ছিল। তাতেই ঝোলানো থাকত স্কুলের চাবির গোছা।
গোলোক বাবুর ছিল একটি দড়ির খাট। মাঝে কাঁথা, সামনে বালিশ পিছনে পাতা থাকত দু-তিনটে চটের বস্তা। দড়িতে ঝোলানো থাকত ধুতি জামা। ছিল পান, পানের বাটা, সুপারি। আর ছিল একটা বিষ্ণুপুরের লণ্ঠন।
আমিও মাঝে মধ্যে স্কুলের হস্টেলে থাকতাম। একদিন রাতে দেখছি গোলোকবাবু লণ্ঠন জ্বালেন নি। স্যারকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন জ্যোৎস্না রাত। তাই জ্বালিনি। হস্টেলের রুম থেকে রঘুনন্দনবাবুর নেওয়া দুধ বেশ কয়েকবার চুরি হয়ে যায়। উনি কিন্তু বেড়ালকে সন্দেহ করেননি।
ভবসুন্দর সিংহ বড়ঠাকুর। দুর্দান্ত চেহারা। খুব সুন্দর কথা বলতেন। পড়াতেনও। থিয়েটার নাটকে দারুণ অভিনয় করতেন। রাজবাড়ি থেকে স্কুল হেঁটেই যাতায়াত করতেন। মূল রাস্তার একদম বাঁয়ে সব সময়ই চলতেন- যাতে বিপদ না হয়। সাইকেল জানতেন। তবে চালাতেন
কম। শম্বুক গতি। কালীকিঙ্কর সিংহমহাপাত্র পড়াতেন সংস্কৃত, বাংলা, অভিনয়েও পারদর্শী। সুধীর রঞ্জন রায় বাংলার শিক্ষক। লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত।
হিন্দির শিক্ষক প্রবোধচন্দ্র মহান্তি। তীক্ষ্মস্বরে পড়াতেন ক্লাশে। কুলডোবা থেকে যাতায়াত করতেন।
হরিশচন্দ্র সিংহমহাপাত্র। ইংরাজির শিক্ষক। প্যান্ট শার্ট পরে ক্লাশে শুধু ইংরাজি পড়াতেন না এই ভাষার উচ্চারণও শেখাতেন। হরিশবাবু আবার ছিলেন এন-সি- সি অফিসার। ওঁর স্কুলে আসা, খাওয়া দাওয়া ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময় বাঁধা ছিল। এদিক ওদিক হওয়া চলত না।
তখন বিজ্ঞানের বিষয়গুলি পড়াতেন গিরিধারী সৎপথী, শ্রীবাসচন্দ্র সিংহমহাপাত্র, বনমালী সিংহমহাপাত্র, বনমালী দাস, রাধারমণ পাত্র এবং দীপ্তেন্দুবিকাশ চট্টোপাধ্যায়।
গণিতের শিক্ষক বনমালী দাস বাবু মনে করতেন উচ্চমাধ্যামিক স্তরে কেবলমাত্র ভালো ছাত্ররাই "গণিত" বিষয় পাবে। তাই জটিল অঙ্ক দিয়ে তিনি এমন শুরু করতেন যার ফলে সাধারণ ছাত্ররা গণিত বিষয় ছেড়ে দিত।
সরস্বতী পূজার টাকা পয়সার হিসাব রাখতেন বনমালী দাস বাবু। ১টাকার গোলমাল ধরার জন্য উনি গোটা রাত কাবার করেছিলেন। শশাঙ্ক বাবু বলেছিলেন বরং ১ টাকা দিচ্ছি হিসাব ছাড়ুন। বনমালী দাস বাবু কিন্তু হিসাব ছাড়েননি। পরদিন ভোর পাঁচটায় হিসাব মিলেছিল।
ইতিহাস-ভূগোল বিষয়গুলি পড়াতেন নলিনীরঞ্জন সিংহবাবু,কিরীটিভূষণ সিংহমহাপাত্র, সুধীরকুমার লাহা এবং শশাঙ্কশেখর সিংহমহাপাত্র। এঁরা যখন বিভিন্ন ক্লাশে পড়াতেন স্কুল গম্ গম্ করত। লাহাবাবু, শশাঙ্কবাবু দারুণ বক্তৃতা দিতেন। কিরীটিবাবু মৌখিক পরীক্ষা এমন নিখুঁত নিতেন যার ফলে ছাত্রছাত্রীদের লাইন দিয়ে প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত।
এছাড়াও সহ-শিক্ষক ছিলেন মুরলীমোহন সিংহবাবু এবং অনিলবরণ মহাপাত্র। মুরলীবাবু ধীর স্থির, অন্যদিকে অনিলবাবু ছিলেন কিছুটা ছটফটে। ছাত্রদের পড়াতেন দরদ দিয়ে।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিলেন মোট ছয় জন। এঁরা হলেন, কিরীটিভূষণ নায়ক, অনিলবরণ মহান্তি, অনাদি চরণ সিংহমহাপাত্র, গোকুল চন্দ্র মহান্তি, আনন্দমোহন সিংহ এবং গজানন রায়। এঁরা সকলেই আন্তরিকতার সাথে স্কুলে কাজ করতেন। এঁদের মধ্যে অনাদিচরণ,
ডবল বেঞ্চ নীচতলা থেকে উপর তলা ছুটে ছুটে একাই নিয়ে যেতেন। সবাই স্কুলে থাকতেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
আমরা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সবাই ছিলাম যেন একই পরিবারের সদস্য। আমাদের রাজনীতির রঙ আলাদা ছিল। মত আলাদা ছিল। কিন্তু শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে মতভেদ হয়নি। উন্নয়নের স্বার্থে আমরা সবাই এক। এটাই ছিল সেদিনের ব্রত।
'''২১ মার্চ ২০২৪'''
ব্যানার্জীডাঙ্গা হাই স্কুল। গড়বেতা স্টেশন এর পশ্চিমে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফতেসিংপুর এলাকায় অবস্থিত এই প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত স্কুলে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। আমি ১৯৬৫ সালে এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। হোস্টেলেই থাকতাম। তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কৃষ্ণদাস পণ্ডা। আমি এই স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে একাদশ শ্রেণির উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করি। এক বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য স্কুলের পাশ দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল ফেরার পথে হঠাৎই আমি এই স্কুলে প্রবেশ করি। স্কুলের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করি। বর্তমান প্রধান শিক্ষক প্রদ্যোৎ চক্রবর্তী মহাশয় এবং ইংরেজির শিক্ষক সুব্রত চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। স্কুলে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মূর্তি বসেছে এবং একটি ভবন প্রয়াত প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণদাস পণ্ডার নামে উৎসর্গ করা হয়েছে দেখে খুব ভালো লাগলো।
==ফিরে দেখা==
ফিরে দেখা++++চিঠি # নিজের জীবনের কথা লিখেছেন সত্যনারায়ণ সিংহমহাপাত্র। কয়েক বছর আগেই তিনি প্রয়াত হয়েছেন তার প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।
প্রতিঃ :
তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
সম্পাদক, কৃষ্টি কিরণ
মদনবাগ, পোঃ-সিমলাপাল
জেলা-বাঁকুড়া
পিন-৭২২১৫১
তাং-১লা মাঘ, ১৪২১( 16.01.2015)
প্রিয় তুষারবাবু,
প্রথমেই জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রীতি শুভেচ্ছা ও নমস্কার। হঠাৎ কয়েকদিন আগে আপনার সম্পাদিত "কৃষ্টি কিরণ”, ষষ্ঠ বর্ষ- ষষ্ঠ সংখ্যা-২০১৪ আমার নজরে পড়ল। কোন এক আত্মীয়ের হাত দিয়ে কলকাতায় আমার কাছে এসে পৌঁচেছে। আমি তা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আপনার এই পত্রিকায় ছাপানো "কোন এক গাঁয়ের কথা" পড়ে দেখলাম এবং পুটিয়াদহ গ্রাম সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা দেখতে পেলাম, বিশেষ করে আমার স্বর্গীয় দাদা রাইচরণ মহান্তির নাম দেখলাম ঐ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
বলতে বাধা নেই যে পুটিয়াদহ আমার শ্বশুরবাড়ি যেখান থেকে আমি ১৯৫১ সালের মে মাসে মিস সবিতা মহান্তিকে (পিতা-স্বর্গীয় বিভূতি ভূষণ মহান্তি এবং জ্যাঠতেতো দাদা স্বর্গীয় রাইচরণ মহান্তি) আমার সহধর্মিনী হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম। উল্লেখযোগ্য হিসাবে জানাই যে তখনকার দিনে গাড়ি ঘোড়ার যুগ ছিল না। আমি জামাই হিসাবে পালকিতে চেপে আমার গ্রাম থেকে পুটিয়াদহ গ্রামে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ষোলটি (১৬) গরুর গাড়িতে বর যাত্রীরা গিয়েছিলেন। আর ছিল ২০ জনের ব্যান্ডপার্টি। বিয়ে করে ফেরার সময় আমরা দুজন (বর এবং কনে) দুটি পালকিতে করে আলাদা ভাবে ফিরেছিলাম। তারপর যা অনুষ্ঠান হবার আমাদের দেশের বিধিমত হয়েছিল।
আমাদের চার কন্যা। তাদের জন্ম যথাক্রমে ১৯৫৫, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭১ সালে। প্রথম কন্যা লোপামুদ্রা (৬০) এখন হিউসটন (টেক্সাস) আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। ওরা বর্তমানে মার্কিন নাগরিক। বিয়ে হয়েছে অশোক কুমার পণ্ডার সাথে (ইঞ্জিনিয়ার আই আই টি-খড়ঙ্গপুর) দ্বিতীয়া কন্যা ডাক্তার তপতী (৫৩) বর্তমানে ম্যাঞ্চেস্টারে (ইংল্যান্ড) বসবাস করছে এবং ওখানকার নাগরিক। স্বামী ডাক্তার দেবাশীষ চক্রবর্তী (অর্থোপেডিক সার্জন)। তৃতীয়া কন্যা পারমিতা (৫০) বর্তমানে ফিলাডেলফিয়া আমেরিকাতে বসবাস করছে। স্বামী সুভাস চক্রবর্তী এবং চতুর্থা কন্যা সঙ্ঘমিত্রা (৪৬), আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে আছে। স্বামী কৌশিক ধর ওরাও ওখানকার নাগরিক। বড় কন্যার দুই পুত্র। একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, বাকি তিন কন্যার একটি করে পুত্র সন্তান আছে। তারা সবাই স্কুল বা কলেজের ছাত্র। বলাবাহুল্য সংঘমিত্রা মেধাবী ছাত্রী স্কুলে বা কলেজে ও কখনও প্রথম ছাড়া দ্বিতীয়হয়নি। কলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিক্স এবং টেলিকমিউনিকেশনে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট গোল্ড মেডালিষ্ট। তারপর আমেরিকাতে যায় এবং সেখানে হাবার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি নেয়। বর্তমানে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে ওরাকোল ফিনান্স কোম্পানীতে ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত।
উল্লেখ্য, আমি ১৯৪৪ সালে সিমলাপাল মদন মোহন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় এসে পড়াশোনা করি। আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে আমি মেডিক্যাল পড়ি এবং ডাক্তার হই। কিন্তু ভাগ্যচক্রে তা হয়ে ওঠেনি। ডাক্তারী পড়ার জন্য আর্থিক সহায়তাদানে আমার বাবার অসুবিধা ছিল। তিনি আমাকে দুই বছর অপেক্ষা করতে বলেন কারণ তখন টাকা পয়সার সংস্থান করা তাঁর পক্ষে অসুবিধা ছিল। আমার খুব অভিমান হ'ল। আমার সেজো মামা স্বর্গীয় কৃষ্ণচন্দ্র নায়ক (গ্রাম- রাধানগর, পাঁচমুড়া) হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে থাকতেন এবং ওখানে একটা কোম্পানীতে চাকরী করতেন। আমি ওনাকে লিখলাম যে আমি কলকাতাতে আসতে চাই এবং ওখানে সুবিধা মতো পড়াশোনা করতে চাই।
তারপর অনেক কষ্ট করে চাকুরি করতে করতে আমি আই কম, বি কম এবং এম.এ কমার্স (১৯৫১) পাশ করি। সব গুলিই ইভিনিং সেকশান এ পড়াশুনা। এরপর লণ্ডনে অবস্থিত চাটার্ড এন্ড জেনারেল ম্যানেজম্যান্ট ইনস্টিটিউট (CGMA) থেকে ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করে বর্তমানে এস.সি.এম এ (Associated Member) এছাড়া আমি Indian Institute of Cost and Management Accountant (ICWA) Fellow Member। তারপর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং চাকুরীর প্রয়োজনে ৫৬ বছর বয়সে কলিকাতা ইউনির্ভাসিটি থেকে এল.এল. বি. ডিগ্রীর (Law Degree) প্রয়োজন অনুভব করি। এর পিছনেও একটা ইতিহাস আছে। তখন আমি ইউনিয়ন কাবইিডে কাজ করি। আমাদের কোম্পানীর বোম্বাইয়ে অবস্থিত Chemicals and Plastic Factory এর একটি কেস গড়াতে গড়াতে সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত চলে যায়। যেহেতু আমি এই ব্যাপারটা সারা ভারতব্যাপী দেখতাম সেই হেতু আমাকে আগাগোড়া কেসটা দেখতে হয়েছে। সিনিয়র এডভোকেট শ্রদ্ধেয় সোলি সোরাজি মহাশয় সুপ্রীমকোর্টে আমাদের কোম্পানীর হয়ে কেসটা করেছিলেন আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কারণ আমি ঘটনাটি বিস্তারিত জানতাম। কোর্ট রুমে যখন ওনার পিছনে পিছনে আমি ঢুকতে যাচ্ছি তখন গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘাকার দারোয়ান আমাকে ঢুকতে দেয়নি কারণ আমি তখন Advocate ছিলাম না। এই ঘটনায় আমি ও আমাদের সিনিয়র এডভোকেট অত্যন্ত অপমানিত ও লজ্জিত বোধ করি। অবশেষে আমি Visitor's Gallery তে বসতে বাধ্য হই। এই ঘটনা থেকে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যে আমি Law Degree নেব। কলকাতাতে ফিরে এসে আমি Calcutta University Law College, Hazra Branch থেকে আমার এক অধীনস্থ কর্মীর মারফত একটি ফর্ম সংগ্রহ করি। উল্লেখ্য ঐ একই সময়ে আমার দ্বিতীয়া কন্যা তপতীও ডাক্তারী ডিগ্রীর জন্য M.B.B.S পড়ছিল। এই ভাবে আমি Law Degree অর্জন করি এবং আমি Bar Council of India এর সদস্য হয়ে যাই। তারপর থেকে আমি সারা ভারতবর্ষে কালো কোর্ট চড়িয়ে কেস করতে পারছি।আমি ১৯৬৪ সালে ইউনিয়ন কারবাইডে চিফ ওয়াক্স একাউনট্যান্ট হিসাবে যোগদান করেছিলাম। প্রথমে কয়েক বছর ফ্যাক্টরীতে ছিলাম তারপর হেড অফিস (জীবনদীপ কোলকাতা-৭০০ ০৭১) থেকে ১৯৮৭ তে অবসর গ্রহণ করি। যখন আমি জীবনদীপে ছিলাম তখন আমাকে সারা ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়াতে হোত কারণ আমাদের কোম্পানীর ১১টি ফ্যাক্টরী ছিল বোম্বাই, কোলকাতা, মাদ্রাজ, হাইদ্রাবাদ, লখনৌতে আর ১৮টি সেলস অফিস ছিল এবং ৪টি ডিভিশন অফিস ছিল (ডিভিশন গুলি হল- Agricultural Products Divn. Battery Products Divn. Carbon and Metal Divn. and Chemicals and Plastic Divn.) আর আমি তার ইনডিরেক্ট ট্যাক্স ম্যাটার দেখাশোনা করতাম। এবং প্রয়োজন মতো যে সমস্ত মামলা হোত Revenue Department (Both State & Central Govt.) এর সাথে, আমাকে সেই গুলির তত্ত্বাবধান করতে হোত।
আমি M/s Union Carbide Ltd. থেকে ১৯৮৭ সালে ৬০বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করি। তারপর থেকে আমি এডভোকেট হিসাবে ইনডিরেক্ট ট্যাক্স কনসালট্যান্ট (INDIRECT TAX CON- SULTANT) হিসাবে প্রাক্টিস করছি। আমি দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ জনকল্যাণ সমিতির সঙ্গে বহুবছর ধরে জড়ত এবং বর্তমানে ঐ সমিতির সভাপতি। বিশেষ ভাবে জানাচ্ছি যে আমাদের ফ্যামিলিতে কতকগুলি প্রথম স্থানের অধিকারী ঘটনা আছে, যেমন-
১। আমার স্বর্গীয়া স্ত্রী আমাদের দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ সমাজে প্রথম মহিলা ম্যাট্রিকুলেট এবংপ্রথম গ্রাজুয়েট।
২।আমার তৃতীয়া কন্যা ডাঃ তপতী প্রথম মহিলা ডাক্তার।
৩। কনিষ্ঠা কন্যা সঙ্ঘমিত্রা প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট।
আমি M.A. (COM), ACMA (U.K)
বর্তমানে আমার বয়স ৮৯ বছর। শারীরিক ও মানসিক ভাবে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ও আমার পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এছাড়া আমি রোটারি ক্লাব অফ সাউথ ক্যালকাটা এর সাথে জড়িত।
আপনার পত্রিকার লেখাগুলি আমাকে খুবই আনন্দ দিয়েছে। সেই সঙ্গে আমি একটি আমার -লেখা (Article- MY FIRST VISIT TO CALCUTTA IN 1940) পাঠাচ্ছি। যদি সম্ভব হয় এটি আপনার পত্রিকায় প্রকাশ করবেন। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নমস্কার, প্রীতি ও ভালোবাসা আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি।
সত্যনারায়ণ সিংহমহাপাত্র
২৭/৩৩ কে. এম. নস্কর রোড পোস্ট অফিস ও থানা-রিজেন্ট পার্ক কলকাতা-৭০০ ০৪০
==কয়েকটি কবিতা==
।।মানুষ আছে ।।
'''তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী'''
(উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি)
মানুষ আছে সুধী সফল, জ্ঞান সমন্বিত
আবার কেহ দিশাহীন
অজ্ঞ ও ঘৃণিত।
মানুষ আছে পরম সুখী দুঃখ নাই ঘরে
আবার কেহ দুঃখে মরে মনের অন্তরে।
মানুষ আছে সম্পন্ন সে, সুস্থ ও সবল
আবার কেহ পায় না খাবার হয় অতি দূর্বল।
মানুষ আছে আনন্দতে টাকায় গড়াগড়ি
আবার কেহ পায় না টাকা কাঁদে জীবন ভরি।
মানুষ আছে বীরের মতো খুবই বলবান
আবার কেহ ভিতু অতি ত্রাসিত তার প্রাণ।
মানুষ আছে বিদ্বান অতি পূণ্য পুঁথি হাতে
আবার কেহ তাড়ি খেয়ে ঘুমায় দিন রাতে।
মানুষ আছে সৎ প্রকৃতির সাধু সমাহারে
আবার কেহ ডুব দেয় দুষ্কৃত-সাগরে।
মানুষ আছে ভাগ্যবান সৌভাগ্য নিয়ে
আবার কেহ ভাগ্যহীন সারা জীবন দিয়ে।
ভালো মন্দে দোষে গুণে সত্য ও মিথ্যায়
মানুষের বিচরণ এই যে ধরায়।
'''কবিতা'''
'''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
কবিতায় আছে প্রেম আছে ভালোবাসা
সুখ আছে দুঃখ আছে মনের ভরসা।
কবিতায় ছন্দ আছে কিংবা ছন্দহীন
নীড়হারা পাখি যেন আকাশে উড্ডিন।
কবিতা কুরে খায় বুকের ভেতর
সমুদ্রের ঢেউ যেন প্লাবিত অন্তর।
কবিতায় শুরু আছে নেই এর শেষ
জীবন প্রবাহে আনে নতুন আবেশ।
কবিতায় জন্ম কথা মৃত্যু কথা থাকে
জীবনের লুকোচুরি লেখনীর ফাঁকে।
কবিতায় সুর থাকে আর থাকে গান
জীবন প্রবাহে তাই কবিতা মহান।
কবিতা কখনো হয় সহজ সরল
আবার কখনো সে যে জটিল - গরল!
ভালো-মন্দ আলো-ছায়া তোমার শরীরে
জন্ম থেকে মৃত্যু তুমি থাকো যে অন্তরে।
।।আমার বিশ্বাস।।
তুষারকান্তি যগ্নিগ্রহী
উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি
আমার বিশ্বাস-
টুকরো টুকরো আলোর কণায়
সত্যের সূর্য উঠবে!
প্রেম ও ভালোবাসার নতুন মেঘ
নীল আকাশে ভাসবে।
আমার বিশ্বাস-
ধরণীর তলে, গগনের গায়ে,
আলোর বন্যা ঝরবে। ছায়া
সুশীতল কাননের মাঝে সবুজের
ঢেউ পড়বে।
আমার বিশ্বাস-
ধরার মাঝে মনের বনের সব
ফুল আজ ফুটবে।
হৃদয় মাঝে মনের গাঙে
সব আশা আজ জুটবে।
।।খসে পড়ে।।
তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য,
পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি
মাধবীলতার ফুল খসে পড়ে
জীবনের আশা আকাঙ্খার
একটি একটি কুঁড়ি খসে যায়।
শীতের হিমেল হাওয়ায় খসে
পড়ে বনানীর পাতা।
জীবনের আয়ু একটু একটু করে
খসে যায়।
খসে পড়ে মরচে পড়া সেতারের
তার
খসে যায় নীল আকাশ, উদার
হৃদয় পাখির পালক।
ফুল থেকে খসে যায় রেণু
বাতাসের উত্তালে।
মন খসে চলে যায় অন্যলোকে,
চলে যায় হারিয়ে যায় বলেই
বার বার শুনি আগমনীর গান।
সুখের সবুজ হাসি, চোখের
চিরন্তন পলক-
করি নতুনের আরাধনা।
==নিবন্ধ==
।। বয়ঃসন্ধিকালে প্রয়োজন জীবনশৈলী শিক্ষা ।।
তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী
বয়ঃসন্ধি কালে বালকের চেহারা হয়ে ওঠে পুরুষ সুলভ। গলার স্বর পরিবর্তিত হয়। দেহ লম্বা হয়, পেশী হয় সুগঠিত ও শক্তিশালী। দেহের ওজন বাড়ে। গোঁফ দাড়ি গজায়, বুকে বগলে যৌনাঙ্গে কেশোদগম হয়। শুক্রাণু উৎপন্ন হয় শরীরে।
এই সময়ে বালিকাও ওজনে বাড়ে, লম্বা হয়, যৌনাঙ্গ বৃদ্ধি পায়। গলার স্বরের পরিবর্তন ঘটে। স্তনের আকার বৃদ্ধি পায়। বগলে, যৌনাঙ্গে কেশোদগম হয়। শরীরে ডিম্বাণু উৎপন্ন শুরু হয়। জরায়ু প্রাচীরে বিরাট পরিবর্তন-ভাঙা গড়ার কাজ চলে। মাসে মাসে রক্তস্রাব হয়।
বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে এই সময়ে এক ধরণের উদ্দীপনা কাজ করে যা যৌনাবেগ।
এর লক্ষণ;
• বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ।
• যৌন মিলনের বাসনা।
• বিশেষ ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ বা অনীহা।
• গভীর সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্খা।
বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক পরিবর্তন গুলো কি হতে পারে? আমাদের দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণে যা ধরা পড়ে তা এই রকম;
• ছেলে মেয়েরা বাবা-মায়ের সব কথা সব সময় শোনে না। বন্ধু বান্ধবদের কথা
বেশি শুনতে ভালোবাসে।
• নিজে যেটা ভালো বোঝে সেটাই করার চেষ্টা করে।
• মন চঞ্চল হয়। অনেক সময় সামান্য কথাতেও উত্তেজিত হয়।
• সাজ গোজ ও অন্যকে অনুকরণ করতে ভালোবাসে।
• সব বিষয়েই কৌতূহল থাকে।
• অনেক সময় বিমূর্ত চিন্তা করে।
বিমূর্ত চিন্তা করতে করতেই সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে বয়ঃ সন্ধিকালের তরুণ তরুণীরা। তারা হয়ে ওঠে সমাজের চালিকা শক্তি। এই শক্তিকে ঠিক ভাবে কাজে লাগালে সমাজেরই উপকার।
এই সময়ে শরীরের প্রতি আরও বেশি যত্ন নেওয়া দরকার। সাধারণ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা দরকার। শরীর ও মনকে সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত করা প্রয়োজন।
ছেলে মেয়েরা ভুল পথে পরিচালিত হলে সমূহ বিপদ। সমাজের কুপ্রভাব, সমাজের প্রলোভন, মিডিয়ার দর্শন ও প্রচার পথভ্রষ্ট করে অনেককে। অসুস্থ ভাবনা বাসা বাঁধে কিশোর কিশোরীর মনে। সুযোগ বুঝে বাঁধন হারা হতে পারে। তাই সাবধান! মুক্তি দিতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা। জীবনের ছন্দ ঠিক রাখতে পারে 'জীবন শৈলী'। সমাজের শৃঙ্খলাকে বজায় রাখতে পারে এই শিক্ষা। সৃজনশীল কাজ, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পারস্পরিক সম্মানবোধ, সঠিক পথ নির্দেশেই সুস্থ সবল করতে পারে বর্তমান প্রজন্মের তরুণ তরুণীকে। শরীরে সমস্যা থাকলে তা গোপন করা উচিত নয়। যৌন চেতনার ক্ষেত্রেও অযথা লজ্জা বা অপরাধ বোধের কিছু নেই। সবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্য আরোও একটু সচেতন হওয়া দরকার। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে একটু বেরিয়ে আসা দরকার। প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা জীবন শৈলী শিখন। শরীরের পরিবর্তন সহজ-ভাবে বোঝানো দরকার। খুব সমস্যা হলে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক, শারীরিক এমনকি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হলে বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন, স্কুলের শিক্ষক সবাইকেই বিষয়টি ভাবতে হবে। সমস্যা গুলো বুঝতে হবে। বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।
কিশোর কিশোরীর অস্বাভাবিক আচরণ ঘটলে তিরস্কার না করে তাদের মনের কাছাকাছি যেতে হবে। ব্যক্তিত্ব গড়ার জন্য তাদের দিয়ে স্বাধীন কাজকর্ম করাতে হবে। আলোচনা, সভা সমিতি, দলগত কাজ, খেলাধূলা, কোন পরীক্ষা পরিকল্পনা, বিতর্ক সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ ও বিশেষ দায়িত্ব দিলে তারা উৎসাহ পারে। সৃজন মূলক কাজে ব্যস্ত থাকলে মানসিক ও সামাজিক সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
আমাদের ছেলে মেয়েরা চায় সমান অধিকার। চায় ভালোবাসা। চায় নিরাপত্তা। আশা করে স্বীকৃতি ও প্রশংসার। এরা চায় নতুন দায়িত্ব। এরা অর্জন করতে চায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। এসব প্রয়োজন মেটাবেন কে? অবশ্যই বাবা, মা, আত্মীয় পরিজন, শিক্ষক আর সমগ্র সমাজ। চাই সুস্বাস্থ্য। চাই সঠিক পরিবেশ। চাই জীবন শৈলীর শিক্ষা। চাই আলোকময় ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা।
তাহলেই মুক্তি হবে সংকটের। কিশোর কিশোরীরা পরিচালিত হবে সঠিক পথে। সমাজ হবে কলুষ মুক্ত। দেশ পাবে উপযুক্ত নাগরিক।
==লোকসাহিত্য==
'''তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী'''
উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি
এই বাংলার বুকে নদী যেমন শত ধারায় উৎসারিত সেই রকম লোক সাহিত্য শতধারায় বিরাজমান । চিত্তের অন্দরমহলে গাঁথা হয়ে আছে লোকসাহিত্য। মানুষের সুখ দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা, কামনা-বাসনা, প্রতিফলিত হয়েছে লোকসাহিত্যে। কখনও গীত, কখনও ছড়া, কখনও আবৃত্তি কখনও বা গল্পরূপে লোকমুখে প্রচলিত লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অভিব্যক্তি ঘটে। সমাজের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, শিল্প সাহিত্য সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ সবকিছুর মধ্যেই মানবজাতির যে পরিচয় তাই তো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিকাশে লোকসাহিত্যের ভূমিকাও কম নয়।
লোকসাহিত্য সবসময় হয়তো ঠিক শিল্পসম্মত বা ছন্দোবদ্ধ হয়নি। তা না হোক, মানুষের মনের অন্দরমহলের গোপন দরজা খুলে দিয়েছে লোকসাহিত্য।
দোলায়িত করেছে মানুষের প্রাণ ও মনকে।
লোকসাহিত্য কোন একক সাহিত্যিকের সৃষ্টি নয়। অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত সাধনার ফসল। লোকসাহিত্যের ধারা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়। মানুষের জীবনপ্রবাহের বার্তা বহন করে। রঙীন কল্পলোকের দ্বার উন্মুক্ত করে।
বাংলার ঘরে ঘরে লিখিত অলিখিত প্রচলিত অপ্রচলিত লোকসাহিত্যের যে কত নিদর্শন আছে তার ইয়ত্তা নেই। শিশুসাহিত্য, মেয়েলি ব্রতকথা, ধর্মসাহিত্য, সভাসাহিত্য, পল্লীসাহিত্য, প্রবচনসাহিত্য, ইতিবৃত্তিমূলকসাহিত্যে ভরপুর লোকসাহিত্য।
ছেলে ভুলানো ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, রূপকথা, উপ কথা এসব নিয়েই শিশু সাহিত্য। শিশুসাহিত্যের ছড়া ও গানকে রবীন্দ্রনাথ তুলনা করেছেন নানা রঙের ভাসমান মেঘের সাথে । এই মেঘ শিশুমন ও হৃদয়কে উর্বর করে।
ছেলেভুলানো ছড়া এই রকম:
ইকিড় মিকিড়, চাম চিকিড়
চামের কৌটা, মকদ্দোমা হাঁড়িকুড়ি।
দুয়ারে বসে চাল কাড়ি।
চাল কাড়তে হল বেলা
ভাত খেয়ে যা দুপুর বেলা।
ভাতে পড়ল মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা
খা কামারের মাথা।
খোকার চোখে ঘুম নেই। মা ধরেছেন ঘুম পাড়ানি গান:
ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো।
খাট নেই পালঙ্ক নেই
চাটাই পেতে বসো।
বাটা ভরে পান দেব
গাল ভরে খাও।
খোকার চোখে ঘুম নেই
ঘুম দিয়ে যাও।
নগরায়ণ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে লোক সাহিত্যের অনুশীলন ও সংরক্ষণ এক বড় প্রশ্ন চিহ্নের উপর দাঁড়িয়ে। বাংলার ঘরে ঘরে আগের মতো আর লোক সাহিত্যের চর্চা হয় না। অনুশীলন হয় না। মানুষের অবসরের সময় কেড়ে নিয়েছে কম্পিউটার, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন। লোকসাহিত্যের কথা শোনাবার লোক কমে যাচ্ছে। ধুঁকতে ধুঁকতে কোন ক্রমে বেঁচে আছে আমাদের লোকসাহিত্য। তবে এখনো সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন লোকসাহিত্য চর্চাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। উৎসাহিত করছে। অনুষ্ঠানও হচ্ছে। মা ঠাকুমার কাছ থেকে যে শিশু গল্প শুনত এখন তা শুনছে রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটারের কাছ থেকে। বাংলার লোকসাহিত্য শুধু মানুষের মনে নয় এখন গাঁথা হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের শরীরেও। সভ্যতার অগ্রগতি ও যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রে ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারছে কি লোকসাহিত্য? অকালেই সে চলে যাবে না তো?
তথ্য সূত্র: পরম পরশ, পৃঃ ৪৫,৪৬
==চাণক্য শ্লোক ও শিক্ষা==
ভারতবর্ষের মধ্যে চাণক্য ছিলেন একজন অসাধারণ পণ্ডিত। মানুষের কর্তব্য, সঠিক ধর্মপথে চালনা, সমাজকল্যাণ, উপযুক্ত বিদ্যা ও শিক্ষা বিষয়ে তিনি অনেক শ্লোক রচনা করেছেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, চণকের পুত্র বা চণক বংশীয় সন্তান বলে তাঁর নাম চাণক্য। তিনি আবার কৌটিল্য, বিষ্ণুগুপ্ত এমনকি বিষ্ণু শর্মা নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য এই বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চাণক্যের আর্বিভাব।
চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে চাণকোর অবদান খুবই উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-এ চন্দ্রগুপ্ত রাজা ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে রাজধানী পাটলিপুত্র দখল করেন। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন চাণক্য।
মহামতি চাণক্য তাঁর প্রতিভা বলে যে শ্লোক রচনা করেছেন তার সামাজিক মূল্য বিরাট। চাণক্য শ্লোক বর্তমানেও মনে হয় খুবই প্রাসঙ্গিক। চাণক্য শ্লোকের ভাববস্তু আমাদের জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। চাণক্যের শ্লোকগুলি অধিকাংশই বাস্তবধর্মী।
শিক্ষা ও বিদ্যা বিষয়ে চাণক্য শ্লোক আমাদের জীবনে কতটা অপরিহার্য তা শ্লোকের বিষয়বস্তুর মধ্যে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের জীবন প্রবাহে চাণক্য শ্লোকের উপদেশ ঠিকমতো গ্রহণ করলে মানব সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। বিদ্যা ও শিক্ষা বিষয়ে কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করলাম।
শ্লোক-১
অলসস্য কুতো বিদ্যা অবিদ্যস্যকুতোধনম্।
অধনস্য কুতো মিত্রম্ অমিত্রস্য কুতঃ সুখম্।।
যারা অলস তাদের বিদ্যা হয় না। বিদ্যা না থাকলে ধন হয় না। যার ধন নেই তার বন্ধু জোটে না, যার বন্ধু নেই তার সুখ নেই।
শ্লোক-২: অনভ্যাসে বিষং বিদ্যা বৃদ্ধস্য
তরুণী বিষম্।
আরোগে তু বিষং বৈদ্যঃ অজীর্ণে ভোজনং
বিষম্।।
ঠিকমতো অভ্যাস না করলে বিদ্য বিষ তুল্য বুড়োমানুষের তরুণী স্ত্রী বিষতুল্য, রোগ দূর হলে চিকিৎসক বিষতুল্য,
খাবার ঠিকমতো হজম না হলে ভোজন বিষবৎ হয়।
শ্লোক-৩:
অবিদ্যঃ পুরুষঃ শোচ্যঃ শোচ্যা নারী চানপত্যা।
নিরাহারাঃ প্রজাঃ শোচ্যাঃ শোচ্যং রাষ্ট্রমরাজকম্।।
যে পুরুষের বিদ্যা নেই, যে নারীর সন্তান নেই, যে প্রজা অনাহারে থাকে, যে রাষ্ট্র রাজাহীন-এগুলোর জন্য শোক করা উচিত।
শ্লোক-৪: ন চ বিদ্যসমো বন্ধু র্ন চ ব্যাধিসম রিপুঃ।
ন চাপত্য সম স্নেহো র্ন চ দৈবাং পরং বলম্।।
বিদ্যার মতো তুল্য বন্ধু নেই, ব্যাধির মতো শত্রু নেই, সন্তান স্নেহের তুল্য স্নেহ নেই, দৈব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোনো বল নেই।
শ্লোক-৫: বিদ্যা মিত্রং প্রবাসেষু, মাতা মিত্রং গৃহেসু চ।
ব্যাধিত সৌষধং মিত্রং ধর্মে মিত্রং মৃতস্য চ।।
প্রবাসে বিদ্যা হল বন্ধু, বাড়িতে মা বন্ধু, ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তির ঔষধ হল বন্ধু, ধর্ম হল মৃতের বন্ধু।
শ্লোক-৬: ধনং ক্ষীণং ভবেদানাদ বিদ্যাদানাদ্বিবর্ধতে। তস্মান্মান্যে ধ্রুবং বিদ্যা ধনাদপি গরিয়সী।।
ধন দান করলে তা কমে যায়, বিদ্যা দান করলে তা বাড়ে, সেইজন্য নিশ্চিন্ত মনে করি-ধনের থেকে বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ।
শ্লোক-৭: জ্ঞাতিভির্বণ্টা নৈব চৌরেনাপি ন নীয়তে।
দানেন ন ক্ষয়ং যাতি বিদ্যারত্বং মহাধনম।।
বিদ্যা হল এমন রত্ন বা মূল্যবান ধন যার ভাগ জ্ঞাতিরা নিতে পারে না, চোরে যাকে চুরি করতে পারে না। দান করলে যার ক্ষয় হয় না।
শ্লোক-৮: কামং ক্রোধং তথা লোভং স্বাদং শৃঙ্খার কৌতুকম্। অতি নিদ্রাতি সেবা বিদ্যার্থী হাষ্ট বর্জয়েৎ।।
বিদ্যার্থী তথা ছাত্রের কাম, ক্রোধ, লোভ, সুস্বাদু খাবার, শৃঙ্গার, কৌতুক, অতিরিক্ত ঘুম, অতিরিক্ত ভোজন এট আটটি বর্জন করা উচিত
শ্লোক-৯: অবিদ্যং জীবনং শূন্যং দিক্ শূন্যা চেদবান্ধবাঃ। পুত্রহীনং গৃহং শূন্যং সর্বশূন্যা দরিদ্রতা।।
বিদ্যা না থাকলে জীবন শূন্য, বন্ধুবান্ধব না থাকলে সবদিক শূন্য, গৃহে পুত্র না থাকলে তা শূন্য, দরিদ্র ব্যক্তির সবকিছুই শূন্য।
শ্লোক-১০: রূপযৌবনসম্পন্না বিশাল কুলসম্ভবাঃ। বিদ্যাহীনা ন, শোভন্তে নির্গন্ধা ইব কিংশুকাঃ।।
রূপ যৌবন সম্পন্ন হলেও, উচ্চকুলে জন্ম নিলেও বিদ্যাহীন ব্যক্তি গন্ধহীন পলাশ ফুলের মতো।
শ্লোক-১১: ক্ষময়া দয়য়া প্রেমা সুনুতেনার্জবেন চ। বশী কুযাৎ জগৎ সবং বিনয়েন চ সেবয়া।।
, দয়া, প্রেম, সত্য, সরলতা, বিনয় এবং সেবা দ্বারা সকল জগৎকে বশীভূত করবে।
ক্ষমা সিংহাদেকং বকাদেকং যশুনন্ত্রীণি গর্দভাৎ।
শ্লোক-১২: বায়সাৎ পঞ্জ শিক্ষেৎ চত্বারি কুকুটাদপি।।
সিংহের কাছ থেকে একটি, বকের কাছ থেকে একটি, কুকুরের কাছ থেকে ছয়টি, গর্দভের কাছ থেকে তিনটি, কাকের কাছ থেকে পাঁচটি, মোরগের কাছ থেকে চারটি গুণ শিক্ষা করা উচিত।
সিংহ বীর বিক্রমে শিকার ধরে। কাজ সহজ বা কঠিন হোক তা বীর বিক্রমে করা দরকার। বকের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমরা নিতে পারি তা হল, সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করার শিক্ষা।
কুকুরের কাছ থেকে যে ছয়রকম শিক্ষা আমরা নিতে পারি। তা হল, বিভিন্ন আহার, অল্পে সন্তোষ, শীঘ্র ঘুম, সামান্য শব্দে জেগে ওঠা, প্রভুভক্তি এবং শত্রুকে আক্রমণ।
গর্দভের কাছ থেকে যে তিনটি শিক্ষা আমরা পাই সেগুলি হল, ভার বহন, শীত গ্রীষ্ম উপেক্ষা, সবসময় সন্তোষ।
কাকের কাছ থেকে পাঁচটি শিক্ষা হল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আচরণ, সময়ে আহার, পরিশ্রম ও সতর্কতা। মোরগের কাছ থেকে আমরা চার রকম শিক্ষা পাই-ভোরে ওঠা, যুদ্ধবিদ্যা, একসাথে ভাগ করে খাওয়া, বিপদে স্ত্রীকে রক্ষা করা।
চাণক্যের শ্লোকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা সর্বকালীন ও যুগজয়ী। আমাদের জীবনে চলার পথে যদি চাণক্যের উপদেশ কিছুটা গ্রহণ করি তাহলে আমাদের অশেষ উপকার হবে বলেই মনে হয়''' তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী''' <ref> স্মরণিকা,রাজ্য সম্মেলন,২০২৩, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি, লেখক- তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, পাতা=৩১,৩২</ref>
==বেতার মাধ্যমে পাঠদান==
নিজস্ব প্রতিবেদন: ১৯৭৮ সাল নাগাদ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিদ্যালয় স্তরের পাঠদানের ক্ষেত্রে বেতার সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশিষ্ট শিক্ষকদের পাঠদান খুব সহজেই লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে যেত। এই পাঠদান পর্ব বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। পাঠদানের এই পর্ব ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলে। পরবর্তী পর্যায়ে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের দৌলতে এই পাঠদান বন্ধ হয়। সিমলাপাল মদন মোহন হাইস্কুলের সহ-শিক্ষক তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী সেই সময় অনেক পাঠদানে অংশ নিয়েছিলেন। তার কয়েকটি তুলে ধরলাম।
১) অষ্টম শ্রেণিঃ উদ্ভিদকোষ ও প্রাণীকোষের গঠন।
আকাশবাণী কলকাতা ক প্রচার তরঙ্গ প্রচারের তারিখ: ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ ২টা ৩৫মিঃ
মোট সময় ২৩ মিনিট। ফিঃ ৫০ টাকা
পুনঃপ্রচার ফি ১২টা ৫০পঃ স্টুডিওতে রেকর্ডিং
হয়: ১৮-০৯-৭৯ সকাল ১০টা ৩০মিঃ
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী, ছাত্র/ছাত্রী: জয়ন্ত গোস্বামী, প্রতিমা সিংহমহাপাত্র।
২) অষ্টম শ্রেণিঃ জীবন বিজ্ঞান: পাঠদানের
বিষয়: ব্যাপন ও অভিস্রবণ এবং জীবদেহে তার গুরুত্ব।
প্রচারের তারিখ: ২৫ মার্চ ১৯৮৭, ২টা ৩৫মিঃ মোট সময় ১৮ মিনিট। আকাশবাণী কলকাতা
ক প্রচার তরঙ্গ ফি: ১২৫ টাকা, স্টুডিওতে
রেকর্ডিং হয়: ২৩-০৩-৮৭ বেলা ১২টা
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
ছাত্রঃ মলয় চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু সিংহমহাপাত্র, প্রিয়ব্রত সিংহমহাপাত্র।
৩) জানা অজানা: ডিমের কথা:
সময় ৫ মিনিট
বক্তা: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী, আকাশবাণী কলকাতা, ক প্রচার তরঙ্গ, প্রচারের তারিখ ৩০ নভেম্বর ১৯৮৭ সকাল ৮টা পুনঃপ্রচার ৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ ফি ৬০টাকা।
স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়: ১৭-১১-৮৭
দুপুর ২টা।
৪) একাদশ শ্রেণি: জীব বিজ্ঞান (শারীর বিদ্যা)
বিষয়: রক্তের মাধ্যমে শ্বসনের জন্য গ্যাস পরিবহণ
আকাশবাণী কলকাতা, ক প্রচার তরঙ্গ, প্রচারের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭। ২টা ৩৫মি.
