উইকিবই
bnwikibooks
https://bn.wikibooks.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE
MediaWiki 1.45.0-wmf.9
first-letter
মিডিয়া
বিশেষ
আলাপ
ব্যবহারকারী
ব্যবহারকারী আলাপ
উইকিবই
উইকিবই আলোচনা
চিত্র
চিত্র আলোচনা
মিডিয়াউইকি
মিডিয়াউইকি আলোচনা
টেমপ্লেট
টেমপ্লেট আলোচনা
সাহায্য
সাহায্য আলোচনা
বিষয়শ্রেণী
বিষয়শ্রেণী আলোচনা
উইকিশৈশব
উইকিশৈশব আলাপ
বিষয়
বিষয় আলাপ
রন্ধনপ্রণালী
রন্ধনপ্রণালী আলোচনা
TimedText
TimedText talk
মডিউল
মডিউল আলাপ
ব্যবহারকারী:Alphaa Noman
2
7171
85936
85265
2025-07-11T06:49:12Z
Alphaa Noman
3111
/* শিক্ষাজীবন */
85936
wikitext
text/x-wiki
আমি আব্দুল্লাহ আল নোমান। আমি উইকিপিডিয়াতে Alphaa Noman নামটি ব্যবহার করে থাকি। ২০১৫ সালে বাংলা উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ শুরু করি। বর্তমানে আমি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী।
==শিক্ষাজীবন==
*বেনাপোল মর্ডান ইংলিশ ইন্সটিটিউট (বেনাপোল স্থল, যশোর)
*বেনাপোল রেসিডেনসিয়াল ইন্সটিটিউট (বেনাপোল স্থল, যশোর)
*[[w:আকিজ কলেজিয়েট স্কুল|আকিজ কলেজিয়েট স্কুল]] (নাভারণ, যশোর)
*[[w:মোংলা বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়|মোংলা বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়]]
*[[w:গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়|আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, গোবিপ্রবি]]
kakycomrikxywob04g6fargwet1megp
আলাপ:বাংলা যুক্তাক্ষর
1
9853
85931
59995
2025-07-10T14:50:16Z
2409:4040:410:BD96:0:0:2A50:B0AC
/* সম্পাদনার অনুরোধ, ১০ জুলাই ২০২৫ */ নতুন অনুচ্ছেদ
85931
wikitext
text/x-wiki
== আরো কিছু যুক্তাক্ষর ==
বাংলায় ২৮৫ টি যুক্তাক্ষর ছাড়াও প্রচলিত শব্দে আরো কিছু ভিন্ন যুক্তক্ষরের প্রচলন আছে৷ তা যোগ করা হলো৷ - [[ব্যবহারকারী:শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য|শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য|আলাপ]]) ১৮:০১, ২৯ অক্টোবর ২০১৯ (ইউটিসি)
== সম্পাদনার অনুরোধ, ১০ জুলাই ২০২৫ ==
{{সম্পাদনার অনুরোধ| উত্তর=না}}
<!-- অনুরোধ শুরু -->
<!-- অনুরোধ শেষ -->
[[বিশেষ:অবদান/2409:4040:410:BD96:0:0:2A50:B0AC|2409:4040:410:BD96:0:0:2A50:B0AC]] ১৪:৫০, ১০ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
ক্ক ক্ট ক্ট্য ক্ট্র ক্ত ক্ত্ব ক্ত্য ক্ত্র ক্ন ক্ব ক্ম ক্য ক্র ক্ল ক্ষ ক্ষ্ণ ক্ষ্ব ক্ষ্ম ক্ষ্ম্য ক্ষ্য ক্স খ্ব খ্য খ্র গ্গ গ্ঘ গ্ণ গ্ণ গ্দ গ্দ্ব গ্দ্য গ্দ্র গ্ধ গ্ধ্য গ্ধ্র গ্ধ্ব গ্ন গ্ন্য গ্ব গ্ম গ্য গ্র গ্র্য গ্ল গু ঘ্ন ঘ্য ঘ্র ঘ্ব ঙ্ক ঙ্ক্ত ঙ্ক্ত ঙ্ক্ব ঙ্ক্য ঙ্ক্র ঙ্ক্ষ ঙ্ক্ত্য ঙ্ক্ত্র ঙ্ক্ষ্য ঙ্ক্ষ্ম ঙ্ক্ষ্ম্য ঙ্খ ঙ্খ্য ঙ্খ্র ঙ্গ ঙ্গ্ব ঙ্গ্য ঙ্গ্র ঙ্ঘ ঙ্ঘ্ব ঙ্ঘ্য ঙ্ঘ্র ঙ্ম চ্চ চ্ছ চ্ছ্ব চ্ছ্র চ্ঞ চ্ব চ্য চ্র জ্জ জ্জ্ব জ্জ্য জ্জ্র জ্ঝ জ্ঞ জ্ব জ্য জ্র ঞ্চ ঞ্ছ ঞ্জ ঞ্ঝ ট্ট ট্ব ট্ম ট্য ট্র ড্ড ড্ব ড্ম ড্য ড্র ড়্গ ড্র্য ঢ্য ঢ্র ণ্ট ণ্ঠ ণ্ঠ্য ণ্ড ণ্ড্য ণ্ড্র ণ্ঢ ণ্ণ ণ্ন ণ্ব ণ্ম ণ্য ত্ক ত্ত ত্ত্ব ত্ত্য ত্ত্র ত্থ ত্ন ত্ব ত্ম ত্ম্য ত্য ত্র ত্র্য ত্ল ত্স থ্ব থ্য থ্র দ্গ দ্ঘ দ্দ দ্দ্ব দ্দ্য দ্দ্র দ্ধ দ্ধ্য দ্ধ্র দ্ধ্ব দ্ব দ্ব্য দ্ভ দ্ভ্র দ্ম দ্য দ্র দ্র্য ধ্ন ধ্ব ধ্ম ধ্য ধ্র ন্ট ন্ট্র ন্ট্ব ন্ট্য ন্ঠ ন্ড ন্ড্র ন্ড্ব ন্ড্য ন্ত ন্ত্ব ন্ত্য ন্ত্র ন্ত্র্য ন্ত্ব্য ন্ত্ব্র ন্ত্ব্র্য ন্থ ন্থ্র ন্থ্ব ন্থ্য ন্দ ন্দ্য ন্দ্ব ন্দ্র ন্ধ ন্ধ্য ন্ধ্র ন্ধ্ব ন্ন ন্ব ন্ম ন্য প্ট প্ত প্ন প্প প্য প্র প্র্য প্ল প্স ফ্র ফ্ল ব্জ ব্দ ব্দ্ব ব্দ্য ব্দ্র ব্ধ ব্ব ব্য ব্র ব্ল ভ্ব ভ্য ভ্র ভ্ল ম্ন ম্প ম্প্র ম্ফ ম্ব ম্ব্র ম্ভ ম্ভ্র ম্ম ম্য ম্র ম্ল য্য র্ক র্ক্য র্গ্য র্ঘ্য র্চ্য র্জ্য র্ণ্য র্ত্য র্থ্য র্দ্য র্ধ্য র্প্য র্ঙ্ক র্ঙ্গ র্ঙ্ঘ র্ঞ্চ্য র্ঞ্ছ্য র্ঞ্জ্য র্ঞ্ঝ্য র্ব্য র্ম্য র্শ্য র্ষ্য র্হ্য র্খ র্গ র্গ্র র্ঘ র্চ র্ছ র্জ র্ঝ র্ট র্ঠ র্ড র্ঢ র্ণ র্ত র্ত্র র্থ র্দ র্দ্ব র্দ্র র্ধ র্ধ্ব র্ন র্প র্ফ র্ব র্ভ র্ম র্য র্র র্ল র্শ র্শ্ব র্ষ র্স র্হ র্ঠ্য র্ঢ্য র্ন্ট র্স্ট র্ক্ট র্ষ্ট র্ন্ড র্ণ্ড র্ণ্ঠ র্ল্ড র্ল্ট র্স্প র্ষ্ণ র্ন্ত র্ন্ত্র্য র্ব্ব র্স্প্র র্শ্চ র্শ্ন র্স্ল র্স্প্ল র্ষ্ণ্য র্হ্ব র্হ্র রু রূ ল্ক ল্ক্য ল্গ ল্ট ল্ড ল্প ল্ফ ল্ফ ল্ব ল্ভ ল্ভ ল্ম ল্য ল্ল শ্চ শ্ছ শ্ত শ্ন শ্ব শ্ম শ্য শ্র শ্ল শু ষ্ক ষ্ক্র ষ্ক্য ষ্ট ষ্ট্য ষ্ট্র ষ্ঠ ষ্ঠ্য ষ্ণ ষ্ন ষ্প ষ্প্র ষ্প্য ষ্ফ ষ্ব ষ্ম ষ্য ষ্ল স্ক স্ক্র স্খ স্ট স্ট্র স্ত স্ত্ব স্ত্য স্ত্র স্থ স্থ্য স্ন স্প স্প্র স্প্ল স্প্ল স্ফ স্ব স্ম স্য স্র স্ল হ্ণ হ্ন হ্ব হ্ম হ্য হ্র হ্ল হু হৃ গু রু রূ শু হু হৃ খ্রু খ্রূ গ্রু গ্রূ চ্রু চ্রূ ছ্রু ছ্রূ জ্রু জ্রূ ঝ্রু ঝ্রূ ত্রু ত্রূ থ্রু থ্রূ দ্রু দ্রূ ধ্রু ধ্রূ প্রু প্রূ ব্রু ব্রূ ভ্রু ভ্রূ ম্রু ম্রূ ও শ্রু শ্রূ স্রু স্রূ হ্রু হ্রূ হ্রৃ গ্লু গ্লূ ত্লু ত্লূ থ্লু থ্লূ দ্লু দ্লূ ধ্লু ধ্লূ প্লু প্লূ ব্লু ব্লূ ভ্লু ভ্লূ ম্লু ম্লূ শ্লু শ্লূ স্লু স্লূ হ্লু হ্লূ হ্লৃ ন্দ্রু ন্দ্রূ ব্দ্রু ব্দ্রূ দ্দ্রু দ্দ্রূ জ্জ্রু জ্জ্রূ
2hopf1v7gr9f0tk3x0sr78z43gx21ki
উইকিবই:সম্পাদনার সংখ্যা অনুযায়ী উইকিবইয়ের সম্পাদকগণ/১-১০০
4
10682
85935
85635
2025-07-11T05:50:13Z
KanikBot
8129
হালনাগাদ
85935
wikitext
text/x-wiki
:সর্বশেষ হালনাগাদ: ০৫:৫০, ১১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
{| class="wikitable"
! নং !! ব্যবহারকারী নাম !! মোট সম্পাদনা
|-
|১||{{u|MdsShakil}}||১১১১১
|-
|২||{{u|ShahadatHossain}}||৪২১৫
|-
|৩||{{u|Aishik Rehman}}||৩৭০৪
|-
|৪||{{u|Tahmid}}||৩৫৮৯
|-
|৫||{{u|Salil Kumar Mukherjee}}||৩৫৮২
|-
|৬||{{u|মোহাম্মদ জনি হোসেন}}||২৩১৯
|-
|৭||{{u|R1F4T}}||১৪৯০
|-
|৮||{{u|IqbalHossain}}||১২৭৯
|-
|৯||{{u|RDasgupta2020}}||১১৫২
|-
|১০||{{u|Asikur.rahman25}}||১১৩০
|-
|১১||{{u|SHEIKH}}||১১১৬
|-
|১২||{{u|Sumasa}}||১০৫৬
|-
|১৩||{{u|কমলেশ মন্ডল}}||১০৪৬
|-
|১৪||{{u|Sheikh Mehedi Hassan}}||১০২৯
|-
|১৫||{{u|Jonoikobangali}}||১০২৭
|-
|১৬||{{u|MD Abu Siyam}}||১০২৫
|-
|১৭||{{u|SMontaha32}}||৯৪৩
|-
|১৮||{{u|Md.Farhan Mahmud}}||৯৩২
|-
|১৯||{{u|আ হ ম সাকিব}}||৯১৭
|-
|২০||{{u|Md Rashidul Hasan Biplob}}||৯১৫
|-
|২১||{{u|Alphaa Noman}}||৯১২
|-
|২২||{{u|Rajan chandra Saha Raju}}||৮৩৩
|-
|২৩||{{u|MS Sakib}}||৮২৩
|-
|২৪||{{u|আফতাবুজ্জামান}}||৭৮৯
|-
|২৫||{{u|AstroWizard}}||৭৬৫
|-
|২৬||{{u|Mehedi Abedin}}||৭৪১
|-
|২৭||{{u|Yahya}}||৭২৫
|-
|২৮||{{u|শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য}}||৬৪৬
|-
|২৯||{{u|Md Mobashir Hossain}}||৬২৫
|-
|৩০||{{u|Firuz Ahmmed}}||৫৮৯
|-
|৩১||{{u|Nettime Sujata}}||৫০১
|-
|৩২||{{u|NusJaS}}||৪৮৭
|-
|৩৩||{{u|Jayantanth}}||৪৮৩
|-
|৩৪||{{u|Bosesukla}}||৪৪০
|-
|৩৫||{{u|MdaNoman}}||৪৩৪
|-
|৩৬||{{u|Pathoschild}}||৩৭৩
|-
|৩৭||{{u|Szilard}}||৩৫৭
|-
|৩৮||{{u|Ei to ami akash}}||৩৫১
|-
|৩৯||{{u|RiazACU}}||৩৪৪
|-
|৪০||{{u|Mcepy}}||৩৪০
|-
|৪১||{{u|NahidSultan}}||৩১৮
|-
|৪২||{{u|ZI Jony}}||৩১৪
|-
|৪৩||{{u|Mahbubslt}}||৩১০
|-
|৪৪||{{u|Gallileo2k}}||৩০৬
|-
|৪৫||{{u|স্বপ্নীল কর্মকার কাব্য}}||২৯৮
|-
|৪৬||{{u|Muhammad}}||২৯৭
|-
|৪৭||{{u|Md Aahradul Islam Tasin}}||২৮৫
|-
|৪৮||{{u|The Piash}}||২৫৮
|-
|৪৯||{{u|M.Asaduzzaman sahed}}||২৪৭
|-
|৫০||{{u|Pratyya Ghosh}}||২৩৩
|-
|৫১||{{u|Safuan12616}}||২২৯
|-
|৫২||{{u|AbuSayeed}}||২২৩
|-
|৫৩||{{u|Somajyoti}}||২২০
|-
|৫৪||{{u|Sheikh MD. Obaidul Hossain}}||২১৩
|-
|৫৫||{{u|তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী}}||২০৮
|-
|৫৬||{{u|মো. মাহমুদুল আলম}}||২০৮
|-
|৫৭||{{u|নিয়াজ ইসলাম}}||২০২
|-
|৫৮||{{u|Shuvo Hulk}}||১৯৬
|-
|৫৯||{{u|Sajidmahamud835}}||১৮৮
|-
|৬০||{{u|Obangmoy}}||১৭৬
|-
|৬১||{{u|Shakibul Alam Risvy}}||১৬৫
|-
|৬২||{{u|Greatder}}||১৬০
|-
|৬৩||{{u|Safi Mahfouz}}||১৫৯
|-
|৬৪||{{u|মোহাম্মদ হাসানুর রশিদ}}||১৪২
|-
|৬৫||{{u|Maruf}}||১৪১
|-
|৬৬||{{u|Wikitanvir}}||১৪০
|-
|৬৭||{{u|Belayet73}}||১৩০
|-
|৬৮||{{u|Masud1395}}||১২৮
|-
|৬৯||{{u|Asked42}}||১২৭
|-
|৭০||{{u|Hasan muntaseer}}||১২০
|-
|৭১||{{u|Anubhab91}}||১০৬
|-
|৭২||{{u|Bono.Ruma}}||১০৫
|-
|৭৩||{{u|FARMER}}||১০২
|-
|৭৪||{{u|Moheen}}||৯৮
|-
|৭৫||{{u|MR.ANABRATA GUCHAIT}}||৯৪
|-
|৭৬||{{u|Sammati Das}}||৯০
|-
|৭৭||{{u|Mohithasan61}}||৮৯
|-
|৭৮||{{u|Timeontask}}||৮৫
|-
|৭৯||{{u|BadhonCR}}||৮৩
|-
|৮০||{{u|খাত্তাব হাসান}}||৮২
|-
|৮১||{{u|কায়সার আহমাদ}}||৭৭
|-
|৮২||{{u|Ams riyad}}||৭৩
|-
|৮৩||{{u|Md Nayed Ahmed Riaj}}||৭০
|-
|৮৪||{{u|Rahul amin roktim}}||৬৮
|-
|৮৫||{{u|Ishrat Jahan Tahmid}}||৬৮
|-
|৮৬||{{u|যুবায়ের হোসাইন কায়েফ}}||৬৭
|-
|৮৭||{{u|Ladsgroup}}||৬৭
|-
|৮৮||{{u|Mahir256}}||৬৫
|-
|৮৯||{{u|Nakul Chandra Barman}}||৬৫
|-
|৯০||{{u|Ishtiak Abdullah}}||৬৩
|-
|৯১||{{u|Anik Kanti Dey}}||৬২
|-
|৯২||{{u|হাম্মাদ}}||৬০
|-
|৯৩||{{u|WikimediaNotifier}}||৬০
|-
|৯৪||{{u|RUBEL SHAIKH}}||৫৮
|-
|৯৫||{{u|Morshed RC}}||৫৬
|-
|৯৬||{{u|Md. Golam Mukit Khan}}||৫৬
|-
|৯৭||{{u|Kwamikagami}}||৫৩
|-
|৯৮||{{u|Anisvai}}||৫৩
|-
|৯৯||{{u|Nil Nandy}}||৫০
|-
|১০০||{{u|Sadi2202}}||৫০
|}
am2ugmuc6oz95cci5pnemc6xiv4oefv
আলাস্কার ইতিহাস/মার্কিন জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে আলাস্কা (১৮৬৭-বর্তমান)
0
20998
85939
69001
2025-07-11T09:09:54Z
Túrelio
5114
([[c:GR|GR]]) [[c:COM:Duplicate|Duplicate]]: [[File:Denali-alpine-lakes-forest-Highsmith.jpeg]] → [[File:Alpine lakes and forest, Denali National Park, Alaska, by Carol M. Highsmith.jpg]] Exact or scaled-down duplicate: [[c::File:Alpine lakes and forest, Denali National Park, Alaska, by Carol M. Highsmith.jpg]]
85939
wikitext
text/x-wiki
=মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে আলাস্কা (১৮৬৭-বর্তমান)=
== প্রুডহো বে তেলক্ষেত্র ==
[[File:Prudhoe Bay oil fields 1971 FWS.jpg|right|180px]]
১৯৫৯ সালে আলাস্কা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ১২ মার্চ, ১৯৬৮ সালে আলাস্কার নর্থ স্লোপে প্রুডহো বে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এই তেলক্ষেত্রের মালিকানার মাধ্যমে, আলাস্কার সরকার তেল বাণিজ্য থেকে প্রদেয় অর্থ ও কর দাবি করে রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারত। তেলের বাণিজ্যের জন্য আলাস্কার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজ্য সরকার একটি ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তবে, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পথের ভৌত ভূগোল এবং জমির মালিকানার সমস্যা সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। এই অঞ্চলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য জমির মালিকানার সমস্যা সমাধান করতে হয়েছিল। আলাস্কার জমিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার কাছে প্রদান করা হয়েছিল; আলাস্কার আদি বাসিন্দাদের জমির ন্যূনতম অধিকার ছিল। তাদের পৈতৃক জমির অধিকার দাবি করতে আলাস্কার আদি বাসিন্দারা এই বিষয়টি ক্রমাগত উত্থাপন করেছিল। অবশেষে, রাজ্য সরকার জমির দাবি মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইন ট্রেইলে স্থাপন করা যায়।
== আলাস্কা নেটিভ ক্লেইমস সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট (এএনসিএসএ) ==
[[File:Nixon 30-0316a.jpg|thumb|নিক্সন]]
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে, রিচার্ড এম. নিক্সনের প্রেসিডেন্সির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কা নেটিভ ক্লেইমস সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট আইনে পরিণত করে। এই আইন ঘোষণার ফলে আদিবাসী আলাস্কানদের এবং সরকারের মধ্যে জমির দাবি এবং অর্থপ্রদান বড় পরিবর্তন আনে। কংগ্রেস প্রায় এক শতাব্দী ধরে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমির জন্য আদিবাসী আলাস্কানদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ক্ষতিপূরণের মধ্যে ছিল ৪০০ মিলিয়ন একর জমি এবং প্রায় $৯৬৫ মিলিয়ন ডলার। এই মুহূর্তটি আদিবাসী আলাস্কানদের জন্য সন্তুষ্টির ছিল কারণ তারা বিলের সংশোধনের সাথে একমত হয়েছিল। জমি এবং অর্থ পরিচালনার ক্ষেত্রে, এএনসিএসএ ১২টি আঞ্চলিক কর্পোরেশন এবং প্রায় ২০০টি গ্রাম কর্পোরেশন বাস্তবায়িত করেছিল।
=== ১২ আঞ্চলিক কর্পোরেশন ===
====আর্কটিক স্লোপ আঞ্চলিক কর্পোরেশন (ASRC)====
[[File:NORTH AND WEST SIDES - Arctic Slope Regional Corporation Office Building, Agvik and Kiogak Streets, Barrow, North Slope Borough, AK HABS AK,15-BARR,3-2.tif|thumb|উত্তর এবং পশ্চিম দিক - আর্কটিক স্লোপ আঞ্চলিক কর্পোরেশন অফিস বিল্ডিং, আগভিক এবং কিওগাক স্ট্রিটস, ব্যারো, উত্তর স্লোপ বরো, একে হাবস একে, ১৫-বার, ৩-২ ]]
আটটি গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে, আর্কটিক স্লোপ আঞ্চলিক কর্পোরেশনকে ৫ মিলিয়ন একর জমি প্রদান করা হয়, যার মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম বিটুমেন এবং কয়লার মজুদ রয়েছে। প্রায় ১১,০০০ শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা বেড়েছে। এই কর্পোরেশনের প্রধান কার্যক্রম হল তেল ও গ্যাস পরিষেবা, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং যোগাযোগ।
====আথনা কর্পোরেশন====
আথনা কর্পোরেশন কপার রিভার বেসিনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন একর জমির মালিক। এই কর্পোরেশনে মোট ১৫০০ শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। কর্পোরেশনের প্রধান লক্ষ্য হল বৈচিত্র্য এবং বৃদ্ধি, জমি, মানব এবং খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। বেশিরভাগ কাজ ১৪টি সহায়ক সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয় যা নির্মাণ, প্রকৃতি পুনরুদ্ধার, খাদ্য পরিষেবা ঠিকাদার এবং পরিচ্ছন্নতা এবং প্রশাসনিক পরিষেবাগুলি পরিচালনা করে।
====দ্য আলেউট কর্পোরেশন====
আলেউট কর্পোরেশন ৭১,০০০ একর ভূ-পৃষ্ঠের জমি এবং ১.৬ মিলিয়ন একর ভূগর্ভস্থ সম্পত্তির সাথে $১৯.৫ মিলিয়ন ডলারের নিষ্পত্তি করেছে। প্রায় ৩২০০ শেয়ারহোল্ডার এই কর্পোরেশনে তালিকাভুক্ত। বর্তমানে, আলেউট কর্পোরেশন তাদের ভূগর্ভস্থ সম্পত্তির অধীনে বালি, নুড়ি এবং পাথর পর্যবেক্ষণ এবং বিক্রি করে। কর্পোরেশনের প্রধান লক্ষ্য হল ফেডারেল অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি, তেল ও গ্যাস বিনিয়োগ এবং বিক্রয় কার্যক্রম।
====বেরিং স্ট্রেইটস নেটিভ কর্পোরেশন====
বেরিং স্ট্রেইটস নেটিভ কর্পোরেশন আলাস্কার সিওয়ার্ড উপদ্বীপ এবং নর্টন সাউন্ডের পূর্বাঞ্চলকে আচ্ছাদন করে। মোট ৬,৩০০ শেয়ারহোল্ডার তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং প্রায় ২ মিলিয়ন একর ভূগর্ভস্থ জমির মালিক। তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে খনন, নির্মাণ, বিক্রয় এবং পর্যটন।
====ব্রিস্টল বে নেটিভ কর্পোরেশন ====
আলাস্কার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে আচ্ছাদন করে, ব্রিস্টল বে নেটিভ কর্পোরেশনে মোট ৯,০০০ শেয়ারহোল্ডার রয়েছে, যার মধ্যে এস্কিমো, ইন্ডিয়ান এবং আলেউট শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। কর্পোরেশন দায়িত্বশীল সম্পদ উন্নয়নের সমর্থক। ৩০টি অপারেটিং সহায়ক সংস্থার সমন্বয়ে, কর্পোরেশন প্রধানত পেট্রোলিয়াম, সরকার, তেলক্ষেত্র এবং নির্মাণ পরিষেবাগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
====ক্যালিস্টা কর্পোরেশন====
ক্যালিস্টা কর্পোরেশন ৬.৫ মিলিয়ন একর ভূগর্ভস্থ জমি, ৩,০০,০০০ একর ভূ-পৃষ্ঠের সম্পত্তি এবং প্রাথমিক মূলধনের উপর ফেডারেল সরকারের দ্বারা ৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দাবি করেছে। কর্পোরেশন নির্মাণ, সামরিক, খনন এবং যোগাযোগে বিশেষজ্ঞ।
====চুগাচ আলাস্কা কর্পোরেশন ====
[[File:Chugach state park eklutna lake.jpg|thumb|চুগাচ স্টেট পার্কের একলুটনা লেক]]
চুগাচ কর্পোরেশন দক্ষিণ-মধ্য আলাস্কার প্রায় ৯,০০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং ৯২৫,০০০ একর জমির মালিক। কর্পোরেশনটি ব্যবসা পরিষেবা, সরকারী চুক্তি, প্রকৌশল, এবং নির্মাণ খাতে সক্রিয়।
==== কুক ইনলেট রিজিওনাল কর্পোরেশন (CIRI) ====
কুক ইনলেট রিজিওনাল কর্পোরেশন (CIRI) ৬,৩০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রায় ১.৩ মিলিয়ন একর জমি এবং সম্পদ অধিকার নিয়ে কাজ করে। তাদের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে, যার মধ্যে পর্যটন, রিয়েল এস্টেট, এবং শক্তি সম্পদ ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত।
==== ডোনলিন কর্পোরেশন ====
ডোনলিন কর্পোরেশন প্রায় ২,৪০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেন্ট্রাল আলাস্কার ১০০,০০০ একর জমির মালিক। এই কর্পোরেশনটি প্রধানত খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নে সক্রিয়, বিশেষত সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ।
==== কনিয়াগ কর্পোরেশন ====
কনিয়াগ কর্পোরেশন দক্ষিণ-পশ্চিম আলাস্কার ৩,৭০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রায় ৮০০,০০০ একর জমির মালিক। কনিয়াগ প্রধানত মাছ ধরা, পর্যটন, এবং পরিবহন খাতে কাজ করে।
==== নানানা কর্পোরেশন ====
নানানা কর্পোরেশন আলাস্কার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং প্রায় ১৩,০০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের প্রায় ১০০,০০০ একর জমি রয়েছে এবং তারা প্রধানত খনিজ সম্পদ উন্নয়ন এবং খনন শিল্পে কাজ করে।
==== সীলস্কা কর্পোরেশন ====
সীলস্কা কর্পোরেশন প্রায় ৮,৩০০ শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আলাস্কায় ২ মিলিয়ন একর জমির মালিক। তাদের প্রধান কার্যক্রম খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ, এবং পরিবহন খাতে।
==== ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইন সিস্টেম ====
[[File:Trans-Alaska Pipeline System showing the pipe's route.jpg|thumb|ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইনের পথ প্রদর্শন]]
ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইন সিস্টেম আলাস্কান তেলের পরিবহনের জন্য একটি বিশাল প্রকল্প। প্রায় ৮০০ মাইল দীর্ঘ এই পাইপলাইনটি প্রুডহো বে থেকে ভ্যালডিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। পাইপলাইনটি ১৯৭৭ সালে সম্পন্ন হয়েছিল এবং এটি আলাস্কা রাজ্যের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলে। পাইপলাইন নির্মাণের সময় পরিবেশগত প্রভাব একটি বড় উদ্বেগ ছিল। পাইপলাইনটি নির্মাণের সময় প্রকৃতির ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, যেমন বিশেষ তাপ নিরোধক ব্যবহার, পাইলিং দ্বারা পাইপলাইন উত্তোলন, এবং পশুদের চলাচলের জন্য সেতু নির্মাণ। আলাস্কার তেল শিল্প এবং আদিবাসী অধিকারগুলির মধ্যে সম্পর্ক একটি জটিল এবং পরিবর্তনশীল বিষয়। আলাস্কা নেটিভ ক্লেইমস সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট (এএনসিএসএ) এবং ট্রান্স-আলাস্কা পাইপলাইন সিস্টেম আলাস্কার অর্থনীতিতে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। এই দুটি প্রধান ঘটনা আলাস্কার ইতিহাস এবং উন্নয়নের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।
== জাতীয় উদ্যান ==
আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বৃহত্তম উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকার আবাসস্থল, যা সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন পাস করার জন্য বহু বছরের পরিশ্রমের ফলাফল। আলাস্কা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ল্যান্ডস কনজারভেশন অ্যাক্ট (এএনআইএলসিএ) ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট কার্টার দ্বারা পাস করা হয়েছিল। এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এটি একশ মিলিয়নেরও বেশি একর আলাস্কার জমিকে বিভিন্ন স্তরের সুরক্ষা প্রদান করেছিল। এএনআইএলসিএ স্বাক্ষরের সময়, প্রেসিডেন্ট কার্টার বলেছিলেন, "আমরা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের চেয়ে বড় একটি এলাকা সংরক্ষণের জন্য আলাদা করছি।" এএনআইএলসিএ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে "একটি বৃহত্তম সংরক্ষণ এবং বন্যপ্রাণী সুরক্ষার স্থানগুলির মধ্যে একটি" হিসেবে রয়ে গেছে।
=== আলাস্কা জাতীয় আগ্রহ জমি সংরক্ষণ আইন (এএনআইএলসিএ) বিতর্ক ===
ফেডারেল জমি নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে, যেখানে সংরক্ষণবাদীরা ব্যবসায়িক স্বার্থের বিপক্ষে এবং জাতীয় স্বার্থ স্থানীয় স্বার্থের বিপক্ষে। এএনআইএলসিএ এর পরিচয় এই প্রবণতাকে অনুসরণ করে এবং যখন সংরক্ষণবাদীরা অনুন্নত জমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত থাকায় সমর্থন করে, অন্যরা মনে করে এই সুরক্ষা আলাস্কার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সীমিত করে। ১৯৫৮ সালের আলাস্কা স্টেটহুড অ্যাক্ট, ১৯ 1971১ সালের আলাস্কা নেটিভ ক্লেইমস সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট (এএনএসসিএ) এর সাথে একত্রে, আলাস্কার বাণিজ্য, শক্তি সম্পদ এবং পরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা সমন্বিতভাবে করার জন্য ১৪৮ মিলিয়ন একর আলাস্কার জমি প্রদান করে। সংরক্ষণবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য, ANSCA ও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আশি মিলিয়ন একর জমি সংরক্ষণের সুযোগ দেয়। প্রায় নয় বছর এবং বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট কার্টার এএনআইএলসিএ পাস করেন, আলাস্কার জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাকে আরও ৪৩ মিলিয়ন একর বাড়িয়ে এবং “নতুন দশটি এলাকা এবং তিনটি বিদ্যমান এলাকায় জাতীয় উদ্যান সুরক্ষা প্রদান করেন”। এএনআইএলসিএ এছাড়াও রাজ্য এবং জাতীয় সরকারের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করে, কারণ এটি আলাস্কার গ্রামীণ বাসিন্দাদের সংকটের সময় মাছ এবং শিকার করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়। এটি আলাস্কার রাজ্য সংবিধানের বিরোধিতা করে, যা বলে যে মাছ, বন্যপ্রাণী এবং জল সাধারণ ব্যবহারের জন্য মানুষের জন্য সংরক্ষিত, কোন একক অধিকারের জন্য নয়। প্রাথমিক প্রতিরোধের পরও, এএনআইএলসিএ এর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রধানত পর্যটনের বৃদ্ধির কারণে। আলাস্কা পর্যটন শিল্প সমিতির সাম্প্রতিক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, "২০১৬ সালের গ্রীষ্মে ১.৮ মিলিয়ন রাজ্যের বাইরে পর্যটক এসেছিল, যারা রাজ্যে মোট ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।"
== আলাস্কার আটটি জাতীয় উদ্যান ==
=== ডেনালি জাতীয় উদ্যান ===
[[File:Alpine lakes and forest, Denali National Park, Alaska, by Carol M. Highsmith.jpg|right|150px]]
ডেনালি জাতীয় উদ্যান উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, ২০,৩১০ ফুট উঁচু মাউন্ট ম্যাককিনলে অবস্থান করে। উদ্যানটি প্রথমে ১৯১৭ সালে মাউন্ট ম্যাককিনলে জাতীয় উদ্যান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে এএনআইএলসিএ পাসের সাথে সাথে উদ্যানটি “ডেনালি এর সাথে সংযুক্ত হয়ে ডেনালি জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়” এবং বর্তমানে এটি ছয় মিলিয়ন একর এলাকা। যেহেতু এটি রাস্তা দিয়ে পৌঁছানো যায় এমন কিছু উদ্যানের মধ্যে একটি, এটি একটি জনপ্রিয় আলাস্কার জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৬ সালে উদ্যানটি একটি আন্তর্জাতিক জীবমণ্ডল সংরক্ষণ এলাকা হিসাবে মনোনীত হয়, যা বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জ্ঞানী ব্যবহারকে কেন্দ্র করে।
=== আর্কটিক জাতীয় উদ্যানের গেটস ===
[[File:GatesofArctic.jpg|right|150px]]
আর্কটিক জাতীয় উদ্যানের গেটস যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উত্তরের জাতীয় উদ্যান এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম ৮.৪ মিলিয়ন একর। উদ্যানটির নাম ওয়াইল্ডারনেস অ্যাডভোকেট রবার্ট মার্শাল থেকে এসেছে, যিনি ১৯৩০-এর দশকে এলাকাটি পরিদর্শন করেছিলেন যেখানে তিনি খাড়া পর্বতমালা দেখে এবং “দুটি সংলগ্ন শৃঙ্গকে 'আর্কটিকের গেটস' নামে অভিহিত করেছিলেন।”
=== গ্লেসিয়ার বে জাতীয় উদ্যান ===
[[File:Glacier Bay National Park.jpg|right|150px]]
গ্লেসিয়ার বে জাতীয় উদ্যান ৩.৩ মিলিয়ন একর যা গ্লেসিয়ার বে অন্তর্ভুক্ত করে, যা বিশ্বের বৃহত্তম সংরক্ষিত জীবমণ্ডল সংরক্ষণ এলাকার মধ্যে একটি। গ্লেসিয়ার বে জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকা হওয়ার জন্য যে ভূদৃশ্যটি গঠিত হয়েছিল তা ইউরোপীয় অনুসন্ধানকারীরা প্রথমে এই কোণে পৌঁছানোর সময় বরফে আবৃত ছিল।
=== কাটমাই জাতীয় উদ্যান ===
[[File:Katmai National Park and Preserve Brooks Falls.jpg|right|150px]]
১৯১২ সালে, নোভারুপ্টার অগ্ন্যুৎপাত ছিল ২০ শতকের বৃহত্তম অগ্ন্যুৎপাত। জাতীয় ভৌগোলিক সমাজ যখন অগ্ন্যুৎপাত অঞ্চলটি তদন্ত শুরু করে, তখন তারা এলাকাটি ১৯১৮ সালে একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষিত করার জন্য লবিং করেছিল। এএনআইএলসিএ এর সাথে, কাটমাই জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ প্রসারিত করে কাটমাই জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকা তৈরি করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, টিমোথি ট্রেডওয়েল, একজন প্রধান আলাস্কার ব্যক্তিত্ব, প্রায়ই বলতেন যে কাটমাই জাতীয় উদ্যান ছিল তার প্রিয়।
=== কেনাই ফিয়র্ডস জাতীয় উদ্যান ===
[[File:By ovedc - Kenai Fjords National Park - 1.jpg|right|150px]]
কেনাই ফিয়র্ডস জাতীয় উদ্যান আলাস্কার ক্ষুদ্রতম জাতীয় উদ্যান যা ৬০৭,০০০ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে। হিমবাহ, তরঙ্গ এবং পর্বতমালা উদ্যানটি গঠন করেছে এবং অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য আবাসস্থল তৈরি করেছে। হার্ডিং আইসফিল্ড উদ্যানটিকে প্রভাবিত করে, ৭০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এবং প্রায় এক মাইল উচ্চ এবং শত শত ফুট গভীর।
=== কোবুক ভ্যালি জাতীয় উদ্যান ===
[[File:River meander, outside of Kobuk Valley National Park (8029767197).jpg|right|150px]]
কোবুক ভ্যালি জাতীয় উদ্যান আলাস্কার আর্কটিকে অবস্থিত এবং ১.৮ মিলিয়ন একর। এটি আলাস্কার সবচেয়ে অনুন্নত জাতীয় উদ্যান হিসাবে পরিচিত এবং এটি আলাস্কার অন্য কোনো উদ্যানের চেয়ে কম পর্যটক দেখে। এটি তার ২৫ বর্গমাইল বিশাল বালির টিলা, যা ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, যা হিমবাহের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
=== লেক ক্লার্ক জাতীয় উদ্যান ===
[[File:By ovedc - Lake Clark National Park - 29.jpg|right|150px]]
লেক ক্লার্ক জাতীয় উদ্যান ৪ মিলিয়ন একর এবং এটি দেনাইনা নামে পরিচিত আথাবাসকান জনগণের আবাসস্থল, যারা হাজার হাজার বছর ধরে সেখানে বসবাস করে আসছে। লেক ক্লার্ক জাতীয় উদ্যানের উপস্থিতি কম এবং এটি "আলাস্কার অন্যতম বৃহত্তম রহস্য" নামে পরিচিত।
=== র্যাংল-সেন্ট এলিয়াস জাতীয় উদ্যান ===
[[File:Mt Saint Elias, South Central Alaska.jpg|right|150px]]
এএনআইএলসিএ পাস হওয়ার সাথে সাথে, র্যাংল পর্বতমালা র্যাংল-সেন্ট এলিয়াস জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকার অংশ হয়ে যায়। উদ্যানটি আলাস্কার দক্ষিণ-মধ্যভাগে অবস্থিত এবং ১৩.২ মিলিয়ন একর এলাকা জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকা।
== টিমোথি ট্রেডওয়েল ==
==== শৈশব ও উত্থান ====
টিমোথি ট্রেডওয়েল, যিনি "গ্রিজলি ম্যান" নামে পরিচিত, গ্রিজলি ভাল্লুকের পরিবেশগত সুরক্ষার পক্ষে একজন প্রবক্তা ছিলেন। তিনি আলাস্কার জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে একজন বিত
র্কিত এবং বহুল প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি ১৯৫৭ সালের ২৯শে এপ্রিল নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে বেড়ে ওঠেন। তার শৈশব এবং কিশোর জীবনের সময়, ট্রেডওয়েল মাদক ও মদের সাথে জড়িত ছিল, এবং তিনি বলেন যে গ্রিজলি ভাল্লুকের প্রতি তার আবেগ তাকে এই নির্ভরতা থেকে রক্ষা করেছে।
==== গ্রিজলি ভাল্লুকের সাথে যোগাযোগ ====
তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময়, ট্রেডওয়েল আলাস্কার কাটমাই জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষণ এলাকায় বসবাস করতেন, যেখানে তিনি ভাল্লুকের সাথে সময় কাটাতেন। তিনি তার প্রকৃতি এবং তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য ভাল্লুকদের কাছে যেতেন এবং তাদের সুরক্ষার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করতেন।
==== ড্রাগ এবং অ্যালকোহল আসক্তি ====
টিমোথি ট্রেডওয়েলের মাদক ও অ্যালকোহলের আসক্তি ইলিনয়ের ব্র্যাডলি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সময় শুরু হয়। ক্যাম্পাস পার্টি এবং ফ্র্যাটারনিটিতে ট্রেডওয়েল অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন। উনিশ বছর বয়সে তিনি স্পিডবলের অতিরিক্ত ডোজের কারণে প্রায় মারা যাচ্ছিলেন। স্পিডবল হলো কোকেন এবং হেরোইনের মিশ্রণ। মাদকাসক্তির সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে, ট্রেডওয়েল প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পান। ট্রেডওয়েল বলেছিলেন: "ভাল্লুকরা এতটাই অনুপ্রেরণাদায়ক হয়ে উঠেছিল যে আমি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছিলাম। এটি ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা, একদম অলৌকিক। এবং এই অলৌকিক ঘটনা ছিল প্রাণী।”
==== প্রারম্ভিক আবেগ ====
ট্রেডওয়েলের বন্যপ্রাণীর প্রতি আগ্রহ শুরু হয়েছিল তার “গড় এবং একঘেয়ে মধ্যবিত্ত জীবনধারা” থেকে পালানোর ইচ্ছা থেকে। ব্র্যাডলি ইউনিভার্সিটিতে তার বন্যপ্রাণীর প্রতি আগ্রহের সূচনা হয়, যেখানে তিনি একটি ভাল্লুকের নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার নকল করতে গিয়ে তৃতীয় তলার ডরম ব্যালকনি থেকে লাফ দেন। দুই বছর ব্র্যাডলি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার পর, ট্রেডওয়েল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান, যেখানে তিনি টেরি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ভিয়েতনাম ভেটেরানের সাথে দেখা করেন। টেরি তাকে ভাল্লুক দেখার জন্য আলাস্কায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। এই ভ্রমণের সময়, ট্রেডওয়েল ভাল্লুক এবং ক্যাম্পিংয়ের প্রতি তার সম্পূর্ণ আগ্রহ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যা তাকে আজকের "গ্রিজলি ম্যান" হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
==== বার্ষিক অভিযান ====
কলেজ শেষ করার পর, ট্রেডওয়েল শীতকালে বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করতেন এবং গ্রীষ্মকালে আলাস্কায় বাৎসরিক অভিযানে যেতেন। তিনি আলাস্কার বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ করতেন এবং পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে বন্যপ্রাণীর মাঝে কাটাতেন। ট্রেডওয়েলের প্রিয় স্থান ছিল কাটমাই ন্যাশনাল পার্ক। তিনি প্রায়ই ভাল্লুক এবং শিয়ালদের মুখোমুখি হতেন যারা আলাস্কার জমিতে ঘুরে বেড়াত। তার বাৎসরিক অভিযানের সময়, ট্রেডওয়েল ভাল্লুকদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করতেন। তিনি ভাল্লুকদের দেহের ভাষা নকল করে, চার পায়ে হেঁটে এবং এমনকি গর্জন করে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেন। এই অভিযানের সময়, তিনি বন্যপ্রাণীর সাথে তার সাক্ষাৎ এবং কথোপকথন রেকর্ড করতেন এবং ১০০ ঘন্টারও বেশি ফুটেজ ফিল্ম করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
==== মৃত্যু ====
[[File:Treadwell Incident Map.jpg|right|200px]]
ট্রেডওয়েলের মৃত্যু ৬ অক্টোবর, ২০০৩ এ নিশ্চিত হয়েছিল। ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে, ট্রেডওয়েল তার বান্ধবী অ্যামি হুগেনার্ডের সাথে কাটমাই ন্যাশনাল পার্কে ভ্রমণ করেন। ট্রেডওয়েল আগস্টের শেষে ভ্রমণ শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়ানোর ফলে, ট্রেডওয়েল ভাল্লুকের আক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, কারণ এটি ছিল ভাল্লুকদের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক মৌসুম। কোডিয়াক দ্বীপে কাটমাই ন্যাশনাল পার্ক অন্বেষণ করার সময়, ট্রেডওয়েল এবং হুগেনার্ড তাদের ক্যাম্পসাইট একটি স্যামন স্ট্রিম এবং ভাল্লুক ট্রেইলের কাছে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। ভাল্লুক জীববিজ্ঞানী ল্যারি ভ্যান ডেল বলেন, "একটি ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য কেউ আরও বিপজ্জনক জায়গা ডিজাইন করতে পারত না"। ট্রেডওয়েলের পার্কের বাইরে শেষ যোগাযোগ ছিল ৫ অক্টোবর, ২০০৩। পরের দিন, এয়ার ট্যাক্সি পাইলট উইলি ফুলটন তাদের পার্ক থেকে তুলতে আসেন কিন্তু তাদের খুঁজে পাননি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই, পার্ক রেঞ্জাররা তাদের ক্যাম্পসাইটের কাছাকাছি ট্রেডওয়েল এবং হুগেনার্ডের অবশেষ খুঁজে পায়। ট্রেডওয়েল এবং হুগেনার্ড ভাল্লুকের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন। আক্রমণের স্থানে একটি ভিডিও রেকর্ডার পাওয়া গিয়েছিল যা আক্রমণের সময় রেকর্ডিং করছিল, তবে এটি ছিল ফাঁকা ফুটেজ। তবে টেপটি আক্রমণের অডিও রেকর্ড করেছিল, যা দম্পতির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর বিবরণ দেয়। ট্রেডওয়েল একটি ভাল্লুকের কিছু অদ্ভুত আচরণ নথিভুক্ত করেছিলেন, যা বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে দম্পতিকে হত্যা করেছিল।
==== মিডিয়া ====
তার আলাস্কার অভিযানের সময়, টিমোথি ট্রেডওয়েল একশ ঘন্টারও বেশি ভিডিও ফুটেজ রেকর্ড করেছিলেন। ২০০৫ সালে, লায়ন্স গেট ফিল্মস "গ্রিজলি ম্যান" নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। ডকুমেন্টারিটি ওয়ার্নার হার্জগ দ্বারা পরিচালিত এবং ট্রেডওয়েলের রেকর্ডিংগুলির কিছু আকর্ষণীয় ফুটেজকে তুলে ধরে। ডকুমেন্টারিটি দেখায় যে ট্রেডওয়েল কতটা অবিশ্বাস্য ফুটেজ নিতে পেরেছিলেন এবং তার জীবনকেও ফোকাস করে। ট্রেডওয়েলের জীবনের উপর ভিত্তি করে অনেক উপন্যাস রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল "ডেথ ইন দ্য গ্রিজলি মেজ", "দ্য গ্রিজলি মেজ", "গ্রিজলি ম্যান", এবং তার নিজের উপন্যাস "অ্যামং গ্রিজলিস"। ২০০১ সালে ট্রেডওয়েল ডেভিড লেটারম্যানের "লেট শো"-তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন, যেখানে তিনি আলাস্কার ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করেন।
==== সংগঠন ও সামাজিক কারণ ====
ট্রেডওয়েল "গ্রিজলি পিপল" নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ভাল্লুক এবং তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণের চেষ্টা করে। এই সংস্থাটি তার বাৎসরিক অভিযানের তহবিল জোগাত এবং লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং পাটাগোনিয়ার মতো বিখ্যাত সেলিব্রিটি এবং ব্র্যান্ডের কাছ থেকে অনুদান পেত।
==== আলাস্কান প্রভাব এবং জনসাধারণের উপলব্ধি ====
টিমোথি ট্রেডওয়েলকে প্রায়শই আলাস্কায় পুরুষ সারভাইভালিস্টদের একটি স্টেরিওটাইপের সাথে তুলনা করা হয়। আলাস্কানদের মধ্যে ট্রেডওয়েলের সমর্থন মিশ্রিত। তার সমর্থকদের বেশিরভাগই প্রকৃতিবিদ, যারা বন্যপ্রাণীতে তার বেঁচে থাকার ক্ষমতাকে প্রশংসা করত। তাকে সম্মান করা হয়েছিল কম সরঞ্জাম দিয়ে ভ্রমণের জন্য, যার মধ্যে ছিল তার ভাল্লুক স্প্রে না নেওয়ার দৃঢ়তা। কিছু আলাস্কান তাকে আইডল হিসেবে দেখে, আবার কিছু তাকে আলাস্কান জীবনধারার জন্য হুমকি মনে করত। ট্রেডওয়েল প্রায়শই জাতীয় উদ্যান পরিষেবার সদস্য এবং আলাস্কান শিকারিদের সাথে উদ্যানের নিয়ম এবং আলাস্কান বন্দুক আইন নিয়ে বিরোধ করতেন। অনেক আলাস্কান মনে করতেন তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল এবং তার ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলি শেষ পর্যন্ত তার কাছে ফিরে আসবে। বন্যপ্রাণীতে তার সময়ের মধ্যে মনে করা হয় যে ট্রেডওয়েল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন এবং মানবিক সংস্পর্শের অভাবে ধীরে ধীরে কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি করছিলেন। আজ, তার কর্মগুলো আলাস্কানদের মধ্যে প্রায়ই বিতর্কিত হয়, এবং তার স্মৃতিচিহ্নগুলি নিলামে বিক্রি হয়।
== আলাস্কার পর্যটন ==
আলাস্কা তার পর্যটন আকর্ষণগুলির জন্য সারা বছর জুড়ে ভ্রমণকারীদের হটস্পট হয়ে উঠেছে। শীতকালীন আবহাওয়া মোকাবেলা করতে ইচ্ছুক পর্যটকরা "দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার" এর কম ভ্রমণকৃত মৌসুমে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশ নিতে পারেন। গত দশকে আলাস্কায় ভ্রমণকারী পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ভ্যানেসা ওরর তার প্রবন্ধে "হট স্পটস ইন দ্য কোল্ড অফ উইন্টার" বলেছেন যে ২০০৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে প্রায় ২৬০,০০০ বাইরের রাজ্যের দর্শক শীতকালীন কার্যকলাপের জন্য আলাস্কা ভ্রমণ করেছিলেন।
==== শীতকালীন কার্যক্রম ====
শীতকালে পর্যটকরা আলাস্কার তাপমাত্রা উপভোগ করতে পারে, যা -৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আলাস্কা মিউজিয়াম অফ দ্য নর্থ একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। এটি অনেক আর্ট গ্যালারি, প্রদর্শনী এবং স্থানীয় আর্টিফ্যাক্ট অফার করে, এবং প্রতিদিন শত শত পর্যটকদের কাছে পৌঁছায়। পর্যটকরা স্থানীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য স্থানীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ফোক মিউজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে আলাস্কা বরফের মাছ ধরা, কুকুর স্লেজিং এবং বরফে হাঁটার মতো আকর্ষণীয় কার্যকলাপের জন্য একটি দুর্দান্ত গন্তব্য। স্থানীয় দোকানগুলিতে ক্রয় করতে ইচ্ছুক পর্যটকদের জন্য স্থানীয়ভাবে তৈরি শিল্পকর্ম, হস্তশিল্প এবং কিউরিওস অফার করা হয়। আলাস্কার একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণ হল আরোরার আলো, যা শীতকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পর্যটকরা সারা রাত বসে উত্তরের আলো উপভোগ করতে পারেন এবং আলাস্কান অভিজ্ঞতার সবচেয়ে জাদুকরী দিকগুলি দেখতে পারেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণ হল টলকিটনা মাউন্টেন রেঞ্জ, যেখানে পর্যটকরা স্থানীয় ল্যান্ডস্কেপ এবং আলাস্কান সংস্কৃতির বিভিন্ন দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
==== জনপ্রিয়তা ====
আলাস্কা গ্রীষ্মে তার শীতল তাপমাত্রা এবং দীর্ঘ দিনের জন্য আরও বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে। গ্রীষ্মকালীন পর্যটন প্রতি বছর একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে, যখন পর্যটকরা জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভ্রমণ করতে আগ্রহী হন। গ্রীষ্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ডেনালি ন্যাশনাল পার্ক, জুনো গ্লেসিয়ারস, এবং আমেরিকা থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হোয়াইট পাস রেলওয়ে। আলাস্কার অনেক দর্শক সার্কেল ট্রেনের মাধ্যমে আসে, যা আলাস্কান প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং উপকূলরেখার একটি নৈমিত্তিক ভ্রমণ অফার করে। ক্রুজ জাহাজ, এবং স্থানীয় সরবরাহকারীরা পর্যটকদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণের জন্য আলাস্কা উপকূল বরাবর পর্যটন অফার করে।
আলাস্কা রাজ্য সারা বছর ধরেই পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। যারা শীতের কঠিন আবহাওয়ার সাহস নিয়ে আলাস্কায় আসে, তারা দেখতে পায় যে এই কম ভ্রমণকৃত মৌসুমেও অনেক কার্যকলাপ রয়েছে। গত দশকে আলাস্কায় পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ভেনেসা ওর তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, "শীতের ঠাণ্ডায় হট স্পট: মহান দেশে সবসময় কিছু করার আছে", যেখানে তিনি বলেছিলেন যে ২০০৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২৬০,০০০ রাজ্যের বাইরের পর্যটক আলাস্কা ভ্রমণের আশা করা হয়েছিল এবং হাজার হাজার রাজ্যবাসী বিশেষ ইভেন্টের জন্য শহরের মধ্যে ভ্রমণ করবেন বলে আশা করা হয়েছিল। এছাড়াও, আলাস্কা আন্তর্জাতিক পর্যটকদেরও আকর্ষণ করছে, বিশেষত যারা তুষারপাত কম দেখতে পায়। ওর আরও উল্লেখ করেছেন যে জাপানি পর্যটকরা বাজারের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে থাকে, ২০০৫ সালে প্রায় আট হাজার থেকে দশ হাজার পর্যটক আলাস্কা ভ্রমণ করেছিল। এর ফলে প্রায় $১ মিলিয়নের অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছিল।
আলাস্কা তাদের রাজ্যে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে কারণ শীতকালীন খেলাধুলার কার্যক্রমের জন্য নতুন বাজারের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। লেখক পেগ স্টোমিয়েরোস্কি তার প্রবন্ধে "শীতকালীন ছুটি: কেবিন জ্বর থেকে মুক্তি এবং রাজ্যে খেলুন" এই পরিবর্তনটি উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধে তিনি আঙ্কোরেজ কনভেনশন ও ভিজিটরস ব্যুরোর যোগাযোগ ও বিপণন প্রোগ্রামের ভাইস প্রেসিডেন্ট ন্যান্স লারসেনের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, যিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে মার্কিন আলপাইন চ্যাম্পিয়নশিপ এবং জুনিয়র নর্ডিক অলিম্পিক ট্রায়ালসের মতো বড় ইভেন্টগুলি আয়োজনে এবং নিয়ে আসায় শীতকালীন পর্যটন বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ এটি প্রতিযোগিতায় ক্রীড়াবিদ, কোচ এবং পরিবারের লোকজনকে আকর্ষণ করে। এর ফলে, আলাস্কা শীতকালীন ক্রীড়া এবং অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেমন আলপাইন স্কিইং, স্নোশুয়িং এবং ক্রস-কান্ট্রি স্কিইং।
আলাস্কার কঠোর আবহাওয়া প্যাটার্নগুলি রাজ্যটি বার্ষিক আয়োজন করে এমন শীতকালীন সাংস্কৃতিক ইভেন্টগুলির কারণে পর্যটন বৃদ্ধি করে। আমেরিকার ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা ইঙ্গিত করে যে গত বছরে প্রায় ৯৩ মিলিয়ন আমেরিকান ভ্রমণকালে অন্তত একটি সাংস্কৃতিক, শিল্প, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক কার্যকলাপ বা সাধারণ ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন। এটি আলাস্কার পক্ষে কাজ করেছে কারণ তাদের প্রতি বছর আয়োজিত সবচেয়ে বড় ইভেন্টগুলি রাজ্যের ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আলাস্কার দুটি সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ইভেন্ট হল ফার রঁদেভু ফেস্টিভ্যাল এবং ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেস।