মোট সময় ১৮ মিঃ ফি ১২৫ টাকা।
স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়: ১৬-১২-৮৭ বেলা ১২টা
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী
ছাত্রঃ সন্দীপ কুমার নন্দী, ইন্দ্রনীল ভৌমিক, দেবীপ্রসাদ ঢং।
৫) একাদশ শ্রেণি: জীব বিজ্ঞান (শারীর বিদ্যা)
বিষয়: মানবদেহে শ্বসনের প্রক্রিয়া এবং তার স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ।
কলকাতা ক প্রচার তরঙ্গ,প্রচারের তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ ২টা, ৩৫মি.
মোট সময় ১৮মিঃ ফি-১৩৫ টাকা।
স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়: ১-২-৮৯
সকাল ১১টা
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
ছাত্র: সমীর কুমার পাত্র, পার্থপ্রতিম পণ্ডা, ইন্দ্রনীল মহান্তি।
৬) একাদশ শ্রেণি: জীব বিজ্ঞান (শারীর বিদ্যা)
বিষয়: মানবদেহে প্রোটিনের বিপাক,
কলকাতা ক প্রচার তরঙ্গ
প্রচারের তারিখ ২৭ জুলাই ১৯৮৯ ২টা. ৩৫মি.
মোট সময় ১৮মিঃ ফি-২০৫ টাকা।
স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়: ২২-০৭-৮৯
সকাল ১১টা
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
ছাত্রঃ রাম কর্মকার, প্রদীপ কুমার
সিংহমহাপাত্র, অরুণ কুমার সৎপথী।
৭) একাদশ শ্রেণি: জীব বিজ্ঞান (শারীর বিদ্যা)
বিষয়: আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাদ্যের পরিপাক
কলকাতা ক প্রচার তরঙ্গ
প্রচারের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ১৯৯০
২টা. ৩৫মি. মোট সময় ১৮মিঃ ফি- ২০৫ টাকা।
স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়: ১৩-১২-৯০
বেলা ১১টা
অংশগ্রহণকারী শিক্ষক: তুষারকান্তি যন্নিগ্রহী
ছাত্র: অংশুমান ভদ্র, তাপস সিংহমহাপাত্র, সুব্রত সিংহমহাপাত্র। সূত্র: কৃষ্টি কিরণ ২০২১
qv5l9btzwljlac6jq4tbwvp0gbxle5k
ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash
3
23420
85518
85309
2025-07-01T15:12:57Z
Mehedi Abedin
7113
/* পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ */ উত্তর
85518
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ০৯:৪০, ১১ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] ==
প্রতিযোগিতার জন্য জমা দেওয়া [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] পাতায় কিছু সমস্যা আছে এবং পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করা হয়নি। সমস্যাগুলোর সমাধান করে আমাকে মেনশন করে জানালে পাতাটি পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিবো। দ্রুত ঠিক করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ০৪:৪২, ২২ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:আমি শীঘ্রই ভুল ত্রুটি যা আছে তার সংশোধন করে আপনাকে উত্তরের মাধ্যমে জানাচ্ছি। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৬:৪৮, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
::আমার সংশোধন করা হয়ে গেছে। একবার পর্যালোচনা করে তা গ্রহণ করে নিন। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৭:০৭, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:::@[[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] দুঃখিত, মেনশন করে না জানানোর ফলে নোটিফিকেশন পাইনি। আমি শীঘ্রই পুনঃপর্যালোচনা শুরু করবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:১২, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
bgxyoqctnq189icbe0spn1dly1kabn3
85519
85518
2025-07-01T15:14:23Z
Mehedi Abedin
7113
/* পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/যোগাযোগ শুরু */ নতুন অনুচ্ছেদ
85519
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ০৯:৪০, ১১ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] ==
প্রতিযোগিতার জন্য জমা দেওয়া [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] পাতায় কিছু সমস্যা আছে এবং পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করা হয়নি। সমস্যাগুলোর সমাধান করে আমাকে মেনশন করে জানালে পাতাটি পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিবো। দ্রুত ঠিক করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ০৪:৪২, ২২ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:আমি শীঘ্রই ভুল ত্রুটি যা আছে তার সংশোধন করে আপনাকে উত্তরের মাধ্যমে জানাচ্ছি। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৬:৪৮, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
::আমার সংশোধন করা হয়ে গেছে। একবার পর্যালোচনা করে তা গ্রহণ করে নিন। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৭:০৭, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:::@[[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] দুঃখিত, মেনশন করে না জানানোর ফলে নোটিফিকেশন পাইনি। আমি শীঘ্রই পুনঃপর্যালোচনা শুরু করবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:১২, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/যোগাযোগ শুরু]] ==
এই পাতায় অনুবাদে বেশ কিছু ত্রুটি আছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বাক্য ও অনুচ্ছেদ বোঝা যায়না। প্রতিযোগিতার পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ হওয়ার আগে এটা ঠিক করে আমাকে মেনশন করে জানালে আবার পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিতে পারবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:১৪, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
moh10acy1ja3hw5je8ko587zdt849yf
85525
85519
2025-07-01T15:22:49Z
Mehedi Abedin
7113
/* পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ */ উত্তর
85525
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ০৯:৪০, ১১ মে ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] ==
প্রতিযোগিতার জন্য জমা দেওয়া [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ]] পাতায় কিছু সমস্যা আছে এবং পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করা হয়নি। সমস্যাগুলোর সমাধান করে আমাকে মেনশন করে জানালে পাতাটি পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিবো। দ্রুত ঠিক করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ০৪:৪২, ২২ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:আমি শীঘ্রই ভুল ত্রুটি যা আছে তার সংশোধন করে আপনাকে উত্তরের মাধ্যমে জানাচ্ছি। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৬:৪৮, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
::আমার সংশোধন করা হয়ে গেছে। একবার পর্যালোচনা করে তা গ্রহণ করে নিন। [[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Ei to ami akash|আলাপ]]) ১৭:০৭, ২৫ জুন ২০২৫ (ইউটিসি)
:::@[[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] দুঃখিত, মেনশন করে না জানানোর ফলে নোটিফিকেশন পাইনি। আমি শীঘ্রই পুনঃপর্যালোচনা শুরু করবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:১২, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
::::@[[ব্যবহারকারী:Ei to ami akash|Ei to ami akash]] গৃহীত হয়েছে। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:২২, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
== [[পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/যোগাযোগ শুরু]] ==
এই পাতায় অনুবাদে বেশ কিছু ত্রুটি আছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বাক্য ও অনুচ্ছেদ বোঝা যায়না। প্রতিযোগিতার পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ হওয়ার আগে এটা ঠিক করে আমাকে মেনশন করে জানালে আবার পর্যালোচনা করে গ্রহণ করে নিতে পারবো। [[ব্যবহারকারী:Mehedi Abedin|Mehedi Abedin]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:Mehedi Abedin|আলাপ]]) ১৫:১৪, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
lhuxdi14mmiuav3dcv8cd6dkaz1wcj2
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস/ঔপনিবেশিক ধর্ম
0
25580
85508
79685
2025-07-01T14:48:56Z
Mehedi Abedin
7113
85508
wikitext
text/x-wiki
==ইংল্যান্ডের চার্চ==
১৭শ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের সরকারি চার্চ নির্বাসনের এক সময়কাল পার করে এসেছিল। রাজা প্রথম চার্লসের সরকারের নীতির বিরোধিতা করে পুরিতান অলিভার ক্রমওয়েল তাঁকে ১৬৪৭ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করেন এবং পার্লামেন্ট থেকে রাজপন্থীদের বিতাড়নের পর রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় এক প্রজন্ম ধরে চার্চে আধ্যাত্মিক নেতার অনুপস্থিতি ছিল। পুনঃস্থাপনের সময় রাজা দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলে চার্চ আবার ধূপ, সঙ্গীত, অলঙ্কারিক পোশাক, এবং দীর্ঘ সেবা সহ প্রার্থনার বই (বুক অফ কমন প্রেয়ার) ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু
তখন এমন এক জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা এই আচারগুলোর বাইরে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কিছু "লো চার্চ" এই অলঙ্কারিকতা বিরোধী মানুষের সেবা করত এবং তারা চাপা পড়ে যাওয়া পিউরিতীয়দের প্রতি সহানুভূতি দেখাত। ধনসম্পদ এবং সাধাসিধে জীবনের এই পারস্পরিক বৈপরীত্য একই ধর্মের মধ্যে অস্বস্তিকর ছিল।
ব্রিটেনের চাপ কমাতে মার্কিন উপনিবেশগুলোকে ব্যবহারের ফলে সেখানে সরকারি ধর্ম খুব কম প্রতিনিধিত্ব পায় যদিও প্রার্থনার বই সেখানে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের "হাই চার্চ" গোষ্ঠীর বিশপ ও কর্তৃত্ব ছিল; কিন্তু আমেরিকায় এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি ভার্জিনিয়ার মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাংলিকান উপনিবেশেও চার্চ পম্প বা কর্তৃত্ব ছাড়াই চলতো। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে ধর্মীয় বন্ধন ছিল দুর্বল, যেন সমুদ্রের অতিরিক্ত একটি মাইল দূরত্ব।
==মেথডবাদ==
'''জন''' এবং '''চার্লস ওয়েসলি''' ১৮শ শতকে মেথডবাদের সূচনা করেন। ''জন ওয়েসলি'' ছিলেন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একজন পুরোহিত। তিনি ও তার ভাই ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডজুড়ে খ্রিস্টানদের ছোট ছোট গোষ্ঠী পরিচালনা করতেন, যাদের ওয়েসলীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এরা পরে মেথডবাদের সমর্থক নামে পরিচিত হয়। এটি শুরুতে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একটি সম্প্রদায়ে হিসেবে ছিল, স্বাধীন মণ্ডলী নয়। কারণ এটি কর্তৃপক্ষের কাঠামোর চেয়ে সাধারণ জনগণের ওপর জোর দিত এবং আবেগপূর্ণ বিশ্বাসকে ধর্মান্তরের প্রমাণ হিসেবে দেখত, এজন্য অনেকে একে সন্দেহের চোখে দেখত। জন ওয়েসলি এক ধর্মোপদেশে প্রশ্ন করেন: "মেথডবাদী কে? " তিনি উত্তর দেন: "মেথডবাদী সে, যার অন্তরে 'ঈশ্বরের প্রেম পবিত্র আত্মার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে'"<ref>"Character of A Methodist" (title assigned by the anthology), extract from a sermon by John Wesley. Kerr, Hugh E., Editor, <u>Readings In Christian Thought.</u> Second Edition. Nashville: Abingdon Press, 1990(1966).</ref>। মেথডিস্টরা বাইবেল অধ্যয়ন ও বিলাসবিহীন জীবনযাপনে গুরুত্ব দিত। নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে তাদের মেথডিস্ট বলা হতো।
==উপনিবেশিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেথডবাদ==
১৭৬০-এর দশকের শেষভাগে মেথডবাদ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জন ওয়েসলি নিযুক্ত প্রচারক '''রিচার্ড বোর্ডম্যান''' ও '''জোসেফ পিলমোর''' ১৭৬৯ সালে নতুন বিশ্বে মেথডবাদী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসেন। পিলমোর ফিলাডেলফিয়ায় ও বোর্ডম্যান নিউ ইয়র্কে কাজ শুরু করেন। পিলমোর ছিলেন অধিক কার্যকর, তিনি দক্ষিণে গিয়েও মেথডবাদ প্রচার করেন। অন্যান্যরাও এলেন—'''রবার্ট উইলিয়ামস''' ও '''জন কিং''' ওয়েসলির অনুমতি ছাড়াই এলেন; '''ফ্রান্সিস আসবুরি''' ও '''রিচার্ড রাইট''' ১৭৭১ সালে আসেন; '''জর্জ শ্যাডফোর্ড''' ও '''টমাস র্যাঙ্কিন''' ১৭৭৩ সালে আসেন।<ref>Norwood, Fredrick A. The Story of American Methodism</ref>
চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সমসাময়িকদের বিপরীতে মেথডবাদীরা গির্জাহীন এলাকায় মাঠে প্রচার করতে প্রস্তুত ছিল। উপরন্তু, এদের বেশিরভাগই সাধারণ ধর্মপ্রচারক ছিলেন যারা দীর্ঘকালীন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা নয় বরং আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পুরোহিত হয়েছিলেন। এভাবে মেথডবাদ মার্কিন বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে।
==মহাজাগরণ==
মহাজাগরণ ছিল আমেরিকায় মূলত চার্চ অফ ইংল্যান্ড থেকে আলাদা থাকা খ্রিস্টান শাখাগুলোর মধ্যে (যেমন ব্যাপ্টিস্ট, মেথডবাদ, ও পিউরিতীয় হতে উৎপন্ন মতবাদ) একটি ধর্মীয় জাগরণের সময়কাল। ইতিহাসবিদরা এটি চারটি ধাপে বিভক্ত দেখেন। প্রথম ধাপটি নিউ ইংল্যান্ডে ১৭৩০-এর দশকে শুরু হয়ে ত্রিশ বছর স্থায়ী ছিল।<ref>Norwood, Frederick A. The Story of American Methodism</ref> এটি ছিল দুটি অংশে বিভক্ত—পুরিতান ও মেথডিস্ট অংশ।
একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন পিউরিতান মন্ত্রী '''জনাথন এডওয়ার্ডস'''। তিনি দেখতেন যে পিলগ্রিমদের বিশ্বাস থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা গঠন বা আচার-অনুষ্ঠানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ডস ছিলেন ইভানজেলিজমপন্থী, তিনি ধর্মান্তরের জন্য প্রচার করতেন। তার কিছু উপদেশ মানুষকে কান্নায় ভাসাতো বা উল্লাসে দাঁড় করিয়ে দিত। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপদেশ "পাপীরা একটি রাগান্বিত ঈশ্বরের হাতের মুঠোয়" যেখানে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (তিনি মাকড়সা নিয়ে রচনা করেছিলেন) এবং অসাধারণ বাচনশক্তি ব্যবহার করে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেন।
জন ওয়েসলি ও তার সহপাঠী '''জর্জ হোয়াইটফিল্ড''' দ্বারা এই জাগরণের মেথডবাদী দিকটি চালিত হয়েছিল। ওয়েসলি ১৭৩৫ সালে জর্জিয়ায় আসেন, যদিও তেমন সাফল্য পাননি। তবে হোয়াইটফিল্ড আমেরিকায় সাতবার আসেন এবং কৃষ্ণ দাসদের মধ্যেও প্রচার করেন, যা তখন অনেকের পক্ষে অচিন্তনীয় ছিল।
==মোরাভীয়==
'''জন''' ও '''চার্লস ওয়েসলির''' সঙ্গে ১৭৩৫ সালে আমেরিকায় আসা মোরাভীয়রা ছিলেন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। তারা মোরাভিয়া ও বোহেমিয়া ত্যাগ করে মার্কিন মুলুকে খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে আসেন। তারা প্রথমে জর্জিয়া, পরে পেনসিলভানিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনায় বসতি গড়েন। মোরাভীয়রা সঙ্গীতপ্রিয় ছিল, তারা প্রতিদিন স্তুতি গান করতেন এবং কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রও রচনা করতেন।
'''জন আন্টেস''' ছিলেন প্রথম আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী মোরাভীত সুরকার। ১৭৪০ সালে পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নিয়ে তিনি অনেক ধর্মীয় সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচনাগুলি গির্জার প্রশিক্ষিত দল বা একক কণ্ঠে পরিবেশিত হতো, সাধারণ গান হিসেবে নয়।
==মেনোনায়ীয়==
'''উইলিয়াম পেন'''-এর আমন্ত্রণে কিছু মেনোনায়ীয় ১৬৮৩ সালে পেনসিলভানিয়ায় আসেন। এই গোষ্ঠী বাইবেলের সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। তারা শিশুদের বাপ্তিস্ম না দিয়ে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের বাপ্তিস্ম দিত, যা সমসাময়িকদের ক্ষুব্ধ করত। তারা কর প্রদান, অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে চরম শান্তিবাদে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ড, প্রুশিয়া, ইউক্রেন, ও রাশিয়া থেকেও মোনানায়ীয়এয়া আমেরিকা ও কানাডায় আসে। তাদের মধ্যে আমিশরা অন্যতম, যারা ধর্মীয় শাস্তি হিসেবে সামাজিকভাবে বর্জন কার্যক্রম ব্যবহার করে।
==ইহুদিধর্ম==
প্রথম অ-খ্রিস্টান গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় আসে '''সেফার্ডীয় ইহুদিরা'''। তারা প্রথমে ব্রাজিলের রেসিফে শহরে বসতি গড়ে, পরে ১৬৫৪ সালে নিউ আমস্টারডামে (বর্তমান নিউ ইয়র্ক সিটি) আসে। যদিও ওলন্দাজদের দেশে ইহুদিদের সম্মান ছিল, নিউ আমস্টারডামের গভর্নর '''পিটার স্টাইভেসান্ট''' তাদের রাখতে চাননি। তিনি ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চিঠিতে লেখেন যে ইহুদিরা এই উপনিবেশকে “সংক্রমিত ও অস্থির” করবে। ইহুদিরা পাল্টা চিঠিতে জানায় তারা ডাচদের সম্মান করে এবং বহু পুরোনো নাগরিক। কোম্পানি সিদ্ধান্ত দেয়, ইহুদিরা থাকতে পারবে যদি তারা নিজের দরিদ্রদের দেখাশোনা করে ও খ্রিস্টানদের দান আশা না করে।
উপনিবেশিক আমলে ইহুদিরা পূর্ব উপকূল ও দক্ষিণের কিছু উপনিবেশে বসতি গড়ে, যেমন সাভান্না, চার্লস্টন, ফিলাডেলফিয়া, ও নিউপোর্ট। আজও টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো উপাসনালয়টি ১৭৬৩ সালে নিউপোর্টের সেফার্রডীয় ইহুদিরা নির্মাণ করে, যা '''তুরো সিনাগগ''' নামে পরিচিত। এটি '''জেশুয়াত ইস্রায়েল''' সম্প্রদায়ের ঘর।
ইহুদিদের জন্য শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা, উপাসনা ও কোশার রান্নার চর্চা কঠিন ছিল। '''রেবেকা স্যামুয়েল''' তার মা-বাবাকে চিঠিতে লেখেন: “এখানে ইহুদিত্ব চাপা পড়ে গেছে। এখানে [পিটার্সবার্গ, ভার্জিনিয়া] দশ-বারোজন ইহুদি আছেন, তারা প্রকৃত ইহুদি নয়... আমি একটি সিনাগগ দেখতে আগ্রহী যেখানে যেতে পারি।” যদিও আরও ইহুদি আসেন, তারা ইংরেজি শিখে সমাজে স্থান করে নেন। কিন্তু শনিবার উপাসনা করা ছিল কষ্টকর যখন সবাই রবিবার গির্জায় যেত। কিছু উপনিবেশে তারা ভোট দিতে, সরকারি পদে থাকতে বা সম্পত্তি কিনতে পারত না। তারা ভিন্ন ছিল এবং ইউরোপের মতো নির্যাতনের আশঙ্কা করত। কিন্তু এখানে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারত। রাতদুপুরে দরজায় কড়াঘাত, যন্ত্রণা, বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ভয় ছিল না।<ref>Judaism- Stone, Amy. Jewish Americans. Milwaukee: World Almanac Library, 2007.</ref>
==ক্যাথলিকবাদ==
ম্যাসাচুসেটস বে উপনিবেশে প্রথম কুড়ি বছরে কোনো ক্যাথলিকের উপস্থিতি ছিল না, তবুও ১৬৪৭ সালের মে মাসে পিউরিতানীয় সরকার একটি কঠোর আইন পাশ করে, যা "যে কোনো যাজক, ধর্মীয় পুরোহিত বা রোমান পোপ কর্তৃক নিয়োজিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি"-কে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেয়। ১৭৩২ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ কর্তৃক জর্জিয়া উপনিবেশ গঠনের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও ক্যাথলিকদের ছাড় দেওয়া হয়নি।<ref>[http://www.traditioninaction.org/History/B_001_Colonies.html Horvat, Marian T. "Let None Dare Call it Liberty: The Catholic Church in Colonial America". Retrieved 09/05/15]</ref> ক্যাথলিকদের জন্য প্রকাশ্যে উপাসনা নিষিদ্ধ ছিল এবং পুরোহিতের মাস বলাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।
ক্যাথলিকবাদ প্রথম আসে ''মেরিল্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট''-এর মাধ্যমে। রাজা প্রথম চার্লস '''সিসিল ক্যালভার্ট (লর্ড বাল্টিমোর)'''-কে উদারভাবে মেরিল্যান্ড উপনিবেশের চার্টার দেন। তিনি একজন ক্যাথলিক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাথলিকদের সহনশীলতা বজায় রাখেন, কিন্তু পরে ভার্জিনিয়া থেকে আগত পিউরিতানীয়রা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। চার বছর পরে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন।
১৬৭২ সালে দ্বিতীয় চার্লসের ভাই ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আইরিশ ক্যাথলিক '''টমাস ডনগান'''-কে নিউ ইয়র্কের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এর ফলে ক্যাথলিকদের জন্য কিছু অধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু ডাচ ও ব্রিটিশরা এতে অখুশি ছিল। ১৬৮৯ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অপসারণ করা হয় এবং প্রোটেস্টান্ট রাজা-রানী উইলিয়াম ও মেরি ক্ষমতায় আসেন। মেরিল্যান্ডে আবার ক্যাথলিক বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ক্যালভার্টদের শাসন শেষ হয়। ১৬৯২ সালে ধর্মীয় সহনশীলতা আইন বাতিল হয় এবং মেরিল্যান্ডের সরকারি ধর্ম হিসেবে করের মাধ্যমে পরিচালিত চার্চ অফ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।<ref>Greely, Andrew M. ''An Ugly Little Secret'' 1928.</ref>
নিউ ইয়র্ক উপনিবেশে রাজা দ্বিতীয় জেমসের অপসারণের আগেই '''জ্যাকব লেইসলার''' নামে একজন ক্যাথলিক বিরোধী নেতা "প্যাপিস্ট" ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়ান এবং মিথ্যা খবর প্রচার করেন। ১৬৮৮ সালের শেষ নাগাদ তিনি ডনগানকে অপসারণ করে নিজেকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ঘোষণা করেন। তিনি সব ক্যাথলিকদের গ্রেপ্তার, ভোটাধিকার বাতিল এবং সরকারি পদ থেকে অপসারণ করেন। যদিও লেইসলার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত হন, তার প্রভাব রয়ে যায়, ক্যাথলিকদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল হয়।<ref>Horvat.</ref>
==ডিইবাদ==
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য ধর্মীয় ধারা ছিল '''ডিইবাদ'''। এটি ইংল্যান্ড থেকে আগত একটি বিশ্বাস, যা মার্কিন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে "প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ প্রারম্ভিক ডিইবাদীরা তাদের বিশ্বাস প্রচার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন [...] কারণ তারা বিশ্বাস করতেন কেবল বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই যুক্তিবাদীভাবে ধর্ম বুঝতে সক্ষম।"<ref>Bedell, George C., Leo Sandon, Jr., Charles T. Wellborn. Religion in America. Second edition. New York: Macmillan, 1982 (1975). P. 231.</ref> ডিইবাদীরা কিছু বিশ্বাস খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিল রাখলেও (যেমন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও যুক্তির ওপর বিশ্বাস) তারা বাইবেলকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করত না। তারা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর কারো সঙ্গে কথা বলেন না; প্রকৃতি একটি ঘড়ির মতো, যা একবার চালু হলে নিজে চলতে থাকে; এবং অলৌকিক বিশ্বাস পাগলামি।
পরিচিত মার্কিন ডিইবাদীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত—'''বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন''' কিছু সময়ের জন্য ছিলেন; অন্যান্যরা ছিলেন '''জেমস ম্যাডিসন''', '''ইথান অ্যালেন''', ও '''থমাস পেইন''' (যার বিখ্যাত রচনা ''দ্য এইজ অফ রিজন'' অলৌকিক বিশ্বাসকে মূর্খতা বলে অভিহিত করে)। '''থমাস জেফারসন''' ডিইজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার স্বাধীনতার ঘোষণায় "ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচার্স গড" শব্দগুচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে।
==পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন==
# এই ব্যক্তিদের প্রত্যেককে তার ধর্মের সাথে সংযুক্ত করুন: জন ওয়েসলি, জোনাথন এডওয়ার্ডস, সিসিল ক্যালভার্ট।
# জার্মান-ভাষী দেশগুলির একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। গ্রেট ব্রিটেনের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন।
==তথ্যসূত্র==
{{reflist}}
{{BookCat}}
{{status|100%}}
{{BookCat}}
inhjycj1s8vpu01sf81f11fjc00tqni
85509
85508
2025-07-01T14:49:39Z
Mehedi Abedin
7113
85509
wikitext
text/x-wiki
==ইংল্যান্ডের চার্চ==
১৭শ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের সরকারি চার্চ নির্বাসনের এক সময়কাল পার করে এসেছিল। রাজা প্রথম চার্লসের সরকারের নীতির বিরোধিতা করে পুরিতান অলিভার ক্রমওয়েল তাঁকে ১৬৪৭ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করেন এবং পার্লামেন্ট থেকে রাজপন্থীদের বিতাড়নের পর রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় এক প্রজন্ম ধরে চার্চে আধ্যাত্মিক নেতার অনুপস্থিতি ছিল। পুনঃস্থাপনের সময় রাজা দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলে চার্চ আবার ধূপ, সঙ্গীত, অলঙ্কারিক পোশাক, এবং দীর্ঘ সেবা সহ প্রার্থনার বই (বুক অফ কমন প্রেয়ার) ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু
তখন এমন এক জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা এই আচারগুলোর বাইরে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কিছু "লো চার্চ" এই অলঙ্কারিকতা বিরোধী মানুষের সেবা করত এবং তারা চাপা পড়ে যাওয়া পিউরিতীয়দের প্রতি সহানুভূতি দেখাত। ধনসম্পদ এবং সাধাসিধে জীবনের এই পারস্পরিক বৈপরীত্য একই ধর্মের মধ্যে অস্বস্তিকর ছিল।
ব্রিটেনের চাপ কমাতে মার্কিন উপনিবেশগুলোকে ব্যবহারের ফলে সেখানে সরকারি ধর্ম খুব কম প্রতিনিধিত্ব পায় যদিও প্রার্থনার বই সেখানে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের "হাই চার্চ" গোষ্ঠীর বিশপ ও কর্তৃত্ব ছিল; কিন্তু আমেরিকায় এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি ভার্জিনিয়ার মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাংলিকান উপনিবেশেও চার্চ পম্প বা কর্তৃত্ব ছাড়াই চলতো। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে ধর্মীয় বন্ধন ছিল দুর্বল, যেন সমুদ্রের অতিরিক্ত একটি মাইল দূরত্ব।
==মেথডবাদ==
'''জন''' এবং '''চার্লস ওয়েসলি''' ১৮শ শতকে মেথডবাদের সূচনা করেন। ''জন ওয়েসলি'' ছিলেন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একজন পুরোহিত। তিনি ও তার ভাই ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডজুড়ে খ্রিস্টানদের ছোট ছোট গোষ্ঠী পরিচালনা করতেন, যাদের ওয়েসলীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এরা পরে মেথডবাদের সমর্থক নামে পরিচিত হয়। এটি শুরুতে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একটি সম্প্রদায়ে হিসেবে ছিল, স্বাধীন মণ্ডলী নয়। কারণ এটি কর্তৃপক্ষের কাঠামোর চেয়ে সাধারণ জনগণের ওপর জোর দিত এবং আবেগপূর্ণ বিশ্বাসকে ধর্মান্তরের প্রমাণ হিসেবে দেখত, এজন্য অনেকে একে সন্দেহের চোখে দেখত। জন ওয়েসলি এক ধর্মোপদেশে প্রশ্ন করেন: "মেথডবাদী কে? " তিনি উত্তর দেন: "মেথডবাদী সে, যার অন্তরে 'ঈশ্বরের প্রেম পবিত্র আত্মার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে'"<ref>"Character of A Methodist" (title assigned by the anthology), extract from a sermon by John Wesley. Kerr, Hugh E., Editor, <u>Readings In Christian Thought.</u> Second Edition. Nashville: Abingdon Press, 1990(1966).</ref>। মেথডিস্টরা বাইবেল অধ্যয়ন ও বিলাসবিহীন জীবনযাপনে গুরুত্ব দিত। নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে তাদের মেথডিস্ট বলা হতো।
==উপনিবেশিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেথডবাদ==
১৭৬০-এর দশকের শেষভাগে মেথডবাদ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জন ওয়েসলি নিযুক্ত প্রচারক '''রিচার্ড বোর্ডম্যান''' ও '''জোসেফ পিলমোর''' ১৭৬৯ সালে নতুন বিশ্বে মেথডবাদী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসেন। পিলমোর ফিলাডেলফিয়ায় ও বোর্ডম্যান নিউ ইয়র্কে কাজ শুরু করেন। পিলমোর ছিলেন অধিক কার্যকর, তিনি দক্ষিণে গিয়েও মেথডবাদ প্রচার করেন। অন্যান্যরাও এলেন—'''রবার্ট উইলিয়ামস''' ও '''জন কিং''' ওয়েসলির অনুমতি ছাড়াই এলেন; '''ফ্রান্সিস আসবুরি''' ও '''রিচার্ড রাইট''' ১৭৭১ সালে আসেন; '''জর্জ শ্যাডফোর্ড''' ও '''টমাস র্যাঙ্কিন''' ১৭৭৩ সালে আসেন।<ref>Norwood, Fredrick A. The Story of American Methodism</ref>
চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সমসাময়িকদের বিপরীতে মেথডবাদীরা গির্জাহীন এলাকায় মাঠে প্রচার করতে প্রস্তুত ছিল। উপরন্তু, এদের বেশিরভাগই সাধারণ ধর্মপ্রচারক ছিলেন যারা দীর্ঘকালীন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা নয় বরং আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পুরোহিত হয়েছিলেন। এভাবে মেথডবাদ মার্কিন বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে।
==মহাজাগরণ==
মহাজাগরণ ছিল আমেরিকায় মূলত চার্চ অফ ইংল্যান্ড থেকে আলাদা থাকা খ্রিস্টান শাখাগুলোর মধ্যে (যেমন বাপ্তিস্মবাদ, মেথডবাদ, ও পিউরিতীয় হতে উৎপন্ন মতবাদ) একটি ধর্মীয় জাগরণের সময়কাল। ইতিহাসবিদরা এটি চারটি ধাপে বিভক্ত দেখেন। প্রথম ধাপটি নিউ ইংল্যান্ডে ১৭৩০-এর দশকে শুরু হয়ে ত্রিশ বছর স্থায়ী ছিল।<ref>Norwood, Frederick A. The Story of American Methodism</ref> এটি ছিল দুটি অংশে বিভক্ত—পুরিতান ও মেথডিস্ট অংশ।
একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন পিউরিতান মন্ত্রী '''জনাথন এডওয়ার্ডস'''। তিনি দেখতেন যে পিলগ্রিমদের বিশ্বাস থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা গঠন বা আচার-অনুষ্ঠানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ডস ছিলেন ইভানজেলিজমপন্থী, তিনি ধর্মান্তরের জন্য প্রচার করতেন। তার কিছু উপদেশ মানুষকে কান্নায় ভাসাতো বা উল্লাসে দাঁড় করিয়ে দিত। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপদেশ "পাপীরা একটি রাগান্বিত ঈশ্বরের হাতের মুঠোয়" যেখানে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (তিনি মাকড়সা নিয়ে রচনা করেছিলেন) এবং অসাধারণ বাচনশক্তি ব্যবহার করে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেন।
জন ওয়েসলি ও তার সহপাঠী '''জর্জ হোয়াইটফিল্ড''' দ্বারা এই জাগরণের মেথডবাদী দিকটি চালিত হয়েছিল। ওয়েসলি ১৭৩৫ সালে জর্জিয়ায় আসেন, যদিও তেমন সাফল্য পাননি। তবে হোয়াইটফিল্ড আমেরিকায় সাতবার আসেন এবং কৃষ্ণ দাসদের মধ্যেও প্রচার করেন, যা তখন অনেকের পক্ষে অচিন্তনীয় ছিল।
==মোরাভীয়==
'''জন''' ও '''চার্লস ওয়েসলির''' সঙ্গে ১৭৩৫ সালে আমেরিকায় আসা মোরাভীয়রা ছিলেন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। তারা মোরাভিয়া ও বোহেমিয়া ত্যাগ করে মার্কিন মুলুকে খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে আসেন। তারা প্রথমে জর্জিয়া, পরে পেনসিলভানিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনায় বসতি গড়েন। মোরাভীয়রা সঙ্গীতপ্রিয় ছিল, তারা প্রতিদিন স্তুতি গান করতেন এবং কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রও রচনা করতেন।
'''জন আন্টেস''' ছিলেন প্রথম আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী মোরাভীত সুরকার। ১৭৪০ সালে পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নিয়ে তিনি অনেক ধর্মীয় সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচনাগুলি গির্জার প্রশিক্ষিত দল বা একক কণ্ঠে পরিবেশিত হতো, সাধারণ গান হিসেবে নয়।
==মেনোনায়ীয়==
'''উইলিয়াম পেন'''-এর আমন্ত্রণে কিছু মেনোনায়ীয় ১৬৮৩ সালে পেনসিলভানিয়ায় আসেন। এই গোষ্ঠী বাইবেলের সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। তারা শিশুদের বাপ্তিস্ম না দিয়ে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের বাপ্তিস্ম দিত, যা সমসাময়িকদের ক্ষুব্ধ করত। তারা কর প্রদান, অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে চরম শান্তিবাদে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ড, প্রুশিয়া, ইউক্রেন, ও রাশিয়া থেকেও মোনানায়ীয়এয়া আমেরিকা ও কানাডায় আসে। তাদের মধ্যে আমিশরা অন্যতম, যারা ধর্মীয় শাস্তি হিসেবে সামাজিকভাবে বর্জন কার্যক্রম ব্যবহার করে।
==ইহুদিধর্ম==
প্রথম অ-খ্রিস্টান গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় আসে '''সেফার্ডীয় ইহুদিরা'''। তারা প্রথমে ব্রাজিলের রেসিফে শহরে বসতি গড়ে, পরে ১৬৫৪ সালে নিউ আমস্টারডামে (বর্তমান নিউ ইয়র্ক সিটি) আসে। যদিও ওলন্দাজদের দেশে ইহুদিদের সম্মান ছিল, নিউ আমস্টারডামের গভর্নর '''পিটার স্টাইভেসান্ট''' তাদের রাখতে চাননি। তিনি ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চিঠিতে লেখেন যে ইহুদিরা এই উপনিবেশকে “সংক্রমিত ও অস্থির” করবে। ইহুদিরা পাল্টা চিঠিতে জানায় তারা ডাচদের সম্মান করে এবং বহু পুরোনো নাগরিক। কোম্পানি সিদ্ধান্ত দেয়, ইহুদিরা থাকতে পারবে যদি তারা নিজের দরিদ্রদের দেখাশোনা করে ও খ্রিস্টানদের দান আশা না করে।
উপনিবেশিক আমলে ইহুদিরা পূর্ব উপকূল ও দক্ষিণের কিছু উপনিবেশে বসতি গড়ে, যেমন সাভান্না, চার্লস্টন, ফিলাডেলফিয়া, ও নিউপোর্ট। আজও টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো উপাসনালয়টি ১৭৬৩ সালে নিউপোর্টের সেফার্রডীয় ইহুদিরা নির্মাণ করে, যা '''তুরো সিনাগগ''' নামে পরিচিত। এটি '''জেশুয়াত ইস্রায়েল''' সম্প্রদায়ের ঘর।
ইহুদিদের জন্য শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা, উপাসনা ও কোশার রান্নার চর্চা কঠিন ছিল। '''রেবেকা স্যামুয়েল''' তার মা-বাবাকে চিঠিতে লেখেন: “এখানে ইহুদিত্ব চাপা পড়ে গেছে। এখানে [পিটার্সবার্গ, ভার্জিনিয়া] দশ-বারোজন ইহুদি আছেন, তারা প্রকৃত ইহুদি নয়... আমি একটি সিনাগগ দেখতে আগ্রহী যেখানে যেতে পারি।” যদিও আরও ইহুদি আসেন, তারা ইংরেজি শিখে সমাজে স্থান করে নেন। কিন্তু শনিবার উপাসনা করা ছিল কষ্টকর যখন সবাই রবিবার গির্জায় যেত। কিছু উপনিবেশে তারা ভোট দিতে, সরকারি পদে থাকতে বা সম্পত্তি কিনতে পারত না। তারা ভিন্ন ছিল এবং ইউরোপের মতো নির্যাতনের আশঙ্কা করত। কিন্তু এখানে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারত। রাতদুপুরে দরজায় কড়াঘাত, যন্ত্রণা, বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ভয় ছিল না।<ref>Judaism- Stone, Amy. Jewish Americans. Milwaukee: World Almanac Library, 2007.</ref>
==ক্যাথলিকবাদ==
ম্যাসাচুসেটস বে উপনিবেশে প্রথম কুড়ি বছরে কোনো ক্যাথলিকের উপস্থিতি ছিল না, তবুও ১৬৪৭ সালের মে মাসে পিউরিতানীয় সরকার একটি কঠোর আইন পাশ করে, যা "যে কোনো যাজক, ধর্মীয় পুরোহিত বা রোমান পোপ কর্তৃক নিয়োজিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি"-কে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেয়। ১৭৩২ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ কর্তৃক জর্জিয়া উপনিবেশ গঠনের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও ক্যাথলিকদের ছাড় দেওয়া হয়নি।<ref>[http://www.traditioninaction.org/History/B_001_Colonies.html Horvat, Marian T. "Let None Dare Call it Liberty: The Catholic Church in Colonial America". Retrieved 09/05/15]</ref> ক্যাথলিকদের জন্য প্রকাশ্যে উপাসনা নিষিদ্ধ ছিল এবং পুরোহিতের মাস বলাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।
ক্যাথলিকবাদ প্রথম আসে ''মেরিল্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট''-এর মাধ্যমে। রাজা প্রথম চার্লস '''সিসিল ক্যালভার্ট (লর্ড বাল্টিমোর)'''-কে উদারভাবে মেরিল্যান্ড উপনিবেশের চার্টার দেন। তিনি একজন ক্যাথলিক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাথলিকদের সহনশীলতা বজায় রাখেন, কিন্তু পরে ভার্জিনিয়া থেকে আগত পিউরিতানীয়রা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। চার বছর পরে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন।
১৬৭২ সালে দ্বিতীয় চার্লসের ভাই ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আইরিশ ক্যাথলিক '''টমাস ডনগান'''-কে নিউ ইয়র্কের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এর ফলে ক্যাথলিকদের জন্য কিছু অধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু ডাচ ও ব্রিটিশরা এতে অখুশি ছিল। ১৬৮৯ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অপসারণ করা হয় এবং প্রোটেস্টান্ট রাজা-রানী উইলিয়াম ও মেরি ক্ষমতায় আসেন। মেরিল্যান্ডে আবার ক্যাথলিক বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ক্যালভার্টদের শাসন শেষ হয়। ১৬৯২ সালে ধর্মীয় সহনশীলতা আইন বাতিল হয় এবং মেরিল্যান্ডের সরকারি ধর্ম হিসেবে করের মাধ্যমে পরিচালিত চার্চ অফ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।<ref>Greely, Andrew M. ''An Ugly Little Secret'' 1928.</ref>
নিউ ইয়র্ক উপনিবেশে রাজা দ্বিতীয় জেমসের অপসারণের আগেই '''জ্যাকব লেইসলার''' নামে একজন ক্যাথলিক বিরোধী নেতা "প্যাপিস্ট" ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়ান এবং মিথ্যা খবর প্রচার করেন। ১৬৮৮ সালের শেষ নাগাদ তিনি ডনগানকে অপসারণ করে নিজেকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ঘোষণা করেন। তিনি সব ক্যাথলিকদের গ্রেপ্তার, ভোটাধিকার বাতিল এবং সরকারি পদ থেকে অপসারণ করেন। যদিও লেইসলার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত হন, তার প্রভাব রয়ে যায়, ক্যাথলিকদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল হয়।<ref>Horvat.</ref>