[[File:Snow sculptures at Fur Rondy 120225-F-NZ143-008.jpg|thumb|ফার রঁদেভু ফেস্টিভ্যালে বরফের ভাস্কর্য]]
=== ফার রঁদেভু ফেস্টিভ্যাল ===
ফার রঁদেভু ফেস্টিভ্যালটি ঐতিহ্যগতভাবে ১০ দিনের শীতকালীন উদযাপন ছিল, তবে এখন এটি ১৭ দিনের শীতকালীন উৎসবে বাড়ানো হয়েছে, যা ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। এটি উত্তর আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম শীতকালীন উৎসব। স্থানীয়রা এই উৎসবকে "ফার রঁদে" বলে অভিহিত করে এবং এটি শীতের শেষের সূচনা উদযাপন করে। ফার রঁদেভু মূলত হকি এবং বাস্কেটবলের উপর কেন্দ্রীভূত শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে শুরু হয়েছিল, তবে এটি এখন সাংস্কৃতিকভাবে অনেক বড় কিছুতে পরিণত হয়েছে। আজ, শীতকালীন উৎসবে অনেক জনপ্রিয় কার্যকলাপ রয়েছে, যেমন ফার রঁদে গ্র্যান্ড প্যারেড, স্নোশু সফটবল, আইস বোলিং, ফার রঁদে মেলোড্রামা, স্নো ভাস্কর্য প্রতিযোগিতা, এবং মাইনার্স এবং ট্র্যাপার্স বল।
১৯৩৫ সালে রঁদেভু কার্নিভাল শুরু হয়েছিল। কার্নিভালের উদ্দেশ্য ছিল শীতকালে মানুষকে একত্রিত করা। তৎকালীন সময়ে আলাস্কায় ফার ট্রেড দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় শিল্প হওয়ায় এটি উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। এটি ট্র্যাপার এবং ক্রেতাদের অ্যাঙ্কোরেজে মিলিত হওয়ার এবং মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই তাদের ব্যবসা পরিচালনার একটি সোনালি সুযোগ প্রদান করেছিল। ট্র্যাপিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল এবং সবচেয়ে দীর্ঘ শিয়াল, সেরা শিয়াল, এবং সেরা ইরমিন পেলের জন্য পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। এভাবে, উৎসবটির নাম “ফার রঁদেভু” রাখা হয়েছিল কারণ এটি ফার ক্রয় এবং বিক্রয়ের জন্য মানুষের মিলনস্থল ছিল।
আজ, ফার রঁদে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং শিল্পের বিভিন্ন দিক সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ দেয়। চার্লট জেনসেন নেটিভ আর্টস মার্কেট, যা প্রতি বছর রঁদে চলাকালীন অনুষ্ঠিত হয়, আলাস্কা নেটিভ শিল্পী এবং কারিগরদের সারা রাজ্য থেকে আকর্ষণ করে, এমনকি দূরবর্তী স্থান যেমন সেন্ট লরেন্স দ্বীপ, মেকোরিয়ুক এবং শিসমারেফ থেকেও। ডায়মন্ড সেন্টারে টেবিলগুলি আলাস্কা নেটিভ বিডওয়ার্ক, খোদাই এবং পোশাকসহ জটিল এবং উদ্ভাবনী টুকরোতে পূর্ণ থাকে। 'ইন্ডিয়ান লাইফ' জার্নালে পোস্ট করা একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, "ফার রঁদেভু আলাস্কা নেটিভ আর্ট, সঙ্গীত এবং সংস্কৃতিকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে।" এটি ব্যাখ্যা করে যে দর্শকরা বিভিন্ন উপাদান থেকে তৈরি রত্নগুলি খুঁজে পেতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে হাতে খোদাই করা ওয়ালরাস-হাতির দাঁতের ভাস্কর্য, সিলস্কিন টুপি, বিডওয়ার্ক করা মুস-হাইড পার্স এবং রঙিন তুলার কুসপুক যা একটি ঐতিহ্যবাহী আলাস্কা নেটিভ পোশাক। ফার রঁদেভু উৎসব শুধুমাত্র শীতকালীন মৌসুম উদযাপন করে না, বরং এর নেটিভ ইতিহাসকেও উদযাপন করে।
[[File:Rudy Demoski Sr's dog team (8529502259).jpg|thumb|ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেসে একটি কুকুর দল]]
=== ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেস ===
ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেস প্রতি বছর ৬ মার্চ ফার রঁদেভু উৎসবের সময় অনুষ্ঠিত হয়। জার্নাল চাইল্ড লাইফে "ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেস" নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল এবং এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই দৌড়টি দর্শক এবং স্থানীয়দের একইভাবে বের করে আনে যাতে তারা অভিজ্ঞ এবং নতুন মাশারদের, তাদের কুকুর হ্যান্ডলার এবং অবশ্যই ইভেন্টের তারকাদের, কুকুরদের এক ঝলক দেখতে পারে। এই বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়া ইভেন্টটি বিশ্বের অন্যতম কঠিন দৌড়।
ইডিটারড ট্রেইল স্লেড ডগ রেসটি আলাস্কান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি। একসময় ইডিটারড ছিল ১০,০০০ লোকের একটি সরগরম শহর। ১৮৯৮ সালে, ইউকনে সোনা আবিষ্কৃত হয় এবং ইডিটারড বৃদ্ধি পায় এবং ফুলে ফেঁপে ওঠে। ইডিটারড ট্রেইল একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হয়ে ওঠে। কুকুরের স্লেড দলগুলি মেইল এবং সোনা অ্যাঙ্কোরেজ, আলাস্কায় নিয়ে যেত। সোনা শেষ হয়ে গেলে, ট্রেইলটি অপ্রচলিত হয়ে যায় এবং ইডিটারড একটি ফাঁকা শহরে পরিণত হয়। ১৯২৫ সালে, একটি ডিপথেরিয়া মহামারী নোমের আলাস্কা নেটিভ জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দেয়। একমাত্র ওষুধ ছিল সেরাম যা ১,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত। মুসাররা ইডিটারড ট্রেইল ধরে মেইল ড্রপ এলাকায় একত্রিত হয়েছিল এবং তারা ওষুধ এনে সংক্রমণের প্রকোপ থামিয়ে দেয়। সেরাম রেসের স্মৃতিচারণ করতে, ইডিটারড রেস শুরু করা হয়েছিল।
আজ, রেসটি কুকুরের স্লেডিং এবং মাশিংয়ের মনোমুগ্ধকর ঐতিহ্যকে সম্মান জানায়। দৌড়টি একটি দুর্দান্ত ক্রীড়া ইভেন্ট যা আলাস্কা রাজ্যের শীতকালীন গৌরব প্রদর্শন করে। কুকুর এবং তাদের পরিচালকদের সম্মানিত করা হয় এবং ট্রেইলটি শতাব্দী ধরে আলাস্কা সমাজের উপর যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে তাও স্বীকৃত হয়। শিশুদের জন্য বিশেষভাবে উপভোগ্য, ইডিটারড একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখে এবং দর্শকদের আলাস্কার শীতকালীন বিস্ময় অন্বেষণ করার সুযোগ দেয়।
== ইডিটারড ট্রেইল ==
==== ইডিটারড ট্রেইলের ইতিহাস ====
আলাস্কার অভ্যন্তরের ট্রেইলগুলো ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন শহর ও খনিতে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯০৮ সালে, ইডিটারড নামে একটি ছোট শহরের কাছে সোনা পাওয়া যায়, যেখান থেকে এই ট্রেইলটির নামকরণ হবে। ১৯১০ সালের মধ্যে, আলাস্কার রোড কমিশন পথগুলো পরিষ্কার করে এবং এই ট্রেইলকে "সেওয়ার্ড টু নোম মেইল ট্রেইল" নামে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। এই ট্রেইলটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সোনা ও অন্যান্য পণ্যবাহী রুট হিসেবে কাজ করেছিল এবং ক্রমবর্ধমান অঞ্চলের দূরবর্তী শহরগুলোতে পণ্য সরবরাহের নতুন উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, ইডিটারড ট্রেইল বরাবর পরিবহনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিল স্লেজ কুকুর। ১৯২৪ সালে বুশ পাইলটদের ব্যবহার শুরু হলে ট্রেইলের জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং ১৯৩০ সালের মধ্যে বেশিরভাগ খনির বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ট্রেইলটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে স্লেজ ডগ রেসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে ট্রেইলটি আবার তার প্রাক্তন মহিমায় ফিরে আসে।
[[File:Balto.jpg|right|200px|বলটো স্ট্যাচু সেন্ট্রাল পার্কে]]
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে, অনেকেই ইডিটারড ট্রেইলের কথা জানেন বিখ্যাত কুকুর বলটোর গল্পের জন্য। বলটো ১৯২৫ সালের সিরাম রান-এর শেষ ৫০ মাইলের পথপ্রদর্শক কুকুর হিসেবে পরিচিত। ১৯২৪-২৫ সালের শীতে, নোম শহরে ডিপথেরিয়ার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব ঘটে। শহরটি সম্প্রতি তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা প্রতিস্থাপনের জন্য নতুন টিকার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু শিপিং রুট বন্ধ হওয়ার পরেও চালানটি পৌঁছায়নি। ইডিটারড ট্রেইলের হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নোমে ওষুধ পৌঁছানোই একমাত্র উপায় ছিল। যখন নোম শহরে ডিপথেরিয়া নির্ণয় করা হয়, স্থানীয় ডাক্তার একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কোয়ারেন্টাইন আরোপের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সিরামের জন্য সাহায্য চান। এই ওষুধটি ছাড়া, ধারণা করা হয় যে নোম ও আশেপাশের শহরের ১০,০০০ বাসিন্দাদের বেশিরভাগই বাঁচতে পারতেন না। চালানটি ইডিটারড ট্রেইল বরাবর এক কুকুর স্লেজ দলের কাছ থেকে আরেক দলে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সময়মতো নোমে পৌঁছেছিল। ইডিটারড স্লেজ ডগ রেস প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় কেবল স্লেজ ডগ রেসের খেলা ধরে রাখার জন্য নয়, বরং ট্রেইল ও মাশারদের সম্মান জানানোর জন্য যারা কঠিন শীতের মধ্যে হাজারো লোককে বাঁচাতে সাহস দেখিয়েছিলেন।
==== ইডিটারড স্লেজ ডগ রেসের সূচনা ====
১৯৬৭ সালে ইডিটারড ট্রেইল বরাবর প্রথম স্লেজ ডগ রেস অনুষ্ঠিত হয়, যা জো রেডিংটন সিনিয়র এবং ডরোথি পেইজ আয়োজন করেছিলেন স্লেজ ডগ রেসিংয়ে আগ্রহ পুনরুদ্ধারের আশায়। প্রথম রেসটি মাত্র ৯ মাইলের ছিল, কিন্তু ১৯৭৩ সালে যখন অফিসিয়াল ইডিটারড স্লেজ ডগ রেস শুরু হয়, তখন রেসটি ১,১৫০ মাইলে পৌঁছায় এবং ৭০ টিরও বেশি দল প্রতিযোগিতা করে। দুটি রুট, উত্তর এবং দক্ষিণ, অন্তত ২৩ টি চেকপয়েন্ট আছে যেখানে প্রতিযোগীরা ২ মিনিট থেকে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে পারেন। এই স্টপগুলো, যার মধ্যে ইডিটারড শহরও রয়েছে, প্রতিযোগীদের আলাস্কার বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি পরিচিত হওয়ার সুযোগ দেয়। এই অভিযান এবং ব্যক্তিগত উন্নতির অনুভূতি অনেককে আলাস্কায় পর্যটনে আকর্ষণ করে। ভ্রমণটি "মডার্ন পিলগ্রিমেজ" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং আমাদের বর্তমান বিশ্বে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের তুলনায় আলাস্কার ঠান্ডা বন্যতায় আর কিছুই নেই।
==== আজকের ইডিটারড স্লেজ ডগ রেস ====
বর্তমান রেসটি প্রতি মার্চ মাসে ইডিটারড ট্রেইল বরাবর অনুষ্ঠিত হয়, তবে এর পরিকল্পনা করতে পুরো এক বছর লেগে যায়। রেসটি পরিচালনা করতে বছরে ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয় এবং বেশিরভাগ অর্থ স্পন্সর থেকে আসে। অনেক স্পন্সর আছে, তবে অ্যাঙ্কোরেজ ক্রিসলার ডজ র্যাম জনতার প্রিয় স্পন্সর, কারণ তারা বছরে দুইবার লটারি আয়োজনের জন্য অনুদান দেয়। যে কোনও বিজ্ঞাপন বা আর্থিক সহায়তার শীর্ষে, ডিলারশিপটি দুইটি ডজ র্যাম ট্রাকও ডগ স্লেজ রেস লটারিতে দেয়, যেখানে প্রবেশের টিকিটের মূল্য ১০০ ডলার। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে রেসটি সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবর্তিত হয়েছে। রিমোট এলাকায় স্যাটেলাইট অ্যাক্সেস পাওয়ার ক্ষমতা সহজ হয়েছে। টেলিকম প্রোভাইডার জিসিআই প্রথম প্রতিযোগীকে ইডিটারড শহরে পৌঁছানোর জন্য ৩০০০ ডলার মূল্যের সোনার নাগেট দেয়। এটি দেখায় যে এই রেস আলাস্কার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাথে এর সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। আলাস্কার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিছু স্পন্সর এই রাজ্যের বৃহত্তম ক্রীড়া ইভেন্টে অংশ নিচ্ছে নিজেদের নাম করার আশায়, তবে অন্যরা রাজ্যের মানুষদের উপকার করার চেষ্টা করছে। ডনলিন গোল্ড ইডিটারড শহরের কাছাকাছি অবস্থিত একটি খনি, যার এই অঞ্চলের ইতিহাস ও উন্নয়নের সাথে অনেক শেকড় রয়েছে। প্রতি বছর ডনলিন গোল্ড প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় সমর্থক, চেকপয়েন্টে কর্মী সহায়তা, কিছু মাশারদের স্পন্সর এবং স্কুল ভ্রমণ ও স্কুল পরিচালিত খাদ্য ড্রাইভ স্পন্সর করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই রেস প্রায়ই ছাত্রদের গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয় শেখার ইচ্ছা উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয় স্লেজ ডগ রেস এবং এর চারপাশের বিশ্বকে প্রসঙ্গে রেখে।
উত্তরের অন্বেষণ প্রায়ই সাহিত্যে রোমান্টিকভাবে উপস্থাপিত হয় এবং একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মানুষের জন্য অস্বাভাবিক নয়। ইডিটারড স্লেজ ডগ রেস অভিযানের সাথে দর্শনীয় স্থান দেখা এবং বিপজ্জনক ও অজানা অঞ্চলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উত্তেজনা নিয়ে আসে। 'দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার' কৌশলের অংশ হিসেবে আলাস্কা এখনও অন্বেষণ করা হয়নি এবং বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত। এই ধারণাগুলো ইডিটারড রেসের বিপণন সহজ করে তোলে। রেসটি জেতা কিছু লোকের জন্য লক্ষ্য হতে পারে, তবে রেসটি সম্পূর্ণ করা যে কারও জন্য একটি অর্জন।
== সিনেমা ==
আলাস্কার প্রাকৃতিক বন্যতা বহু বছর ধরে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে। এর ফলে উত্তর-পশ্চিমের 'ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' এর অজানা রহস্য অনুসন্ধান করে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। এই সিনেমাগুলোর সাধারণ থিমের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই, উত্তরের সাধারণ প্রাণী যেমন নেকড়ে এবং ভাল্লুক এবং গোল্ড রাশ। এই থিমগুলো সাধারণত আদর্শিত হয়, বিশেষ করে গোল্ড রাশের কথা বললে। ১৯২০-এর দশকের অনেক চলচ্চিত্রে একজন খনির আদর্শিত জীবনকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে সে সারাদিন কাজ করে, প্রচুর অর্থ উপার্জন করে এবং সন্ধ্যায় সেলুনে গিয়ে মহিলাদের সাথে মদ্যপান করে। আদিবাসী আমেরিকানরাও আলাস্কান চলচ্চিত্র গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই সমস্ত চলচ্চিত্র দর্শকদের আলাস্কার সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের তীব্র ধারণা দিয়েছে।
==== ১৯২০-১৯৯৭ ====
[[File:The gold rush 08.jpg|thumb|দ্য গোল্ড রাশ ০৮]]
১৯২৫ সালে নির্মিত নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য গোল্ড রাশ, বিখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত। ছবিটি ১৮০০-এর দশকের শেষের দিকে ভিত্তিক এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করা ডোনার পার্টি নামে একটি অগ্রগামী দলের প্রতিফলন বলে মনে করা হয়। চলচ্চিত্রটি চ্যাপলিনের সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায়, যে একজন অভিবাসী খনি হিসেবে আসে এবং একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ভাল্লুকের সাথে একটি কেবিনে বসবাস শুরু করে। চলচ্চিত্রটি তাকে সোনা খুঁজে পাওয়া, কিছু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া এবং একটি সম্ভাব্য প্রেমিকাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করার চিত্রিত করে। ছবিটির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দৃশ্য হল যেখানে চ্যাপলিন এবং তার সহ-অভিনেতা ক্ষুধার্ত হন এবং চ্যাপলিন একটি জুতার লেজ রান্না করেন এবং খান। চার্লি চ্যাপলিন এই চলচ্চিত্রটির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং ১৯৯৭ সালে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে এটি সংরক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।
অন্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি হল ১৯৮৩ সালের নির্মিত নিভারন রিভার। চলচ্চিত্রটি আলাস্কার উইলো ক্রিকের কাছে চিত্রায়িত হয়েছিল, যেখানকার একটি নদীতে একজন খনির বাস্তব সোনার চিরুনি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। গল্পটি শিকারি হান্টারের ফাঁদে পড়ার প্রায় ব্যর্থ প্রচেষ্টার সাথে জড়িত এবং পল নিউম্যান, ক্যাথরিন হেপবার্ন এবং মেরিল স্ট্রিপের মতো বড় অভিনেতাদের নিয়ে। ছবিটি একটি সফল ছিল এবং একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে 'দ্য ওয়াইল্ড লাইফ অব আলাস্কা' (১৯৯১) এবং 'ফরেস্ট ফরেস্টার' (১৯৯৬)।
১৯২৫ সালে নির্মিত নিঃশব্দ চলচ্চিত্র ''দ্য গোল্ড রাশ''-এ বিখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন অভিনয় করেছেন। সিনেমাটি ১৮০০ সালের শেষের দিকে তৈরি হয় এবং এটি ডোনার পার্টি নামে পরিচিত একদল পথিকের জীবনের প্রতিফলন ঘটায়, যারা ক্যালিফোর্নিয়ায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিল। প্রতিটি মানুষই সেখানে নিজস্ব ভাগ্য খুঁজছিল। সিনেমাটি আলাস্কার কঠিন প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সীমান্তের মতো জীবনযাপনের মধ্যে হাস্যরস নিয়ে আসে। এই চলচ্চিত্রে গোল্ড রাশ এবং এর পেছনের সংস্কৃতির একটি সাধারণ থিম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা অনেক আলাস্কা ভিত্তিক সিনেমায় দেখা যায়। এটি চ্যাপলিনের অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দুটি একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ''রানওয়ে ট্রেন'' একটি অ্যাকশন থ্রিলার চলচ্চিত্র, যা আলাস্কার কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশে দুই পালিয়ে যাওয়া বন্দীর গল্প বলে। তারা একটি চালকবিহীন ট্রেনে আটকে পড়ে। জোন ভয়েট অভিনীত ওস্কার "ম্যানি" ম্যানহাইম একজন নির্মম ব্যাংক ডাকাত এবং এরিক রবার্টস অভিনীত বাক ম্যাকগি একটি কনিষ্ঠ বন্দী। ম্যানি একটি অস্থিরতার পর পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাক তাকে সাহায্য করে। এই সিনেমায় তাদের চমৎকার অভিনয়ের জন্য ভয়েট এবং রবার্টস উভয়েই একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল, যেখানে ভয়েট পুরস্কারটি জিতেছিলেন।
ডিজনি কোম্পানি আলাস্কার উপর ভিত্তি করে কয়েকটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি করেছে, যেমন ''হোয়াইট ফ্যাং''। এটি জ্যাক লন্ডনের লেখা বইয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি। সিনেমাটি ১৯৯১ সালে মুক্তি পায় এবং বক্স অফিসে প্রায় পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন ডলার আয় করে। সিনেমাটি আলাস্কার কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং একজন যুবক জ্যাক কনরয় (ইথান হক অভিনীত) এবং তার অংশীদার ওলফ-কুকুর হোয়াইট ফ্যাং-এর বন্ধনের কাহিনী তুলে ধরে। জ্যাক অনেকের মতো গোল্ড রাশে অংশ নিতে আলাস্কায় এসেছিল। হোয়াইট ফ্যাং, যিনি একজন ছোট্ট কুকুরছানা, তাকে একা জমাটবদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার উপায় শিখতে হয়। একটি স্থানীয় আদিবাসী উপজাতি জ্যাক এবং হোয়াইট ফ্যাংকে একসাথে আনার জন্য সাহায্য করে এবং তারা একে অপরের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং একটি গভীর বন্ধন গড়ে তোলে।
সিনেমাটির সাফল্যের পর, ডিজনি ১৯৯৪ সালে ''হোয়াইট ফ্যাং টু: মিথ অব দ্য হোয়াইট ওলফ'' তৈরি করে। এইবার সিনেমাটিতে হেনরি কেসি (স্কট বেয়ারস্টো অভিনীত) নামে এক তরুণ স্বর্ণ খোঁজার লোক এবং হোয়াইট ফ্যাং-এর কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। হেনরি জ্যাকের সম্পত্তি দেখাশোনা করছে যখন জ্যাক সান ফ্রান্সিসকোতে। তাদের আলাস্কার গভীর বনাঞ্চলে অভিযানের সময় একটি আদিবাসী উপজাতির সাথে দেখা হয়। প্রধান আদিবাসী চিফ হেনরিকে আধ্যাত্মিক নির্দেশনা দেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেন। এই সিনেমাগুলিতে দেখানো আদিবাসী সংস্কৃতি বাইরের বিশ্বের কাছে তাদের জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে।
১৯৮৯ সালের এক্সন ভালডেজের তেলের বিশাল পরিবেশগত দুর্ঘটনার পর, ১৯৯৪ সালে ''অন ডেডলি গ্রাউন্ড'' মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি একটি পরিবেশগত অ্যাকশন মুভি হিসেবে তৈরি হয়। স্টিভেন সিগাল অভিনীত ফোরেস্ট টাফট একজন পরিবেশবাদী এবং তেল রিগ ফায়ার বিশেষজ্ঞ, যিনি একটি তেলের কোম্পানির বিপজ্জনক অর্থ সাশ্রয়ের চক্রান্ত উদঘাটন করেন। টাফটকে তেল কোম্পানির ভাড়াটে সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে হয় এবং আলাস্কার বন্য পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার থেকে রক্ষা করতে হয়। মাইকেল কেইনও এই চলচ্চিত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত তেল কোম্পানির মালিক হিসেবে অভিনয় করেছেন। যদিও সিনেমাটি সমালোচকদের কাছে খুব একটা সাফল্য পায়নি, এটি একটি অনন্য কাহিনী নিয়ে আলাস্কার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ''বাল্টো'', যা ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায়। এটি আলাস্কার একটি শহর নোমের একটি মহান স্লেড ডগের কাহিনী, যিনি সময় এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করে শহরের অসুস্থদের সাহায্য করতে গিয়ে একটি স্লেড ডগ দলের সাথে যোগ দেন। এই সিনেমাটি বাস্তব বাল্টো নামে একটি কুকুরের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যিনি ১৯২৫ সালের সিরাম দৌড় করেছিলেন। সিনেমাটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পিক্সার দুটি অতিরিক্ত সিনেমা তৈরি করে; ''বাল্টো II: ওলফ কোয়েস্ট'' ২০০০ সালে এবং ''বাল্টো III: উইংস অফ চেঞ্জ'' ২০০৪ সালে। এই চলচ্চিত্রগুলি আলাস্কার উপর ভিত্তি করে অন্যান্য সিনেমাগুলির সাধারণ থিমগুলি অনুসরণ করে।
''দ্য এজ'' চলচ্চিত্রটি ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। দুই মানুষকে আলাস্কার কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশে এবং তাদের প্লেন ক্র্যাশের পর জীবনের জন্য লড়াই করতে হয়। একজন শিক্ষিত ধনী ব্যক্তি (অ্যান্থনি হপকিনস অভিনীত) এবং একজন ফটোগ্রাফার (অ্যালেক বাল্ডউইন অভিনীত) একসাথে কাজ করতে হয়। তারা আলাস্কার সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকারী, গ্রিজলি ভল্লুকের মুখোমুখি হয়, যা বারবার তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে পরীক্ষা করে।
==== দ্য গোল্ড রাশ ====
''[[File:Miners During the Gold Rush in Alaska ca 1900.gif|thumb|আলাস্কায় সোনার রাশের সময় খনি শ্রমিকরা। আনুমানিক ১৯০০]]''
আলাস্কার গোল্ড রাশগুলি অনেক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং টেলিভিশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। অনেক সিনেমা এবং টেলিভিশন শো এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ''ক্লন্ডাইক'' ছিল ১৮৯৭ সালের ক্লন্ডাইক গোল্ড রাশের সময়কালীন আমেরিকান টেলিভিশন শো। শোতে রালফ টেগার এবং জেমস কবর্ন অভিনয় করেছিলেন। শোটির পর্যাপ্ত দর্শকসংখ্যা না থাকায় এটি বাতিল হয়ে যায়।
''দ্য স্পয়লার্স'' হল রেক্স বিচ রচিত একটি উপন্যাস, যা নোম, আলাস্কার গোল্ড রাশের বাস্তব ঘটনাগুলির উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। এটি ১৯০৬ সালের সেরা বিক্রিত উপন্যাস ছিল এবং পরে এটি নাটক ও চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়। জন ওয়েন, যিনি ১৯২০-এর দশকে হলিউডে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, এই চলচ্চিত্রে রয় গ্লেনিস্টার চরিত্রে অভিনয় করেন। আলাস্কার নোম থেকে ফিরে আসার পর, তিনি স্থানীয় সোনা খননকারীদের সাথে সমস্যায় পড়েন। এই সিনেমাটি 'ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' ধারণাটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরে।
''নর্থ টু আলাস্কা'' সিনেমাতেও জন ওয়েন অভিনীত সম চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্লটটি ১৮৯০-এর দশকের গোল্ড রাশের উপর ভিত্তি করে তৈরি। ওয়েনের চরিত্র স্যাম এবং তার সহযোগী জর্জ সোনা পায় এবং তাদের সোনার সুরক্ষা করতে হয়। জনি হর্টন, যিনি তার ঐতিহাসিক বর্ণনামূলক গানের জন্য পরিচিত, সিনেমার শিরোনাম গানটি গেয়েছেন, যা ১৯৬১ সালের জানুয়ারি ৯ তারিখে মার্কিন বিলবোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে। দুঃখজনকভাবে, জনি হর্টন সিনেমার প্রিমিয়ারের আগে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন।
==== গোল্ড রাশের প্রভাব ====
আলাস্কায় গোল্ড রাশ
১৮৯৭ সালে, লোকজন আক্ষরিক এবং প্রতীকীভাবে আলাস্কার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং ইউকনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল, আশা ছিল যে তারা সোনা খুঁজে পাবে। যখন তারা সেখানে পৌঁছায়, তাদের স্বাগত জানায় কঠোর আবহাওয়া এবং আরও কঠোর জীবনযাত্রার শর্ত যা সীমিত খাদ্য সরবরাহ এবং অল্প স্বাস্থ্যের যত্নের উপায় নিয়ে গঠিত। এই কঠিন পরিস্থিতি খনি শ্রমিকদের একটি ভিন্ন চরিত্র গড়ে তুলেছিল, যা ছিল কঠোর, দৃঢ় এবং উচ্চ ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণ। তারা জানত না যে সোনা খোঁজার জন্য যারা অভিবাসন করেছিল তারা চিরতরে তাদের বসতি স্থাপন করা জমি, যারা আগে থেকে সেখানে বাস করছিল এবং ভবিষ্যতে যারা সেখানে বাস করবে তাদের জীবন পরিবর্তন করবে।
==== মদ্যপান ====
যখন গোল্ড রাশের কথা বলা হয়, বেশিরভাগ লোকের মনে একটি ছবি আসে যেখানে কিছু পাগল বৃদ্ধ লোক দীর্ঘ দাড়ি নিয়ে বালতির পর বালতি মাটি ধুয়ে সোনার টুকরো খুঁজে পাচ্ছে। দিনের শেষে তারা অপরাধী, মাতাল এবং স্বেচ্ছাসেবকদের ভরা স্যালুনে বিশ্রাম নেয়। লোকেরা যে বিষয়টি বিবেচনা করে না তা হল স্যালুন এবং খনি শ্রমিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন অভ্যাসগুলির নেটিভ আমেরিকান জনগণের উপর ক্ষতিকর প্রভাব। ভারতীয়দের তাদের জমি থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেওয়া, তাদের সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া এবং স্থানীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করার পাশাপাশি, বসতি স্থাপনকারীরা অ্যালকোহলের পরিচয়ের মাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে, সোনার সন্ধানকারীরা প্রচুর পরিমাণে মদ এবং অপব্যবহারমূলক পানীয় অভ্যাস সহ আলাস্কায় বসতি স্থাপন করে। বলা হয় যে এই সময়ে মালবাহী জাহাজগুলি খাবারের চেয়ে অ্যালকোহল সরবরাহ করতে বেশি আগ্রহী ছিল।
নেটিভরা বাণিজ্যের মাধ্যমে অ্যালকোহলের সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছিল, কিন্তু স্যালুন থেকে অস্বাস্থ্যকর পানীয় অভ্যাস, যেমন অতিরিক্ত মদ্যপান, শিখেছিল। এটি এখন স্পষ্টভাবে আধুনিক আলাস্কায় দেখা যায়, যা সব আমেরিকান রাজ্যের মধ্যে অতিরিক্ত মদ্যপানের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে, যা গত এক মাসে অন্তত একবার পাঁচটি বা তার বেশি পানীয় গ্রহণ করেছে এবং ভারী মদ্যপানে অষ্টম স্থানে রয়েছে, গত ত্রিশ দিনে প্রতিদিন দুই বা তার বেশি পানীয় গ্রহণ করেছে। আলাস্কার অ্যালকোহল মৃত্যু হার প্রতি ১০০,০০০ জনসংখ্যায় ২১, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারের তিনগুণ, যেখানে আলাস্কা নেটিভদের হার প্রায় দশগুণ। অ্যালকোহলের অপব্যবহার যৌন নির্যাতন, শিশু নির্যাতন এবং আত্মহত্যা সহ একটি বিস্তৃত সামাজিক সমস্যার সাধারণ উপাদান। আলাস্কার আত্মহত্যার হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারের প্রায় দ্বিগুণ; নন-নেটিভ আলাস্কারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেশি, যেখানে নেটিভদের মধ্যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারের ৩.৬ গুণ।
১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত গবেষণা এবং অধ্যয়ন না করা পর্যন্ত লোকেরা বুঝতে পারেনি আলাস্কায় অ্যালকোহল সমস্যা কতটা খারাপ ছিল, যখন নেটিভ গ্রামবাসী এবং আলাস্কার লোকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে লোকদের উন্নতির জন্য পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। যদিও এতে কিছু সংগ্রাম হবে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রায় সতেরটি আলাস্কার গ্রাম অ্যালকোহল বিক্রয় নিষিদ্ধ করে, পঁচাত্তরটি অ্যালকোহলের বিক্রয় এবং আমদানি নিষিদ্ধ করে এবং তেত্রিশটি সম্পূর্ণভাবে দখল নিষিদ্ধ করে। এই সমস্ত উদ্যোগগুলি অ্যালকোহল অপব্যবহার কমাতে প্রমাণিত হয়েছে, এবং আজও আরও উন্নতি করা হচ্ছে, তবে সমস্যা এখনও বিদ্যমান।
==== সাংস্কৃতিক প্রভাব ====
আজ পর্যন্ত আলাস্কার সমাজে গোল্ড রাশ এখনও জীবিত এবং এটি বিভিন্নভাবে দেখা যায়। যদিও আলাস্কা ১৮০০ এর দশকের মতো অবস্থানে নেই, ফ্রন্টিয়ার এখনও সেই সময়ের কিছু একই মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস ধারণ করে। এটি এমন খেলাধুলার পছন্দে দেখা যায় যেমন হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং, শিকার এবং কুকুর স্লেড রেস, যা সমস্তই খুব কঠোর এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলা। আধুনিক লোকেরা এখনও সেই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ধরে রেখেছে যারা তাদের খনি সঙ্গীর চেয়ে বেশি সোনা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছিল। গোল্ড রাশ সালুন খোলার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করেছিল যা বেশিরভাগ সময় প্যানারদের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করত। এটি এখনও স্পষ্টভাবে দেখা যায়, এবং এমনকি এটি ক্লন্ডাইক তত্ত্ব নামে একটি তত্ত্বে পরিণত হয়েছে, যা বলে যে যারা এমন জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিল যেখানে গোল্ড রাশ ব্যাপক ছিল তাদের প্রতিযোগিতামূলক এবং সৃজনশীল ড্রাইভ অন্য কোথাও তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটস সিয়াটলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, একটি স্থান যা গোল্ড রাশের সময় সমৃদ্ধ হয়েছিল। গোল্ড রাশ লোকেদের নতুন ব্যবসা তৈরি করার দরজা খুলে দিয়েছিল যা আজও টিকে আছে, যেমন নর্ডস্ট্রম। সেই সময়ে বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা ধারণ করা বিশ্বাসগুলি এখনও দেখা যায়। উচ্চতর কর্তৃপক্ষ যেমন সরকারগুলির প্রতি সাধারণ অপছন্দ এখনও বিদ্যমান, নেটিভ লোকেদের এখনও তাদের মতো করে গণ্য করা হয় না, এবং মহিলাদের প্রতি নির্যাতন হয়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ১৮৬০ সাল থেকে কমে গেছে কিন্তু তাদের উপস্থিতি সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আলাস্কার ইতিহাসে অনুসরণ করা যেতে পারে।
আলাস্কা এই ইতিহাসকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেছে, তারা জাতীয় উদ্যানগুলি খুলেছে যেখানে লোকেরা একই পর্বত পথ ধরে হাঁটতে পারে যা খনন করতে ব্যবহৃত হত, যেমন ক্লন্ডাইক গোল্ড রাশ ন্যাশনাল হিস্টোরিকাল পার্ক। লোকেরা অনেকবার এই জমি দাবি করার চেষ্টা করেছে কিন্তু জাতি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে উপলব্ধি করে এবং এটি সুরক্ষিত থাকে। পর্যটকরা যারা আলাস্কায় যান তারা এখন অনেক সাহসিক কাজ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন যার মধ্যে কিছু গোল্ড রাশের উপর ভিত্তি করে, উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালে, জাতি গোল্ড রাশের শতবর্ষ উদযাপন করেছে। যদিও শীতল তাপমাত্রার কারণে আলাস্কায় একটি ছোট পর্যটক বাজার রয়েছে, রাজ্যটি এখনও দর্শনার্থীদের উপভোগ করার জন্য সাংস্কৃতিক আকর্ষণগুলি বিকাশের চেষ্টা করছে। খনির সংস্কৃতি আজও জীবিত এবং এটি কার্টুনের পরে কার্টুনে পাওয়া যেতে পারে, এমনকি বাস্তবতা টিভিতেও যেমন গোল্ড রাশ, এজ অফ আলাস্কা এবং ক্লন্ডাইক, যা সমস্তই আধুনিক দিনের খনির উপর ভিত্তি করে আলাস্কায়।
==== বিংশ শতাব্দী ====
চলচ্চিত্রগুলি মিডিয়ার আগ্রহের সাথে মানানসই করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল যাতে মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় এবং লাভ করা যায়। বিংশ শতাব্দীতে, থ্রিলার এবং হরর চলচ্চিত্রগুলির প্রতি আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে আরও থ্রিলার এবং হরর মুভি তৈরি হয়েছিল। ২০০২ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্স দ্বারা মুক্তিপ্রাপ্ত ইনসমনিয়া একটি অত্যন্ত নাটকীয় থ্রিলার চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির স্থান একটি আলাস্কার শহরে এবং সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস এবং আল পাচিনো অভিনীত। ছবিটি এলএপিডি অফিসার পাচিনো এবং উইলিয়ামসের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরীক্ষা করে, যেখানে পাচিনো ইনসমনিয়ার সাথে লড়াই করে এবং উইলিয়ামস একজন সংবেদনশীল, স্নায়ুযুদ্ধযুক্ত একাকী যার দ্রুত রাগ। চলচ্চিত্রে, তিনি চাপা মন্দ প্রকাশ করতে একটি শীতল সংযত আচরণ ব্যবহার করেন। একজন সমালোচক বলেছিলেন যে উইলিয়ামস চরিত্রটির প্রয়োজনীয় আবেগগত এবং মানসিক অশান্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবং ফলস্বরূপ ছবিটিকে পিছনে রেখেছিলেন। ছবিটি আলাস্কার গ্রীষ্মের অনন্য চিরস্থায়ী দিনের আলো ব্যবহার করে আল পাচিনোর ইনসমনিয়ার সাথে লড়াইকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বাস্তব জীবনে, চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত কিভিক নদীর উপরে স্থাপিত মিসোয়ায়ার দ্বীপটি ফেয়ারব্যাঙ্কসের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি শহর, যা নিসান নামক অঞ্চলে ৫০ জন লোকের বাস। এটি ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে খুব বেশি দূরে নয় এবং কোল্ডফুটে যাওয়ার পথে। এটি আলাস্কার গোল্ড রাশের একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে অনেক লোক আসার জন্য তাদের পথ তৈরি করে। এটি একজন ১৭ বছর বয়সী ছেলের প্রথম সোনার সন্ধানের স্থানও।
==== উপসংহার ====
আলাস্কা কঠিন পরিস্থিতি এবং খনি শ্রমিকদের মনের অবস্থা এখনও বর্তমান প্রজন্মের সাথে যুক্ত হতে পারে। রাজ্যটি নতুন ব্যবসা তৈরি করতে শুরু করেছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আকর্ষণ করে রেখেছে, তবে তারা এখনও তাদের সমাজের সমস্যার সাথে লড়াই করছে, যেমন অ্যালকোহল অপব্যবহার এবং আত্মহত্যার উচ্চ হার। একসময়ের দুঃসাহসিক স্থান এখনও সারা বিশ্বে মানুষকে আকর্ষণ করে এবং সঠিক প্রচেষ্টা এবং নেতৃত্বের সাথে আলাস্কা একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
== সারা প্যালিন ==
==== আলাস্কার গভর্নর ====
[[File:Sarah Palin Germany 3 Cropped Lightened.JPG|right|200px]]
সারা প্যালিন একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ এবং লেখিকা। তিনি ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর আলাস্কার নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। প্যালিন আলাস্কার প্রথম নারী গভর্নর এবং ৪২ বছর বয়সে আলাস্কার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গভর্নর হন। গভর্নর হিসেবে, প্যালিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার প্রধান অগ্রাধিকার হবে রাজ্যের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, যা কর্মশক্তি, পরিবহন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে করা হবে। ১৫ জানুয়ারী, ২০০৮ তারিখে তার স্টেট অফ দ্য স্টেট ভাষণে, প্যালিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচার করে বলেছিলেন, "আমরা আমাদের অর্থনীতি উন্নয়ন চালিয়ে যেতে পারি এবং অবশ্যই করতে হবে কারণ আমরা ফেডারেল সরকারের অর্থের উপর এতটা নির্ভর করতে পারি না এবং করা উচিত নয়। বরং, আসুন আমরা শক্তি সংগ্রহ করি এবং আলাস্কা এবং আমেরিকার জন্য উৎপাদন করি।” গভর্নর প্যালিন তার মেয়াদকালে পুঁজি বাজেটে বড় কাটছাঁট করার জন্য এবং সম্ভব হলে রাজ্য ব্যয় হ্রাস করার জন্যও পরিচিত ছিলেন।
একটি শক্তিশালী অর্থনীতি বিকাশের জন্য প্যালিনের প্রচারণার অংশ হিসেবে, তিনি আলাস্কার ক্লিয়ার অ্যান্ড ইকুইটেবল শেয়ার (ACES) স্বাক্ষর করেন যা তেল মুনাফার উপর একটি নেট কর অন্তর্ভুক্ত করে এবং আলাস্কায় তেল কোম্পানিগুলিকে কার্যক্রম উন্নয়নের জন্য প্রণোদনা প্রদান করে। ACES তেল বাজারে কম দামের সময় উৎপাদকদের সুরক্ষা প্রদান করে, একইসাথে আলাস্কার মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে। ACES পাস করার ফলে রাজ্যে রেকর্ড সংখ্যক তেল শিল্পের চাকরি সৃষ্টি হয়। স্বচ্ছতা এবং নৈতিক সংস্কারও প্যালিনের গভর্নরশিপ এবং খোলা এবং সৎ সরকারের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গভর্নর প্যালিন দ্বিপক্ষীয় নৈতিক আইন, উন্নত প্রকাশ আইন এবং নির্বাহী এবং আইনসভা শাখার নৈতিক আইনগুলির জন্য লড়াই করেন এবং স্বাক্ষর করেন, যা হাউস বিল ১০৯ এর অংশ।
গভর্নর হিসাবে তার বছরগুলিতে প্যালিনের জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। ২০০৭ সালের মে মাসে তার অনুমোদনের রেটিং ৯৩% থেকে ২০০৯ সালের মে মাসে ৫৪% পর্যন্ত হ্রাস পায়। রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি প্রার্থী [[John McCain|জন ম্যাককেইন]] এর রানিং মেট হিসাবে প্যালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, তিনি সারা আমেরিকায় মিডিয়ার মনোযোগ এবং সমালোচনা বৃদ্ধি পেয়েছিলেন। জেমস ই. ক্যাম্পবেলের লেখা একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে রিপাবলিকান সম্মেলনে প্যালিনের নির্বাচনে রক্ষণশীল ভিত্তি প্রাথমিকভাবে সক্রিয় হয়েছিল, তবে প্যালিনের পরবর্তী সাক্ষাৎকারগুলি জনসাধারণ এবং জাতীয় মিডিয়া দ্বারা বিপর্যয়কর হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়েছিল। এই একই গবেষণায় বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতি প্রচারণায় আলাস্কার গভর্নরের নির্বাচন ম্যাককেইনের ধীরে ধীরে পোলিংয়ে হ্রাসের পাশাপাশি প্যালিনের অনুমোদনের হারেও অবদান রেখেছে।
সারা প্যালিন ২৬ জুলাই, ২০০৯ তারিখে আলাস্কার গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা মিডিয়া এবং তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনার কারণ হয়েছিল।
==== ২০০৮ ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রচারণা ====
২৯ আগস্ট, ২০০৮ তারিখে রিপাবলিকান রানিং মেট জন ম্যাককেইন দ্বারা ২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সারা প্যালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, সারা প্যালিন আমেরিকান রাজনীতিতে একটি অপেক্ষাকৃত "অজানা চরিত্র" হিসেবে মিডিয়ার মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের তুলনায়, সারা প্যালিন মিডিয়াতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি কভারেজ পেয়েছিলেন এবং একটি বিতর্কিত চরিত্র হিসাবে, তিনি আরও সমালোচনা এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আলাস্কার বাইরের একটি বড় অংশের আমেরিকানরা প্যালিন এবং তার বিশ্বাস ও রাজনীতি সম্পর্কে অপরিচিত ছিল, তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে মিডিয়াতে প্যালিনের কভারেজ মূলত এই এলাকায় আলোকপাত করেনি, বরং তার ব্যক্তিত্ব এবং তুচ্ছ বিষয়গুলিতে বেশি মনোনিবেশ করেছিল। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ''নিউজউইক'' তার কভারেজের অর্ধেকেরও বেশি (৫৮.২%) প্যালিনের শৈশব, পরিবার, শারীরিক চেহারা এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। বিপরীতে, মাত্র ১১.৯% কভারেজ তার অফিসের যোগ্যতা, আইনসভা অভিজ্ঞতা এবং জাতীয় রাজনৈতিক প্রচারণার সময়কার দুটি প্রধান রাজনৈতিক বিষয় -- ইরাক যুদ্ধ এবং জাতির অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে মনোনিবেশ করেছিল।
প্রচারণার সময় দেশীয় এবং বিদেশী রাজনীতির সাথে অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য প্যালিনের সমালোচকরা, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয়ই দ্রুত তাকে আক্রমণ করেছিলেন। তবে, রিপাবলিকান পার্টি তার অভিজ্ঞতা, সাফল্য এবং আলাস্কার গভর্নর হিসেবে জনপ্রিয়তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তাদের মনোনয়নের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং যৌক্তিকতা হিসাবে উল্লেখ করেছিল।
==== জনসাধারণের চিত্র এবং ব্যক্তিত্ব ====
সারা প্যালিনের জনপ্রিয়তা তাকে জাতীয় পর্যায়ে আলাস্কার রাজনীতিকে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছিল, যা অনেক আমেরিকান আগে অবগত ছিল না।
প্যালিনের ব্যক্তিত্ব এবং দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাস জাতীয় মিডিয়া থেকে ব্যাপক সমালোচনা এবং মনোযোগ পেয়েছিল। তিনি জনসমক্ষে তার খ্রিস্টান জীবনের বিষয়ে খুবই উন্মুক্ত ছিলেন। গর্ভপাতের বিষয়ে তার প্রো-লাইফ অবস্থান ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছিল। প্যালিনের বিশ্বাস বিতর্কিত ছিল এবং জাতীয় নারী সংস্থা (NOW) এর মতো সংগঠনগুলির সমালোচনা পেয়েছিল, যারা বলেছিল "প্রতিটি নারী নারীর অধিকার সমর্থন করে না।" প্যালিনের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি প্রচারণার সময় একাধিকবার বিতর্কিত প্রমাণিত হয়েছিল। অক্টোবর ২০০৮ সালে, সিবিএন-এর ডেভিড ব্রডির সাথে এক সাক্ষাৎকারে, প্যালিন বলেছিলেন যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সাংবিধানিক সংশোধনীকে সমর্থন করবেন, যা এই বিষয়ে তার রানিং মেট ম্যাককেইনের অবস্থানের বিপরীত।
জনসাধারণের ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্যালিনের জনপ্রিয়তা তার চরিত্রের উপর ভিত্তি করে প্যারোডি এবং ব্যঙ্গাত্মক রচনার সৃষ্টি করেছিল। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়, স্কেচ কমেডি টেলিভিশন শো স্যাটারডে নাইট লাইভ বেশ কয়েকটি স্কেচ প্রচার করেছিল যা সারা প্যালিনকে প্যারোডি করেছিল, প্রধানত তার আচরণ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের মজা করে। তবে, স্যাটারডে নাইট লাইভ-এ প্যালিনের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিকৃতি রিপাবলিকান পার্টির জন্য তার কিছু ধর্মীয় বিশ্বাসকে একটি দায়িত্বে পরিণত করেছিল। প্যালিনকে অভিনেত্রী এবং এসএনএল লেখক টিনা ফে দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছিল। স্কেচগুলি সমালোচকদের দ্বারা ভালভাবে গৃহীত হয়েছিল এবং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল এবং ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ফে তৎকালীন আলাস্কার গভর্নরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং জানুয়ারী ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্যালিনের চরিত্রে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিলেন।
সারা প্যালিন তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক স্মৃতিকথা "গোয়িং রগ: অ্যান আমেরিকান লাইফ" ১৭ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রকাশ করেন, যা প্রকাশের পর ছয় সপ্তাহ ধরে নিউইয়র্ক টাইমসের #১ বেস্টসেলার হয়ে ওঠে, তবে বইটি নিজেই মিশ্র পর্যালোচনা পেয়েছিল। তদুপরি, প্যালিন তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে অনেক স্মরণীয় উক্তি ব্যবহার করার জন্য পরিচিত হয়েছেন। তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে: "আমরা বলি তোমার পরিবর্তন রাখো, আমরা আমাদের ঈশ্বর, আমাদের বন্দুক, আমাদের সংবিধান রাখব", "বন্ধুরা, এই সরকার ব্যর্থ হওয়ার জন্য খুব বড় নয়, এটি সফল হওয়ার জন্য খুব বড়", "আমি সেই হকি মায়েদের ভালবাসি। আপনি জানেন যে তারা হকি মা এবং পিট বুলের মধ্যে পার্থক্য বলে কী? লিপস্টিক"।