==ডিইবাদ==
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য ধর্মীয় ধারা ছিল '''ডিইবাদ'''। এটি ইংল্যান্ড থেকে আগত একটি বিশ্বাস, যা মার্কিন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে "প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ প্রারম্ভিক ডিইবাদীরা তাদের বিশ্বাস প্রচার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন [...] কারণ তারা বিশ্বাস করতেন কেবল বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই যুক্তিবাদীভাবে ধর্ম বুঝতে সক্ষম।"<ref>Bedell, George C., Leo Sandon, Jr., Charles T. Wellborn. Religion in America. Second edition. New York: Macmillan, 1982 (1975). P. 231.</ref> ডিইবাদীরা কিছু বিশ্বাস খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিল রাখলেও (যেমন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও যুক্তির ওপর বিশ্বাস) তারা বাইবেলকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করত না। তারা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর কারো সঙ্গে কথা বলেন না; প্রকৃতি একটি ঘড়ির মতো, যা একবার চালু হলে নিজে চলতে থাকে; এবং অলৌকিক বিশ্বাস পাগলামি।
পরিচিত মার্কিন ডিইবাদীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত—'''বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন''' কিছু সময়ের জন্য ছিলেন; অন্যান্যরা ছিলেন '''জেমস ম্যাডিসন''', '''ইথান অ্যালেন''', ও '''থমাস পেইন''' (যার বিখ্যাত রচনা ''দ্য এইজ অফ রিজন'' অলৌকিক বিশ্বাসকে মূর্খতা বলে অভিহিত করে)। '''থমাস জেফারসন''' ডিইজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার স্বাধীনতার ঘোষণায় "ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচার্স গড" শব্দগুচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে।
==পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন==
# এই ব্যক্তিদের প্রত্যেককে তার ধর্মের সাথে সংযুক্ত করুন: জন ওয়েসলি, জোনাথন এডওয়ার্ডস, সিসিল ক্যালভার্ট।
# জার্মান-ভাষী দেশগুলির একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। গ্রেট ব্রিটেনের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন।
==তথ্যসূত্র==
{{reflist}}
{{BookCat}}
{{status|100%}}
{{BookCat}}
p3onlxzv8y64t2in5x79fmbuolpyljp
85510
85509
2025-07-01T14:50:02Z
Mehedi Abedin
7113
85510
wikitext
text/x-wiki
==চার্চ অফ ইংল্যান্ড==
১৭শ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের সরকারি চার্চ নির্বাসনের এক সময়কাল পার করে এসেছিল। রাজা প্রথম চার্লসের সরকারের নীতির বিরোধিতা করে পুরিতান অলিভার ক্রমওয়েল তাঁকে ১৬৪৭ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করেন এবং পার্লামেন্ট থেকে রাজপন্থীদের বিতাড়নের পর রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় এক প্রজন্ম ধরে চার্চে আধ্যাত্মিক নেতার অনুপস্থিতি ছিল। পুনঃস্থাপনের সময় রাজা দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলে চার্চ আবার ধূপ, সঙ্গীত, অলঙ্কারিক পোশাক, এবং দীর্ঘ সেবা সহ প্রার্থনার বই (বুক অফ কমন প্রেয়ার) ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু
তখন এমন এক জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা এই আচারগুলোর বাইরে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কিছু "লো চার্চ" এই অলঙ্কারিকতা বিরোধী মানুষের সেবা করত এবং তারা চাপা পড়ে যাওয়া পিউরিতীয়দের প্রতি সহানুভূতি দেখাত। ধনসম্পদ এবং সাধাসিধে জীবনের এই পারস্পরিক বৈপরীত্য একই ধর্মের মধ্যে অস্বস্তিকর ছিল।
ব্রিটেনের চাপ কমাতে মার্কিন উপনিবেশগুলোকে ব্যবহারের ফলে সেখানে সরকারি ধর্ম খুব কম প্রতিনিধিত্ব পায় যদিও প্রার্থনার বই সেখানে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের "হাই চার্চ" গোষ্ঠীর বিশপ ও কর্তৃত্ব ছিল; কিন্তু আমেরিকায় এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি ভার্জিনিয়ার মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাংলিকান উপনিবেশেও চার্চ পম্প বা কর্তৃত্ব ছাড়াই চলতো। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে ধর্মীয় বন্ধন ছিল দুর্বল, যেন সমুদ্রের অতিরিক্ত একটি মাইল দূরত্ব।
==মেথডবাদ==
'''জন''' এবং '''চার্লস ওয়েসলি''' ১৮শ শতকে মেথডবাদের সূচনা করেন। ''জন ওয়েসলি'' ছিলেন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একজন পুরোহিত। তিনি ও তার ভাই ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডজুড়ে খ্রিস্টানদের ছোট ছোট গোষ্ঠী পরিচালনা করতেন, যাদের ওয়েসলীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এরা পরে মেথডবাদের সমর্থক নামে পরিচিত হয়। এটি শুরুতে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একটি সম্প্রদায়ে হিসেবে ছিল, স্বাধীন মণ্ডলী নয়। কারণ এটি কর্তৃপক্ষের কাঠামোর চেয়ে সাধারণ জনগণের ওপর জোর দিত এবং আবেগপূর্ণ বিশ্বাসকে ধর্মান্তরের প্রমাণ হিসেবে দেখত, এজন্য অনেকে একে সন্দেহের চোখে দেখত। জন ওয়েসলি এক ধর্মোপদেশে প্রশ্ন করেন: "মেথডবাদী কে? " তিনি উত্তর দেন: "মেথডবাদী সে, যার অন্তরে 'ঈশ্বরের প্রেম পবিত্র আত্মার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে'"<ref>"Character of A Methodist" (title assigned by the anthology), extract from a sermon by John Wesley. Kerr, Hugh E., Editor, <u>Readings In Christian Thought.</u> Second Edition. Nashville: Abingdon Press, 1990(1966).</ref>। মেথডিস্টরা বাইবেল অধ্যয়ন ও বিলাসবিহীন জীবনযাপনে গুরুত্ব দিত। নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে তাদের মেথডিস্ট বলা হতো।
==উপনিবেশিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেথডবাদ==
১৭৬০-এর দশকের শেষভাগে মেথডবাদ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জন ওয়েসলি নিযুক্ত প্রচারক '''রিচার্ড বোর্ডম্যান''' ও '''জোসেফ পিলমোর''' ১৭৬৯ সালে নতুন বিশ্বে মেথডবাদী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসেন। পিলমোর ফিলাডেলফিয়ায় ও বোর্ডম্যান নিউ ইয়র্কে কাজ শুরু করেন। পিলমোর ছিলেন অধিক কার্যকর, তিনি দক্ষিণে গিয়েও মেথডবাদ প্রচার করেন। অন্যান্যরাও এলেন—'''রবার্ট উইলিয়ামস''' ও '''জন কিং''' ওয়েসলির অনুমতি ছাড়াই এলেন; '''ফ্রান্সিস আসবুরি''' ও '''রিচার্ড রাইট''' ১৭৭১ সালে আসেন; '''জর্জ শ্যাডফোর্ড''' ও '''টমাস র্যাঙ্কিন''' ১৭৭৩ সালে আসেন।<ref>Norwood, Fredrick A. The Story of American Methodism</ref>
চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সমসাময়িকদের বিপরীতে মেথডবাদীরা গির্জাহীন এলাকায় মাঠে প্রচার করতে প্রস্তুত ছিল। উপরন্তু, এদের বেশিরভাগই সাধারণ ধর্মপ্রচারক ছিলেন যারা দীর্ঘকালীন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা নয় বরং আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পুরোহিত হয়েছিলেন। এভাবে মেথডবাদ মার্কিন বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে।
==মহাজাগরণ==
মহাজাগরণ ছিল আমেরিকায় মূলত চার্চ অফ ইংল্যান্ড থেকে আলাদা থাকা খ্রিস্টান শাখাগুলোর মধ্যে (যেমন বাপ্তিস্মবাদ, মেথডবাদ, ও পিউরিতীয় হতে উৎপন্ন মতবাদ) একটি ধর্মীয় জাগরণের সময়কাল। ইতিহাসবিদরা এটি চারটি ধাপে বিভক্ত দেখেন। প্রথম ধাপটি নিউ ইংল্যান্ডে ১৭৩০-এর দশকে শুরু হয়ে ত্রিশ বছর স্থায়ী ছিল।<ref>Norwood, Frederick A. The Story of American Methodism</ref> এটি ছিল দুটি অংশে বিভক্ত—পুরিতান ও মেথডিস্ট অংশ।
একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন পিউরিতান মন্ত্রী '''জনাথন এডওয়ার্ডস'''। তিনি দেখতেন যে পিলগ্রিমদের বিশ্বাস থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা গঠন বা আচার-অনুষ্ঠানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ডস ছিলেন ইভানজেলিজমপন্থী, তিনি ধর্মান্তরের জন্য প্রচার করতেন। তার কিছু উপদেশ মানুষকে কান্নায় ভাসাতো বা উল্লাসে দাঁড় করিয়ে দিত। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপদেশ "পাপীরা একটি রাগান্বিত ঈশ্বরের হাতের মুঠোয়" যেখানে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (তিনি মাকড়সা নিয়ে রচনা করেছিলেন) এবং অসাধারণ বাচনশক্তি ব্যবহার করে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেন।
জন ওয়েসলি ও তার সহপাঠী '''জর্জ হোয়াইটফিল্ড''' দ্বারা এই জাগরণের মেথডবাদী দিকটি চালিত হয়েছিল। ওয়েসলি ১৭৩৫ সালে জর্জিয়ায় আসেন, যদিও তেমন সাফল্য পাননি। তবে হোয়াইটফিল্ড আমেরিকায় সাতবার আসেন এবং কৃষ্ণ দাসদের মধ্যেও প্রচার করেন, যা তখন অনেকের পক্ষে অচিন্তনীয় ছিল।
==মোরাভীয়==
'''জন''' ও '''চার্লস ওয়েসলির''' সঙ্গে ১৭৩৫ সালে আমেরিকায় আসা মোরাভীয়রা ছিলেন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। তারা মোরাভিয়া ও বোহেমিয়া ত্যাগ করে মার্কিন মুলুকে খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে আসেন। তারা প্রথমে জর্জিয়া, পরে পেনসিলভানিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনায় বসতি গড়েন। মোরাভীয়রা সঙ্গীতপ্রিয় ছিল, তারা প্রতিদিন স্তুতি গান করতেন এবং কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রও রচনা করতেন।
'''জন আন্টেস''' ছিলেন প্রথম আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী মোরাভীত সুরকার। ১৭৪০ সালে পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নিয়ে তিনি অনেক ধর্মীয় সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচনাগুলি গির্জার প্রশিক্ষিত দল বা একক কণ্ঠে পরিবেশিত হতো, সাধারণ গান হিসেবে নয়।
==মেনোনায়ীয়==
'''উইলিয়াম পেন'''-এর আমন্ত্রণে কিছু মেনোনায়ীয় ১৬৮৩ সালে পেনসিলভানিয়ায় আসেন। এই গোষ্ঠী বাইবেলের সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। তারা শিশুদের বাপ্তিস্ম না দিয়ে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের বাপ্তিস্ম দিত, যা সমসাময়িকদের ক্ষুব্ধ করত। তারা কর প্রদান, অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে চরম শান্তিবাদে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ড, প্রুশিয়া, ইউক্রেন, ও রাশিয়া থেকেও মোনানায়ীয়এয়া আমেরিকা ও কানাডায় আসে। তাদের মধ্যে আমিশরা অন্যতম, যারা ধর্মীয় শাস্তি হিসেবে সামাজিকভাবে বর্জন কার্যক্রম ব্যবহার করে।
==ইহুদিধর্ম==
প্রথম অ-খ্রিস্টান গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় আসে '''সেফার্ডীয় ইহুদিরা'''। তারা প্রথমে ব্রাজিলের রেসিফে শহরে বসতি গড়ে, পরে ১৬৫৪ সালে নিউ আমস্টারডামে (বর্তমান নিউ ইয়র্ক সিটি) আসে। যদিও ওলন্দাজদের দেশে ইহুদিদের সম্মান ছিল, নিউ আমস্টারডামের গভর্নর '''পিটার স্টাইভেসান্ট''' তাদের রাখতে চাননি। তিনি ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চিঠিতে লেখেন যে ইহুদিরা এই উপনিবেশকে “সংক্রমিত ও অস্থির” করবে। ইহুদিরা পাল্টা চিঠিতে জানায় তারা ডাচদের সম্মান করে এবং বহু পুরোনো নাগরিক। কোম্পানি সিদ্ধান্ত দেয়, ইহুদিরা থাকতে পারবে যদি তারা নিজের দরিদ্রদের দেখাশোনা করে ও খ্রিস্টানদের দান আশা না করে।
উপনিবেশিক আমলে ইহুদিরা পূর্ব উপকূল ও দক্ষিণের কিছু উপনিবেশে বসতি গড়ে, যেমন সাভান্না, চার্লস্টন, ফিলাডেলফিয়া, ও নিউপোর্ট। আজও টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো উপাসনালয়টি ১৭৬৩ সালে নিউপোর্টের সেফার্রডীয় ইহুদিরা নির্মাণ করে, যা '''তুরো সিনাগগ''' নামে পরিচিত। এটি '''জেশুয়াত ইস্রায়েল''' সম্প্রদায়ের ঘর।
ইহুদিদের জন্য শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা, উপাসনা ও কোশার রান্নার চর্চা কঠিন ছিল। '''রেবেকা স্যামুয়েল''' তার মা-বাবাকে চিঠিতে লেখেন: “এখানে ইহুদিত্ব চাপা পড়ে গেছে। এখানে [পিটার্সবার্গ, ভার্জিনিয়া] দশ-বারোজন ইহুদি আছেন, তারা প্রকৃত ইহুদি নয়... আমি একটি সিনাগগ দেখতে আগ্রহী যেখানে যেতে পারি।” যদিও আরও ইহুদি আসেন, তারা ইংরেজি শিখে সমাজে স্থান করে নেন। কিন্তু শনিবার উপাসনা করা ছিল কষ্টকর যখন সবাই রবিবার গির্জায় যেত। কিছু উপনিবেশে তারা ভোট দিতে, সরকারি পদে থাকতে বা সম্পত্তি কিনতে পারত না। তারা ভিন্ন ছিল এবং ইউরোপের মতো নির্যাতনের আশঙ্কা করত। কিন্তু এখানে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারত। রাতদুপুরে দরজায় কড়াঘাত, যন্ত্রণা, বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ভয় ছিল না।<ref>Judaism- Stone, Amy. Jewish Americans. Milwaukee: World Almanac Library, 2007.</ref>
==ক্যাথলিকবাদ==
ম্যাসাচুসেটস বে উপনিবেশে প্রথম কুড়ি বছরে কোনো ক্যাথলিকের উপস্থিতি ছিল না, তবুও ১৬৪৭ সালের মে মাসে পিউরিতানীয় সরকার একটি কঠোর আইন পাশ করে, যা "যে কোনো যাজক, ধর্মীয় পুরোহিত বা রোমান পোপ কর্তৃক নিয়োজিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি"-কে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেয়। ১৭৩২ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ কর্তৃক জর্জিয়া উপনিবেশ গঠনের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও ক্যাথলিকদের ছাড় দেওয়া হয়নি।<ref>[http://www.traditioninaction.org/History/B_001_Colonies.html Horvat, Marian T. "Let None Dare Call it Liberty: The Catholic Church in Colonial America". Retrieved 09/05/15]</ref> ক্যাথলিকদের জন্য প্রকাশ্যে উপাসনা নিষিদ্ধ ছিল এবং পুরোহিতের মাস বলাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।
ক্যাথলিকবাদ প্রথম আসে ''মেরিল্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট''-এর মাধ্যমে। রাজা প্রথম চার্লস '''সিসিল ক্যালভার্ট (লর্ড বাল্টিমোর)'''-কে উদারভাবে মেরিল্যান্ড উপনিবেশের চার্টার দেন। তিনি একজন ক্যাথলিক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাথলিকদের সহনশীলতা বজায় রাখেন, কিন্তু পরে ভার্জিনিয়া থেকে আগত পিউরিতানীয়রা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। চার বছর পরে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন।
১৬৭২ সালে দ্বিতীয় চার্লসের ভাই ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আইরিশ ক্যাথলিক '''টমাস ডনগান'''-কে নিউ ইয়র্কের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এর ফলে ক্যাথলিকদের জন্য কিছু অধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু ডাচ ও ব্রিটিশরা এতে অখুশি ছিল। ১৬৮৯ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অপসারণ করা হয় এবং প্রোটেস্টান্ট রাজা-রানী উইলিয়াম ও মেরি ক্ষমতায় আসেন। মেরিল্যান্ডে আবার ক্যাথলিক বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ক্যালভার্টদের শাসন শেষ হয়। ১৬৯২ সালে ধর্মীয় সহনশীলতা আইন বাতিল হয় এবং মেরিল্যান্ডের সরকারি ধর্ম হিসেবে করের মাধ্যমে পরিচালিত চার্চ অফ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।<ref>Greely, Andrew M. ''An Ugly Little Secret'' 1928.</ref>
নিউ ইয়র্ক উপনিবেশে রাজা দ্বিতীয় জেমসের অপসারণের আগেই '''জ্যাকব লেইসলার''' নামে একজন ক্যাথলিক বিরোধী নেতা "প্যাপিস্ট" ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়ান এবং মিথ্যা খবর প্রচার করেন। ১৬৮৮ সালের শেষ নাগাদ তিনি ডনগানকে অপসারণ করে নিজেকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ঘোষণা করেন। তিনি সব ক্যাথলিকদের গ্রেপ্তার, ভোটাধিকার বাতিল এবং সরকারি পদ থেকে অপসারণ করেন। যদিও লেইসলার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত হন, তার প্রভাব রয়ে যায়, ক্যাথলিকদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল হয়।<ref>Horvat.</ref>
==ডিইবাদ==
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য ধর্মীয় ধারা ছিল '''ডিইবাদ'''। এটি ইংল্যান্ড থেকে আগত একটি বিশ্বাস, যা মার্কিন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে "প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ প্রারম্ভিক ডিইবাদীরা তাদের বিশ্বাস প্রচার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন [...] কারণ তারা বিশ্বাস করতেন কেবল বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই যুক্তিবাদীভাবে ধর্ম বুঝতে সক্ষম।"<ref>Bedell, George C., Leo Sandon, Jr., Charles T. Wellborn. Religion in America. Second edition. New York: Macmillan, 1982 (1975). P. 231.</ref> ডিইবাদীরা কিছু বিশ্বাস খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিল রাখলেও (যেমন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও যুক্তির ওপর বিশ্বাস) তারা বাইবেলকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করত না। তারা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর কারো সঙ্গে কথা বলেন না; প্রকৃতি একটি ঘড়ির মতো, যা একবার চালু হলে নিজে চলতে থাকে; এবং অলৌকিক বিশ্বাস পাগলামি।
পরিচিত মার্কিন ডিইবাদীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত—'''বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন''' কিছু সময়ের জন্য ছিলেন; অন্যান্যরা ছিলেন '''জেমস ম্যাডিসন''', '''ইথান অ্যালেন''', ও '''থমাস পেইন''' (যার বিখ্যাত রচনা ''দ্য এইজ অফ রিজন'' অলৌকিক বিশ্বাসকে মূর্খতা বলে অভিহিত করে)। '''থমাস জেফারসন''' ডিইজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার স্বাধীনতার ঘোষণায় "ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচার্স গড" শব্দগুচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে।
==পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন==
# এই ব্যক্তিদের প্রত্যেককে তার ধর্মের সাথে সংযুক্ত করুন: জন ওয়েসলি, জোনাথন এডওয়ার্ডস, সিসিল ক্যালভার্ট।
# জার্মান-ভাষী দেশগুলির একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। গ্রেট ব্রিটেনের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন।
==তথ্যসূত্র==
{{reflist}}
{{BookCat}}
{{status|100%}}
{{BookCat}}
cw6mjbtrbygwkbgxldgzgdx7wbk7467
85511
85510
2025-07-01T14:51:00Z
Mehedi Abedin
7113
85511
wikitext
text/x-wiki
==চার্চ অফ ইংল্যান্ড==
১৭শ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের সরকারি চার্চ নির্বাসনের এক সময়কাল পার করে এসেছিল। রাজা প্রথম চার্লসের সরকারের নীতির বিরোধিতা করে পুরিতান অলিভার ক্রমওয়েল তাঁকে ১৬৪৭ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করেন এবং পার্লামেন্ট থেকে রাজপন্থীদের বিতাড়নের পর রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় এক প্রজন্ম ধরে চার্চে আধ্যাত্মিক নেতার অনুপস্থিতি ছিল। পুনঃস্থাপনের সময় রাজা দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলে চার্চ আবার ধূপ, সঙ্গীত, অলঙ্কারিক পোশাক, এবং দীর্ঘ সেবা সহ প্রার্থনার বই (বুক অফ কমন প্রেয়ার) ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু
তখন এমন এক জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা এই আচারগুলোর বাইরে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কিছু "লো চার্চ" এই অলঙ্কারিকতা বিরোধী মানুষের সেবা করত এবং তারা চাপা পড়ে যাওয়া পিউরিতীয়দের প্রতি সহানুভূতি দেখাত। ধনসম্পদ এবং সাধাসিধে জীবনের এই পারস্পরিক বৈপরীত্য একই ধর্মের মধ্যে অস্বস্তিকর ছিল।
ব্রিটেনের চাপ কমাতে মার্কিন উপনিবেশগুলোকে ব্যবহারের ফলে সেখানে সরকারি ধর্ম খুব কম প্রতিনিধিত্ব পায় যদিও প্রার্থনার বই সেখানে ছিল। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের "হাই চার্চ" গোষ্ঠীর বিশপ ও কর্তৃত্ব ছিল; কিন্তু আমেরিকায় এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি ভার্জিনিয়ার মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাংলিকান উপনিবেশেও চার্চ পম্প বা কর্তৃত্ব ছাড়াই চলতো। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে ধর্মীয় বন্ধন ছিল দুর্বল, যেন সমুদ্রের অতিরিক্ত একটি মাইল দূরত্ব।
==মেথডবাদ==
'''জন''' এবং '''চার্লস ওয়েসলি''' ১৮শ শতকে মেথডবাদের সূচনা করেন। ''জন ওয়েসলি'' ছিলেন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একজন পুরোহিত। তিনি ও তার ভাই ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডজুড়ে খ্রিস্টানদের ছোট ছোট গোষ্ঠী পরিচালনা করতেন, যাদের ওয়েসলীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এরা পরে মেথডবাদের সমর্থক নামে পরিচিত হয়। এটি শুরুতে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একটি সম্প্রদায়ে হিসেবে ছিল, স্বাধীন মণ্ডলী নয়। কারণ এটি কর্তৃপক্ষের কাঠামোর চেয়ে সাধারণ জনগণের ওপর জোর দিত এবং আবেগপূর্ণ বিশ্বাসকে ধর্মান্তরের প্রমাণ হিসেবে দেখত, এজন্য অনেকে একে সন্দেহের চোখে দেখত। জন ওয়েসলি এক ধর্মোপদেশে প্রশ্ন করেন: "মেথডবাদী কে? " তিনি উত্তর দেন: "মেথডবাদী সে, যার অন্তরে 'ঈশ্বরের প্রেম পবিত্র আত্মার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে'"<ref>"Character of A Methodist" (title assigned by the anthology), extract from a sermon by John Wesley. Kerr, Hugh E., Editor, <u>Readings In Christian Thought.</u> Second Edition. Nashville: Abingdon Press, 1990(1966).</ref>। মেথডিস্টরা বাইবেল অধ্যয়ন ও বিলাসবিহীন জীবনযাপনে গুরুত্ব দিত। নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে তাদের মেথডিস্ট বলা হতো।
==উপনিবেশিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেথডবাদ==
১৭৬০-এর দশকের শেষভাগে মেথডবাদ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জন ওয়েসলি নিযুক্ত প্রচারক '''রিচার্ড বোর্ডম্যান''' ও '''জোসেফ পিলমোর''' ১৭৬৯ সালে নতুন বিশ্বে মেথডবাদী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসেন। পিলমোর ফিলাডেলফিয়ায় ও বোর্ডম্যান নিউ ইয়র্কে কাজ শুরু করেন। পিলমোর ছিলেন অধিক কার্যকর, তিনি দক্ষিণে গিয়েও মেথডবাদ প্রচার করেন। অন্যান্যরাও এলেন—'''রবার্ট উইলিয়ামস''' ও '''জন কিং''' ওয়েসলির অনুমতি ছাড়াই এলেন; '''ফ্রান্সিস আসবুরি''' ও '''রিচার্ড রাইট''' ১৭৭১ সালে আসেন; '''জর্জ শ্যাডফোর্ড''' ও '''টমাস র্যাঙ্কিন''' ১৭৭৩ সালে আসেন।<ref>Norwood, Fredrick A. The Story of American Methodism</ref>
চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সমসাময়িকদের বিপরীতে মেথডবাদীরা গির্জাহীন এলাকায় মাঠে প্রচার করতে প্রস্তুত ছিল। উপরন্তু, এদের বেশিরভাগই সাধারণ ধর্মপ্রচারক ছিলেন যারা দীর্ঘকালীন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা নয় বরং আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পুরোহিত হয়েছিলেন। এভাবে মেথডবাদ মার্কিন বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে।
==মহাজাগরণ==
মহাজাগরণ ছিল আমেরিকায় মূলত চার্চ অফ ইংল্যান্ড থেকে আলাদা থাকা খ্রিস্টান শাখাগুলোর মধ্যে (যেমন বাপ্তিস্মবাদ, মেথডবাদ, ও পিউরিতীয় হতে উৎপন্ন মতবাদ) একটি ধর্মীয় জাগরণের সময়কাল। ইতিহাসবিদরা এটি চারটি ধাপে বিভক্ত দেখেন। প্রথম ধাপটি নিউ ইংল্যান্ডে ১৭৩০-এর দশকে শুরু হয়ে ত্রিশ বছর স্থায়ী ছিল।<ref>Norwood, Frederick A. The Story of American Methodism</ref> এটি ছিল দুটি অংশে বিভক্ত—পুরিতান ও মেথডিস্ট অংশ।
একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন পিউরিতান মন্ত্রী '''জনাথন এডওয়ার্ডস'''। তিনি দেখতেন যে পিলগ্রিমদের বিশ্বাস থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা গঠন বা আচার-অনুষ্ঠানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ডস ছিলেন ইভানজেলিজমপন্থী, তিনি ধর্মান্তরের জন্য প্রচার করতেন। তার কিছু উপদেশ মানুষকে কান্নায় ভাসাতো বা উল্লাসে দাঁড় করিয়ে দিত। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপদেশ "পাপীরা একটি রাগান্বিত ঈশ্বরের হাতের মুঠোয়" যেখানে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (তিনি মাকড়সা নিয়ে রচনা করেছিলেন) এবং অসাধারণ বাচনশক্তি ব্যবহার করে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেন।
জন ওয়েসলি ও তার সহপাঠী '''জর্জ হোয়াইটফিল্ড''' দ্বারা এই জাগরণের মেথডবাদী দিকটি চালিত হয়েছিল। ওয়েসলি ১৭৩৫ সালে জর্জিয়ায় আসেন, যদিও তেমন সাফল্য পাননি। তবে হোয়াইটফিল্ড আমেরিকায় সাতবার আসেন এবং কৃষ্ণ দাসদের মধ্যেও প্রচার করেন, যা তখন অনেকের পক্ষে অচিন্তনীয় ছিল।
==মোরাভীয়==
'''জন''' ও '''চার্লস ওয়েসলির''' সঙ্গে ১৭৩৫ সালে আমেরিকায় আসা মোরাভীয়রা ছিলেন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। তারা মোরাভিয়া ও বোহেমিয়া ত্যাগ করে মার্কিন মুলুকে খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে আসেন। তারা প্রথমে জর্জিয়া, পরে পেনসিলভানিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনায় বসতি গড়েন। মোরাভীয়রা সঙ্গীতপ্রিয় ছিল, তারা প্রতিদিন স্তুতি গান করতেন এবং কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রও রচনা করতেন।
'''জন আন্টেস''' ছিলেন প্রথম আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী মোরাভীত সুরকার। ১৭৪০ সালে পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নিয়ে তিনি অনেক ধর্মীয় সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচনাগুলি গির্জার প্রশিক্ষিত দল বা একক কণ্ঠে পরিবেশিত হতো, সাধারণ গান হিসেবে নয়।
==মেনোনায়ীয়==
'''উইলিয়াম পেন'''-এর আমন্ত্রণে কিছু মেনোনায়ীয় ১৬৮৩ সালে পেনসিলভানিয়ায় আসেন। এই গোষ্ঠী বাইবেলের সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। তারা শিশুদের বাপ্তিস্ম না দিয়ে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের বাপ্তিস্ম দিত, যা সমসাময়িকদের ক্ষুব্ধ করত। তারা কর প্রদান, অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে চরম শান্তিবাদে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ড, প্রুশিয়া, ইউক্রেন, ও রাশিয়া থেকেও মোনানায়ীয়এয়া আমেরিকা ও কানাডায় আসে। তাদের মধ্যে আমিশরা অন্যতম, যারা ধর্মীয় শাস্তি হিসেবে সামাজিকভাবে বর্জন কার্যক্রম ব্যবহার করে।
==ইহুদিধর্ম==
প্রথম অ-খ্রিস্টান গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় আসে '''সেফার্ডীয় ইহুদিরা'''। তারা প্রথমে ব্রাজিলের রেসিফে শহরে বসতি গড়ে, পরে ১৬৫৪ সালে নিউ আমস্টারডামে (বর্তমান নিউ ইয়র্ক সিটি) আসে। যদিও ওলন্দাজদের দেশে ইহুদিদের সম্মান ছিল, নিউ আমস্টারডামের গভর্নর '''পিটার স্টাইভেসান্ট''' তাদের রাখতে চাননি। তিনি ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চিঠিতে লেখেন যে ইহুদিরা এই উপনিবেশকে “সংক্রমিত ও অস্থির” করবে। ইহুদিরা পাল্টা চিঠিতে জানায় তারা ডাচদের সম্মান করে এবং বহু পুরোনো নাগরিক। কোম্পানি সিদ্ধান্ত দেয়, ইহুদিরা থাকতে পারবে যদি তারা নিজের দরিদ্রদের দেখাশোনা করে ও খ্রিস্টানদের দান আশা না করে।
উপনিবেশিক আমলে ইহুদিরা পূর্ব উপকূল ও দক্ষিণের কিছু উপনিবেশে বসতি গড়ে, যেমন সাভান্না, চার্লস্টন, ফিলাডেলফিয়া, ও নিউপোর্ট। আজও টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো উপাসনালয়টি ১৭৬৩ সালে নিউপোর্টের সেফার্রডীয় ইহুদিরা নির্মাণ করে, যা '''তুরো সিনাগগ''' নামে পরিচিত। এটি '''জেশুয়াত ইস্রায়েল''' সম্প্রদায়ের ঘর।
ইহুদিদের জন্য শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা, উপাসনা ও কোশার রান্নার চর্চা কঠিন ছিল। '''রেবেকা স্যামুয়েল''' তার মা-বাবাকে চিঠিতে লেখেন: “এখানে ইহুদিত্ব চাপা পড়ে গেছে। এখানে [পিটার্সবার্গ, ভার্জিনিয়া] দশ-বারোজন ইহুদি আছেন, তারা প্রকৃত ইহুদি নয়... আমি একটি সিনাগগ দেখতে আগ্রহী যেখানে যেতে পারি।” যদিও আরও ইহুদি আসেন, তারা ইংরেজি শিখে সমাজে স্থান করে নেন। কিন্তু শনিবার উপাসনা করা ছিল কষ্টকর যখন সবাই রবিবার গির্জায় যেত। কিছু উপনিবেশে তারা ভোট দিতে, সরকারি পদে থাকতে বা সম্পত্তি কিনতে পারত না। তারা ভিন্ন ছিল এবং ইউরোপের মতো নির্যাতনের আশঙ্কা করত। কিন্তু এখানে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারত। রাতদুপুরে দরজায় কড়াঘাত, যন্ত্রণা, বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ভয় ছিল না।<ref>Judaism- Stone, Amy. Jewish Americans. Milwaukee: World Almanac Library, 2007.</ref>
==ক্যাথলিকবাদ==
ম্যাসাচুসেটস বে উপনিবেশে প্রথম কুড়ি বছরে কোনো ক্যাথলিকের উপস্থিতি ছিল না, তবুও ১৬৪৭ সালের মে মাসে পিউরিতানীয় সরকার একটি কঠোর আইন পাশ করে, যা "যে কোনো যাজক, ধর্মীয় পুরোহিত বা রোমান পোপ কর্তৃক নিয়োজিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি"কে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেয়। ১৭৩২ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ কর্তৃক জর্জিয়া উপনিবেশ গঠনের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও ক্যাথলিকদের ছাড় দেওয়া হয়নি।<ref>[http://www.traditioninaction.org/History/B_001_Colonies.html Horvat, Marian T. "Let None Dare Call it Liberty: The Catholic Church in Colonial America". Retrieved 09/05/15]</ref> ক্যাথলিকদের জন্য প্রকাশ্যে উপাসনা নিষিদ্ধ ছিল এবং পুরোহিতের মাস বলাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।
ক্যাথলিকবাদ প্রথম আসে ''মেরিল্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট''-এর মাধ্যমে। রাজা প্রথম চার্লস '''সিসিল ক্যালভার্ট (লর্ড বাল্টিমোর)'''কে উদারভাবে মেরিল্যান্ড উপনিবেশের চার্টার দেন। তিনি একজন ক্যাথলিক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাথলিকদের সহনশীলতা বজায় রাখেন, কিন্তু পরে ভার্জিনিয়া থেকে আগত পিউরিতানীয়রা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। চার বছর পরে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন।
১৬৭২ সালে দ্বিতীয় চার্লসের ভাই ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আইরিশ ক্যাথলিক '''টমাস ডনগান'''কে নিউ ইয়র্কের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এর ফলে ক্যাথলিকদের জন্য কিছু অধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু ডাচ ও ব্রিটিশরা এতে অখুশি ছিল। ১৬৮৯ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অপসারণ করা হয় এবং প্রোটেস্টান্ট রাজা-রানী উইলিয়াম ও মেরি ক্ষমতায় আসেন। মেরিল্যান্ডে আবার ক্যাথলিক বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ক্যালভার্টদের শাসন শেষ হয়। ১৬৯২ সালে ধর্মীয় সহনশীলতা আইন বাতিল হয় এবং মেরিল্যান্ডের সরকারি ধর্ম হিসেবে করের মাধ্যমে পরিচালিত চার্চ অফ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।<ref>Greely, Andrew M. ''An Ugly Little Secret'' 1928.</ref>
নিউ ইয়র্ক উপনিবেশে রাজা দ্বিতীয় জেমসের অপসারণের আগেই '''জ্যাকব লেইসলার''' নামে একজন ক্যাথলিক বিরোধী নেতা "প্যাপিস্ট" ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়ান এবং মিথ্যা খবর প্রচার করেন। ১৬৮৮ সালের শেষ নাগাদ তিনি ডনগানকে অপসারণ করে নিজেকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ঘোষণা করেন। তিনি সব ক্যাথলিকদের গ্রেপ্তার, ভোটাধিকার বাতিল এবং সরকারি পদ থেকে অপসারণ করেন। যদিও লেইসলার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত হন, তার প্রভাব রয়ে যায়, ক্যাথলিকদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল হয়।<ref>Horvat.</ref>
==ডিইবাদ==
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য ধর্মীয় ধারা ছিল '''ডিইবাদ'''। এটি ইংল্যান্ড থেকে আগত একটি বিশ্বাস, যা মার্কিন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে "প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ প্রারম্ভিক ডিইবাদীরা তাদের বিশ্বাস প্রচার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন [...] কারণ তারা বিশ্বাস করতেন কেবল বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই যুক্তিবাদীভাবে ধর্ম বুঝতে সক্ষম।"<ref>Bedell, George C., Leo Sandon, Jr., Charles T. Wellborn. Religion in America. Second edition. New York: Macmillan, 1982 (1975). P. 231.</ref> ডিইবাদীরা কিছু বিশ্বাস খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিল রাখলেও (যেমন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও যুক্তির ওপর বিশ্বাস) তারা বাইবেলকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করত না। তারা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর কারো সঙ্গে কথা বলেন না; প্রকৃতি একটি ঘড়ির মতো, যা একবার চালু হলে নিজে চলতে থাকে; এবং অলৌকিক বিশ্বাস পাগলামি।
পরিচিত মার্কিন ডিইবাদীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত—'''বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন''' কিছু সময়ের জন্য ছিলেন; অন্যান্যরা ছিলেন '''জেমস ম্যাডিসন''', '''ইথান অ্যালেন''', ও '''থমাস পেইন''' (যার বিখ্যাত রচনা ''দ্য এইজ অফ রিজন'' অলৌকিক বিশ্বাসকে মূর্খতা বলে অভিহিত করে)। '''থমাস জেফারসন''' ডিইজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার স্বাধীনতার ঘোষণায় "ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচার্স গড" শব্দগুচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে।
==পর্যালোচনার জন্য প্রশ্ন==
# এই ব্যক্তিদের প্রত্যেককে তার ধর্মের সাথে সংযুক্ত করুন: জন ওয়েসলি, জোনাথন এডওয়ার্ডস, সিসিল ক্যালভার্ট।
# জার্মান-ভাষী দেশগুলির একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। গ্রেট ব্রিটেনের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন। আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের একটি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মের নাম বলুন।
==তথ্যসূত্র==
{{reflist}}
{{BookCat}}
{{status|100%}}
{{BookCat}}
i8fqa83iqhsmlo5tq6jgpp2hixv5vxg
কানাডায় শরনার্থী প্রক্রিয়া/এই লেখার সম্পর্কে
0
25692
85503
80104
2025-07-01T14:17:50Z
Mehedi Abedin
7113
85503
wikitext
text/x-wiki
কানাডীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় প্রেক্ষাপটে অভিবাসন আইন (বিশেষত উদ্বাস্তু আইন) সম্পর্কিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। এসব বইতে সাধারণত এমন বিষয়সমূহ আলোচনা করা হয়, যেমন: 'নির্যাতনের ভীতির যৌক্তিক ভিত্তি কী' এবং 'কোন পরিস্থিতিতে একজন দাবিকৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অধিকার থাকে'। এই বইটি সে রকম নয়। বরং, এটি কানাডায় উদ্বাস্তু মর্যাদা দাবি করার আইনি প্রক্রিয়া, বিশেষত কানাডার অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বোর্ডের অধীনস্থ '''উদ্বাস্তু সুরক্ষা বিভাগীয় বিধিমালা'' নিয়ে একটি গ্রন্থ। প্রতি বছর কানাডায় হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু সুরক্ষার জন্য আবেদন করে। তাদের যাত্রাপথটি এ বইয়ে বর্ণিত আইনসমূহ দ্বারা পরিচালিত হয়। এই গ্রন্থে আলোচিত প্রক্রিয়াগত অধিকারসমূহ 'আইনের শাসন' নীতিকে কানাডার আশ্রয় ব্যবস্থায় কার্যকর করার একটি মৌলিক উপাদান: এই অধিকারসমূহ দাবি পর্যালোচনার প্রক্রিয়াকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলে এবং সেইসাথে কানাডার জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার বৈধতাও নিশ্চিত করে।<ref>Van Wolleghem, P. G., & Sicakkan, H. G. (2024). Recognizing international protection. How institutional arrangements affect asylum decisions. ''Journal of Ethnic and Migration Studies'', ''51''(1), 50–78. https://doi.org/10.1080/1369183X.2024.2429665, page 75.</ref>
=== এই গ্রন্থের পরিসরের সীমাবদ্ধতা ===
উদ্বাস্তু আইনকে অনেক সময় প্রশাসনিক আইন, মানবাধিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, (কখনও কখনও) ফৌজদারি আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন ইত্যাদির একত্রিত রূপ হিসেবে ধরা হয়,<ref>Jenny Poon, ''A Legal Pluralist Approach to Migration Control: Norm Compliance in a Globalized World'', 34 Emory Int'l L. Rev. Recent Dev. 2037 (2020). Available at: https://scholarlycommons.law.emory.edu/eilr-recent-developments/4 at page 2039.</ref> এবং এই গ্রন্থে এই উপাদানগুলোর সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, এই গ্রন্থটি কানাডার উদ্বাস্তু আইনি প্রক্রিয়ার একটি সর্বাঙ্গীণ বিবরণ নয়, আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার তো নয়ই। এখানে তিনটি মুখ্য সীমাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্য:
# প্রথমত, জেমস হ্যাথাওয়ে উল্লেখ করেছেন যে উদ্বাস্তু আইনের দুটি মূল বিষয় হলো—উদ্বাস্তু মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা এবং সেই মর্যাদা লাভের পর প্রাপ্ত অধিকারসমূহ। তিনি বলেন, এ দুটির মধ্যে প্রথমটি অধিক মনোযোগ পেয়েছে এবং এই গ্রন্থও সেই ধারা অনুসরণ করে মূলত উদ্বাস্তু মর্যাদার আবেদন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে, এমন না যে এটি মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্লেষণ করে।<ref>James C. Hathaway, ''The Rights of Refugees under International Law,'' April 2021, ISBN: 9781108810913, <https://assets.cambridge.org/97811084/95899/excerpt/9781108495899_excerpt.pdf> (Accessed March 6, 2021), at page 1.</ref>
# দ্বিতীয়ত, উদ্বাস্তু মর্যাদা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ার আলোচনায়ও এই গ্রন্থ কেবল কানাডার অভ্যন্তরীণ আশ্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ও বিদেশে পুনর্বাসন ব্যবস্থার আলোচনাকে এড়িয়ে চলে। এর একটি কারণ হলো সেই পুনর্বাসন সিদ্ধান্তের প্রকৃতি। কানাডা সরকার উল্লেখ করেছে, পুনর্বাসন একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচালিত হয় এবং "ফলে পুনর্বাসন সিদ্ধান্তগুলো আশ্রয় নির্ধারণের মতো আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে না।"<ref>High Commissioner's Forum, ''Resettlement and Convention Plus Initiatives,'' discussion paper, Doc FORUM/2003/02 (18 June 2003), para. 13. </ref> এই ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়সাধ্য এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক।
# তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ আশ্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যেও এই গ্রন্থ ফেডারেল আদালতে বিচারিক পর্যালোচনার নিয়ম, অভিবাসন বিভাগের অধিকারযোগ্যতা নির্ধারণের বিধি, অথবা প্রত্যাবাসনের পূর্ববর্তী ঝুঁকি মূল্যায়ন (পিআরআরএ) প্রক্রিয়া—এসবের আলোচনা করে না। এমনকি কোনো দাবি অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বোর্ডে প্রেরণের আইন ও প্রক্রিয়াও এখানে আলোচনা হয়নি।
=== এই গ্রন্থের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিষয়বস্তু ===
এখন যেহেতু আলোচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থে কী নেই, এবার দেখা যাক এতে কী আছে এবং কীভাবে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গ্রন্থের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো উদ্বাস্তু সুরক্ষা বিভাগীয় বিধিমালার ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণ। এই ব্যাখ্যা তিনটি মাত্রায় কাজ করে: ''লেক্স লাটা (বর্তমান আইন)'', ''লেক্স'' ''হিস্টোরিকা'' (''আইনের ইতিহাস)'', এবং ''লেক্স'' ''ফেরেন্ডা'' ''(আদর্শ আইন)''।
==== ''লেক্স লাটা'' ====
আইন যেমন বর্তমানে আছে, এই গ্রন্থ তার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে চায় এবং এক ধরনের ইতিবাচক আইনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবদান রাখতে চায়। ধর্ম যেমন একটি বৃহত্তর সামাজিক কাঠামো হিসেবে সমাজে শৃঙ্খলা আনে, আইনও তাই করে।<ref>Rosen, L (1989), The Anthropology of Justice: Law as Culture in Islamic Society, Cambridge: University Press, page 17. </ref> জেরেমি বেন্থাম বলেছেন, “যে জাতির আইনের অবস্থা অনিশ্চিত বা অজানা, তাদের দাসত্বই নির্ধারিত।”<ref>Mindus, P. (2020). Towards a Theory of Arbitrary Law-making in Migration Policy. ''Etikk I Praksis - Nordic Journal of Applied Ethics'', ''14''(2), 9-33. <nowiki>https://doi.org/10.5324.eip.v14i2.3712</nowiki></ref> এই অনিশ্চয়তা দূর করতে এই গ্রন্থ দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছে: ১) পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে নিয়ম নির্ধারণ এবং ২) সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিসংখ্যানগত প্রবণতা বিশ্লেষণ।
এই বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই করা হয়েছে, কারণ উদ্বাস্তু সুরক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনি অঙ্গীকারসমূহ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু কানাডার অভিবাসন ও উদ্বাস্তু সুরক্ষা আইন (আইআরপিএ) আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত, তাই এর বিধানসমূহ অন্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। আইআরপিএ কেবল একটি অভ্যন্তরীণ আইন নয়; এটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার আলোকে ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
==== ''লেক্স'' ''হিস্টোরিকা'' ====
আইনের আলোচনায় এই গ্রন্থ ইতিহাসের গুরুত্ব অনুধাবন করে। আইনজীবী অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস বলেছেন, "আইনের জীবনচক্র যুক্তি নয়, অভিজ্ঞতা।"<ref>Britannica Encyclopaedia, ''Oliver Wendell Holmes, Jr.'', <https://www.britannica.com/biography/Oliver-Wendell-Holmes-Jr/The-Common-Law> (Accessed October 9, 2021).</ref> এই গ্রন্থ উদ্বাস্তু প্রক্রিয়ার ইতিহাস, নীতিগত পরিবর্তন, এবং কেন পরিবর্তন এসেছে তা বিশ্লেষণ করেছে। এই প্রক্রিয়ার কিছু অংশ রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন; যেমন হামলিন বলেছেন, উদ্বাস্তু আইন রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক গঠিত একটি উপায় যা বিষয়টিকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করে, একে মহত্ত্বের নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করে এবং ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও বৈশ্বিক শোষণ থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে আড়াল করে।<ref>Rebecca Hamlin, ''Crossing: How We Label and React to People on the Move'', Stanford, CA: Stanford University Press, 2021, ISBN 9781503627888, page 63.</ref> আবার অন্যদিকে, দ্রুত পরিবর্তনশীল নীতিমালা এবং জনমতের পরিবর্তনেরও প্রভাব রয়েছে।<ref>The Canadian Encyclopedia. "Canadian Refugee Policy". 10 November 2020, Historica Canada. https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/canadian-refugee-policy. Accessed 30 December 2020.</ref> এই পরিবর্তনশীলতার ফলে নিয়ম ও প্রক্রিয়া প্রায়ই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যা দাবিদার ও আইনজীবীদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করে।
==== ''লেক্স ফেরেন্ডা'' ====
সবশেষে, এই লেখাটি এমন একটি আইনের বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা "যেমন হওয়া উচিত" সেই ধারণাকে প্রতিফলিত করে (''লেক্স ফেরেন্ডা'')। উদাহরণস্বরূপ, এই লেখায় কেবলমাত্র প্রধান মামলা ও নীতিমালা উপস্থাপন করা হয়নি; বরং এগুলোকে সংহত ও সুবিন্যস্ত করে নীতিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে কোনো বিষয়ে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে কিংবা আইন এখনও অপর্যাপ্ত, সেখানে লেখক কর্তৃক একটি (বিকল্প) উত্তম পথ নির্দেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ধরনের আইনবিষয়ক বর্ণনায় যেসব নৈতিক মান ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
* কানাডার আন্তর্জাতিক আইনি অঙ্গীকারকে নৈতিক মানের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। গত অর্ধ-শতাব্দীতে কানাডার উদ্বাস্তু নীতিতে বিভিন্ন পরিবর্তন আসলেও এসব প্রক্রিয়াগত উদ্ভাবন ১৯৫১ সালের উদ্বাস্তু কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকারের একটি স্থিতিশীল প্রেক্ষাপটে ঘটেছে। কনভেনশনটি শুরুতে অস্থায়ী বলে বিবেচিত হলেও প্রায় সত্তর বছর ধরে এটি প্রাসঙ্গিক। আনন্দ উপেন্দ্রন উল্লেখ করেন যে, এর প্রাসঙ্গিকতা মূলত মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে টিকে রয়েছে, যা "শুরু থেকেই মানবজাতির প্রতি চিরস্থায়ীভাবে নিজেকে ঘোষিত করতে চেয়েছিল।"<ref name=":0">Anand Upendran, ''At Sea? The State of International Refugee Law'', <http://www.mcrg.ac.in/RLS_Migration_2021/Papers/Anand%20Upendran_Abstract.pdf> (Accessed June 2, 2021)।</ref>
* লেখাটিতে তুলনামূলক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও এটি কানাডীয় আইনে ভিত্তি করে রচিত, কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা অধ্যয়ন করে একটি নীতিনির্ভর ব্যাখ্যার ভিত্তি তৈরির চেষ্টাও করা হয়েছে।
* অভিবাসন ও উদ্বাস্তু সুরক্ষা আইন (আইআরপিএ)-এর উদ্দেশ্য অনুচ্ছেদকেও সংসদীয় উদ্দেশ্যের একটি উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে: কানাডীয় শরণার্থী পদ্ধতি/শরণার্থী পদ্ধতির ব্যাখ্যার নীতিমালা#আইআরপিএ এসএস. ৩(২) এবং ৩(৩): আইন থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যার নীতিমালা।
* এই লেখাটি আলোচ্য নিয়ম, চুক্তি ও আইনসমূহকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের ভাষায়, আইনের ব্যাখ্যা এবং আইনি যুক্তির ভিত্তি হলো বিভিন্ন নিয়ম ও নীতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে সেগুলোকে মানব প্রচেষ্টা বা উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে দেখা।<ref>International Law Commission, ''Fragmentation of international law: difficulties arising from the diversification and expansion of international law,'' DOCUMENT A/CN.4/L.682 and Add.1*, 13 April 2006, <https://legal.un.org/ilc/documentation/english/a_cn4_l682.pdf> (Accessed September 26, 2022), PDF-এর পৃষ্ঠা 15।</ref> এই লেখাটিও সেই লক্ষ্যেই অবদান রাখতে চায়।
=== উপসংহার ===
সবশেষে, এই লেখাটি আলোচিত বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও গভীরতার সঙ্গে মানানসই একটি ভঙ্গিতে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (যেমন উদ্বাস্তু কনভেনশন) স্বভাবতই একটি গম্ভীর বিষয়। উপেন্দ্রন লিখেছেন: “এই দলিলগুলো গম্ভীর কারণ এগুলো দুঃখজনক ইতিহাসের ফলাফল; কারণ এগুলো মানুষ ও রাষ্ট্রের নিপীড়নের ক্ষমতা স্বীকার করে; কারণ, এগুলো অপমান ও দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করলেও স্পষ্টত সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।”<ref name=":0" />
তবে, উদ্বাস্তু আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই গম্ভীর বাস্তবতার বিপরীতে একটি আশার দিকও রয়েছে, সেটি হলো আশ্রয়ের ধারণা ও এর অন্তর্ভুক্ত সহায়তার প্রতিশ্রুতি। দার্শনিক জন রলস বলেন, আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে মানুষ বিপদে অপরের সহায়তা পেতে পারে – এই প্রকাশ্য জ্ঞান নিজেই অত্যন্ত মূল্যবান। এর আসল মূল্য সাহায্য প্রাপ্তির মধ্যে নয় বরং অন্যদের সদিচ্ছার প্রতি আস্থা ও ভরসার অনুভূতির মধ্যে নিহিত। তিনি বলেন, এমন সমাজ কল্পনা করুন যেখানে কেউ অন্যের জন্য এই দায়িত্ববোধ অনুভব করে না—সেটি মানবতার প্রতি উপেক্ষার একটি প্রতিচ্ছবি হবে যা আত্মমর্যাদাবোধকেও ধ্বংস করে দেবে।<ref>J. Rawls, A Theory of Justice (1971), at 338-39।</ref>
কানাডায় নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টায় উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি ও যথাযথ সহায়তা প্রদান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিরোধের পথ।<ref>Alex Verman and Sean Rehaag, ''Transgender Erasure: Barriers Facing Transgender Refugees in Canada,'' (2024) 69:1 McGill LJ 49 — (2024) 69:1 RD McGill 49, <https://lawjournal.mcgill.ca/article/transgender-erasure-barriers-facing-transgender-refugees-in-canada/>, PDF-এর পৃষ্ঠা 47 (জার্নাল নম্বরিং অনুযায়ী পৃষ্ঠা 95)।</ref> ব্রিজেট হেইডেন লিখেছেন: "একজন উদ্বাস্তুকে অন্যান্য সীমান্ত পার হওয়া মানুষ, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, কিংবা দুর্দশায় থাকা মানুষদের থেকে আলাদা করে যেটি চিহ্নিত করে, তা হলো আমাদের দায়িত্ববোধ এবং তাদের প্রতি করুণা বা সহানুভূতির অনুভব। 'উদ্বাস্তু' শব্দটি একটি পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত।”<ref>Hayden, Bridget. “What’s in a Name? The Nature of the Individual in Refugee Studies.” Journal of Refugee Studies 19, no. 4 (2006): 471–87।</ref> এইভাবে, উদ্বাস্তু সুরক্ষা শুধু গম্ভীর দায়িত্ব নয়, বরং গ্রহণকারী রাষ্ট্রের জন্য গর্ব ও পরিচয়ের বিষয়ও হতে পারে।
কানাডার উদ্বাস্তু প্রক্রিয়া রাষ্ট্র হিসেবে কানাডা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। এক লেখক যেমন বলেছিলেন, "বিদেশিরা আমাদের প্রতিচ্ছবি; তাদের আইনি অবস্থান নিয়ে আমাদের বিবেচনার মধ্যে আমরা নিজেদের একটি বিশ্লেষণ দেখতে পাই যা খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভব।"<ref>E.M. Morgan, ''Aliens and Process Rights: The Open and Shut Case of Legal Sovereignty,'' (1988) 7 Wisconsin International Law Journal, 107-47, as cited in R. G. L. Fairweather, ''Canada's New Refugee Determination System'', 27 CAN. Y.B. INT'l L. 295 (1989), পৃষ্ঠা 308।</ref> সেই প্রতিচ্ছবি কেমন হবে তা পাঠকের উপর নির্ভর করে। বলা যায়, এই লেখার মাধ্যমে যে চিত্র উঠে আসে তা হলো একটি দেশ যা উদ্বাস্তুদের মর্যাদা প্রদান বিষয়ে ব্যাপক সম্পদ ও মনোযোগ দিয়েছে। এটি একদিকে মানবিক ঐতিহ্যের দাবিদার একটি রাষ্ট্রকে প্রতিফলিত করে, যার পরিচয় গড়ে উঠেছে নিপীড়িতদের আশ্রয়দাতা হিসেবে। অপরদিকে বলা যেতে পারে, উদ্বাস্তু আইন এমন এক কাঠামো তৈরি করে যা "আমরা বনাম তারা", "স্থানীয় বনাম বিদেশি"-এর বিভাজনকে টিকিয়ে রাখে এবং এর পেছনে ব্যয়কৃত সম্পদ একটি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক উদ্যোগের অংশ যা সীমান্তের কার্যকারিতা ও সার্বভৌমতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করে। সবশেষে, উদ্বাস্তু আইন এই ভিন্নধর্মী ইতিহাস ও উদ্দেশ্যের একটি জটিল সম্মিলন।
== তথ্যসূত্র ==
<references responsive="" />
{{BookCat}}
h5dk8961b1hofwxz40n1sqdrflmilng
ইন্দ্রিয়তন্ত্র/ঘ্রাণতন্ত্র/সংবেদী অঙ্গ
0
25739
85504
80300
2025-07-01T14:19:42Z
Mehedi Abedin
7113
85504
wikitext
text/x-wiki
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের প্রধান '''ঘ্রাণতন্ত্র''' নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার সময় গন্ধযুক্ত পদার্থ শনাক্ত করে, যেখানে এই পদার্থগুলি ঘ্রাণ রিসেপ্টর ধারণকারী ঘ্রাণ আবরণীর সংস্পর্শে আসে।
ঘ্রাণ সংবেদনশীলতা নাকের গহ্বরে সেপ্টামের কাছাকাছি ঘ্রাণ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি দ্বারা আবৃত এলাকার সাথে সরাসরি সমানুপাতিক, যা ঘ্রাণ রিসেপ্টর কোষ অবস্থিত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। এই এলাকার বিস্তৃতি বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির মধ্যে সুনির্দিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কুকুরদের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত উন্নত এবং এই ঝিল্লি দ্বারা আবৃত এলাকা প্রায় ৭৫ – ১৫০ বর্গ সেমি; এই প্রাণীগুলিকে ম্যাক্রোসম্যাটিক প্রাণী বলা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে ঘ্রাণ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি প্রায় ৩ – ৫ বর্গ সেমি এলাকা আবৃত করে, তাই তাদের মাইক্রোসম্যাটিক প্রাণী হিসাবে পরিচিতি আছে।
মানুষের প্রায় ১ কোটি ঘ্রাণ কোষ রয়েছে, যার প্রতিটি ঘ্রাণ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি গঠনকারী ৩৫০টি ভিন্ন রিসেপ্টর প্রকার ধারণ করে। এই ৩৫০টি ভিন্ন রিসেপ্টর কেবল একটি নির্দিষ্ট গন্ধযুক্ত পদার্থের জন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। একটি গন্ধযুক্ত অণুর সাথে বন্ধন একটি আণবিক চেইন বিক্রিয়া শুরু করে, যা রাসায়নিক সংবেদনকে একটি বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে।
বৈদ্যুতিক সংকেত ঘ্রাণ স্নায়ুর অ্যাক্সন দিয়ে ঘ্রাণ বাল্ব পর্যন্ত পৌঁছায়। এই অঞ্চলে ১০০০ থেকে ২০০০ গ্লোমেরুলার কোষ রয়েছে যা বিভিন্ন রিসেপ্টর থেকে আসা সম্ভাবনাগুলোকে একত্রিত ও ব্যাখ্যা করে। এইভাবে, উদাহরণস্বরূপ, কফির সুবাসকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব, যা প্রায় ৬৫০টি ভিন্ন গন্ধযুক্ত পদার্থ দ্বারা গঠিত। মানুষ প্রায় ১০,০০০ গন্ধের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
সংকেতটি তারপর ঘ্রাণ কর্টেক্সে যায় যেখানে এটি পরিচিত গন্ধযুক্ত পদার্থগুলোর (যেমন ঘ্রাণ স্মৃতি) সাথে তুলনা করে চিহ্নিত করা হবে এবং এর সাথে ঘ্রাণ উদ্দীপনায় একটি আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়াও জড়িত থাকে।
এই আকর্ষণীয় বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, মানব জিনোমে প্রায় ৬০০ – ৭০০টি জিন (সম্পূর্ণ জিনোমের প্রায় ২%) ঘ্রাণ রিসেপ্টরকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার জন্য বিশেষায়িত, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৩৫০টি এখনও '''ঘ্রাণতন্ত্র''' গঠনে ব্যবহৃত হয়। এটি মানুষের ঘ্রাণশক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার বিবর্তনীয় পরিবর্তনের একটি প্রমাণ।
{{BookCat}}
j0don4scdr28sqyru3octujeoplcvzd
প্রোগ্রামিংয়ের মৌলিক ধারণা/অনুশীলন: পয়েন্টার
0
25843
85507
80749
2025-07-01T14:28:47Z
Mehedi Abedin
7113
85507
wikitext
text/x-wiki
"প্রোগ্রামিং ফান্ডামেন্টালস - সি++ ব্যবহার করে একটি মডুলার স্ট্রাকচার্ড অ্যাপ্রোচ" সংগ্রহ/পাঠ্যপুস্তকের এই অধ্যায়টিকে সমর্থন করে এমন প্রশ্ন, অনুশীলন, সমস্যা ইত্যাদি।
== শেখার উদ্দেশ্য ==
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির কার্যকলাপ, ব্যায়াম, ল্যাব অ্যাসাইনমেন্ট, সমস্যা, অথবা নির্ধারিত কুইজ/পরীক্ষার ক্ষেত্রে সময়; শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আশা করা যায় যে ১০০% নির্ভুলতার সাথে:
# এই অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কিত মডিউলগুলিতে তালিকাভুক্ত সংজ্ঞাগুলিতে পদগুলি সংজ্ঞায়িত করবে।
# পয়েন্টার ডেটা টাইপ, ঠিকানা এবং ইনডাইরেকশন অপারেটর, ডিরেফারেন্সিংয়ের ধারণা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা অর্জন করবে।
# সিউডোকোড দেওয়া হয়েছে, রেফারেন্স ভেরিয়েবল ব্যবহার করে এমন একটি প্রোগ্রামের জন্য সি++ কোড লিখতে পারবে।
== অনুশীলন ==
'''অনুশীলন ১'''
=== নিম্নলিখিত বিবৃতিগুলির সত্য অথবা মিথ্যা উত্তর দাও: ===
# অ্যাড্রেস অপারেটর হল @ প্রতীক।
# যখন শুধুমাত্র একটি আইটেম পরিবর্তন করার থাকে, তখন রেফারেন্স দ্বারা পাসিং ব্যবহার করা উচিত।
# পয়েন্টার ডেটা টাইপের ভেরিয়েবলগুলি একটি তারকাচিহ্ন ব্যবহার করে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
# রেফারেন্সের মাধ্যমে ভেরিয়েবল পাস করার পরিবর্তে ইনডিরেক্টেশন অপারেটরের সাথে পয়েন্টার ব্যবহার করা যেতে পারে।
# দুই ধরণের ডিরেফারেন্সিং আছে - একটি ইনডিরেক্টেশন অপারেটরের সাথে এবং অন্যটি ইনডেক্স অপারেটরের সাথে।
{{Collapsible top|title='''উত্তর'''}}
# মিথ্যা
# মিথ্যা
# সত্য
# সত্য
# সত্য
{{Collapse bottom}}
== বিবিধ জিনিসপত্র ==
এই মুহূর্তে কিছু নেই।
== ল্যাব অ্যাসাইনমেন্টর ==
'''অধ্যায় ২২ ফাইলের জন্য একটি ফোল্ডার বা সাব-ফোল্ডার তৈরি করা'''
আপনার কম্পাইলার/আইডি-এর উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে প্রক্রিয়াকরণের জন্য সোর্স কোড ফাইলগুলি কোথায় ডাউনলোড এবং সংরক্ষণ করবেন। প্রুডেন্স নির্দেশ করে যে সোর্স কোড ফাইলগুলি ডাউনলোড করার আগে আপনাকে প্রয়োজন অনুসারে এই ফোল্ডারগুলি তৈরি করতে হবে। ব্লাডশেড ডেভ-সি++ ৫ কম্পাইলার/আইডিই এর জন্য একটি প্রস্তাবিত সাব-ফোল্ডারের নামকরণ করা যেতে পারে:
* অধ্যায়_২২ নামের ফোল্ডারের মধ্যে: সিপিপি_সোর্স_কোড_ফাইলস (Cpp_Source_Code_Files)
যদি আপনি তা না করে থাকেন, তাহলে অনুগ্রহ করে উপযুক্ত ফোল্ডার এবং/অথবা সাব-ফোল্ডার তৈরি করুন।
'''ল্যাব ফাইল ডাউনলোড করুন'''
নিম্নলিখিত ফাইল ডাউনলোড করে আপনার স্টোরেজ ডিভাইসে উপযুক্ত ফোল্ডারে সংরক্ষণ করুন। ফাইলটি ডাউনলোড করার জন্য আপনাকে লিঙ্কটিতে ডান ক্লিক করে "সেভ টার্গেট অ্যাজ" নির্বাচন করতে হতে পারে।
কানেক্সিয়ন্স থেকে ডাউনলোড করুন:[https://legacy.cnx.org/content/m22153/latest/Lab_22_Pseudocode.txt ল্যাব_২২_সিউডোকোড.টেক্সট (Lab_22_Pseudocode.txt)]
'''বিস্তারিত ল্যাব নির্দেশাবলী'''
নীচের নির্দেশাবলী সাবধানে পড়ুন এবং অনুসরণ করুন, এবং তালিকাভুক্ত ক্রম অনুসারে পদক্ষেপগুলি সম্পাদন করুন।
* Lab_22_Pseudocode.txt ফাইল থেকে একটি সোর্স কোড ফাইল তৈরি করুন। নাম দিন: Lab_22.cpp
* আপনার প্রোগ্রাম তৈরি করুন (কম্পাইল করুন এবং চালান)।
* এই প্রোগ্রামটি সফলভাবে লেখার পর, যদি আপনি কলেজ ক্রেডিটের জন্য এই কোর্সটি নিয়ে থাকেন তাহলে গ্রেডিংয়ের জন্য জমা দেওয়ার জন্য আপনার অধ্যাপক/প্রশিক্ষকের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।
== সমস্যা ==
'''সমস্যা ২২ক – নির্দেশাবলী'''
পয়েন্টার ডেটা টাইপ, ঠিকানা এবং ডিরেফারেন্সিং ব্যবহারের একটি সাধারণ ব্যাখ্যা দিন। আপনার আলোচনায় ইনডিরেকশন অপারেটর এবং ইনডেক্স অপারেটর উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করুন।
dlhiotyckno8k145bu08ykt3az1j497
পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/যোগাযোগ শুরু
0
26303
85517
82148
2025-07-01T15:11:31Z
Mehedi Abedin
7113
85517
wikitext
text/x-wiki
=যোগাযোগের সূচনা=
পঠন হল আপনার পাঠকদের সাথে আপনার শব্দ ও গ্রাফিক্সের একটি গতিশীল মিথস্ক্রিয়া। একটি বাক্য বা অনুচ্ছেদের প্রতি আপনার পাঠকের প্রতিক্রিয়া পরবর্তী সমস্ত বাক্য এবং অনুচ্ছেদের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলস্বরূপ, শুরুর বাক্য বা অংশটি একটি বিশেষ গুরুত্ব গ্রহণ করে। এটি পাঠকদের পরবর্তী সমস্ত বাক্য এবং অংশের প্রতি কী মনোভাব তৈরি করে তা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। এটি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মনোযোগী রাখে।
শুরুতে, আপনি অত্যন্ত ব্যবহারযোগ্য এবং অত্যন্ত প্ররোচনামূলক উপায়ে আপনার যোগাযোগ শুরু করার জন্য আটটি পাঠককেন্দ্রিক কৌশল শিখবেন। খুব কমই, যদি কখনও হয়, আপনি একসাথে আটটিই ব্যবহার করবেন। একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একটি বা একটি সংমিশ্রণ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আপনার পাঠকদের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে যা আপনি আপনার যোগাযোগের উদ্দেশ্যগুলি নির্ধারণ করার সময় অর্জন করেছিলেন। অধ্যায়ের নবম নির্দেশিকা এমন পরিস্থিতিতে নীতিগত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে যেখানে কর্মক্ষেত্রে লোকেরা কখনও কখনও ভাবছেন যে তাদের আদৌ যোগাযোগ করার চেষ্টা করা উচিত কিনা।
প্রথম তিনটি নির্দেশিকা বিষয় ঘোষণা করে, মূল বিষয় উল্লেখ করে এবং আপনার যোগাযোগের সংগঠনের পূর্বাভাস দেয়।
'''নির্দেশিকা ১: আপনার পাঠকদের মনোযোগ দেওয়ার কারণ দিন'''
শুরুতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আপনার পাঠকদের আপনার বার্তাটি এড়িয়ে বা অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে রাজি করানো। কর্মক্ষেত্রে, লোকেরা অভিযোগ করে যে তারা অনেক বেশি ইমেইল, স্মারকলিপি এবং প্রতিবেদন পায়। আপনার লক্ষ্য হল তাদের কেবল বার্তাটির প্রতি কিছুটা মনোযোগ দেওয়ার জন্যই নয় বরং গভীর মনোযোগ দেওয়ার জন্যও বোঝানো। আপনার যোগাযোগ প্রাথমিকভাবে প্ররোচনামূলক হলে এটি করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে লোকজম কোনও বার্তা পড়ার সময় বা শোনার সময় যত বেশি গভীরভাবে চিন্তা করে, তত বেশি তারা এটির প্রস্তাবিত মনোভাব ধরে রাখবে, সেই মনোভাবগুলিকে বিপরীত করার প্রচেষ্টাগুলিকে প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা তত বেশি এবং সেই মনোভাব অনুসারে কাজ করার সম্ভাবনা তত বেশি।
আপনার পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আপনাকে দুটি জিনিস করতে হবে:
*আপনার বিষয় ঘোষণা করুন
*আপনার পাঠকদের বলুন যে আপনি যে তথ্য প্রদান করছেন তা থেকে তারা কীভাবে উপকৃত হবে
উভয় জিনিসই করতে ভুলবেন না। ধরে নিবেন না যে আপনার পাঠকরা আপনার বিষয় বলার পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার তথ্যের মূল্য দেখতে পাবেন। আপনার কাছে স্পষ্ট মনে হওয়া সুবিধাগুলি তাদের কাছে স্পষ্ট নাও হতে পারে।
== সাবজেক্ট লাইনের গুরুত্ব ==
সাবজেক্ট লাইনগুলি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং সাধারণত মাত্র কয়েকটি শব্দ দীর্ঘ হয়। একটি বিষয় লাইন লেখার সময়, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখবেন:
*সংক্ষিপ্ত রাখুন। সাবজেক্ট লাইনটি পাঠককে বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করার জন্য, সাবজেক্ট লাইন নয়
*এটি আকর্ষণীয় করে তুলুন। যখন লোকেরা আপনার বিষয় লাইনটি পড়বে, তখন তারা কি আরও পড়তে চাইবে?
*নিশ্চিত করুন যে এটি সাবজেক্ট লাইন। সাবজেক্ট লাইনটি পাঠককে ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তা জানানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইমেইল একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। এর দুটি শুরু রয়েছে: সাবজেক্ট লাইন এবং ইমেলের প্রথম বাক্য। আপনার অভিপ্রেত পাঠক যতক্ষণ না আপনার বিষয় লাইন তাদের আপনার বার্তাটি খুলতে রাজি করায় ততক্ষণ পড়বে না। আপনার বিষয়ের নামটি সঠিকভাবে বলুন এবং নির্দেশ করুন যে এটি সম্পর্কে আপনার যা বলার আছে তা আপনার পাঠকদের উপকার করবে। স্মারকলিপি এবং চিঠিতে বিষয় লাইনগুলিও ব্যবহার করুন।
==পাঠকের সুবিধা তুলে ধরার দুটি উপায়==
আপনার যোগাযোগ পড়ে সামগ্রিকভাবে উপকৃত ব্যক্তিদের রাজি করানোর জন্য দুটি কৌশল বিশেষভাবে কার্যকর।
'''আপনার পাঠকের অনুরোধ দেখুন'''
কর্মক্ষেত্রে, আপনি প্রায়শই লিখবেন কারণ একজন সহকর্মী, ব্যবস্থাপক, অথবা মক্কেল আপনার কাছে সুপারিশ বা তথ্য চেয়েছেন। আপনার উত্তরের পাঠকের সুবিধা নির্ধারণ করতে, কেবল অনুরোধটি পড়ুন।
'''আপনার পাঠকদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করার প্রস্তাব'''
যোগাযোগের শুরুতে পাঠকদের সুবিধাগুলি তুলে ধরার দ্বিতীয় কৌশল হল আপনার পাঠকদের বলা যে আপনার যোগাযোগ তাদের মুখোমুখি হওয়া সমস্যার সমাধানে সহায়তা করবে। বেশিরভাগ কর্মচারী নিজেদেরকে সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে মনে করেন। সমস্যাটি প্রযুক্তিগত, সাংগঠনিক বা নীতিগত বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত হোক না কেন, পাঠক বা ব্যক্তি এমন যোগাযোগকে স্বাগত জানাবেন যা তাদের সমাধান খুঁজে পেতে সহায়তা করে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জে সি ম্যাথেস এবং ডোয়াইট ডব্লিউ স্টিভেনসন একটি বিশেষভাবে শক্তিশালী পদ্ধতির পরামর্শ দিয়েছেন। মূল বিষয় হল লেখার শুরু যা সমস্যা সমাধান/সময় সাশ্রয়ী সমাধান প্রদান করে পাঠকদের উদ্বেগের উপর ভিত্তি করে তৈরি করে। প্রথমে আপনি যে পাঠকদের সমাধান করতে যাচ্ছেন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির তালিকা তৈরি করুন। তালিকা থেকে এমন একটি সমস্যা বেছে নিন যা আপনার তথ্য এবং ধারণা পাঠকদের সমাধান প্রদান করবে। এটি করার পরে আপনি একটি যৌথ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় অংশীদার হিসাবে নিজেকে এবং পাঠকদের সাথে সংযুক্ত করতে শুরু করেছেন যেখানে আপনার যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একবার আপনি নির্ধারণ করে ফেললেন যে আপনার এবং আপনার পাঠকদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের অংশীদারিত্ব কীভাবে বর্ণনা করবেন, আপনার যোগাযোগের শুরুর খসড়া তৈরি করুন।
<u>আপনার পাঠকদের সাথে সমস্যা সমাধানের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা</u>
# আপনার পাঠকদের বলুন যে সমস্যাটি সমাধানে আপনি তাদের সাহায্য করবেন। আপনার পাঠকরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এমন একটি সমস্যা চিহ্নিত করতে ভুলবেন না।
# সমস্যা সমাধানে আপনি কী করেছেন তা আপনার পাঠকদের বলুন। আপনার নিজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছেন তা পর্যালোচনা করুন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রদত্ত পণ্যগুলি তদন্ত করার সময় আপনি আপনার নিয়োগকর্তার পণ্যগুলির একটির জন্য বা আপনার ফলাফলের জন্য একটি নতুন বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারেন। আপনি ব্যক্তিগতভাবে যা করেছেন তা তালিকাভুক্ত করার পরিবর্তে আপনার গবেষণা বা তথ্য আপনার পাঠকদের কাছে কেন তাৎপর্যপূর্ণ হবে তা তৈরি করার উপর মনোযোগ দিন।
# আপনার পাঠকদের বলুন যে আপনার যোগাযোগ কীভাবে তাদের কাজ আরও দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে সাহায্য করবে এবং তাদের অবদান কীভাবে যৌথ সহযোগিতার সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
<u>এখানে কিছু পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে সমস্যা সমাধানের পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিবরণ সাধারণত কাম্য</u>
* আপনার তাৎক্ষণিক কর্মী-গোষ্ঠীর বাইরের লোকেরা আপনার যোগাযোগ পড়বে।
আপনার পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ বা সকলেই যত বেশি দূরে থাকবেন, আপনার বার্তার প্রেক্ষাপটের সাথে তাদের পরিচিত হওয়ার সম্ভাবনা তত কম থাকবে।
* আপনার যোগাযোগের একটি পটভূমি ও একটি সারাংশ থাকবে।
আবদ্ধ নথিগুলি সাধারণত বর্তমান পাঠকদের একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর জন্য তৈরি করা হয় এবং তারা প্রায়শই ভবিষ্যতের পাঠকদের পরামর্শের জন্য জমা দেয়। উভয় গ্রুপেই কমপক্ষে কিছু পাঠক থাকতে পারে যাদের আপনি যে সমস্যা সমাধানের পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন সে সম্পর্কে কোনও ধারণা থাকবে না।
* আপনার যোগাযোগটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের সাথে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে।
এই ধরণের সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই উচ্চস্তরের পরিচালকদের দ্বারা নেওয়া হয় যাদের তাদের পড়া প্রতিবেদনের সাংগঠনিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন।
==অযাচিত যোগাযোগে সমস্যা সংজ্ঞায়িত করা==
আপনার কর্মজীবনে, আপনাকে অনুরোধ না করেই অনুরোধ বা সুপারিশ করার অনেক সুযোগ আসবে। এই অযাচিত যোগাযোগগুলি লেখার সময়, আপনার পাঠকদের বোঝাতে হতে পারে যে একটি সমস্যা আছে। এর জন্য কিছু সৃজনশীল, পাঠক-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হতে পারে।
'''নির্দেশিকা ২: আপনার মূল বিষয়টি উল্লেখ করুন'''
আপনি সাধারণত শুরুতেই আপনার মূল বিষয়টি উল্লেখ করে আপনার যোগাযোগের ব্যবহারযোগ্যতা এবং প্ররোচনামূলকতা বৃদ্ধি করতে পারেন। এটি করার তিনটি প্রধান কারণ:
* আপনি আপনার পাঠকদের সবচেয়ে বেশি যা চান বা যা প্রয়োজন তা খুঁজে পেতে সাহায্য করেন
* আপনি আপনার পাঠকদের আপনার মূল বিষয়টি সঠিকভাবে পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেন, নয়তো তারা আপনার যোগাযোগ পত্র একপাশে রেখে দেবেন।
* আপনি আপনার পাঠকদের পরবর্তী বিষয়টি দেখার জন্য একটি প্রেক্ষাপট প্রদান করেন
==চিন্তা করে আপনার মূল বিষয়টি নির্বাচন করুন==
ঠিক একইভাবে আপনার যোগাযোগের মূল বিষয়টি নির্বাচন করুন যেভাবে আপনি প্রতিটি বিভাগের মূল বিষয়টি নির্বাচন করেন। আপনি যদি কোনও অনুরোধের উত্তর দেন তাহলে আপনার মূল বিষয়টি হবে আপনার পাঠকের জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর। আপনি যদি নিজের উদ্যোগে লিখেন তাহলে আপনার মূল বিষয়টি হতে পারে আপনার যোগাযোগটি পড়ার পর আপনি আপনার পাঠকদের নিয়ে কী ভাববেন বা করবেন তা। উদাহরণস্বরূপ, যদি চান আপনার বস কোনও কিছুতে স্বাক্ষর করুক, তাহলে আপনি আপনার বিষয়বস্তু "স্বাক্ষর প্রয়োজন" করতে পারেন এবং তারপরে আপনার নথির মূল বিষয় হিসাবে কী স্বাক্ষর করতে হবে তা ব্যাখ্যা করতে পারেন।
'''নির্দেশিকা ৩: আপনার পাঠকদের বলুন কী আশা করতে হবে'''
যদি আপনার যোগাযোগ খুব সংক্ষিপ্ত না হয় তাহলে এর শুরু থেকেই পাঠকদের পরবর্তী অংশগুলিতে কী আশা করতে হবে তা বলা উচিত। যোগাযোগের শুরুতে অবস্থিত একটি পূর্বাভাস বিবৃতি তার সংগঠন এবং পরিধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। এটি কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণ করবে। প্রথমত, এটি পাঠকদের মনোযোগ কেবল কী মোকাবেলা করা প্রয়োজন তার দিকেই সংকুচিত করবে। দ্বিতীয়ত, এটি এমন কিছু পাঠককে নিরুৎসাহিত করবে যাদের জন্য আপনি লিখতে চান না। এটি মামলা এড়াতে সাহায্য করতে পারে।
==আপনার যোগাযোগের সংগঠন সম্পর্কে বলুন==
শুরুতেই আপনার পাঠকদের আপনার যোগাযোগের সংগঠন সম্পর্কে বলার মাধ্যমে আপনি তাদের বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে সংযোগ বোঝার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করেন। এই কাঠামোটি আপনার যোগাযোগের ব্যবহারযোগ্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে, আপনার পাঠকদের তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে সাহায্য করে যে আপনার তৈরি প্রতিটি নতুন বিষয় তারা ইতিমধ্যেই পড়েছেন তার সাথে কীভাবে সম্পর্কিত। এটি পাঠকদের দ্রুত তাদের অনুসন্ধান করা তথ্যে পরিভ্রমণ করতে সাহায্য করে।
==আপনার যোগাযোগের পরিধি সম্পর্কে বলুন==
পাঠকরা শুরু থেকেই জানতে চান যে একটি যোগাযোগ কী ধারণ করে এবং কী ধারণ করে না। এমনকি যদি তারা নিশ্চিত হন যে আপনি তাদের সাথে প্রাসঙ্গিক কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তবুও তারা ভাবতে পারেন যে আপনি যে বিষয়টি সম্পর্কে তারা জানতে চান তার নির্দিষ্ট দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করছেন কিনা। প্রায়শই আপনি যখন আপনার যোগাযোগের সংগঠন সম্পর্কে বলবেন তখন আপনি আপনার পাঠকদের তার পরিধি সম্পর্কে বলবেন: যখন আপনি এটি সম্বোধন করা বিষয়গুলি তালিকাভুক্ত করবেন, তখন আপনি এর পরিধি নির্দেশ করবেন। তবে, এমন সময় আসবে যখন আপনাকে অতিরিক্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি তখন ঘটে যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি আপনার বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে সম্বোধন করছেন না অথবা আপনি এটিকে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে সম্বোধন করছেন।
'''নির্দেশিকা ৪: আপনার বার্তার প্রতি উন্মুক্ততা উৎসাহিত করুন'''
এই বইয়ের অন্যান্য অধ্যায়গুলিতে জোর দেওয়া হয়েছে যে পাঠকরা যখন কোনও যোগাযোগ পড়েন তখন তারা বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। যখন তারা আপনার দ্বারা প্রস্তুত নির্দেশাবলীর একটি সেট পড়েন, তখন তারা আপনার নির্দেশাবলীর প্রতিটি বিশদ অনুসরণ করতে পারেন অথবা নিজেরাই পদ্ধতিটি চেষ্টা করতে পারেন, যদি তারা হতবাক হয়ে যান তবেই আপনার নির্দেশাবলী অনুযায়ী পরামর্শ করুন। যেহেতু আপনি যেভাবে যোগাযোগ শুরু করেন তা আপনার পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলে, তাই আপনার শুরুর প্ররোচনামূলক মাত্রার দিকে সর্বদা মনোযোগ দেওয়া উচিত। সর্বদা এমনভাবে শুরু করুন যা আপনার পাঠকদের আপনার বাকি যোগাযোগের প্রতি উন্মুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য হতে উৎসাহিত করে।
==পাঠকদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হতে পারে==
সাধারণত আপনার গ্রহণযোগ্য প্রতিক্রিয়া পেতে কোনও সমস্যা হবে না কারণ আপনি সহকর্মী কর্মচারী, গ্রাহক এবং আপনার সরবরাহ করা তথ্য চান এমন অন্যদের সাথে যোগাযোগ করবেন। তবে কিছু পরিস্থিতিতে আপনার পাঠকদের আপনার বার্তার প্রতি আরও নেতিবাচক মনোভাব থাকতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আপনার বার্তার জন্য একটি ন্যায্য শুনানি পেতে হলে আপনার যোগাযোগের শুরুর খসড়া তৈরিতে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। আপনার বার্তার প্রতি আপনার পাঠকদের প্রাথমিক মনোভাব নেতিবাচক হবে যদি নিম্নলিখিত প্রশ্নের উত্তর "হ্যাঁ" হয়। যদি তাই হয়, তাহলে আপনার যোগাযোগের প্রতি আপনার পাঠকদের প্রতিক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে এমন মনোভাবগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করুন এবং তারপরে সেই অনুযায়ী আপনার শুরুটি তৈরি করুন।
* আপনার বার্তায় কি আপনার পাঠকদের জন্য খারাপ খবর রয়েছে?
* আপনার বার্তায় কি এমন ধারণা বা সুপারিশ রয়েছে যা আপনার পাঠকদের কাছে অবাঞ্ছিত হবে?
* আপনার পাঠকরা কি আপনার, আপনার বিভাগ বা আপনার কোম্পানির প্রতি অবিশ্বাস, বিরক্তি বা প্রতিযোগিতা বোধ করেন?
* আপনার পাঠকরা কি আপনার বিষয় বা পরিস্থিতি সম্পর্কে সন্দিহান হতে পারেন?
* আপনার পাঠকরা কি উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হতে পারেন?
ইতিবাচক প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া প্রচার বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করার জন্য সবচেয়ে বেশি কৌশল পরিস্থিতি থেকে পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্ন হয়। তবে এই তিনটি কৌশল প্রায়শই কাজ করে।
<u>উন্মুক্ততা উৎসাহিত করার কৌশল</u>
* নিজেকে একজন অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করুন, সমালোচক বা প্রতিযোগী হিসেবে নয়। আপনার পাঠকদের সাথে কাজ করার মাধ্যমে আপনি যে সমস্যার সমাধান করতে চান অথবা যে লক্ষ্য অর্জন করতে চান তা অর্জন করতে চান তা বোঝান।
* আপনার মূল বিষয়টি উপস্থাপনে বিলম্ব করুন। প্রাথমিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আপনার পাঠকদের পরবর্তী প্রতিটি বিষয়ের প্রতি আক্রমণাত্মকভাবে পাল্টা যুক্তি তৈরি করতে প্ররোচিত করতে পারে। অতএব, যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে আপনার পাঠকরা আপনার শুরুতেই আপনার মূল বিষয়টির প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। যদি আপনি আপনার মূল বিষয়টি উপস্থাপনে বিলম্ব করেন, তাহলে আপনার পাঠকরা আপনার মূল বিষয়টি আবিষ্কার করার এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে অন্তত আপনার অন্যান্য বিষয়গুলি বস্তুনিষ্ঠভাবে বিবেচনা করতে পারেন।
* আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করুন। যদি লোকেজন বার্তা প্রদানকারী ব্যক্তির উপর আস্থা রাখে, তাহলে তারা অনুকূলভাবে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফলস্বরূপ, আপনি যদি আপনার পাঠকদের বোঝাতে শুরু করেন যে আপনি আপনার বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞানী, তাহলে আপনি আপনার বার্তার প্রতি উন্মুক্ততা বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে আপনার যোগ্যতা ঘোষণা করা উচিত, আপনি কেবল আপনার পাঠকদের উপর অপ্রয়োজনীয় তথ্য চাপিয়ে দিচ্ছেন। আপনার সহকর্মীদের মতো যারা ইতিমধ্যেই আপনার দক্ষতা সম্পর্কে অনুকূল মতামত তৈরি করেছেন তাদের কাছে লেখার সময় আপনার যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করা এড়িয়ে চলুন।
* সহায়তার জন্য জিজ্ঞাসা করুন। বেশিরভাগ ব্যক্তি সাহায্য চাওয়া হলে নতুন ধারণাগুলি গ্রহণ করতে বেশি আগ্রহী হন। এমনকি যদি আপনি পরিস্থিতি সম্পর্কে সবকিছু জানেন, তবুও আপনি নিজে থেকে এটি সমাধান করতে সক্ষম নাও হতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে পাঠকের কাছে সাহায্য চাওয়া উপকারী হবে। এটি আপনার পাঠককে দেখায় যে আপনি যদি পরিস্থিতি সম্পর্কে সবকিছু জানেন, তবুও আপনি যা জানা দরকার তা জানেন না। লেখার সময় প্রায়শই অহংকারী বা গর্বিত হয়ে না আসা গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও আমাদের কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমাদের গর্বকে গ্রাস করতে হয়। একই স্তরের মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করুন। আপনি আরও বেশি জানেন এমন আচরণ করলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আরও বেশি হবে।
==নিজেকে একটি গল্প বলুন==
যদিও প্রস্তাবিত কৌশলগুলি প্রায়শই খোলামেলাভাবে উৎসাহিত করবে, সেগুলি যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করবেন না। যোগাযোগের শুরুতে সর্বদা আপনার পাঠকদের বিশেষ মনোভাব, অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যাশাগুলি মনে রাখবেন। আপনি আপনার পাঠকদের সম্পর্কে নিজেকে একটি গল্প বলার মাধ্যমে এটি করতে পারেন। আপনার গল্পের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া উচিত আপনার পাঠক, যদি আপনি একজন ব্যক্তির কাছে লিখছেন তবে একজন ব্যক্তি, অথবা যদি আপনি একটি গোষ্ঠীর কাছে লিখছেন তবে আপনার শ্রোতাদের একজন সাধারণ সদস্য। এই ব্যক্তি আপনার যোগাযোগ শুরু করার কয়েক মিনিট আগে আপনার গল্প শুরু করুন এবং যতক্ষণ না সে আপনার প্রথম শব্দগুলি পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে যান। যদিও আপনি আসলে আপনার যোগাযোগে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত করবেন না, এটি তৈরি করা আপনাকে কীভাবে শুরু করবেন তা সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে।
'''নির্দেশিকা ৫: প্রয়োজনীয় পটভূমি তথ্য প্রদান করুন'''
আপনি যখন কোনও যোগাযোগের শুরুর খসড়া তৈরি করেন তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন যে আপনি তাদের কী বলতে যাচ্ছেন তা বোঝার জন্য আপনার পাঠকদের কোনও পটভূমি তথ্যের প্রয়োজন আছে কিনা।
<u>যেসব পরিস্থিতিতে শুরুতেই তথ্যের প্রয়োজন হতে পারে</u>
* আপনার নির্দিষ্ট বিষয়গুলো বোঝার জন্য আপনার পাঠকদের কিছু সাধারণ নীতি বুঝতে হবে।
* আপনার পাঠকরা আপনি যে প্রযুক্তিগত শব্দগুলো ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে অপরিচিত
* আপনার পাঠকরা আপনি যে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন তার সাথে অপরিচিত
আপনার যোগাযোগের শুরুতেই সমস্ত পটভূমি তথ্য প্রযোজ্য নয়। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অংশের সাথে সম্পর্কিত তথ্য সেই অংশের শুরুতেই উপস্থিত হওয়া উচিত। আপনার যোগাযোগের শুরুতে কেবল পটভূমি তথ্য অন্তর্ভুক্ত করুন যা আপনার পাঠকদের আপনার সামগ্রিক বার্তা বুঝতে সাহায্য করবে।
'''নির্দেশিকা ৬: আপনার যোগাযোগ খুব ছোট না হলে একটি সারাংশ অন্তর্ভুক্ত করুন'''
সারাংশগুলি ব্যস্ত পরিচালকদের সম্পূর্ণ নথি না পড়েই মূল বিষয়গুলো শিখতে সাহায্য করে এবং তারা সেই পাঠকদের যোগাযোগের বিষয়বস্তু এবং সংগঠনের একটি সারসংক্ষেপ দেয়। দীর্ঘ যোগাযোগের জন্য, বিশেষ করে যেগুলো কভার এবং বিষয়বস্তুর সারণী থাকার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ, এই সারাংশগুলি দীর্ঘ এবং প্রায়শই একটি পৃথক পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়।
'''নির্দেশিকা ৭: আপনার পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী আপনার লেখার শুরুর দৈর্ঘ্য সামঞ্জস্য করুন'''
এমন কোনও নিয়ম নেই যা বলে যে সূচনা কত দীর্ঘ হওয়া উচিত। একটি ভালো, পাঠক-কেন্দ্রিক শুরুর জন্য কেবল একটি বাক্যাংশের প্রয়োজন হতে পারে অথবা বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা লাগতে পারে। আপনার পাঠকদের কেবল সেই তথ্যই দিতে হবে যা তারা ইতিমধ্যে জানে না।
<u>পাঠকদের নিম্নলিখিতগুলি জানা উচিত</u>
- কেন তাদের লেখাটি পড়া উচিত
- যোগাযোগের মূল বিষয়
- যোগাযোগের সংগঠন এবং পরিধি
- যোগাযোগটি বোঝার এবং ব্যবহার করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় পটভূমি তথ্য
আপনি যদি আপনার পাঠকদের এই সমস্ত তথ্য দিয়ে থাকেন এবং তাদের আপনার বার্তা খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে থাকেন, তাহলে যত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্তই হোক না কেন, আপনি একটি ভালো শুরু লিখেছেন।
'''নির্দেশিকা ৮: আপনার লেখার শুরুকে আপনার পাঠকদের সাংস্কৃতিক পটভূমির সাথে খাপ খাইয়ে নিন'''
যোগাযোগের শুরু সম্পর্কে পাঠকদের প্রত্যাশা এবং পছন্দ তাদের সংস্কৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। আপনি যে পরামর্শগুলি পড়েছেন তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু পশ্চিমা দেশের পাঠকদের জন্য উপযুক্ত। তবে পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কার্যকরভাবে খোলামেলা ভাব তৈরি করার জন্য আপনার পাঠকদের সংস্কৃতির যোগাযোগের রীতিনীতি সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা আবশ্যক। যদি আপনার এই বোধগম্যতা না থাকে, তাহলে কিছু গবেষণা করুন অথবা সেই সংস্কৃতির কাউকে খুঁজে বের করে তাদের জিজ্ঞাসা করুন।
'''নির্দেশিকা ৯: নীতিশাস্ত্র নির্দেশিকা: অনৈতিক অনুশীলনগুলিকে দ্রুত এবং কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করা শুরু করুন'''
ধরুন আপনি জানতে পারেন যে আপনার নিয়োগকর্তা এমন একটি কাজে লিপ্ত আছেন যা আপনি অনৈতিক বলে মনে করেন। অথবা আপনাকে এমন কিছু লিখতে বলা হয়েছে যা নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে আপনার ধারণাকে লঙ্ঘন করে। আপনার কি কথা বলা উচিত বা লিখিতভাবে আপনার উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত? নতুন কর্মীদের মাঝে মাঝে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করার আগে নিরাপত্তা এবং মর্যাদা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এর অর্থ হল আপনি এমন একটি অনুশীলনের সাথে কথা বলার আগে বছরের পর বছর ব্যয় করতে পারেন যা আপনি নীতিগত বলে মনে করেন। একটি অনৈতিক কাজ উপেক্ষা করা নিজেই অনৈতিক হিসাবে দেখা হবে। আপনি যখন নীতিগত বলে মনে করেন এমন কোনও কাজের প্রতি কীভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন তা নির্ধারণ করার সময় আপনি এমন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন যা কীভাবে একটি স্মারকলিপি শুরু করবেন যেখানে আপনি এমন একটি পদক্ষেপের সুপারিশ করবেন যা আপনার পাঠকদের দ্বিমত পোষণ করবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন।
<u>আপনার চাকরির ঝুঁকি না নিয়ে অনৈতিক অনুশীলন পরিবর্তনের জন্য 3 কৌশল</u>
- পরিবর্তনের বীজ বপন করুন
- অভিযোগের পরিবর্তে যুক্তি ব্যবহার করুন
- অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য উন্মুক্ত থাকুন
আপনি একদিন এমন একটি অনুশীলন প্রত্যক্ষ করতে পারেন যা এতটাই জঘন্য যে এটি বন্ধ করার জন্য আপনি ভবিষ্যতে পদোন্নতি এবং এমনকি আপনার চাকরির ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক হবেন। আপনি যদি নিজেকে সেই পরিস্থিতিতে পান, তাহলে আপনার কোম্পানির ভিতরে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাহায্য নিন। আপনি যে অনুশীলনের বিরুদ্ধে আপত্তি করেন তা যদি আইন বা সরকারী নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘন করে, তাহলে উপযুক্ত সংস্থাকে সতর্ক করুন। এটিকে হুইসেল ব্লোয়িং বলা হয়। হুইসেল ব্লোয়িংকে রক্ষা করার জন্য কিছু রাজ্য এবং ফেডারেল আইন রয়েছে।
==নিজেকে জিজ্ঞাসা করার জন্য ১০টি প্রশ্ন==
আপনার চিঠি, ই-মেইল এবং অন্যান্য নিয়মিত যোগাযোগের পরিকল্পনা করার সময় নিজেকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করুন:
# আমি এই ব্যক্তিকে কতটা ভালোভাবে চিনি?
# চিঠিতে আলোচিত বিষয় সম্পর্কে তারা কতটা জানে?
# আমি যা বলতে চাই তার প্রতি তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? ফার্মের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে আমি এই যোগাযোগটি কীভাবে ব্যবহার করতে পারি?
# এই বার্তাটি দিয়ে আমি ঠিক কী অর্জন করার চেষ্টা করছি?
# আলোচিত ধারণাগুলি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্তর কী?
# আমার এবং ফার্মের প্রতি তাদের মনোভাব কী?
# তাদের সাথে আমার/আমাদের পূর্ববর্তী কোন ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল?
# তাদের প্রোফাইলের উপর ভিত্তি করে আমার কতটা এবং কী ধরণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা উচিত?
# আমার বার্তা উপস্থাপনে আমি কতটা প্রযুক্তিগত হতে পারি?
# এই বার্তাটি সহজে পড়া এবং বোঝার জন্য আমি কী কৌশল ব্যবহার করতে পারি?
{{BookCat}}
os8op3c61s0eshzymla6yo7btch45vw
দর্শনের সাথে পরিচয়/অভিজ্ঞতাবাদ
0
26358
85543
82113
2025-07-01T17:59:01Z
MdsShakil
7280
85543
wikitext
text/x-wiki
অভিজ্ঞতাবাদ হল একটি দার্শনিক ধারণা যার ভিত্তি হল যে বিশ্ব সম্পর্কে সমস্ত নির্ভরযোগ্য জ্ঞান অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়। বিখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন হিউম (Hume), লক (Locke) এবং বার্কলে (Berkley)। এই দার্শনিক তত্ত্বটি এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি যে ব্যক্তিরা Tabula rasa, যার অর্থ কোনো অন্তর্নিহিত মানসিক বিষয়বস্তুহীন, নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমরা কোনো অন্তর্নিহিত মানসিক বিষয়বস্তু ছাড়াই জন্মগ্রহণ করি এবং সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞান আমাদের জীবন জুড়ে প্রাপ্ত উপলব্ধি থেকে আসে। অভিজ্ঞতাবাদের আন্দোলন আংশিকভাবে ডেসকার্টস (Descartes) এবং স্পিনোজা (Spinoza) কর্তৃক প্রস্তাবিত যুক্তিবাদ এর প্রত্যান্দোলন ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে আরোহী (অর্থাৎ কার্য থেকে কারণ নির্ণায়ক) বা posteriori বলা হয়।
{{বইয়ের_বিষয়শ্রেণী}}
nq6dldn81djo7uxkgsew54ou8d5tz3e
পেশাদার ও কারিগরি লেখনী/নকশা/প্রারম্ভিক অংশ
0
26409
85520
85308
2025-07-01T15:15:28Z
Mehedi Abedin
7113
85520
wikitext
text/x-wiki
=প্রারম্ভিক অংশ: বিষয়বস্তু, তালিকা এবং আরও অনেক কিছু=
কোনও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে ফ্রন্ট ম্যাটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, তা সে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির গবেষণার জন্য হোক বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিবেদনের জন্য। আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয় তৈরি করার সময় ফন্টের আকার, ফন্টের ধরণ, বিন্যাস এবং সংগঠনের মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলিও বিবেচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অপরিহার্য। একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ পাঠককে প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি কী সম্পর্কে হবে তা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
এই উপাদানগুলিকে প্রায়শই "বইয়ের উপাদান" বলা হয়, কারণ এগুলি সাধারণত বৃহত্তর রচনাগুলিতে পাওয়া যায়।
আপনার প্রকাশনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা উচিত। ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, আপনার পাঠকরা কীভাবে প্রতিবেদনটি ব্যবহার করবেন এবং তারা কী খুঁজবেন তা বিবেচনা করা উচিত এবং এটি খুঁজে পাওয়া সহজ করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
==প্রচ্ছদ==
একটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হল পাঠকের কাছে আপনার প্রতিবেদনটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি খুব সহজ, সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত উপায়। এতে থাকা উচিত:
* একটি বৃহৎ নির্দিষ্ট শিরোনাম
* কোম্পানির নাম
* লেখক(দের) নাম
* প্রতিবেদনের তারিখ
* প্রাসঙ্গিক ছবি
একটি বা দুটি প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার একটি লক্ষ্য হল তথ্যবহুল এবং মাপযোগ্য হওয়া কারণ একবার এটি ফাইল করা হয়ে গেলে, অন্যান্য প্রতিবেদনের স্তুপ থেকে এটি বেছে নেওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে তুলে ধরা। যদি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদটি বিষণ্ণ এবং নিস্তেজ দেখায়, তাহলে পাঠক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তে শুরু করবেন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যবহৃত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার মতো একটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ভাবুন। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটিই প্রথম দেখা যায়। এটি ভালো বা খারাপ উভয়ের জন্যই প্রথম ছাপের ভিত্তি হবে। প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে দেখানোর একটি সহজ উপায় হল প্রতিবেদনের জন্য এমন একটি থিম ব্যবহার করা যার সাথে আপনার দর্শকরা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ম্যাকডোনাল্ডসে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়, তাহলে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি হলুদ এবং লাল রঙে থাকবে এবং সোনালী খিলানগুলি ছবি হিসাবে থাকবে। পাঠকের বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ যে তিনিই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
==শিরোনাম পৃষ্ঠা==
একটি শিরোনাম পৃষ্ঠা আপনার প্রচ্ছদের সাথে খুব মিল থাকবে '''এবং এটি প্রচ্ছদের তথ্য পুনরাবৃত্তি করবে, তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যোগ করবে। '''- এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন নম্বর, তারিখ, শিরোনাম, লেখকদের নাম এবং ঠিকানা, নির্দিষ্ট চুক্তির তথ্য, তত্ত্বাবধায়কের নাম এবং ঠিকানা এবং প্রতিবেদনটি সমর্থনকারী সংস্থার নাম এবং ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে (টেকনিক্যাল কমিউনিকেশনস, পৃ. ৩১২)
শিরোনাম পৃষ্ঠাটি নথি এবং এর লেখকদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট, বিস্তারিত তথ্য প্রদানের একটি সুযোগ যা এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
{{SAMPLE|sampletext=Sample Draft
(Document number) 10-1
(Date) March 7, 2010
(Title)
The Madden Project
By
(Author)
John Manning
Brett Peterson
1234 Touch Down Lane
Miami, Fl 57897
Madden Inc
And
(Place to Contact)
Madden Inc. No. 54321
Project officer
(Who’s in charge)
Ari Washington
Manager of Exploratory Research
6667 Prime Time Court
Mendota Heights, MN 55178
(Who paid for the project)
Football Cooperation
The Department of Research and Development
1812 Legacy Drive
Columbus, OH 99121
|caption=Sample Draft}}
==কার্যনির্বাহী সারাংশ বা সারসংক্ষেপ==
ব্যবসায়িক জগতে সারাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একজন ব্যবস্থাপককে আপনার নথির মূল বিষয়গুলি শিখতে সাহায্য করবে এবং পাঠককে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে যে সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তারা যা খুঁজছেন তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিনা। তথ্যবহুল তথ্য প্রদর্শনকারী চার্ট এবং গ্রাফগুলির সহায়ক চিত্র যা ডকুমেন্টের এই অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা উচিত, কিন্তু প্রতিটির মূল বিষয়গুলি নয়। এখানে আপনার প্রতিবেদনের বেশিরভাগ মূল শব্দ ব্যবহার করা হবে এবং এটি কভার করা তথ্যের একটি পূর্বরূপ হবে। প্রায়শই, একটি ডাটাবেসে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় সারাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এই অংশে আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি চিত্রিত করা কার্যকর হতে পারে।
সারাংশ সর্বদা একটি পৃষ্ঠা বা তার কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে তথ্যবহুল পরিস্থিতিতে। সাধারণত একটি সারাংশ মোট প্রতিবেদনের ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
টেকনিক্যাল কমিউনিকেশন টেক্সট অনুসারে,
* উদ্দিষ্ট শ্রোতাদের চিহ্নিত করুন
* বিষয়বস্তু বর্ণনা করুন
* পাঠককে তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলুন
==সূচীপত্র==
যেকোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণে, বিষয়বস্তুর একটি সারণী প্রতিবেদনটির দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু দীর্ঘ প্রতিবেদনে গ্রাফের একটি সারণী অথবা চিত্রের একটি সারণীও থাকতে পারে।
সারাংশ ছাড়াও, এটি পাঠককে আপনার কভার করা বিষয়গুলি দ্রুত নিরীক্ষণ করার অনুমতি দেবে। যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন তাহলেও তাতে সাহায্য করবে। সঠিক শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম ব্যবহার করলে পাঠকরা আপনার নথিতে থাকা সমস্ত তথ্যের একটি ভালো ধারণা পাবেন।
সূচীপত্র সাধারণত অত্যন্ত সাধারণ এবং একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যবহারকারীর দিকনির্দেশনার সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। সূচীপত্র মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড থেকে ফর্ম্যাট করা যেতে পারে।
উদাহরণ: [http://www.chicagomanualofstyle.org/ch01/ch01_fig07.html শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল: সূচীপত্র: ফর্ম্যাটিং]
== চিত্র এবং সারণির তালিকা==
এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দরকারী বিভাগ কারণ আপনার ছবি বা সারণি আপনার লেখার মধ্যে বারবার উল্লেখ করা হয়। আপনার নিবন্ধটি প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার বেশি হলে চিত্র এবং সারণির তালিকা অন্তর্ভুক্ত করুন। যখন ছবিগুলিকে একসাথে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয় তখন এটি তাদের মধ্যে সহজে তুলনা করার অনুমতি দেয়।
{{BookCat}}
l63f47o43za9t3wjzuogibeo5y2w5vq
85521
85520
2025-07-01T15:18:33Z
Mehedi Abedin
7113
85521
wikitext
text/x-wiki
=প্রারম্ভিক অংশ: বিষয়বস্তু, তালিকা এবং আরও অনেক কিছু=
কোনও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, তা সে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির গবেষণার জন্য হোক বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিবেদনের জন্য। আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয় তৈরি করার সময় ফন্টের আকার, ফন্টের ধরণ, বিন্যাস এবং সংগঠনের মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলিও বিবেচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অপরিহার্য। একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ পাঠককে প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি কী সম্পর্কে হবে তা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
এই উপাদানগুলিকে প্রায়শই "বইয়ের উপাদান" বলা হয়, কারণ এগুলি সাধারণত বৃহত্তর রচনাগুলিতে পাওয়া যায়।
আপনার প্রকাশনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা উচিত। ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, আপনার পাঠকরা কীভাবে প্রতিবেদনটি ব্যবহার করবেন এবং তারা কী খুঁজবেন তা বিবেচনা করা উচিত এবং এটি খুঁজে পাওয়া সহজ করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
==প্রচ্ছদ==
একটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হল পাঠকের কাছে আপনার প্রতিবেদনটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি খুব সহজ, সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত উপায়। এতে থাকা উচিত:
* একটি বৃহৎ নির্দিষ্ট শিরোনাম
* কোম্পানির নাম
* লেখক(দের) নাম
* প্রতিবেদনের তারিখ
* প্রাসঙ্গিক ছবি
একটি বা দুটি প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার একটি লক্ষ্য হল তথ্যবহুল এবং মাপযোগ্য হওয়া, কারণ একবার এটি ফাইল করা হয়ে গেলে অন্যান্য প্রতিবেদনের স্তুপ থেকে এটি বেছে নেওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে তুলে ধরা। যদি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদটি বিষণ্ণ এবং নিস্তেজ দেখায়, তাহলে পাঠক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তে শুরু করবেন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যবহৃত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার মতো একটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ভাবুন। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটিই প্রথম দেখা যায়। এটি ভালো বা খারাপ উভয়ের জন্যই প্রথম ছাপের ভিত্তি হবে। প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে দেখানোর একটি সহজ উপায় হল প্রতিবেদনের জন্য এমন একটি থিম ব্যবহার করা যার সাথে আপনার দর্শকরা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ম্যাকডোনাল্ডসে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়, তাহলে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি হলুদ এবং লাল রঙে থাকবে এবং সোনালী খিলানগুলি ছবি হিসাবে থাকবে। পাঠকের বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ যে তিনিই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
==শিরোনাম পৃষ্ঠা==
একটি শিরোনাম পৃষ্ঠা আপনার প্রচ্ছদের সাথে খুব মিল থাকবে '''এবং এটি প্রচ্ছদের তথ্য পুনরাবৃত্তি করবে, তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যোগ করবে। '''- এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন নম্বর, তারিখ, শিরোনাম, লেখকদের নাম এবং ঠিকানা, নির্দিষ্ট চুক্তির তথ্য, তত্ত্বাবধায়কের নাম এবং ঠিকানা এবং প্রতিবেদনটি সমর্থনকারী সংস্থার নাম এবং ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে (টেকনিক্যাল কমিউনিকেশনস, পৃ. ৩১২)
শিরোনাম পৃষ্ঠাটি নথি এবং এর লেখকদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট, বিস্তারিত তথ্য প্রদানের একটি সুযোগ যা এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
{{SAMPLE|sampletext=Sample Draft
(Document number) 10-1
(Date) March 7, 2010
(Title)
The Madden Project
By
(Author)
John Manning
Brett Peterson
1234 Touch Down Lane
Miami, Fl 57897
Madden Inc
And
(Place to Contact)
Madden Inc. No. 54321
Project officer
(Who’s in charge)
Ari Washington
Manager of Exploratory Research
6667 Prime Time Court
Mendota Heights, MN 55178
(Who paid for the project)
Football Cooperation
The Department of Research and Development
1812 Legacy Drive
Columbus, OH 99121
|caption=Sample Draft}}
==কার্যনির্বাহী সারাংশ বা সারসংক্ষেপ==
ব্যবসায়িক জগতে সারাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একজন ব্যবস্থাপককে আপনার নথির মূল বিষয়গুলি শিখতে সাহায্য করবে এবং সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তারা যা খুঁজছেন তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিনা তা পাঠককে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। তথ্যবহুল তথ্য প্রদর্শনকারী চার্ট এবং গ্রাফগুলির সহায়ক চিত্র যা নথির এই অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা উচিত, কিন্তু প্রতিটির মূল বিষয়গুলি নয়। এখানে আপনার প্রতিবেদনের বেশিরভাগ মূল শব্দ ব্যবহার করা হবে এবং এটি কভার করা তথ্যের একটি পূর্বরূপ হবে। প্রায়শই, একটি ডাটাবেসে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় সারাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এই অংশে আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি চিত্রিত করা কার্যকর হতে পারে।
সারাংশ সর্বদা একটি পৃষ্ঠা বা তার কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে তথ্যবহুল পরিস্থিতিতে। সাধারণত একটি সারাংশ মোট প্রতিবেদনের ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
টেকনিক্যাল কমিউনিকেশন টেক্সট অনুসারে,
* উদ্দিষ্ট শ্রোতাদের চিহ্নিত করুন
* বিষয়বস্তু বর্ণনা করুন
* পাঠককে তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলুন
==সূচীপত্র==
যেকোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণে বিষয়বস্তুর একটি সারণী প্রতিবেদনটির দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু দীর্ঘ প্রতিবেদনে গ্রাফের একটি সারণী অথবা চিত্রের একটি সারণীও থাকতে পারে।
সারাংশ ছাড়াও এটি পাঠককে আপনার কভার করা বিষয়গুলি দ্রুত নিরীক্ষণ করার অনুমতি দেবে। যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন তাহলেও তাতে সাহায্য করবে। সঠিক শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম ব্যবহার করলে পাঠকরা আপনার নথিতে থাকা সমস্ত তথ্যের একটি ভালো ধারণা পাবেন।
সূচীপত্র সাধারণত অত্যন্ত সাধারণ এবং একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যবহারকারীর দিকনির্দেশনার সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। সূচীপত্র মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড থেকে ফর্ম্যাট করা যেতে পারে।
উদাহরণ: [http://www.chicagomanualofstyle.org/ch01/ch01_fig07.html শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল: সূচীপত্র: ফর্ম্যাটিং]
== চিত্র এবং সারণির তালিকা==
এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দরকারী বিভাগ কারণ আপনার ছবি বা সারণি আপনার লেখার মধ্যে বারবার উল্লেখ করা হয়। আপনার নিবন্ধটি প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার বেশি হলে চিত্র এবং সারণির তালিকা অন্তর্ভুক্ত করুন। যখন ছবিগুলিকে একসাথে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয় তখন এটি তাদের মধ্যে সহজে তুলনা করার অনুমতি দেয়।
{{BookCat}}
4zjx0sdwlfmn8dlllehn6dwnlo74ar5
85522
85521
2025-07-01T15:18:56Z
Mehedi Abedin
7113
85522
wikitext
text/x-wiki
=প্রারম্ভিক অংশ: বিষয়বস্তু, তালিকা এবং আরও অনেক কিছু=
কোনও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, তা সে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির গবেষণার জন্য হোক বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিবেদনের জন্য। আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয় তৈরি করার সময় ফন্টের আকার, ফন্টের ধরণ, বিন্যাস এবং সংগঠনের মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলিও বিবেচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অপরিহার্য। একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ পাঠককে প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি কী সম্পর্কে হবে তা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
এই উপাদানগুলিকে প্রায়শই "বইয়ের উপাদান" বলা হয়, কারণ এগুলি সাধারণত বৃহত্তর রচনাগুলিতে পাওয়া যায়।
আপনার প্রকাশনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা উচিত। ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, আপনার পাঠকরা কীভাবে প্রতিবেদনটি ব্যবহার করবেন এবং তারা কী খুঁজবেন তা বিবেচনা করা উচিত এবং এটি খুঁজে পাওয়া সহজ করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
==প্রচ্ছদ==
একটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হল পাঠকের কাছে আপনার প্রতিবেদনটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি খুব সহজ, সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত উপায়। এতে থাকা উচিত:
* একটি বৃহৎ নির্দিষ্ট শিরোনাম
* কোম্পানির নাম
* লেখক(দের) নাম
* প্রতিবেদনের তারিখ
* প্রাসঙ্গিক ছবি
একটি বা দুটি প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার একটি লক্ষ্য হল তথ্যবহুল এবং মাপযোগ্য হওয়া, কারণ একবার এটি ফাইল করা হয়ে গেলে অন্যান্য প্রতিবেদনের স্তুপ থেকে এটি বেছে নেওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে তুলে ধরা। যদি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদটি বিষণ্ণ এবং নিস্তেজ দেখায়, তাহলে পাঠক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তে শুরু করবেন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যবহৃত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার মতো একটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ভাবুন। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটিই প্রথম দেখা যায়। এটি ভালো বা খারাপ উভয়ের জন্যই প্রথম ছাপের ভিত্তি হবে। প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে দেখানোর একটি সহজ উপায় হল প্রতিবেদনের জন্য এমন একটি থিম ব্যবহার করা যার সাথে আপনার দর্শকরা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ম্যাকডোনাল্ডসে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়, তাহলে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি হলুদ এবং লাল রঙে থাকবে এবং সোনালী খিলানগুলি ছবি হিসাবে থাকবে। পাঠকের বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ যে তিনিই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
==শিরোনাম পৃষ্ঠা==
একটি শিরোনাম পৃষ্ঠা আপনার প্রচ্ছদের সাথে খুব মিল থাকবে '''এবং এটি প্রচ্ছদের তথ্য পুনরাবৃত্তি করবে, তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যোগ করবে। '''- এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন নম্বর, তারিখ, শিরোনাম, লেখকদের নাম এবং ঠিকানা, নির্দিষ্ট চুক্তির তথ্য, তত্ত্বাবধায়কের নাম এবং ঠিকানা এবং প্রতিবেদনটি সমর্থনকারী সংস্থার নাম এবং ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে (টেকনিক্যাল কমিউনিকেশনস, পৃ. ৩১২)
শিরোনাম পৃষ্ঠাটি নথি এবং এর লেখকদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট, বিস্তারিত তথ্য প্রদানের একটি সুযোগ যা এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
{{SAMPLE|sampletext=Sample Draft
(Document number) 10-1
(Date) March 7, 2010
(Title)
The Madden Project
By
(Author)
John Manning
Brett Peterson
1234 Touch Down Lane
Miami, Fl 57897
Madden Inc
And
(Place to Contact)
Madden Inc. No. 54321
Project officer
(Who’s in charge)
Ari Washington
Manager of Exploratory Research
6667 Prime Time Court
Mendota Heights, MN 55178
(Who paid for the project)
Football Cooperation
The Department of Research and Development
1812 Legacy Drive
Columbus, OH 99121
|caption=নমুনা খসড়া}}
==কার্যনির্বাহী সারাংশ বা সারসংক্ষেপ==
ব্যবসায়িক জগতে সারাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একজন ব্যবস্থাপককে আপনার নথির মূল বিষয়গুলি শিখতে সাহায্য করবে এবং সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তারা যা খুঁজছেন তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিনা তা পাঠককে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। তথ্যবহুল তথ্য প্রদর্শনকারী চার্ট এবং গ্রাফগুলির সহায়ক চিত্র যা নথির এই অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা উচিত, কিন্তু প্রতিটির মূল বিষয়গুলি নয়। এখানে আপনার প্রতিবেদনের বেশিরভাগ মূল শব্দ ব্যবহার করা হবে এবং এটি কভার করা তথ্যের একটি পূর্বরূপ হবে। প্রায়শই, একটি ডাটাবেসে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় সারাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এই অংশে আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি চিত্রিত করা কার্যকর হতে পারে।
সারাংশ সর্বদা একটি পৃষ্ঠা বা তার কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে তথ্যবহুল পরিস্থিতিতে। সাধারণত একটি সারাংশ মোট প্রতিবেদনের ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
টেকনিক্যাল কমিউনিকেশন টেক্সট অনুসারে,
* উদ্দিষ্ট শ্রোতাদের চিহ্নিত করুন
* বিষয়বস্তু বর্ণনা করুন
* পাঠককে তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলুন
==সূচীপত্র==
যেকোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণে বিষয়বস্তুর একটি সারণী প্রতিবেদনটির দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু দীর্ঘ প্রতিবেদনে গ্রাফের একটি সারণী অথবা চিত্রের একটি সারণীও থাকতে পারে।
সারাংশ ছাড়াও এটি পাঠককে আপনার কভার করা বিষয়গুলি দ্রুত নিরীক্ষণ করার অনুমতি দেবে। যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন তাহলেও তাতে সাহায্য করবে। সঠিক শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম ব্যবহার করলে পাঠকরা আপনার নথিতে থাকা সমস্ত তথ্যের একটি ভালো ধারণা পাবেন।
সূচীপত্র সাধারণত অত্যন্ত সাধারণ এবং একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যবহারকারীর দিকনির্দেশনার সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। সূচীপত্র মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড থেকে ফর্ম্যাট করা যেতে পারে।
উদাহরণ: [http://www.chicagomanualofstyle.org/ch01/ch01_fig07.html শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল: সূচীপত্র: ফর্ম্যাটিং]
== চিত্র এবং সারণির তালিকা==
এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দরকারী বিভাগ কারণ আপনার ছবি বা সারণি আপনার লেখার মধ্যে বারবার উল্লেখ করা হয়। আপনার নিবন্ধটি প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার বেশি হলে চিত্র এবং সারণির তালিকা অন্তর্ভুক্ত করুন। যখন ছবিগুলিকে একসাথে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয় তখন এটি তাদের মধ্যে সহজে তুলনা করার অনুমতি দেয়।
{{BookCat}}
gqh59kkvb7yidflo6h8jvgnq1gdv8ms
85523
85522
2025-07-01T15:19:20Z
Mehedi Abedin
7113
85523
wikitext
text/x-wiki
=প্রারম্ভিক অংশ বা ফ্রন্ট ম্যাটার: বিষয়বস্তু, তালিকা এবং আরও অনেক কিছু=
কোনও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, তা সে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির গবেষণার জন্য হোক বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিবেদনের জন্য। আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয় তৈরি করার সময় ফন্টের আকার, ফন্টের ধরণ, বিন্যাস এবং সংগঠনের মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলিও বিবেচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অপরিহার্য। একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ পাঠককে প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি কী সম্পর্কে হবে তা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
এই উপাদানগুলিকে প্রায়শই "বইয়ের উপাদান" বলা হয়, কারণ এগুলি সাধারণত বৃহত্তর রচনাগুলিতে পাওয়া যায়।
আপনার প্রকাশনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা উচিত। ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, আপনার পাঠকরা কীভাবে প্রতিবেদনটি ব্যবহার করবেন এবং তারা কী খুঁজবেন তা বিবেচনা করা উচিত এবং এটি খুঁজে পাওয়া সহজ করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
==প্রচ্ছদ==
একটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হল পাঠকের কাছে আপনার প্রতিবেদনটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি খুব সহজ, সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত উপায়। এতে থাকা উচিত:
* একটি বৃহৎ নির্দিষ্ট শিরোনাম
* কোম্পানির নাম
* লেখক(দের) নাম
* প্রতিবেদনের তারিখ
* প্রাসঙ্গিক ছবি
একটি বা দুটি প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার একটি লক্ষ্য হল তথ্যবহুল এবং মাপযোগ্য হওয়া, কারণ একবার এটি ফাইল করা হয়ে গেলে অন্যান্য প্রতিবেদনের স্তুপ থেকে এটি বেছে নেওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে তুলে ধরা। যদি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদটি বিষণ্ণ এবং নিস্তেজ দেখায়, তাহলে পাঠক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তে শুরু করবেন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যবহৃত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার মতো একটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ভাবুন। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটিই প্রথম দেখা যায়। এটি ভালো বা খারাপ উভয়ের জন্যই প্রথম ছাপের ভিত্তি হবে। প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে দেখানোর একটি সহজ উপায় হল প্রতিবেদনের জন্য এমন একটি থিম ব্যবহার করা যার সাথে আপনার দর্শকরা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ম্যাকডোনাল্ডসে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়, তাহলে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি হলুদ এবং লাল রঙে থাকবে এবং সোনালী খিলানগুলি ছবি হিসাবে থাকবে। পাঠকের বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ যে তিনিই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
==শিরোনাম পৃষ্ঠা==
একটি শিরোনাম পৃষ্ঠা আপনার প্রচ্ছদের সাথে খুব মিল থাকবে '''এবং এটি প্রচ্ছদের তথ্য পুনরাবৃত্তি করবে, তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যোগ করবে। '''- এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন নম্বর, তারিখ, শিরোনাম, লেখকদের নাম এবং ঠিকানা, নির্দিষ্ট চুক্তির তথ্য, তত্ত্বাবধায়কের নাম এবং ঠিকানা এবং প্রতিবেদনটি সমর্থনকারী সংস্থার নাম এবং ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে (টেকনিক্যাল কমিউনিকেশনস, পৃ. ৩১২)
শিরোনাম পৃষ্ঠাটি নথি এবং এর লেখকদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট, বিস্তারিত তথ্য প্রদানের একটি সুযোগ যা এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
{{SAMPLE|sampletext=Sample Draft
(Document number) 10-1
(Date) March 7, 2010
(Title)
The Madden Project
By
(Author)
John Manning
Brett Peterson
1234 Touch Down Lane
Miami, Fl 57897
Madden Inc
And
(Place to Contact)
Madden Inc. No. 54321
Project officer
(Who’s in charge)
Ari Washington
Manager of Exploratory Research
6667 Prime Time Court
Mendota Heights, MN 55178
(Who paid for the project)
Football Cooperation
The Department of Research and Development
1812 Legacy Drive
Columbus, OH 99121
|caption=নমুনা খসড়া}}
==কার্যনির্বাহী সারাংশ বা সারসংক্ষেপ==
ব্যবসায়িক জগতে সারাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একজন ব্যবস্থাপককে আপনার নথির মূল বিষয়গুলি শিখতে সাহায্য করবে এবং সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তারা যা খুঁজছেন তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিনা তা পাঠককে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। তথ্যবহুল তথ্য প্রদর্শনকারী চার্ট এবং গ্রাফগুলির সহায়ক চিত্র যা নথির এই অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা উচিত, কিন্তু প্রতিটির মূল বিষয়গুলি নয়। এখানে আপনার প্রতিবেদনের বেশিরভাগ মূল শব্দ ব্যবহার করা হবে এবং এটি কভার করা তথ্যের একটি পূর্বরূপ হবে। প্রায়শই, একটি ডাটাবেসে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় সারাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এই অংশে আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি চিত্রিত করা কার্যকর হতে পারে।
সারাংশ সর্বদা একটি পৃষ্ঠা বা তার কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে তথ্যবহুল পরিস্থিতিতে। সাধারণত একটি সারাংশ মোট প্রতিবেদনের ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
টেকনিক্যাল কমিউনিকেশন টেক্সট অনুসারে,
* উদ্দিষ্ট শ্রোতাদের চিহ্নিত করুন
* বিষয়বস্তু বর্ণনা করুন
* পাঠককে তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলুন
==সূচীপত্র==
যেকোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণে বিষয়বস্তুর একটি সারণী প্রতিবেদনটির দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু দীর্ঘ প্রতিবেদনে গ্রাফের একটি সারণী অথবা চিত্রের একটি সারণীও থাকতে পারে।
সারাংশ ছাড়াও এটি পাঠককে আপনার কভার করা বিষয়গুলি দ্রুত নিরীক্ষণ করার অনুমতি দেবে। যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন তাহলেও তাতে সাহায্য করবে। সঠিক শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম ব্যবহার করলে পাঠকরা আপনার নথিতে থাকা সমস্ত তথ্যের একটি ভালো ধারণা পাবেন।
সূচীপত্র সাধারণত অত্যন্ত সাধারণ এবং একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যবহারকারীর দিকনির্দেশনার সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। সূচীপত্র মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড থেকে ফর্ম্যাট করা যেতে পারে।
উদাহরণ: [http://www.chicagomanualofstyle.org/ch01/ch01_fig07.html শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল: সূচীপত্র: ফর্ম্যাটিং]
== চিত্র এবং সারণির তালিকা==
এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দরকারী বিভাগ কারণ আপনার ছবি বা সারণি আপনার লেখার মধ্যে বারবার উল্লেখ করা হয়। আপনার নিবন্ধটি প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার বেশি হলে চিত্র এবং সারণির তালিকা অন্তর্ভুক্ত করুন। যখন ছবিগুলিকে একসাথে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয় তখন এটি তাদের মধ্যে সহজে তুলনা করার অনুমতি দেয়।
{{BookCat}}
5wxyx6squ2bk6lsme0hgcgurg3yym2s
85524
85523
2025-07-01T15:22:06Z
Mehedi Abedin
7113
85524
wikitext
text/x-wiki
=প্রারম্ভিক অংশ বা ফ্রন্ট ম্যাটার: বিষয়বস্তু, তালিকা এবং আরও অনেক কিছু=
কোনও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, তা সে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির গবেষণার জন্য হোক বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিবেদনের জন্য। আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয় তৈরি করার সময় ফন্টের আকার, ফন্টের ধরণ, বিন্যাস এবং সংগঠনের মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলিও বিবেচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অপরিহার্য। একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ পাঠককে প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি কী সম্পর্কে হবে তা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
এই উপাদানগুলিকে প্রায়শই "বইয়ের উপাদান" বলা হয়, কারণ এগুলি সাধারণত বৃহত্তর রচনাগুলিতে পাওয়া যায়।
আপনার প্রকাশনা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা উচিত। ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য, আপনার পাঠকরা কীভাবে প্রতিবেদনটি ব্যবহার করবেন এবং তারা কী খুঁজবেন তা বিবেচনা করা উচিত এবং এটি খুঁজে পাওয়া সহজ করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
==প্রচ্ছদ==
একটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হল পাঠকের কাছে আপনার প্রতিবেদনটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি খুব সহজ, সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত উপায়। এতে থাকা উচিত:
* একটি বৃহৎ নির্দিষ্ট শিরোনাম
* কোম্পানির নাম
* লেখক(দের) নাম
* প্রতিবেদনের তারিখ
* প্রাসঙ্গিক ছবি
একটি বা দুটি প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার একটি লক্ষ্য হল তথ্যবহুল এবং মাপযোগ্য হওয়া, কারণ একবার এটি ফাইল করা হয়ে গেলে অন্যান্য প্রতিবেদনের স্তুপ থেকে এটি বেছে নেওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে তুলে ধরা। যদি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদটি বিষণ্ণ এবং নিস্তেজ দেখায়, তাহলে পাঠক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তে শুরু করবেন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যবহৃত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার মতো একটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ভাবুন। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটিই প্রথম দেখা যায়। এটি ভালো বা খারাপ উভয়ের জন্যই প্রথম ছাপের ভিত্তি হবে। প্রতিবেদনটিকে আলাদা করে দেখানোর একটি সহজ উপায় হল প্রতিবেদনের জন্য এমন একটি থিম ব্যবহার করা যার সাথে আপনার দর্শকরা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ম্যাকডোনাল্ডসে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়, তাহলে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি হলুদ এবং লাল রঙে থাকবে এবং সোনালী খিলানগুলি ছবি হিসাবে থাকবে। পাঠকের বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ যে তিনিই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
==শিরোনাম পৃষ্ঠা==
একটি শিরোনাম পৃষ্ঠা আপনার প্রচ্ছদের সাথে খুব মিল থাকবে '''এবং এটি প্রচ্ছদের তথ্য পুনরাবৃত্তি করবে, তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যোগ করবে। '''- এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন নম্বর, তারিখ, শিরোনাম, লেখকদের নাম এবং ঠিকানা, নির্দিষ্ট চুক্তির তথ্য, তত্ত্বাবধায়কের নাম এবং ঠিকানা এবং প্রতিবেদনটি সমর্থনকারী সংস্থার নাম এবং ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে (টেকনিক্যাল কমিউনিকেশনস, পৃ. ৩১২)
শিরোনাম পৃষ্ঠাটি নথি এবং এর লেখকদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট, বিস্তারিত তথ্য প্রদানের একটি সুযোগ যা এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
{{SAMPLE|sampletext=নমুনা খসড়া
(দলিল নং) ১০-১
(তারিখ) মার্চ ৭, ২০১০
(শিরোনাম)
দ্য ম্যাডেন প্রজেক্ট
লিখেছেন
জন ম্যানিং
ব্রেট পিটারসন
১২৩৪ টাচ ডাউন লেন
মিয়ামি, ফ্লোরিডা ৫৭৮৯৭
ম্যাডেন ইনক.