0tyws0asm6c9b51y5oaeqqe7jp8uv6f
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)
0
27197
85938
85922
2025-07-11T09:03:31Z
Jonoikobangali
676
85938
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#মহীধরপাদ|মহীধরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ধামপাদ|ধামপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কঙ্কণ|কঙ্কণ]]
### [[/চর্যাপদ#গুণ্ডরীপাদ|গুণ্ডরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তাড়কপাদ|তাড়কপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#জয়নন্দী|জয়নন্দী]]
### [[/চর্যাপদ#ঢেণ্ঢণপাদ|ঢেণ্ঢণপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তন্ত্রীপাদ|তন্ত্রীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
## [[/চর্যাপদ#ভাষা|ভাষা]]
### [[/চর্যাপদ#সন্ধ্যাভাষা|সন্ধ্যাভাষা]]
## [[/চর্যাপদ#সাহিত্যমূল্য|সাহিত্যমূল্য]]
## [[/চর্যাপদ#সমাজচিত্র|সমাজচিত্র]]
</div>
</div>
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
<!-- ### পর্ব ২ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ২''' – আদি মধ্যযুগ: ত্রয়োদশ-পঞ্চদশ শতক</big>
# [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি|প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি]]
## [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য|''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্য]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কবি: বড়ু চণ্ডীদাস|কবি: বড়ু চণ্ডীদাস]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কাব্য পরিচয়|কাব্য পরিচয়]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#গ্রন্থনাম বিচার|গ্রন্থনাম বিচার]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা|পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি|চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কৃষ্ণ|কৃষ্ণ]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#রাধা|রাধা]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#বড়ায়ি|বড়ায়ি]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কাব্যাঙ্গিক|কাব্যাঙ্গিক]]
</div>
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
h5k7qzu39k4bxhs3n2bkaj3gu0v1n75
85941
85938
2025-07-11T10:28:04Z
Jonoikobangali
676
85941
wikitext
text/x-wiki
{| cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="width:100%; border:solid #BBBBBB 5px; background:#EEEEEE"
|-
| style="vertical-align:center" | <div style="margin-left:15px;margin-right:15px">
{{book title|বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)}}
এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুযায়ী প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সাধারণ পাঠকবর্গ ও শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রকাশ করা।
এই বইটিতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। প্রথম পর্বে আছে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় বাঙালির রচিত সাহিত্য ও চর্যাপদের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্যের বিবরণ। তৃতীয় পর্বে চৈতন্য যুগে রচিত অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যের বিবরণও। চতুর্থ পর্বে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও পদসংকলন, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্যের বিবরণ।
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
|}
{| width="100%" cellspacing="0" cellpadding="4" border="0" style="border:solid #BBBBBB 1px; background:#EEEEEE"
<!-- ### পর্ব ১ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ১''' – প্রাচীন যুগ: দশম-দ্বাদশ শতক</big>
# [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা|সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষা]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য|বাঙালি ও সংস্কৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য|বাঙালি ও প্রাকৃত সাহিত্য]]
## [[/সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত বাঙালির সাহিত্য#বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য|বাঙালি ও অপভ্রংশ সাহিত্য]]
# [[/চর্যাপদ|চর্যাপদ]]
## [[/চর্যাপদ#রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার|রচনাকাল ও গ্রন্থনাম বিচার]]
## [[/চর্যাপদ#কবি|কবি]]
### [[/চর্যাপদ#লুইপাদ|লুইপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শবরীপাদ|শবরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভুসুকুপাদ|ভুসুকুপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#সরহপাদ|সরহপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কাহ্নপাদ|কাহ্নপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বিরূপপাদ|বিরূপপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#শান্তিপাদ|শান্তিপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#দারিকপাদ|দারিকপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ডোম্বীপাদ|ডোম্বীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কুক্কুরীপাদ|কুক্কুরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#চাটিলপাদ|চাটিলপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#আর্যদেব|আর্যদেব]]
### [[/চর্যাপদ#কম্বলাম্বরপাদ|কম্বলাম্বরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#বীণাপাদ|বীণাপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ভাদেপাদ|ভাদেপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#মহীধরপাদ|মহীধরপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#ধামপাদ|ধামপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#কঙ্কণ|কঙ্কণ]]
### [[/চর্যাপদ#গুণ্ডরীপাদ|গুণ্ডরীপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তাড়কপাদ|তাড়কপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#জয়নন্দী|জয়নন্দী]]
### [[/চর্যাপদ#ঢেণ্ঢণপাদ|ঢেণ্ঢণপাদ]]
### [[/চর্যাপদ#তন্ত্রীপাদ|তন্ত্রীপাদ]]
## [[/চর্যাপদ#ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব|ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব]]
## [[/চর্যাপদ#ভাষা|ভাষা]]
### [[/চর্যাপদ#সন্ধ্যাভাষা|সন্ধ্যাভাষা]]
## [[/চর্যাপদ#সাহিত্যমূল্য|সাহিত্যমূল্য]]
## [[/চর্যাপদ#সমাজচিত্র|সমাজচিত্র]]
</div>
</div>
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
<!-- ### পর্ব ২ ### -->
|-
| style="vertical-align:top;text-align:center" | <div style="margin-top:10px"></div>
| style="vertical-align:top" | <div style="margin-right:15px"><big>'''পর্ব ২''' – আদি মধ্যযুগ: ত্রয়োদশ-পঞ্চদশ শতক</big>
# [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি|প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি]]
## [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য|''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্য]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কবি: বড়ু চণ্ডীদাস|কবি: বড়ু চণ্ডীদাস]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কাব্য পরিচয়|কাব্য পরিচয়]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#গ্রন্থনাম বিচার|গ্রন্থনাম বিচার]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা|পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি|চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কৃষ্ণ|কৃষ্ণ]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#রাধা|রাধা]]
#### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#বড়ায়ি|বড়ায়ি]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#প্রকরণ|প্রকরণ]]
### [[/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি#কাব্যাঙ্গিক|কাব্যাঙ্গিক]]
</div>
| style="background:#CCCCEE;vertical-align:top" |
|}
===ত্রয়োদশ শতক-পঞ্চদশ শতক===
# [[/শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা|শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ অনুবাদ
# [[/কৃত্তিবাস ওঝা|কৃত্তিবাস ওঝা]]
; মহাভারত অনুবাদ
# [[/কবীন্দ্র পরমেশ্বর|কবীন্দ্র পরমেশ্বর]]
# [[/শ্রীকর নন্দী|শ্রীকর নন্দী]]
; ভাগবত অনুবাদ
# [[/মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়|মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল====
; মনসামঙ্গল
# [[/হরি দত্ত|হরি দত্ত]]
# [[/নারায়ণ দেব|নারায়ণ দেব]]
# [[/বিজয় গুপ্ত|বিজয় গুপ্ত]]
# [[/বিপ্রদাস পিপলাই|বিপ্রদাস পিপলাই]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/মানিক দত্ত|মানিক দত্ত]]
===ষোড়শ শতক থেকে মধ্য সপ্তদশ শতক===
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন ও কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর====
; মনসামঙ্গল
# [[/কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ|কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ]]
# [[/ দ্বিজ বংশীদাস|দ্বিজ বংশীদাস]]
; চণ্ডীমঙ্গল
# [[/দ্বিজ মাধব|দ্বিজ মাধব]]
# [[/মুকুন্দ চক্রবর্তী|মুকুন্দ চক্রবর্তী]]
# [[/দ্বিজ রামদেব|দ্বিজ রামদেব]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামাই পণ্ডিত|রামাই পণ্ডিত]]
# [[/রূপরাম চক্রবর্তী|রূপরাম চক্রবর্তী]]
# [[/খেলারাম চক্রবর্তী|খেলারাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামকৃষ্ণ রায়|রামকৃষ্ণ রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/দ্বিজ শ্রীধর|দ্বিজ শ্রীধর]]
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/মুরারি গুপ্ত|মুরারি গুপ্ত]]
# [[/নরহরি সরকার|নরহরি সরকার]]
# [[/শিবানন্দ সেন|শিবানন্দ সেন]]
# [[/জ্ঞানদাস|জ্ঞানদাস]]
# [[/গোবিন্দদাস|গোবিন্দদাস]]
# [[/বাসুদেব ঘোষ|বাসুদেব ঘোষ]]
# [[/রামানন্দ বসু|রামানন্দ বসু]]
# [[/বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়|বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/যদুনন্দন দাস|যদুনন্দন দাস]]
# [[/মাধবদাস|মাধবদাস]]
# [[/অনন্ত দাস|অনন্ত দাস]]
====চরিতকাব্য====
# [[/বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত|বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত]]
# [[/লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল|লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল|জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল]]
# [[/কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত|কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত]]
# [[/গোবিন্দদাসের কড়চা|গোবিন্দদাসের কড়চা]]
# [[/চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়|চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/অদ্ভুতাচার্য|অদ্ভুতাচার্য]]
# [[/চন্দ্রাবতী|চন্দ্রাবতী]]
; মহাভারত
# [[/কাশীরাম দাস|কাশীরাম দাস]]
; ভাগবত
# [[/রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী|রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী]]
# [[/মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল|মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল]]
# [[/দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল|দুঃখী শ্যামদাসের গোবিন্দমঙ্গল]]
===মধ্য সপ্তদশ শতক—অষ্টাদশ শতক===
====বৈষ্ণব পদাবলি====
# [[/প্রেমদাস|প্রেমদাস]]
# [[/রাধামোহন ঠাকুর|রাধামোহন ঠাকুর]]
# [[/চন্দ্রশেখর|চন্দ্রশেখর]]
=====বৈষ্ণব পদসংকলন=====
# [[/ক্ষণদাগীতচিন্তামণি|ক্ষণদাগীতচিন্তামণি]]
# [[/গীতচন্দ্রোদয়|গীতচন্দ্রোদয়]]
# [[/গৌরচরিতচিন্তামণি|গৌরচরিতচিন্তামণি]]
# [[/পদামৃতসমুদ্র|পদামৃতসমুদ্র]]
# [[/পদকল্পতরু|পদকল্পতরু]]
====মঙ্গলকাব্য: মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর ও শিবায়ন====
; মনসামঙ্গল
# [[/তন্ত্রবিভূতি|তন্ত্রবিভূতি]]
# [[/জগজ্জীবন ঘোষাল|জগজ্জীবন ঘোষাল]]
# [[/জীবন মৈত্র|জীবন মৈত্র]]
; ধর্মমঙ্গল
# [[/রামদাস আদক|রামদাস আদক]]
# [[/সীতারাম দাস|সীতারাম দাস]]
# [[/যাদুনাথ বা যাদবনাথ|যাদুনাথ বা যাদবনাথ]]
# [[/শ্রীশ্যাম পণ্ডিত|শ্রীশ্যাম পণ্ডিত]]
# [[/ঘনরাম চক্রবর্তী|ঘনরাম চক্রবর্তী]]
# [[/মানিক গাঙ্গুলী|মানিক গাঙ্গুলী]]
; অন্নদামঙ্গল
# [[/ভারতচন্দ্র রায়|ভারতচন্দ্র রায়]]
; কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
# [[/কৃষ্ণরাম দাস|কৃষ্ণরাম দাস]]
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/বলরাম চক্রবর্তী|বলরাম চক্রবর্তী]]
; শিবায়ন
# [[/রামেশ্বর ভট্টাচার্য|রামেশ্বর ভট্টাচার্য]]
====অনুবাদ কাব্য: রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত====
; রামায়ণ
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/জগৎরাম রায়|জগৎরাম রায়]]
# [[/রামানন্দ ঘোষ|রামানন্দ ঘোষ]]
; মহাভারত
# [[/দ্বৈপায়ন দাস|দ্বৈপায়ন দাস]]
# [[/নন্দরাম দাস|নন্দরাম দাস]]
# [[/গঙ্গাদাস সেন|গঙ্গাদাস সেন]]
; ভাগবত
# [[/শঙ্কর কবিচন্দ্র|শঙ্কর কবিচন্দ্র]]
# [[/বলরাম দাস|বলরাম দাস]]
# [[/দ্বিজ মাধবেন্দ্র|দ্বিজ মাধবেন্দ্র]]
# [[/দ্বিজ রমানাথ|দ্বিজ রমানাথ]]
====শাক্ত পদাবলি====
# [[/রামপ্রসাদ সেন|রামপ্রসাদ সেন]]
# [[/কললাকান্ত ভট্টাচার্য|কমলাকান্ত ভট্টাচার্য]]
# [[/অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা|অন্যান্য শাক্ত পদকর্তা]]
====নাথ সাহিত্য====
# [[/নাথ সাহিত্য|নাথ সাহিত্য]]
====ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা====
# [[/ময়মনসিংহ গীতিকা|ময়মনসিংহ গীতিকা]]
# [[/পূর্ববঙ্গ গীতিকা|পূর্ববঙ্গ গীতিকা]]
====চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য====
# [[/চট্টগ্রাম-রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য|চট্টগ্রাম রোসাঙের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য]]
{{বিষয়|বাংলা সাহিত্য}}
{{বর্ণানুক্রমিক|ব}}
{{বিষয়|সাহিত্য}}
{{বইয়ের বিষয়শ্রেণী}}
07prm8efnbld2jb0jkhykcajur09cs1
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)/প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি
0
27249
85937
85921
2025-07-11T09:02:40Z
Jonoikobangali
676
/* বড়ায়ি */
85937
wikitext
text/x-wiki
পৌরাণিক সংস্কৃতির অন্যতম বিশিষ্ট একটি ধারা হল কৃষ্ণকথার ধারা। বৈদিক সাহিত্যেই এই কৃষ্ণকথার বীজ নিহিত ছিল। ক্রমে পুরাণগুলির মধ্যে দিয়ে ক্রমবিকাশের নানা পর্যায় পার হয়ে বিষ্ণু, নারায়ণ, হরি, বাসুদেব ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র একক পুরুষে একীভূত হয়ে যায়। তখন তিনি হন অংশী, অন্যরা অংশ। আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৮০০ থেকে ১০০০ অব্দের মধ্যবর্তীকালে রচিত ভাগবত পুরাণে সেই অংশী ‘স্বয়ং ভগবান’ কৃষ্ণ নামে কথিত হলেন। এই পুরাণে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হল কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত কাহিনি। বস্তুত ভাগবতধর্মের বিকাশ ঘটল এই গ্রন্থ রচনার পরে। এরপর একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল উত্তর ভারতেও। সেই সূত্রে বাংলাতেও এসে উপস্থিত হল কৃষ্ণভক্তিবাদ। সেন আমলে বাংলায় যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল, তার অন্যতম অবলম্বন ছিল কৃষ্ণকথা। জয়দেব তাঁর ''গীতগোবিন্দম্'' কাব্যে কৃষ্ণকে একই সঙ্গে করে তুললেন পরমারাধ্য বিষ্ণুর অবতার এবং কামকেলিকলার নায়ক।
ঠিক এই সময়েই বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল, যার সুদূরপ্রসারী ফলে বাঙালি সমাজ, বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি হিন্দুর দৈনিক জীবনে এল এক আমূল পরিবর্তন। ঘটনাটি ইতিহাসে তুর্কি আক্রমণ নামে খ্যাত। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিতে তুর্কি সেনানায়ক ইখ্তিয়ার-উদ্দিন মহম্মদ বিন বখ্তিয়ার খিলজি আক্রমণ করলেন রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজ্য। বৃদ্ধ রাজা পালিয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গে। বিদেশি শাসনে সাধারণ হিন্দুরা সমূহ বিপদের সম্মুখীন হল। এই সংকটকালে কোনও সাহিত্য রচিত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য আজও পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয়, তুর্কি আক্রমণের প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার পর সমাজজীবন সুস্থির হলে বাঙালির সাহিত্যচর্চার অবকাশ তৈরি হয়। এই দু-আড়াইশো বছর সময়টিকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। এই সময়েই বিদেশি শাসকের ধর্মীয় ও সামাজিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলা সাহিত্যকে অবলম্বন করে বাঙালি হিন্দু এক সাংস্কৃতিক বর্ম গড়ে তোলে।
আসলে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষেরা উচ্চবর্ণের নিপীড়ন সহ্য করার পর ইসলামের সাম্যবাদী নীতিতে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে শাসকবর্গের প্রলোভন ও দমনপীড়নের নীতি তো ছিলই। ফলে দলে দলে লোক ধর্মান্তরিত হচ্ছিল ভয়ে, লোভে, পীড়নে ও পিরদের কেরামতিতে আকৃষ্ট হয়ে। এতে হিন্দু সমাজপতিদের টনক নড়ে। নিজেদের ধর্মাদর্শকে দেশীয় ভাষায় সকলের কাছে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তারা। সমাজের ভাঙন প্রতিরোধে শাস্ত্রকথা শুনিয়ে লোক-নিস্তারণের দায়িত্ব নেন অনুবাদক কবিরা। অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যের আখ্যানে উঠে আসে অবনমিত সম্প্রদায়ের উপরে ওঠার ইতিহাস। চণ্ডী, মনসা, ধর্মঠাকুর প্রমুখ লোকদেবতা আর অপাংক্তেয় হয়ে থাকেন না, বরং মন্ত্র ও পূজা ইত্যাদি প্রাপ্তির মাধ্যমে তাঁরাও স্বীকৃত হন উচ্চসমাজে। প্রাক্-চৈতন্য যুগে বাংলায় প্রচারিত কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য এই প্রেক্ষাপটেই বিবেচ্য।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে কৃষ্ণের নৈষ্ঠিক পূজার্চনার রীতি চালু হয়। তৎকালীন অভিলিখন, ভাস্কর্য ও শাস্ত্রগ্রন্থে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবে বৈদান্তিক মতের প্রাধান্য ঘটে। সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়ায় একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব ভক্তিবাদী আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে উত্তর ভারতে। আরও তিন শতক পরে চতুর্দশ শতকের শেষভাগে মাধবেন্দ্র পুরী সারা ভারতে কৃষ্ণভক্তিবাদ প্রচার করেন। শোনা যায় বাংলায় তিনি কৃষ্ণভক্তির সূচনা করেছিলেন অদ্বৈত আচার্য ও ঈশ্বর পুরী নামে দুই শিষ্যের মাধ্যমে। ঈশ্বর পুরীই দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত স্মার্ত নিমাই পণ্ডিতকে—যিনি সন্ন্যাসগ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা চৈতন্য মহাপ্রভু নামে পরিচিত হন। বস্তুত ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা চৈতন্যের প্রভাবে বাংলায় কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তাঁর রাগানুগা ভক্তি প্রচলিত কৃষ্ণার্চনার ধারায় এক অভিনব সংযোজন। প্রাক্-চৈতন্য যুগের তুলনায় তাই চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কৃষ্ণকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারা অনেকটাই আলাদা। প্রথম পর্বে যেখানে বৈধী ভক্তির প্রাধান্য দেখা যায়, চৈতন্য-পরবর্তী পর্বে বৈষ্ণব সাধনায় দেখা যায় রাগানুগা প্রেমাভক্তির প্রাধান্য। পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদাবলিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনতত্ত্বের স্পর্শ অথবা ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থের ন্যায় বৈষ্ণবীয় অলংকারশাস্ত্রের নিগূঢ় বন্ধন ছিল না; সেই পদ রচিত হয়েছিল কবিদের নিজস্ব প্রাকৃত ও আধ্যাত্মিক চেতনার সংমিশ্রণে, কোথাও আবার সংস্কৃত সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা প্রকরণের ছায়া অবলম্বনে। সাহিত্যের ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন প্রমাণের উপর নির্ভর করে জানিয়েছেন, প্রাক্-চৈতন্য যুগে কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদসাহিত্য দেশীয় ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন তিনজন শক্তিমান কবি। এঁরা হলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কবি বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলির অন্যতম দুই বিশিষ্ট রূপকার বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস। অবশ্য ভাষা ও জাতিগত বিচারে বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না। তিনি পদ রচনা করেন ব্রজবুলি ভাষায়। প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও পদাবলি সাহিত্য আলোচনায় এই তিন বিশিষ্ট কবির সাহিত্যসম্ভারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে।
==''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্য==
আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দাবি সর্বজনস্বীকৃত। এই কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস আর কোনও বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তিনি যে বাংলা ভাষায় কৃষ্ণকেন্দ্রিক একটি বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাব্যটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) প্রাচীন সাহিত্য-বিশারদ বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামে বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র্য-বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচা থেকে অযত্নরক্ষিত এই পুথিটি উদ্ধার করেন। সাত বছর পরে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুথিটিকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি। প্রকাশের পর এই গ্রন্থের নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
===কবি: বড়ু চণ্ডীদাস===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। মধ্যযুগে চণ্ডীদাস নামধারী আরও কবি ছিলেন বলে গবেষকদের ধারণা। তবে বড়ু চণ্ডীদাস যে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কাব্যের ভণিতা থেকে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কবি কোথাও নিজেকে ‘অনন্ত বড়ু’, কোথাও ‘অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস’, আবার কোথাও বা কেবল ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ ভণিতাই পাওয়া যায় সর্বাধিক সংখ্যায়—২৯৮ বার, এবং ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা আছে ১০৭ বার। এই পুথি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই বাঙালি পাঠক ও বৈষ্ণব সমাজ চণ্ডীদাসের পদের সঙ্গে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকে বৈষ্ণব মহাজনদের রচিত পদগুলির সংকলনও প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ''স্কেচ অফ দ্য রিলিজিয়াস সেক্টস অফ হিন্দুজ'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন যে, গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির যৌথ কর্তৃত্বে সংস্কৃত ভাষায় ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়েছিল। তথ্যটি বাঙালি লেখকদের কলমে বিকৃত হয়ে এই রূপ নেয় যে, চণ্ডীদাস ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি পুথি রচনা করেছিলেন। তাই ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথি আবিষ্কারের পর স্বয়ং আবিষ্কর্তাও বিভ্রান্ত হয়ে কবিকে ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’ বলেই উল্লেখ করেন। তাঁর ধারণা ছিল “দীর্ঘকাল যাবৎ চণ্ডীদাস বিরচিত কৃষ্ণকীর্তন”-এর যে অস্তিত্বের কথা তিনি শুনে আসছিলেন, প্রাপ্ত পুথিটি তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। ভণিতায় প্রাপ্ত ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ নামটি তিনি উপেক্ষা করে যান। সেই থেকেই চণ্ডীদাস সমস্যার প্রাথমিক সূত্রপাত। দীনেশচন্দ্র সেনও জানান, “কবি চণ্ডীদাস ও কৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা যে অভিন্ন ব্যক্তি, তৎসম্বন্ধে আমাদের সংশয় নেই।” যে চণ্ডীদাস যৌবনে তীব্র আদিরসাত্মক রচনায় সিদ্ধহস্ত, পরিণত বয়সে তিনিই আধ্যাত্মিক রসে বিহ্বল। মনীন্দ্রমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালা থেকে দীন চণ্ডীদাসের পদ আবিষ্কার করলে সমস্যা আরও তীব্র হয়। কারণ পুরোনো পুথিপত্রে একক চণ্ডীদাসের উল্লেখই পাওয়া যায়। যেমন, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ''চৈতন্যচরিতামৃত'' বা সনাতন গোস্বামীর ''বৈষ্ণবতোষিণী'' টীকা ইত্যাদিতে কোথাও বড়ু বা দীন চণ্ডীদাসের নামোল্লেখ নেই।
কিন্তু এত জটিলতা সত্ত্বেও কয়েকটি অকাট্য প্রমাণের বলে পদাবলির চণ্ডীদাস থেকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতাকে পৃথক করা সম্ভব হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-র ষষ্টিতম ভাগ, দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করে কোন কোন সূত্রে দুই চণ্ডীদাস স্বতন্ত্র তা দেখিয়েছেন। তাঁর সুচিন্তিত সমাধানগুলি হল:
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে কোথাও ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’ বা ‘দীন চণ্ডীদাস’ ভণিতা নেই।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার পিতামাতার নাম সাগর ও পদুমা বলে উল্লেখ করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার শাশুড়ি বা ননদের নাম উল্লেখ করেননি। ‘বড়ায়ি’ ছাড়া কোনও সখীকেও সম্বোধন করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে চন্দ্রাবলী রাধারই নামান্তর, পৃথক প্রতিনায়িকা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কৃষ্ণের কোনও সখার নাম উল্লেখ করেননি।
# বড়ু চণ্ডীদাস সর্বত্র প্রেম অর্থে ‘নেহ’ বা ‘নেহা’ ব্যবহার করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কোথাও রাধার বিশেষণে ‘বিনোদিনী’ এবং কৃষ্ণ অর্থে ‘শ্যাম’ ব্যবহার করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে রাধা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস ব্রজবুলি জানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
উপরিউক্ত তথ্যগুলি বড়ু চণ্ডীদাসের পৃথক অস্তিত্বের প্রমাণ। আসলে মধ্যযুগের অনেক কবির মতোই বড়ু চণ্ডীদাসও নিজের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। কেবল তিনি যে ‘বাসলী’ নামে এক দেবীর সেবক ছিলেন, সেই কথাই উল্লিখিত হয়েছে ভণিতায়। এই কবিকে নিয়ে লোক-ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়েছে অনেক জনশ্রুতি। কবির জন্মস্থান বাঁকুড়ার ছাতনা না বীরভূমের নানুর তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, দুই স্থানেই বাসলী দেবীর মন্দির আছে, চণ্ডীদাস ও রামী রজকিনীকে নিয়ে লোকপ্রবাদ প্রচলিত, বছরের নির্দিষ্ট দিনে মেলা ও উৎসব হয়। তবে বাঁকুড়ার দিকেই পাল্লা ভারী। কারণ নানুরের কবি চণ্ডীদাসের ভণিতায় মেলে ‘বাশুলী’ দেবীর নাম এবং ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে ‘বাসলী’ দেবীর উল্লেখ। এছাড়া গুরুতর প্রমাণ এই কাব্যের ভাষা। বাঁকুড়ার লোকভাষার আনুনাসিক ধ্বনির প্রাধান্য এবং এই অঞ্চলে প্রচলিত গড়া, চুক, মাকড়, ঝঁট, ভোক ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যেও পাওয়া যায়। কোনও কোনও গবেষক বাঁকুড়ার উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ তার প্রাচীন প্রয়োগ দেখিয়েছেন। তাছাড়া এই পুথিটিও পাওয়া গিয়েছে বাঁকুড়া থেকেই। এছাড়া তালশিক্ষার যে পুথিতে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কয়েকটি পদের আধুনিক রূপান্তর পাওয়া যায়, সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছে এই জেলাতেই।
বড়ু চণ্ডীদাস লোকরীতির কাব্য রচনা করলেও তিনি যে সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। যে অনায়াস দক্ষতায় ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং ''গীতগোবিন্দম্'' ও ''কুট্টিনীমতম্'' ইত্যাদি গ্রন্থের তথ্য কাব্যে ব্যবহার করেছেন এবং দেড় শতাধিক সংস্কৃত শ্লোক রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি প্রমাণিত হয়। ‘বড়ু’ শব্দটি থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন, কবি ব্রাহ্মণ ছিলেন। এটি ‘বটু’ শব্দ থেকেই আসতে পারে। বড়ু হলেন শ্রোত্রীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ। রজকিনী-ঘটিত জনশ্রুতিতে তিনি ব্রাহ্মণ বলেই কথিত। ছাতনার বাসলী আসলে খড়্গ-খর্পরধারিণী দক্ষিণাকালী। সেই সূত্রে কবিকে শাক্ত বলে গণ্য করাই সমীচীন। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ভাষা দেখে ভাষাতাত্ত্বিকেরা একে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের রচনা বলে শনাক্ত করেছেন। সম্ভবত বড়ু চণ্ডীদাস পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধেই আবির্ভূত হন।
===কাব্য পরিচয়===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক আখ্যানধর্মী কাব্য। ধ্রুপদি প্রেমকাহিনির মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিশেষত্ব-মণ্ডিত। রামসীতা বা হরপার্বতীর ন্যায় এই প্রেম স্বকীয়া বা বিবাহোত্তর প্রেম নয়, এই প্রেমের প্রকৃতি পরকীয়া। বস্তুত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাড়া আর কোথাও রাধাকৃষ্ণের স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ দেখানো হয়নি। লোক-ঐতিহ্যে রাধা কৃষ্ণের মাতুলানী। ফলে এই প্রেম নিয়ে অনেক মুখরোচক গালগল্প তৈরি হয়েছিল এক সময়ে। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে অবশ্য রাধা তত্ত্বে পরিণত। তখন তিনি কৃষ্ণের স্বকীয়া অন্তরঙ্গা শক্তি। হ্লাদিনীর সারভূত রূপ মহাভাব থেকে রাধার উৎপত্তি ব্যাখ্যাত। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাস প্রাক্-চৈতন্য যুগের কবি। রাধাকে তিনি চিত্রিত করেছেন প্রাকৃত রমণী রূপেই, কোনও আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আলোকে নয়। স্বীকার করে নিয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মাতুলানী-ভাগিনেয় সম্পর্ক। ফলে এই কাব্য লোকরঞ্জনকারী এক কাহিনিতে পর্যবসিত হয়েছে। এর ভাব, ভাষা, আঙ্গিক, পরিবেশ সবই গ্রামীণ। গ্রাম্য রুচির কাছে আত্মসমর্পণ করে পণ্ডিত কবি এই কাব্যে পুরাণকথা ও লোকশ্রুতির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তবে তাঁর মধ্যে প্রতিভার অভাব ছিল না। সেই প্রতিভায় রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির চরিত্র হয়ে উঠেছে সমুজ্জ্বল। ভাগবত পুরাণে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় না। জয়দেবই প্রথম রাধাকে নিয়ে বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেন। বড়ু চণ্ডীদাসের অন্যতম আদর্শ এই রচনা। তবে রাধা চরিত্র চিত্রণে তিনি যে প্রখর সমাজবাস্তবতা ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন, তা অনবদ্য। দেশীয় ভাষায় এইপ্রকার বৃহদায়তন প্রথম আখ্যানকাব্য রচনার কৃতিত্ব বড়ু চণ্ডীদাসেরই প্রাপ্য।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশ পাওয়া যায়নি। মাঝের কয়েকটি পাতাও অবলুপ্ত। পাওয়া গিয়েছে তেরোটি খণ্ডে বিন্যস্ত মোট ৪১৮টি পদ। কবি প্রথম বারোটি খণ্ডের নাম দিয়েছেন যথাক্রমে (১) জন্মখণ্ড, (২) তাম্বুলখণ্ড, (৩) দানখণ্ড, (৪) নৌকাখণ্ড, (৫) ভারখণ্ড, (৬) ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড, (৭) বৃন্দাবনখণ্ড, (৮) যমুনান্তর্গত কালীয়দমনখণ্ড, (৯) যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ড, (১০) যমুনান্তর্গত হারখণ্ড, (১১) বাণখণ্ড ও (১২) বংশীখণ্ড। ত্রয়োদশ খণ্ডটির শেষাংশ পাওয়া যায়নি বলে এই খণ্ডের কবিকৃত নামটি জানা যায় না। সম্পাদক বসন্তরঞ্জন এই খণ্ডের নামকরণ করেছেন ‘রাধাবিরহ’। তেরোটি খণ্ডে অখণ্ড সুস্পষ্ট একটি গল্প বলা হয়েছে। গল্প এগিয়েছে কবির বিবৃতি এবং আখ্যানের মুখ্য তিন চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। গল্পটি সংক্ষেপে এইরকম:
অত্যাচারী কংসের পীড়নে ব্যথিতা বসুন্ধরার আর্তিতে স্বর্গের দেবতারা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কংসের বিনাশের জন্য নারায়ণ ‘কৃষ্ণ’ নাম নিয়ে বসুদেবের গৃহে দেবকীর উদরে জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁর সম্ভোগের জন্য লক্ষ্মীও প্রেরিত হলেন রাধা রূপে। তার পিতা সাগর, মাতা পদুমা বা পদ্মা। দেবগণের ইচ্ছানুসারে রাধার স্বামী হলেন নপুংসক আইহন। বালিকাবধূ রাধার পরিচর্যার জন্য এলেন পদ্মার বুড়ি পিসি বড়ায়ি। গোপরমণী রাধাকে দুধ-দই বেচতে মথুরার হাটে যেতে হয়। একদা রাধা বড়ায়ির দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়। তার রূপ-গুণ বর্ণনা করে ব্রজের রাখাল নন্দগোপসুত কৃষ্ণের কাছে বড়ায়ি রাধার সন্ধান জানতে চাইল। সেই রূপের কথা শুনে কৃষ্ণের মনে রাধাসঙ্গের বাসনা জেগে উঠল। বড়ায়ির হাতে তাম্বুল অর্থাৎ পান দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব জানালেন কৃষ্ণ। কিন্তু বিবাহিতা রাধার মনে তখনও স্বামী-সংস্কার তীব্র। পরপুরুষের প্রতি বিরাগ সে ক্রুদ্ধ হয়ে তাম্বুলে লাথি মেরে বড়ায়িকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। অপমানিতা বড়ায়ি এসে কৃষ্ণের কাছে সব জানিয়ে এর প্রতিবিধান করতে বলল। দুজনে পরামর্শ করল, যমুনার ঘাটে কৃষ্ণ দানী সেজে বসবে এবং দানের ছলে দুধ-দই নষ্ট করবে, হার কেড়ে নেবে, কাঁচুলি ছিঁড়বে। পরামর্শ অনুযায়ী কুতঘাটে বসে রইল কৃষ্ণ। রাধা সখীদের নিয়ে এল সেই ঘাটে। কৃষ্ণ দানী হয়ে মহাদান চেয়ে বসল। শুধু পণ্যদ্রব্য পার করার কড়ি নয়, রাধার অঙ্গের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ কড়ি দাবি করল সে। কড়ি না দিলে দিতে হবে আলিঙ্গন। কিন্তু রাধার পক্ষে তা মেনে নেওয়া কখনই সম্ভব নয়। শুরু হল বাগবিতণ্ডা। রাধা কৃষ্ণকে নিবৃত্ত করতে চায় মাতুলানী সম্পর্কের কথা তুলে। কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য “নহসি মাউলানী রাধা সম্বন্ধে শালী”। কৃষ্ণ রাধাকে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেও রাধা সেসব বিস্মৃত। শেষে রাধার বাধাদান সত্ত্বেও কৃষ্ণ তার সঙ্গে বনের মধ্যে মিলিত হল। আবারও বড়ায়িয়ের কৌশলে রাধা এল যমুনার ঘাটে। একাকিনী রাধাকে যমুনা পার করার সময় কৃষ্ণ মাঝ-নদীতে ঝড় তুলে রাধার মনে ভীতি সঞ্চার করল। ভয়ার্ত রাধা বাঁচার জন্য কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হল। সেই সুযোগে নদীমধ্যে দুজনের মিলন ঘটল। এতদিনে রাধা বুঝতে পেরেছে কৃষ্ণের দুর্বলতা কোথায়। তাই সে এবার নিজেই অগ্রণী হয়ে মথুরার হাটের জন্য বড়োসড়ো পসরা সাজালো। মথুরার পথে যেতে কৃষ্ণকে ‘সুরতি’ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বইয়ে নিল দুধ-দইয়ের ভার। একইভাবে দেহলোভী কৃষ্ণকে দিয়ে প্রচণ্ড রোদে ছাতাও বহন করালো রাধা। অতঃপর বৃন্দাবনে মহাসমারোহে ঘটল বসন্তের আবির্ভাব। রাধা এবার আড়চোখে চেয়ে ও নানা অঙ্গভঙ্গি করে কৃষ্ণের কামনা জাগিয়ে তুলল। ষোলোশো গোপিনী সঙ্গে বিলাস সমাপ্ত করে কৃষ্ণ রাধার কাছে এসে দেখল সে অভিমানাহত হয়ে বিষণ্ণ মনে নীরবে বসে আছে। কৃষ্ণ মধুর বচনে রাধার মান ভাঙিয়ে লিপ্ত হল সঙ্গমে। রাসলীলায় কৃষ্ণের উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে জলক্রীড়ার কথা চিন্তা করে কালীদহের বিষাক্ত জল বিষমুক্ত করতে দহে নেমে পড়ল কৃষ্ণ। বিষের তীব্রতায় কৃষ্ণ অচৈতন্য হয়ে পড়লে নন্দ, যশোদা, বলরাম প্রমুখ আত্মীয়েরা বিলাপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণের বিপদ অনুমান করে যাবতীয় লোকলজ্জা ত্যাগ করে রাধা এবার সর্বসমক্ষে ‘পরাণপতি’ বলে কেঁদে উঠল। অবশেষে কালীয় নাগকে দমন করে কৃষ্ণ উঠে এল জল থেকে। একদিন রাধা সখীদের নিয়ে যমুনায় জল ভরতে এসে কৃষ্ণের সঙ্গে জলকেলিতে মত্ত হল। সেই সুযোগে কৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করল। রাধার অনুনয়ে কৃষ্ণ বস্ত্র ফিরিয়ে দিলেও তার বক্ষহারটি লুকিয়ে রাখল। হার না পেয়ে রাধা এবার গিয়ে অনুযোগ জানালো কৃষ্ণজননী যশোদার কাছে। যশোদা কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করলে অপমানিত কৃষ্ণ ফুলধনু দিয়ে রাধাকে বাণাহত করে মূর্চ্ছিত করল। কিন্তু এবার বড়ায়ি কৃষ্ণের আচরণে ক্ষুব্ধ হল। সে তিরস্কার করে রাধার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বলল। তখন কৃষ্ণের হস্তস্পর্শে রাধার চৈতন্য হল। পরিশেষে বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের পুনর্মিলন ঘটল। এখন আর কৃষ্ণের মনে রাধার প্রতি পূর্বের অদম্য আসক্তি কিছুই নেই। বরং শারীরিক মিলনে রাধার মনে জাগ্রত হয়েছে অপূর্ব সুখোন্মাদনা। সে এখন কৃষ্ণ-অন্তপ্রাণ। তার আর কোনও লজ্জা, ভয় বা সতীত্বের বন্ধন নেই। কৃষ্ণ এবার একটি সুন্দর মোহন বাঁশি গড়িয়ে কদমতলায় বসে একমনে বাজাতে থাকে। তার সেই বাঁশির সুর রাধার চিত্তকে বিপর্যস্ত করে দেয়। সে ঘর-সংসার ভোলে, তার গৃহকর্ম নষ্ট হয়, মনে মনে ভাবে “দাসী হআঁ তোর পাএ নিশিবোঁ আপনা”। বড়ায়িকে সে বারবার বলে কৃষ্ণকে তার কাছে এনে দিতে। বড়ায়ি বিপরীত কথা বলে রাধাকে নিরস্ত করতে চায়। কিন্তু রাধার মন কোনও যুক্তিতেই বশীভূত হয় না। তখন দুজনে মিলে কৃষ্ণের সন্ধানে বৃন্দাবনে যায়। সেখানে কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। রাতে শয্যায় শায়িত রাধার কানে কৃষ্ণের বাঁশির শব্দ এসে প্রবেশ করে। সে নিদ্রিত স্বামীকে ফেলে একাকিনী কৃষ্ণমিলনের উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে পথেই মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে রাধা। বড়ায়ি তার মূর্চ্ছাভঙ্গ করে পরামর্শ দেয় কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করতে। তাই-ই করে রাধা। বাঁশি বিহনে কৃষ্ণ ব্যাকুলভাবে বিলাপ করতে থাকে। অবশেষে বড়ায়ির মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ রাধার কাছে করজোড়ে মিনতি করলে রাধা বাঁশি ফিরিয়ে দেয়। রাধার সকল অপরাধ ক্ষমা করে কৃষ্ণ। বেশ কয়েক মাস কেটে গেলেও শর্ত অনুসারে কৃষ্ণ রাধাকে আর দেখা দেয় না। এবার কৃষ্ণ বিহনে রাধার মনে হতে থাকে “এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবই অসার”। সে বারবার বড়ায়িকে কৃষ্ণ এনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বড়ায়ি তাকে পরামর্শ দেয় কদমতলায় কিশলয় শয্যা রচনা করে প্রতীক্ষা করতে। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। অতঃপর তারা বৃন্দাবনে প্রবেশ করে গোচারণরত কৃষ্ণের দেখা পায়। রাধা তখন কাতরভাবে তার কাছে অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তবুও কৃষ্ণের মন গলে না। অবশেষে বড়ায়ির অনুরোধে কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলনে সম্মত হয়। বিহারের পর শ্রান্ত হয়ে কৃষ্ণের উরুতে মাথা রেখে রাধা ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণ বড়ায়িকে ডেকে তার হাতে রাধার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে মথুরায় চলে যায়। নিদ্রাভঙ্গের পর কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে রাধা। রাধার বিলাপে অস্থির হয়ে বড়ায়ি মথুরায় গিয়ে কৃষ্ণের কাছে রাধার কথা জানায়। কৃষ্ণের বক্তব্য, সে প্রগলভা রাধার কাছে যাবে না। তার মুখদর্শন করতেও সে ইচ্ছুক নয়। আর তাছাড়া সে মথুরায় এসেছে দুরাচারী কংশকে নাশ করতে। তার আর কোনওমতেই বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়া চলে না। এরপরই পুথি খণ্ডিত। যতদূর মনে হয়, কবি রাধা ও কৃষ্ণের বিচ্ছেদেই কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন।
মধ্যযুগীয় কাব্যে প্রক্ষিপ্তি একটি বড়ো সমস্যা। সাহিত্যের সব শাখাতেই কম-বেশি এটি দেখা যায়। যে যুগের লেখকের কর্তৃত্ব সঠিকভাবে চিহ্নিত হত না, সেই যুগে একের রচনায় অন্যের হস্তক্ষেপ স্থান পেয়ে যেত নির্বিরোধে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের প্রক্ষেপ নিয়ে প্রথম সংশয় জ্ঞাপন করেন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ‘বড়ু’ ও ‘বাসলী’-বিহীন ভণিতাগুলিকে তিনি অন্যের রচনা বলে মনে করেন। দানখণ্ডের তিনটি পদে ড. সুকুমার সেন প্রক্ষেপ দেখেছেন। আবার কেউ কেউ গায়েনের প্রক্ষেপ লক্ষ্য করেছেন কাব্যের নানা স্থানে। প্রখ্যাত সমালোচক বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, সমগ্র ‘রাধাবিরহ’ অংশটিই প্রক্ষিপ্ত। তিনি মোট ছয়টি যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু যুক্তিগুলি যে ততটা প্রমাণনির্ভর নয়, সে বিষয়ে একাধিক গবেষক প্রতি-যুক্তি দিয়েছেন। বিশেষত ‘রাধাবিরহ’ যে কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার প্রমাণ রয়েছে কাহিনির অভ্যন্তরীণ কাল-পরম্পরায়, কাব্যের গঠনে, রাধার বয়সের অগ্রহতির সাক্ষ্যে, চরিত্রের ক্রম-পরিণামে এবং অবশ্যই কবির ক্রমবিকশিত প্রতিভার স্তরোন্নয়নে। কাব্যের সূচনায় ‘এগার-বরিষ’-এর রাধা এখানে পূর্ণ যুবতীতে পরিণত, কামুক কৃষ্ণ এই পর্যায়ে ভোগতৃপ্ত হয়ে ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পর্যবসিত। কবি যে ক্রমশ ভাবগভীরতার পথে এগিয়ে এসেছেন, তার প্রমাণ আছে বংশীখণ্ডেই। এই খণ্ডেরই প্রত্যাশিত পরিণাম দেখা যায় ‘রাধাবিরহ’ অংশে। যে গীতিকাব্যিক মূর্চ্ছনার সূচনা হয়েছিল “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কূলে” ইত্যাদি পদে, তার সার্থক পরিণতি ঘটল “দিনের সুরুজ পোড়াআঁ মারে রাতিহো এ দুখ চান্দে” ইত্যাদিতে। রাধার চারিত্রিক বিবর্তনে সম্পূর্ণতা দেখানোর সূত্র ‘রাধাবিরহ’ এই কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য এক অঙ্গ। অন্য কোনও কবির হাত থেকে পূর্বের কাহিনি, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদির এতখানি সঙ্গতিপূর্ণ ধারাবাহিকতা আশা করা যায় না। অতএব কিছু ক্ষেত্রে মৃদু সংশয় থাকলেও কাব্যের অন্তর্বর্তী প্রমাণে ‘রাধাবিরহ’ যে মূল কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তা স্বীকার করে নেওয়া যায়। এই অংশটি না থাকলে বড়ু চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার সামগ্রিক মূর্তিটি অনুধাবন করা যেত না।
===গ্রন্থনাম বিচার===
চর্যাপদের পুথির গ্রন্থনাম নিয়ে যেমন বিতর্ক দেখে দিয়েছিল, তেমনই বিতর্ক দেখা দেয় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথির নামকরণকে কেন্দ্র করেও। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে চর্যাপদ সম্পর্কে একটি যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, পরবর্তীকালের কোনও গ্রন্থে এই কাব্যের নামোল্লেখও করা হয়নি। প্রকৃত সমস্যার সূত্রপাত আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশের পাতা না পাওয়ায়। বইয়ের সূচনায় এবং পুথির শেষে সমাপ্তিসূচক পুষ্পিকাতেই গ্রন্থনাম পাওয়া যায়। এই দুই অংশ না থাকায় পুথিটি থেকে আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন কোনও নাম পাননি। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। পূর্বাপর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রাচ্যতত্ত্ববিদ উইলসনের দেওয়া একটি ভ্রান্ত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নামকরণের বিষয়টি। তিনি গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি কর্তৃক যৌথভাবে রচিত ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে এক সংস্কৃত কাব্যের কথা জানিয়েছিলেন। সেই তথ্য প্রথম বিকৃত হয় জগদ্বন্ধু ভদ্রের ‘গোবিন্দদাস’ প্রবন্ধে (''বান্ধব'', শ্রাবণ ১২৮২ সংখ্যা)। তিনি লেখেন, “উইলসন সাহেব কৃত উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে লিখিত আছে যে, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাস উভয়ে মিলিত হইয়া কৃষ্ণকীর্তন প্রণয়ন করেন।” এই সংবাদই সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করেন রমণীমোহন মল্লিক, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য, ব্রজসুন্দর সান্যাল প্রমুখ প্রাবন্ধিকেরা। ক্রমে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামক কাল্পনিক গ্রন্থটির একক রচয়িতায় পরিণত হন চণ্ডীদাস। বড়ু চণ্ডীদাসের পুথি আবিষ্কৃত হওয়ার পর বসন্তরঞ্জনও ভেবেছিলেন যে, তিনি সেই হারিয়ে-যাওয়া বহুশ্রুত গ্রন্থটিই আবিষ্কার করেছেন। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে গ্রন্থটির নাম দেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এবং লেখকের নাম হিসেবে উল্লেখ করেন ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’। গ্রন্থপ্রকাশের এগারো বছর পরে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে গ্রন্থনাম নিয়ে প্রথম সংশয় প্রকাশ করেন রমেশ বসু। ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-য় প্রকাশিত ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রবন্ধে তিনি এও বলেন যে, “এই গ্রন্থ সংস্কৃত ও লৌকিক পুরাণের সমবায়ে গঠিত বলিয়া ইহাও পুরাণ আখ্যা পাইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। বাস্তবিকই বাঙ্গালায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক যদি কোন মৌলিক পুরাণ থাকে তাহা এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।” ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে ''বিশ্ববাণী'' পত্রিকায় দক্ষিণারঞ্জন ঘোষ ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামক আর-একটি প্রবন্ধে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামের কোনও ভিত্তি পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করে প্রশ্ন তোলেন, “শুধু বসন্তবাবুর ধারণা এবং শোনা কথার মূল্য কি?” চার বছর পরে নলিনীনাথ দাশগুপ্ত ''বিচিত্রা'' পত্রিকায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সামাজিক তথ্য’ প্রবন্ধে নানা দিক আলোচনা করে পুথিটির ''কৃষ্ণমঙ্গল'' নামকরণের পক্ষপাতী হন। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ''প্রবাসী'' পত্রিকায় ‘চণ্ডীদাস চরিত’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, “এক মস্ত ভুলও হয়ে গেছে, রাধাকৃষ্ণলীলার ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নাম হয়ে গেছে।” উপরিউক্ত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের ''প্রবাসী'' পত্রিকায় সম্পাদক বসন্তরঞ্জন লেখেন ‘চণ্ডীদাস চরিতে সংশয়’। সেখানে তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হন। কিন্তু তাঁর মত গবেষকদের মধ্যে ততটা গৃহীত হয়নি।
নামকরণের সমস্যাটি আরও জটিল হয় যখন ১৩৪২ বঙ্গাব্দে বসন্তরঞ্জন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণে পুথির মধ্যে প্রাপ্ত একটি চিরকুট প্রকাশ করেন। তাতে লেখা ছিল: “শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণঃ।। শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্বের ৯৫ পচানই পত্র হইতে একসও দস পত্র পর্য্যন্ত একুন ১৬ শোল পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চাননে শ্রীশ্রী মহারাজা হুজুরকে লইয়া গেলেন পুনশ্চ আনিয়া দিবেন—সন ১০৮৯”। প্রাচীন পুথির মধ্যে এই ধরনের রসিদ পাওয়ায় এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, রসিদটি উক্ত গ্রন্থ-সংক্রান্ত। ফলে নামকরণকে কেন্দ্র করে স্পষ্টত দুটি দল তৈরি হয়ে গেল। একদল পুথিটির ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নাম রাখার পক্ষপাতী, অন্য দলের মতে এর নাম হওয়া উচিত ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব''। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। এর পাশাপাশি অধ্যাপক সত্যব্রত দে ১৩৮৬-৮৭ বঙ্গাব্দের ''রবীন্দ্রভারতী পত্রিকা''-য় একটি কূটতর্ক তুললেন, “গ্রন্থটির সঠিক নাম কি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন না কৃষ্ণকীর্তন?... যে চারটি সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে বসন্তরঞ্জন চণ্ডীদাস-রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যের অস্তিত্বে দৃঢ়নিশ্চয় হয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকটিতেই গ্রন্থনাম কৃষ্ণকীর্তনরূপে লিখিত।”
নামকরণ সমস্যার নিরিখে কয়েকটি যুক্তি গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘কীর্তন’ শব্দটির অর্থ অনেক। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ''বঙ্গীয় শব্দকোষ''-এ ‘কীর্তন’ বলতে ঘোষণা, কথন, বর্ণন, বিবরণ, গুণকীর্তন, স্তবন ইত্যাদি অর্থ নির্দেশিত হয়েছে। ‘কীর্তন’ শব্দটির বৈষ্ণবীয় অর্থ-তাৎপর্য থেকে বের করে এনে যদি প্রয়োগ করা যায়, তাহলে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি অযোগ্য হয় না। যেহেতু উইলসন তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থের নামে ‘শ্রী’ শব্দটি যুক্ত করেননি এবং বাঙালি গবেষকেরাও ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামটিই উল্লেখ করেছেন, সেহেতু সত্যব্রত দে-র মতে বইটির নাম ''কৃষ্ণকীর্তন'' হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুক্তির গলদ হল এই যে, উইলসন যে সংস্কৃত ''কৃষ্ণকীর্তন''-এর কথা বলেছেন, তার লেখক গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি—চণ্ডীদাস নন। একটি ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এই মতটিকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন। ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামটিও এই প্রসঙ্গে বিচার্য। প্রাপ্ত রসিদটি আবিষ্কৃত পুথির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু সেই রসিদে বর্ণিত তথ্য যে উক্ত পুথি-সংক্রান্ত হবেই এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। রসিদে বলে হয়েছে যে, ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামক একটি পুথির ৯৫ থেকে ১১০ পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন নামে এক ব্যক্তি মহারাজের জন্য ধার করে নিয়ে গেলেন ১০৮৯ সালে অর্থাৎ ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর মাস দুয়েকের মধ্যেই পাতাগুলি ফেরৎ এল। ফেরৎ আসার পর খোয়া না যাওয়ার সম্ভাবনা, যেহেতু গ্রন্থাগারটিতে পুথি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা নেওয়া হত এবং যার প্রমাণ এই রসিদ। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ধার নেওয়া পাতাগুলির মধ্যে ৯৮/১ এবং ১০৪-১১০ পত্র অর্থাৎ মোট সাড়ে সাতটি পাতা নিখোঁজ। তাহলে অনুমান করতে হয়, অন্য কোনও পুথির ওই ১৬টি পত্র ধার নেওয়া হয়েছিল, যার রসিদটি কোনওভাবে চলে এসেছে এই পুথির মধ্যে। অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় এই ক্ষেত্রে অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, জীব গোস্বামী রচিত একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ''। এটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের একটি মূল্যবান গ্রন্থ। বিষ্ণুপুরে শ্রীনিবাস আচার্য রাজগুরু হিসেবে প্রভূত সম্মান পেয়েছিলেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। বৃন্দাবনের শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রীনিবাসের সাক্ষাৎ গুরু ছিলেন জীব গোস্বামী। বিষ্ণুপুরে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের গ্রন্থ প্রচারে একদা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন শ্রীনিবাস। ছোটো চিরকুটটির মধ্যে যে ‘আচার্য প্রভু’-র কথা আছে, তিনি এই শ্রীনিবাস আচার্য ছাড়া আর কেউ নন। তাই তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বিষ্ণুপুরের রাজা কোনও কারণে জীব গোস্বামীর ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ'' গ্রন্থেরই ১৬টি পাতা ধার নিয়েছিলেন এবং পরে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন। অতএব বসন্তরঞ্জনের প্রাপ্ত পুথিটির নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' হতে পারে না। তবু এই বিষয়ে কোনও পাথুরে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।
===পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা===
ভাগবতের কৃষ্ণকে অবলম্বন করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কাহিনি গড়ে উঠলেও এই কাব্যকে কোনও সমালোচকই অনুবাদ কাব্য বলে নির্দেশ করেননি। অথচ অনুবাদের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কৃত আদর্শ থেকে আখ্যানভাগ, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদি গৃহীত হয়ে থাকে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর কয়েকটি ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আসলে যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে অনুবাদ সাহিত্যের জন্ম বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত তার তাগিদ অনুভব করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক বৈষ্ণবধর্মের প্রতি তাঁর তেমন আনুগত্য ছিল না বলেই মনে হয়। ‘বাসুলী-সেবক’ অভিধাটিই চিনিয়ে দেয় তাঁর নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সেকালের শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বময় প্রেক্ষাপটে এই কাব্যকে উপদলীয় ধর্মবিদ্বেষের উৎসৃষ্টি বলে মনে হতেই পারে। কাব্যের নানা স্থানে তার প্রমাণও আছে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের নায়ক সম্পর্কে সকলেই প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে, এই কৃষ্ণ আদৌ বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা নন। পুরাণপুরুষ কৃষ্ণের আবরণে কবি আসলে প্রকাশ করেছেন নারীদেহ-লোলুপ এক ‘কামী’ গ্রাম্য গোপযুবককে, যে ছলনা, প্রতারণা ও বলপ্রয়োগ করে এক অনিচ্ছুক বিবাহিতা নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ‘গততৃষ্ণ’ হয়ে নির্দ্বিধায় তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমন অমানবিক পাশবিক চরিত্র দেবতার হতে পারে না। অর্বাচীন পুরাণে বর্ণিত রাধাও যেন রক্তমাংসের নারীতে পরিণত হয়েছেন এই কাব্যে, যার মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন ঘটেছে স্বামী-সংস্কারে আবদ্ধা কুলবধূ থেকে পরপুরুষের প্রেমসন্তপ্তা স্বাধীনভর্তৃকা প্রেমিকাতে। উল্লেখ্য, কবি একবারের জন্যও ‘দেবতা’ কৃষ্ণের কাছে প্রণত হচ্ছেন না, যেমন হয়েছিলেন তাঁর আদর্শ জয়দেব। পাঠক যেন তাঁর অঙ্কিত কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ স্ব-কল্পিত মনে না করে, তাই যেন কবি প্রচলিত পুরাণের সঙ্গে কৃষ্ণ চরিত্রের সম্পর্ক দেখিয়ে দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পুরাণ-বচন উদ্ধৃত করে কবি তাঁর বর্ণিত গল্পের সঙ্গে পৌরাণিকতার একটি প্রচ্ছন্ন যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। সেই সূত্রেই এসেছে ভাগবত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে সন্নিবেশিত নানা তথ্য। বিশেষ করে জন্মখণ্ড বর্ণনায় অনেকগুলি পুরাণ থেকে যে তিনি আখ্যানবস্তু আহরণ করে নিজের মতো করে সেগুলি বিন্যস্ত করেছেন তার প্রমাণ রয়েছে আখ্যান-বিন্যাসে। জন্মখণ্ডে কবি রচিত প্রথম সংস্কৃত শ্লোকটি হল:
<poem>
:: পৃথুভারব্যথাং পৃথ্বী কথয়ামাস নির্জ্জরান্।
:: ততঃ সরভসং দেবাঃ কংসধ্বংসে মনো দধুঃ।।
</poem>
এই প্রসঙ্গ বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ ও ভাগবত পুরাণেও আছে। তবে প্রত্যেকটি কাহিনিই কম-বেশি স্বতন্ত্র। যেমন, বিষ্ণুপুরাণে পৃথিবীকে বহুভারে পীড়িতা হয়ে সুমেরু পর্বতে দেবতাদের কাছে গিয়ে নিজের বেদনার কথা বিবৃত করতে দেখা যায়। পদ্মপুরাণে কংসের নিপীড়নের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। ভাগবত পুরাণে আছে বসুমতীর গোরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দুঃখ নিবেদনের সংবাদ। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে আছে দেবকীর সপ্তম পুত্রকে রোহিণীর গর্ভে মায়া দ্বারা সংক্রামিত করে অষ্টম গর্ভে নারায়ণের নিজে আবির্ভূত হওয়ার অঙ্গীকার। বড়ু চণ্ডীদাসও সেই তথ্য পরিবেশন করেছেন। এছাড়া নারায়ণ কর্তৃক দেবতাদের হস্তে কৃষ্ণ ও শুভ্রবর্ণের কেশ প্রদানের প্রসঙ্গও বিভিন্ন পুরাণ থেকে গৃহীত। অবশ্য এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, রাধার জন্মকাহিনি বর্ণনায় কবি পুরাণের পথ পরিহার করে স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। নারদের যে রূপ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অঙ্কিত হয়েছে, তারও উৎস কবির নিজস্ব কল্পনা। জন্মখণ্ড ছাড়া ভাগবতের স্পষ্ট প্রমাণ পড়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। ভাগবতে কথিত হয়েছে যে, ষোলো শত গোপিনী সঙ্গে কৃষ্ণ শরৎকালে একদা বিলাসে মত্ত হয়েছিলেন। এটি রাস নামে কথিত। বড়ু চণ্ডীদাসও এই কাহিনি অনুসরণ করেন। তাঁর রাধা এখন আর মিলনে অনিচ্ছুক নন। বরং বক্রদৃষ্টিতে ও বিচিত্র দেহভঙ্গিতে কৃষ্ণের কামনা উদ্রেক করতে যথেষ্ট পটিয়সী। অন্যান্য গোপিনী থাকা সত্ত্বেও রাধাতেই যেন কৃষ্ণের সফল তৃপ্তি। তবুও রাধার অনুরোধে সব সখীদের তৃপ্ত করার প্রতিশ্রুতির দেন কৃষ্ণ। অতঃপর বনের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়। ভাগবতেও আছে:
<poem>
:: অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বর।
:: যন্নো বিহায় গোবিন্দ প্রীত যামনয়দ্রহঃ।।
</poem>
তবে ভাগবতের ঘটনাক্রম অনুসরণ করেননি বড়ু চণ্ডীদাস। ভাগবতের রাস অনুষ্ঠিত হয়েছিল কংসবধের পরে, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ রাস হল কংসবধের পূর্বেই। তাছাড়া ভাগবতের রাস শরৎকালীন এবং নিশাকালে সম্পন্ন, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে দিবাকালীন বাসন্তী রাসের বর্ণনা। এক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জয়দেবের দ্বারা। ''গীতগোবিন্দম্''-এর দু-একটি পদের আক্ষরিক গীতানুবাদও রয়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। যেমন, “রতি তোর আশোআশেঁ গেলা অভিসারে” ইত্যাদি। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কৃষ্ণের বৃন্দাবন-বিলাস একান্তভাবেই ভাগবত-বর্ণিত রাতের অনুকরণজাত। ভাগবতের সঙ্গে এই কাব্যের মিল আছে কালীয়দমনখণ্ডের কাহিনিতেও। দুই গ্রন্থেই কালীদহের জলে নেমে কৃষ্ণ কর্তৃক কালীয়নাগ দমনের প্রসঙ্গ আছে। তবে বড়ু চণ্ডীদাস উদ্দেশ্যের ভিন্নতা দেখিয়েছেন। ভাগবতকার যেখানে কালীদহের বিষাক্ত জল বৃন্দাবনবাসীর ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য কৃষ্ণকে নাগদমনে নিয়োজিত করেছেন, সেখানে বড়ু চণ্ডীদাস দেখাতে চেয়েছেন যে, সখীদের নিয়ে জলক্রীড়ার করার জন্য কালীদহ বিষমুক্ত করতে কৃষ্ণ সেই জলাশয়ে ঝাঁপ দেন। অচৈতন্য কৃষ্ণের আত্মজ্ঞান ফেরানোর জন্য বলরামের দশাবতার স্তবের মধ্যে ক্রম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এই কাব্যে। বরাহপুরাণে কৃষ্ণের নাম আছে অষ্টম স্থানে, সেখানে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কাহিনির প্রয়োজনে তা সবশেষে উল্লিখিত। বস্ত্রহরণের প্রসঙ্গটিও ভাগবত থেকে নেওয়া। তবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বস্ত্রের সঙ্গে কৃষ্ণ রাধার হারও চুরি করে নেয় এবং সব কিছু ফিরিয়ে দিলেও হারটি নিজের কাছে রেখে দেয়। এই তথ্য ভাগবতে নেই। আখ্যানের বাইরেও পুরাণের প্রভাব আবিষ্কার করা যায় কবি কর্তৃক নানা পৌরাণিক প্রসঙ্গের অবতারণায়। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে উপমা ও উৎপ্রেক্ষা স্বরূপ এগুলি সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন তিনি। পরদারাসক্তির সমর্থনে কৃষ্ণের উক্তিতে এসেছে কুন্তী, রম্ভা ও গঙ্গার প্রসঙ্গ। এর বিপক্ষে রাধা উদাহরণ দিয়েছেন সোম-তারা, ইন্দ্র-অহল্যা ও চণ্ডী কর্তৃক সুন্দ-উপসুন্দ বধের। পুরাণশাস্ত্রে কবির পাণ্ডিত্যের প্রমাণ এগুলি। কিন্তু এইসব দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কৃষ্ণমাহাত্ম্যমূলক কাব্য নয়। পুরাণের পরিচিত গল্পকে আশ্রয় করে কবি এতে লৌকিক জীবনের পরিচয়ই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মৌলিকতা দেখিয়েছেন রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্র চিত্রণে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের তেরোটি খণ্ডের মধ্যে মোট চার-পাঁচটি খণ্ডে পুরাণের প্রভাব বাদ দিলে অবশিষ্ট খণ্ডগুলি কম-বেশি কবির স্ব-কল্পিত। বিশেষত তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড, ভারখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড পুরোপুরি কবির নিজস্ব উদ্ভাবনা। এগুলির কোনও সাহিত্যিক উৎস নেই। আখ্যান-সূত্রে বোঝা যায়, জন্মখণ্ডের পর কাহিনিকে কবি লোকসমাজের রুচি অনুযায়ী পরিবর্তিত করে নেন। দেবতাদের অনুরোধে কৃষ্ণ পৃথিবীতে আসেন বটে, তবে তাঁর মুখ্য কাজ কংসবধ আপাতত গৌণ হয়ে যায়, পরিবর্তে রাধার দেহসম্ভোগে তিনি মত্ত হয়ে ওঠেন। তার জন্য ছলনা, চাতুরী, কৌশল, বলপ্রয়োগ কোনও কিছুতেই দ্বিধা নেই তাঁর। লম্পট পুরুষের মতোই কৃষ্ণের হাবভাব, গ্রাম্য গোঁয়ারের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ তাঁর কথাবার্তা। জন্মখণ্ডের কর্তব্যপরায়ণ নারায়ণের সঙ্গে এই কৃষ্ণকে কোথাও মিলিয়ে নেওয়া যায় না। পাশাপাশি এটাও দেখা যায় যে, কবি কৃষ্ণকে পদ্মনাভ, চক্রপাণি, গদাধর ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে পুরাণের অনুসরণ করেছেন, আবার অন্যদিকে মগর-খাড়ু পরিয়ে, হাতে লগুড় ধরিয়ে গ্রাম্য যুবকে রূপান্তরিত করেছেন। এই বিষয়ে ড. সত্যবতী গিরি তাঁর ''বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ'' গ্রন্থে লিখেছেন, “গ্রামীণ সাধারণের রুচিকে পরিতৃপ্ত করার জন্যই কবি কৃষ্ণের এই গ্রাম্যরূপ অঙ্কন করেছেন। নিঃসন্দেহে এটিও কবির লোকমুখিতারই প্রমাণ।” (পৃ. ৬৫)
রাধার ক্ষেত্রে কবি অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। তার জন্মকাহিনি কোনও পুরাণকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠেনি। বস্তুত ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ কিংবা হরিবংশে রাধার উল্লেখও করা হয়নি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধা কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী, যা অন্য কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে দেখা যায় না। এই পুরাণে রাধার পিতামাতার পরিচয়ও আছে। তিনি বৃষভানু ও কলাবতীর কন্যা। আবার পদ্মপুরাণে রাধার মায়ের নাম কীর্তিকা বা কীর্তিদা। বড়ু চণ্ডীদাস এসবের সঙ্গে পরিচিত হয়েও এক নতুন সংবাদ দিলেন—কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্য দেবগণের নির্দেশে লক্ষ্মী রাধা হয়ে এলেন। তাঁর পিতা সাগর গোপ, মাতা পদ্মা। রাধাকে কবি প্রথমাবধিই আত্মবিস্মৃত করে রাখলেন। সেই সঙ্গে লৌকিক জনশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর বিবাহ দিলেন নপুংসক আইহনের সঙ্গে। ফলে কাহিনির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অবকাশ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে নাটকীয়তা। সতীত্ব-সংস্কারে বাঁধা বিবাহিতা রাধার সঙ্গে দেহলোভী কৃষ্ণের বাগবিতণ্ডা বেশ জমে উঠেছে। রাধার এই কৃষ্ণ-বিমুখতা কবির নিজস্ব কাব্যভাবনার ফসল। তাম্বুলখণ্ডে বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে কৃষ্ণের কামাসক্ত হওয়া এবং বড়ায়িকে দিয়ে তাম্বুল প্রেরণ, রাধা কর্তৃক বড়ায়ির অপমান এবং ক্রুদ্ধ বড়ায়ির কৃষ্ণকে রাধা-লাঞ্ছনার মন্ত্রণা দান কোনও পুরাণেই নেই। আসলে কবি জয়দেবের কাব্য থেকে রাধার পূর্ণায়ত ছবিটি গ্রহণ করলেও তাতে সামাজিকতার রং চড়িয়ে তাঁকে অনেক বেশি বাস্তবের নারী করে তুলেছেন। এই রাধার মধ্যে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, কামনা-বাসনা, রিরংসা, লোভ, দুঃখ-বেদনা সবই পুঞ্জীভূত হয়েছে। দানখণ্ডের আখ্যানেও দেখা যায়, কৃষ্ণের দানী সেজে বসা, মথুরার ঘাটে তর্ক করা, রাধার দই-দুধ নষ্ট করা, পরিশেষে তাঁর দেহসম্ভোগ পুরাণ-বহির্ভূত বিষয় হিসেবে কাহিনিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেছে। নৌকাখণ্ডে নৌকার মাঝি সেজে ছল করে রাধাকে সম্ভোগ করতে, ছত্রখণ্ড ও ভারখণ্ডে সঙ্গমলোভে দই-দুধের পসরা বহন করতে এবং রাধার মস্তকে ছত্রধারণ করতে দেখা যায় কৃষ্ণকে। হারখণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার হার চুরি, ক্ষুব্ধ রাধার যশোদার কাছে নালিশ, তিরষ্কৃত কৃষ্ণের বাণ মেরে রাধাকে মূর্চ্ছিত করা এবং বড়ায়ির ভর্ৎসনায় রাধার চেতনা সম্পাদন করাও কবির নিজস্ব কল্পনা। বংশীখণ্ডে বাঁশির শব্দে গৃহস্থালির কাজ-ভোলা রাধার ছবি অনবদ্য। এর জন্য কবির কোথাও কোনও ঋণ নেই। বড়ায়ির পরামর্শে রাধা যে কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে আবার ফিরিয়ে দেয় তারও কোনও প্রাচীন উৎস নেই। রাধাবিরহ অংশে বড়ায়িকে বারবার কৃষ্ণ এনে দেওয়ার অনুরোধ, এমনকি শেষ সম্ভোগের পর বড়ায়ির হাতে রাধাকে সমর্পণ করে কৃষ্ণের প্রস্থানও কবির স্ব-কল্পিত। এগুলির একটিও পুরাণ-বর্ণিত ঘটনা নয়। আর এই অংশগুলিতে অশ্লীলতা ও গ্রাম্যতা দোষেরও আধিক্য দেখা যায়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গটিও একটি বিচার্য বিষয়। মনে রাখতে হবে, এই কাব্য রাজসভার সাহিত্য নয়, গ্রাম্যের অখ্যাত অশিক্ষিত অপরিশীলিত সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যেই এর রচনা। যে পাশ্চাত্য প্রভাবজাত মার্জিত সাহিত্যবোধের আধুনিক পাঠক সাহিত্যকে বিচার করেন, পঞ্চদশ শতকের বাংলায় তার আবির্ভাব ঘটেনি। বরং ভারতীয় সাহিত্যের আদিরসকেই এই কাব্যে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন ভারতে যৌনতাকে বিশিষ্ট জ্ঞানশৃঙ্খলা হিসেবে পাঠ করার রীতি ছিল, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''। তাছাড়া ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের রতিই প্রথম ভাব, রসের আদিতে দাঁড়ায় শৃঙ্গার রস। কৃষ্ণের ন্যায় দেবচরিত্রে কলঙ্কের কথা যদি তোলা হয়, তাহলে বলতে হবে সমান দোষে দুষ্ট পুরাণকারও। তাঁরাও দেবরাজ ইন্দ্রকে অগম্যাগামী লম্পট পুরুষ রূপে চিত্রিত করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রতিবেশে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কাব্যে ধর্মের আবরণে আসলে কবি শুনিয়েছেন সমকালের জীবনকথা। রাধা ও কৃষ্ণের পৌরাণিক ঐতিহ্যমণ্ডিত নামগুলি সরিয়ে ফেলতে পারলেই সারা কাহিনিতে অনুভব করা যাবে পঞ্চদশ শতকের বাঙালি সমাজকে। তখন কৃষ্ণ আর ঐশী সত্তা থাকেন না, হয়ে পড়েন সামন্ততান্ত্রিক পুরুষ-শাসিত সমাজের ব্যভিচার-দুষ্ট পুরুষ, যে নারীকে লাঞ্ছিত করে কেড়ে নেয় তার নিজস্ব সম্পদ, সামাজিক বলদর্পিতায় পিষ্ট করে নারীর স্বাধীন সত্তা। বুঝতে অসুবিধাই হয় না, বড়ু চণ্ডীদাস আসলে তাঁর কালের ধৃষ্ট কামুক পুরুষ ও লাঞ্ছিতা নারীর কথাই বলতে চেয়েছেন তাঁর কাব্যে, কেবল কালের অনুরোধে তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছে ধর্মের আবরণ। ধর্মের এই অনাবশ্যক অংশটুকু বাদ দিলেই কৃষ্ণকথা পরিণত হতে পারত বিশুদ্ধ মানবকথায়, এবং বাঙালি পাঠক সেদিনই লাভ করতে পারত আধুনিক সাহিত্যের স্বাদ।
===চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি===
আখ্যানধর্মী সাহিত্যে চরিত্র এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাহিনি স্থূল ঘটনামাত্রের বিবরণ নয়, তার পিছনে থাকে পাত্রপাত্রীর সচেতন চিন্তা ও ক্রিয়া। চরিত্র বিবর্তিত হয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কখনও ঘটনা চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, কখনও চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে ঘটনাকে। এইভাবে তৈরি হয় দ্বন্দ্বময়তা, আখ্যানে আসে গতি। ঘটনা ও চরিত্রের আপেক্ষিক প্রাধান্য বিচার করলে দেখা যায়, মধ্যযুগের কবিরা ঘটনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, চরিত্রের অন্তঃরহস্য উদ্ঘাটনে ততটা যত্নবান হননি। অথচ চরিত্র-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তাঁদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হত, যেহেতু তাঁদের কাব্যের আখ্যানবৃত্ত ছিল পূর্বনির্ধারিত। অল্প যে কয়েকজন কবি এর ব্যতিক্রম বড়ু চণ্ডীদাস তাঁদের অন্যতম। আখ্যান-বিন্যাসে যেমন তিনি পুরাণকে অতিক্রম করে মৌলিকতার সাক্ষর রেখেছেন, তেমনই চরিত্রগুলিও তাঁর হাতে পেয়েছে অন্য মাত্রা।
====কৃষ্ণ====
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রটি সম্পর্কে শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ''মধ্যযুগের কবি ও কাব্য'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শ্রেষ্ঠত্বের সবটুকু আত্মসাৎ করিয়াছে রাধা। যাহার নাম কীর্তন করিতে কাব্যটির রচনা সেই শ্রীকৃষ্ণই উহার দোষের আশ্রয়। কাব্যটির যত কিছু দুর্নাম কৃষ্ণের জন্যই।” এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে দুটি কথা বলা যায়। প্রথমত, বড়ু চণ্ডীদাস যে কৃষ্ণের মাহাত্ম্যকীর্তনের জন্য কাব্য রচনা করেননি তার প্রমাণ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এই পাওয়া যায়। তাছাড়া এই কাব্যের নামকরণও যে কবিই করেছেন, তার কোনও উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, কাব্যের দোষ কাব্য-বর্ণিত কোনও চরিত্রের স্বভাব বা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না, করে অলংকারশাস্ত্রে কথিত নানা মানদণ্ডের উপরে। রসাভাসে বা অঙ্গীরসের পরিস্ফুটনে বাধা সৃষ্টি হলে কাব্যে দোষ দেখা যায়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এইসব ত্রুটি থেকে মুক্ত। আসলে এই কাব্যের কৃষ্ণ জয়দেবের ধীরললিত নায়ক কিংবা চৈতন্য-পরবর্তী যুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্বময় কৃষ্ণ নয় বলে পাঠকের অভ্যস্থ রসসিদ্ধ সংস্কারে আঘাত লাগে। এই কৃষ্ণ শাস্ত্রবর্ণিত দেবতা নয়, বরং কবির সমাজবোধ-প্রসূত রক্তমাংসের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে দেবত্বের মোড়কে তিনি তাঁর যুগের লম্পট মানবিকতাবোধশূন্য কামুক পুরুষকেই হাজির করেছেন কাব্যের কাঠামোয়। অর্থাৎ কৃষ্ণ চরিত্র চিত্রণে কবিকে দুই দিক সামলে চলতে হয়েছে। একদিকে তাঁকে রক্ষা করতে হয়েছে কৃষ্ণের প্রথাগত দেবতা এবং অনুদিকে তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে তাঁর সমকালের সাধারণ মানুষের বাস্তব আচরণকে। এইভাবে জোড়াতালি দিতে গিয়ে তিনি যে সব দিকে সঙ্গতি রক্ষা করতে পেরেছেন তা নয়, তবে তাঁর চেষ্টার মধ্যে যে আন্তরিকতা ও অভিনবত্ব ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জন্মখণ্ড থেকে রাধাবিরহ পর্যন্ত সর্বত্রই কৃষ্ণের উপস্থিতি। তবে প্রথম দিকে সেই উপস্থিতি যতটা সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ, শেষ দিকে তা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে কৃষ্ণকে অবলম্বন করে মুখ্যত রাধা চরিত্রেরই বিকাশ দেখিয়েছেন কবি।
জন্মখণ্ডের কৃষ্ণ ঐশী ভাবান্বিত এক পরম সত্তা। পুরাণপুরুষের আবির্ভাব কাহিনি এখানে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে পুরাণের অনুসরণ করেই। কৃষ্ণের প্রথাগত দেবত্ব রক্ষা করা হয়েছে পুতনা-বধ, যমলার্জুন ভঙ্গ ও কেশী দানব বিনাশের পৌরাণিক কাহিনির অবতারণায়।
ভাগবতের এই ঐশ্বর্যময় কৃষ্ণ তাম্বুলখণ্ডে এসে হঠাৎ প্রকৃতি বদল করে ফেলে। এখান থেকেই সে পরিপূর্ণ গ্রাম্য গোপযুবক। সে উদ্ধত, হঠকারী, একগুঁয়ে, হৃদয়হীন ও নারীদেহ-লোলুপ। ভূ-ভার হরণের জন্য যে তার আবির্ভাব সে কথা সে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে সে এক লালসাদীপ্ত কামুকে পরিণত। তার সমস্ত প্রচেষ্টার মধ্যে রাধাকে করায়ত্ত করার বাসনাই প্রকট। প্রথমে তাম্বুল প্রেরণ করে সে ভদ্রভাবে মিলনের প্রস্তাব জানায়, রাধা তা অপমান করে প্রত্যাখ্যান করলে সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেয় ছলে বলে কৌশলে করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়ে। এই দুটি খণ্ডে তো বটেই, ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডেও কৃষ্ণের দেবত্ব তলানিতে এসে ঠেকে যখন সে ‘সুরতি’ লাভের লোভে সমস্ত মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে রাধার দই-দুধের ভার বহন করে এবং তার মাথায় ছত্রধারণ করে।
বৃন্দাবনখণ্ডের কৃষ্ণ কিছুটা জয়দেব-অনুসারী, তবু কবি এখানে কৃষ্ণ চরিত্রে বিশিষ্টতা এনেছেন। জয়দেবের কাব্যভাষার অনুবাদ যেন কৃষ্ণের মুখে, “তোহ্মে সে মোহোর রতন ভূষণ তোহ্মে সে মোহোর জীবন”। আবার জয়দেবের কৃষ্ণ রাধাকে ত্যাগ করে অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে বিহার করলেও বড়ু চণ্ডীদাসের কৃষ্ণ রাধার অনুরোধে গোপিনীদের সঙ্গে বিহাররত।
কালীয়দমনখণ্ডে কবি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে নিয়ে যান পুরাণবৃত্তে। জলক্রীয়ায় ইচ্ছুক কৃষ্ণ বীরত্ব সহকারে বিষাক্ত জলে নেমে দর্পের সঙ্গে কালীয়নাগ দমন করে। ভাগবতের কাহিনি হলেও দুষ্ট কৃষ্ণের আর-এক রূপ পাওয়া যায় বস্ত্রহরণখণ্ডে। কবি গ্রাম্য আচরণে অভ্যস্থ যৌবনলোভী যুবকের ছবি এঁকেছেন এখানে। রাধার আকুতিতে তার বসন ফিরিয়ে দিলেও কৃষ্ণ হার গোপন রাখে। রাধা অভিযোগ জানান যশোদার কাছে। মায়ের কাছে ভর্ৎসিত কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে সে বাণখণ্ডে হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়ে রাধাকে বাণে সংজ্ঞাহীন করে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের এই পর্যায় থেকে দেখা যায়, রাধার প্রতি কৃষ্ণের পূর্বের আকর্ষণ প্রায় তিরোহিত। এর সঙ্গত কারণ কবি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। যে যৌন-আকাঙ্ক্ষা প্রথমাবধি কৃষ্ণকে চালিত করেছে, এখন তার পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে কৃষ্ণ রাধার প্রতি বিগতস্পৃহ হয়ে পড়েছে। ‘কামী’ কৃষ্ণ এখন ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পরিণত। তাই রাধার সামান্য অপরাধ সে ক্ষমা করতে পারে না। তুচ্ছ কারণে সে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না রাধার কাছ থেকে। কৃষ্ণের এই নির্মমতা সত্যই সমালোচনার যোগ্য। তাই দেখা যায়, যে বড়ায়ি এতদিন কৃষ্ণকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে রাধার সতীত্বের দর্প চূর্ণ করতে সাহায্য করেছে, এখন সেই বর্ষীয়সী অভিভাবিকাই তিরস্কার করছে ‘দেব বনমালী’ রাধাকে সংজ্ঞাহীন করে দিয়েছে বলে। বড়ায়ি ভর্ৎসনা না করলে কৃষ্ণ রাধার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনত কিনা সন্দেহ।
রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের এই শীতলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে। এতক্ষণ কৃষ্ণের আচরণ অভব্য ও অশালীন ছিল বটে, কিন্তু শিশুসুলভ ছিল না। কিন্তু বংশীখণ্ডে দেখা গেল পূর্বাপরসঙ্গতিবিহীন এক কৃষ্ণকে। সে নিস্পৃহ চিত্তে একাকী বৃন্দাবনে বসে বাঁশি বাজায়। সে বাঁশির শব্দে রাধার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণকে না পেয়ে বড়ায়ির পরামর্শে রাধা বাঁশি চুরি করে। বাঁশি না পেয়ে কৃষ্ণ অবোধ বালকের মতো কাঁদতে থাকে। শেষে বড়ায়ির বুদ্ধিতে করজোড়ে রাধা ও গোপীদের কাছে করুণ স্বরে বাঁশি ফেরৎ চায় সে। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণ চরিত্রের পূর্বের গাম্ভীর্যটুকু সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে এখানে।
রাধাবিরহেও কৃষ্ণ চরিত্র একই রকম সামঞ্জস্যহীন। রাধার বিষয়ে তার ক্রমবর্ধমান অনীহা খণ্ডটির প্রথম ও শেষ দিকে বজায় থাকলেও মধ্যাংশে, বিশেষত মিলনের পর, কৃষ্ণের আচরণ বিস্ময়করভাবে অন্য রকম। বড়ায়ির অনুরোধেই কৃষ্ণ মথুরা ছেড়ে বৃন্দাবনে এসেছে কেবল রাধার সঙ্গে মিলিত হতে। লক্ষণীয়, কৃষ্ণ এবার নিষ্ঠুর হয়েও পুরোপুরি নির্মম হতে পারেনি। মিলনকালে তো বটেই, মিলনের পরেও কৃষ্ণের কয়েকটি আচরণ বেশ অপ্রত্যাশিত। সে তৎক্ষণাৎ স্থান পরিত্যাগ করে না, রতিক্লান্ত সঙ্গিনীর পরিচর্যা করে:
<poem>
:: নব কিশলয়ত শয্যা রচিল।
:: নিজ উরুতলে তাক নিশ্চলে রাখিল।।
</poem>
নিদ্রিতা রাধার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্যও কৃষ্ণের কত আয়াস। মথুরায় যাওয়ার আগে বড়ায়ির হাতে রাধাকে অর্পণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে যায় সে। কামুক কৃষ্ণের এই হঠাৎ জেগে-ওঠা কর্তব্যবোধের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমগ্র ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কেবল এই অংশটুকুতে প্রেমিক কৃষ্ণ এক ঝলক উঁকি দিয়েই চিরতরে হারিয়ে যায়। গ্রন্থ শেষ হয়েছে রাধার প্রতি বিতৃষ্ণ কৃষ্ণের উক্তিতে:
<poem>
:: শতকী না কর বড়ায়ি বোঁলো মা তোহ্মরে।
:: জায়িতেঁ না ফুরে মন নাম শুণী তারে।।
:: যত দুখ দিল মোরে তোম্ভার গোচরে।
:: হেন মন কৈলোঁ আর না দেখিবোঁ তারে।।
</poem>
কৃষ্ণের এই হৃদয়হীন উক্তি ও আচরণ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কারণ, এ কাব্যে সে স্বর্গের দেবতা নয়, দেবতার খোলসে ঢাকা রক্তমাংসের কামতাড়িত দোষগুণান্বিত পার্থিব মানুষ।
====রাধা====
বড়ু চণ্ডীদাসের খ্যাতি মূলত তাঁর রাধা চরিত্রটির জন্য। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রাধা তত্ত্ব বা পুরাণ-সম্ভূত চরিত্র নয়, একজন সামান্যা নারী। কিন্তু সৃষ্টিকৌশলে সে হয়ে উঠেছে অসামান্যা। প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে রাধার নাম নেই; অর্বাচীন পুরাণেও তথ্যে নানা পার্থক্য দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস রাধার জন্মেতিহাস রচনা করেছেন নিজের মতো করে। বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী “কাহ্নাঞির সম্ভোগ কারণে” দেবতাদের নির্দেশে রাধা দেহ ধারণ করে মর্ত্যে আবির্ভূতা। কিন্তু স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কাব্যের দ্বন্দ্ব আকর্ষণীয় করতে কবি তাকে করেছেন আত্মবিস্মৃত। লোকশ্রুতিতে রাধা নপুংসক আইহনের পত্নী। সেই লোকশ্রুতি অনুসারেই কবি অল্পবয়সী বিবাহিতা রাধার দাম্পত্যজীবনের ছবি এঁকেছেন। সেই সূত্রে রাধার চারপাশে তৈরি হয়েছে একটি সামাজিক পরিচিতির বলয়, বাস্তব সংসারের রমণীর লৌকিক সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, রাগ-দেষ, আবেগ-আর্তি, বিশ্বাস-সংস্কার তার মধ্যে নিহিত। অথচ বড়ু চণ্ডীদাস যাঁর দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত সেই জয়দেবের কাব্যে রাধা কল্পলোকসম্ভব রোম্যান্টিক নায়িকার গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেনি। আসলে বাস্তব-সচেতন জীবনশিল্পীর চোখ দিয়েই কাব্যের চরিত্রকে দেখতে চেয়েছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস; কোনও তত্ত্ব, আবেগ বা ভাবাতিরেক তাঁকে চালনা করেনি। এইজন্য পদাবলির চণ্ডীদাসের রাধা কেবল কৃষ্ণনাম শ্রবণেই মিলনোৎকণ্ঠায় কালযাপন করেন, কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা সতীত্ব-সংস্কারের তাড়নায় প্রথমে কৃষ্ণের কুপ্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। রাধার এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কারণ কবি তাকে পঞ্চদশ শতকের বাংলার পুরুষশাসিত সমাজে স্থাপন করে তার সংকট, সীমাবদ্ধতা, আনন্দ, আবেগ, ক্রোধ, মোহ ইত্যাদিকে মূর্ত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। একজন দক্ষ মনস্তাত্ত্বিক শিল্পীর মতো এই চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনেও যত্নবান হয়েছেন তিনি। কৃষ্ণের অনাবৃত কামবাসনার সূত্রে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে যৌন-মনস্তত্ত্বও। এক রতি-অনভিজ্ঞা নারীর ক্রমশ দেহসুখের মধ্যে দিয়ে প্রেমের অমরাবতীতে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রাপথ চিত্রিত হয়েছে এখানে। প্রেম শিকড়হীন কল্পলতা বা নিরালম্ব কোনও মানসিক আবেগ নয়, তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে দেহভাবনা—এই বিশ্বাসে ভর করেই কবি রাধাকে রূপ দিয়েছেন, নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন তার সঙ্গতিপূর্ণ বিবর্তন।
বড়ু চণ্ডীদাস রাধার উদ্দেশ্যে যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন, তাতেই রাধার রূপলাবণ্যের কমনীয়তা ধরা পড়েছে। নাবালিকা কুলবধূ এই রাধা ‘শিরীষকুসুম কোঁঅলী’, ‘অদ্ভুত কনকপুতলী’ ও ‘তীনভুবনজন মোহিনী’। কিন্তু সাধারণ গোপরমণী হিসেবে সংসার নির্বাহ করতে মথুরার হাটে তাকে দই-দুধ বেচতে যেতে হয়। তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত বড়ায়ির। এই বড়ায়ির মুখে রাধার রূপলাবণ্যের কথা শুনে কৃষ্ণ তাম্বুল দিয়ে মিলনের প্রস্তাব জানালে সতীত্ব-সংস্কারে আবদ্ধা রাধা ক্ষিপ্ত হয়। বড়ায়িকে সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়:
<poem>
:: ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর আছে সুলক্ষণ দেহ।
:: নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা।।
</poem>
বীরপত্নী হওয়ার গর্বও তার কম নয়। সে বড়ায়িকে প্রহার করে তাম্বুলে লাথি মেরে প্রকারান্তরে কৃষ্ণকেও অপমান করে। বস্তুত দেহ-মনের দুর্বলতাহীন এই সতীত্ববোধ ভারতীয় নারীর চিরকালের সম্পদ। রাধার আত্মমর্যাদাপূর্ণ বলিষ্ঠ ঘোষণা তাকে স্বতন্ত্র নারীব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। কিন্তু যে সমাজ স্বৈরাচারী পুরুষের অধীনে, সেই সমাজে নারীর এই স্বাধীন অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। রাধার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কৃষ্ণে একে কামাতুর, তার উপর সামান্য নাবালিকা কর্তৃক অপমানিত। লাঞ্ছিতা বড়ায়িও তারই পক্ষে। অতএব দানখণ্ডে প্রবল তর্কাতর্কির পর কৃষ্ণের গায়ের জোরের কাছে সহজেই হার হয় রাধার। মথুরার ঘাটে কপট দানী কৃষ্ণ জোর করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়। মিলনের পূর্বে সে কৃষ্ণকে বারবার সাবধান করে দেয় যেন তার অঙ্গসজ্জা নষ্ট না হয়। অর্থাৎ এই মিলনকে সে গোপন রাখতে চায়। নৌকাখণ্ডে আবার ছলনাময় কৃষ্ণের ফাঁদে ধরা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয় রাধাকে। তবে এবার ভয় ও লজ্জা মিশ্রিত এক আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার মনে। অনিচ্ছা ও ক্ষীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাধার মনে কোথাও যেন মিলনসুখের অঙ্কুর দেখা দেয়: “রাধার মনত তবেঁ জাগিল মদন”। তাই এবারের মিলনের কথা রাধা গোপন করে বড়ায়ির কাছে, কৃষ্ণের অত্যাচারের কথা চেপে গিয়ে বরং তার উপকারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে:
<poem>
:: ডুবিআঁ মরিতোঁ যবেঁ না থাকিত কাহ্নে।
:: আত্মা লআঁ সান্তরিআঁ রাখিল পরাণে।।
:: এবার কাহ্নাঞিঁ বড় কৈল উপকার।
:: জরমেঁ সুঝিতেঁ নারোঁ এ গুণ তাহার।।
</poem>
এখন থেকে রাধা কৃষ্ণের কাছে তার মূল্য বোধে, অনুমান করতে পারে কৃষ্ণের দুর্বলতাও। সেই অভিজ্ঞতাকেই রাধা এবার দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডে। ‘সুরতি’ দানের লোভ দেখিয়ে ভার ও ছত্র বহন করায় বটে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রত্যাশা পূরণ করে না। আবার এটাও লক্ষণীয় যে, এক নপুংসকের স্ত্রী হিসেবে উদ্ভিন্নযৌবনা রাধার মধ্যে পরপুরুষের দেহসম্বন্ধের ফলে জাত কামবাসনা পরিতৃপ্তির জন্য অন্য কোনও বৈধ পথও খোলা নেই। অতএব নৌকাখণ্ডে অঙ্কুরিত দেহচেতনা এবার বৃন্দাবনখণ্ডে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। কৃষ্ণ নয়, এবার রাধা নিজেই মিলনাকাঙ্ক্ষী হয়ে বড়ায়ির কাছে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। এমনকি বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্য শাশুড়ির অনুমতি লাভে নতুন কৌশল ফাঁদে। কৃষ্ণ অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে বিহার করলে রাধার মনে মানের উদয় হয়। প্রেমে অধিকারবোধ না জন্মালে তথা প্রেম পরিপক্ক না হলে এই মান বা ঈর্ষা জাগ্রত হওয়া সম্ভব নয়। কালীয়দমনখণ্ডে আরও একধাপ এগিয়ে যায় রাধা। কৃষ্ণ মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লে আতঙ্কিত রাধা সর্বসমক্ষে ‘পরাণ পতী’ বলে উল্লেখ করে; কৃষ্ণবিহনে যে তার ধন-জন, জীবন-যৌবন সবই বিফল সে-কথাও জানায় বিলাপের কালে।
পরবর্তী দুই খণ্ডে অবশ্য রাধা চরিত্র একটু খাপছাড়া। কেউ কেউ একে “মানের এক এক পর্যায়” বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু হারখণ্ডে যশোদার কাছে রাধার নালিশ জানানোর ঘটনাটিকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। সম্ভবত কাহিনির প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চরিত্রাঙ্কন করতে গিয়েই এই ত্রুটি ঘটেছে। যাই হোক, যশোদা কর্তৃক তিরস্কৃত কৃষ্ণ এবার নির্মম হয়ে ওঠে এবং পূর্বসম্বন্ধ একপ্রকার বিস্মৃত হয়েই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফুলশর দিয়ে রাধাকে মূর্চ্ছিত করে। পরবর্তী দুই খণ্ডে যে মিলন-ব্যাকুল রাধাকে দেখা যায়, সেও এই পুষ্পধনুর অদৃশ্য প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে। কারণ, এর আগে রাধাকে এতটা বিহ্বল হতে দেখা যায়নি। এবার তার দ্বিধা, সংকোচ, জড়তা কিছুই নেই। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বংশীখণ্ডের ও রাধাবিরহের রাধা তীব্রভাবে দেহবাসনাকেই তুলে ধরেছে। কৃষ্ণের মোহনবাঁশির স্বর তাকে উন্মনা করে, মিলনে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু কোথাও প্রিয়তমকে না পেয়ে সুযোগ বুঝে বাঁশি লুকিয়ে রেখে মনের যন্ত্রণা লাঘব করতে চায় সে। আবার কৃষ্ণের আকুল অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাঁশি ফেরৎ দিতেও সে দ্বিধা করে না।