এবং
(যোগাযোগের স্থান)
ম্যাডেন ইনক. নং ৫৪৩২১
প্রকল্প কর্মকর্তা
(দায়িত্বে যিনি আছেন)
আরি ওয়াশিংটন
পরীক্ষামূলক গবেষণার ব্যবস্থাপক
৬৬৬৭ প্রাইম টাইম কোর্ট
মেনডোটা হাইটস, মিনেসোটা ৫৫১৭৮
(প্রকল্পের যিনি অর্থ প্রদান করেছেন)
ফুটবল কো-অপারেশন
গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ
১৮১২ লিগেসি ড্রাইভ
কলম্বাস, ওহাইও ৯৯১২১
|caption=নমুনা খসড়া}}
==কার্যনির্বাহী সারাংশ বা সারসংক্ষেপ==
ব্যবসায়িক জগতে সারাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একজন ব্যবস্থাপককে আপনার নথির মূল বিষয়গুলি শিখতে সাহায্য করবে এবং সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তারা যা খুঁজছেন তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিনা তা পাঠককে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। তথ্যবহুল তথ্য প্রদর্শনকারী চার্ট এবং গ্রাফগুলির সহায়ক চিত্র যা নথির এই অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা উচিত, কিন্তু প্রতিটির মূল বিষয়গুলি নয়। এখানে আপনার প্রতিবেদনের বেশিরভাগ মূল শব্দ ব্যবহার করা হবে এবং এটি কভার করা তথ্যের একটি পূর্বরূপ হবে। প্রায়শই, একটি ডাটাবেসে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করার সময় সারাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এই অংশে আপনার প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি চিত্রিত করা কার্যকর হতে পারে।
সারাংশ সর্বদা একটি পৃষ্ঠা বা তার কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে তথ্যবহুল পরিস্থিতিতে। সাধারণত একটি সারাংশ মোট প্রতিবেদনের ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
টেকনিক্যাল কমিউনিকেশন টেক্সট অনুসারে,
* উদ্দিষ্ট শ্রোতাদের চিহ্নিত করুন
* বিষয়বস্তু বর্ণনা করুন
* পাঠককে তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলুন
==সূচীপত্র==
যেকোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণে বিষয়বস্তুর একটি সারণী প্রতিবেদনটির দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু দীর্ঘ প্রতিবেদনে গ্রাফের একটি সারণী অথবা চিত্রের একটি সারণীও থাকতে পারে।
সারাংশ ছাড়াও এটি পাঠককে আপনার কভার করা বিষয়গুলি দ্রুত নিরীক্ষণ করার অনুমতি দেবে। যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন তাহলেও তাতে সাহায্য করবে। সঠিক শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম ব্যবহার করলে পাঠকরা আপনার নথিতে থাকা সমস্ত তথ্যের একটি ভালো ধারণা পাবেন।
সূচীপত্র সাধারণত অত্যন্ত সাধারণ এবং একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যবহারকারীর দিকনির্দেশনার সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। সূচীপত্র মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড থেকে ফর্ম্যাট করা যেতে পারে।
উদাহরণ: [http://www.chicagomanualofstyle.org/ch01/ch01_fig07.html শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল: সূচীপত্র: ফর্ম্যাটিং]
== চিত্র এবং সারণির তালিকা==
এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দরকারী বিভাগ কারণ আপনার ছবি বা সারণি আপনার লেখার মধ্যে বারবার উল্লেখ করা হয়। আপনার নিবন্ধটি প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার বেশি হলে চিত্র এবং সারণির তালিকা অন্তর্ভুক্ত করুন। যখন ছবিগুলিকে একসাথে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয় তখন এটি তাদের মধ্যে সহজে তুলনা করার অনুমতি দেয়।
{{BookCat}}
bq8znjzhj1f8a1xslym7k3m1rv898e1
দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ
0
26587
85532
82603
2025-07-01T15:35:48Z
Mehedi Abedin
7113
Mehedi Abedin [[দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ]] কে [[দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]] শিরোনামে স্থানান্তর করেছেন
82603
wikitext
text/x-wiki
স্বাধীনতাবাদের মূল ভিত্তি হলো স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাস। স্বাধীনতাবাদীরা সাধারণত এই স্বাধীনতাকে দুটি ক্ষেত্রে ভাগ করেন: সামাজিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সামাজিক স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে মুক্তভাবে মত প্রকাশের অধিকার বা নিপীড়নের ভয় ছাড়াই সমকামী হওয়ার স্বাধীনতা, আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে মুক্ত বাজারে ব্যবসা করার সুযোগ যেখানে অতিরিক্ত কর, আমদানি/রপ্তানির শুল্ক, কিংবা কঠোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বাধা নেই।
স্বাধীনতাবাদীরা এমন একটি সরকার চায় যা অর্থনীতি এবং ব্যক্তিগত সামাজিক স্বাধীনতার ওপর খুব কম বা ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতাবাদ যেখানে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তা হলো: কিছু স্বাধীনতাবাদী দার্শনিক সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব (social contract theory) — যা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে — সেটির বৈধতাকেই অস্বীকার করেন এবং যুক্তি দেন যে, রাষ্ট্র ছাড়াও একটি অ্যানার্কো-ক্যাপিটালিস্ট (anarcho-capitalist) বিকল্প বিদ্যমান থাকতে পারে বা থাকা উচিত। স্বাধীনতাবাদী দার্শনিক রবার্ট নোজিক এমন এক ধরণের সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দেন, যা পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজারভিত্তিক হলেও একটি ন্যূনতম, তথাকথিত "নাইটওয়াচম্যান" রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়। এই ধরণের তত্ত্বের অনুসারীদের বলা হয় "মিনার্কিস্ট" (minarchists), এবং নোজিক ও উদারপন্থী দার্শনিক জন রলসের মধ্যে বিতর্কটি [[Introduction to Philosophy/Liberalism|উদারতাবাদ]] সংক্রান্ত পাতায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
অবশেষে, স্বাধীনতাবাদীরা নানাবিধ নৈতিক দাবি করে থাকেন—যেমন: "কর আরোপ করা মানে চুরি করা"। আইন র্যান্ড (Ayn Rand) একটি স্বার্থপরতাবাদী (egoism) নৈতিক তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দেন, যেখানে বলা হয়, সব নৈতিক কাজ প্রকৃতপক্ষে আত্মস্বার্থ থেকে উদ্ভূত এবং আমাদের উচিত আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে কাজ করা, সেইসব ত্যাগের নৈতিকতার পরিবর্তে যেগুলো তিনি "পরার্থবাদ" (altruism) বলে বর্ণনা করেছেন।
== রেফারেন্স ও আরও পাঠের জন্য ==
* {{wikipedia-inline|Libertarianism}}
{{BookCat}}
0b463c7f0nexxxwtkh7ahpxucp222gq
85536
85532
2025-07-01T15:39:35Z
Mehedi Abedin
7113
85536
wikitext
text/x-wiki
উদারনীতিবাদের মূল ভিত্তি হলো স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাস। উদারনীতিবাদীরা সাধারণত এই উদারনীতি দুটি ক্ষেত্রে ভাগ করেন: সামাজিক উদারনীতি এবং অর্থনৈতিক উদারনীতি। সামাজিক উদারনীতির মধ্যে পড়ে মুক্তভাবে মত প্রকাশের অধিকার বা নিপীড়নের ভয় ছাড়াই সমকামী হওয়ার স্বাধীনতা, আর অর্থনৈতিক উদারনীতির মধ্যে রয়েছে মুক্ত বাজারে ব্যবসা করার সুযোগ যেখানে অতিরিক্ত কর, আমদানি/রপ্তানির শুল্ক, কিংবা কঠোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বাধা নেই।
উদারনীতিবাদীরা এমন একটি সরকার চায় যা অর্থনীতি ও ব্যক্তিগত সামাজিক স্বাধীনতার ওপর খুব কম বা ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতাবাদ যেখানে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তা হলো: কিছু উদারনীতিবাদী দার্শনিক সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব (যা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে) সেটির বৈধতাকেই অস্বীকার করেন এবং যুক্তি দেন যে, রাষ্ট্র ছাড়াও বিকল্প হিসেবে একটি নৈরাজ্য-পুঁজিবাদী থাকতে পারে বা থাকা উচিত। উদারনীতিবাদী দার্শনিক রবার্ট নোজিক এমন এক ধরণের সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দেন, যা পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজারভিত্তিক হলেও একটি ন্যূনতম ও তথাকথিত "নাইটওয়াচম্যান" রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়। এই ধরণের তত্ত্বের অনুসারীদের বলা হয় "মিনার্কিস্ট", এবং নোজিক ও উদারপন্থী দার্শনিক জন রলসের মধ্যে বিতর্কটি [[Introduction to Philosophy/Liberalism|উদারতাবাদ]] সংক্রান্ত পাতায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
অবশেষে, স্বাধীনতাবাদীরা নানাবিধ নৈতিক দাবি করে থাকেন—যেমন: "কর আরোপ করা মানে চুরি করা"। আইন র্যান্ড একটি স্বার্থপরতাবাদী নৈতিক তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দেন, যেখানে বলা হয়, সব নৈতিক কাজ প্রকৃতপক্ষে আত্মস্বার্থ থেকে উদ্ভূত এবং আমাদের উচিত আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে কাজ করা, সেইসব ত্যাগের নৈতিকতার পরিবর্তে যেগুলো তিনি "পরার্থবাদ" বলে বর্ণনা করেছেন।
== সূত্র ও আরও পাঠের জন্য ==
* {{wikipedia-inline|উদারনীতিবাদ}}
{{BookCat}}
q1a9d86lotfzjbgvcb08r208xie6uwz
আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ
1
26588
85534
82604
2025-07-01T15:35:49Z
Mehedi Abedin
7113
Mehedi Abedin [[আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ]] কে [[আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]] শিরোনামে স্থানান্তর করেছেন
82604
wikitext
text/x-wiki
{{আলাপ পাতা}}
{{আলাপ পাতা/উইকিবই লিখন প্রতিযোগিতা ২০২৫}}
8vxn9zum7n3tju9ayrerhr25vm4kljv
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)
0
27197
85506
85502
2025-07-01T14:22:17Z
Jonoikobangali
676
85506
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
elqmcgf0l5ab969s7ijqge4h3s2v17x
85514
85506
2025-07-01T14:59:04Z
Jonoikobangali
676
85514
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
qaa5hfyjzs1vx7yv1c14nqdmodhxm45
85516
85514
2025-07-01T15:09:30Z
Jonoikobangali
676
85516
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
kz0u9ptn6nmnvkj2u195mjxsn9chgf6
85527
85516
2025-07-01T15:28:56Z
Jonoikobangali
676
85527
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
rpf9x7357s3yttx377ry223xyw3qvhz
85531
85527
2025-07-01T15:34:24Z
Jonoikobangali
676
85531
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
44yracxon21wrzu8y400gm3pug0pwd8
85539
85531
2025-07-01T15:54:13Z
Jonoikobangali
676
85539
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#মহীধরপাদ|মহীধরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ধামপাদ|ধামপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কঙ্কণ|কঙ্কণ]]
### [[/চর্যাপদ#গুণ্ডরীপাদ|গুণ্ডরীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
n62bj7au1hu5n56fkkudz0p7thxdwuf
85541
85539
2025-07-01T16:04:14Z
Jonoikobangali
676
85541
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#মহীধরপাদ|মহীধরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ধামপাদ|ধামপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কঙ্কণ|কঙ্কণ]]
### [[/চর্যাপদ#গুণ্ডরীপাদ|গুণ্ডরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তাড়কপাদ|তাড়কপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#জয়নন্দী|জয়নন্দী]]
### [[/চর্যাপদ#ঢেণ্ঢণপাদ|ঢেণ্ঢণপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তন্ত্রীপাদ|তন্ত্রীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
ozljtcj2nhfzgnzm1rf4uzwwnef209w
85553
85541
2025-07-02T11:18:12Z
Jonoikobangali
676
85553
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#মহীধরপাদ|মহীধরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ধামপাদ|ধামপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কঙ্কণ|কঙ্কণ]]
### [[/চর্যাপদ#গুণ্ডরীপাদ|গুণ্ডরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তাড়কপাদ|তাড়কপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#জয়নন্দী|জয়নন্দী]]
### [[/চর্যাপদ#ঢেণ্ঢণপাদ|ঢেণ্ঢণপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তন্ত্রীপাদ|তন্ত্রীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
## [[/চর্যাপদ#ভাষা|ভাষা]]
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন|বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]]
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
====বৈষ্ণব পদাবলি: বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস====
# [[/বিদ্যাপতি|বিদ্যাপতি]]
# [[/চণ্ডীদাস|চণ্ডীদাস]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
nnn5ohxotqwayfqjtxrmox7c0m09oti
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)/চর্যাপদ
0
27231
85505
85501
2025-07-01T14:21:52Z
Jonoikobangali
676
/* দারিকপাদ */
85505
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
ctcn4bg30qizai0w5bk390l4nz4zs1n
85513
85505
2025-07-01T14:58:29Z
Jonoikobangali
676
/* ডোম্বীপাদ */
85513
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
9rrszyje4gaeor3xt3vjyb4dkgv01h7
85515
85513
2025-07-01T15:09:05Z
Jonoikobangali
676
/* কুক্কুরীপাদ */
85515
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
ieckfm3aem8gl98gh5vjm74u63dgo1y
85526
85515
2025-07-01T15:28:03Z
Jonoikobangali
676
/* চাটিলপাদ */
85526
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
lyc2vmr1je8spm6q5ytqg0zuwu4pi7f
85530
85526
2025-07-01T15:33:49Z
Jonoikobangali
676
/* বীণাপাদ */
85530
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
80y5kavkyf5kj5tjbemiz1hy01hq8nk
85538
85530
2025-07-01T15:52:32Z
Jonoikobangali
676
/* ভাদেপাদ */
85538
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
surmiixarzjvlssak4xeteugnjuwk5o
85540
85538
2025-07-01T16:02:25Z
Jonoikobangali
676
/* গুণ্ডরীপাদ */
85540
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
ac8sjj048c7zjrwqn2mws92ohzd5t3z
85546
85540
2025-07-02T09:45:36Z
Jonoikobangali
676
/* ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব */
85546
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
hedlf2e3k4nbwfrqjxfbfg50a0berjj
85547
85546
2025-07-02T09:52:02Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85547
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
sl9gfx1mtidfhgx76o5wfq0okrdglbm
85548
85547
2025-07-02T09:56:15Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85548
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
; (ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, ৯ প্রভৃতি বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় এলেও বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ পার্থক্য রক্ষিত হয় না। চর্যার বানানেও এই বিশেষ লক্ষণটি দেখা যায়। যেমন, চিএ, চিঅ; হোহী, হোহি; লুই, লূই; বোহী, বোহি ইত্যাদি।
# স্বরবর্ণের মতো ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্বতন্ত্র ধ্বনিজ্ঞাপক চিহ্ন থাকলেও বাংলায় সেগুলির উচ্চারণে বিশেষ পার্থক্য নেই। জ-য, ণ-ন, শ-ষ-স ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। চর্যাতেও স্বভাবতই এইসব বর্ণের লিপি-বিপর্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন, জোইনি, যোইনী; যাই, জাই; নাবী, ণাবী; শবর, সবর; শূন, সূণ; ষিআলা, শিয়ালী ইত্যাদি।
# অর্থপার্থক্য সৃষ্টি কিংবা বিশেষ কোনও আবেগ প্রকাশের জন্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। চর্যার ভাষায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, ফাড্ডিঅ, নিঅড্ডী, চ্ছাড়ী ইত্যাদি।
1382phdq728bfqubo3k7t4t3fpw178s
85549
85548
2025-07-02T10:03:37Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85549
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
; (ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, ৯ প্রভৃতি বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় এলেও বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ পার্থক্য রক্ষিত হয় না। চর্যার বানানেও এই বিশেষ লক্ষণটি দেখা যায়। যেমন, চিএ, চিঅ; হোহী, হোহি; লুই, লূই; বোহী, বোহি ইত্যাদি।
# স্বরবর্ণের মতো ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্বতন্ত্র ধ্বনিজ্ঞাপক চিহ্ন থাকলেও বাংলায় সেগুলির উচ্চারণে বিশেষ পার্থক্য নেই। জ-য, ণ-ন, শ-ষ-স ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। চর্যাতেও স্বভাবতই এইসব বর্ণের লিপি-বিপর্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন, জোইনি, যোইনী; যাই, জাই; নাবী, ণাবী; শবর, সবর; শূন, সূণ; ষিআলা, শিয়ালী ইত্যাদি।
# অর্থপার্থক্য সৃষ্টি কিংবা বিশেষ কোনও আবেগ প্রকাশের জন্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। চর্যার ভাষায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, ফাড্ডিঅ, নিঅড্ডী, চ্ছাড়ী ইত্যাদি।
; (খ) রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# বাংলা ভাষার সমস্ত কারকে ‘-এ’ বিভক্তির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। চর্যার ভাষাতেও ‘-এ’ বা ‘-এঁ’ বিভক্তির এইরকম প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, কর্তৃকারকে—কুম্ভীরে খাঅ; কর্মকারকে—গঅবরেঁ তোলিআ; করণকারকে—কুঠারে ছিজঅ; সম্প্রদান কারকে—ধামার্থে চাটিল; অপাদান কারকে—জামে কাম কি কামে জাম; অধিকরণ কারকে—ঘরে সান্ধঅ।
# আধুনিক বাংলায় যেমন কর্ম-কর্তৃ বাচ্য গঠন করা হয়ে থাকে, চর্যাতেও অবিকল তারই প্রতিরূপ দেখা যায়। যেমন, নানা তরুবর মৌলিল রে, ডমরু বাজএ বীরনাদে।
# বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ চর্যাতেও বিভিন্ন কারকে দেখা যায়। যেমন, তৃতীয়াতে ‘-তেঁ’ বিভক্তি (সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই); চতুর্থীতে ‘-রেঁ’ বিভক্তি (সো করউ রস রসানেরে কংখা); ষষ্ঠীতে ‘-র’/‘এর’ বিভক্তি (সাঙ্কমত চড়িলে; দুধিল দুধ কি বেণ্টে ধামায়) ইত্যাদি।
# বাংলার নিজস্ব কিছু অনুসর্গ (মাঝে, অন্তরে, সঙ্গে ইত্যাদি) আছে। চর্যায় এগুলির প্রয়োগও অপ্রতুল নয়। যেমন, কোড়ি মাঝেঁ একু; তোহার অন্তরে; দুজ্জন সাঙ্গে অবসরি জাই ইত্যাদি।
5pka5q71w1te68yfcxru6jx390279ok
85550
85549
2025-07-02T10:15:57Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85550
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
; (ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, ৯ প্রভৃতি বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় এলেও বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ পার্থক্য রক্ষিত হয় না। চর্যার বানানেও এই বিশেষ লক্ষণটি দেখা যায়। যেমন, চিএ, চিঅ; হোহী, হোহি; লুই, লূই; বোহী, বোহি ইত্যাদি।
# স্বরবর্ণের মতো ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্বতন্ত্র ধ্বনিজ্ঞাপক চিহ্ন থাকলেও বাংলায় সেগুলির উচ্চারণে বিশেষ পার্থক্য নেই। জ-য, ণ-ন, শ-ষ-স ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। চর্যাতেও স্বভাবতই এইসব বর্ণের লিপি-বিপর্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন, জোইনি, যোইনী; যাই, জাই; নাবী, ণাবী; শবর, সবর; শূন, সূণ; ষিআলা, শিয়ালী ইত্যাদি।
# অর্থপার্থক্য সৃষ্টি কিংবা বিশেষ কোনও আবেগ প্রকাশের জন্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। চর্যার ভাষায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, ফাড্ডিঅ, নিঅড্ডী, চ্ছাড়ী ইত্যাদি।
; (খ) রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# বাংলা ভাষার সমস্ত কারকে ‘-এ’ বিভক্তির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। চর্যার ভাষাতেও ‘-এ’ বা ‘-এঁ’ বিভক্তির এইরকম প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, কর্তৃকারকে—কুম্ভীরে খাঅ; কর্মকারকে—গঅবরেঁ তোলিআ; করণকারকে—কুঠারে ছিজঅ; সম্প্রদান কারকে—ধামার্থে চাটিল; অপাদান কারকে—জামে কাম কি কামে জাম; অধিকরণ কারকে—ঘরে সান্ধঅ।
# আধুনিক বাংলায় যেমন কর্ম-কর্তৃ বাচ্য গঠন করা হয়ে থাকে, চর্যাতেও অবিকল তারই প্রতিরূপ দেখা যায়। যেমন, নানা তরুবর মৌলিল রে, ডমরু বাজএ বীরনাদে।
# বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ চর্যাতেও বিভিন্ন কারকে দেখা যায়। যেমন, তৃতীয়াতে ‘-তেঁ’ বিভক্তি (সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই); চতুর্থীতে ‘-রেঁ’ বিভক্তি (সো করউ রস রসানেরে কংখা); ষষ্ঠীতে ‘-র’/‘এর’ বিভক্তি (সাঙ্কমত চড়িলে; দুধিল দুধ কি বেণ্টে ধামায়) ইত্যাদি।
# বাংলার নিজস্ব কিছু অনুসর্গ (মাঝে, অন্তরে, সঙ্গে ইত্যাদি) আছে। চর্যায় এগুলির প্রয়োগও অপ্রতুল নয়। যেমন, কোড়ি মাঝেঁ একু; তোহার অন্তরে; দুজ্জন সাঙ্গে অবসরি জাই ইত্যাদি।
# স্বাধীন অব্যয় রূপে উপসর্গের প্রয়োগেও বাংলার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। উপসর্গগুলি অব্যয় হিসেবে বিশেষ্যের পূর্বে বসে বিচিত্র অর্থপ্রকাশে সাহায্য করে। চর্যাপদেও এই লক্ষণ দৃশ্যমান। যেমন, <u>নি</u>সারা, <u>বি</u>আলী, <u>স</u>চ্চড়ে, <u>বি</u>মনা ইত্যাদি।
m0mozry88pzop2qy69u6dae0eyorfzv
85551
85550
2025-07-02T10:22:09Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85551
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
; (ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, ৯ প্রভৃতি বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় এলেও বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ পার্থক্য রক্ষিত হয় না। চর্যার বানানেও এই বিশেষ লক্ষণটি দেখা যায়। যেমন, চিএ, চিঅ; হোহী, হোহি; লুই, লূই; বোহী, বোহি ইত্যাদি।
# স্বরবর্ণের মতো ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্বতন্ত্র ধ্বনিজ্ঞাপক চিহ্ন থাকলেও বাংলায় সেগুলির উচ্চারণে বিশেষ পার্থক্য নেই। জ-য, ণ-ন, শ-ষ-স ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। চর্যাতেও স্বভাবতই এইসব বর্ণের লিপি-বিপর্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন, জোইনি, যোইনী; যাই, জাই; নাবী, ণাবী; শবর, সবর; শূন, সূণ; ষিআলা, শিয়ালী ইত্যাদি।
# অর্থপার্থক্য সৃষ্টি কিংবা বিশেষ কোনও আবেগ প্রকাশের জন্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। চর্যার ভাষায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, ফাড্ডিঅ, নিঅড্ডী, চ্ছাড়ী ইত্যাদি।
; (খ) রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# বাংলা ভাষার সমস্ত কারকে ‘-এ’ বিভক্তির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। চর্যার ভাষাতেও ‘-এ’ বা ‘-এঁ’ বিভক্তির এইরকম প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, কর্তৃকারকে—কুম্ভীরে খাঅ; কর্মকারকে—গঅবরেঁ তোলিআ; করণকারকে—কুঠারে ছিজঅ; সম্প্রদান কারকে—ধামার্থে চাটিল; অপাদান কারকে—জামে কাম কি কামে জাম; অধিকরণ কারকে—ঘরে সান্ধঅ।
# আধুনিক বাংলায় যেমন কর্ম-কর্তৃ বাচ্য গঠন করা হয়ে থাকে, চর্যাতেও অবিকল তারই প্রতিরূপ দেখা যায়। যেমন, নানা তরুবর মৌলিল রে, ডমরু বাজএ বীরনাদে।
# বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ চর্যাতেও বিভিন্ন কারকে দেখা যায়। যেমন, তৃতীয়াতে ‘-তেঁ’ বিভক্তি (সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই); চতুর্থীতে ‘-রেঁ’ বিভক্তি (সো করউ রস রসানেরে কংখা); ষষ্ঠীতে ‘-র’/‘এর’ বিভক্তি (সাঙ্কমত চড়িলে; দুধিল দুধ কি বেণ্টে ধামায়) ইত্যাদি।
# বাংলার নিজস্ব কিছু অনুসর্গ (মাঝে, অন্তরে, সঙ্গে ইত্যাদি) আছে। চর্যায় এগুলির প্রয়োগও অপ্রতুল নয়। যেমন, কোড়ি মাঝেঁ একু; তোহার অন্তরে; দুজ্জন সাঙ্গে অবসরি জাই ইত্যাদি।
# স্বাধীন অব্যয় রূপে উপসর্গের প্রয়োগেও বাংলার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। উপসর্গগুলি অব্যয় হিসেবে বিশেষ্যের পূর্বে বসে বিচিত্র অর্থপ্রকাশে সাহায্য করে। চর্যাপদেও এই লক্ষণ দৃশ্যমান। যেমন, <u>নি</u>সারা, <u>বি</u>আলী, <u>স</u>চ্চড়ে, <u>বি</u>মনা ইত্যাদি।
# আধুনিক বাংলায় ‘সে’ শব্দটি মুখ্যত সর্বনাম হিসেবে, আবার কখনও বা বাক্যালংকার অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্য ভাষায় শব্দটি বসে বিশেষণ ও সর্বনাম হিসেবেই। বাক্যকে অলংকৃত করার উদ্দেশ্যে বাংলা ছাড়া আর কোথাও ‘সে’ বসে না। চর্যায় ‘সে’ ও একই অর্থে ‘সো’-এর ব্যবহার দেখা যায় যত্রতত্র। যেমন, এক সে শুণ্ডিনী, এক সো পদুমা, গুরু বোস সে সীসা কাল ইত্যাদি।
cvlf81pa39zlwnsmwzfib7r37vdiw9h
85552
85551
2025-07-02T11:17:10Z
Jonoikobangali
676
/* ভাষা */
85552
wikitext
text/x-wiki
বিশ শতকের গোড়ায় চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন বাংলার এক অমূল্য লুপ্ত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচ্যবিদ্যার বিশিষ্ট গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু তাঁর ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' পুথি আবিষ্কারের পিছনে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতি চর্চার একটি ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশের অতীত ইতিহাসের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার ও তার নবমূল্যায়ন। এর সূচনা ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় গবেষকেরাই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেমন, বি. এইচ. হজসন ও ড্যানিয়েল রাইট উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুথি উদ্ধার করে ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণ করেন, যার ফলে ইউরোপীয় গবেষকেরা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি গবেষকেরাও এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গবেষক রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু পুথি উদ্ধার করে আনেন এবং ''দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার ইন নেপাল'' (১৮৮২) শীর্ষক পুস্তিকায় সেগুলির নাম প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে শরৎচন্দ্র দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রাচীন পুথি উদ্ধারের ভার গ্রহণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম-বিষয়ক কয়েকটি সংস্কৃত পুথি তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল যাত্রা করে তিনি নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের প্রাচীন পুথি ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'', সরহপাদের ''দোহাকোষ'' ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ''। এই তিনটি পুথির সঙ্গে পূর্বাবিষ্কৃত ''ডাকার্ণব'' পুথিটিকে যুক্ত করে শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি। ভূমিকায় তিনি চারটি পুথির ভাষাকেই বাংলা বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কেবল চর্যাগীতিগুলির ভাষাকেই বাংলা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই দিক থেকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হল এই চর্যাপদ।
চর্যাপদের পুথি তালপাতায় লেখা হয়েছিল। নেপাল থেকে আনা পুথি আবার রাজদরবারে ফেরত দেওয়ার আগে শাস্ত্রী মহাশয় সেটির অনেকগুলি ফোটোকপি করে নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, তালপাতার উভয় পৃষ্ঠাতেই পদগুলি লেখা হয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় আছে পাঁচটি করে টানা লাইন। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁক, সম্ভবত সেখানে ফুটো করে সুতো বা ওই জাতীয় কিছু পরাবার জন্য। পাতাগুলি সংখ্যাযুক্ত এবং সংখ্যাটি লিখিত পাতার শেষ পৃষ্ঠায়। এইভাবে প্রাপ্ত পুথির শেষ পাতার অঙ্ক ৬৯। কিন্তু তার পরেও যে পুথি বাকি ছিল তার প্রমাণ ওই পাতার পদটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায়। শুধু শেষ পাতা নয়, মাঝের ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৬৬ সংখ্যক পাতাগুলিও পাওয়া যায়নি। লুপ্ত পাতা বাদে প্রাপ্ত পুথিটি মোট ৬৪ পৃষ্ঠার। পুথিটিতে আরও একধরনের ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি মোট পদের সংখ্যা নির্দেশক। বলা বাহুল্য, লুপ্ত পাতার পদগুলি পাওয়া যায়নি। এই রকম অপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে তিনটি। শেষ পাতার যে পদসংখ্যা পাওয়া যায় সেটি ৪৯। সেখানেই শুরু হয়েছে ৫০ সংখ্যক পদটি, যার বাকি অংশ লুপ্ত পাতার সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে। মুনিদত্তের টীকার সূত্রে জানা যায়, কোনও একটি শতপদী সংকলন থেকে অর্ধেক সংখ্যক পদ নিয়ে সেটির টীকা রচনার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ চর্যার পুথিটি ছিল মোট ৫০টি পদের সংকলন। সাড়ে তিনটি পদ না পাওয়ায় প্রাপ্ত পদের সংখ্যা এখানে সাড়ে ছেচল্লিশ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। অনুবাদক ছিলেন কীর্তিচন্দ্র। সেই পুথিটি অক্ষত। তার থেকে লুপ্ত সাড়ে তিনটি পদের বিষয় ও তার ব্যাখ্যা জানা গিয়েছে।
টীকার পুথিটি সংকলনে একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে মূল গান ও তার টীকা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত টীকার পুথিতে মূল গান সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সমগ্র পদ উদ্ধৃত করে টীকাকার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পদগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, টীকার ভাষা সংস্কৃত। টীকার নাম ''নির্মলগিরা টীকা''। টীকাকারের নাম মুনিদত্ত। গানগুলি একক পদকর্তার নয়, বিভিন্ন জনের রচনা। প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগের উল্লেখ ও পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। তারপর দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পদটি। সব শেষে রয়েছে তার ব্যাখ্যা বা টীকা। টীকার পরে আছে গানের ক্রমিক সংখ্যা। অবশ্য গ্রন্থসূচনার পদটিতে একটু ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। প্রথমে নমস্ক্রিয়ার পর সদ্গুরু বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ, তারপর “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” পদটির দ্বারা মূল চর্যাগীতির আরম্ভ। তারপর গানটির রাগের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য ধরনের ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ৯ সংখ্যক পদে চর্যাকারের নাম উল্লিখিত হয়নি, যদিও গানের মাঝে ভণিতা থেকে জানা যায় এটি কাহ্নপাদের রচনা। ১০ সংখ্যক চর্যার পরে টীকাকার বা লিপিকর লিখে রেখেছেন, “লাড়ীডোম্বীপাদানাম্ সূনেত্যাদি। চর্য্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি।” অর্থাৎ এখানে অপেক্ষিত ব্যাখ্যাটি নেই। তাছাড়া মূল গানগুলির পাঠ ও টীকায় উদ্ধৃত অংশগুলির পাঠে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, মূল গান সংকলন ও তার টীকা রচনা দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাজ। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন, মুনিদত্তের টীকা পরে কারও দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই পরবর্তী সংস্কার-কর্তাও অন্য কোনও গীতিসংগ্রহ থেকে মূল গানগুলিকে নিয়ে ব্যাখ্যার আগে সংযোজিত করে থাকতে পারেন। টীকারম্ভের প্রথম বাক্যটি রচনা এবং গানের সূচনায় কবি ও রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ সম্ভবত এই সংস্কার-কর্তারই কাজ। পুথির পাঁচটি পাতা হারিয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক গানের ছটি চরণ এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৩ ও ২৪ সংখ্যক গানের সম্পূর্ণ টীকা এবং ২৫ সংখ্যক গানের টীকার প্রথমাংশটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ৪৭ সংখ্যক গানের ব্যাখ্যার সামান্য অংশ হারিয়ে গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক গানের শেষ পদটির ব্যাখ্যা ছাড়া গান সহ সমগ্র টীকাটিই লুপ্ত। তিব্বতি অনুবাদটির আবিষ্কারক ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী গানগুলি সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরে তিব্বতি অনুবাদের ছায়া অনুসরণে ড. সুকুমার সেন লুপ্ত গানগুলির সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করে তাঁর সম্পাদিত ''চর্যাগীতি পদাবলী'' গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
==রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার==
১৯১৬ সালে ''হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা'' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক রকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চর্যাগীতির ভাষা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতান্তর ছিল, তেমনই এগুলির রচনাকাল ও প্রাপ্ত পুথির প্রকৃত নাম নিয়েও ছিল নানা সংশয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন, গানগুলির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম শতক এবং সেই কারণেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামে তিনি ‘হাজার বছরের পুরাণ’ এই সময়-জ্ঞাপক বিশেষণটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সেই কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে মেনে নিতে চাননি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন, চর্যার মূল গানগুলি কোন সময়ে লেখা হয়েছিল? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, টীকা-সম্বলিত যে সংগ্রহটি পাওয়া গিয়েছে, সেটিই বা কোন সময়ে লেখা হয়? মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বলা যায়, গানগুলি আগে লেখা হয়েছিল এবং পরে তার থেকে কয়েকটি গান বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা রচিত হয়। তাই প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে দুটি প্রশ্নের নিরিখে। প্রথমত, চর্যাকারেরা কবে আবির্ভূত হন? এবং দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে চর্যায় প্রাপ্ত ভাষার জন্ম কোন সময়ে? বিভিন্ন গবেষক এই দুই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতির বাস্তব ঐতিহাসিক সকল ঘটনারই লিখিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই চর্যাপদ, চর্যাপদের কবিগণ, তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু এবং সেই সংক্রান্ত তারিখ-যুক্ত কোনও তথ্য পাওয়া কঠিন। তাই জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্য সত্যাসত্য নির্বিশেষে সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। চর্যাকারেরা নিছক কবি বা গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ ধারার সাধক। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁর খ্যাত হয়েছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে। তাঁদের নিয়ে তাই নানা অলৌকিক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলি সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। সুম্পাখন্পো-র ''Pag Sam Jon Zang'' ও লামা তারানাথের ''Khabad Dun Dan'' হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এই সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ। ভারতেও সিদ্ধাচার্যদের নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল। ভারতে যোগী সিদ্ধসাধকদের আবির্ভাব ঘটে। নাথপন্থা ও সহজযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে তাত্ত্বিক এবং দেহসাধনা ও যোগাচারকেন্দ্রিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলির আদান-প্রদান ঘটেছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেহসাধনা এই উভয় মতেরই ভিত্তিস্বরূপ। নাথপন্থীদের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের নাম পাওয়া যায়। ‘চৌরাসী সিদ্ধ’ অর্থাৎ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যেরা মধ্যে ছিয়াত্তর জনের নাম পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে। এছাড়া তন্ত্রগ্রন্থ ''কৌলজ্ঞাননির্ণয়'' এবং নাথপন্থীদের গুরুশিষ্য-পরম্পরা সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতেও সিদ্ধাচার্যেরা কথা অল্পবিস্তর বর্ণিত হয়েছে। ড. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তাঁর ''চর্যাগীতির ভূমিকা'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জনশ্রুতিগুলি যে সব ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে এই লোকপরম্পরাগত ঐতিহ্যের মিল যথেষ্টই আছে।
চর্যাগীতির রচনাকাল বিষয়ে তিনজন বিশিষ্ট গবেষক তিনটি পৃথক মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য যুক্তি প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, “The period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems.” অর্থাৎ তাঁর মতে দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়েছিল। সময় নির্ধারণে তিনি আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও শেষ সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের জীবৎকালকে প্রমাণস্বরূপ ধরেছেন। এই দুই কবির জীবনেতিহাস স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তিই এক্ষেত্রে মুখ্য আশ্রয়। সিদ্ধাচার্যদের একটি গুরুশিষ্য-পরম্পরা ছিল। তিব্বতি ঐতিহ্যে লুইপাদ প্রথম গুরু বা আদি সিদ্ধাচার্য। মুনিদত্তের টীকাতেও লুইপাদকে সেই সম্মান জানিয়ে বলা হয়েছে “শ্রীলূয়ীচরণাদিসুদ্ধ রচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে…” এবং তাঁর পদ দিয়েই গ্রন্থারম্ভ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান লুইপাদের ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। দীপঙ্কর ১০৩৮ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে তিব্বতি যাত্রা করেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮। সেই হিসেবে লুইপাদের আবির্ভাবকাল তাঁর মতে দশম শতকের মাঝামাঝি। অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুসারে কাহ্নপাদ ছিলেন জালন্ধরীপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ রচিত ৩৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ চর্যাগীতি ছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ''হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা''। এই গ্রন্থটির অনুলিপির কাল জানা গিয়েছে। রাজা গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়। তাই সুনীতিকুমার দ্বাদশ শতককেই চর্যাগীতির সময়সীমা ধরতে চান। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই গবেষকেরা বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দীপঙ্কর সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশকের উক্ত তথ্যের তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পি. কর্ডিয়ার ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে লুইপাদ ও দীপঙ্কর উভয়ের নামেই ''অভিসময়বিহঙ্গ'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। আসলে লুইপাদের এই গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা অন্যান্য বৌদ্ধ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে জানা যায় যে, কম্বলাম্বরপাদ, প্রজ্ঞারক্ষিত, সুমতিকীর্তি, প্রভাকরগুপ্ত, রত্নবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্রের ন্যায় অসংখ্য বৌদ্ধ পণ্ডিত এই গ্রন্থটির উপর নানা সময়ে বৃত্তি, ক্রম, মঞ্জরী, টীকা ইত্যাদি রচনা করেন। দীপঙ্করের নাম এভাবেই উল্লিখিত হতে পারে। তিনি লুইপাদকে সরাসরি গ্রন্থরচনায় সাহায্য করেননি, বরং লুইপাদের গ্রন্থটির অনুবাদ করেছিলেন মাত্র। অন্যদিকে কাহ্নপাদের গ্রন্থটির অনুলিপির কাল ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ স্থিরীকৃত হলেও অনুলিপির সময় যে লেখকের জীবৎকালের কাছাকাছি হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ষোড়শ শতকের কোনও গ্রন্থের অনুলিপি অষ্টাদশ শতকেও হতে দেখা গিয়েছে। এইসব বিরুদ্ধ যুক্তির বলে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তা হিন্দিভাষী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি ''দোহাকোষ''-এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, সিদ্ধাচার্যেরা আবির্ভূত হয়েছিলেন অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। তিনি আরও মনে করেন যে, লুইপাদ নন, আদি সিদ্ধাচার্য ছিলেন রাহুলভদ্র সরহপাদ, যিনি বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক ছিলেন। শান্তরক্ষিত ভোট সম্রাট খি স্রোঙ দে চন্-এর রাজত্বকালে (৭৫৫—৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) রাজার আহ্বানে তিব্বতে গিয়েছিলেন। আর-একটি প্রমাণ হল, সরহপাদের শিক্ষক ছিলেন নালন্দার পণ্ডিত ধর্মকীর্তি, যিনি শান্তরক্ষিতের শিষ্য এবং গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) বন্ধু। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সরহপাদকে অষ্টম শতকের ব্যক্তি বলে গণ্য করা চলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন সরহপাদের প্রশিষ্য—সরহপাদের শিষ্য শবরপাদ, তাঁর শিষ্য লুইপাদ। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ''জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ লেটারস'' (২৮শ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে, সরহপাদের দোহাগুলি ‘বিনষ্ট-প্রণষ্ট’ (‘বিণট্ঠা-পণট্ঠা-পউ’) হতে দেখে দিবাকর চন্দ নামে এক পণ্ডিত ২২১ নেপাল সম্বৎ অর্থাৎ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সেগুলি একটি পুথিতে সংকলিত করেন: “সমস্তো জহালব্ধা দোহাকোসো এসো সংহহিত্ত… পণ্ডিত সিরি দিবাকর চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রাবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং।” এই বিষয়টিও পরোক্ষে প্রমাণ করে যে সরহপাদ খুব প্রাচীন সময়ের কবি; নইলে দ্বাদশ শতকের সূচনাতেই তাঁর ''দোহাকোষ'' বিনষ্ট হতে পারে না।