রাধাবিরহের অধিকাংশ পদেই ক্রন্দনরতা রাধার বিরহের দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রাধাবিরহ অংশে রাধার যে বেদনা তাহা নিতান্ত ব্যক্তিগত বেদনা নয়। বেদনার সুর ব্যক্তিকে অতিক্রম করিয়া সর্বকালের সর্বদেশের বিরহ-বেদনার সুরের সহিত মিলিত হইয়াছে।” এই রাধার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে পদাবলির ভাবতন্ময়া পূর্বরাগাশ্রিতা রাধার। কিন্তু এই পর্যায়েও রাধার আবেগ দেহকে অতিক্রম করে অপার্থিব প্রেমের পথে অগ্রসর হতে পারেনি। প্রমাণ বড়ায়ির উক্তি, কৃষ্ণের বিদ্রূপ এবং রাধার নিজের আক্ষেপ। রাধা যখন বারবার কাতর হয়ে কৃষ্ণকে এনে দেওয়ার অনুরোধ জানায়, তখন অভিজ্ঞা বৃদ্ধা বড়ায়ি তার এই সুগভীর আর্তির পিছনে কিসের উত্তেজনা তা বুঝতে পারে। একদিন যে কৃষ্ণের মিলন-প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, এখন তাকে আঘাত দিয়ে বড়ায়ি বলে:
<poem>
:: এবেঁ ঘুসঘুসাআঁ পোড়ে তোর মন।
:: পোটলী বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন।।
</poem>
রাধা বড়ায়ির কাছে যে কথা জানিয়ে কৃষ্ণকে আনার অনুরোধ করেছে সেগুলির মধ্যে কয়েকটি এইরকম: "আয়িস ল বড়ায়ি রাখহ পরাণ সহিতেঁ নারোঁ মনমথবাণ।।", "ঝাঁট করি কাহ্নাঞিঁ আনাওঁ। রতি সুখে রজনী পোহাওঁ।।", "পীন কঠিন উচ তনে কাহ্নাঞি পাইলেঁ দিবোঁ আলিঙ্গনে।।", "উন্নত যৌবন মোর দিনে দিনে শেষ"। এগুলি কামোন্মত্ত বিহ্বল দেহসুখপ্রত্যাশী নারীর কথা, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। রাধাবিরহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পদে ‘যৌবন’, ‘মনমথ’ ও ‘সুরতী’ শব্দ তিনটি বারবার ব্যবহার করে কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্জলা দেহকামনা কেমন করে বেষ্টন করে আছে যুবতী রাধাকে। রাধার অনুরোধে বড়ায়ি গিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ে এলে সে যেভাবে রাধার সঙ্গে বাক্যবিনিময় করেছে, তাতে দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার মদনপীড়াটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। নইলে সে বিদ্রূপ করে নপুংসক আইহনের কথা তুলে বলত না, “ঘরে গিআঁ সেব তোহ্মে আইহন পতী”।
কিন্তু শেষপর্যন্ত বহু অনুরোধে একবার মিলন এবং চিরজীবনের জন্য নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কিছুই জোটে না রাধার। এই সমাজের নারীভাগ্যই যেন রাধার এক দুঃখময় জীবনবৃত্তে প্রতিবিম্বিত। ড. সত্যবতী গিরি তাই লিখেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের কামনার বলিমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।... তার মন যখন পারিবারিক ও সামাজি পরিবেশের প্রথাবদ্ধ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্বের অবস্থানে আনন্দিত, তখন নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য এক পুরুষ তার অনিচ্ছুক শরীরের উপর বলাৎকার করেছে। আর সেই কারণেই সরল সুস্থ নারীর মন ও শরীর দুই-ই যখন সেই পুরুষকে পাওয়ার জন্য আকুল, তখন সে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত।... অনিচ্ছুক বা ইচ্ছুক রাধার উভয় প্রান্তই এই সমাজে নারীভাগ্যের সীমানা। কৃষ্ণের হাতে আত্মসমর্পণের অনিচ্ছা প্রকাশে সে বিদ্রোহিনী, আবার আত্মনিবেদনে ইচ্ছুক রাধাও সামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহিনী। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই তার বিদ্রোহ সফল নয়। সে সামন্ত-শাসিত বাঙালি সমাজের প্রথম নতজানু বিদ্রোহিনী।”
====বড়ায়ি====
রূপ গোস্বামী তাঁর ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলায় সহায়িকা সখীর ভূমিকা বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর বড়ায়ির আবির্ভাব সেই গ্রন্থের অনেক পূর্বে। অবশ্য ''গীতগোবিন্দম্''-এ নাগরিক রুচিসম্পন্না সখীদের দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস গ্রামীণ পটভূমির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সখীর বিকল্পে এনেছেন বড়ায়িকে। সে একাধারে দূতী, সখী ও অভিভাবিকা। এই তিন ভূমিকার সমাহারে বড়ায়ি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় চরিত্র। দামোদর গুপ্তের ''কুট্টিনীমতম্'' অথবা বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''-এ নিসৃষ্টার্থা দূতীর ধারণা পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের বড়ায়ি অবশ্য কবির দেখা গ্রাম্য কুট্টিনী, যারা সেকালে এই জাতীয় গোপন সম্পর্ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিল। বহু পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্রের ''নীলদর্পণ'' নাটকের পদী ময়রাণীর চরিত্রেও এই-জাতীয় চরিত্রের ছায়া দেখা যায়। তাই অনুমান করা যায়, একদা গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের বয়স্কা রমণীদের দেখা যেয়, যারা অর্থের বিনিময়ে অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ঘটাতো অথবা কামুক পুরুষের কাছে এনে দিত তার আকাঙ্ক্ষিতা নারীকে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে বড়ায়ির একটি সামাজিক পরিচয় আছে। সে রাধার মায়ের পিসি। সেই অর্থে সম্পর্কে রাধার দিদিমা বা বড়-আয়ি। সেই থেকেই সম্ভবত ‘বড়ায়ি’ নামটি এসেছে। তার বেশভূষা, চেহারা ও অঙ্গভঙ্গি বর্ণনায় কবি বেশ হাস্যরস সঞ্চারিত করেছেন। রাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইহন-জননী তাকে নিয়ে এসেছে রাধার পিত্রালয় থেকে। তার কাজ নাবালিকা বধূর পরিচর্যা, মথুরার হাটে নিয়ে যাওয়া এবং সর্বক্ষণ তার সঙ্গ দেওয়া। একবার বনপথে রাধা চোখের আড়ালে চলে গেলে ‘গরু রাখোলা’ কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপবর্ণনা করে সে তার হদিশ জানতে চায়। সে-কথা শুনে ‘কামী’ কৃষ্ণ রাধার রূপে আকৃষ্ট হয়ে এবং বড়ায়ির হাতে তাম্বুল প্রেরণ করে। বড়ায়ি যে দূতীগিরিতে নিপুণা ও সফল তার উল্লেখ আছে বড়ায়ির নিজের উক্তিতেই। কিন্তু সেই সাফল্যে সম্ভবত প্রথম আঘাত রাধার অস্বীকৃতি। শুধু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান নয়, বড়ায়িকে মাটিতে ফেলে প্রহার করে রাধা। বড়ায়ির মনে জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। কৃষ্ণই হয়ে ওঠে তার অবলম্বন। পরবর্তী দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড প্রভৃতি অংশের প্রত্যেকটিতেই তাই বড়ায়ি কৃষ্ণের পক্ষাবলম্বী হয়েছে নাবালিকার দর্পচূর্ণ করতে।
কিন্তু বড়ায়ি কেন এহেন অসামাজিক সম্পর্কের প্রস্তাব নিয়ে আসতে রাজি হয়েছিল সেটিও বিবেচ্য। একজন সমালোচকের মতে, নপুংসক-পত্নী রাধার বিড়ম্বিত জীবনের প্রতি ছিল বড়ায়ির গভীর সমবেদনা। রতিসুখ-বঞ্চিয়া নারীর শুষ্ক জীবনকে পূর্ণ ও সরস করার অভিলাষেই সে সম্মত হয়েছিল কৃষ্ণের অশালীন প্রস্তাবে। তাই দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে রাধার করা অমপানের প্রতিশোধ নিলেও বৃন্দাবনখণ্ডে এগিয়ে আসে রাধাকে সাহায্য করতে। দেহসুখ-বাসনায় উদ্বেল রাধার শাশুড়ির কাছ থেকে বাক্-কৌশলে সে অনুমতি আদায় করে। আবার বাণখণ্ডে কৃষ্ণ রাধাকে বাণের আঘাতে মূর্চ্ছিত করলে বড়ায়ি কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করে। এই ঘটনা থেকে বড়ায়ি চরিত্রের আর-একটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মধ্যে নিরপেক্ষতাবোধও দুর্লভ নয়। রাধা ও কৃষ্ণ দুজনেই তাঁর স্নেহভাজন। ফলে যাকে যখন বঞ্চিত বা পীড়িত বলে মনে হয়েছে বড়ায়ি নির্দ্বিধায় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার মনোব্যথা লঘু করার ক্ষেত্রে বড়ায়ির ভূমিকা অনবদ্য। এই পর্যায়ের বড়ায়ি যেন ''গীতগোবিন্দম্''-এর সহায়িকা সখী। কখনও সে নানা যুক্তিতর্কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, কখন বাঁশি চুরি করার পরামর্শ দেয়, কখনও রাধার আর্তিতে বিগলিত হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হয়, কখনও মূর্চ্ছিতা রাধার চেতনা ফিরিয়ে আনতে তার সুশ্রুষা করে, আবার কখনও মথুরায় গিয়ে আহ্বান করে কৃষ্ণকে। এখন রাধার যাবতীয় দুঃখ-নিবেদনের আধার হয় বড়ায়ি। কৃষ্ণও তার মনের ক্ষোভ ব্যক্ত করে এই বড়ায়ির কাছেই। সে রাধার দেওয়া অপমান ভুলতে পারছে না, আর তার রাধাতে আসক্তি নেই। কেবল বড়ায়ির অনুরোধেই সে শেষবারের মতো বৃন্দাবনে এসে মিলিত হয় রাধার সঙ্গে। সম্ভোগের পর নিদ্রিতা রাধার প্রতি যত্ন নিতে বলে যায় বড়ায়িকে। বড়ায়ি তাই কেবল দূতী বা সখী নয়, একই সঙ্গে সে কর্তব্যপরায়ণা অভিভাবিকাও।
সমগ্র আখ্যান থেকে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম-সংঘটনের ক্ষেত্রে বড়ায়ির সক্রিয়তাই সর্বাধিক।। দুই পক্ষের মধ্যে যখনই কোনও সংকট, অনীহা, দ্বন্দ্ব, ভুল-বোঝাবুঝি উপস্থিত হয়েছে, বড়ায়ি তখন তার কূটবুদ্ধি, অভিভাবিকা-সুলভ পরামর্শ, সখীসুলভ সহমর্মিতা, পরিজনতুল্য স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছে। এই বড়ায়ি যেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রধান পরিচালক। লৌকিক প্রেমের কাব্যে কবির উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধ মানবরস পরিবেশন। তাই অলংকারশাস্ত্রে কথিত নিষ্প্রাণ কুট্টিনী চরিত্র নয়, কবি নিজ কল্পনার গুণে বড়ায়িকে করে তুলেছেন রক্তমাংসের এমন এক জীবন্ত মানুষ, যার মধ্যে আত্মগর্ব, প্রতিহিংসা-পরায়ণতা, বুদ্ধির প্রখরতা, বিপুল চরিত্রাভিজ্ঞতা সবই আছে, সেই সঙ্গে আছে পীড়িত ও বঞ্চিতের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধও। গোড়ার দিকে ‘কুটিল’, ‘কপটকুশলা’ বিশেষণে ভূষিতা এই বৃদ্ধা তাই অনায়াসেই হয়ে উঠেছে এক গভীর ব্যঞ্জনাময় চরিত্র। এই অনন্য চরিত্রের অনুকরণ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি।
===কাব্যাঙ্গিক===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সংরূপগত শ্রেণিবিচার সম্বন্ধেও মতানৈক্য আছে। Genre বা সংরূপ হল কোনও নির্দিষ্ট শিল্পাঙ্গিক, যা সাহিত্যকর্মকে একটি শ্রেণি থেকে আর-একটি শ্রেণিতে পৃথক করতে সমর্থ হয়। সব রচনা সমানভাবে রূপপ্রাপ্ত হয় না। তাই ভাবের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকলেও কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প ইত্যাদি সাহিত্যপ্রকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন আস্বাদন অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। প্রত্যেকটি আঙ্গিকেরই স্বতন্ত্র মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলির আবির্ভাবও বিশেষ বিশেষ সময়ে পৃথক পৃথক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে থাকে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর গোত্রনির্ণয়ে প্রায় সকল সমালোচককেই থমকে যেতে হয়েছে। কারণ, এই রচনা কোনও একটি বিশেষ সংরূপের বৈশিষ্ট্য আত্মীকরণ করে আবির্ভূত হয়নি। বরং এর মধ্যে লক্ষিত হয়েছে মিশ্র রূপের সমাবেশ। এটা খুবই নিশ্চিত যে, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানমূলক রচনা ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। ‘কাব্য’ হিসেবেই এর পরিচিতি সর্বাধিক। কিন্তু বাংলা ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাসের কোনও আদর্শ ছিল কিনা, অন্তত পরবর্তীকালের আবিষ্কৃত গ্রন্থাবলির মধ্যে তার কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায় না। তবে জয়দেবের ''গীতগোবিন্দম্''-এর কাছে তিনি যে বিষয়-ভাবনা ও আঙ্গিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ঋণী তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বস্তুত শিল্পাঙ্গিক হিসেবে জয়দেবের রচনাটি ছিল অভিনব। যতদূর সম্ভব তিনি লোকনাট্যের রীতি অনুসরণে গীতিনাট্যের পালা রচনা করেছিলেন। এই সংরূপটিকে জয়দেব নির্দেশ করেছিলেন ‘গীতপ্রবন্ধম্’ বলে। কিন্তু কেবল গান নয়, সঙ্গে কবির বর্ণনা এবং ঘটনাশ্রিত পাত্রপাত্রীদের উক্তি-প্রত্যুক্তিও গ্রথিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। সব মিলিয়ে ''গীতগোবিন্দম্'' এক বিচিত্র শ্রেণির গ্রন্থ, যা সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যেই দুর্লভ। অনুপুঙ্ক্ষ বিচার করলে দেখা যায়, বড়ু চণ্ডীদাসের রচনাতেও সেই আখ্যান-বিবৃতি, নাটকীয়তা ও গীতিধর্মিতার সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।
বড়ু চণ্ডীদাস মুখ্যত ভাগবতীয় কাহিনির প্রসিদ্ধ কাঠামোয় তাঁর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-আখ্যানটিকে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরাগমন পর্যন্ত বৃন্দাবনের ঘটনাগুলিই এতে বিবৃত। অথচ বিবরণের প্রচলিত বর্ণনাত্মক পদ্ধতিকে একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে না নিয়ে তিনি বৈচিত্র্য এনেছেন নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। নাটক সংলাপ-নির্ভর একটি স্বতন্ত্র সংরূপ, যা অখণ্ড সমগ্রতায় বিধৃত হয়। নাটকের প্রাণ হল দ্বন্দ্ব। তীব্র গতিতে তা প্রার্থিত পরিণামের দিকে ছুটে চলে। নাটকের প্রধান গুণ বাস্তবধর্মিতা। এর চরিত্রগুলি যত বেশি রক্তমাংসের হয়, ততই সাহিত্য হিসেবে নাটক দর্শকের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর তেরোটি খণ্ডে আখ্যান যেভাবে এগিয়েছে তাতে যথেষ্ট নাটকীয় উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। জন্মখণ্ডের বিবরণটিকে ধরা যেতে পারে সংস্কৃত নাটকের সূচক বা প্রস্তাবনার মতো, যেখানে নাটকের মুখ্য কুশীলবদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর দীর্ঘ বারোটি খণ্ড জুড়ে তাদেরই নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, মানসিক সংকট, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও বিচিত্র প্রকার ভাব ও আবেগের বিস্তার। প্রতিটি খণ্ড এমনভাবে স্থান ও কালের পরম্পরায় সজ্জিত যে, প্রত্যেকটিকে একটি ঘটমান নাট্যবৃত্তের ক্রমিক দৃশ্যায়ন বলে মনে হওয়াও সম্ভব। ঘটনার সঙ্গে উত্থান-পতনে নাটকীয় চরিত্রগুলির যে বিবর্তন ঘটে এখানে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে সে অপেক্ষিত মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তিটি বড়ু চণ্ডীদাস তুলে ধরেছেন রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রে। মিহির চৌধুরী কামিল্যা তাঁর সম্পাদিত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি নাবালিকা, যে দেহজ মিলন সম্পর্কে অনভিজ্ঞা, পরপুরুষ সম্পর্কে প্রচণ্ড ভীতা, আত্মসম্ভমময়ী এবং নিজের স্বামীকুল, পিতৃকুল সম্পর্কে গর্বিতা, সেই একাদশবর্ষীয়া বালিকা এক নির্লজ্জ, কামাতুর, গ্রাম্য গোপবালকের বারংবার অবৈধ পীড়নে কেমন করে ধীরে ধীরে মর্মদাহী যন্ত্রণার ভিতর দিয়া পীড়নকারীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো, বড়ু চণ্ডীদাস তার একটি উপভোগ্য কাহিনী নির্মাণ করেছেন।” (পৃ. ৫৬) তাম্বুলখণ্ডের স্বামী-গর্বিতা যে নারী একদা বলেছিল, “নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা”, সেই স্বীয় অবস্থানে সানন্দিতা সুস্থিতা পূর্ণযুবতীকে দিয়ে আখ্যানের শেষে কবি বলিয়ে নেন:
<poem>
:: ধরন না জাএ বড়ায়ি আহ্মার যৌবন।
:: প্রাণ রাখি আনি দেহ নান্দের নন্দন।।
</poem>
চরিত্রের এই বিবর্তন অনেকগুলি ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটেছে। কবি নাট্যকার-সুলভ দক্ষতায় সমগ্র বৃত্তের মধ্যে সেই কার্য-কারণ সম্পর্ক রক্ষা করে প্রার্থিত পরিণামের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে কৃষ্ণ চরিত্রটিকে প্রথম থেকেই করে তুলেছেন নারীসঙ্গলোভী এক কামুক পুরুষ। রাধাকে দৈহিক ভাবে পাওয়ার জন্য সে নানারকম ছলনা, প্রতারণা, অভিনয় ও নীচতার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। রাধার সঙ্গে বারবার মিলিত হয়ে অন্তরের তৃষ্ণার উপশম ঘটে তার। অতঃপর ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণ তুচ্ছ অজুহাতে মিথ্যা অভিযোগে সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না কৃষ্ণসঙ্গাভিলাষী রাধাকে নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করে চলে যায়। আত্যন্তিক আসক্তি থেকে পূর্ণ অনাসক্তি—কৃষ্ণের এই বিপরীতধর্মী অবস্থান নানা নাটকীয় পরিস্থিতিতে অল্প অল্প করে এগিয়েছে। নাটক অভিনয়যোগ্য মঞ্চনির্ভর সাহিত্যধারা। তারও শেষ গন্তব্য সেই রস। বর্ণিত আখ্যানটি আধুনিক দৃষ্টিতে স্থূল, গ্রাম্য ও অমার্জিত ঠেকতে পারে, কিন্তু এর খাঁটি মানবিক রসে কোথাও কোনও সন্দেহ উপস্থিত হয় না। নাটকের উদ্দেশ্যে এই রস সৃষ্টি করা এবং সেই দিক থেকে বড়ু চণ্ডীদাস সম্পূর্ণ সফল। নাটকের মুখ্য অবলম্বন তথা বহিরঙ্গের চিহ্ন হল সংলাপ। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এও দেখা যায় ৪১৮টি পদের মধ্যে মাত্র ৪২টি পদ কবির বিবৃবি, অবশিষ্ট পৌনে চারশো পদ কোনও না কোনও চরিত্রের উক্তি বা স্বগতোক্তি। সংলাপের মধ্যেও আছে পাত্রপাত্রী ও পরিস্থিতিগত বৈচিত্র্য। যেমন, দানখণ্ডে কৃষ্ণের উক্তিতে অশালীন প্রস্তাব থাকলেও তার ভাষাগত অভিব্যক্তিটি গ্রাম্যতাদোষ থেকে মুক্ত। অন্যদিকে রাধার সংলাপে যে ধার ও তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করা যায়, তা গ্রাম্য নারীর ভাষা ও প্রবচনে সমৃদ্ধ এবং তার অন্তরের ঘৃণা ও অস্বীকৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। আবার বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ভাষায় আবেগধর্মিতা প্রবলভাবে উপস্থিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মাত্র তিনটি মুখ্য চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নাটককে অলংকারশাস্ত্রে ‘বীথি’ বলা হয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সঙ্গে এই নাট্যশ্রেণির সাদৃশ্য দেখা যায়। এতে পরিবেশিত শৃঙ্গার রসের আধিক্যের নিরিখে কেউ কেউ একে জাগের গান অথবা ঝুমুর গানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাগের গান ‘ধামালি’ বলে কথিত। এই গানে সঙ্গমকামনার বিষয়টিই মুখ্য। ঝুমুর গানে থাকে দুটি দল, যারা পারস্পরিক উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে আখ্যানটিকে গতিময় করে তোলে। এই দুইয়ের কিছু কিছু লক্ষণ থাকলেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' সম্পূর্ণত লোকরীতির রচনা নয়। বরং ড. সুকুমার সেন ‘লগনী’, ‘দণ্ডক’, ‘প্রকীণ্ণক’ ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগের সূত্রে এটিকে ‘নাটগীত’ শ্রেণির রচনা বলে মনে করেন। তিনি আরও অনুমান করেন, মধ্যযুগে এই পালা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সম্ভবত পুতুলনাচ হত। ‘পঞ্চালিকা’ অর্থে পুতুল ধরলে এর প্রকৃত অভিধা হয় ‘নাটগীত পঞ্চালিকা’। দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, বস্ত্রহরণখণ্ড, রাধাবিরহ প্রভৃতি অংশে যেভাবে রাধাকৃষ্ণের দৈহিক সম্ভোগের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব পাত্রপাত্রীর দ্বারা তার অভিনয় নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। অতএব এর নাট্যধর্মিতা ও মঞ্চযোগ্যতা স্বীকার করে নিলে পুতুলনাচের সম্ভাবনার কথাও অবশ্যই মানতে হয়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ নাট্যধর্ম ব্যাপক পরিমাণে থাকলেও এটিকে কোনওমতেই বিশুদ্ধ নাটক বলা চলে না। প্রথাসিদ্ধ নাটকের অবয়বে এটি লেখা হয়নি। বরং যে কৌশলে সংলাপগুলিকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, তাতে এর বর্ণনাত্মক স্বভাবটিই ধরা পড়ে। একটি নিটোল গল্প সাজিয়ে-গুছিয়ে বলেছেন কবি। পাত্রপাত্রীর অঙ্গভঙ্গি, ক্রিয়া, মনের কথা ইত্যাদিকে সংলাপের পাশাপাশি নিজের কথার মাধ্যমেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এই রীতি নাটকের নয়, কথাসাহিত্যের; আরও নির্দিষ্ট করে বললে উপন্যাসের। এই ভঙ্গিটিই আদ্যন্ত দৃশ্যমান সমগ্র গ্রন্থে। বৃহদায়তন আখ্যানকে যেমন কথাসাহিত্যিক একাধিক অধ্যায়ে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত করে ঘটনার এক-একটি পর্যায় নির্মাণ করেন, এখানে খণ্ডবিভাগ মোটামুটি তারই অনুকল্পে সাজানো। জন্মখণ্ডে তথ্যমূলক বিবরণই প্রধান। এরপর তাম্বুলখণ্ড থেকে বাণখণ্ড পর্যন্ত গল্প চলেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে। তারপর আবার স্তিমিত হয়ে পড়েছে আখ্যানের গতি। পরিসংখ্যান অনুসারে, সমগ্র আখ্যানে মোট ৪২টি পদ কবির উক্তি। এতে পরস্প-বিচ্ছিন্ন ক্রিয়া ও ঘটনাগুলিকে এক সূত্রে গেঁথে তোলার প্রয়াস লক্ষিত। আর আছে ১৬১টি সংস্কৃত শ্লোক। এই শ্লোকগুলির বেশ কয়েকটি কবির উক্তি তথা নির্ভেজাল বিবৃতি। ঘটনার উল্লম্ফনকে ধরার জন্য এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এগুলিতে প্রধান তিন চরিত্রের স্বভাব ও আচরণ সম্পর্কে ছোটো ছোটো অথচ তীক্ষ্ণ মন্তব্য করা হয়েছে, যা নাট্যধর্মকে কিছুটা ক্ষুণ্ণ করে কথাসাহিত্যের বিশ্লেষণধর্মিতাকে চিনিয়ে দেয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বড়ু চণ্ডীদাস যে আলাদা করে বর্ণনাধর্মিতার দিকে দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন, তার বিশেষ প্রমাণ এই শ্লোকগুলিই।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ গীতিলক্ষণও খুব স্পষ্ট। নাটকীয়তা ও বর্ণনাধর্মিতার সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়ে প্রসঙ্গ অনুসারে গীতিকবিতার সুর অনুরণিত হয়েছে এতে। রচনার প্রথমাংশে লোকসংগীত ঝুমুরের প্রভাব অনেকেই স্বীকার করেন। কিন্তু এর শেষাংশে তা রীতিমতো গীতিকাব্যিক মূচ্ছনার সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে দুটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথম, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব রচনাই সংগীত-নির্ভর। গেয়ে পরিবেশনের উদ্দেশ্যেই এগুলি রচিত হত। কাব্য হিসেবে তাই এগুলি গেয়কাব্য। দ্বিতীয়ত, মধ্যযুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি বলে কবির ব্যক্তিগত স্বকীয় ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটনের কোনও জায়গা ছিল না। তবে নিজের অন্তরঙ্গ অনুভূতি কিংবা উপলব্ধিকে আখ্যান-বিধৃত চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে কোনও বাধা ছিল না। বস্তুত তাই লক্ষ্য করা যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বিশেষত বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ব্যক্তিচিত্তের অন্তর্গূঢ় বেদনাই রূপলাভ করেছে গীতকাব্যের ভাষায় ও সুরে। ব্যক্তিগত এই যন্ত্রণা প্রকাশের সূত্রেই হয়তো একসঙ্গে বাঁধা পড়তে পারে বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসের কৃষ্ণপ্রেম-উন্মাদিনী শ্রীরাধিকা। কেউ কেউ বংশীখণ্ডের “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কুলে” পদটিকে গীতিকাব্যিক উচ্ছ্বাসের চূড়ান্ত নিদর্শন বলে মনে করেন। এই পদটির আখ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টাও হয়েছে; যদিও রাধা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে অন্য সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয়। যাই হোক, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' যে একদা আসরে গাইবার জন্যই লেখা হয়েছিল তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ প্রতিটি পদের সূচনায় বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর উল্লেখ। গাইবার সময় সুরের একঘেয়েমি এড়ানোর জন্য বৈচিত্র্যময় রাগ ব্যবহারের নির্দেশ করে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শিল্পসচেতনতার পরিচয়ই দিয়েছেন। একই সঙ্গে রয়েছে তালের উল্লেখও। রাগ ও তালের এহেন প্রয়োগ দেখে তাঁকে সংগীত-বিশারদও ধরা যেতে পারে। সব মিলিয়ে ৩২টি রাগ-রাগিণীর উল্লেখ করেছেন তিনি। এগুলির মধ্যে পাহাড়িয়া রাগে রচিত পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। অন্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রামগিরি, গুজ্জরী, কোড়া, ধানুষী, দেশাগ, মালব, ভাটিয়ালী, মল্লার, দেশবরাড়ী, বেলাবলী, আহের, ভৈরবী, ললিত, মালবশ্রী, বসন্ত, বিভাস ইত্যাদি। তালের মধ্যে আছে যতি, রূপক, ক্রীড়া, একতালী, আঠতালা ইত্যাদি। সংগীতবিদ রাজ্যেশ্বর মিত্র এই গ্রন্থের গীতিমূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “এ গ্রন্থটি কী কাব্য, কী সংগীত, কী গীতিনাট্য সব দিক থেকেই রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রাচীন সংগীত কলার অত্যুৎকৃষ্ট পরিচায়ক।” যাই হোক, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কোনও একটি নির্দিষ্ট সংরূপ তার বিশেষ লক্ষণ নিয়ে উপস্থিত নেই। বরং এটি বিবেচনা করা যায় যথেষ্ট লাট্যোপাদান-সমৃদ্ধ গীতিধর্মাশ্রয়ী আদিরসাত্মক আখ্যানকাব্য হিসেবে। এই মিশ্র অথচ গুণান্বিত সংরূপটির অনুসরণ পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর কখনও দেখা যায়নি।
16jqdgiuiqibenad4w7jw9y8ejjb0fd
85940
85937
2025-07-11T10:26:51Z
Jonoikobangali
676
/* কাব্যাঙ্গিক */
85940
wikitext
text/x-wiki
পৌরাণিক সংস্কৃতির অন্যতম বিশিষ্ট একটি ধারা হল কৃষ্ণকথার ধারা। বৈদিক সাহিত্যেই এই কৃষ্ণকথার বীজ নিহিত ছিল। ক্রমে পুরাণগুলির মধ্যে দিয়ে ক্রমবিকাশের নানা পর্যায় পার হয়ে বিষ্ণু, নারায়ণ, হরি, বাসুদেব ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র একক পুরুষে একীভূত হয়ে যায়। তখন তিনি হন অংশী, অন্যরা অংশ। আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৮০০ থেকে ১০০০ অব্দের মধ্যবর্তীকালে রচিত ভাগবত পুরাণে সেই অংশী ‘স্বয়ং ভগবান’ কৃষ্ণ নামে কথিত হলেন। এই পুরাণে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হল কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত কাহিনি। বস্তুত ভাগবতধর্মের বিকাশ ঘটল এই গ্রন্থ রচনার পরে। এরপর একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল উত্তর ভারতেও। সেই সূত্রে বাংলাতেও এসে উপস্থিত হল কৃষ্ণভক্তিবাদ। সেন আমলে বাংলায় যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল, তার অন্যতম অবলম্বন ছিল কৃষ্ণকথা। জয়দেব তাঁর ''গীতগোবিন্দম্'' কাব্যে কৃষ্ণকে একই সঙ্গে করে তুললেন পরমারাধ্য বিষ্ণুর অবতার এবং কামকেলিকলার নায়ক।
ঠিক এই সময়েই বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল, যার সুদূরপ্রসারী ফলে বাঙালি সমাজ, বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি হিন্দুর দৈনিক জীবনে এল এক আমূল পরিবর্তন। ঘটনাটি ইতিহাসে তুর্কি আক্রমণ নামে খ্যাত। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিতে তুর্কি সেনানায়ক ইখ্তিয়ার-উদ্দিন মহম্মদ বিন বখ্তিয়ার খিলজি আক্রমণ করলেন রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজ্য। বৃদ্ধ রাজা পালিয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গে। বিদেশি শাসনে সাধারণ হিন্দুরা সমূহ বিপদের সম্মুখীন হল। এই সংকটকালে কোনও সাহিত্য রচিত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য আজও পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয়, তুর্কি আক্রমণের প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার পর সমাজজীবন সুস্থির হলে বাঙালির সাহিত্যচর্চার অবকাশ তৈরি হয়। এই দু-আড়াইশো বছর সময়টিকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। এই সময়েই বিদেশি শাসকের ধর্মীয় ও সামাজিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলা সাহিত্যকে অবলম্বন করে বাঙালি হিন্দু এক সাংস্কৃতিক বর্ম গড়ে তোলে।
আসলে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষেরা উচ্চবর্ণের নিপীড়ন সহ্য করার পর ইসলামের সাম্যবাদী নীতিতে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে শাসকবর্গের প্রলোভন ও দমনপীড়নের নীতি তো ছিলই। ফলে দলে দলে লোক ধর্মান্তরিত হচ্ছিল ভয়ে, লোভে, পীড়নে ও পিরদের কেরামতিতে আকৃষ্ট হয়ে। এতে হিন্দু সমাজপতিদের টনক নড়ে। নিজেদের ধর্মাদর্শকে দেশীয় ভাষায় সকলের কাছে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তারা। সমাজের ভাঙন প্রতিরোধে শাস্ত্রকথা শুনিয়ে লোক-নিস্তারণের দায়িত্ব নেন অনুবাদক কবিরা। অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যের আখ্যানে উঠে আসে অবনমিত সম্প্রদায়ের উপরে ওঠার ইতিহাস। চণ্ডী, মনসা, ধর্মঠাকুর প্রমুখ লোকদেবতা আর অপাংক্তেয় হয়ে থাকেন না, বরং মন্ত্র ও পূজা ইত্যাদি প্রাপ্তির মাধ্যমে তাঁরাও স্বীকৃত হন উচ্চসমাজে। প্রাক্-চৈতন্য যুগে বাংলায় প্রচারিত কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য এই প্রেক্ষাপটেই বিবেচ্য।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে কৃষ্ণের নৈষ্ঠিক পূজার্চনার রীতি চালু হয়। তৎকালীন অভিলিখন, ভাস্কর্য ও শাস্ত্রগ্রন্থে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবে বৈদান্তিক মতের প্রাধান্য ঘটে। সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়ায় একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব ভক্তিবাদী আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে উত্তর ভারতে। আরও তিন শতক পরে চতুর্দশ শতকের শেষভাগে মাধবেন্দ্র পুরী সারা ভারতে কৃষ্ণভক্তিবাদ প্রচার করেন। শোনা যায় বাংলায় তিনি কৃষ্ণভক্তির সূচনা করেছিলেন অদ্বৈত আচার্য ও ঈশ্বর পুরী নামে দুই শিষ্যের মাধ্যমে। ঈশ্বর পুরীই দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত স্মার্ত নিমাই পণ্ডিতকে—যিনি সন্ন্যাসগ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা চৈতন্য মহাপ্রভু নামে পরিচিত হন। বস্তুত ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা চৈতন্যের প্রভাবে বাংলায় কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তাঁর রাগানুগা ভক্তি প্রচলিত কৃষ্ণার্চনার ধারায় এক অভিনব সংযোজন। প্রাক্-চৈতন্য যুগের তুলনায় তাই চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কৃষ্ণকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারা অনেকটাই আলাদা। প্রথম পর্বে যেখানে বৈধী ভক্তির প্রাধান্য দেখা যায়, চৈতন্য-পরবর্তী পর্বে বৈষ্ণব সাধনায় দেখা যায় রাগানুগা প্রেমাভক্তির প্রাধান্য। পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদাবলিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনতত্ত্বের স্পর্শ অথবা ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থের ন্যায় বৈষ্ণবীয় অলংকারশাস্ত্রের নিগূঢ় বন্ধন ছিল না; সেই পদ রচিত হয়েছিল কবিদের নিজস্ব প্রাকৃত ও আধ্যাত্মিক চেতনার সংমিশ্রণে, কোথাও আবার সংস্কৃত সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা প্রকরণের ছায়া অবলম্বনে। সাহিত্যের ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন প্রমাণের উপর নির্ভর করে জানিয়েছেন, প্রাক্-চৈতন্য যুগে কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদসাহিত্য দেশীয় ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন তিনজন শক্তিমান কবি। এঁরা হলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কবি বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলির অন্যতম দুই বিশিষ্ট রূপকার বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস। অবশ্য ভাষা ও জাতিগত বিচারে বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না। তিনি পদ রচনা করেন ব্রজবুলি ভাষায়। প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও পদাবলি সাহিত্য আলোচনায় এই তিন বিশিষ্ট কবির সাহিত্যসম্ভারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে।
==''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্য==
আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দাবি সর্বজনস্বীকৃত। এই কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস আর কোনও বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তিনি যে বাংলা ভাষায় কৃষ্ণকেন্দ্রিক একটি বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাব্যটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) প্রাচীন সাহিত্য-বিশারদ বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামে বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র্য-বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচা থেকে অযত্নরক্ষিত এই পুথিটি উদ্ধার করেন। সাত বছর পরে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুথিটিকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি। প্রকাশের পর এই গ্রন্থের নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
===কবি: বড়ু চণ্ডীদাস===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। মধ্যযুগে চণ্ডীদাস নামধারী আরও কবি ছিলেন বলে গবেষকদের ধারণা। তবে বড়ু চণ্ডীদাস যে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কাব্যের ভণিতা থেকে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কবি কোথাও নিজেকে ‘অনন্ত বড়ু’, কোথাও ‘অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস’, আবার কোথাও বা কেবল ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ ভণিতাই পাওয়া যায় সর্বাধিক সংখ্যায়—২৯৮ বার, এবং ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা আছে ১০৭ বার। এই পুথি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই বাঙালি পাঠক ও বৈষ্ণব সমাজ চণ্ডীদাসের পদের সঙ্গে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকে বৈষ্ণব মহাজনদের রচিত পদগুলির সংকলনও প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ''স্কেচ অফ দ্য রিলিজিয়াস সেক্টস অফ হিন্দুজ'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন যে, গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির যৌথ কর্তৃত্বে সংস্কৃত ভাষায় ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়েছিল। তথ্যটি বাঙালি লেখকদের কলমে বিকৃত হয়ে এই রূপ নেয় যে, চণ্ডীদাস ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি পুথি রচনা করেছিলেন। তাই ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথি আবিষ্কারের পর স্বয়ং আবিষ্কর্তাও বিভ্রান্ত হয়ে কবিকে ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’ বলেই উল্লেখ করেন। তাঁর ধারণা ছিল “দীর্ঘকাল যাবৎ চণ্ডীদাস বিরচিত কৃষ্ণকীর্তন”-এর যে অস্তিত্বের কথা তিনি শুনে আসছিলেন, প্রাপ্ত পুথিটি তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। ভণিতায় প্রাপ্ত ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ নামটি তিনি উপেক্ষা করে যান। সেই থেকেই চণ্ডীদাস সমস্যার প্রাথমিক সূত্রপাত। দীনেশচন্দ্র সেনও জানান, “কবি চণ্ডীদাস ও কৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা যে অভিন্ন ব্যক্তি, তৎসম্বন্ধে আমাদের সংশয় নেই।” যে চণ্ডীদাস যৌবনে তীব্র আদিরসাত্মক রচনায় সিদ্ধহস্ত, পরিণত বয়সে তিনিই আধ্যাত্মিক রসে বিহ্বল। মনীন্দ্রমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালা থেকে দীন চণ্ডীদাসের পদ আবিষ্কার করলে সমস্যা আরও তীব্র হয়। কারণ পুরোনো পুথিপত্রে একক চণ্ডীদাসের উল্লেখই পাওয়া যায়। যেমন, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ''চৈতন্যচরিতামৃত'' বা সনাতন গোস্বামীর ''বৈষ্ণবতোষিণী'' টীকা ইত্যাদিতে কোথাও বড়ু বা দীন চণ্ডীদাসের নামোল্লেখ নেই।
কিন্তু এত জটিলতা সত্ত্বেও কয়েকটি অকাট্য প্রমাণের বলে পদাবলির চণ্ডীদাস থেকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতাকে পৃথক করা সম্ভব হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-র ষষ্টিতম ভাগ, দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করে কোন কোন সূত্রে দুই চণ্ডীদাস স্বতন্ত্র তা দেখিয়েছেন। তাঁর সুচিন্তিত সমাধানগুলি হল:
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে কোথাও ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’ বা ‘দীন চণ্ডীদাস’ ভণিতা নেই।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার পিতামাতার নাম সাগর ও পদুমা বলে উল্লেখ করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার শাশুড়ি বা ননদের নাম উল্লেখ করেননি। ‘বড়ায়ি’ ছাড়া কোনও সখীকেও সম্বোধন করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে চন্দ্রাবলী রাধারই নামান্তর, পৃথক প্রতিনায়িকা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কৃষ্ণের কোনও সখার নাম উল্লেখ করেননি।
# বড়ু চণ্ডীদাস সর্বত্র প্রেম অর্থে ‘নেহ’ বা ‘নেহা’ ব্যবহার করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কোথাও রাধার বিশেষণে ‘বিনোদিনী’ এবং কৃষ্ণ অর্থে ‘শ্যাম’ ব্যবহার করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে রাধা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস ব্রজবুলি জানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
উপরিউক্ত তথ্যগুলি বড়ু চণ্ডীদাসের পৃথক অস্তিত্বের প্রমাণ। আসলে মধ্যযুগের অনেক কবির মতোই বড়ু চণ্ডীদাসও নিজের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। কেবল তিনি যে ‘বাসলী’ নামে এক দেবীর সেবক ছিলেন, সেই কথাই উল্লিখিত হয়েছে ভণিতায়। এই কবিকে নিয়ে লোক-ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়েছে অনেক জনশ্রুতি। কবির জন্মস্থান বাঁকুড়ার ছাতনা না বীরভূমের নানুর তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, দুই স্থানেই বাসলী দেবীর মন্দির আছে, চণ্ডীদাস ও রামী রজকিনীকে নিয়ে লোকপ্রবাদ প্রচলিত, বছরের নির্দিষ্ট দিনে মেলা ও উৎসব হয়। তবে বাঁকুড়ার দিকেই পাল্লা ভারী। কারণ নানুরের কবি চণ্ডীদাসের ভণিতায় মেলে ‘বাশুলী’ দেবীর নাম এবং ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে ‘বাসলী’ দেবীর উল্লেখ। এছাড়া গুরুতর প্রমাণ এই কাব্যের ভাষা। বাঁকুড়ার লোকভাষার আনুনাসিক ধ্বনির প্রাধান্য এবং এই অঞ্চলে প্রচলিত গড়া, চুক, মাকড়, ঝঁট, ভোক ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যেও পাওয়া যায়। কোনও কোনও গবেষক বাঁকুড়ার উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ তার প্রাচীন প্রয়োগ দেখিয়েছেন। তাছাড়া এই পুথিটিও পাওয়া গিয়েছে বাঁকুড়া থেকেই। এছাড়া তালশিক্ষার যে পুথিতে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কয়েকটি পদের আধুনিক রূপান্তর পাওয়া যায়, সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছে এই জেলাতেই।
বড়ু চণ্ডীদাস লোকরীতির কাব্য রচনা করলেও তিনি যে সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। যে অনায়াস দক্ষতায় ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং ''গীতগোবিন্দম্'' ও ''কুট্টিনীমতম্'' ইত্যাদি গ্রন্থের তথ্য কাব্যে ব্যবহার করেছেন এবং দেড় শতাধিক সংস্কৃত শ্লোক রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি প্রমাণিত হয়। ‘বড়ু’ শব্দটি থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন, কবি ব্রাহ্মণ ছিলেন। এটি ‘বটু’ শব্দ থেকেই আসতে পারে। বড়ু হলেন শ্রোত্রীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ। রজকিনী-ঘটিত জনশ্রুতিতে তিনি ব্রাহ্মণ বলেই কথিত। ছাতনার বাসলী আসলে খড়্গ-খর্পরধারিণী দক্ষিণাকালী। সেই সূত্রে কবিকে শাক্ত বলে গণ্য করাই সমীচীন। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ভাষা দেখে ভাষাতাত্ত্বিকেরা একে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের রচনা বলে শনাক্ত করেছেন। সম্ভবত বড়ু চণ্ডীদাস পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধেই আবির্ভূত হন।
===কাব্য পরিচয়===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক আখ্যানধর্মী কাব্য। ধ্রুপদি প্রেমকাহিনির মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিশেষত্ব-মণ্ডিত। রামসীতা বা হরপার্বতীর ন্যায় এই প্রেম স্বকীয়া বা বিবাহোত্তর প্রেম নয়, এই প্রেমের প্রকৃতি পরকীয়া। বস্তুত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাড়া আর কোথাও রাধাকৃষ্ণের স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ দেখানো হয়নি। লোক-ঐতিহ্যে রাধা কৃষ্ণের মাতুলানী। ফলে এই প্রেম নিয়ে অনেক মুখরোচক গালগল্প তৈরি হয়েছিল এক সময়ে। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে অবশ্য রাধা তত্ত্বে পরিণত। তখন তিনি কৃষ্ণের স্বকীয়া অন্তরঙ্গা শক্তি। হ্লাদিনীর সারভূত রূপ মহাভাব থেকে রাধার উৎপত্তি ব্যাখ্যাত। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাস প্রাক্-চৈতন্য যুগের কবি। রাধাকে তিনি চিত্রিত করেছেন প্রাকৃত রমণী রূপেই, কোনও আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আলোকে নয়। স্বীকার করে নিয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মাতুলানী-ভাগিনেয় সম্পর্ক। ফলে এই কাব্য লোকরঞ্জনকারী এক কাহিনিতে পর্যবসিত হয়েছে। এর ভাব, ভাষা, আঙ্গিক, পরিবেশ সবই গ্রামীণ। গ্রাম্য রুচির কাছে আত্মসমর্পণ করে পণ্ডিত কবি এই কাব্যে পুরাণকথা ও লোকশ্রুতির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তবে তাঁর মধ্যে প্রতিভার অভাব ছিল না। সেই প্রতিভায় রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির চরিত্র হয়ে উঠেছে সমুজ্জ্বল। ভাগবত পুরাণে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় না। জয়দেবই প্রথম রাধাকে নিয়ে বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেন। বড়ু চণ্ডীদাসের অন্যতম আদর্শ এই রচনা। তবে রাধা চরিত্র চিত্রণে তিনি যে প্রখর সমাজবাস্তবতা ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন, তা অনবদ্য। দেশীয় ভাষায় এইপ্রকার বৃহদায়তন প্রথম আখ্যানকাব্য রচনার কৃতিত্ব বড়ু চণ্ডীদাসেরই প্রাপ্য।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশ পাওয়া যায়নি। মাঝের কয়েকটি পাতাও অবলুপ্ত। পাওয়া গিয়েছে তেরোটি খণ্ডে বিন্যস্ত মোট ৪১৮টি পদ। কবি প্রথম বারোটি খণ্ডের নাম দিয়েছেন যথাক্রমে (১) জন্মখণ্ড, (২) তাম্বুলখণ্ড, (৩) দানখণ্ড, (৪) নৌকাখণ্ড, (৫) ভারখণ্ড, (৬) ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড, (৭) বৃন্দাবনখণ্ড, (৮) যমুনান্তর্গত কালীয়দমনখণ্ড, (৯) যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ড, (১০) যমুনান্তর্গত হারখণ্ড, (১১) বাণখণ্ড ও (১২) বংশীখণ্ড। ত্রয়োদশ খণ্ডটির শেষাংশ পাওয়া যায়নি বলে এই খণ্ডের কবিকৃত নামটি জানা যায় না। সম্পাদক বসন্তরঞ্জন এই খণ্ডের নামকরণ করেছেন ‘রাধাবিরহ’। তেরোটি খণ্ডে অখণ্ড সুস্পষ্ট একটি গল্প বলা হয়েছে। গল্প এগিয়েছে কবির বিবৃতি এবং আখ্যানের মুখ্য তিন চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। গল্পটি সংক্ষেপে এইরকম:
অত্যাচারী কংসের পীড়নে ব্যথিতা বসুন্ধরার আর্তিতে স্বর্গের দেবতারা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কংসের বিনাশের জন্য নারায়ণ ‘কৃষ্ণ’ নাম নিয়ে বসুদেবের গৃহে দেবকীর উদরে জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁর সম্ভোগের জন্য লক্ষ্মীও প্রেরিত হলেন রাধা রূপে। তার পিতা সাগর, মাতা পদুমা বা পদ্মা। দেবগণের ইচ্ছানুসারে রাধার স্বামী হলেন নপুংসক আইহন। বালিকাবধূ রাধার পরিচর্যার জন্য এলেন পদ্মার বুড়ি পিসি বড়ায়ি। গোপরমণী রাধাকে দুধ-দই বেচতে মথুরার হাটে যেতে হয়। একদা রাধা বড়ায়ির দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়। তার রূপ-গুণ বর্ণনা করে ব্রজের রাখাল নন্দগোপসুত কৃষ্ণের কাছে বড়ায়ি রাধার সন্ধান জানতে চাইল। সেই রূপের কথা শুনে কৃষ্ণের মনে রাধাসঙ্গের বাসনা জেগে উঠল। বড়ায়ির হাতে তাম্বুল অর্থাৎ পান দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব জানালেন কৃষ্ণ। কিন্তু বিবাহিতা রাধার মনে তখনও স্বামী-সংস্কার তীব্র। পরপুরুষের প্রতি বিরাগ সে ক্রুদ্ধ হয়ে তাম্বুলে লাথি মেরে বড়ায়িকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। অপমানিতা বড়ায়ি এসে কৃষ্ণের কাছে সব জানিয়ে এর প্রতিবিধান করতে বলল। দুজনে পরামর্শ করল, যমুনার ঘাটে কৃষ্ণ দানী সেজে বসবে এবং দানের ছলে দুধ-দই নষ্ট করবে, হার কেড়ে নেবে, কাঁচুলি ছিঁড়বে। পরামর্শ অনুযায়ী কুতঘাটে বসে রইল কৃষ্ণ। রাধা সখীদের নিয়ে এল সেই ঘাটে। কৃষ্ণ দানী হয়ে মহাদান চেয়ে বসল। শুধু পণ্যদ্রব্য পার করার কড়ি নয়, রাধার অঙ্গের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ কড়ি দাবি করল সে। কড়ি না দিলে দিতে হবে আলিঙ্গন। কিন্তু রাধার পক্ষে তা মেনে নেওয়া কখনই সম্ভব নয়। শুরু হল বাগবিতণ্ডা। রাধা কৃষ্ণকে নিবৃত্ত করতে চায় মাতুলানী সম্পর্কের কথা তুলে। কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য “নহসি মাউলানী রাধা সম্বন্ধে শালী”। কৃষ্ণ রাধাকে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেও রাধা সেসব বিস্মৃত। শেষে রাধার বাধাদান সত্ত্বেও কৃষ্ণ তার সঙ্গে বনের মধ্যে মিলিত হল। আবারও বড়ায়িয়ের কৌশলে রাধা এল যমুনার ঘাটে। একাকিনী রাধাকে যমুনা পার করার সময় কৃষ্ণ মাঝ-নদীতে ঝড় তুলে রাধার মনে ভীতি সঞ্চার করল। ভয়ার্ত রাধা বাঁচার জন্য কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হল। সেই সুযোগে নদীমধ্যে দুজনের মিলন ঘটল। এতদিনে রাধা বুঝতে পেরেছে কৃষ্ণের দুর্বলতা কোথায়। তাই সে এবার নিজেই অগ্রণী হয়ে মথুরার হাটের জন্য বড়োসড়ো পসরা সাজালো। মথুরার পথে যেতে কৃষ্ণকে ‘সুরতি’ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বইয়ে নিল দুধ-দইয়ের ভার। একইভাবে দেহলোভী কৃষ্ণকে দিয়ে প্রচণ্ড রোদে ছাতাও বহন করালো রাধা। অতঃপর বৃন্দাবনে মহাসমারোহে ঘটল বসন্তের আবির্ভাব। রাধা এবার আড়চোখে চেয়ে ও নানা অঙ্গভঙ্গি করে কৃষ্ণের কামনা জাগিয়ে তুলল। ষোলোশো গোপিনী সঙ্গে বিলাস সমাপ্ত করে কৃষ্ণ রাধার কাছে এসে দেখল সে অভিমানাহত হয়ে বিষণ্ণ মনে নীরবে বসে আছে। কৃষ্ণ মধুর বচনে রাধার মান ভাঙিয়ে লিপ্ত হল সঙ্গমে। রাসলীলায় কৃষ্ণের উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে জলক্রীড়ার কথা চিন্তা করে কালীদহের বিষাক্ত জল বিষমুক্ত করতে দহে নেমে পড়ল কৃষ্ণ। বিষের তীব্রতায় কৃষ্ণ অচৈতন্য হয়ে পড়লে নন্দ, যশোদা, বলরাম প্রমুখ আত্মীয়েরা বিলাপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণের বিপদ অনুমান করে যাবতীয় লোকলজ্জা ত্যাগ করে রাধা এবার সর্বসমক্ষে ‘পরাণপতি’ বলে কেঁদে উঠল। অবশেষে কালীয় নাগকে দমন করে কৃষ্ণ উঠে এল জল থেকে। একদিন রাধা সখীদের নিয়ে যমুনায় জল ভরতে এসে কৃষ্ণের সঙ্গে জলকেলিতে মত্ত হল। সেই সুযোগে কৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করল। রাধার অনুনয়ে কৃষ্ণ বস্ত্র ফিরিয়ে দিলেও তার বক্ষহারটি লুকিয়ে রাখল। হার না পেয়ে রাধা এবার গিয়ে অনুযোগ জানালো কৃষ্ণজননী যশোদার কাছে। যশোদা কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করলে অপমানিত কৃষ্ণ ফুলধনু দিয়ে রাধাকে বাণাহত করে মূর্চ্ছিত করল। কিন্তু এবার বড়ায়ি কৃষ্ণের আচরণে ক্ষুব্ধ হল। সে তিরস্কার করে রাধার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বলল। তখন কৃষ্ণের হস্তস্পর্শে রাধার চৈতন্য হল। পরিশেষে বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের পুনর্মিলন ঘটল। এখন আর কৃষ্ণের মনে রাধার প্রতি পূর্বের অদম্য আসক্তি কিছুই নেই। বরং শারীরিক মিলনে রাধার মনে জাগ্রত হয়েছে অপূর্ব সুখোন্মাদনা। সে এখন কৃষ্ণ-অন্তপ্রাণ। তার আর কোনও লজ্জা, ভয় বা সতীত্বের বন্ধন নেই। কৃষ্ণ এবার একটি সুন্দর মোহন বাঁশি গড়িয়ে কদমতলায় বসে একমনে বাজাতে থাকে। তার সেই বাঁশির সুর রাধার চিত্তকে বিপর্যস্ত করে দেয়। সে ঘর-সংসার ভোলে, তার গৃহকর্ম নষ্ট হয়, মনে মনে ভাবে “দাসী হআঁ তোর পাএ নিশিবোঁ আপনা”। বড়ায়িকে সে বারবার বলে কৃষ্ণকে তার কাছে এনে দিতে। বড়ায়ি বিপরীত কথা বলে রাধাকে নিরস্ত করতে চায়। কিন্তু রাধার মন কোনও যুক্তিতেই বশীভূত হয় না। তখন দুজনে মিলে কৃষ্ণের সন্ধানে বৃন্দাবনে যায়। সেখানে কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। রাতে শয্যায় শায়িত রাধার কানে কৃষ্ণের বাঁশির শব্দ এসে প্রবেশ করে। সে নিদ্রিত স্বামীকে ফেলে একাকিনী কৃষ্ণমিলনের উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে পথেই মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে রাধা। বড়ায়ি তার মূর্চ্ছাভঙ্গ করে পরামর্শ দেয় কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করতে। তাই-ই করে রাধা। বাঁশি বিহনে কৃষ্ণ ব্যাকুলভাবে বিলাপ করতে থাকে। অবশেষে বড়ায়ির মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ রাধার কাছে করজোড়ে মিনতি করলে রাধা বাঁশি ফিরিয়ে দেয়। রাধার সকল অপরাধ ক্ষমা করে কৃষ্ণ। বেশ কয়েক মাস কেটে গেলেও শর্ত অনুসারে কৃষ্ণ রাধাকে আর দেখা দেয় না। এবার কৃষ্ণ বিহনে রাধার মনে হতে থাকে “এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবই অসার”। সে বারবার বড়ায়িকে কৃষ্ণ এনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বড়ায়ি তাকে পরামর্শ দেয় কদমতলায় কিশলয় শয্যা রচনা করে প্রতীক্ষা করতে। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। অতঃপর তারা বৃন্দাবনে প্রবেশ করে গোচারণরত কৃষ্ণের দেখা পায়। রাধা তখন কাতরভাবে তার কাছে অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তবুও কৃষ্ণের মন গলে না। অবশেষে বড়ায়ির অনুরোধে কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলনে সম্মত হয়। বিহারের পর শ্রান্ত হয়ে কৃষ্ণের উরুতে মাথা রেখে রাধা ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণ বড়ায়িকে ডেকে তার হাতে রাধার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে মথুরায় চলে যায়। নিদ্রাভঙ্গের পর কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে রাধা। রাধার বিলাপে অস্থির হয়ে বড়ায়ি মথুরায় গিয়ে কৃষ্ণের কাছে রাধার কথা জানায়। কৃষ্ণের বক্তব্য, সে প্রগলভা রাধার কাছে যাবে না। তার মুখদর্শন করতেও সে ইচ্ছুক নয়। আর তাছাড়া সে মথুরায় এসেছে দুরাচারী কংশকে নাশ করতে। তার আর কোনওমতেই বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়া চলে না। এরপরই পুথি খণ্ডিত। যতদূর মনে হয়, কবি রাধা ও কৃষ্ণের বিচ্ছেদেই কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন।
মধ্যযুগীয় কাব্যে প্রক্ষিপ্তি একটি বড়ো সমস্যা। সাহিত্যের সব শাখাতেই কম-বেশি এটি দেখা যায়। যে যুগের লেখকের কর্তৃত্ব সঠিকভাবে চিহ্নিত হত না, সেই যুগে একের রচনায় অন্যের হস্তক্ষেপ স্থান পেয়ে যেত নির্বিরোধে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের প্রক্ষেপ নিয়ে প্রথম সংশয় জ্ঞাপন করেন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ‘বড়ু’ ও ‘বাসলী’-বিহীন ভণিতাগুলিকে তিনি অন্যের রচনা বলে মনে করেন। দানখণ্ডের তিনটি পদে ড. সুকুমার সেন প্রক্ষেপ দেখেছেন। আবার কেউ কেউ গায়েনের প্রক্ষেপ লক্ষ্য করেছেন কাব্যের নানা স্থানে। প্রখ্যাত সমালোচক বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, সমগ্র ‘রাধাবিরহ’ অংশটিই প্রক্ষিপ্ত। তিনি মোট ছয়টি যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু যুক্তিগুলি যে ততটা প্রমাণনির্ভর নয়, সে বিষয়ে একাধিক গবেষক প্রতি-যুক্তি দিয়েছেন। বিশেষত ‘রাধাবিরহ’ যে কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার প্রমাণ রয়েছে কাহিনির অভ্যন্তরীণ কাল-পরম্পরায়, কাব্যের গঠনে, রাধার বয়সের অগ্রহতির সাক্ষ্যে, চরিত্রের ক্রম-পরিণামে এবং অবশ্যই কবির ক্রমবিকশিত প্রতিভার স্তরোন্নয়নে। কাব্যের সূচনায় ‘এগার-বরিষ’-এর রাধা এখানে পূর্ণ যুবতীতে পরিণত, কামুক কৃষ্ণ এই পর্যায়ে ভোগতৃপ্ত হয়ে ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পর্যবসিত। কবি যে ক্রমশ ভাবগভীরতার পথে এগিয়ে এসেছেন, তার প্রমাণ আছে বংশীখণ্ডেই। এই খণ্ডেরই প্রত্যাশিত পরিণাম দেখা যায় ‘রাধাবিরহ’ অংশে। যে গীতিকাব্যিক মূর্চ্ছনার সূচনা হয়েছিল “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কূলে” ইত্যাদি পদে, তার সার্থক পরিণতি ঘটল “দিনের সুরুজ পোড়াআঁ মারে রাতিহো এ দুখ চান্দে” ইত্যাদিতে। রাধার চারিত্রিক বিবর্তনে সম্পূর্ণতা দেখানোর সূত্র ‘রাধাবিরহ’ এই কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য এক অঙ্গ। অন্য কোনও কবির হাত থেকে পূর্বের কাহিনি, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদির এতখানি সঙ্গতিপূর্ণ ধারাবাহিকতা আশা করা যায় না। অতএব কিছু ক্ষেত্রে মৃদু সংশয় থাকলেও কাব্যের অন্তর্বর্তী প্রমাণে ‘রাধাবিরহ’ যে মূল কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তা স্বীকার করে নেওয়া যায়। এই অংশটি না থাকলে বড়ু চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার সামগ্রিক মূর্তিটি অনুধাবন করা যেত না।
===গ্রন্থনাম বিচার===
চর্যাপদের পুথির গ্রন্থনাম নিয়ে যেমন বিতর্ক দেখে দিয়েছিল, তেমনই বিতর্ক দেখা দেয় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথির নামকরণকে কেন্দ্র করেও। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে চর্যাপদ সম্পর্কে একটি যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, পরবর্তীকালের কোনও গ্রন্থে এই কাব্যের নামোল্লেখও করা হয়নি। প্রকৃত সমস্যার সূত্রপাত আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশের পাতা না পাওয়ায়। বইয়ের সূচনায় এবং পুথির শেষে সমাপ্তিসূচক পুষ্পিকাতেই গ্রন্থনাম পাওয়া যায়। এই দুই অংশ না থাকায় পুথিটি থেকে আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন কোনও নাম পাননি। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। পূর্বাপর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রাচ্যতত্ত্ববিদ উইলসনের দেওয়া একটি ভ্রান্ত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নামকরণের বিষয়টি। তিনি গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি কর্তৃক যৌথভাবে রচিত ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে এক সংস্কৃত কাব্যের কথা জানিয়েছিলেন। সেই তথ্য প্রথম বিকৃত হয় জগদ্বন্ধু ভদ্রের ‘গোবিন্দদাস’ প্রবন্ধে (''বান্ধব'', শ্রাবণ ১২৮২ সংখ্যা)। তিনি লেখেন, “উইলসন সাহেব কৃত উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে লিখিত আছে যে, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাস উভয়ে মিলিত হইয়া কৃষ্ণকীর্তন প্রণয়ন করেন।” এই সংবাদই সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করেন রমণীমোহন মল্লিক, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য, ব্রজসুন্দর সান্যাল প্রমুখ প্রাবন্ধিকেরা। ক্রমে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামক কাল্পনিক গ্রন্থটির একক রচয়িতায় পরিণত হন চণ্ডীদাস। বড়ু চণ্ডীদাসের পুথি আবিষ্কৃত হওয়ার পর বসন্তরঞ্জনও ভেবেছিলেন যে, তিনি সেই হারিয়ে-যাওয়া বহুশ্রুত গ্রন্থটিই আবিষ্কার করেছেন। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে গ্রন্থটির নাম দেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এবং লেখকের নাম হিসেবে উল্লেখ করেন ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’। গ্রন্থপ্রকাশের এগারো বছর পরে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে গ্রন্থনাম নিয়ে প্রথম সংশয় প্রকাশ করেন রমেশ বসু। ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-য় প্রকাশিত ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রবন্ধে তিনি এও বলেন যে, “এই গ্রন্থ সংস্কৃত ও লৌকিক পুরাণের সমবায়ে গঠিত বলিয়া ইহাও পুরাণ আখ্যা পাইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। বাস্তবিকই বাঙ্গালায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক যদি কোন মৌলিক পুরাণ থাকে তাহা এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।” ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে ''বিশ্ববাণী'' পত্রিকায় দক্ষিণারঞ্জন ঘোষ ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামক আর-একটি প্রবন্ধে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামের কোনও ভিত্তি পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করে প্রশ্ন তোলেন, “শুধু বসন্তবাবুর ধারণা এবং শোনা কথার মূল্য কি?” চার বছর পরে নলিনীনাথ দাশগুপ্ত ''বিচিত্রা'' পত্রিকায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সামাজিক তথ্য’ প্রবন্ধে নানা দিক আলোচনা করে পুথিটির ''কৃষ্ণমঙ্গল'' নামকরণের পক্ষপাতী হন। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ''প্রবাসী'' পত্রিকায় ‘চণ্ডীদাস চরিত’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, “এক মস্ত ভুলও হয়ে গেছে, রাধাকৃষ্ণলীলার ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নাম হয়ে গেছে।” উপরিউক্ত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের ''প্রবাসী'' পত্রিকায় সম্পাদক বসন্তরঞ্জন লেখেন ‘চণ্ডীদাস চরিতে সংশয়’। সেখানে তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হন। কিন্তু তাঁর মত গবেষকদের মধ্যে ততটা গৃহীত হয়নি।
নামকরণের সমস্যাটি আরও জটিল হয় যখন ১৩৪২ বঙ্গাব্দে বসন্তরঞ্জন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণে পুথির মধ্যে প্রাপ্ত একটি চিরকুট প্রকাশ করেন। তাতে লেখা ছিল: “শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণঃ।। শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্বের ৯৫ পচানই পত্র হইতে একসও দস পত্র পর্য্যন্ত একুন ১৬ শোল পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চাননে শ্রীশ্রী মহারাজা হুজুরকে লইয়া গেলেন পুনশ্চ আনিয়া দিবেন—সন ১০৮৯”। প্রাচীন পুথির মধ্যে এই ধরনের রসিদ পাওয়ায় এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, রসিদটি উক্ত গ্রন্থ-সংক্রান্ত। ফলে নামকরণকে কেন্দ্র করে স্পষ্টত দুটি দল তৈরি হয়ে গেল। একদল পুথিটির ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নাম রাখার পক্ষপাতী, অন্য দলের মতে এর নাম হওয়া উচিত ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব''। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। এর পাশাপাশি অধ্যাপক সত্যব্রত দে ১৩৮৬-৮৭ বঙ্গাব্দের ''রবীন্দ্রভারতী পত্রিকা''-য় একটি কূটতর্ক তুললেন, “গ্রন্থটির সঠিক নাম কি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন না কৃষ্ণকীর্তন?... যে চারটি সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে বসন্তরঞ্জন চণ্ডীদাস-রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যের অস্তিত্বে দৃঢ়নিশ্চয় হয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকটিতেই গ্রন্থনাম কৃষ্ণকীর্তনরূপে লিখিত।”
নামকরণ সমস্যার নিরিখে কয়েকটি যুক্তি গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘কীর্তন’ শব্দটির অর্থ অনেক। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ''বঙ্গীয় শব্দকোষ''-এ ‘কীর্তন’ বলতে ঘোষণা, কথন, বর্ণন, বিবরণ, গুণকীর্তন, স্তবন ইত্যাদি অর্থ নির্দেশিত হয়েছে। ‘কীর্তন’ শব্দটির বৈষ্ণবীয় অর্থ-তাৎপর্য থেকে বের করে এনে যদি প্রয়োগ করা যায়, তাহলে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি অযোগ্য হয় না। যেহেতু উইলসন তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থের নামে ‘শ্রী’ শব্দটি যুক্ত করেননি এবং বাঙালি গবেষকেরাও ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামটিই উল্লেখ করেছেন, সেহেতু সত্যব্রত দে-র মতে বইটির নাম ''কৃষ্ণকীর্তন'' হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুক্তির গলদ হল এই যে, উইলসন যে সংস্কৃত ''কৃষ্ণকীর্তন''-এর কথা বলেছেন, তার লেখক গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি—চণ্ডীদাস নন। একটি ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এই মতটিকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন। ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামটিও এই প্রসঙ্গে বিচার্য। প্রাপ্ত রসিদটি আবিষ্কৃত পুথির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু সেই রসিদে বর্ণিত তথ্য যে উক্ত পুথি-সংক্রান্ত হবেই এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। রসিদে বলে হয়েছে যে, ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামক একটি পুথির ৯৫ থেকে ১১০ পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন নামে এক ব্যক্তি মহারাজের জন্য ধার করে নিয়ে গেলেন ১০৮৯ সালে অর্থাৎ ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর মাস দুয়েকের মধ্যেই পাতাগুলি ফেরৎ এল। ফেরৎ আসার পর খোয়া না যাওয়ার সম্ভাবনা, যেহেতু গ্রন্থাগারটিতে পুথি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা নেওয়া হত এবং যার প্রমাণ এই রসিদ। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ধার নেওয়া পাতাগুলির মধ্যে ৯৮/১ এবং ১০৪-১১০ পত্র অর্থাৎ মোট সাড়ে সাতটি পাতা নিখোঁজ। তাহলে অনুমান করতে হয়, অন্য কোনও পুথির ওই ১৬টি পত্র ধার নেওয়া হয়েছিল, যার রসিদটি কোনওভাবে চলে এসেছে এই পুথির মধ্যে। অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় এই ক্ষেত্রে অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, জীব গোস্বামী রচিত একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ''। এটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের একটি মূল্যবান গ্রন্থ। বিষ্ণুপুরে শ্রীনিবাস আচার্য রাজগুরু হিসেবে প্রভূত সম্মান পেয়েছিলেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। বৃন্দাবনের শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রীনিবাসের সাক্ষাৎ গুরু ছিলেন জীব গোস্বামী। বিষ্ণুপুরে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের গ্রন্থ প্রচারে একদা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন শ্রীনিবাস। ছোটো চিরকুটটির মধ্যে যে ‘আচার্য প্রভু’-র কথা আছে, তিনি এই শ্রীনিবাস আচার্য ছাড়া আর কেউ নন। তাই তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বিষ্ণুপুরের রাজা কোনও কারণে জীব গোস্বামীর ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ'' গ্রন্থেরই ১৬টি পাতা ধার নিয়েছিলেন এবং পরে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন। অতএব বসন্তরঞ্জনের প্রাপ্ত পুথিটির নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' হতে পারে না। তবু এই বিষয়ে কোনও পাথুরে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।
===পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা===
ভাগবতের কৃষ্ণকে অবলম্বন করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কাহিনি গড়ে উঠলেও এই কাব্যকে কোনও সমালোচকই অনুবাদ কাব্য বলে নির্দেশ করেননি। অথচ অনুবাদের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কৃত আদর্শ থেকে আখ্যানভাগ, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদি গৃহীত হয়ে থাকে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর কয়েকটি ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আসলে যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে অনুবাদ সাহিত্যের জন্ম বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত তার তাগিদ অনুভব করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক বৈষ্ণবধর্মের প্রতি তাঁর তেমন আনুগত্য ছিল না বলেই মনে হয়। ‘বাসুলী-সেবক’ অভিধাটিই চিনিয়ে দেয় তাঁর নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সেকালের শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বময় প্রেক্ষাপটে এই কাব্যকে উপদলীয় ধর্মবিদ্বেষের উৎসৃষ্টি বলে মনে হতেই পারে। কাব্যের নানা স্থানে তার প্রমাণও আছে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের নায়ক সম্পর্কে সকলেই প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে, এই কৃষ্ণ আদৌ বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা নন। পুরাণপুরুষ কৃষ্ণের আবরণে কবি আসলে প্রকাশ করেছেন নারীদেহ-লোলুপ এক ‘কামী’ গ্রাম্য গোপযুবককে, যে ছলনা, প্রতারণা ও বলপ্রয়োগ করে এক অনিচ্ছুক বিবাহিতা নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ‘গততৃষ্ণ’ হয়ে নির্দ্বিধায় তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমন অমানবিক পাশবিক চরিত্র দেবতার হতে পারে না। অর্বাচীন পুরাণে বর্ণিত রাধাও যেন রক্তমাংসের নারীতে পরিণত হয়েছেন এই কাব্যে, যার মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন ঘটেছে স্বামী-সংস্কারে আবদ্ধা কুলবধূ থেকে পরপুরুষের প্রেমসন্তপ্তা স্বাধীনভর্তৃকা প্রেমিকাতে। উল্লেখ্য, কবি একবারের জন্যও ‘দেবতা’ কৃষ্ণের কাছে প্রণত হচ্ছেন না, যেমন হয়েছিলেন তাঁর আদর্শ জয়দেব। পাঠক যেন তাঁর অঙ্কিত কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ স্ব-কল্পিত মনে না করে, তাই যেন কবি প্রচলিত পুরাণের সঙ্গে কৃষ্ণ চরিত্রের সম্পর্ক দেখিয়ে দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পুরাণ-বচন উদ্ধৃত করে কবি তাঁর বর্ণিত গল্পের সঙ্গে পৌরাণিকতার একটি প্রচ্ছন্ন যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। সেই সূত্রেই এসেছে ভাগবত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে সন্নিবেশিত নানা তথ্য। বিশেষ করে জন্মখণ্ড বর্ণনায় অনেকগুলি পুরাণ থেকে যে তিনি আখ্যানবস্তু আহরণ করে নিজের মতো করে সেগুলি বিন্যস্ত করেছেন তার প্রমাণ রয়েছে আখ্যান-বিন্যাসে। জন্মখণ্ডে কবি রচিত প্রথম সংস্কৃত শ্লোকটি হল:
<poem>
:: পৃথুভারব্যথাং পৃথ্বী কথয়ামাস নির্জ্জরান্।
:: ততঃ সরভসং দেবাঃ কংসধ্বংসে মনো দধুঃ।।
</poem>
এই প্রসঙ্গ বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ ও ভাগবত পুরাণেও আছে। তবে প্রত্যেকটি কাহিনিই কম-বেশি স্বতন্ত্র। যেমন, বিষ্ণুপুরাণে পৃথিবীকে বহুভারে পীড়িতা হয়ে সুমেরু পর্বতে দেবতাদের কাছে গিয়ে নিজের বেদনার কথা বিবৃত করতে দেখা যায়। পদ্মপুরাণে কংসের নিপীড়নের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। ভাগবত পুরাণে আছে বসুমতীর গোরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দুঃখ নিবেদনের সংবাদ। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে আছে দেবকীর সপ্তম পুত্রকে রোহিণীর গর্ভে মায়া দ্বারা সংক্রামিত করে অষ্টম গর্ভে নারায়ণের নিজে আবির্ভূত হওয়ার অঙ্গীকার। বড়ু চণ্ডীদাসও সেই তথ্য পরিবেশন করেছেন। এছাড়া নারায়ণ কর্তৃক দেবতাদের হস্তে কৃষ্ণ ও শুভ্রবর্ণের কেশ প্রদানের প্রসঙ্গও বিভিন্ন পুরাণ থেকে গৃহীত। অবশ্য এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, রাধার জন্মকাহিনি বর্ণনায় কবি পুরাণের পথ পরিহার করে স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। নারদের যে রূপ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অঙ্কিত হয়েছে, তারও উৎস কবির নিজস্ব কল্পনা। জন্মখণ্ড ছাড়া ভাগবতের স্পষ্ট প্রমাণ পড়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। ভাগবতে কথিত হয়েছে যে, ষোলো শত গোপিনী সঙ্গে কৃষ্ণ শরৎকালে একদা বিলাসে মত্ত হয়েছিলেন। এটি রাস নামে কথিত। বড়ু চণ্ডীদাসও এই কাহিনি অনুসরণ করেন। তাঁর রাধা এখন আর মিলনে অনিচ্ছুক নন। বরং বক্রদৃষ্টিতে ও বিচিত্র দেহভঙ্গিতে কৃষ্ণের কামনা উদ্রেক করতে যথেষ্ট পটিয়সী। অন্যান্য গোপিনী থাকা সত্ত্বেও রাধাতেই যেন কৃষ্ণের সফল তৃপ্তি। তবুও রাধার অনুরোধে সব সখীদের তৃপ্ত করার প্রতিশ্রুতির দেন কৃষ্ণ। অতঃপর বনের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়। ভাগবতেও আছে:
<poem>
:: অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বর।
:: যন্নো বিহায় গোবিন্দ প্রীত যামনয়দ্রহঃ।।
</poem>
তবে ভাগবতের ঘটনাক্রম অনুসরণ করেননি বড়ু চণ্ডীদাস। ভাগবতের রাস অনুষ্ঠিত হয়েছিল কংসবধের পরে, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ রাস হল কংসবধের পূর্বেই। তাছাড়া ভাগবতের রাস শরৎকালীন এবং নিশাকালে সম্পন্ন, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে দিবাকালীন বাসন্তী রাসের বর্ণনা। এক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জয়দেবের দ্বারা। ''গীতগোবিন্দম্''-এর দু-একটি পদের আক্ষরিক গীতানুবাদও রয়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। যেমন, “রতি তোর আশোআশেঁ গেলা অভিসারে” ইত্যাদি। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কৃষ্ণের বৃন্দাবন-বিলাস একান্তভাবেই ভাগবত-বর্ণিত রাতের অনুকরণজাত। ভাগবতের সঙ্গে এই কাব্যের মিল আছে কালীয়দমনখণ্ডের কাহিনিতেও। দুই গ্রন্থেই কালীদহের জলে নেমে কৃষ্ণ কর্তৃক কালীয়নাগ দমনের প্রসঙ্গ আছে। তবে বড়ু চণ্ডীদাস উদ্দেশ্যের ভিন্নতা দেখিয়েছেন। ভাগবতকার যেখানে কালীদহের বিষাক্ত জল বৃন্দাবনবাসীর ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য কৃষ্ণকে নাগদমনে নিয়োজিত করেছেন, সেখানে বড়ু চণ্ডীদাস দেখাতে চেয়েছেন যে, সখীদের নিয়ে জলক্রীড়ার করার জন্য কালীদহ বিষমুক্ত করতে কৃষ্ণ সেই জলাশয়ে ঝাঁপ দেন। অচৈতন্য কৃষ্ণের আত্মজ্ঞান ফেরানোর জন্য বলরামের দশাবতার স্তবের মধ্যে ক্রম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এই কাব্যে। বরাহপুরাণে কৃষ্ণের নাম আছে অষ্টম স্থানে, সেখানে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কাহিনির প্রয়োজনে তা সবশেষে উল্লিখিত। বস্ত্রহরণের প্রসঙ্গটিও ভাগবত থেকে নেওয়া। তবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বস্ত্রের সঙ্গে কৃষ্ণ রাধার হারও চুরি করে নেয় এবং সব কিছু ফিরিয়ে দিলেও হারটি নিজের কাছে রেখে দেয়। এই তথ্য ভাগবতে নেই। আখ্যানের বাইরেও পুরাণের প্রভাব আবিষ্কার করা যায় কবি কর্তৃক নানা পৌরাণিক প্রসঙ্গের অবতারণায়। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে উপমা ও উৎপ্রেক্ষা স্বরূপ এগুলি সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন তিনি। পরদারাসক্তির সমর্থনে কৃষ্ণের উক্তিতে এসেছে কুন্তী, রম্ভা ও গঙ্গার প্রসঙ্গ। এর বিপক্ষে রাধা উদাহরণ দিয়েছেন সোম-তারা, ইন্দ্র-অহল্যা ও চণ্ডী কর্তৃক সুন্দ-উপসুন্দ বধের। পুরাণশাস্ত্রে কবির পাণ্ডিত্যের প্রমাণ এগুলি। কিন্তু এইসব দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কৃষ্ণমাহাত্ম্যমূলক কাব্য নয়। পুরাণের পরিচিত গল্পকে আশ্রয় করে কবি এতে লৌকিক জীবনের পরিচয়ই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মৌলিকতা দেখিয়েছেন রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্র চিত্রণে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের তেরোটি খণ্ডের মধ্যে মোট চার-পাঁচটি খণ্ডে পুরাণের প্রভাব বাদ দিলে অবশিষ্ট খণ্ডগুলি কম-বেশি কবির স্ব-কল্পিত। বিশেষত তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড, ভারখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড পুরোপুরি কবির নিজস্ব উদ্ভাবনা। এগুলির কোনও সাহিত্যিক উৎস নেই। আখ্যান-সূত্রে বোঝা যায়, জন্মখণ্ডের পর কাহিনিকে কবি লোকসমাজের রুচি অনুযায়ী পরিবর্তিত করে নেন। দেবতাদের অনুরোধে কৃষ্ণ পৃথিবীতে আসেন বটে, তবে তাঁর মুখ্য কাজ কংসবধ আপাতত গৌণ হয়ে যায়, পরিবর্তে রাধার দেহসম্ভোগে তিনি মত্ত হয়ে ওঠেন। তার জন্য ছলনা, চাতুরী, কৌশল, বলপ্রয়োগ কোনও কিছুতেই দ্বিধা নেই তাঁর। লম্পট পুরুষের মতোই কৃষ্ণের হাবভাব, গ্রাম্য গোঁয়ারের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ তাঁর কথাবার্তা। জন্মখণ্ডের কর্তব্যপরায়ণ নারায়ণের সঙ্গে এই কৃষ্ণকে কোথাও মিলিয়ে নেওয়া যায় না। পাশাপাশি এটাও দেখা যায় যে, কবি কৃষ্ণকে পদ্মনাভ, চক্রপাণি, গদাধর ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে পুরাণের অনুসরণ করেছেন, আবার অন্যদিকে মগর-খাড়ু পরিয়ে, হাতে লগুড় ধরিয়ে গ্রাম্য যুবকে রূপান্তরিত করেছেন। এই বিষয়ে ড. সত্যবতী গিরি তাঁর ''বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ'' গ্রন্থে লিখেছেন, “গ্রামীণ সাধারণের রুচিকে পরিতৃপ্ত করার জন্যই কবি কৃষ্ণের এই গ্রাম্যরূপ অঙ্কন করেছেন। নিঃসন্দেহে এটিও কবির লোকমুখিতারই প্রমাণ।” (পৃ. ৬৫)
রাধার ক্ষেত্রে কবি অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। তার জন্মকাহিনি কোনও পুরাণকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠেনি। বস্তুত ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ কিংবা হরিবংশে রাধার উল্লেখও করা হয়নি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধা কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী, যা অন্য কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে দেখা যায় না। এই পুরাণে রাধার পিতামাতার পরিচয়ও আছে। তিনি বৃষভানু ও কলাবতীর কন্যা। আবার পদ্মপুরাণে রাধার মায়ের নাম কীর্তিকা বা কীর্তিদা। বড়ু চণ্ডীদাস এসবের সঙ্গে পরিচিত হয়েও এক নতুন সংবাদ দিলেন—কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্য দেবগণের নির্দেশে লক্ষ্মী রাধা হয়ে এলেন। তাঁর পিতা সাগর গোপ, মাতা পদ্মা। রাধাকে কবি প্রথমাবধিই আত্মবিস্মৃত করে রাখলেন। সেই সঙ্গে লৌকিক জনশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর বিবাহ দিলেন নপুংসক আইহনের সঙ্গে। ফলে কাহিনির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অবকাশ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে নাটকীয়তা। সতীত্ব-সংস্কারে বাঁধা বিবাহিতা রাধার সঙ্গে দেহলোভী কৃষ্ণের বাগবিতণ্ডা বেশ জমে উঠেছে। রাধার এই কৃষ্ণ-বিমুখতা কবির নিজস্ব কাব্যভাবনার ফসল। তাম্বুলখণ্ডে বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে কৃষ্ণের কামাসক্ত হওয়া এবং বড়ায়িকে দিয়ে তাম্বুল প্রেরণ, রাধা কর্তৃক বড়ায়ির অপমান এবং ক্রুদ্ধ বড়ায়ির কৃষ্ণকে রাধা-লাঞ্ছনার মন্ত্রণা দান কোনও পুরাণেই নেই। আসলে কবি জয়দেবের কাব্য থেকে রাধার পূর্ণায়ত ছবিটি গ্রহণ করলেও তাতে সামাজিকতার রং চড়িয়ে তাঁকে অনেক বেশি বাস্তবের নারী করে তুলেছেন। এই রাধার মধ্যে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, কামনা-বাসনা, রিরংসা, লোভ, দুঃখ-বেদনা সবই পুঞ্জীভূত হয়েছে। দানখণ্ডের আখ্যানেও দেখা যায়, কৃষ্ণের দানী সেজে বসা, মথুরার ঘাটে তর্ক করা, রাধার দই-দুধ নষ্ট করা, পরিশেষে তাঁর দেহসম্ভোগ পুরাণ-বহির্ভূত বিষয় হিসেবে কাহিনিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেছে। নৌকাখণ্ডে নৌকার মাঝি সেজে ছল করে রাধাকে সম্ভোগ করতে, ছত্রখণ্ড ও ভারখণ্ডে সঙ্গমলোভে দই-দুধের পসরা বহন করতে এবং রাধার মস্তকে ছত্রধারণ করতে দেখা যায় কৃষ্ণকে। হারখণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার হার চুরি, ক্ষুব্ধ রাধার যশোদার কাছে নালিশ, তিরষ্কৃত কৃষ্ণের বাণ মেরে রাধাকে মূর্চ্ছিত করা এবং বড়ায়ির ভর্ৎসনায় রাধার চেতনা সম্পাদন করাও কবির নিজস্ব কল্পনা। বংশীখণ্ডে বাঁশির শব্দে গৃহস্থালির কাজ-ভোলা রাধার ছবি অনবদ্য। এর জন্য কবির কোথাও কোনও ঋণ নেই। বড়ায়ির পরামর্শে রাধা যে কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে আবার ফিরিয়ে দেয় তারও কোনও প্রাচীন উৎস নেই। রাধাবিরহ অংশে বড়ায়িকে বারবার কৃষ্ণ এনে দেওয়ার অনুরোধ, এমনকি শেষ সম্ভোগের পর বড়ায়ির হাতে রাধাকে সমর্পণ করে কৃষ্ণের প্রস্থানও কবির স্ব-কল্পিত। এগুলির একটিও পুরাণ-বর্ণিত ঘটনা নয়। আর এই অংশগুলিতে অশ্লীলতা ও গ্রাম্যতা দোষেরও আধিক্য দেখা যায়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গটিও একটি বিচার্য বিষয়। মনে রাখতে হবে, এই কাব্য রাজসভার সাহিত্য নয়, গ্রাম্যের অখ্যাত অশিক্ষিত অপরিশীলিত সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যেই এর রচনা। যে পাশ্চাত্য প্রভাবজাত মার্জিত সাহিত্যবোধের আধুনিক পাঠক সাহিত্যকে বিচার করেন, পঞ্চদশ শতকের বাংলায় তার আবির্ভাব ঘটেনি। বরং ভারতীয় সাহিত্যের আদিরসকেই এই কাব্যে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন ভারতে যৌনতাকে বিশিষ্ট জ্ঞানশৃঙ্খলা হিসেবে পাঠ করার রীতি ছিল, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''। তাছাড়া ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের রতিই প্রথম ভাব, রসের আদিতে দাঁড়ায় শৃঙ্গার রস। কৃষ্ণের ন্যায় দেবচরিত্রে কলঙ্কের কথা যদি তোলা হয়, তাহলে বলতে হবে সমান দোষে দুষ্ট পুরাণকারও। তাঁরাও দেবরাজ ইন্দ্রকে অগম্যাগামী লম্পট পুরুষ রূপে চিত্রিত করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রতিবেশে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কাব্যে ধর্মের আবরণে আসলে কবি শুনিয়েছেন সমকালের জীবনকথা। রাধা ও কৃষ্ণের পৌরাণিক ঐতিহ্যমণ্ডিত নামগুলি সরিয়ে ফেলতে পারলেই সারা কাহিনিতে অনুভব করা যাবে পঞ্চদশ শতকের বাঙালি সমাজকে। তখন কৃষ্ণ আর ঐশী সত্তা থাকেন না, হয়ে পড়েন সামন্ততান্ত্রিক পুরুষ-শাসিত সমাজের ব্যভিচার-দুষ্ট পুরুষ, যে নারীকে লাঞ্ছিত করে কেড়ে নেয় তার নিজস্ব সম্পদ, সামাজিক বলদর্পিতায় পিষ্ট করে নারীর স্বাধীন সত্তা। বুঝতে অসুবিধাই হয় না, বড়ু চণ্ডীদাস আসলে তাঁর কালের ধৃষ্ট কামুক পুরুষ ও লাঞ্ছিতা নারীর কথাই বলতে চেয়েছেন তাঁর কাব্যে, কেবল কালের অনুরোধে তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছে ধর্মের আবরণ। ধর্মের এই অনাবশ্যক অংশটুকু বাদ দিলেই কৃষ্ণকথা পরিণত হতে পারত বিশুদ্ধ মানবকথায়, এবং বাঙালি পাঠক সেদিনই লাভ করতে পারত আধুনিক সাহিত্যের স্বাদ।
===চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি===
আখ্যানধর্মী সাহিত্যে চরিত্র এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাহিনি স্থূল ঘটনামাত্রের বিবরণ নয়, তার পিছনে থাকে পাত্রপাত্রীর সচেতন চিন্তা ও ক্রিয়া। চরিত্র বিবর্তিত হয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কখনও ঘটনা চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, কখনও চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে ঘটনাকে। এইভাবে তৈরি হয় দ্বন্দ্বময়তা, আখ্যানে আসে গতি। ঘটনা ও চরিত্রের আপেক্ষিক প্রাধান্য বিচার করলে দেখা যায়, মধ্যযুগের কবিরা ঘটনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, চরিত্রের অন্তঃরহস্য উদ্ঘাটনে ততটা যত্নবান হননি। অথচ চরিত্র-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তাঁদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হত, যেহেতু তাঁদের কাব্যের আখ্যানবৃত্ত ছিল পূর্বনির্ধারিত। অল্প যে কয়েকজন কবি এর ব্যতিক্রম বড়ু চণ্ডীদাস তাঁদের অন্যতম। আখ্যান-বিন্যাসে যেমন তিনি পুরাণকে অতিক্রম করে মৌলিকতার সাক্ষর রেখেছেন, তেমনই চরিত্রগুলিও তাঁর হাতে পেয়েছে অন্য মাত্রা।
====কৃষ্ণ====
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রটি সম্পর্কে শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ''মধ্যযুগের কবি ও কাব্য'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শ্রেষ্ঠত্বের সবটুকু আত্মসাৎ করিয়াছে রাধা। যাহার নাম কীর্তন করিতে কাব্যটির রচনা সেই শ্রীকৃষ্ণই উহার দোষের আশ্রয়। কাব্যটির যত কিছু দুর্নাম কৃষ্ণের জন্যই।” এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে দুটি কথা বলা যায়। প্রথমত, বড়ু চণ্ডীদাস যে কৃষ্ণের মাহাত্ম্যকীর্তনের জন্য কাব্য রচনা করেননি তার প্রমাণ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এই পাওয়া যায়। তাছাড়া এই কাব্যের নামকরণও যে কবিই করেছেন, তার কোনও উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, কাব্যের দোষ কাব্য-বর্ণিত কোনও চরিত্রের স্বভাব বা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না, করে অলংকারশাস্ত্রে কথিত নানা মানদণ্ডের উপরে। রসাভাসে বা অঙ্গীরসের পরিস্ফুটনে বাধা সৃষ্টি হলে কাব্যে দোষ দেখা যায়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এইসব ত্রুটি থেকে মুক্ত। আসলে এই কাব্যের কৃষ্ণ জয়দেবের ধীরললিত নায়ক কিংবা চৈতন্য-পরবর্তী যুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্বময় কৃষ্ণ নয় বলে পাঠকের অভ্যস্থ রসসিদ্ধ সংস্কারে আঘাত লাগে। এই কৃষ্ণ শাস্ত্রবর্ণিত দেবতা নয়, বরং কবির সমাজবোধ-প্রসূত রক্তমাংসের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে দেবত্বের মোড়কে তিনি তাঁর যুগের লম্পট মানবিকতাবোধশূন্য কামুক পুরুষকেই হাজির করেছেন কাব্যের কাঠামোয়। অর্থাৎ কৃষ্ণ চরিত্র চিত্রণে কবিকে দুই দিক সামলে চলতে হয়েছে। একদিকে তাঁকে রক্ষা করতে হয়েছে কৃষ্ণের প্রথাগত দেবতা এবং অনুদিকে তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে তাঁর সমকালের সাধারণ মানুষের বাস্তব আচরণকে। এইভাবে জোড়াতালি দিতে গিয়ে তিনি যে সব দিকে সঙ্গতি রক্ষা করতে পেরেছেন তা নয়, তবে তাঁর চেষ্টার মধ্যে যে আন্তরিকতা ও অভিনবত্ব ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জন্মখণ্ড থেকে রাধাবিরহ পর্যন্ত সর্বত্রই কৃষ্ণের উপস্থিতি। তবে প্রথম দিকে সেই উপস্থিতি যতটা সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ, শেষ দিকে তা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে কৃষ্ণকে অবলম্বন করে মুখ্যত রাধা চরিত্রেরই বিকাশ দেখিয়েছেন কবি।
জন্মখণ্ডের কৃষ্ণ ঐশী ভাবান্বিত এক পরম সত্তা। পুরাণপুরুষের আবির্ভাব কাহিনি এখানে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে পুরাণের অনুসরণ করেই। কৃষ্ণের প্রথাগত দেবত্ব রক্ষা করা হয়েছে পুতনা-বধ, যমলার্জুন ভঙ্গ ও কেশী দানব বিনাশের পৌরাণিক কাহিনির অবতারণায়।
ভাগবতের এই ঐশ্বর্যময় কৃষ্ণ তাম্বুলখণ্ডে এসে হঠাৎ প্রকৃতি বদল করে ফেলে। এখান থেকেই সে পরিপূর্ণ গ্রাম্য গোপযুবক। সে উদ্ধত, হঠকারী, একগুঁয়ে, হৃদয়হীন ও নারীদেহ-লোলুপ। ভূ-ভার হরণের জন্য যে তার আবির্ভাব সে কথা সে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে সে এক লালসাদীপ্ত কামুকে পরিণত। তার সমস্ত প্রচেষ্টার মধ্যে রাধাকে করায়ত্ত করার বাসনাই প্রকট। প্রথমে তাম্বুল প্রেরণ করে সে ভদ্রভাবে মিলনের প্রস্তাব জানায়, রাধা তা অপমান করে প্রত্যাখ্যান করলে সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেয় ছলে বলে কৌশলে করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়ে। এই দুটি খণ্ডে তো বটেই, ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডেও কৃষ্ণের দেবত্ব তলানিতে এসে ঠেকে যখন সে ‘সুরতি’ লাভের লোভে সমস্ত মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে রাধার দই-দুধের ভার বহন করে এবং তার মাথায় ছত্রধারণ করে।
বৃন্দাবনখণ্ডের কৃষ্ণ কিছুটা জয়দেব-অনুসারী, তবু কবি এখানে কৃষ্ণ চরিত্রে বিশিষ্টতা এনেছেন। জয়দেবের কাব্যভাষার অনুবাদ যেন কৃষ্ণের মুখে, “তোহ্মে সে মোহোর রতন ভূষণ তোহ্মে সে মোহোর জীবন”। আবার জয়দেবের কৃষ্ণ রাধাকে ত্যাগ করে অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে বিহার করলেও বড়ু চণ্ডীদাসের কৃষ্ণ রাধার অনুরোধে গোপিনীদের সঙ্গে বিহাররত।
কালীয়দমনখণ্ডে কবি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে নিয়ে যান পুরাণবৃত্তে। জলক্রীয়ায় ইচ্ছুক কৃষ্ণ বীরত্ব সহকারে বিষাক্ত জলে নেমে দর্পের সঙ্গে কালীয়নাগ দমন করে। ভাগবতের কাহিনি হলেও দুষ্ট কৃষ্ণের আর-এক রূপ পাওয়া যায় বস্ত্রহরণখণ্ডে। কবি গ্রাম্য আচরণে অভ্যস্থ যৌবনলোভী যুবকের ছবি এঁকেছেন এখানে। রাধার আকুতিতে তার বসন ফিরিয়ে দিলেও কৃষ্ণ হার গোপন রাখে। রাধা অভিযোগ জানান যশোদার কাছে। মায়ের কাছে ভর্ৎসিত কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে সে বাণখণ্ডে হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়ে রাধাকে বাণে সংজ্ঞাহীন করে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের এই পর্যায় থেকে দেখা যায়, রাধার প্রতি কৃষ্ণের পূর্বের আকর্ষণ প্রায় তিরোহিত। এর সঙ্গত কারণ কবি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। যে যৌন-আকাঙ্ক্ষা প্রথমাবধি কৃষ্ণকে চালিত করেছে, এখন তার পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে কৃষ্ণ রাধার প্রতি বিগতস্পৃহ হয়ে পড়েছে। ‘কামী’ কৃষ্ণ এখন ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পরিণত। তাই রাধার সামান্য অপরাধ সে ক্ষমা করতে পারে না। তুচ্ছ কারণে সে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না রাধার কাছ থেকে। কৃষ্ণের এই নির্মমতা সত্যই সমালোচনার যোগ্য। তাই দেখা যায়, যে বড়ায়ি এতদিন কৃষ্ণকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে রাধার সতীত্বের দর্প চূর্ণ করতে সাহায্য করেছে, এখন সেই বর্ষীয়সী অভিভাবিকাই তিরস্কার করছে ‘দেব বনমালী’ রাধাকে সংজ্ঞাহীন করে দিয়েছে বলে। বড়ায়ি ভর্ৎসনা না করলে কৃষ্ণ রাধার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনত কিনা সন্দেহ।
রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের এই শীতলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে। এতক্ষণ কৃষ্ণের আচরণ অভব্য ও অশালীন ছিল বটে, কিন্তু শিশুসুলভ ছিল না। কিন্তু বংশীখণ্ডে দেখা গেল পূর্বাপরসঙ্গতিবিহীন এক কৃষ্ণকে। সে নিস্পৃহ চিত্তে একাকী বৃন্দাবনে বসে বাঁশি বাজায়। সে বাঁশির শব্দে রাধার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণকে না পেয়ে বড়ায়ির পরামর্শে রাধা বাঁশি চুরি করে। বাঁশি না পেয়ে কৃষ্ণ অবোধ বালকের মতো কাঁদতে থাকে। শেষে বড়ায়ির বুদ্ধিতে করজোড়ে রাধা ও গোপীদের কাছে করুণ স্বরে বাঁশি ফেরৎ চায় সে। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণ চরিত্রের পূর্বের গাম্ভীর্যটুকু সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে এখানে।
রাধাবিরহেও কৃষ্ণ চরিত্র একই রকম সামঞ্জস্যহীন। রাধার বিষয়ে তার ক্রমবর্ধমান অনীহা খণ্ডটির প্রথম ও শেষ দিকে বজায় থাকলেও মধ্যাংশে, বিশেষত মিলনের পর, কৃষ্ণের আচরণ বিস্ময়করভাবে অন্য রকম। বড়ায়ির অনুরোধেই কৃষ্ণ মথুরা ছেড়ে বৃন্দাবনে এসেছে কেবল রাধার সঙ্গে মিলিত হতে। লক্ষণীয়, কৃষ্ণ এবার নিষ্ঠুর হয়েও পুরোপুরি নির্মম হতে পারেনি। মিলনকালে তো বটেই, মিলনের পরেও কৃষ্ণের কয়েকটি আচরণ বেশ অপ্রত্যাশিত। সে তৎক্ষণাৎ স্থান পরিত্যাগ করে না, রতিক্লান্ত সঙ্গিনীর পরিচর্যা করে:
<poem>
:: নব কিশলয়ত শয্যা রচিল।
:: নিজ উরুতলে তাক নিশ্চলে রাখিল।।
</poem>
নিদ্রিতা রাধার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্যও কৃষ্ণের কত আয়াস। মথুরায় যাওয়ার আগে বড়ায়ির হাতে রাধাকে অর্পণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে যায় সে। কামুক কৃষ্ণের এই হঠাৎ জেগে-ওঠা কর্তব্যবোধের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমগ্র ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কেবল এই অংশটুকুতে প্রেমিক কৃষ্ণ এক ঝলক উঁকি দিয়েই চিরতরে হারিয়ে যায়। গ্রন্থ শেষ হয়েছে রাধার প্রতি বিতৃষ্ণ কৃষ্ণের উক্তিতে:
<poem>
:: শতকী না কর বড়ায়ি বোঁলো মা তোহ্মরে।
:: জায়িতেঁ না ফুরে মন নাম শুণী তারে।।
:: যত দুখ দিল মোরে তোম্ভার গোচরে।
:: হেন মন কৈলোঁ আর না দেখিবোঁ তারে।।
</poem>
কৃষ্ণের এই হৃদয়হীন উক্তি ও আচরণ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কারণ, এ কাব্যে সে স্বর্গের দেবতা নয়, দেবতার খোলসে ঢাকা রক্তমাংসের কামতাড়িত দোষগুণান্বিত পার্থিব মানুষ।
====রাধা====
বড়ু চণ্ডীদাসের খ্যাতি মূলত তাঁর রাধা চরিত্রটির জন্য। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রাধা তত্ত্ব বা পুরাণ-সম্ভূত চরিত্র নয়, একজন সামান্যা নারী। কিন্তু সৃষ্টিকৌশলে সে হয়ে উঠেছে অসামান্যা। প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে রাধার নাম নেই; অর্বাচীন পুরাণেও তথ্যে নানা পার্থক্য দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস রাধার জন্মেতিহাস রচনা করেছেন নিজের মতো করে। বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী “কাহ্নাঞির সম্ভোগ কারণে” দেবতাদের নির্দেশে রাধা দেহ ধারণ করে মর্ত্যে আবির্ভূতা। কিন্তু স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কাব্যের দ্বন্দ্ব আকর্ষণীয় করতে কবি তাকে করেছেন আত্মবিস্মৃত। লোকশ্রুতিতে রাধা নপুংসক আইহনের পত্নী। সেই লোকশ্রুতি অনুসারেই কবি অল্পবয়সী বিবাহিতা রাধার দাম্পত্যজীবনের ছবি এঁকেছেন। সেই সূত্রে রাধার চারপাশে তৈরি হয়েছে একটি সামাজিক পরিচিতির বলয়, বাস্তব সংসারের রমণীর লৌকিক সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, রাগ-দেষ, আবেগ-আর্তি, বিশ্বাস-সংস্কার তার মধ্যে নিহিত। অথচ বড়ু চণ্ডীদাস যাঁর দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত সেই জয়দেবের কাব্যে রাধা কল্পলোকসম্ভব রোম্যান্টিক নায়িকার গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেনি। আসলে বাস্তব-সচেতন জীবনশিল্পীর চোখ দিয়েই কাব্যের চরিত্রকে দেখতে চেয়েছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস; কোনও তত্ত্ব, আবেগ বা ভাবাতিরেক তাঁকে চালনা করেনি। এইজন্য পদাবলির চণ্ডীদাসের রাধা কেবল কৃষ্ণনাম শ্রবণেই মিলনোৎকণ্ঠায় কালযাপন করেন, কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা সতীত্ব-সংস্কারের তাড়নায় প্রথমে কৃষ্ণের কুপ্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। রাধার এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কারণ কবি তাকে পঞ্চদশ শতকের বাংলার পুরুষশাসিত সমাজে স্থাপন করে তার সংকট, সীমাবদ্ধতা, আনন্দ, আবেগ, ক্রোধ, মোহ ইত্যাদিকে মূর্ত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। একজন দক্ষ মনস্তাত্ত্বিক শিল্পীর মতো এই চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনেও যত্নবান হয়েছেন তিনি। কৃষ্ণের অনাবৃত কামবাসনার সূত্রে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে যৌন-মনস্তত্ত্বও। এক রতি-অনভিজ্ঞা নারীর ক্রমশ দেহসুখের মধ্যে দিয়ে প্রেমের অমরাবতীতে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রাপথ চিত্রিত হয়েছে এখানে। প্রেম শিকড়হীন কল্পলতা বা নিরালম্ব কোনও মানসিক আবেগ নয়, তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে দেহভাবনা—এই বিশ্বাসে ভর করেই কবি রাধাকে রূপ দিয়েছেন, নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন তার সঙ্গতিপূর্ণ বিবর্তন।
বড়ু চণ্ডীদাস রাধার উদ্দেশ্যে যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন, তাতেই রাধার রূপলাবণ্যের কমনীয়তা ধরা পড়েছে। নাবালিকা কুলবধূ এই রাধা ‘শিরীষকুসুম কোঁঅলী’, ‘অদ্ভুত কনকপুতলী’ ও ‘তীনভুবনজন মোহিনী’। কিন্তু সাধারণ গোপরমণী হিসেবে সংসার নির্বাহ করতে মথুরার হাটে তাকে দই-দুধ বেচতে যেতে হয়। তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত বড়ায়ির। এই বড়ায়ির মুখে রাধার রূপলাবণ্যের কথা শুনে কৃষ্ণ তাম্বুল দিয়ে মিলনের প্রস্তাব জানালে সতীত্ব-সংস্কারে আবদ্ধা রাধা ক্ষিপ্ত হয়। বড়ায়িকে সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়:
<poem>
:: ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর আছে সুলক্ষণ দেহ।
:: নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা।।
</poem>
বীরপত্নী হওয়ার গর্বও তার কম নয়। সে বড়ায়িকে প্রহার করে তাম্বুলে লাথি মেরে প্রকারান্তরে কৃষ্ণকেও অপমান করে। বস্তুত দেহ-মনের দুর্বলতাহীন এই সতীত্ববোধ ভারতীয় নারীর চিরকালের সম্পদ। রাধার আত্মমর্যাদাপূর্ণ বলিষ্ঠ ঘোষণা তাকে স্বতন্ত্র নারীব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। কিন্তু যে সমাজ স্বৈরাচারী পুরুষের অধীনে, সেই সমাজে নারীর এই স্বাধীন অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। রাধার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কৃষ্ণে একে কামাতুর, তার উপর সামান্য নাবালিকা কর্তৃক অপমানিত। লাঞ্ছিতা বড়ায়িও তারই পক্ষে। অতএব দানখণ্ডে প্রবল তর্কাতর্কির পর কৃষ্ণের গায়ের জোরের কাছে সহজেই হার হয় রাধার। মথুরার ঘাটে কপট দানী কৃষ্ণ জোর করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়। মিলনের পূর্বে সে কৃষ্ণকে বারবার সাবধান করে দেয় যেন তার অঙ্গসজ্জা নষ্ট না হয়। অর্থাৎ এই মিলনকে সে গোপন রাখতে চায়। নৌকাখণ্ডে আবার ছলনাময় কৃষ্ণের ফাঁদে ধরা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয় রাধাকে। তবে এবার ভয় ও লজ্জা মিশ্রিত এক আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার মনে। অনিচ্ছা ও ক্ষীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাধার মনে কোথাও যেন মিলনসুখের অঙ্কুর দেখা দেয়: “রাধার মনত তবেঁ জাগিল মদন”। তাই এবারের মিলনের কথা রাধা গোপন করে বড়ায়ির কাছে, কৃষ্ণের অত্যাচারের কথা চেপে গিয়ে বরং তার উপকারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে:
<poem>
:: ডুবিআঁ মরিতোঁ যবেঁ না থাকিত কাহ্নে।
:: আত্মা লআঁ সান্তরিআঁ রাখিল পরাণে।।
:: এবার কাহ্নাঞিঁ বড় কৈল উপকার।
:: জরমেঁ সুঝিতেঁ নারোঁ এ গুণ তাহার।।
</poem>
এখন থেকে রাধা কৃষ্ণের কাছে তার মূল্য বোধে, অনুমান করতে পারে কৃষ্ণের দুর্বলতাও। সেই অভিজ্ঞতাকেই রাধা এবার দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডে। ‘সুরতি’ দানের লোভ দেখিয়ে ভার ও ছত্র বহন করায় বটে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রত্যাশা পূরণ করে না। আবার এটাও লক্ষণীয় যে, এক নপুংসকের স্ত্রী হিসেবে উদ্ভিন্নযৌবনা রাধার মধ্যে পরপুরুষের দেহসম্বন্ধের ফলে জাত কামবাসনা পরিতৃপ্তির জন্য অন্য কোনও বৈধ পথও খোলা নেই। অতএব নৌকাখণ্ডে অঙ্কুরিত দেহচেতনা এবার বৃন্দাবনখণ্ডে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। কৃষ্ণ নয়, এবার রাধা নিজেই মিলনাকাঙ্ক্ষী হয়ে বড়ায়ির কাছে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। এমনকি বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্য শাশুড়ির অনুমতি লাভে নতুন কৌশল ফাঁদে। কৃষ্ণ অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে বিহার করলে রাধার মনে মানের উদয় হয়। প্রেমে অধিকারবোধ না জন্মালে তথা প্রেম পরিপক্ক না হলে এই মান বা ঈর্ষা জাগ্রত হওয়া সম্ভব নয়। কালীয়দমনখণ্ডে আরও একধাপ এগিয়ে যায় রাধা। কৃষ্ণ মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লে আতঙ্কিত রাধা সর্বসমক্ষে ‘পরাণ পতী’ বলে উল্লেখ করে; কৃষ্ণবিহনে যে তার ধন-জন, জীবন-যৌবন সবই বিফল সে-কথাও জানায় বিলাপের কালে।
পরবর্তী দুই খণ্ডে অবশ্য রাধা চরিত্র একটু খাপছাড়া। কেউ কেউ একে “মানের এক এক পর্যায়” বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু হারখণ্ডে যশোদার কাছে রাধার নালিশ জানানোর ঘটনাটিকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। সম্ভবত কাহিনির প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চরিত্রাঙ্কন করতে গিয়েই এই ত্রুটি ঘটেছে। যাই হোক, যশোদা কর্তৃক তিরস্কৃত কৃষ্ণ এবার নির্মম হয়ে ওঠে এবং পূর্বসম্বন্ধ একপ্রকার বিস্মৃত হয়েই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফুলশর দিয়ে রাধাকে মূর্চ্ছিত করে। পরবর্তী দুই খণ্ডে যে মিলন-ব্যাকুল রাধাকে দেখা যায়, সেও এই পুষ্পধনুর অদৃশ্য প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে। কারণ, এর আগে রাধাকে এতটা বিহ্বল হতে দেখা যায়নি। এবার তার দ্বিধা, সংকোচ, জড়তা কিছুই নেই। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বংশীখণ্ডের ও রাধাবিরহের রাধা তীব্রভাবে দেহবাসনাকেই তুলে ধরেছে। কৃষ্ণের মোহনবাঁশির স্বর তাকে উন্মনা করে, মিলনে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু কোথাও প্রিয়তমকে না পেয়ে সুযোগ বুঝে বাঁশি লুকিয়ে রেখে মনের যন্ত্রণা লাঘব করতে চায় সে। আবার কৃষ্ণের আকুল অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাঁশি ফেরৎ দিতেও সে দ্বিধা করে না।
রাধাবিরহের অধিকাংশ পদেই ক্রন্দনরতা রাধার বিরহের দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রাধাবিরহ অংশে রাধার যে বেদনা তাহা নিতান্ত ব্যক্তিগত বেদনা নয়। বেদনার সুর ব্যক্তিকে অতিক্রম করিয়া সর্বকালের সর্বদেশের বিরহ-বেদনার সুরের সহিত মিলিত হইয়াছে।” এই রাধার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে পদাবলির ভাবতন্ময়া পূর্বরাগাশ্রিতা রাধার। কিন্তু এই পর্যায়েও রাধার আবেগ দেহকে অতিক্রম করে অপার্থিব প্রেমের পথে অগ্রসর হতে পারেনি। প্রমাণ বড়ায়ির উক্তি, কৃষ্ণের বিদ্রূপ এবং রাধার নিজের আক্ষেপ। রাধা যখন বারবার কাতর হয়ে কৃষ্ণকে এনে দেওয়ার অনুরোধ জানায়, তখন অভিজ্ঞা বৃদ্ধা বড়ায়ি তার এই সুগভীর আর্তির পিছনে কিসের উত্তেজনা তা বুঝতে পারে। একদিন যে কৃষ্ণের মিলন-প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, এখন তাকে আঘাত দিয়ে বড়ায়ি বলে:
<poem>
:: এবেঁ ঘুসঘুসাআঁ পোড়ে তোর মন।
:: পোটলী বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন।।
</poem>
রাধা বড়ায়ির কাছে যে কথা জানিয়ে কৃষ্ণকে আনার অনুরোধ করেছে সেগুলির মধ্যে কয়েকটি এইরকম: "আয়িস ল বড়ায়ি রাখহ পরাণ সহিতেঁ নারোঁ মনমথবাণ।।", "ঝাঁট করি কাহ্নাঞিঁ আনাওঁ। রতি সুখে রজনী পোহাওঁ।।", "পীন কঠিন উচ তনে কাহ্নাঞি পাইলেঁ দিবোঁ আলিঙ্গনে।।", "উন্নত যৌবন মোর দিনে দিনে শেষ"। এগুলি কামোন্মত্ত বিহ্বল দেহসুখপ্রত্যাশী নারীর কথা, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। রাধাবিরহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পদে ‘যৌবন’, ‘মনমথ’ ও ‘সুরতী’ শব্দ তিনটি বারবার ব্যবহার করে কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্জলা দেহকামনা কেমন করে বেষ্টন করে আছে যুবতী রাধাকে। রাধার অনুরোধে বড়ায়ি গিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ে এলে সে যেভাবে রাধার সঙ্গে বাক্যবিনিময় করেছে, তাতে দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার মদনপীড়াটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। নইলে সে বিদ্রূপ করে নপুংসক আইহনের কথা তুলে বলত না, “ঘরে গিআঁ সেব তোহ্মে আইহন পতী”।
কিন্তু শেষপর্যন্ত বহু অনুরোধে একবার মিলন এবং চিরজীবনের জন্য নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কিছুই জোটে না রাধার। এই সমাজের নারীভাগ্যই যেন রাধার এক দুঃখময় জীবনবৃত্তে প্রতিবিম্বিত। ড. সত্যবতী গিরি তাই লিখেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের কামনার বলিমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।... তার মন যখন পারিবারিক ও সামাজি পরিবেশের প্রথাবদ্ধ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্বের অবস্থানে আনন্দিত, তখন নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য এক পুরুষ তার অনিচ্ছুক শরীরের উপর বলাৎকার করেছে। আর সেই কারণেই সরল সুস্থ নারীর মন ও শরীর দুই-ই যখন সেই পুরুষকে পাওয়ার জন্য আকুল, তখন সে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত।... অনিচ্ছুক বা ইচ্ছুক রাধার উভয় প্রান্তই এই সমাজে নারীভাগ্যের সীমানা। কৃষ্ণের হাতে আত্মসমর্পণের অনিচ্ছা প্রকাশে সে বিদ্রোহিনী, আবার আত্মনিবেদনে ইচ্ছুক রাধাও সামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহিনী। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই তার বিদ্রোহ সফল নয়। সে সামন্ত-শাসিত বাঙালি সমাজের প্রথম নতজানু বিদ্রোহিনী।”
====বড়ায়ি====
রূপ গোস্বামী তাঁর ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলায় সহায়িকা সখীর ভূমিকা বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর বড়ায়ির আবির্ভাব সেই গ্রন্থের অনেক পূর্বে। অবশ্য ''গীতগোবিন্দম্''-এ নাগরিক রুচিসম্পন্না সখীদের দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস গ্রামীণ পটভূমির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সখীর বিকল্পে এনেছেন বড়ায়িকে। সে একাধারে দূতী, সখী ও অভিভাবিকা। এই তিন ভূমিকার সমাহারে বড়ায়ি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় চরিত্র। দামোদর গুপ্তের ''কুট্টিনীমতম্'' অথবা বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''-এ নিসৃষ্টার্থা দূতীর ধারণা পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের বড়ায়ি অবশ্য কবির দেখা গ্রাম্য কুট্টিনী, যারা সেকালে এই জাতীয় গোপন সম্পর্ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিল। বহু পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্রের ''নীলদর্পণ'' নাটকের পদী ময়রাণীর চরিত্রেও এই-জাতীয় চরিত্রের ছায়া দেখা যায়। তাই অনুমান করা যায়, একদা গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের বয়স্কা রমণীদের দেখা যেয়, যারা অর্থের বিনিময়ে অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ঘটাতো অথবা কামুক পুরুষের কাছে এনে দিত তার আকাঙ্ক্ষিতা নারীকে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে বড়ায়ির একটি সামাজিক পরিচয় আছে। সে রাধার মায়ের পিসি। সেই অর্থে সম্পর্কে রাধার দিদিমা বা বড়-আয়ি। সেই থেকেই সম্ভবত ‘বড়ায়ি’ নামটি এসেছে। তার বেশভূষা, চেহারা ও অঙ্গভঙ্গি বর্ণনায় কবি বেশ হাস্যরস সঞ্চারিত করেছেন। রাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইহন-জননী তাকে নিয়ে এসেছে রাধার পিত্রালয় থেকে। তার কাজ নাবালিকা বধূর পরিচর্যা, মথুরার হাটে নিয়ে যাওয়া এবং সর্বক্ষণ তার সঙ্গ দেওয়া। একবার বনপথে রাধা চোখের আড়ালে চলে গেলে ‘গরু রাখোলা’ কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপবর্ণনা করে সে তার হদিশ জানতে চায়। সে-কথা শুনে ‘কামী’ কৃষ্ণ রাধার রূপে আকৃষ্ট হয়ে এবং বড়ায়ির হাতে তাম্বুল প্রেরণ করে। বড়ায়ি যে দূতীগিরিতে নিপুণা ও সফল তার উল্লেখ আছে বড়ায়ির নিজের উক্তিতেই। কিন্তু সেই সাফল্যে সম্ভবত প্রথম আঘাত রাধার অস্বীকৃতি। শুধু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান নয়, বড়ায়িকে মাটিতে ফেলে প্রহার করে রাধা। বড়ায়ির মনে জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। কৃষ্ণই হয়ে ওঠে তার অবলম্বন। পরবর্তী দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড প্রভৃতি অংশের প্রত্যেকটিতেই তাই বড়ায়ি কৃষ্ণের পক্ষাবলম্বী হয়েছে নাবালিকার দর্পচূর্ণ করতে।
কিন্তু বড়ায়ি কেন এহেন অসামাজিক সম্পর্কের প্রস্তাব নিয়ে আসতে রাজি হয়েছিল সেটিও বিবেচ্য। একজন সমালোচকের মতে, নপুংসক-পত্নী রাধার বিড়ম্বিত জীবনের প্রতি ছিল বড়ায়ির গভীর সমবেদনা। রতিসুখ-বঞ্চিয়া নারীর শুষ্ক জীবনকে পূর্ণ ও সরস করার অভিলাষেই সে সম্মত হয়েছিল কৃষ্ণের অশালীন প্রস্তাবে। তাই দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে রাধার করা অমপানের প্রতিশোধ নিলেও বৃন্দাবনখণ্ডে এগিয়ে আসে রাধাকে সাহায্য করতে। দেহসুখ-বাসনায় উদ্বেল রাধার শাশুড়ির কাছ থেকে বাক্-কৌশলে সে অনুমতি আদায় করে। আবার বাণখণ্ডে কৃষ্ণ রাধাকে বাণের আঘাতে মূর্চ্ছিত করলে বড়ায়ি কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করে। এই ঘটনা থেকে বড়ায়ি চরিত্রের আর-একটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মধ্যে নিরপেক্ষতাবোধও দুর্লভ নয়। রাধা ও কৃষ্ণ দুজনেই তাঁর স্নেহভাজন। ফলে যাকে যখন বঞ্চিত বা পীড়িত বলে মনে হয়েছে বড়ায়ি নির্দ্বিধায় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার মনোব্যথা লঘু করার ক্ষেত্রে বড়ায়ির ভূমিকা অনবদ্য। এই পর্যায়ের বড়ায়ি যেন ''গীতগোবিন্দম্''-এর সহায়িকা সখী। কখনও সে নানা যুক্তিতর্কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, কখন বাঁশি চুরি করার পরামর্শ দেয়, কখনও রাধার আর্তিতে বিগলিত হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হয়, কখনও মূর্চ্ছিতা রাধার চেতনা ফিরিয়ে আনতে তার সুশ্রুষা করে, আবার কখনও মথুরায় গিয়ে আহ্বান করে কৃষ্ণকে। এখন রাধার যাবতীয় দুঃখ-নিবেদনের আধার হয় বড়ায়ি। কৃষ্ণও তার মনের ক্ষোভ ব্যক্ত করে এই বড়ায়ির কাছেই। সে রাধার দেওয়া অপমান ভুলতে পারছে না, আর তার রাধাতে আসক্তি নেই। কেবল বড়ায়ির অনুরোধেই সে শেষবারের মতো বৃন্দাবনে এসে মিলিত হয় রাধার সঙ্গে। সম্ভোগের পর নিদ্রিতা রাধার প্রতি যত্ন নিতে বলে যায় বড়ায়িকে। বড়ায়ি তাই কেবল দূতী বা সখী নয়, একই সঙ্গে সে কর্তব্যপরায়ণা অভিভাবিকাও।
সমগ্র আখ্যান থেকে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম-সংঘটনের ক্ষেত্রে বড়ায়ির সক্রিয়তাই সর্বাধিক।। দুই পক্ষের মধ্যে যখনই কোনও সংকট, অনীহা, দ্বন্দ্ব, ভুল-বোঝাবুঝি উপস্থিত হয়েছে, বড়ায়ি তখন তার কূটবুদ্ধি, অভিভাবিকা-সুলভ পরামর্শ, সখীসুলভ সহমর্মিতা, পরিজনতুল্য স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছে। এই বড়ায়ি যেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রধান পরিচালক। লৌকিক প্রেমের কাব্যে কবির উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধ মানবরস পরিবেশন। তাই অলংকারশাস্ত্রে কথিত নিষ্প্রাণ কুট্টিনী চরিত্র নয়, কবি নিজ কল্পনার গুণে বড়ায়িকে করে তুলেছেন রক্তমাংসের এমন এক জীবন্ত মানুষ, যার মধ্যে আত্মগর্ব, প্রতিহিংসা-পরায়ণতা, বুদ্ধির প্রখরতা, বিপুল চরিত্রাভিজ্ঞতা সবই আছে, সেই সঙ্গে আছে পীড়িত ও বঞ্চিতের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধও। গোড়ার দিকে ‘কুটিল’, ‘কপটকুশলা’ বিশেষণে ভূষিতা এই বৃদ্ধা তাই অনায়াসেই হয়ে উঠেছে এক গভীর ব্যঞ্জনাময় চরিত্র। এই অনন্য চরিত্রের অনুকরণ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি।
==প্রকরণ===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সংরূপগত শ্রেণিবিচার সম্বন্ধেও মতানৈক্য আছে। Genre বা সংরূপ হল কোনও নির্দিষ্ট শিল্পাঙ্গিক, যা সাহিত্যকর্মকে একটি শ্রেণি থেকে আর-একটি শ্রেণিতে পৃথক করতে সমর্থ হয়। সব রচনা সমানভাবে রূপপ্রাপ্ত হয় না। তাই ভাবের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকলেও কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প ইত্যাদি সাহিত্যপ্রকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন আস্বাদন অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। প্রত্যেকটি আঙ্গিকেরই স্বতন্ত্র মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলির আবির্ভাবও বিশেষ বিশেষ সময়ে পৃথক পৃথক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে থাকে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর গোত্রনির্ণয়ে প্রায় সকল সমালোচককেই থমকে যেতে হয়েছে। কারণ, এই রচনা কোনও একটি বিশেষ সংরূপের বৈশিষ্ট্য আত্মীকরণ করে আবির্ভূত হয়নি। বরং এর মধ্যে লক্ষিত হয়েছে মিশ্র রূপের সমাবেশ। এটা খুবই নিশ্চিত যে, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানমূলক রচনা ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। ‘কাব্য’ হিসেবেই এর পরিচিতি সর্বাধিক। কিন্তু বাংলা ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাসের কোনও আদর্শ ছিল কিনা, অন্তত পরবর্তীকালের আবিষ্কৃত গ্রন্থাবলির মধ্যে তার কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায় না। তবে জয়দেবের ''গীতগোবিন্দম্''-এর কাছে তিনি যে বিষয়-ভাবনা ও আঙ্গিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ঋণী তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বস্তুত শিল্পাঙ্গিক হিসেবে জয়দেবের রচনাটি ছিল অভিনব। যতদূর সম্ভব তিনি লোকনাট্যের রীতি অনুসরণে গীতিনাট্যের পালা রচনা করেছিলেন। এই সংরূপটিকে জয়দেব নির্দেশ করেছিলেন ‘গীতপ্রবন্ধম্’ বলে। কিন্তু কেবল গান নয়, সঙ্গে কবির বর্ণনা এবং ঘটনাশ্রিত পাত্রপাত্রীদের উক্তি-প্রত্যুক্তিও গ্রথিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। সব মিলিয়ে ''গীতগোবিন্দম্'' এক বিচিত্র শ্রেণির গ্রন্থ, যা সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যেই দুর্লভ। অনুপুঙ্ক্ষ বিচার করলে দেখা যায়, বড়ু চণ্ডীদাসের রচনাতেও সেই আখ্যান-বিবৃতি, নাটকীয়তা ও গীতিধর্মিতার সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।
বড়ু চণ্ডীদাস মুখ্যত ভাগবতীয় কাহিনির প্রসিদ্ধ কাঠামোয় তাঁর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-আখ্যানটিকে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরাগমন পর্যন্ত বৃন্দাবনের ঘটনাগুলিই এতে বিবৃত। অথচ বিবরণের প্রচলিত বর্ণনাত্মক পদ্ধতিকে একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে না নিয়ে তিনি বৈচিত্র্য এনেছেন নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। নাটক সংলাপ-নির্ভর একটি স্বতন্ত্র সংরূপ, যা অখণ্ড সমগ্রতায় বিধৃত হয়। নাটকের প্রাণ হল দ্বন্দ্ব। তীব্র গতিতে তা প্রার্থিত পরিণামের দিকে ছুটে চলে। নাটকের প্রধান গুণ বাস্তবধর্মিতা। এর চরিত্রগুলি যত বেশি রক্তমাংসের হয়, ততই সাহিত্য হিসেবে নাটক দর্শকের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর তেরোটি খণ্ডে আখ্যান যেভাবে এগিয়েছে তাতে যথেষ্ট নাটকীয় উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। জন্মখণ্ডের বিবরণটিকে ধরা যেতে পারে সংস্কৃত নাটকের সূচক বা প্রস্তাবনার মতো, যেখানে নাটকের মুখ্য কুশীলবদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর দীর্ঘ বারোটি খণ্ড জুড়ে তাদেরই নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, মানসিক সংকট, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও বিচিত্র প্রকার ভাব ও আবেগের বিস্তার। প্রতিটি খণ্ড এমনভাবে স্থান ও কালের পরম্পরায় সজ্জিত যে, প্রত্যেকটিকে একটি ঘটমান নাট্যবৃত্তের ক্রমিক দৃশ্যায়ন বলে মনে হওয়াও সম্ভব। ঘটনার সঙ্গে উত্থান-পতনে নাটকীয় চরিত্রগুলির যে বিবর্তন ঘটে এখানে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে সে অপেক্ষিত মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তিটি বড়ু চণ্ডীদাস তুলে ধরেছেন রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রে। মিহির চৌধুরী কামিল্যা তাঁর সম্পাদিত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি নাবালিকা, যে দেহজ মিলন সম্পর্কে অনভিজ্ঞা, পরপুরুষ সম্পর্কে প্রচণ্ড ভীতা, আত্মসম্ভমময়ী এবং নিজের স্বামীকুল, পিতৃকুল সম্পর্কে গর্বিতা, সেই একাদশবর্ষীয়া বালিকা এক নির্লজ্জ, কামাতুর, গ্রাম্য গোপবালকের বারংবার অবৈধ পীড়নে কেমন করে ধীরে ধীরে মর্মদাহী যন্ত্রণার ভিতর দিয়া পীড়নকারীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো, বড়ু চণ্ডীদাস তার একটি উপভোগ্য কাহিনী নির্মাণ করেছেন।” (পৃ. ৫৬) তাম্বুলখণ্ডের স্বামী-গর্বিতা যে নারী একদা বলেছিল, “নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা”, সেই স্বীয় অবস্থানে সানন্দিতা সুস্থিতা পূর্ণযুবতীকে দিয়ে আখ্যানের শেষে কবি বলিয়ে নেন:
<poem>
:: ধরন না জাএ বড়ায়ি আহ্মার যৌবন।
:: প্রাণ রাখি আনি দেহ নান্দের নন্দন।।
</poem>
চরিত্রের এই বিবর্তন অনেকগুলি ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটেছে। কবি নাট্যকার-সুলভ দক্ষতায় সমগ্র বৃত্তের মধ্যে সেই কার্য-কারণ সম্পর্ক রক্ষা করে প্রার্থিত পরিণামের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে কৃষ্ণ চরিত্রটিকে প্রথম থেকেই করে তুলেছেন নারীসঙ্গলোভী এক কামুক পুরুষ। রাধাকে দৈহিক ভাবে পাওয়ার জন্য সে নানারকম ছলনা, প্রতারণা, অভিনয় ও নীচতার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। রাধার সঙ্গে বারবার মিলিত হয়ে অন্তরের তৃষ্ণার উপশম ঘটে তার। অতঃপর ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণ তুচ্ছ অজুহাতে মিথ্যা অভিযোগে সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না কৃষ্ণসঙ্গাভিলাষী রাধাকে নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করে চলে যায়। আত্যন্তিক আসক্তি থেকে পূর্ণ অনাসক্তি—কৃষ্ণের এই বিপরীতধর্মী অবস্থান নানা নাটকীয় পরিস্থিতিতে অল্প অল্প করে এগিয়েছে। নাটক অভিনয়যোগ্য মঞ্চনির্ভর সাহিত্যধারা। তারও শেষ গন্তব্য সেই রস। বর্ণিত আখ্যানটি আধুনিক দৃষ্টিতে স্থূল, গ্রাম্য ও অমার্জিত ঠেকতে পারে, কিন্তু এর খাঁটি মানবিক রসে কোথাও কোনও সন্দেহ উপস্থিত হয় না। নাটকের উদ্দেশ্যে এই রস সৃষ্টি করা এবং সেই দিক থেকে বড়ু চণ্ডীদাস সম্পূর্ণ সফল। নাটকের মুখ্য অবলম্বন তথা বহিরঙ্গের চিহ্ন হল সংলাপ। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এও দেখা যায় ৪১৮টি পদের মধ্যে মাত্র ৪২টি পদ কবির বিবৃবি, অবশিষ্ট পৌনে চারশো পদ কোনও না কোনও চরিত্রের উক্তি বা স্বগতোক্তি। সংলাপের মধ্যেও আছে পাত্রপাত্রী ও পরিস্থিতিগত বৈচিত্র্য। যেমন, দানখণ্ডে কৃষ্ণের উক্তিতে অশালীন প্রস্তাব থাকলেও তার ভাষাগত অভিব্যক্তিটি গ্রাম্যতাদোষ থেকে মুক্ত। অন্যদিকে রাধার সংলাপে যে ধার ও তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করা যায়, তা গ্রাম্য নারীর ভাষা ও প্রবচনে সমৃদ্ধ এবং তার অন্তরের ঘৃণা ও অস্বীকৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। আবার বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ভাষায় আবেগধর্মিতা প্রবলভাবে উপস্থিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মাত্র তিনটি মুখ্য চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নাটককে অলংকারশাস্ত্রে ‘বীথি’ বলা হয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সঙ্গে এই নাট্যশ্রেণির সাদৃশ্য দেখা যায়। এতে পরিবেশিত শৃঙ্গার রসের আধিক্যের নিরিখে কেউ কেউ একে জাগের গান অথবা ঝুমুর গানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাগের গান ‘ধামালি’ বলে কথিত। এই গানে সঙ্গমকামনার বিষয়টিই মুখ্য। ঝুমুর গানে থাকে দুটি দল, যারা পারস্পরিক উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে আখ্যানটিকে গতিময় করে তোলে। এই দুইয়ের কিছু কিছু লক্ষণ থাকলেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' সম্পূর্ণত লোকরীতির রচনা নয়। বরং ড. সুকুমার সেন ‘লগনী’, ‘দণ্ডক’, ‘প্রকীণ্ণক’ ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগের সূত্রে এটিকে ‘নাটগীত’ শ্রেণির রচনা বলে মনে করেন। তিনি আরও অনুমান করেন, মধ্যযুগে এই পালা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সম্ভবত পুতুলনাচ হত। ‘পঞ্চালিকা’ অর্থে পুতুল ধরলে এর প্রকৃত অভিধা হয় ‘নাটগীত পঞ্চালিকা’। দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, বস্ত্রহরণখণ্ড, রাধাবিরহ প্রভৃতি অংশে যেভাবে রাধাকৃষ্ণের দৈহিক সম্ভোগের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব পাত্রপাত্রীর দ্বারা তার অভিনয় নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। অতএব এর নাট্যধর্মিতা ও মঞ্চযোগ্যতা স্বীকার করে নিলে পুতুলনাচের সম্ভাবনার কথাও অবশ্যই মানতে হয়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ নাট্যধর্ম ব্যাপক পরিমাণে থাকলেও এটিকে কোনওমতেই বিশুদ্ধ নাটক বলা চলে না। প্রথাসিদ্ধ নাটকের অবয়বে এটি লেখা হয়নি। বরং যে কৌশলে সংলাপগুলিকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, তাতে এর বর্ণনাত্মক স্বভাবটিই ধরা পড়ে। একটি নিটোল গল্প সাজিয়ে-গুছিয়ে বলেছেন কবি। পাত্রপাত্রীর অঙ্গভঙ্গি, ক্রিয়া, মনের কথা ইত্যাদিকে সংলাপের পাশাপাশি নিজের কথার মাধ্যমেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এই রীতি নাটকের নয়, কথাসাহিত্যের; আরও নির্দিষ্ট করে বললে উপন্যাসের। এই ভঙ্গিটিই আদ্যন্ত দৃশ্যমান সমগ্র গ্রন্থে। বৃহদায়তন আখ্যানকে যেমন কথাসাহিত্যিক একাধিক অধ্যায়ে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত করে ঘটনার এক-একটি পর্যায় নির্মাণ করেন, এখানে খণ্ডবিভাগ মোটামুটি তারই অনুকল্পে সাজানো। জন্মখণ্ডে তথ্যমূলক বিবরণই প্রধান। এরপর তাম্বুলখণ্ড থেকে বাণখণ্ড পর্যন্ত গল্প চলেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে। তারপর আবার স্তিমিত হয়ে পড়েছে আখ্যানের গতি। পরিসংখ্যান অনুসারে, সমগ্র আখ্যানে মোট ৪২টি পদ কবির উক্তি। এতে পরস্প-বিচ্ছিন্ন ক্রিয়া ও ঘটনাগুলিকে এক সূত্রে গেঁথে তোলার প্রয়াস লক্ষিত। আর আছে ১৬১টি সংস্কৃত শ্লোক। এই শ্লোকগুলির বেশ কয়েকটি কবির উক্তি তথা নির্ভেজাল বিবৃতি। ঘটনার উল্লম্ফনকে ধরার জন্য এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এগুলিতে প্রধান তিন চরিত্রের স্বভাব ও আচরণ সম্পর্কে ছোটো ছোটো অথচ তীক্ষ্ণ মন্তব্য করা হয়েছে, যা নাট্যধর্মকে কিছুটা ক্ষুণ্ণ করে কথাসাহিত্যের বিশ্লেষণধর্মিতাকে চিনিয়ে দেয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বড়ু চণ্ডীদাস যে আলাদা করে বর্ণনাধর্মিতার দিকে দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন, তার বিশেষ প্রমাণ এই শ্লোকগুলিই।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ গীতিলক্ষণও খুব স্পষ্ট। নাটকীয়তা ও বর্ণনাধর্মিতার সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়ে প্রসঙ্গ অনুসারে গীতিকবিতার সুর অনুরণিত হয়েছে এতে। রচনার প্রথমাংশে লোকসংগীত ঝুমুরের প্রভাব অনেকেই স্বীকার করেন। কিন্তু এর শেষাংশে তা রীতিমতো গীতিকাব্যিক মূচ্ছনার সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে দুটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথম, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব রচনাই সংগীত-নির্ভর। গেয়ে পরিবেশনের উদ্দেশ্যেই এগুলি রচিত হত। কাব্য হিসেবে তাই এগুলি গেয়কাব্য। দ্বিতীয়ত, মধ্যযুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি বলে কবির ব্যক্তিগত স্বকীয় ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটনের কোনও জায়গা ছিল না। তবে নিজের অন্তরঙ্গ অনুভূতি কিংবা উপলব্ধিকে আখ্যান-বিধৃত চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে কোনও বাধা ছিল না। বস্তুত তাই লক্ষ্য করা যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বিশেষত বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ব্যক্তিচিত্তের অন্তর্গূঢ় বেদনাই রূপলাভ করেছে গীতকাব্যের ভাষায় ও সুরে। ব্যক্তিগত এই যন্ত্রণা প্রকাশের সূত্রেই হয়তো একসঙ্গে বাঁধা পড়তে পারে বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসের কৃষ্ণপ্রেম-উন্মাদিনী শ্রীরাধিকা। কেউ কেউ বংশীখণ্ডের “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কুলে” পদটিকে গীতিকাব্যিক উচ্ছ্বাসের চূড়ান্ত নিদর্শন বলে মনে করেন। এই পদটির আখ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টাও হয়েছে; যদিও রাধা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে অন্য সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয়। যাই হোক, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' যে একদা আসরে গাইবার জন্যই লেখা হয়েছিল তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ প্রতিটি পদের সূচনায় বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর উল্লেখ। গাইবার সময় সুরের একঘেয়েমি এড়ানোর জন্য বৈচিত্র্যময় রাগ ব্যবহারের নির্দেশ করে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শিল্পসচেতনতার পরিচয়ই দিয়েছেন। একই সঙ্গে রয়েছে তালের উল্লেখও। রাগ ও তালের এহেন প্রয়োগ দেখে তাঁকে সংগীত-বিশারদও ধরা যেতে পারে। সব মিলিয়ে ৩২টি রাগ-রাগিণীর উল্লেখ করেছেন তিনি। এগুলির মধ্যে পাহাড়িয়া রাগে রচিত পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। অন্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রামগিরি, গুজ্জরী, কোড়া, ধানুষী, দেশাগ, মালব, ভাটিয়ালী, মল্লার, দেশবরাড়ী, বেলাবলী, আহের, ভৈরবী, ললিত, মালবশ্রী, বসন্ত, বিভাস ইত্যাদি। তালের মধ্যে আছে যতি, রূপক, ক্রীড়া, একতালী, আঠতালা ইত্যাদি। সংগীতবিদ রাজ্যেশ্বর মিত্র এই গ্রন্থের গীতিমূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “এ গ্রন্থটি কী কাব্য, কী সংগীত, কী গীতিনাট্য সব দিক থেকেই রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রাচীন সংগীত কলার অত্যুৎকৃষ্ট পরিচায়ক।” যাই হোক, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কোনও একটি নির্দিষ্ট সংরূপ তার বিশেষ লক্ষণ নিয়ে উপস্থিত নেই। বরং এটি বিবেচনা করা যায় যথেষ্ট লাট্যোপাদান-সমৃদ্ধ গীতিধর্মাশ্রয়ী আদিরসাত্মক আখ্যানকাব্য হিসেবে। এই মিশ্র অথচ গুণান্বিত সংরূপটির অনুসরণ পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর কখনও দেখা যায়নি।
96buor2dv7s09ahg0n48rpdaiyff1ji
85942
85940
2025-07-11T10:29:04Z
Jonoikobangali
676
/* প্রকরণ= */
85942
wikitext
text/x-wiki
পৌরাণিক সংস্কৃতির অন্যতম বিশিষ্ট একটি ধারা হল কৃষ্ণকথার ধারা। বৈদিক সাহিত্যেই এই কৃষ্ণকথার বীজ নিহিত ছিল। ক্রমে পুরাণগুলির মধ্যে দিয়ে ক্রমবিকাশের নানা পর্যায় পার হয়ে বিষ্ণু, নারায়ণ, হরি, বাসুদেব ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র একক পুরুষে একীভূত হয়ে যায়। তখন তিনি হন অংশী, অন্যরা অংশ। আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৮০০ থেকে ১০০০ অব্দের মধ্যবর্তীকালে রচিত ভাগবত পুরাণে সেই অংশী ‘স্বয়ং ভগবান’ কৃষ্ণ নামে কথিত হলেন। এই পুরাণে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হল কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত কাহিনি। বস্তুত ভাগবতধর্মের বিকাশ ঘটল এই গ্রন্থ রচনার পরে। এরপর একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল উত্তর ভারতেও। সেই সূত্রে বাংলাতেও এসে উপস্থিত হল কৃষ্ণভক্তিবাদ। সেন আমলে বাংলায় যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল, তার অন্যতম অবলম্বন ছিল কৃষ্ণকথা। জয়দেব তাঁর ''গীতগোবিন্দম্'' কাব্যে কৃষ্ণকে একই সঙ্গে করে তুললেন পরমারাধ্য বিষ্ণুর অবতার এবং কামকেলিকলার নায়ক।
ঠিক এই সময়েই বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল, যার সুদূরপ্রসারী ফলে বাঙালি সমাজ, বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি হিন্দুর দৈনিক জীবনে এল এক আমূল পরিবর্তন। ঘটনাটি ইতিহাসে তুর্কি আক্রমণ নামে খ্যাত। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিতে তুর্কি সেনানায়ক ইখ্তিয়ার-উদ্দিন মহম্মদ বিন বখ্তিয়ার খিলজি আক্রমণ করলেন রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজ্য। বৃদ্ধ রাজা পালিয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গে। বিদেশি শাসনে সাধারণ হিন্দুরা সমূহ বিপদের সম্মুখীন হল। এই সংকটকালে কোনও সাহিত্য রচিত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য আজও পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয়, তুর্কি আক্রমণের প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার পর সমাজজীবন সুস্থির হলে বাঙালির সাহিত্যচর্চার অবকাশ তৈরি হয়। এই দু-আড়াইশো বছর সময়টিকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। এই সময়েই বিদেশি শাসকের ধর্মীয় ও সামাজিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলা সাহিত্যকে অবলম্বন করে বাঙালি হিন্দু এক সাংস্কৃতিক বর্ম গড়ে তোলে।
আসলে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষেরা উচ্চবর্ণের নিপীড়ন সহ্য করার পর ইসলামের সাম্যবাদী নীতিতে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে শাসকবর্গের প্রলোভন ও দমনপীড়নের নীতি তো ছিলই। ফলে দলে দলে লোক ধর্মান্তরিত হচ্ছিল ভয়ে, লোভে, পীড়নে ও পিরদের কেরামতিতে আকৃষ্ট হয়ে। এতে হিন্দু সমাজপতিদের টনক নড়ে। নিজেদের ধর্মাদর্শকে দেশীয় ভাষায় সকলের কাছে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তারা। সমাজের ভাঙন প্রতিরোধে শাস্ত্রকথা শুনিয়ে লোক-নিস্তারণের দায়িত্ব নেন অনুবাদক কবিরা। অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যের আখ্যানে উঠে আসে অবনমিত সম্প্রদায়ের উপরে ওঠার ইতিহাস। চণ্ডী, মনসা, ধর্মঠাকুর প্রমুখ লোকদেবতা আর অপাংক্তেয় হয়ে থাকেন না, বরং মন্ত্র ও পূজা ইত্যাদি প্রাপ্তির মাধ্যমে তাঁরাও স্বীকৃত হন উচ্চসমাজে। প্রাক্-চৈতন্য যুগে বাংলায় প্রচারিত কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য এই প্রেক্ষাপটেই বিবেচ্য।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে কৃষ্ণের নৈষ্ঠিক পূজার্চনার রীতি চালু হয়। তৎকালীন অভিলিখন, ভাস্কর্য ও শাস্ত্রগ্রন্থে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবে বৈদান্তিক মতের প্রাধান্য ঘটে। সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়ায় একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব ভক্তিবাদী আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে উত্তর ভারতে। আরও তিন শতক পরে চতুর্দশ শতকের শেষভাগে মাধবেন্দ্র পুরী সারা ভারতে কৃষ্ণভক্তিবাদ প্রচার করেন। শোনা যায় বাংলায় তিনি কৃষ্ণভক্তির সূচনা করেছিলেন অদ্বৈত আচার্য ও ঈশ্বর পুরী নামে দুই শিষ্যের মাধ্যমে। ঈশ্বর পুরীই দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত স্মার্ত নিমাই পণ্ডিতকে—যিনি সন্ন্যাসগ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা চৈতন্য মহাপ্রভু নামে পরিচিত হন। বস্তুত ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা চৈতন্যের প্রভাবে বাংলায় কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তাঁর রাগানুগা ভক্তি প্রচলিত কৃষ্ণার্চনার ধারায় এক অভিনব সংযোজন। প্রাক্-চৈতন্য যুগের তুলনায় তাই চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কৃষ্ণকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারা অনেকটাই আলাদা। প্রথম পর্বে যেখানে বৈধী ভক্তির প্রাধান্য দেখা যায়, চৈতন্য-পরবর্তী পর্বে বৈষ্ণব সাধনায় দেখা যায় রাগানুগা প্রেমাভক্তির প্রাধান্য। পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদাবলিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনতত্ত্বের স্পর্শ অথবা ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থের ন্যায় বৈষ্ণবীয় অলংকারশাস্ত্রের নিগূঢ় বন্ধন ছিল না; সেই পদ রচিত হয়েছিল কবিদের নিজস্ব প্রাকৃত ও আধ্যাত্মিক চেতনার সংমিশ্রণে, কোথাও আবার সংস্কৃত সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা প্রকরণের ছায়া অবলম্বনে। সাহিত্যের ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন প্রমাণের উপর নির্ভর করে জানিয়েছেন, প্রাক্-চৈতন্য যুগে কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদসাহিত্য দেশীয় ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন তিনজন শক্তিমান কবি। এঁরা হলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কবি বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলির অন্যতম দুই বিশিষ্ট রূপকার বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস। অবশ্য ভাষা ও জাতিগত বিচারে বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না। তিনি পদ রচনা করেন ব্রজবুলি ভাষায়। প্রাক্-চৈতন্য যুগের কৃষ্ণকথা ও পদাবলি সাহিত্য আলোচনায় এই তিন বিশিষ্ট কবির সাহিত্যসম্ভারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে।
==''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্য==
আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দাবি সর্বজনস্বীকৃত। এই কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস আর কোনও বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তিনি যে বাংলা ভাষায় কৃষ্ণকেন্দ্রিক একটি বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাব্যটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) প্রাচীন সাহিত্য-বিশারদ বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামে বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র্য-বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচা থেকে অযত্নরক্ষিত এই পুথিটি উদ্ধার করেন। সাত বছর পরে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুথিটিকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি। প্রকাশের পর এই গ্রন্থের নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
===কবি: বড়ু চণ্ডীদাস===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। মধ্যযুগে চণ্ডীদাস নামধারী আরও কবি ছিলেন বলে গবেষকদের ধারণা। তবে বড়ু চণ্ডীদাস যে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কাব্যের ভণিতা থেকে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কবি কোথাও নিজেকে ‘অনন্ত বড়ু’, কোথাও ‘অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস’, আবার কোথাও বা কেবল ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ ভণিতাই পাওয়া যায় সর্বাধিক সংখ্যায়—২৯৮ বার, এবং ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা আছে ১০৭ বার। এই পুথি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই বাঙালি পাঠক ও বৈষ্ণব সমাজ চণ্ডীদাসের পদের সঙ্গে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকে বৈষ্ণব মহাজনদের রচিত পদগুলির সংকলনও প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ''স্কেচ অফ দ্য রিলিজিয়াস সেক্টস অফ হিন্দুজ'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন যে, গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির যৌথ কর্তৃত্বে সংস্কৃত ভাষায় ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়েছিল। তথ্যটি বাঙালি লেখকদের কলমে বিকৃত হয়ে এই রূপ নেয় যে, চণ্ডীদাস ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে একটি পুথি রচনা করেছিলেন। তাই ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথি আবিষ্কারের পর স্বয়ং আবিষ্কর্তাও বিভ্রান্ত হয়ে কবিকে ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’ বলেই উল্লেখ করেন। তাঁর ধারণা ছিল “দীর্ঘকাল যাবৎ চণ্ডীদাস বিরচিত কৃষ্ণকীর্তন”-এর যে অস্তিত্বের কথা তিনি শুনে আসছিলেন, প্রাপ্ত পুথিটি তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। ভণিতায় প্রাপ্ত ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ নামটি তিনি উপেক্ষা করে যান। সেই থেকেই চণ্ডীদাস সমস্যার প্রাথমিক সূত্রপাত। দীনেশচন্দ্র সেনও জানান, “কবি চণ্ডীদাস ও কৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা যে অভিন্ন ব্যক্তি, তৎসম্বন্ধে আমাদের সংশয় নেই।” যে চণ্ডীদাস যৌবনে তীব্র আদিরসাত্মক রচনায় সিদ্ধহস্ত, পরিণত বয়সে তিনিই আধ্যাত্মিক রসে বিহ্বল। মনীন্দ্রমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালা থেকে দীন চণ্ডীদাসের পদ আবিষ্কার করলে সমস্যা আরও তীব্র হয়। কারণ পুরোনো পুথিপত্রে একক চণ্ডীদাসের উল্লেখই পাওয়া যায়। যেমন, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ''চৈতন্যচরিতামৃত'' বা সনাতন গোস্বামীর ''বৈষ্ণবতোষিণী'' টীকা ইত্যাদিতে কোথাও বড়ু বা দীন চণ্ডীদাসের নামোল্লেখ নেই।