তৃতীয় মতটি দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে চর্যাপদ রচনার সূচনা সপ্তম শতকে। এই মতের ব্যাখ্যায় তিনি ২১ সংখ্যক গানের টীকায় মুনিদত্ত মীননাথের লেখা একটি গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন: “কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।/ কর্মকূরঙ্গ সমাধিকপট।।” মীননাথ নাথগুরুদের অন্যতম এবং উদ্ধৃত অংশটি লেখা হয়েছে আদি স্তরের বাংলা ভাষায়। মীননাথই মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত। ড. শহীদুল্লাহ এঁকেই লুইপাদ বলে ধরেছেন। ফারসি গবেষক সিলভ্যাঁ লেভি ''লে নেপাল'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে গিয়েছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ এই তথ্যের ভিত্তিতে চর্যাগীতির সূচনাকাল ধরেছেন সপ্তম শতককে। তবে এই মত মানতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষার বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সপ্তম শতক অপভ্রংশ ভাষারই কাল। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ এই ভাষা থেকেই বাংলার মতো নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছিল।
চর্যাপদের কালনির্ণয়ে গৌড়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও বিবেচ্য। এমনকি যে সময়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে মন্ত্রনয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানে পরিণত হল, সেটিও আলোচনা করা কর্তব্য। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আর-একটি বাহ্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। সেটি হল প্রাচীন বাংলা সংগীত-বিষয়ক গ্রন্থের সাক্ষ্য। বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের সাধন-সংক্রান্ত গীতিগুচ্ছ হলেও তাতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়নি। চর্যাগীতির মূল অবলম্বন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের এক বিশেষ বিকারগ্রস্থ রূপ। এই বিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর চারটি বৌদ্ধসংগীতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতান্তর সূচিত করেন। পরিণামে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা পরে সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। দার্শনিক মতভেদের কারণে মহাযানীরাও মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এই যোগাচার মতের উদ্ভব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। সপ্তম শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতে বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে মাধ্যমিক ও যোগাচার মত বিশেষ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এরপর অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বৈদিক তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত ও কুমারিল ভট্টের পূর্ব মীমাংসা দর্শনের চাপে বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অবস্থার সঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে হিন্দু পুরাণের দেবদেবীদের অনুরূপ নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটল এবং ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রহস্যাচার গ্রাস করে ফেলল যোগাচারীদের। তন্ত্রের প্রভাবে দেহসাধনা-নির্ভর বৌদ্ধধর্ম কথিত হল ‘মন্ত্রযান’ নামে, যার শেষ পরিণতি বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাগীতিতে এই শেষোক্ত তিনটি মতেরই ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এসব ঘটতে কমপক্ষে এক শতাব্দীর কেটে যাওয়ার কথা। তাই বলা চলে, নবম শতকের আগে মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এই বিকৃতি ঘটেনি। নতুন তত্ত্ব ও সেই অনুযায়ী আচার-সংস্কার গড়ে উঠলে নবদীক্ষিতদের কাছে এর রহস্যময়তা তথা গূঢ় তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সিদ্ধাচার্যেরা। তাঁদের রচনার ভাষা আলো-আঁধারি সন্ধ্যাভাষা বা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করার জন্য বিশেষ প্রযত্নে নির্মিত ভাষা। যৌনাচার-ভিত্তিক এই যোগসাধনপ্রণালী অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সম্ভবত তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি ছিল বেশ অনুকূল। বাংলার সিংহাসনে তখন আসীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল সম্রাটেরা। এই অনুকূল পরিবেশে বসে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অসংখ্য গ্রন্থ ও পদ রচনা করেন। তাঁদের রচিত অধিকাংশ পদের ভাষা নবসৃজ্যমান বাংলা ভাষা এবং টীকা ও ভাষ্যের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত। অতএব সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে চর্যার মূল গানগুলি রচিত হয়েছিল।
এবার মুনিদত্তের টীকাগ্রন্থটির কাল অনুসন্ধান করা যাক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটি যে বেশ পরবর্তীকালে লিখিত, তা গ্রন্থের বিষয় ও লিপির আদর্শ থেকেই স্পষ্ট। চর্যাগীতিগুলি তত্ত্বের বাহক। কিন্তু সেগুলি এমনই আভিপ্রায়িক বচনে পরিপূর্ণ যে, দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছেও তা দুর্বোধ্য ছিল। তত্ত্ব ও সাংকেতিকতার দুরূহতার জন্য এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন দিল। মুনিদত্তই সেই অগ্রণী বৌদ্ধ পণ্ডিত যিনি একশোটি চর্যার একটি গীতিগুচ্ছ থেকে অর্ধেক পদ নিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থে আছে: “তত্রাহৃতানাং চ বিচারিতানাং চর্যাশতেনাহৃত গীতিকানাম্। সত্ত্বৈস্তু সংবোধি বিচারাণার্থং কোষং বুধাঃ সংরচয়াংবভূবঃ।।” মূল গানগুলি রচিত হওয়ার অনেক পরে যে মুনিদত্তের টীকা লিখিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পুথিতে উদ্ধৃত গীতিগুলির পাঠভেদ। এই বিষয়ে ড. সত্যব্রত দেব লিখেছেন, “মূল গীতিরচনার যুগ হইতে টীকা বা অনুলিপি রচনার যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালে এই জনপ্রিয় গীতিগুলি নিশ্চয়ই গায়কদের মুখে মুখে এবং/অথবা লিপিকরদের অনুলিপির মাধ্যমে প্রচারিত ছিল। সুতরাং মূল রচনার সময়কার রূপ হইতে চর্যাগীতিগুলির ভাষা পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, যেমনভাবে মধ্যযুগের অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যকৃতির ভাষা বিকৃত হইয়া গিয়াছে।” লিপির আদর্শ বিচার করে পুথির কালনির্দেশের ক্ষেত্রে লিপিবিশারদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়, ড. সুকুমার সেনের মতে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক এবং তারাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মুনিদত্তের আবির্ভাবকাল জানা যায়নি। অতএব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমান-নির্ভর হতে বাধ্য। খুব সম্ভবত, চতুর্দশ শতকের কিছু আগে বা পরে কোনও এক সময়ে মুনিদত্তের মূল গ্রন্থটির অনুলিপি করা হয়েছিল। প্রাপ্ত পুথিটি যে টীকাকারের স্বহস্তে লিখিত তারও কোনও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। বরং গানগুলির পাঠভেদ থেকে অনুমিত হয় যে, গানগুলি গায়কদের মুখে মুখে কম-বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরে অন্য কোনও ব্যক্তি মূল পুথির অনুলিপি করেছিলেন।
চর্যাপদের রচনাকালের ন্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটির গ্রন্থ নিয়েও গবেষকেরা আজ পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। প্রাপ্ত পুথিটির মলাটের পাতা ও শেষে পুষ্পিকার পাতা পাওয়া যায়নি বলে প্রকৃত তথ্য অজ্ঞাতে থেকে গিয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের যে নামকরণ করেছেন তা স্পষ্টতই বিষয়-নির্দেশক অভিধা, যা একই সঙ্গে সময়কেও ইঙ্গিত করছে। নাম মাত্রেই বিশেষ্য, সেখানে এই ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ অর্থ-ব্যঞ্জনার সূক্ষ্মতার পক্ষে ক্ষতিকারক। শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বিকল্প একটি নাম দিয়েছিলেন ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই নামটির উৎস জানা যায়নি। পুথির কোথাও এই নামটি নেই। এটি সম্পাদকের স্ব-নির্ধারিত নাম হতে পারে, তবে একান্তই যে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নাম নয়, তার প্রমাণ অদ্বয়বজ্রের ''প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধ'' নামের গ্রন্থটি। টীকাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির নামের সঙ্গে এই ‘বিনিশ্চয়’ শব্দটি যুক্ত থাকত। প্রাপ্ত পুথিটিও একটি টীকাগ্রন্থ। মুনিদত্ত বাংলা ভাষায় লেখা পঞ্চাশটি চর্যাগীতির টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। নাম দিয়েছিলেন ''নির্মলগিরা টীকা''। সেদিক থেকে শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি সংগতিপূর্ণ। অথচ এই নামটি নিয়েও গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
চর্যাগীতিগুচ্ছের প্রথম পদের সংস্কৃত টীকায় বলা হয়েছে: “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্য্যচর্য্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মলগিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।” ১৯২৮ সালে বিধুশেখর শাস্ত্রী ''ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি'' পত্রিকার চতুর্থ খণ্ডে এই শ্লোকটির নিরিখে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, এখানে উক্ত ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’ শব্দবন্ধটিই প্রকৃত গ্রন্থনাম, যার অর্থ হল ‘আশ্চর্য চর্যাসমূহের সংকলন’। কিন্তু এটিকে ঠিক গ্রন্থনাম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। বরং উপরিউক্ত বাক্য থেকে টীকাকার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আশ্চর্য বা অদ্ভুত চর্যাসমূহে প্রবেশের ‘সদ্বর্ত্ম’ নির্দেশের জন্য তিনি টীকা রচনা করেছেন। ‘আশ্চর্য’ শব্দটি গানগুলির প্রকৃতি নির্দেশক, যা অবশ্যই বিশেষণ। অন্যদিকে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে তিব্বতি অনুবাদটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন যে, শাস্ত্রী মহাশয় একটি ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নাম দিয়েছেন; গ্রন্থটির আসল নাম হবে ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়''। অবশ্য ড. বাগচী নেপাল রাজদরবারে রক্ষিত পুথিতে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ড. সুকুমার সেনও মনে করেন যে, গ্রন্থটির মূল নাম ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'', কিন্তু লিপিকরের ভুলে তা হয়েছে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। কিন্তু ড. বাগচী ও ড. সেন সমর্থিত ''চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়'' নামটি প্রাপ্ত পুথিতে তো নেই-ই, এমনকি ''তেঙ্গুর'' গ্রন্থমালার পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাতেও পাওয়া যায় না। এই নামটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মুনিদত্তের যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি থাকলেও চর্যার ‘আশ্চর্য বিনিশ্চয়’ অর্থাৎ অপূর্ব অর্থনির্ধারণের ব্যাপারটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হয়। বরং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়ার নামটির পিছনে কিছু যুক্তি আছে। ‘চর্য্যাচর্য্য’ শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ পদ, যার পূর্বপদ ‘চর্য্য’, অর্থাৎ আচরণীয় এবং উত্তরপদ ‘অচর্য্য’ অর্থাৎ যা আচরণীয় নয়। যে গ্রন্থ আচরণীয় ও অনাচরণীয় তত্ত্বকে বিশেষরূপে নিশ্চয়ই করে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ''চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়''। এই কারণে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ''চর্যাগীতিকোষ'' গ্রন্থের ভূমিকায় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “I see no justification to invent a new name when the old one conveys the better meaning, that is, Viniscaya ‘Determination’ of carya ‘that to be practiced’ and acarya ‘that not to be practiced’.”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পর চর্যাপদের পুথি আরও কয়েকজন বিদগ্ধ গবেষক কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। যেমন, মনীন্দ্রমোহন বসুর ''চর্য্যাপদ'', ড. সুকুমার সেনের ''চর্যাগীতি পদাবলী'', ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রীর যুগ্ম সম্পাদনায় ''চর্যাগীতিকোষ'' এবং ড. নীলরতন সেনের ''চর্যাগীতিকোষ'' (ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ)। লক্ষণীয়, সকলেই সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণে গানের দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন এবং শাস্ত্রী মহাশয়ের দেওয়া নামটি বর্জন করেছেন। এই বিষয়ে জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “কিন্তু গ্রন্থনাম বিচারে প্রথম বিচার্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এবং গ্রন্থের উদ্দেশ্য। যে গ্রন্থখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা চর্যাগীতির সঙ্কলন মাত্র নহে, গীতিগুলির অর্থ বা টীকা। গ্রন্থখানির আরম্ভ টীকাকারের বন্দনা ও বস্তুনির্দেশক শ্লোক লইয়া। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতী অনুবাদের যে সংস্কৃত ছায়া দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, তাহাও টীকাকার মুনিদত্তের উক্তি লইয়াই পরিসমাপ্ত।” অথচ সম্পাদিত সব কটি গ্রন্থেই এই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নামকরণে গানের ভূমিকাকেই দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। প্রাপ্ত পুথিটিতে গানগুলির উপস্থিতি যে একটি বিশিষ্ট ঘটনা তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টীকাকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গানগুলির সূত্রে সহজযান বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যা করা। মূল পুথিতে গান আদৌ যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেভাবে সাহিত্যের অর্থপুস্তক লেখা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ প্রতিটি পদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পদের প্রথম শব্দটি উল্লেখ করে এখানে ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এই রীতি বৌদ্ধসাহিত্যে যে সুপ্রচলিত ছিল তার প্রমাণ কাহ্নপাদ রচিত ''যোগরত্নমালা'' টীকা, অদ্বয়বজ্রের ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' এবং নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা''। মুনিদত্তও সেই ধারাতে অর্থবোধের জন্য ''নির্মলগিরা টীকা'' রচনা করেছিলেন। সূচনায় “বিধাস্যে স্ফুটম্” ও অন্তে “কোষস্য চার্থঃ প্রকটিকৃতোঽএ” প্রভৃতি উক্তিই তার প্রমাণ। অতএব টীকাকারের উদ্দেশ্য বিচার করলে পূর্বোক্ত সমস্ত নামই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর মনে হবে। তিনি যে এর ভিন্ন একটি নামকরণ বৌদ্ধধর্মের গূঢ় তত্ত্বসমূহের ভাষ্য তথা ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত ''তাঞ্জুর'' গ্রন্থমালার তালিকা থেকে পাওয়া যায়। সেখানে মুনিদত্তের নামে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থটির উল্লেখ আছে। মুনিদত্তের গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদক কীর্তিচন্দ্রের নামেও একই নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। পি. কর্ডিয়ার কৃত তালিকাও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। উল্লেখ্য যে, তিব্বতি ভাষান্তরেও গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছিল ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি''। আশ্চর্যের বিষয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে যে ''তাঞ্জুর'' তালিকা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, তাতেও মুনিদত্তের নামের পাশে ''চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'' গ্রন্থের উল্লেখ আছে।
==কবি==
চর্যাগীতিগুলির ভণিতায় যেমন পদকর্তাদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তেমনই টীকাগ্রন্থটিতে ব্যাখ্যার সঙ্গে রচয়িতাদের নামও দেওয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি গানের তেইশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধধর্মের যোগাচার শাখার সাধক-কবি। সম্ভবত তন্ত্রযোগ সাধনায় এঁরা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই প্রত্যেকেই সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। মুখ্যত বজ্রযান ও সহজযানের গুরুরাই এই অভিধায় ভূষিত হতেন। তিব্বতি ইতিহাসে চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম সুপ্রসিদ্ধ। লামা তারানাথের গ্রন্থ, মৈথিল কবি জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' ও বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে এই সব সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে।
===লুইপাদ===
টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন। তিব্বতি তালিকায় তাঁর নামই সর্বাগ্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তারানাথ বলেছেন, লুইপাদ চতুর্থ সিদ্ধাচার্য। তিনি উড্ডীয়ান-রাজ উদয়নের করণিক ছিলেন। পরে মহাসিদ্ধ শবরীপাদের কাছে তন্ত্রাভিষেক লাভ করেন এবং নির্বিঘ্নে ধ্যান করার জন্য বাংলার গঙ্গাতীরে আসেন। সাধনরত অবস্থায় তিনি মৎস্যের অন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। এইজন্য নাথধর্মের অন্যতম গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। ‘মৎস্যেন্দ্র’ শব্দের অর্থ হল মাছেদের রাজা অর্থাৎ রুই। পাণিনির “ন র লয়োর্ভেদঃ” সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, রুই ও লুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এইভাবে মীননাথ ও লুইপাদ অভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য সেটি বাস্তব সত্য কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে। লুইপাদ বজ্রযান মতে বজ্রবারাহীর ধ্যান করতেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অবশ্য লুইপাদকে ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, লুইপাদ ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের কায়স্থ বা মুখ্য করণিক। সরহপাদ রচিত দোহাকোষের অদ্বয়বজ্র কৃত পঞ্জিকায় লুইপাদকে ‘কৈবর্ত’ বলা হয়েছে। চর্যাগীতি ও ''তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি'' নামক দোহাকোষ ছাড়া লুইপাদ রচনা করেন ''শ্রীভগবদভিসময়'', ''অভিসময়বিভঙ্গ'', ''বুদ্ধোদয়'' ও ''বজ্রসত্ত্বসাধন''। প্রথম দুটি গ্রন্থ খুবই বিখ্যাত। বিশেষত দ্বিতীয় গ্রন্থটির উপর পরবর্তীকালে অনেক টীকা, ব্যাখ্যা, বৃত্তি, পঞ্জিকা ইত্যাদি রচিত হয়। চর্যার পুথিতে তাঁর দুটি গান (১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===শবরীপাদ===
মহাসিদ্ধ শবরীপাদ ছিলেন লুইপাদের গুরু। শবরীপাদের গুরু ছিলেন রসসিদ্ধ নাগার্জুন। তারানাথের বিবরণে পাওয়া যায়, প্রথম জীবনে শবরীপাদ ছিলেন বঙ্গের এক নটাচার্য। নাগার্জুন তাঁকে শ্রীপর্বতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি শবরসুলভ জীবন যাপন করে ‘শবরীশ্বর’ বা ‘সিদ্ধ শবর’ উপাধি লাভ করেন। তন্ত্রমতে, শবর বা সবর শব্দের অর্থ বজ্রধর। তিনি কনিষ্ঠ সরোহ নামেও পরিচিত। ''তাঞ্জুর'' তালিকা অনুসারে, তিনি বজ্রযোগিনী সাধন-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ষড়ঙ্গ যোগের উপরেও তাঁর অধিকার বিভিন্ন রচনায় প্রমাণিত। তিনি ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বিশেষণেও ভূষিত। ''মহামুদ্রাবজ্রগীতি'', ''চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি'' প্রভৃতি তাঁর রচিত তত্ত্বগ্রন্থ। বৌদ্ধ সাধনমালায় ''সিতকুরুকুল্লাসাধন'' ও ''বজ্রযোগিনী আরাধনাবিধি'' নামে দুটি রচনায় তাঁর ভণিতা পাওয়া যায়। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর দুটি গান (২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত।
===ভুসুকুপাদ===
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চর্যাকার ভুসুকুপাদের ব্যক্তিগত ও প্রাচীনত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মহাযান মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা শান্তিদেব ও চর্যাকার ভুসুকুপাদ অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মতান্তর আছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''শিক্ষাসমুচ্চয়'' ও ''বোধিচর্যাবতার''। তারানাথ এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাকে সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ সংখ্যক তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবনী উদ্ধার করেছেন, সেটি এইরকম: শান্তিদেব ছিলেন রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মা তাঁকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জুবজ্রের নিকট যাত্রা করলেন। পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল এবং তারপর বারো বছর মঞ্জুবজ্রের কাছে থেকে তিনি মঞ্জুশ্রী মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন। তারপরে তিনি ‘রাউত’ বা অশ্বারোহীর বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধরাজের নিকট ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী তরবারিধারী অচলকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তরবারিকে আশ্রয় করে তাঁর অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশ পেল। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুর বেশে নালন্দায় প্রবেশ করলেন। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় ও কুটি গমনে অর্থাৎ বিশ্রামকালে ‘প্রভাস্বর’ বা সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এই নামেই তিনি চর্যাগীতি রচনা করেন। পদকর্তা ভুসুকুর গানে আছে “রাউতু ভনই কট”। এই ভণিতাই দুই ব্যক্তিত্বকে এক করে দিয়েছে। তাছাড়া নারোপা রচিত ''সেকোদ্দেশ টীকা'' গ্রন্থে শান্তিদেব ও ভুসুকুপাদকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ড. সুকুমার সেন এই দুজনকে পৃথক ব্যক্তি বলে মনে করেন। ড. সেনের মতে, ভুসুকুপাদ শান্তিদেবের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালের ব্যক্তি। তিনি সহজযানী সিদ্ধাচার্য। তাঁর রচিত ''চতুরাভরণ'' গ্রন্থের লিপিকাল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ ধরে ড. সেন তাঁকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যক্তি মনে করেছেন। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। ভুসুকুপাদ ত্রয়োদশ শতকের কবি হলে দ্বাদশ শতকের পূর্বে রচিত কোনও গ্রন্থে তাঁর পদ স্থান লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভুসুকুপাদ যে রাজপুত্র ও রাউত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর পদেই পাওয়া যায়। “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী” ভণিতার সূত্রে তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়। তাঁর পদে দু-একটি বঙ্গীয় বাগ্বিধিও লক্ষণীয়। চর্যার পুথিতে ভুসুকুপাদের ৮টি গান সংকলিত হয়েছে: ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩ ও ৪৯ সংখ্যক চর্যা।
===সরহপাদ===
লামা তারানাথ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় সরহপাদকে বলা হয়েছে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘সিদ্ধ মহাচার্য’, ‘মহাব্রাহ্মণ’, ‘যোগী’, ‘মহাযোগী’, ‘যোগীশ্বর’ ও ‘মহাশবর’ (‘শবর’ শব্দটি বজ্রযানে বজ্রধরের প্রতীক)। সরহপাদ উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেদাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। নালন্দায় তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন ধর্মকীর্তি হরিভদ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, হরিভদ্র ছিলেন গৌড়াধিপতি ধর্মপালের (রাজত্বকাল ৭৭০—৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। সেই হিসেবে সরহপাদ অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয় ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। আচার্য স্থবিরকালের নিকট সরহপাদ অভিষিক্ত হন। দাক্ষিণাত্যে এক শরকারের (arrow-smith) কন্যাকে মুদ্রা রূপে গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় শরহ বা সরহ। তাঁর অপর নাম রাহুলভদ্র, সরোরুহবজ্র ও সরোজবজ্র। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সরহপাদের ভিক্ষুনাম রাহুলভদ্র। বজ্রযানের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে সরোরুহবজ্র বা সরোজবজ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন বলেছেন, ‘পূর্বদিশা’ অঞ্চলের অন্তর্গত ‘রাজ্ঞী’ (বর্তমান বিহারের ভাগলপুর) নামক স্থানে তাঁর জন্ম। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, সরহপাদ ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ব্যক্তি। তাঁর লেখা ৩৯ সংখ্যক চর্যাটির বাহ্য অর্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি বঙ্গে জায়া গ্রহণ করেছিলেন: “বঙ্গে জাআ নিলেসি”। তাঁর পদে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ও বাগ্বিধির বিচারেও তাঁকে গৌড়ের অধিবাসী মনে হয়। রসসিদ্ধ নাগার্জুনকে তিনি সহজ মতে অভিষিক্ত করেন। সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রত্ন বাংলা তিন ভাষাতেই সরহপাদ গ্রন্থাদি রচনা করেন। সংস্কৃতে তিনি রচনা করেন ''বুদ্ধকপালসাধন'', ''হেবজ্রতন্ত্রপঞ্জিকাপদ্মিনীনাম'' প্রভৃতি গ্রন্থ। অপভ্রংশে রচিত তাঁর সহজতত্ত্ব ও সহজ-সাধনা বিষয়ক দোহা ও দোহাজাতীয় গীতি সংকলনগুলির মধ্যে ''দোহাকোষগীতি'', ''ক-খ দোহা'' (ক-কারাদি বর্ণকে আদ্যক্ষর করে বর্ণার্থমূলক দোহা), ''মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি'', ''কায়বাক্চিত্তঅমনসিকার'', ''ডাকিনীগুহ্যগীতি'' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর ৪টি পদ (২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ সংখ্যক পদ) সংকলিত।
===কাহ্নপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৫০টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫ সংখ্যক চর্যা; এবং টীকা অনুসারে, মূল পুথিতে লুপ্ত ২৪ সংখ্যক চর্যাটি) কাহ্নপাদের রচনা। তিব্বতি ইতিহাস, ''তাঞ্জুর'' তালিকা, চর্যাগীতি ও বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকায় (নাথগীতিকা) কাহ্নপাদ একটি বিশিষ্ট নাম। টীকাকার তাঁকে ‘কাহ্নপাদ’, ‘কৃষ্ণপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্যপাদ’, ‘কৃষ্ণবজ্রপাদ’, ‘কৃষ্ণাচার্য’, ‘কৃষ্ণাচার্য চরণ’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত ও মণ্ডলাচার্যদের ভিতর সিদ্ধাচার্য। তবে কাহ্নপাদ দুই জন কবির নাম কিনা এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬ ও ৪২ সংখ্যক পদগুলি জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যোগী কাহ্নপাদের এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০ ও ৪৫ সংখ্যক পদগুলি অপর এক কাহ্নপাদের রচনা। কয়েকটি গানে ‘জ্ঞান উপদেশের প্রবণতা’ এবং অন্য গানগুলিতে ডোম্বী-বিবাহের সন্ধ্যা-সংকেতের ভিত্তিতে দুই কাহ্নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও, একই সাধক-কবি দুই ভিন্ন শ্রেণির গান রচনা করেছেন—এই যুক্তিতে কেউ কেউ দুই কাহ্নের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাহ্নপাদের পরিচয় নিয়েও অনেকগুলি জনশ্রুতি আছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ভারতবাসী ও উড়িষ্যা থেকে আগত বলা হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাস অনুসারে, তাঁর জন্মস্থান কর্ণ-নগর। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে তাঁর জন্ম পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগরে। এই স্থানগুলির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নাথগীতিকায় তাঁর একটি কীর্তিস্থল হিসেবে বঙ্গ মেহারকুলের উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদের পদে বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। কাহ্নপাদের জীবনকাহিনিও বিচিত্র। প্রথম জীবনে বিরূপপাদ বা বিরুআপাদের শিষ্য কাহ্নপাদ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে চারটি পাপ করার পর জালন্ধরীপাদের শরণ নেন। জালন্ধরীপাদের নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনার করে তিনি শাপমুক্ত হন। বিরূপপাদের সঙ্গে কাহ্নপাদের যোগের ইঙ্গিত তাঁর পদেই পাওয়া যায়। তবে জালন্ধরীপাদের সঙ্গেই তাঁর যোগ বেশি। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদ জালন্ধরীপাদকে সাক্ষী মেনে মেনেছেন: “শাখি করিব জালন্ধরী পাএ”। তিব্বতি ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে কাহ্নপাদ তাই করেছেন বলে উল্লিখিত। আবার নাথগীতিকায় বলা হয়েছে হাড়িফাকে (জালন্ধরীপাদ) নিত্য সেবা করেন কানফা যোগাই (কাহ্নপাদ)। কাহ্নপাদ ''দোহাকোষপঞ্জিকা'' সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ''হেবজ্রতন্ত্র'' গ্রন্থের উপর একটি গ্রন্থও তাঁর নামে পাওয়া যায়।
===বিরূপপাদ===
বিরূপপাদ বা বিরুআপাদ ছিলেন বজ্রযোগিনীর সাধক। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে ‘আচার্য’, ‘মহাচার্য’, ‘যোগীশ্বর’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সিদ্ধ সাধক হিসেবে তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁর নাম করেছেন। তাঁর কোনও গুরু ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদের প্রথম জীবনের গুরু। তাঁর নামে ''গীতিকা'', ''কর্মচণ্ডালিকাদোহাকোষগীতি'' প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। লামা তারানাথের গ্রন্থে তাঁর মদ্যপানে আসক্তি ও শুণ্ডিনী সাহচর্যের কথা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত তাঁর একমাত্র চর্যাটিতে (৩ সংখ্যক পদ) সেই শুণ্ডিনীর মদ চোলাইয়ের একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
===শান্তিপাদ===
শান্তিপাদ প্রাচীন সিদ্ধাচার্য। ড. সুকুমার সেনও তাঁকে প্রাচীন চর্যাকার বলে স্বীকার করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা মতে, রত্নাকর শান্তিই শান্তিপাদ। তিব্বতি তালিকায় রত্নাকর শান্তি ‘আচার্য’, ‘আচার্যপাদ’ ও ‘মহাপণ্ডিত’ বিশেষণে ভূষিত। লামা তারানাথের বিবরণ অনুসারে, তিনি শবরীপাদের সমসাময়িক, অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নামে ''মুক্তাবলী নামি হেবজ্র পঞ্জিকা'' ও ''কুসুমাঞ্জলি নাম গুহ্যসমাজ নিবন্ধ'' নামে দুই গ্রন্থ উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি সহজ-সাধনার ভিত্তি ''হেবজ্রতন্ত্র'' ও ''গুহ্যসমাজ তন্ত্র'' গ্রন্থদ্বয়ের টীকা। সহজযানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগের সাক্ষর বহন করছে ''সহজরতিসংযোগ'' ও ''সহজ যোগক্রম'' গ্রন্থ দুটি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''সুখদুঃখপরিত্যাগদৃষ্টি''। এছাড়া তিনি বজ্রতারা ও মহামায়ার সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা করেন। শান্তিদেব ও শান্তিপাদকে কেউ কেউ অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু এঁরা যে পৃথক ব্যক্তি তা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। শান্তিদেবের দুটি পদ (১৫ ও ২৬ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===দারিকপাদ===
দারিকপাদকে অভিষিক্ত করেন লুইপাদ। গানের ভণিতাতেও দারিকপাদ বলেছেন, “লুইপাঅ পসাএঁ দারিক”। লামা তারানাথের মতে, দারিকপাদ ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় দারিকপাদের নামে ''শ্রীচক্রতন্ত্ররাজ'' গ্রন্থের ''সেকপ্রক্রিয়াবৃত্তি'' ও ''শ্রীচক্রসম্বরসাধন'' গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। চর্যাগীতির পুথিতে তাঁর একটি মাত্র পদই (৩৪ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া গিয়েছে।
===ডোম্বীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ডোম্বী, আচার্য ডোম্বীপাদ এবং আচার্য বা মহাচার্য ডোম্বী-হেরুকের নামে একাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। লামা তারানাথের মতে, এঁরা সবাই একই ব্যক্তি এবং এই ডোম্বী-হেরুক ছিলেন বিরূপপাদের শিষ্য কাল বিরূপ বা কাহ্নপাদের শিষ্য। তিব্বতি তালিকায় সিদ্ধ ডোম্বী-হেরুককে সন্ন্যাসী ও মগধের রাজা বলা হয়েছে। তারানাথ অবশ্য বলেন, ডোম্বী-হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজপুত্র। মুদ্রিকা নিয়ে সাধনা করতেন বলে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডোম্বী-হেরুক আশ্চর্য সিদ্ধাই দেখিয়ে দুর্ভিক্ষ নিবারণ করেন। তখন লোকে তাঁর সিদ্ধির কথা বুঝতে পারে। ডোম্বী-হেরুকের শিষ্যবর্গ ছিলেন ডোম্বী (আধ্যাত্মিক অর্থে বায়ুরূপা অবধূতিকা) ধরার সাধক। তারানাথ আরও বলেছেন যে, ডোম্বী-হেরুক রাঢ়ের রাজাকেও অভিষিক্ত করেন, ফলে রাঢ় অঞ্চল থেকে তীর্থিক ধর্ম লোপ পায়। মুনিদত্তও ডোম্বীপাদকে ‘লাড়ী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ড. সুকুমার সেন তাঁর রাঢ় অঞ্চলের মানুষ মনে করেন। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে, তিনি ছিলেন অষ্টম শতকের লোক। চর্যাগীতির পুথিতে ডোম্বীপাদের মাত্র একটি পদ (১৪ সংখ্যক চর্যা) সংকলিত হয়েছে। টীকাকার এটির ব্যাখ্যা দেননি। তবে কাহ্নপাদের অনেক পদে ডোম্বীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
===কুক্কুরীপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য কুক্কুরীপাদ কুকুরাজ বা কুক্কুররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর নামে অনেকগুলি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। ''গুহ্যার্থধর ব্যুহ'' নামে তিনি বজ্রসত্ত্ব, বজ্রহেরুক, পদ্মরত্নেশ্বর প্রমুখের সাধন-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারানাথের ভাষ্য অনুসারে, সর্বদা সঙ্গে একটি কুক্কুরী থাকত বলে তিনি কুক্কুরীপাদ নামে পরিচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন অবশ্য কুক্কুটিকপাদ থেকে কুক্কুরীপাদ শব্দটি নিষ্পন্ন করতে চান। চর্যাপদের পুথিতে তাঁর তিনটি চর্যা সংকলিত হয়েছিল; তার মধ্যে ২ ও ২০ সংখ্যক চর্যাটি পাওয়া গিয়েছে এবং ৪৮ সংখ্যক চর্যাটি লুপ্ত।
===চাটিলপাদ===
পদকর্তা চাটিলপাদের অস্তিত্ব তাঁর একটি পদের (৫ সংখ্যক চর্যা) উপর নির্ভরশীল। কারণ তারানাথের বর্ণনায় বা ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায় না। কেবল জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থের সিদ্ধা-বর্ণনায় ‘চাটল’ এবং বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধনামানুসরণ'' গ্রন্থে ‘চাটলা’ নাম পাওয়া যায়। ৫ সংখ্যক পদে তিনি নিজেকে ‘অনুত্তর সামী’ বলে আত্মপ্রশংসা করেছেন বলে, ড. সুকুমার সেন এটিকে চাটিলপাদের কোনও শিষ্যের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কবির আত্মপ্রশংসা বিরল নয় বলেই ড. সেনের মত অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি।
===আর্যদেব===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আর্যদেব বা আজদেবকে ‘আচার্য’ ও ‘মহাচার্য’ বলা হয়েছে। তিনি সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। চতুষ্পীঠ যোগতন্ত্র সাধন সম্পর্কে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সহজ-সাধনায় চিত্তশোধন-বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ''চিত্তাবরণবিশোধন নামপ্রকরণ'' তাঁর রচনা। অপভ্রংশ ভাষায় তিনি রচনা করেন ''কাণেরি গীতিকা''। প্রভুভাই প্যাটেলের মতে, আর্যদেব অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন উড়িষ্যারাজ ইন্দ্রভূতি এবং সরহপাদের শিষ্য নাগার্জুনের সমসাময়িক। আর্যদেবের একটি মাত্র চর্যা (৩১ সংখ্যক পদ) সংকলিত হয়েছে চর্যাগীতির পুথিতে।
===কম্বলাম্বরপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য বা মহাচার্য কম্বলের নাম পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে প্রজ্ঞারক্ষিতের গুরু মহাসিদ্ধ কম্বলাম্বরপাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে এখানে। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ''অভিসময়নামপঞ্জিকা''। লামা তারানাথের বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, লুইপাদের শিষ্য দারিকপাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং সেই সূত্রে লুইপাদের গ্রন্থটির পঞ্জিকা রচনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তারানাথ কম্বলাম্বরপাদকে বজ্রঘণ্টের শিষ্য বলেছেন। ডোম্বী-হেরুক, জালন্ধরীপাদ প্রমুখের সঙ্গে কম্বলাম্বরপাদের যোগাযোগ ছিল। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, কম্বলাম্বরপাদ ছিলেন ঊড়িষ্যার এক রাজকুমার। শ্মশানে সাধনা করে তিনি মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মন্ত্রবতী শ্মশান-ডাকিনী তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে শ্মশানে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাতেই তিনি ‘কম্বল’ নামে খ্যাত হন। তাঁর কিছু সংস্কৃত রচনার অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সরহপাদ রচিত দোহার অদ্বয়বজ্র কৃত টীকায়। সেখানে তিনি শাস্ত্রের শব্দাক্ষরের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। চর্যাগীতির পুথিতে ৮ সংখ্যক পদটি কম্বলাম্বরপাদের রচনা। এটিতে তিনি ‘কামলি’ নামে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। পদটি সাধনতত্ত্বের রূপক। নৌকা বাওয়ার রূপকে কবি মহাসুখচক্রের উদ্দেশ্যে বোধিচিত্তের যাত্রা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন পংক্তিতে নৌকা বাওয়ার বাস্তব চিত্র এই বিষয়ে কবির বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সন্ধ্যা-সংকেতে ও উৎপ্রেক্ষায় পদটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
===বীণাপাদ===
''তাঞ্জুর'' তালিকায় বিরুআপাদের বংশধর রূপে বীণাপাদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য লামা তারানাথের মতে, তিনি ছিলেন অশ্বপাদের শিষ্য। ডোম্বী-হেরুকের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই হিসেবে তিনি অষ্টম শতকের শেষার্ধের ব্যক্তি। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “টীকাকারের অনুকরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচিত বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভণিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই।” কিন্তু অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর মতে, “চর্যাগানে অনেক ক্ষেত্রে লেখক রূপকের আবরণে আত্মগোপন করিয়াছেন, কোথায়ও বা সরাসরি ভণিতা না দিয়া নিজেই গীতিকবিতার নায়ক সাজিয়াছেন। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক চর্যায় ও শবরপাদের ২৮ ও ৫০ সংখ্যক চর্যায় এই রীতিই অবলম্বিত হইয়াছে। কাজেই বীণাপাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” গুহ্যাভিষেক, মহাভিষেক ও বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম বিষয়ে বীণাপাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৭ সংখ্যক চর্যাটিও নিষ্পন্নক্রমের সাধন-সংক্রান্ত চর্যা। সেকমণ্ডলে আলি-কালির দ্বার রুদ্ধ হয়ে চিত্ত অবধূতী মার্গে প্রবিষ্ট হলে কীভাবে হেরুক-বীণায় শূন্যতার ধ্বনি ওঠে এবং কীভাবে যোগিনী-অভিষঙ্গে যোগী বজ্রনৃত্যে ও বজ্রগীতে তন্ময় হন, তারই একটি ছবি ধরা পড়েছে ১৭ সংখ্যক চর্যাটিতে। সাধকসত্ত্বাই এখানে বীণাযন্ত্র-স্বরূপ। বীণার রূপকল্পনায় নীরস দেহতত্ত্ব এই পদে সরস হয়ে উঠেছে। গানটি শুধু তত্ত্ববাহীই নয়, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এবং কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচায়ক।
===ভাদেপাদ===
কাহ্নপাদের যে ছয়জন শিষ্যের একটি করে গান চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম ভাদেপাদ বা ভদ্রপাদ। অন্যত্র তিনি ভদ্রচন্দ্র বা ভদ্রদত্ত বা ভদ্রোক নামেও পরিচিত। লামা তারানাথ তাঁর ‘গুহ্য’ নামটির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা গোপীচন্দ্রের গানে উল্লিখিত কৃষ্ণাচার্যের শিষ্য ‘বাইল ভাদাই’ সম্ভবত ভদ্রপাদ। কানফা গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করতে সোনার গোপীচন্দ্র মূর্তি ক্রুদ্ধ হাড়িপার সম্মুখে স্থাপনের উপদেশ দেন। হাড়িপার ক্রোধে সেই স্বর্ণমূর্তি ভস্ম হয়ে যায়। গুরু জালন্ধরী এই কথা জানতে পেরে কানফাকে শাপ দেন। শেষে ময়নামতীর অনুনয়ে সিদ্ধ হাড়িপা বলেন যে, ‘বাইল ভাদাই’ শাপমুক্ত করবেন কানফাকে। সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই শিষ্য কর্তৃক উদ্ধার লাভ করেছিলেন। গোরক্ষনাথ যেমন গুরু মীননাথকে কামবাসনায় ঘেরা কদলীরাজ্য থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই হয়তো গুরু কানফা বা কাহ্নপাদকে শাপমুক্ত করে থাকবেন ‘বাইল ভাদাই’ বা ভদ্রপাদ। নাথপন্থার সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যোগ এই কাহিনির মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু ভাদেপাদের গানে তান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট নয়, পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও কম। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় ভাদেপাদকে বলা হয়েছে ‘ভাণ্ডারিন্’ (আচার্য)। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ''সহজানন্দদোহাকোষগীতিকাদৃষ্টি''। ৩৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি ভাদেপাদের রচনা। গুরু উপদেশে কীভাবে তিনি সহজচিত্ত লাভ করেছিলেন, তা উল্লিখিত হয়েছে এই পদে। টীকাকার বলেছেন, ভদ্রপাদ ‘জ্ঞানানন্দপ্রমোদ’-যুক্ত সিদ্ধাচার্য। পদটিতেও সর্বধর্ম-অনুপলম্ভরূপ চরম জ্ঞানের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। পদটিতে ‘বাজুল’ (বজ্রকুল) শব্দটির প্রয়োগ দেখে মনে হয়, ভাদেপাদ বজ্রকুলের সাধক ছিলেন।
===মহীধরপাদ===
চর্যাগীতির পুথিতে প্রাপ্ত ১৬ সংখ্যক পদটির রচয়িতা মহিণ্ডা। ভণিতায় ‘মহিণ্ডা’ নামটি পাওয়া গেলেও টীকায় তাঁর নাম মহীধরপাদ। লামা তারানাথ তাঁকে ‘মহিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকা বলা হয়েছে যে, ‘মহিপাদ’ ছিলেন আচার্য কৃষ্ণের অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর (শিষ্য)। ''বায়ুতত্ত্ব দোহাগীতিকা'' গ্রন্থটি মহীধরপাদের রচনা। তাঁর রচিত চর্যাগীতিটি ধ্বনিগাম্ভীর্যে, ২৬ মাত্রার দীর্ঘায়িত ছন্দের গজগতিতে এবং রূপক-কল্পনার সৌন্দর্যে বেশ উপভোগ্য। টীকাকার বলেছেন, "জ্ঞানপানপ্রমত্তো হি সিদ্ধাচার্য মহীধর”। এই জ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে কবির শিল্পদৃষ্টিও প্রশংসনীয়। পদটির সঙ্গে কাহ্নপাদ রচিত ৯ সংখ্যক পদের ভাব ও চিত্র-সাদৃশ্য কাহ্নপাদের সঙ্গে মহীধরপাদের নিকট সম্পর্কেরই সূচক। তবে ড. নির্মল দাশ এই পদের ভণিতায় ক্রিয়াপদে বহুবচন দেখে অনুমান করেন যে, পদটি মহীধরপাদের “শিষ্যানুশিষ্যদেরও” রচনা হতে পারে।
===ধামপাদ===
লামা তারানাথের মতে, ধম্মপাদ বা ধামপাদ ছিলেন কাহ্নপাদের শিষ্য। কাহ্নপাদ যখন গুরুকে উদ্ধার করতে শিষ্যদের নিয়ে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে আসেন, তখন রাজা তাঁদের উদ্দেশ্যে এক ভোজের আয়োজন করেন। কাহ্নপাদ বলেন, শিষ্য ধম্ম ও ধূমকে ভোজনে তৃপ্ত করলেই সকলে পরিতৃপ্ত হবেন। রাজার সংগৃহীত সমস্ত ভোজ্যদ্রব্য ধম্ম ও ধূম নিঃশেষ করেন। এতে সবাই তাঁদের সিদ্ধি বুঝতে পারেন। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় আচার্য ধর্মপাদকে কৃষ্ণ অর্থাৎ কাহ্নপাদের বংশধর বলা হয়েছে। ধামপাদ ''সুগত দৃষ্টি গীতিকা'', ''মহাযান নিষ্পন্নক্রম'', ''হুঙ্কার চিত্তবিন্দু ভাবনাক্রম'' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। চর্যাগীতির পুথিতে সংকলিত ৪৭ সংখ্যক পদটি তাঁর রচনা। এই পদেও নিষ্পন্নক্রম সাধনের কথাই বিবৃত হয়েছে: প্রজ্ঞোপায় সমতাযোগে চণ্ডালী প্রজ্বলিত হয়, অপরিশুদ্ধা নাড়ী দগ্ধ হয় এবং তখন নাড়ীর অধিদেবতা ও চিত্ত বিশ্রাম লাভ করে মহাসুখচক্রে। প্রকারান্তরে কাহ্নপাদ কথিত ‘কামচণ্ডালী’ সাধনার কথাই এখানে পুনর্কথিত হয়েছে। গানটি ''হেবজ্রতন্ত্র''-এর ‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’ শ্লোকটির ভাষা-অনুবাদ।
===কঙ্কণ===
চর্যাগীতির পুথিতে ৪৪ সংখ্যক পদটি কঙ্কণের রচনা। পুথিতে তাঁর নাম কোঙ্কণ বলে উল্লিখিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাঁকে সেই নামেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, তাঁর নাম কৌঙ্কণ। ড. নির্মল দাশের মতে, কঙ্কণ কবির ছদ্মনাম। সম্ভবত কঙ্কণ ছিল তাঁর লব্ধ-উপঢৌকন। সেকালে কবিরা এভাবে প্রাপ্ত উপঢৌকনের নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। কথিত আছে, তিনি আচার্য কম্বলের বংশধর। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় তাঁকে সিদ্ধ সাধক বলা হয়েছে। টীকাকার তাঁকে পরম করুণাসব পানে প্রমুদিত ‘কঙ্কণ সিদ্ধাচার্য’ বলেছেন। কঙ্কণের পদটিতে মধ্যমা নিরোধের যুগনদ্ধ ফলোদয়ের অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মাপের মাত্রা ছন্দ (১১ মাত্রার রসিকা) কঙ্কণই ব্যবহার করেছেন। ছন্দে বৈচিত্র্য এনেছে ষোড়শ-মাত্রিক বন্ধনের সঙ্গে ১১ মাত্রার চরণ: “সুনে সুন মিলিআ জবেঁ। সঅল ধাম উইআ তবেঁ।।” ''চর্যাদোহাকোষগীতিকা'' তাঁর রচনা। সম্ভবত আর কোনও গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি।
===গুণ্ডরীপাদ===
৪ সংখ্যক চর্যাগীতিটি গুণ্ডরীপাদের রচনা। গানটিতে ‘গুড়রী’ ভণিতা দেওয়া হয়েছে। অ্যালবার্ট গ্রানওয়েডেল সিদ্ধাচার্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তাতে গুণ্ডরী নামটি আছে। বিনয়শ্রীর ''সিদ্ধবন্দনা'' গ্রন্থেও তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ''তাঞ্জুর'' তালিকায় এই নামের কোনও লেখকের কথা উল্লিখিত হয়নি। ড. সুকুমার সেনের মতে, গুণ্ডরী সম্ভবত ব্যক্তিনাম নয়, কবির জাতি বা পেশাবাচক নামক এবং সম্ভবত মশলা ইত্যাদি গুঁড়ো করা ছিল কবির পেশা। পুথিতে সংকলিত চর্যাটিতে কুন্দুরু যোগের একটি সংকেত পাওয়া যায়। পদটিতে নরনারীর প্রেম-মিলনের স্থূল বর্ণনা আছে। ড. সেন গানটিতে যৌন-তান্ত্রিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত ও পারিভাষিক শব্দের আধিক্যের কারণে পদকর্তাকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে বিবেচনা করেছেন। পদের শেষে কবির আত্মপ্রশংসা লক্ষণীয়।
===তাড়কপাদ===
৩৭ সংখ্যক চর্যাগীতির রচয়িতা হিসেবে তাড়কের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ''তাঞ্জুর'' তালিকায় যে মহাপণ্ডিত তারশ্রী ও উপাধ্যায় তারপাদের নাম পাওয়া যায়, তাড়ক তাঁদেরই মধ্যে কেউ হতে পারেন। টীকাকার তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলেছেন: “সিদ্ধাচার্য হি তাড়ক।” পদটিতে সহজজ্ঞানের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কবির বস্তুদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায় এতে। নৌকা-পারাপার ও পারানির কড়ি খোঁজার ছবিটি মনোজ্ঞ।
===জয়নন্দী===
৪৬ সংখ্যক চর্যাগীতিটি জয়নন্দীর রচনা। তিনি ‘জঅনন্দি’ নামেও পরিচিত। লামা তারানাথের গ্রন্থে জয়নন্দীর নাম পাওয়া যায় না। গ্রানওয়েডেল কৃত সিদ্ধাচার্যদের নামের তালিকায় ‘জয়নন্দ’ নামটি পাওয়া যায়। টীকাকার তাঁকে পরম করুণা অর্জনের নিমিত্ত ‘অভিজ্ঞালাভী’ বলেছেন। প্রাপ্ত পদটিতে পরমার্থ চিত্তের অদাহ্য অপ্লাব্য অচ্ছেদ্য রূপের বর্ণনা এবং পরমার্থতত্ত্বে লক্ষণ কথিত হয়েছে। পদটি অলংকার-বর্জিত ও সোজাসুজি তত্ত্ববাহী।
===ঢেণ্ঢণপাদ===
৩৩ সংখ্যক পদটি ঢেণ্ঢণপাদের রচনা। তিনি চেণ্ঢনপা বা টেণ্টনপা নামেও পরিচিত। তিব্বতি ইতিহাসে ঢেণ্ঢণপাদের নাম নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ভোট উচ্চারণে যিনি ধেতন, তিনিই ঢেণ্ঢণ। আবার ড. নির্মল দাশের মতে, টেণ্টনপা নামটি ছদ্মনাম। তাঁর পদটিতে যে ‘টেণ্টন’ অর্থাৎ ধূর্ত-সুলভ চাতুর্যের পরিচয় আছে, সেটিকে ড. দাশ কবির ব্যক্তিচরিত্রের নয়, বরং রীতিচরিত্রের পরিচায়ক বলেছেন। আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় রচিত ঢেণ্ঢণপাদের চর্যাগীতিটিতে সন্ধ্যা-সংকেতে সংসারচিত্ত ও সহজচিত্তের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। পদে পদে পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং বিরোধালংকারের সমাবেশে পদটি দুরূহ হলেও উপভোগ্য। সাধক-কবির সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রশংসনীয়। পদটিতে গৌড়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবীরের একটি কবিতায় এবং সহদেব চক্রবর্তী ও লক্ষ্মণের ''অনিলপুরাণ'' ও ''গোর্খবিজয়'' কাব্যেও ঢেণ্ঢণপাদের পদটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
===তন্ত্রীপাদ===
তন্ত্রীপাদ রচিত ২৫ সংখ্যক চর্যাগীতিটি লুপ্ত। টীকা থেকে গানের শেষাংশের কিছু আভাস পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, নৈরাত্মা যোগিনীর অভিষঙ্গে জাতিধর্ম লুপ্ত হয়ে যায়—হীন বৃত্তিধারী তন্ত্রী হন বজ্রধর। তিব্বতি অনুবাদ থেকে বোঝা যায় যে, গানটির বিষয় তাঁত বোনা। ‘তন্ত্রী’ নামটি জাতি-বৃত্তির স্মারক। ড. নির্মল দাশের মতে ‘তন্ত্রী’ ব্যক্তিনাম নয়, জাতিবাচক নাম। সিদ্ধাচার্যদের তালিকা ‘তান্তি’ শব্দটি আছে। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ''বর্ণনরত্নাকর'' গ্রন্থে ‘তান্তিপা’ নামটি পাওয়া যায়।
==ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব==
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। তখন থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক সূচিত হয়। বিশ্বের সকল ভাষার সাহিত্যেই তাই দেখা যায়, মানবীয় অনুভূতিগুলি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনার আবরণে। প্রাচীন ভারতে বেদ, উপনিষদ্, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই এই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদও ছিল এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। পদগুলি রচনার ক্ষেত্রে পদকর্তারা বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের দ্বারা চালিত না হয়ে যে অন্যরকম সাধ্য ও সাধনপ্রণালীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদিও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সেই কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই”, তবু প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে রচিত এই সংগীতের অর্থবোধ ব্যতীত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংগীত বা কাব্য ছিল সেযুগের ধর্মসাধনার অন্যতম সোপান। মঙ্গলকাব্য, নাথসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্যধারাতেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চর্যার সাহিত্যমূল্য যেমন পরিমাপযোগ্য, তেমনই এই গানগুলিতে অবলম্বিত ধর্মের গূঢ় তত্ত্বও প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক গবেষকেরা বৌদ্ধধর্মের নানা পুথি অনুসন্ধান করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ও সহজ-সাধনার স্বরূপ নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে বিদেশি গবেষকদের পাশাপাশি ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড. বাগচী বাংলায় ''বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য'' এবং ইংরেজিতে ''স্টাডিজ ইন তন্ত্রজ'' এবং ড. দাশগুপ্ত ইংরেজিতে ''অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস অ্যাজ ব্যাকগ্রাউন্ড অফ বেঙ্গলি লিটারেচার'' ও ''ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রিক বুদ্ধিজম'' গ্রন্থের রচয়িতা। পরবর্তীকালে সকল গবেষক এঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে সিদ্ধাচার্যদের নির্দেশিত ও অনুশীলিত ধর্মাচারের বিস্তৃত পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে নানা মতভেদের কারণে বৌদ্ধধর্মে ভাঙন দেখা দেয়। ধর্মীয় আদর্শ পর্যালোচনার জন্য পরপর চারটি বৌদ্ধ মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রবল মতবিরোধের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধসমাজ হীনযান ও মহাযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থী হীনযানীদের ভাবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। তাঁরা ‘অর্হৎ’ অর্থাৎ নিজেদের মুক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁদের মধ্যে পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান নামে দুটি উপদল গড়ে ওঠে। শ্রাবকযানীরা বুদ্ধত্বলাভের দুরাশা পোষণ করতেন না, কেবল নির্ধারিত আচার-আচরণ পালন করে ধর্মের পথে পুণ্য অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। যাঁরা বুদ্ধত্বলাভের উচ্চাশা পোষণ করতেন, তাঁরা প্রত্যেকবুদ্ধযানী নামে পরিচিত ছিলেন। এঁদের নিরিখে মহাযানীদের আদর্শ ছিল অনেক উদার। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ন্যায় পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভ এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধত্ব অর্জনকেই আদর্শ বলে মনে করতেন। বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের উপায় হল শূন্যতা ও করুণার অভিন্নতায় বোধিচিত্তের জাগরণ ঘটানো। বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে বুদ্ধত্বলাভের একমাত্র সোপান বোধিসত্ত্বাবস্থায় উন্নীত হওয়া সহজ হত। বোধিচিত্ত কী এবং কীভাবে তাকে জাগরিত করা যায়, সে আলোচনা আবশ্যক। মহাযানীদের মতে, জাগতিক কোনও বস্তুরই নিজস্ব কোনও ধর্ম বা স্বরূপ নেই। অথচ প্রত্যেকের যে প্রাতিভাসিক স্বরূপ দেখা যায়, তা অন্য কোনও স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পার্থিব সকল বস্তুই প্রকৃত অস্তিত্বহীন। বস্তু সম্পর্কে এই জাতীয় জ্ঞানই শূন্যতাজ্ঞান। যখন সাধক জগৎ-সংসারে উক্ত শূন্যতাজ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী করুণাকে একত্র সংযুক্ত করেন, তখন যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই হল বোধিচিত্ত (“শূন্যতা করুণাভিন্নং বোধিচিত্তম্”)। সাধকের মনে বিশ্বব্যাপী করুণার উদয় ঘটলে তিনি কেবল নিজের মুক্তিপ্রয়াসী হন না, পরোপকারের মধ্যে দিয়ে জগতের সকলের মুক্তিপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন। বস্তুত মহাযানী মতের জনপ্রিয়তার কারণ নিহিত হয়ে রয়েছে তাঁর আদর্শে, সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব কল্পনায় এবং সদাচারী পন্থায়। বিশ্বের সকল জীবের মুক্তির জন্য এভাবে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করার কথা অন্য কোনও ধর্মমতে বিশেষ দেখা যায় না। মৈত্রী, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক সদ্বৃত্তির অনুশীলনও মহাযানকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধ পরিভাষায় উক্ত সদ্বৃত্তিগুলিকে বলা হয় ‘পারমিতা’। জগতের শূন্যস্বভাবে বিশ্বাস হেতু মহাযানীরা ‘শূন্যবাদী’ নামে পরিচিত হন। দার্শনিক মত বিচারের সূক্ষ্মতায় মহাযানীদের মধ্যেও দুটি উপদল ছিল। যাঁরা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যবর্তী পথ ধরে চলতে চাইলেন, তাঁরা ‘মধ্যমক’ শাখার অন্তর্গত ছিলেন। অন্যদিকে যাঁরা বস্তুসত্তাকে চিৎসত্তায় পরিণত করে চৈতন্যরূপী জ্ঞানের মধ্যেই সমস্ত জগৎকে ধারণ করতে চাইলেন, তাঁরা গণ্য হতেন যোগাচার শাখার দার্শনিক হিসেবে। মধ্যমক মতের প্রবর্তক নাগার্জুন। যোগাচার মতের সাধন-পথের দিকটিতে অসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটির দার্শনিক দিকটি গড়ে ওঠে বসুবন্ধুর নেতৃত্বে। যোগাচারবাদীরা বলতেন, “সর্বং বুদ্ধিময়ং জগৎ”। এই কারণে এই মতটি ‘বিজ্ঞানবাদ’ নামেও পরিচিত ছিল।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার তথা বিজ্ঞানবাদ থেকে সহজযানে এই মতের রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পদক্ষেপ। এর পিছনে বৈদিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বলেই গবেষকদের ধারণা। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের দ্বারা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মেও দেবদেবীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এই দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু তন্ত্রের দেহকেন্দ্রিক যোগসাধনার প্রক্রিয়াটি যোগাচার মতে গ্রাস করে। ইতিপূর্বে যাঁরা ‘পারমিতা’ অর্থাৎ দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য প্রভৃতি পরম গুণের অনুশীলনের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বাবস্থা লাভের কথা বলতেন, তন্ত্রের প্রভাবে তাঁরাই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে আকাঙ্ক্ষিত বোধিসত্ত্বাবস্থাকে স্থায়ী করার কথা বললেন। এভাবে মন্ত্রের সংযোগে যোগাচার মত প্রথমে ‘মন্ত্রনয়’-এ পরিণত হল, তারপর এই পথেই নানাপ্রকার তান্ত্রিক গুহ্যাচার প্রবেশ করল এই মতে। বলা বাহুল্য, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মসাধনার মধ্যে তন্ত্রের আচারনিষ্ঠা প্রশ্নাতীত এবং এই মত বুদ্ধিগ্রাহ্য আলোচনা অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয় কার্যকরী আচার-পদ্ধতিকেই। তন্ত্রের হাত ধরে মন্ত্র, মণ্ডল ও মুদ্রা এভাবেই ঢুকে পড়ল শীল ও সদাচার-নির্ভর বৌদ্ধধর্মে। যৌনযোগাচার-কেন্দ্রিক সাধনপদ্ধতিও বাদ গেল না। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান পরিচিত হল বজ্রযান নামে। কালক্রমে বজ্রযানেও সাধনার তারতম্যে কিছু উপবিভাগ গড়ে উঠল: ক্রিয়াতন্ত্র, যোগতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র, অনুত্তরতন্ত্র। বজ্রযানের পরবর্তী পরিণতি কালচক্রযান ও সহজযান। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুথিতে উক্ত তিন যানের প্রভাব থাকলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সহজযানী বৌদ্ধ মত। তাই এই সহজযান মতটি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মহাযানী মতের শূন্যের ধারণাটি পূর্বেই বজ্রে পরিণত হয়েছিল। এবার বজ্র পরিণত হল ‘সহজ’-এ। ''হেবজ্রতন্ত্র'' মতে, জন্মের সঙ্গেই যা উৎপন্ন হয় তাই ‘সহজ’ (“সহজাত্যং যদুৎপন্নং সহজং তৎ প্রকীর্তিতম্।”)। দেহ হল সেই সহ-জ উপাদান, যা জীব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত হয়। হিন্দু তন্ত্রেও দেহের প্রাধান্য স্বীকার করে বলা হয়েছে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”। মহাযান মতে, শূন্যতা ও করুণার মিলনে যে বোধিচিত্তের উদ্ভব ঘটত, সহজযানে তা হল প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংযুক্তিতে। প্রজ্ঞা ‘প্রকৃতি’ রূপে এবং উপায় ‘পুরুষ’ রূপে বিবেচিত হল এই মতে। তন্ত্র মতে, পরমার্থ সত্য দুই রূপে প্রতিভাত—নিবৃত্তিরূপ পুরুষ বা শিব এবং প্রবৃত্তিরূপ প্রকৃতি বা শক্তি। যখন শিব ও শক্তি অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি অদ্বয়স্বরূপে মিলিত হয় তখন পরমার্থ সত্য লাভ করা যায়। এই মিথুন বা মিলিতাবস্থাই জীবের কাম্য। কারণ এই মিলন বিশ্বের সৃষ্টিপ্রবাহের কারণ। ''হঠযোগপ্রদীপিকা'' গ্রন্থে বলা হয়েছে, কায়াসাধনায় দেহস্থ বামগা নাড়ী ঈড়া ও দক্ষিণগা নাড়ী পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। এই দুই নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ ও অপান বায়ুকে দেহমধ্যস্থিত নাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত করে মস্তকে স্থিত সহস্রারে প্রেরণ করতে পারলেই অদ্বয় সিদ্ধি ঘটে। এই বিশুদ্ধ দার্শনিক বিষয়টির সঙ্গে পার্থিব নরনারীর যৌনমিলনকে এক করে ফেলা হয়েছে তন্ত্রের আর-একটি অপার্থ (malicious) ধারণায়। সেটি হল, প্রতিটি নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও শিব বিদ্যমান থাকলেও শিব-প্রাধান্যে যে-কোনও পুরুষই শিব এবং শক্তি-প্রাধান্যে নারীমাত্রেই শক্তি। অতএব শিব-শক্তির মিলন বলতে প্রাকৃত নরনারীর যৌনসংযোগকেই বোঝায়। চর্যার সাধকেরা যে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সাধনায় অগ্রসর হতেন, তার পিছনে তন্ত্রের এই প্ররোচনা বিপুলভাবে কাজ করেছে।
সহজযানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখের উপলব্ধি। মহাসুখের অপর নাম সহজ বা সহজানন্দ। নির্বাণ ও মহাসুখ এক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন। তাই সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গানে বারবার মহাসুখের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। চর্যাকার লুইপাদ চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করতে নির্দেশ দেন। ভুসুকুপাদ বলেন, তিনি মিলনলীলার মধ্যেই সহজানন্দ মহাসুখকে উপলব্ধি করেছেন। কম্বলাম্বরপাদ জানান, বাম ও দক্ষিণকে চেপে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মহাসুখ মিলন। এইভাবে কাহ্নপাদ, শবরীপাদ, দারিকপাদ প্রমুখ কবিদের রচনায় মহাসুখের স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, মহাসুখ বা সহজানন্দ একটি অচিন্ত্যনীয় মহাসুখকর অনুভব। এই সহজসুখ উৎপন্ন হয় যে স্থানে, সেই চরমকেন্দ্রটিকে কেউ জিনপুর, কেউ বা কামরূপ, আবার কেউ অনুত্তরধাম, পারিমকুল, কিংবা জোহ্নাবাড়ি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। মহাসুখের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাসগ্রহণের মতো বাহ্যানুষ্ঠান ত্যাগ করার কথাও বলে হয়েছে। প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলিত রূপই যুগনদ্ধ বলে কথিত। এই অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দের উদ্ভব ঘটে। সহজ মহাসুখের অপর লক্ষণ হল শূন্যতা। সাধকের অবস্থানভেদেও শূন্যতার প্রকারভেদ আছে। কায়, বাক্ ও চিত্তের সমবায়ে জীবের সত্তাবোধ। যখন এগুলির অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে তখনই বোধিচিত্তের সর্বশূন্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই অবস্থাকে চর্যাকারেরা নানা ভাবে প্রতীকায়িত করেছেন। কখনও বলেছেন শূন্য প্রান্তর, কখনও বা প্রতিবেশীহীন পর্বতের টিলা। বর্ণচিহ্নরূপহীন চরম শূন্যস্বভাব এই মহাসুখ। এর সর্বরিক্ত রূপ ভুসুকুপাদের ৪৯ সংখ্যক চর্যাটিতে প্রতীকী উপস্থাপনায় উজ্জ্বল। নির্দয় বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠন করে সেখানে। পঞ্চপাটন, ইন্দ্রের মতো বিষয়-আশয় সব বিনষ্ট হয়, সোনা-রুপো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চর্যার মহাসুখের ধারণাকে নানা মাত্রায় দেখা সম্ভব। কখনও তা মিলনজনিত একটি সহজ আনন্দঘন অবস্থা, আবার কখনও তা সর্বশূন্যের সার্থক পরিণাম। যেহেতু বিজ্ঞানবাদ থেকেই এর সূচনা, তাই এর মধ্যে নিরালম্ব বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকেও পাওয়া যায়। এবং এই মহাসুখবৃক্ষের ফল হল মহাকরুণা। দেহের মধ্যে চারটি অবস্থান কল্পনা করে চক্র, ক্ষণ, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি ভেদে মহাসুখের ক্রমোৎকর্ষের বিভিন্ন অভিধা কল্পনা করা হয়েছে। নিচের ছকটিতে তারই আভাস দেওয়া হল:
{| class="wikitable"
|-
| মস্তক || মহাসুখচক্র || সহজানন্দ || বিলক্ষণ || সর্বশূন্য || নৈরাত্মা || চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত
|-
| হৃদয় || ধর্মচক্র || বিরমানন্দ || বিমর্দ || মহাশূন্য || চিত্ত || গ্রাহ্য ও গ্রাহক শূন্য
|-
| কণ্ঠ || সম্ভোগচক্র || পরমানন্দ || বিপাক || অতিশূন্য || বাক্ || গ্রাহক শূন্য
|-
| নাভি || নির্মাণচক্র || প্রথমানন্দ || বিচিত্র || শূন্য || কায় || গ্রাহ্যশূন্য
|}
সাধ্য এই মহাসুখকে সাধক কীভাবে লাভ করেন অর্থাৎ চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত সাধনার পথটি কী তাও আলোচনা করা হয়েছে। চর্যার হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় ভাষা ভেদ করে যেটুকু বোঝা গিয়েছে তা হল, এই ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী যখন মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন যাবতীয় সুখদুঃখের অনুভূতি জীবের অস্তিত্বকে মথিত করে। আর যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং মধ্যনাড়ী সুষুম্নার পথে চালিত হয়, তখন বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সাংবৃতিক বোধিচিত্ত এইভাবে পারমার্থিক বোধিচিত্তে পরিণত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়। সম্পূর্ণ মননপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এই সাধনপথটি কবিরা রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই রূপক কোথাও নৌকা বাওয়ার, কোথাও ইঁদুর মারার, কোথাও মত্ত হাতির পদ্মবন বিনষ্ট করার, আবার কোথাও তুলো ধোনা কিংবা মদ চোলাইয়ের। পুদ্গলচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে পারলেই জিনপুরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ডোম্বীপাদ তাঁর একটি পদে এই নাড়ীদ্বয় ও মধ্যপথে তাদের প্রবেশ করানোর বিষয়টি প্রতীকী আভাসে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন:
<poem>
:: গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
:: তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলেঁ পার করেই।।...
:: চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
:: বাম দাহিন দুই মাগ ন রেবই বাহতু ছন্দা।।
</poem>
এমন বহু পদেই কায়াসাধনার তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত। কাহ্নপাদের একটি পদে কাপালিক যোগীর সাধনায় দেহপ্রাধান্য সরাসরি উচ্চারিত: “দেহ নঅরী বিহরই একাকারেঁ”। চর্যাগীতিগুলিতে গুরুবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। গুহ্য সাধনপ্রক্রিয়া মাত্রেই গুরুগম্য জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিশেষত তান্ত্রিক আচারে অনভিজ্ঞ বালযোগীকে দেহকেন্দ্রিক কৃত্যাদিতে সাহায্য করেন গুরু। তাই চর্যাকারেরা বলেছেন: “বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি”, কিংবা “সদ্গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল”, অথবা “সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুনু জিনউরা” ইত্যাদি। কোথাও আবার গুরুর অপ্রয়োজনীতা ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে “গুরু বোব সিসা কাল”। আসলে বিশুদ্ধ তত্ত্বকথায় গুরুর ভূমিকা ন্যূনতম, কিন্তু তান্ত্রিক গুহ্যাচার পালনে গুরুই পথনির্দেশক। চর্যায় সাধকের নানা অবস্থার বর্ণনা আছে। যখন তিনি বিষয়বদ্ধ তখন একরকম, সাধনার প্রাথমিক স্তরে অন্যরকম, ক্রমশ প্রবৃত্তিনাশে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত, মস্তক বা উষ্ণীষকমলে যখন তাঁর চিত্তের অবস্থান তখন সে অনুভূতি ভিন্ন ধরনের, আবার সহজানন্দ লাভের পর সিদ্ধ সাধকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিটি স্তরে সাধক এক-একজন শক্তি বা সাধনসঙ্গিনীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এঁরাই সংকলিত পদগুলিতে শবরী, ডোম্বী, চণ্ডালী, যোগিনী, নৈরামণি ইত্যাদি নামে খ্যাত। সম্ভোগচক্রের নৈরামণি মহাসুখচক্রে উন্নীত হয়ে সহজসুন্দরীতে পরিণত হন। এইভাবে প্রেমের রূপকে সাধনকথা পরিবেশিত হয়েছে এখানে। বস্তুত এই পথ ধরেই সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবশ্যম্ভাবী পতনের বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল। মূলত ব্যভিচারের কারণে বৃহত্তর সমাজ সেই আমলে এদের বর্জন করতে চেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের পর মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘নেড়া-নেড়ী’ নামে অভিহিত হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এঁদের বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষিত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বীরভদ্রের বৈষ্ণব সাধনায় কিছুটা সহজিয়া প্রভাব পড়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
==ভাষা==
চর্যাপদের ভাষাপ্রসঙ্গটি বিতর্কিত। বিশেষত চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই। উক্ত বইটি ছিল চারটি পুথির সংকলন: মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা সহ চর্যাপদের পুথি, সরহপাদ ও কাহ্নপাদের ''দোহাকোষ'' পুথিদ্বয় এবং ''ডাকার্ণব''। শাস্ত্রী মহাশয় চারটি পুথিই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার লেখা বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই মত সবাই মেনে নেননি। বিতর্কের সূচনা সেই থেকেই। আসলে চর্যাপদ যে সময়ে রচিত হয়েছে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সেই সময়টি নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির উদ্ভবকাল। সবে তখন অপভ্রংশের গর্ভ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, মগহি, অওধি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষা ভূমিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। একই জঠরে বেড়ে ওঠার ফলে এগুলির মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও শব্দভাণ্ডারগত পার্থক্য খুবই কম। গবেষকদের বিভ্রান্তির কারণ সেটাই। ভাষা সাবালক হলে তার এমন কিছু নিজস্ব চিহ্ন প্রকাশিত হয়, যেগুলি ভাষার প্রভেদকারী বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটার আগেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে, ফলে সংশয়ের জাল সহজেই বিস্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯২০ সালে ভাষাতাত্ত্বিক বিজয়চন্দ্র মজুমদার ''বঙ্গবাণী'' মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে এবং ''হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ'' গ্রন্থে বলেন যে, চর্যাগীতিগুলি পুরনো বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি, এতে দু-চারটি বাংলা, ওড়িয়া ও অসমিয়া পদ থাকলেও মূল ভাষাছাঁদ হিন্দির। ১৯২১ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হারমান জেকবি তাঁর সম্পাদিত ''সনৎকুমারচিতম্'' গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের ভাষাকে “All Bengalishch” বা প্রত্ন-বাংলা বলে নির্দেশ করেন, কিন্তু কোনও খাঁটি যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ''দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ'' গবেষণাগ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ, বাগ্বিধি ইত্যাদি বিচার করে প্রথম একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন যে, ''দোহাকোষ'' দুটির ও ''ডাকার্ণব'' পুথির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ, কিন্তু চর্যাগানের ভাষা আদিতম বাংলা। অবশ্য এই বাংলায় কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ এবং দু-চারটি ওড়িয়া-মৈথিলী শব্দ মিশে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী ও বাস্তবসিদ্ধ যুক্তিগুলি মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাঁর ''Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha'' গবেষণাগ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতটি মেনে নেন।
অন্যান্য ভাষার গবেষকেরাও অবশ্য চর্যাপদ তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জয়কান্ত মিশ্র ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল বলেন, চর্যাপদের ভাষা বিহারি এবং সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই মগধ অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৩৫ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের সপ্তম অধিবেশনে উক্ত তিন হিন্দিভাষী পণ্ডিত চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করেন। চর্যায় ‘জো’, ‘সো’, ‘তো’, ‘মই’ প্রভৃতি সর্বনাম, ‘অইসন’, ‘জইসন’, ‘ঐছে’, ‘তৈছে’, ‘জিস’, ‘তিস’, ‘জসু’, ‘তসু’ প্রভৃতি সর্বনামীয় ক্রিয়াবিশেষণ, ‘রাতি পোহাইলী’-র ন্যায় ক্রিয়াপদের স্ত্রীলিঙ্গীকরণে হিন্দি ও মৈথিলীর বিশেষত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখার যে এই দুই ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ‘-ক’, ‘-কো’ বিভক্তি যোগে ষষ্ঠীর পদগঠন এবং ‘-অল’, ‘-অব’ বিভক্তি যোগে যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠনের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে নেই। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার দাবিও চর্যাপদের উপর আছে। যেমন, ওড়িয়াতে সংস্কৃত প্রভাবজাত বর্তমান কালবাচক ক্রিয়াপদে ‘-অন্তি’ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়: “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী” কিংবা “ভনন্তি মহিণ্ডা”। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, ‘-রু’ দিয়ে অপাদানের পদগঠন, সর্বত্র ‘-র’ বিভক্তি দ্বারা ষষ্ঠীর পদগঠন, ‘-মানে’ পরসর্গ যোগে বহুবচনের পদনির্মাণ, যা ওড়িয়া ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ, তার একটি দৃষ্টান্তও চর্যাগানে পাওয়া যায় না। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু-একটি ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও কয়েকটি বিশিষ্ট ও প্রধান ক্ষেত্রে চর্যাগীতির বাক্যগঠন রীতি অসমিয়া ভাষার তুলনায় পৃথক। চর্যার ভাষায় শৌরসেনী অপভ্রংশের লক্ষণ ও শব্দের ব্যবহারও স্বাভাবিক। কারণ, মাগধী প্রাকৃত থেকে জাত মাগধী অপভ্রংশ প্রাত্যহিক ব্যবহারে প্রচলিত থাকলেও শিষ্ট সাহিত্যের ভাষা হিসেবে অষ্টম-নবম শতকে ব্যবহৃত হত শৌরসেনী অপভ্রংশ। চর্যাকারেরা যে যুগের মানুষ ছিলেন সেই যুগের বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। সেযুগের বাংলা-বিহারের বৌদ্ধ সংঘগুলিতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হতেন শিক্ষা ও ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে। ভাষা হিসেবে শৌরসেনী অপভ্রংশের গ্রহণযোগ্যতা সেযুগে ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু চর্যাপদে বাংলা ভাষার লক্ষণ, যা ত্রিস্তরীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেও আধুনিক যুগেও সমানভাবে উপস্থিত, তা এমনভাবে সেঁটে রয়েছে যে তার পরিমাণগত প্রাচুর্যে একে অবশ্যই প্রাচীন বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশিষ্ট গবেষকদের আলোচনার সারাৎসারটুকু উপস্থিত করে বাংলার এই বিশিষ্ট লক্ষণগুলিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে:
; (ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, ৯ প্রভৃতি বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় এলেও বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ পার্থক্য রক্ষিত হয় না। চর্যার বানানেও এই বিশেষ লক্ষণটি দেখা যায়। যেমন, চিএ, চিঅ; হোহী, হোহি; লুই, লূই; বোহী, বোহি ইত্যাদি।
# স্বরবর্ণের মতো ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্বতন্ত্র ধ্বনিজ্ঞাপক চিহ্ন থাকলেও বাংলায় সেগুলির উচ্চারণে বিশেষ পার্থক্য নেই। জ-য, ণ-ন, শ-ষ-স ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। চর্যাতেও স্বভাবতই এইসব বর্ণের লিপি-বিপর্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন, জোইনি, যোইনী; যাই, জাই; নাবী, ণাবী; শবর, সবর; শূন, সূণ; ষিআলা, শিয়ালী ইত্যাদি।
# অর্থপার্থক্য সৃষ্টি কিংবা বিশেষ কোনও আবেগ প্রকাশের জন্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। চর্যার ভাষায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, ফাড্ডিঅ, নিঅড্ডী, চ্ছাড়ী ইত্যাদি।
; (খ) রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
# বাংলা ভাষার সমস্ত কারকে ‘-এ’ বিভক্তির প্রয়োগ লক্ষিত হয়। চর্যার ভাষাতেও ‘-এ’ বা ‘-এঁ’ বিভক্তির এইরকম প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, কর্তৃকারকে—কুম্ভীরে খাঅ; কর্মকারকে—গঅবরেঁ তোলিআ; করণকারকে—কুঠারে ছিজঅ; সম্প্রদান কারকে—ধামার্থে চাটিল; অপাদান কারকে—জামে কাম কি কামে জাম; অধিকরণ কারকে—ঘরে সান্ধঅ।
# আধুনিক বাংলায় যেমন কর্ম-কর্তৃ বাচ্য গঠন করা হয়ে থাকে, চর্যাতেও অবিকল তারই প্রতিরূপ দেখা যায়। যেমন, নানা তরুবর মৌলিল রে, ডমরু বাজএ বীরনাদে।
# বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ চর্যাতেও বিভিন্ন কারকে দেখা যায়। যেমন, তৃতীয়াতে ‘-তেঁ’ বিভক্তি (সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই); চতুর্থীতে ‘-রেঁ’ বিভক্তি (সো করউ রস রসানেরে কংখা); ষষ্ঠীতে ‘-র’/‘এর’ বিভক্তি (সাঙ্কমত চড়িলে; দুধিল দুধ কি বেণ্টে ধামায়) ইত্যাদি।
# বাংলার নিজস্ব কিছু অনুসর্গ (মাঝে, অন্তরে, সঙ্গে ইত্যাদি) আছে। চর্যায় এগুলির প্রয়োগও অপ্রতুল নয়। যেমন, কোড়ি মাঝেঁ একু; তোহার অন্তরে; দুজ্জন সাঙ্গে অবসরি জাই ইত্যাদি।
# স্বাধীন অব্যয় রূপে উপসর্গের প্রয়োগেও বাংলার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। উপসর্গগুলি অব্যয় হিসেবে বিশেষ্যের পূর্বে বসে বিচিত্র অর্থপ্রকাশে সাহায্য করে। চর্যাপদেও এই লক্ষণ দৃশ্যমান। যেমন, <u>নি</u>সারা, <u>বি</u>আলী, <u>স</u>চ্চড়ে, <u>বি</u>মনা ইত্যাদি।
# আধুনিক বাংলায় ‘সে’ শব্দটি মুখ্যত সর্বনাম হিসেবে, আবার কখনও বা বাক্যালংকার অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্য ভাষায় শব্দটি বসে বিশেষণ ও সর্বনাম হিসেবেই। বাক্যকে অলংকৃত করার উদ্দেশ্যে বাংলা ছাড়া আর কোথাও ‘সে’ বসে না। চর্যায় ‘সে’ ও একই অর্থে ‘সো’-এর ব্যবহার দেখা যায় যত্রতত্র। যেমন, এক সে শুণ্ডিনী, এক সো পদুমা, গুরু বোস সে সীসা কাল ইত্যাদি।
; (গ) ক্রিয়াপদের বৈশিষ্ট্য
# বিভিন্ন ক্রিয়ার কাল গঠনে ধাতুরূপে বিশিষ্ট বিভক্তির প্রয়োগ করা হয় বাংলায়। পুরুষ ও বচন ভেদেও তা পৃথক। ভবিষৎকালে ‘-ইব’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয় উত্তম পুরুষে, অতীতকালে প্রথম পুরুষে বসে ‘-ইল’ বিভক্তি এবং অসমাপিকায় ‘-ইয়া’ বা ‘-ইলে’ ইত্যাদি প্রযুক্ত হয়। এইসব লক্ষণ চর্যার ভাষাতেও পাওয়া যায়। যেমন, জই তুম্হে লোঅ হে হেইব পারগামী; কাহ্নু কহি গই করিব নিবাস; কানেট চৌরি নিল অধরাতি; সসুরা নিদ গেল; মাঅ মারিআ কাহ্ন ভইঅ কবালী; সাঙ্কমত চড়িলে ইত্যাদি।
# বাংলা ক্রিয়াপদের অপর বিশেষত্ব হল যৌগিক বা সংযোগমূলক ক্রিয়াপদ গঠন। দুভাবে এই পদ গঠিত হয়। অসমাপিকার সঙ্গে সমাপিকার সংযোগে অথবা বিশেষ্য বা বিশেষণ পদের সঙ্গে সমাপিকার সংযোগে। কেউ কেউ এই জাতীয় ক্রিয়াপদকে বাংলা ভাষার দুর্বলতা বলেও নির্দেশ করেছেন। চর্যাপদেও আছে—গুণিআ লেহুঁ; টুটি গেল, ধরণ ন জাই; নিদ গেল; কহন ন জাই; ভান্তি ন বাসসি; ছই ছোই যাই ইত্যাদি।
# বাংলা ভাষায় বিশিষ্ট ভঙ্গির জন্ম হয়েছে বাক্যে ক্রিয়াপদের বাহ্যিক অনুপস্থিতি থেকে। এই লক্ষণ বাংলা গদ্যের সূচনাতেই লক্ষ্য করা যায়। চর্যাপদের ভাষাতেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, কায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল; ছড়গই সঅল সহাবে সুধ; গন্ধ পরস রস জইসো তইসো।
# বাংলার বিভিন্ন বাগ্বিধির ব্যবহারেও চর্যাপদের ভাষা সহজে অলংকৃত। এইসব বিশিষ্টার্থক বাক্যরীতি পরে কালবাহিত হয়ে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। যেমন, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, হাথেরে কাঙ্কন মা লেউ দাপন, ভান্তি ন বাসসি জাংতে, তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী, বর-সুণ গোহালী কিমো দুঠ বলন্দেঁ ইত্যাদি।
এইসব বাস্তব প্রমাণের ভিত্তিতে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, “The language of the charyas is the genuine vernacular of Bengal at its basis.” চর্যাপদের উপর অন্যান্য ভাষার দাবি নিরপেক্ষভাবে বিচার করে এটুকুই বলা যায় যে, চর্যাগীতিতে বিক্ষিপ্তভাবে ওড়িয়া, অসমিয়া, হিন্দি ও মৈথিলী শব্দ ছড়িয়ে থাকলেও এর মূল প্রকাশ্য ছাঁদটিই ছিল মাগধী অপভ্রংশের গুটি কেটে বেরিয়ে আসা সদ্যোজাত বাংলা ভাষার। তখনও তার পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত না হলেও তার নিজস্বতার অস্ফুট চিহ্নগুলি চর্যাপদের শারীরিক গড়নে ঠিকই ধরা পড়ে।
0wahvsztcj1jkl3b350zjw4z3bnqpsx
টেমপ্লেট:Wikipedia-inline
10
27232
85528
2025-07-01T15:32:59Z
Mehedi Abedin
7113
"{{#if:{{{list|}}} |* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] [[উইকিবই]]য়ে পাঠ্য: {{{list}}} |* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] উইকিপিডিয়ায় {{{links|[[w:{{{1|Special:Search/{{PAGENAME}}}}}|{{{2|{{{1|{{PAGENAME}}}}}}}}]]}}}। }}<noinclude> ---- Adapted from [[w:Template:Wikibooks-inline]]. History given on this [[Template talk:Wikipedia-inline|template talk page]].Category:Wikipedia l..." দিয়ে পাতা তৈরি
85528
wikitext
text/x-wiki
{{#if:{{{list|}}}
|* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] [[উইকিবই]]য়ে পাঠ্য:
{{{list}}}
|* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] উইকিপিডিয়ায় {{{links|[[w:{{{1|Special:Search/{{PAGENAME}}}}}|{{{2|{{{1|{{PAGENAME}}}}}}}}]]}}}।
}}<noinclude>
----
Adapted from [[w:Template:Wikibooks-inline]]. History given on this [[Template talk:Wikipedia-inline|template talk page]].[[Category:Wikipedia link templates|Inline]]</noinclude>
iwghcx88phwmraz8oormrp522p9sylg
85529
85528
2025-07-01T15:33:26Z
Mehedi Abedin
7113
85529
wikitext
text/x-wiki
{{#if:{{{list|}}}
|* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] [[উইকিবই]]য়ে পাঠ্য:
{{{list}}}
|* [[Image:Wikipedia-logo-v2.svg|20px| ]] উইকিপিডিয়ায় {{{links|[[w:{{{1|Special:Search/{{PAGENAME}}}}}|{{{2|{{{1|{{PAGENAME}}}}}}}}]]}}}।
}}<noinclude>
----
Adapted from [[w:Template:Wikibooks-inline]]. History given on this [[Template talk:Wikipedia-inline|template talk page]].[[বিষয়শ্রেণী:উইকিপিডিয়া সংযোগ টেমপ্লেট|Inline]]</noinclude>
if9yj052bsx2j6gt3ox1aerf76r2mgv
দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ
0
27233
85533
2025-07-01T15:35:48Z
Mehedi Abedin
7113
Mehedi Abedin [[দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ]] কে [[দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]] শিরোনামে স্থানান্তর করেছেন
85533
wikitext
text/x-wiki
#পুনর্নির্দেশ [[দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]]
hfjv64alv9btlut5neeqfc71kekzsvz
আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ
1
27234
85535
2025-07-01T15:35:49Z
Mehedi Abedin
7113
Mehedi Abedin [[আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/স্বাধীনতাবাদ]] কে [[আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]] শিরোনামে স্থানান্তর করেছেন
85535
wikitext
text/x-wiki
#পুনর্নির্দেশ [[আলাপ:দর্শনের সাথে পরিচয়/উদারনীতিবাদ]]
i9pki5i86har9t1qyff4o2hniydbvef
ব্যবহারকারী আলাপ:FireDragonValo
3
27235
85545
2025-07-01T22:40:20Z
KanikBot
8129
স্বাগতম!
85545
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ২২:৪০, ১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
75q035wq915ptegphhgdpgju8w5nn7m