কিন্তু এত জটিলতা সত্ত্বেও কয়েকটি অকাট্য প্রমাণের বলে পদাবলির চণ্ডীদাস থেকে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রচয়িতাকে পৃথক করা সম্ভব হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-র ষষ্টিতম ভাগ, দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করে কোন কোন সূত্রে দুই চণ্ডীদাস স্বতন্ত্র তা দেখিয়েছেন। তাঁর সুচিন্তিত সমাধানগুলি হল:
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে কোথাও ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’ বা ‘দীন চণ্ডীদাস’ ভণিতা নেই।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার পিতামাতার নাম সাগর ও পদুমা বলে উল্লেখ করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস রাধার শাশুড়ি বা ননদের নাম উল্লেখ করেননি। ‘বড়ায়ি’ ছাড়া কোনও সখীকেও সম্বোধন করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে চন্দ্রাবলী রাধারই নামান্তর, পৃথক প্রতিনায়িকা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কৃষ্ণের কোনও সখার নাম উল্লেখ করেননি।
# বড়ু চণ্ডীদাস সর্বত্র প্রেম অর্থে ‘নেহ’ বা ‘নেহা’ ব্যবহার করেছেন।
# বড়ু চণ্ডীদাস কোথাও রাধার বিশেষণে ‘বিনোদিনী’ এবং কৃষ্ণ অর্থে ‘শ্যাম’ ব্যবহার করেননি।
# ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে রাধা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নন।
# বড়ু চণ্ডীদাস ব্রজবুলি জানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
উপরিউক্ত তথ্যগুলি বড়ু চণ্ডীদাসের পৃথক অস্তিত্বের প্রমাণ। আসলে মধ্যযুগের অনেক কবির মতোই বড়ু চণ্ডীদাসও নিজের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। কেবল তিনি যে ‘বাসলী’ নামে এক দেবীর সেবক ছিলেন, সেই কথাই উল্লিখিত হয়েছে ভণিতায়। এই কবিকে নিয়ে লোক-ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়েছে অনেক জনশ্রুতি। কবির জন্মস্থান বাঁকুড়ার ছাতনা না বীরভূমের নানুর তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, দুই স্থানেই বাসলী দেবীর মন্দির আছে, চণ্ডীদাস ও রামী রজকিনীকে নিয়ে লোকপ্রবাদ প্রচলিত, বছরের নির্দিষ্ট দিনে মেলা ও উৎসব হয়। তবে বাঁকুড়ার দিকেই পাল্লা ভারী। কারণ নানুরের কবি চণ্ডীদাসের ভণিতায় মেলে ‘বাশুলী’ দেবীর নাম এবং ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে ‘বাসলী’ দেবীর উল্লেখ। এছাড়া গুরুতর প্রমাণ এই কাব্যের ভাষা। বাঁকুড়ার লোকভাষার আনুনাসিক ধ্বনির প্রাধান্য এবং এই অঞ্চলে প্রচলিত গড়া, চুক, মাকড়, ঝঁট, ভোক ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যেও পাওয়া যায়। কোনও কোনও গবেষক বাঁকুড়ার উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ তার প্রাচীন প্রয়োগ দেখিয়েছেন। তাছাড়া এই পুথিটিও পাওয়া গিয়েছে বাঁকুড়া থেকেই। এছাড়া তালশিক্ষার যে পুথিতে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কয়েকটি পদের আধুনিক রূপান্তর পাওয়া যায়, সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছে এই জেলাতেই।
বড়ু চণ্ডীদাস লোকরীতির কাব্য রচনা করলেও তিনি যে সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। যে অনায়াস দক্ষতায় ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং ''গীতগোবিন্দম্'' ও ''কুট্টিনীমতম্'' ইত্যাদি গ্রন্থের তথ্য কাব্যে ব্যবহার করেছেন এবং দেড় শতাধিক সংস্কৃত শ্লোক রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি প্রমাণিত হয়। ‘বড়ু’ শব্দটি থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন, কবি ব্রাহ্মণ ছিলেন। এটি ‘বটু’ শব্দ থেকেই আসতে পারে। বড়ু হলেন শ্রোত্রীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ। রজকিনী-ঘটিত জনশ্রুতিতে তিনি ব্রাহ্মণ বলেই কথিত। ছাতনার বাসলী আসলে খড়্গ-খর্পরধারিণী দক্ষিণাকালী। সেই সূত্রে কবিকে শাক্ত বলে গণ্য করাই সমীচীন। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ভাষা দেখে ভাষাতাত্ত্বিকেরা একে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের রচনা বলে শনাক্ত করেছেন। সম্ভবত বড়ু চণ্ডীদাস পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধেই আবির্ভূত হন।
===কাব্য পরিচয়===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক আখ্যানধর্মী কাব্য। ধ্রুপদি প্রেমকাহিনির মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিশেষত্ব-মণ্ডিত। রামসীতা বা হরপার্বতীর ন্যায় এই প্রেম স্বকীয়া বা বিবাহোত্তর প্রেম নয়, এই প্রেমের প্রকৃতি পরকীয়া। বস্তুত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাড়া আর কোথাও রাধাকৃষ্ণের স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ দেখানো হয়নি। লোক-ঐতিহ্যে রাধা কৃষ্ণের মাতুলানী। ফলে এই প্রেম নিয়ে অনেক মুখরোচক গালগল্প তৈরি হয়েছিল এক সময়ে। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে অবশ্য রাধা তত্ত্বে পরিণত। তখন তিনি কৃষ্ণের স্বকীয়া অন্তরঙ্গা শক্তি। হ্লাদিনীর সারভূত রূপ মহাভাব থেকে রাধার উৎপত্তি ব্যাখ্যাত। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাস প্রাক্-চৈতন্য যুগের কবি। রাধাকে তিনি চিত্রিত করেছেন প্রাকৃত রমণী রূপেই, কোনও আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আলোকে নয়। স্বীকার করে নিয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মাতুলানী-ভাগিনেয় সম্পর্ক। ফলে এই কাব্য লোকরঞ্জনকারী এক কাহিনিতে পর্যবসিত হয়েছে। এর ভাব, ভাষা, আঙ্গিক, পরিবেশ সবই গ্রামীণ। গ্রাম্য রুচির কাছে আত্মসমর্পণ করে পণ্ডিত কবি এই কাব্যে পুরাণকথা ও লোকশ্রুতির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তবে তাঁর মধ্যে প্রতিভার অভাব ছিল না। সেই প্রতিভায় রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির চরিত্র হয়ে উঠেছে সমুজ্জ্বল। ভাগবত পুরাণে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় না। জয়দেবই প্রথম রাধাকে নিয়ে বৃহদায়তন গাথাকাব্য রচনা করেন। বড়ু চণ্ডীদাসের অন্যতম আদর্শ এই রচনা। তবে রাধা চরিত্র চিত্রণে তিনি যে প্রখর সমাজবাস্তবতা ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন, তা অনবদ্য। দেশীয় ভাষায় এইপ্রকার বৃহদায়তন প্রথম আখ্যানকাব্য রচনার কৃতিত্ব বড়ু চণ্ডীদাসেরই প্রাপ্য।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশ পাওয়া যায়নি। মাঝের কয়েকটি পাতাও অবলুপ্ত। পাওয়া গিয়েছে তেরোটি খণ্ডে বিন্যস্ত মোট ৪১৮টি পদ। কবি প্রথম বারোটি খণ্ডের নাম দিয়েছেন যথাক্রমে (১) জন্মখণ্ড, (২) তাম্বুলখণ্ড, (৩) দানখণ্ড, (৪) নৌকাখণ্ড, (৫) ভারখণ্ড, (৬) ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড, (৭) বৃন্দাবনখণ্ড, (৮) যমুনান্তর্গত কালীয়দমনখণ্ড, (৯) যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ড, (১০) যমুনান্তর্গত হারখণ্ড, (১১) বাণখণ্ড ও (১২) বংশীখণ্ড। ত্রয়োদশ খণ্ডটির শেষাংশ পাওয়া যায়নি বলে এই খণ্ডের কবিকৃত নামটি জানা যায় না। সম্পাদক বসন্তরঞ্জন এই খণ্ডের নামকরণ করেছেন ‘রাধাবিরহ’। তেরোটি খণ্ডে অখণ্ড সুস্পষ্ট একটি গল্প বলা হয়েছে। গল্প এগিয়েছে কবির বিবৃতি এবং আখ্যানের মুখ্য তিন চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। গল্পটি সংক্ষেপে এইরকম:
অত্যাচারী কংসের পীড়নে ব্যথিতা বসুন্ধরার আর্তিতে স্বর্গের দেবতারা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কংসের বিনাশের জন্য নারায়ণ ‘কৃষ্ণ’ নাম নিয়ে বসুদেবের গৃহে দেবকীর উদরে জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁর সম্ভোগের জন্য লক্ষ্মীও প্রেরিত হলেন রাধা রূপে। তার পিতা সাগর, মাতা পদুমা বা পদ্মা। দেবগণের ইচ্ছানুসারে রাধার স্বামী হলেন নপুংসক আইহন। বালিকাবধূ রাধার পরিচর্যার জন্য এলেন পদ্মার বুড়ি পিসি বড়ায়ি। গোপরমণী রাধাকে দুধ-দই বেচতে মথুরার হাটে যেতে হয়। একদা রাধা বড়ায়ির দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়। তার রূপ-গুণ বর্ণনা করে ব্রজের রাখাল নন্দগোপসুত কৃষ্ণের কাছে বড়ায়ি রাধার সন্ধান জানতে চাইল। সেই রূপের কথা শুনে কৃষ্ণের মনে রাধাসঙ্গের বাসনা জেগে উঠল। বড়ায়ির হাতে তাম্বুল অর্থাৎ পান দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব জানালেন কৃষ্ণ। কিন্তু বিবাহিতা রাধার মনে তখনও স্বামী-সংস্কার তীব্র। পরপুরুষের প্রতি বিরাগ সে ক্রুদ্ধ হয়ে তাম্বুলে লাথি মেরে বড়ায়িকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। অপমানিতা বড়ায়ি এসে কৃষ্ণের কাছে সব জানিয়ে এর প্রতিবিধান করতে বলল। দুজনে পরামর্শ করল, যমুনার ঘাটে কৃষ্ণ দানী সেজে বসবে এবং দানের ছলে দুধ-দই নষ্ট করবে, হার কেড়ে নেবে, কাঁচুলি ছিঁড়বে। পরামর্শ অনুযায়ী কুতঘাটে বসে রইল কৃষ্ণ। রাধা সখীদের নিয়ে এল সেই ঘাটে। কৃষ্ণ দানী হয়ে মহাদান চেয়ে বসল। শুধু পণ্যদ্রব্য পার করার কড়ি নয়, রাধার অঙ্গের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ কড়ি দাবি করল সে। কড়ি না দিলে দিতে হবে আলিঙ্গন। কিন্তু রাধার পক্ষে তা মেনে নেওয়া কখনই সম্ভব নয়। শুরু হল বাগবিতণ্ডা। রাধা কৃষ্ণকে নিবৃত্ত করতে চায় মাতুলানী সম্পর্কের কথা তুলে। কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য “নহসি মাউলানী রাধা সম্বন্ধে শালী”। কৃষ্ণ রাধাকে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেও রাধা সেসব বিস্মৃত। শেষে রাধার বাধাদান সত্ত্বেও কৃষ্ণ তার সঙ্গে বনের মধ্যে মিলিত হল। আবারও বড়ায়িয়ের কৌশলে রাধা এল যমুনার ঘাটে। একাকিনী রাধাকে যমুনা পার করার সময় কৃষ্ণ মাঝ-নদীতে ঝড় তুলে রাধার মনে ভীতি সঞ্চার করল। ভয়ার্ত রাধা বাঁচার জন্য কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হল। সেই সুযোগে নদীমধ্যে দুজনের মিলন ঘটল। এতদিনে রাধা বুঝতে পেরেছে কৃষ্ণের দুর্বলতা কোথায়। তাই সে এবার নিজেই অগ্রণী হয়ে মথুরার হাটের জন্য বড়োসড়ো পসরা সাজালো। মথুরার পথে যেতে কৃষ্ণকে ‘সুরতি’ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বইয়ে নিল দুধ-দইয়ের ভার। একইভাবে দেহলোভী কৃষ্ণকে দিয়ে প্রচণ্ড রোদে ছাতাও বহন করালো রাধা। অতঃপর বৃন্দাবনে মহাসমারোহে ঘটল বসন্তের আবির্ভাব। রাধা এবার আড়চোখে চেয়ে ও নানা অঙ্গভঙ্গি করে কৃষ্ণের কামনা জাগিয়ে তুলল। ষোলোশো গোপিনী সঙ্গে বিলাস সমাপ্ত করে কৃষ্ণ রাধার কাছে এসে দেখল সে অভিমানাহত হয়ে বিষণ্ণ মনে নীরবে বসে আছে। কৃষ্ণ মধুর বচনে রাধার মান ভাঙিয়ে লিপ্ত হল সঙ্গমে। রাসলীলায় কৃষ্ণের উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে জলক্রীড়ার কথা চিন্তা করে কালীদহের বিষাক্ত জল বিষমুক্ত করতে দহে নেমে পড়ল কৃষ্ণ। বিষের তীব্রতায় কৃষ্ণ অচৈতন্য হয়ে পড়লে নন্দ, যশোদা, বলরাম প্রমুখ আত্মীয়েরা বিলাপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণের বিপদ অনুমান করে যাবতীয় লোকলজ্জা ত্যাগ করে রাধা এবার সর্বসমক্ষে ‘পরাণপতি’ বলে কেঁদে উঠল। অবশেষে কালীয় নাগকে দমন করে কৃষ্ণ উঠে এল জল থেকে। একদিন রাধা সখীদের নিয়ে যমুনায় জল ভরতে এসে কৃষ্ণের সঙ্গে জলকেলিতে মত্ত হল। সেই সুযোগে কৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করল। রাধার অনুনয়ে কৃষ্ণ বস্ত্র ফিরিয়ে দিলেও তার বক্ষহারটি লুকিয়ে রাখল। হার না পেয়ে রাধা এবার গিয়ে অনুযোগ জানালো কৃষ্ণজননী যশোদার কাছে। যশোদা কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করলে অপমানিত কৃষ্ণ ফুলধনু দিয়ে রাধাকে বাণাহত করে মূর্চ্ছিত করল। কিন্তু এবার বড়ায়ি কৃষ্ণের আচরণে ক্ষুব্ধ হল। সে তিরস্কার করে রাধার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বলল। তখন কৃষ্ণের হস্তস্পর্শে রাধার চৈতন্য হল। পরিশেষে বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের পুনর্মিলন ঘটল। এখন আর কৃষ্ণের মনে রাধার প্রতি পূর্বের অদম্য আসক্তি কিছুই নেই। বরং শারীরিক মিলনে রাধার মনে জাগ্রত হয়েছে অপূর্ব সুখোন্মাদনা। সে এখন কৃষ্ণ-অন্তপ্রাণ। তার আর কোনও লজ্জা, ভয় বা সতীত্বের বন্ধন নেই। কৃষ্ণ এবার একটি সুন্দর মোহন বাঁশি গড়িয়ে কদমতলায় বসে একমনে বাজাতে থাকে। তার সেই বাঁশির সুর রাধার চিত্তকে বিপর্যস্ত করে দেয়। সে ঘর-সংসার ভোলে, তার গৃহকর্ম নষ্ট হয়, মনে মনে ভাবে “দাসী হআঁ তোর পাএ নিশিবোঁ আপনা”। বড়ায়িকে সে বারবার বলে কৃষ্ণকে তার কাছে এনে দিতে। বড়ায়ি বিপরীত কথা বলে রাধাকে নিরস্ত করতে চায়। কিন্তু রাধার মন কোনও যুক্তিতেই বশীভূত হয় না। তখন দুজনে মিলে কৃষ্ণের সন্ধানে বৃন্দাবনে যায়। সেখানে কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। রাতে শয্যায় শায়িত রাধার কানে কৃষ্ণের বাঁশির শব্দ এসে প্রবেশ করে। সে নিদ্রিত স্বামীকে ফেলে একাকিনী কৃষ্ণমিলনের উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে পথেই মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে রাধা। বড়ায়ি তার মূর্চ্ছাভঙ্গ করে পরামর্শ দেয় কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করতে। তাই-ই করে রাধা। বাঁশি বিহনে কৃষ্ণ ব্যাকুলভাবে বিলাপ করতে থাকে। অবশেষে বড়ায়ির মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ রাধার কাছে করজোড়ে মিনতি করলে রাধা বাঁশি ফিরিয়ে দেয়। রাধার সকল অপরাধ ক্ষমা করে কৃষ্ণ। বেশ কয়েক মাস কেটে গেলেও শর্ত অনুসারে কৃষ্ণ রাধাকে আর দেখা দেয় না। এবার কৃষ্ণ বিহনে রাধার মনে হতে থাকে “এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবই অসার”। সে বারবার বড়ায়িকে কৃষ্ণ এনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বড়ায়ি তাকে পরামর্শ দেয় কদমতলায় কিশলয় শয্যা রচনা করে প্রতীক্ষা করতে। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণের দর্শন মেলে না। অতঃপর তারা বৃন্দাবনে প্রবেশ করে গোচারণরত কৃষ্ণের দেখা পায়। রাধা তখন কাতরভাবে তার কাছে অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তবুও কৃষ্ণের মন গলে না। অবশেষে বড়ায়ির অনুরোধে কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলনে সম্মত হয়। বিহারের পর শ্রান্ত হয়ে কৃষ্ণের উরুতে মাথা রেখে রাধা ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণ বড়ায়িকে ডেকে তার হাতে রাধার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে মথুরায় চলে যায়। নিদ্রাভঙ্গের পর কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে রাধা। রাধার বিলাপে অস্থির হয়ে বড়ায়ি মথুরায় গিয়ে কৃষ্ণের কাছে রাধার কথা জানায়। কৃষ্ণের বক্তব্য, সে প্রগলভা রাধার কাছে যাবে না। তার মুখদর্শন করতেও সে ইচ্ছুক নয়। আর তাছাড়া সে মথুরায় এসেছে দুরাচারী কংশকে নাশ করতে। তার আর কোনওমতেই বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়া চলে না। এরপরই পুথি খণ্ডিত। যতদূর মনে হয়, কবি রাধা ও কৃষ্ণের বিচ্ছেদেই কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন।
মধ্যযুগীয় কাব্যে প্রক্ষিপ্তি একটি বড়ো সমস্যা। সাহিত্যের সব শাখাতেই কম-বেশি এটি দেখা যায়। যে যুগের লেখকের কর্তৃত্ব সঠিকভাবে চিহ্নিত হত না, সেই যুগে একের রচনায় অন্যের হস্তক্ষেপ স্থান পেয়ে যেত নির্বিরোধে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের প্রক্ষেপ নিয়ে প্রথম সংশয় জ্ঞাপন করেন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ‘বড়ু’ ও ‘বাসলী’-বিহীন ভণিতাগুলিকে তিনি অন্যের রচনা বলে মনে করেন। দানখণ্ডের তিনটি পদে ড. সুকুমার সেন প্রক্ষেপ দেখেছেন। আবার কেউ কেউ গায়েনের প্রক্ষেপ লক্ষ্য করেছেন কাব্যের নানা স্থানে। প্রখ্যাত সমালোচক বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, সমগ্র ‘রাধাবিরহ’ অংশটিই প্রক্ষিপ্ত। তিনি মোট ছয়টি যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু যুক্তিগুলি যে ততটা প্রমাণনির্ভর নয়, সে বিষয়ে একাধিক গবেষক প্রতি-যুক্তি দিয়েছেন। বিশেষত ‘রাধাবিরহ’ যে কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার প্রমাণ রয়েছে কাহিনির অভ্যন্তরীণ কাল-পরম্পরায়, কাব্যের গঠনে, রাধার বয়সের অগ্রহতির সাক্ষ্যে, চরিত্রের ক্রম-পরিণামে এবং অবশ্যই কবির ক্রমবিকশিত প্রতিভার স্তরোন্নয়নে। কাব্যের সূচনায় ‘এগার-বরিষ’-এর রাধা এখানে পূর্ণ যুবতীতে পরিণত, কামুক কৃষ্ণ এই পর্যায়ে ভোগতৃপ্ত হয়ে ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পর্যবসিত। কবি যে ক্রমশ ভাবগভীরতার পথে এগিয়ে এসেছেন, তার প্রমাণ আছে বংশীখণ্ডেই। এই খণ্ডেরই প্রত্যাশিত পরিণাম দেখা যায় ‘রাধাবিরহ’ অংশে। যে গীতিকাব্যিক মূর্চ্ছনার সূচনা হয়েছিল “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কূলে” ইত্যাদি পদে, তার সার্থক পরিণতি ঘটল “দিনের সুরুজ পোড়াআঁ মারে রাতিহো এ দুখ চান্দে” ইত্যাদিতে। রাধার চারিত্রিক বিবর্তনে সম্পূর্ণতা দেখানোর সূত্র ‘রাধাবিরহ’ এই কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য এক অঙ্গ। অন্য কোনও কবির হাত থেকে পূর্বের কাহিনি, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদির এতখানি সঙ্গতিপূর্ণ ধারাবাহিকতা আশা করা যায় না। অতএব কিছু ক্ষেত্রে মৃদু সংশয় থাকলেও কাব্যের অন্তর্বর্তী প্রমাণে ‘রাধাবিরহ’ যে মূল কাব্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তা স্বীকার করে নেওয়া যায়। এই অংশটি না থাকলে বড়ু চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার সামগ্রিক মূর্তিটি অনুধাবন করা যেত না।
===গ্রন্থনাম বিচার===
চর্যাপদের পুথির গ্রন্থনাম নিয়ে যেমন বিতর্ক দেখে দিয়েছিল, তেমনই বিতর্ক দেখা দেয় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' পুথির নামকরণকে কেন্দ্র করেও। ''তেঙ্গুর'' তালিকা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে চর্যাপদ সম্পর্কে একটি যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, পরবর্তীকালের কোনও গ্রন্থে এই কাব্যের নামোল্লেখও করা হয়নি। প্রকৃত সমস্যার সূত্রপাত আবিষ্কৃত পুথিটির প্রথমাংশ ও শেষাংশের পাতা না পাওয়ায়। বইয়ের সূচনায় এবং পুথির শেষে সমাপ্তিসূচক পুষ্পিকাতেই গ্রন্থনাম পাওয়া যায়। এই দুই অংশ না থাকায় পুথিটি থেকে আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন কোনও নাম পাননি। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি সম্পাদিত গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। পূর্বাপর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রাচ্যতত্ত্ববিদ উইলসনের দেওয়া একটি ভ্রান্ত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নামকরণের বিষয়টি। তিনি গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি কর্তৃক যৌথভাবে রচিত ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামে এক সংস্কৃত কাব্যের কথা জানিয়েছিলেন। সেই তথ্য প্রথম বিকৃত হয় জগদ্বন্ধু ভদ্রের ‘গোবিন্দদাস’ প্রবন্ধে (''বান্ধব'', শ্রাবণ ১২৮২ সংখ্যা)। তিনি লেখেন, “উইলসন সাহেব কৃত উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে লিখিত আছে যে, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাস উভয়ে মিলিত হইয়া কৃষ্ণকীর্তন প্রণয়ন করেন।” এই সংবাদই সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করেন রমণীমোহন মল্লিক, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য, ব্রজসুন্দর সান্যাল প্রমুখ প্রাবন্ধিকেরা। ক্রমে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামক কাল্পনিক গ্রন্থটির একক রচয়িতায় পরিণত হন চণ্ডীদাস। বড়ু চণ্ডীদাসের পুথি আবিষ্কৃত হওয়ার পর বসন্তরঞ্জনও ভেবেছিলেন যে, তিনি সেই হারিয়ে-যাওয়া বহুশ্রুত গ্রন্থটিই আবিষ্কার করেছেন। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে গ্রন্থটির নাম দেন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এবং লেখকের নাম হিসেবে উল্লেখ করেন ‘মহাকবি চণ্ডীদাস’। গ্রন্থপ্রকাশের এগারো বছর পরে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে গ্রন্থনাম নিয়ে প্রথম সংশয় প্রকাশ করেন রমেশ বসু। ''সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা''-য় প্রকাশিত ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রবন্ধে তিনি এও বলেন যে, “এই গ্রন্থ সংস্কৃত ও লৌকিক পুরাণের সমবায়ে গঠিত বলিয়া ইহাও পুরাণ আখ্যা পাইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। বাস্তবিকই বাঙ্গালায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক যদি কোন মৌলিক পুরাণ থাকে তাহা এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।” ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে ''বিশ্ববাণী'' পত্রিকায় দক্ষিণারঞ্জন ঘোষ ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামক আর-একটি প্রবন্ধে ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামের কোনও ভিত্তি পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করে প্রশ্ন তোলেন, “শুধু বসন্তবাবুর ধারণা এবং শোনা কথার মূল্য কি?” চার বছর পরে নলিনীনাথ দাশগুপ্ত ''বিচিত্রা'' পত্রিকায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সামাজিক তথ্য’ প্রবন্ধে নানা দিক আলোচনা করে পুথিটির ''কৃষ্ণমঙ্গল'' নামকরণের পক্ষপাতী হন। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ''প্রবাসী'' পত্রিকায় ‘চণ্ডীদাস চরিত’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, “এক মস্ত ভুলও হয়ে গেছে, রাধাকৃষ্ণলীলার ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নাম হয়ে গেছে।” উপরিউক্ত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের ''প্রবাসী'' পত্রিকায় সম্পাদক বসন্তরঞ্জন লেখেন ‘চণ্ডীদাস চরিতে সংশয়’। সেখানে তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হন। কিন্তু তাঁর মত গবেষকদের মধ্যে ততটা গৃহীত হয়নি।
নামকরণের সমস্যাটি আরও জটিল হয় যখন ১৩৪২ বঙ্গাব্দে বসন্তরঞ্জন ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণে পুথির মধ্যে প্রাপ্ত একটি চিরকুট প্রকাশ করেন। তাতে লেখা ছিল: “শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণঃ।। শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্বের ৯৫ পচানই পত্র হইতে একসও দস পত্র পর্য্যন্ত একুন ১৬ শোল পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চাননে শ্রীশ্রী মহারাজা হুজুরকে লইয়া গেলেন পুনশ্চ আনিয়া দিবেন—সন ১০৮৯”। প্রাচীন পুথির মধ্যে এই ধরনের রসিদ পাওয়ায় এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, রসিদটি উক্ত গ্রন্থ-সংক্রান্ত। ফলে নামকরণকে কেন্দ্র করে স্পষ্টত দুটি দল তৈরি হয়ে গেল। একদল পুথিটির ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নাম রাখার পক্ষপাতী, অন্য দলের মতে এর নাম হওয়া উচিত ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব''। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। এর পাশাপাশি অধ্যাপক সত্যব্রত দে ১৩৮৬-৮৭ বঙ্গাব্দের ''রবীন্দ্রভারতী পত্রিকা''-য় একটি কূটতর্ক তুললেন, “গ্রন্থটির সঠিক নাম কি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন না কৃষ্ণকীর্তন?... যে চারটি সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে বসন্তরঞ্জন চণ্ডীদাস-রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যের অস্তিত্বে দৃঢ়নিশ্চয় হয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকটিতেই গ্রন্থনাম কৃষ্ণকীর্তনরূপে লিখিত।”
নামকরণ সমস্যার নিরিখে কয়েকটি যুক্তি গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘কীর্তন’ শব্দটির অর্থ অনেক। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ''বঙ্গীয় শব্দকোষ''-এ ‘কীর্তন’ বলতে ঘোষণা, কথন, বর্ণন, বিবরণ, গুণকীর্তন, স্তবন ইত্যাদি অর্থ নির্দেশিত হয়েছে। ‘কীর্তন’ শব্দটির বৈষ্ণবীয় অর্থ-তাৎপর্য থেকে বের করে এনে যদি প্রয়োগ করা যায়, তাহলে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি অযোগ্য হয় না। যেহেতু উইলসন তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থের নামে ‘শ্রী’ শব্দটি যুক্ত করেননি এবং বাঙালি গবেষকেরাও ''কৃষ্ণকীর্তন'' নামটিই উল্লেখ করেছেন, সেহেতু সত্যব্রত দে-র মতে বইটির নাম ''কৃষ্ণকীর্তন'' হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুক্তির গলদ হল এই যে, উইলসন যে সংস্কৃত ''কৃষ্ণকীর্তন''-এর কথা বলেছেন, তার লেখক গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি—চণ্ডীদাস নন। একটি ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এই মতটিকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন। ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামটিও এই প্রসঙ্গে বিচার্য। প্রাপ্ত রসিদটি আবিষ্কৃত পুথির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু সেই রসিদে বর্ণিত তথ্য যে উক্ত পুথি-সংক্রান্ত হবেই এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। রসিদে বলে হয়েছে যে, ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' নামক একটি পুথির ৯৫ থেকে ১১০ পত্র শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন নামে এক ব্যক্তি মহারাজের জন্য ধার করে নিয়ে গেলেন ১০৮৯ সালে অর্থাৎ ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর মাস দুয়েকের মধ্যেই পাতাগুলি ফেরৎ এল। ফেরৎ আসার পর খোয়া না যাওয়ার সম্ভাবনা, যেহেতু গ্রন্থাগারটিতে পুথি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা নেওয়া হত এবং যার প্রমাণ এই রসিদ। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ধার নেওয়া পাতাগুলির মধ্যে ৯৮/১ এবং ১০৪-১১০ পত্র অর্থাৎ মোট সাড়ে সাতটি পাতা নিখোঁজ। তাহলে অনুমান করতে হয়, অন্য কোনও পুথির ওই ১৬টি পত্র ধার নেওয়া হয়েছিল, যার রসিদটি কোনওভাবে চলে এসেছে এই পুথির মধ্যে। অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় এই ক্ষেত্রে অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, জীব গোস্বামী রচিত একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ''। এটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের একটি মূল্যবান গ্রন্থ। বিষ্ণুপুরে শ্রীনিবাস আচার্য রাজগুরু হিসেবে প্রভূত সম্মান পেয়েছিলেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। বৃন্দাবনের শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রীনিবাসের সাক্ষাৎ গুরু ছিলেন জীব গোস্বামী। বিষ্ণুপুরে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের গ্রন্থ প্রচারে একদা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন শ্রীনিবাস। ছোটো চিরকুটটির মধ্যে যে ‘আচার্য প্রভু’-র কথা আছে, তিনি এই শ্রীনিবাস আচার্য ছাড়া আর কেউ নন। তাই তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বিষ্ণুপুরের রাজা কোনও কারণে জীব গোস্বামীর ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ'' গ্রন্থেরই ১৬টি পাতা ধার নিয়েছিলেন এবং পরে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন। অতএব বসন্তরঞ্জনের প্রাপ্ত পুথিটির নাম ''শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব'' হতে পারে না। তবু এই বিষয়ে কোনও পাথুরে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' নামটি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।
===পৌরাণিক প্রভাব ও মৌলিকতা===
ভাগবতের কৃষ্ণকে অবলম্বন করে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কাহিনি গড়ে উঠলেও এই কাব্যকে কোনও সমালোচকই অনুবাদ কাব্য বলে নির্দেশ করেননি। অথচ অনুবাদের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কৃত আদর্শ থেকে আখ্যানভাগ, চরিত্র, ভাষা ইত্যাদি গৃহীত হয়ে থাকে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর কয়েকটি ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আসলে যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে অনুবাদ সাহিত্যের জন্ম বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত তার তাগিদ অনুভব করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক বৈষ্ণবধর্মের প্রতি তাঁর তেমন আনুগত্য ছিল না বলেই মনে হয়। ‘বাসুলী-সেবক’ অভিধাটিই চিনিয়ে দেয় তাঁর নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সেকালের শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বময় প্রেক্ষাপটে এই কাব্যকে উপদলীয় ধর্মবিদ্বেষের উৎসৃষ্টি বলে মনে হতেই পারে। কাব্যের নানা স্থানে তার প্রমাণও আছে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের নায়ক সম্পর্কে সকলেই প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে, এই কৃষ্ণ আদৌ বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা নন। পুরাণপুরুষ কৃষ্ণের আবরণে কবি আসলে প্রকাশ করেছেন নারীদেহ-লোলুপ এক ‘কামী’ গ্রাম্য গোপযুবককে, যে ছলনা, প্রতারণা ও বলপ্রয়োগ করে এক অনিচ্ছুক বিবাহিতা নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ‘গততৃষ্ণ’ হয়ে নির্দ্বিধায় তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমন অমানবিক পাশবিক চরিত্র দেবতার হতে পারে না। অর্বাচীন পুরাণে বর্ণিত রাধাও যেন রক্তমাংসের নারীতে পরিণত হয়েছেন এই কাব্যে, যার মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন ঘটেছে স্বামী-সংস্কারে আবদ্ধা কুলবধূ থেকে পরপুরুষের প্রেমসন্তপ্তা স্বাধীনভর্তৃকা প্রেমিকাতে। উল্লেখ্য, কবি একবারের জন্যও ‘দেবতা’ কৃষ্ণের কাছে প্রণত হচ্ছেন না, যেমন হয়েছিলেন তাঁর আদর্শ জয়দেব। পাঠক যেন তাঁর অঙ্কিত কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ স্ব-কল্পিত মনে না করে, তাই যেন কবি প্রচলিত পুরাণের সঙ্গে কৃষ্ণ চরিত্রের সম্পর্ক দেখিয়ে দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পুরাণ-বচন উদ্ধৃত করে কবি তাঁর বর্ণিত গল্পের সঙ্গে পৌরাণিকতার একটি প্রচ্ছন্ন যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। সেই সূত্রেই এসেছে ভাগবত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে সন্নিবেশিত নানা তথ্য। বিশেষ করে জন্মখণ্ড বর্ণনায় অনেকগুলি পুরাণ থেকে যে তিনি আখ্যানবস্তু আহরণ করে নিজের মতো করে সেগুলি বিন্যস্ত করেছেন তার প্রমাণ রয়েছে আখ্যান-বিন্যাসে। জন্মখণ্ডে কবি রচিত প্রথম সংস্কৃত শ্লোকটি হল:
<poem>
:: পৃথুভারব্যথাং পৃথ্বী কথয়ামাস নির্জ্জরান্।
:: ততঃ সরভসং দেবাঃ কংসধ্বংসে মনো দধুঃ।।
</poem>
এই প্রসঙ্গ বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ ও ভাগবত পুরাণেও আছে। তবে প্রত্যেকটি কাহিনিই কম-বেশি স্বতন্ত্র। যেমন, বিষ্ণুপুরাণে পৃথিবীকে বহুভারে পীড়িতা হয়ে সুমেরু পর্বতে দেবতাদের কাছে গিয়ে নিজের বেদনার কথা বিবৃত করতে দেখা যায়। পদ্মপুরাণে কংসের নিপীড়নের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। ভাগবত পুরাণে আছে বসুমতীর গোরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দুঃখ নিবেদনের সংবাদ। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে আছে দেবকীর সপ্তম পুত্রকে রোহিণীর গর্ভে মায়া দ্বারা সংক্রামিত করে অষ্টম গর্ভে নারায়ণের নিজে আবির্ভূত হওয়ার অঙ্গীকার। বড়ু চণ্ডীদাসও সেই তথ্য পরিবেশন করেছেন। এছাড়া নারায়ণ কর্তৃক দেবতাদের হস্তে কৃষ্ণ ও শুভ্রবর্ণের কেশ প্রদানের প্রসঙ্গও বিভিন্ন পুরাণ থেকে গৃহীত। অবশ্য এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, রাধার জন্মকাহিনি বর্ণনায় কবি পুরাণের পথ পরিহার করে স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। নারদের যে রূপ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অঙ্কিত হয়েছে, তারও উৎস কবির নিজস্ব কল্পনা। জন্মখণ্ড ছাড়া ভাগবতের স্পষ্ট প্রমাণ পড়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। ভাগবতে কথিত হয়েছে যে, ষোলো শত গোপিনী সঙ্গে কৃষ্ণ শরৎকালে একদা বিলাসে মত্ত হয়েছিলেন। এটি রাস নামে কথিত। বড়ু চণ্ডীদাসও এই কাহিনি অনুসরণ করেন। তাঁর রাধা এখন আর মিলনে অনিচ্ছুক নন। বরং বক্রদৃষ্টিতে ও বিচিত্র দেহভঙ্গিতে কৃষ্ণের কামনা উদ্রেক করতে যথেষ্ট পটিয়সী। অন্যান্য গোপিনী থাকা সত্ত্বেও রাধাতেই যেন কৃষ্ণের সফল তৃপ্তি। তবুও রাধার অনুরোধে সব সখীদের তৃপ্ত করার প্রতিশ্রুতির দেন কৃষ্ণ। অতঃপর বনের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়। ভাগবতেও আছে:
<poem>
:: অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বর।
:: যন্নো বিহায় গোবিন্দ প্রীত যামনয়দ্রহঃ।।
</poem>
তবে ভাগবতের ঘটনাক্রম অনুসরণ করেননি বড়ু চণ্ডীদাস। ভাগবতের রাস অনুষ্ঠিত হয়েছিল কংসবধের পরে, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ রাস হল কংসবধের পূর্বেই। তাছাড়া ভাগবতের রাস শরৎকালীন এবং নিশাকালে সম্পন্ন, কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ আছে দিবাকালীন বাসন্তী রাসের বর্ণনা। এক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাস সম্ভবত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জয়দেবের দ্বারা। ''গীতগোবিন্দম্''-এর দু-একটি পদের আক্ষরিক গীতানুবাদও রয়েছে বৃন্দাবনখণ্ডে। যেমন, “রতি তোর আশোআশেঁ গেলা অভিসারে” ইত্যাদি। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কৃষ্ণের বৃন্দাবন-বিলাস একান্তভাবেই ভাগবত-বর্ণিত রাতের অনুকরণজাত। ভাগবতের সঙ্গে এই কাব্যের মিল আছে কালীয়দমনখণ্ডের কাহিনিতেও। দুই গ্রন্থেই কালীদহের জলে নেমে কৃষ্ণ কর্তৃক কালীয়নাগ দমনের প্রসঙ্গ আছে। তবে বড়ু চণ্ডীদাস উদ্দেশ্যের ভিন্নতা দেখিয়েছেন। ভাগবতকার যেখানে কালীদহের বিষাক্ত জল বৃন্দাবনবাসীর ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য কৃষ্ণকে নাগদমনে নিয়োজিত করেছেন, সেখানে বড়ু চণ্ডীদাস দেখাতে চেয়েছেন যে, সখীদের নিয়ে জলক্রীড়ার করার জন্য কালীদহ বিষমুক্ত করতে কৃষ্ণ সেই জলাশয়ে ঝাঁপ দেন। অচৈতন্য কৃষ্ণের আত্মজ্ঞান ফেরানোর জন্য বলরামের দশাবতার স্তবের মধ্যে ক্রম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এই কাব্যে। বরাহপুরাণে কৃষ্ণের নাম আছে অষ্টম স্থানে, সেখানে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কাহিনির প্রয়োজনে তা সবশেষে উল্লিখিত। বস্ত্রহরণের প্রসঙ্গটিও ভাগবত থেকে নেওয়া। তবে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বস্ত্রের সঙ্গে কৃষ্ণ রাধার হারও চুরি করে নেয় এবং সব কিছু ফিরিয়ে দিলেও হারটি নিজের কাছে রেখে দেয়। এই তথ্য ভাগবতে নেই। আখ্যানের বাইরেও পুরাণের প্রভাব আবিষ্কার করা যায় কবি কর্তৃক নানা পৌরাণিক প্রসঙ্গের অবতারণায়। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে উপমা ও উৎপ্রেক্ষা স্বরূপ এগুলি সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন তিনি। পরদারাসক্তির সমর্থনে কৃষ্ণের উক্তিতে এসেছে কুন্তী, রম্ভা ও গঙ্গার প্রসঙ্গ। এর বিপক্ষে রাধা উদাহরণ দিয়েছেন সোম-তারা, ইন্দ্র-অহল্যা ও চণ্ডী কর্তৃক সুন্দ-উপসুন্দ বধের। পুরাণশাস্ত্রে কবির পাণ্ডিত্যের প্রমাণ এগুলি। কিন্তু এইসব দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কৃষ্ণমাহাত্ম্যমূলক কাব্য নয়। পুরাণের পরিচিত গল্পকে আশ্রয় করে কবি এতে লৌকিক জীবনের পরিচয়ই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মৌলিকতা দেখিয়েছেন রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্র চিত্রণে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের তেরোটি খণ্ডের মধ্যে মোট চার-পাঁচটি খণ্ডে পুরাণের প্রভাব বাদ দিলে অবশিষ্ট খণ্ডগুলি কম-বেশি কবির স্ব-কল্পিত। বিশেষত তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড, ভারখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড পুরোপুরি কবির নিজস্ব উদ্ভাবনা। এগুলির কোনও সাহিত্যিক উৎস নেই। আখ্যান-সূত্রে বোঝা যায়, জন্মখণ্ডের পর কাহিনিকে কবি লোকসমাজের রুচি অনুযায়ী পরিবর্তিত করে নেন। দেবতাদের অনুরোধে কৃষ্ণ পৃথিবীতে আসেন বটে, তবে তাঁর মুখ্য কাজ কংসবধ আপাতত গৌণ হয়ে যায়, পরিবর্তে রাধার দেহসম্ভোগে তিনি মত্ত হয়ে ওঠেন। তার জন্য ছলনা, চাতুরী, কৌশল, বলপ্রয়োগ কোনও কিছুতেই দ্বিধা নেই তাঁর। লম্পট পুরুষের মতোই কৃষ্ণের হাবভাব, গ্রাম্য গোঁয়ারের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ তাঁর কথাবার্তা। জন্মখণ্ডের কর্তব্যপরায়ণ নারায়ণের সঙ্গে এই কৃষ্ণকে কোথাও মিলিয়ে নেওয়া যায় না। পাশাপাশি এটাও দেখা যায় যে, কবি কৃষ্ণকে পদ্মনাভ, চক্রপাণি, গদাধর ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে পুরাণের অনুসরণ করেছেন, আবার অন্যদিকে মগর-খাড়ু পরিয়ে, হাতে লগুড় ধরিয়ে গ্রাম্য যুবকে রূপান্তরিত করেছেন। এই বিষয়ে ড. সত্যবতী গিরি তাঁর ''বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ'' গ্রন্থে লিখেছেন, “গ্রামীণ সাধারণের রুচিকে পরিতৃপ্ত করার জন্যই কবি কৃষ্ণের এই গ্রাম্যরূপ অঙ্কন করেছেন। নিঃসন্দেহে এটিও কবির লোকমুখিতারই প্রমাণ।” (পৃ. ৬৫)
রাধার ক্ষেত্রে কবি অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। তার জন্মকাহিনি কোনও পুরাণকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠেনি। বস্তুত ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ কিংবা হরিবংশে রাধার উল্লেখও করা হয়নি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধা কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী, যা অন্য কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে দেখা যায় না। এই পুরাণে রাধার পিতামাতার পরিচয়ও আছে। তিনি বৃষভানু ও কলাবতীর কন্যা। আবার পদ্মপুরাণে রাধার মায়ের নাম কীর্তিকা বা কীর্তিদা। বড়ু চণ্ডীদাস এসবের সঙ্গে পরিচিত হয়েও এক নতুন সংবাদ দিলেন—কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্য দেবগণের নির্দেশে লক্ষ্মী রাধা হয়ে এলেন। তাঁর পিতা সাগর গোপ, মাতা পদ্মা। রাধাকে কবি প্রথমাবধিই আত্মবিস্মৃত করে রাখলেন। সেই সঙ্গে লৌকিক জনশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর বিবাহ দিলেন নপুংসক আইহনের সঙ্গে। ফলে কাহিনির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অবকাশ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে নাটকীয়তা। সতীত্ব-সংস্কারে বাঁধা বিবাহিতা রাধার সঙ্গে দেহলোভী কৃষ্ণের বাগবিতণ্ডা বেশ জমে উঠেছে। রাধার এই কৃষ্ণ-বিমুখতা কবির নিজস্ব কাব্যভাবনার ফসল। তাম্বুলখণ্ডে বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে কৃষ্ণের কামাসক্ত হওয়া এবং বড়ায়িকে দিয়ে তাম্বুল প্রেরণ, রাধা কর্তৃক বড়ায়ির অপমান এবং ক্রুদ্ধ বড়ায়ির কৃষ্ণকে রাধা-লাঞ্ছনার মন্ত্রণা দান কোনও পুরাণেই নেই। আসলে কবি জয়দেবের কাব্য থেকে রাধার পূর্ণায়ত ছবিটি গ্রহণ করলেও তাতে সামাজিকতার রং চড়িয়ে তাঁকে অনেক বেশি বাস্তবের নারী করে তুলেছেন। এই রাধার মধ্যে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, কামনা-বাসনা, রিরংসা, লোভ, দুঃখ-বেদনা সবই পুঞ্জীভূত হয়েছে। দানখণ্ডের আখ্যানেও দেখা যায়, কৃষ্ণের দানী সেজে বসা, মথুরার ঘাটে তর্ক করা, রাধার দই-দুধ নষ্ট করা, পরিশেষে তাঁর দেহসম্ভোগ পুরাণ-বহির্ভূত বিষয় হিসেবে কাহিনিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেছে। নৌকাখণ্ডে নৌকার মাঝি সেজে ছল করে রাধাকে সম্ভোগ করতে, ছত্রখণ্ড ও ভারখণ্ডে সঙ্গমলোভে দই-দুধের পসরা বহন করতে এবং রাধার মস্তকে ছত্রধারণ করতে দেখা যায় কৃষ্ণকে। হারখণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার হার চুরি, ক্ষুব্ধ রাধার যশোদার কাছে নালিশ, তিরষ্কৃত কৃষ্ণের বাণ মেরে রাধাকে মূর্চ্ছিত করা এবং বড়ায়ির ভর্ৎসনায় রাধার চেতনা সম্পাদন করাও কবির নিজস্ব কল্পনা। বংশীখণ্ডে বাঁশির শব্দে গৃহস্থালির কাজ-ভোলা রাধার ছবি অনবদ্য। এর জন্য কবির কোথাও কোনও ঋণ নেই। বড়ায়ির পরামর্শে রাধা যে কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে আবার ফিরিয়ে দেয় তারও কোনও প্রাচীন উৎস নেই। রাধাবিরহ অংশে বড়ায়িকে বারবার কৃষ্ণ এনে দেওয়ার অনুরোধ, এমনকি শেষ সম্ভোগের পর বড়ায়ির হাতে রাধাকে সমর্পণ করে কৃষ্ণের প্রস্থানও কবির স্ব-কল্পিত। এগুলির একটিও পুরাণ-বর্ণিত ঘটনা নয়। আর এই অংশগুলিতে অশ্লীলতা ও গ্রাম্যতা দোষেরও আধিক্য দেখা যায়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গটিও একটি বিচার্য বিষয়। মনে রাখতে হবে, এই কাব্য রাজসভার সাহিত্য নয়, গ্রাম্যের অখ্যাত অশিক্ষিত অপরিশীলিত সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যেই এর রচনা। যে পাশ্চাত্য প্রভাবজাত মার্জিত সাহিত্যবোধের আধুনিক পাঠক সাহিত্যকে বিচার করেন, পঞ্চদশ শতকের বাংলায় তার আবির্ভাব ঘটেনি। বরং ভারতীয় সাহিত্যের আদিরসকেই এই কাব্যে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন ভারতে যৌনতাকে বিশিষ্ট জ্ঞানশৃঙ্খলা হিসেবে পাঠ করার রীতি ছিল, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''। তাছাড়া ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের রতিই প্রথম ভাব, রসের আদিতে দাঁড়ায় শৃঙ্গার রস। কৃষ্ণের ন্যায় দেবচরিত্রে কলঙ্কের কথা যদি তোলা হয়, তাহলে বলতে হবে সমান দোষে দুষ্ট পুরাণকারও। তাঁরাও দেবরাজ ইন্দ্রকে অগম্যাগামী লম্পট পুরুষ রূপে চিত্রিত করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রতিবেশে ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কাব্যে ধর্মের আবরণে আসলে কবি শুনিয়েছেন সমকালের জীবনকথা। রাধা ও কৃষ্ণের পৌরাণিক ঐতিহ্যমণ্ডিত নামগুলি সরিয়ে ফেলতে পারলেই সারা কাহিনিতে অনুভব করা যাবে পঞ্চদশ শতকের বাঙালি সমাজকে। তখন কৃষ্ণ আর ঐশী সত্তা থাকেন না, হয়ে পড়েন সামন্ততান্ত্রিক পুরুষ-শাসিত সমাজের ব্যভিচার-দুষ্ট পুরুষ, যে নারীকে লাঞ্ছিত করে কেড়ে নেয় তার নিজস্ব সম্পদ, সামাজিক বলদর্পিতায় পিষ্ট করে নারীর স্বাধীন সত্তা। বুঝতে অসুবিধাই হয় না, বড়ু চণ্ডীদাস আসলে তাঁর কালের ধৃষ্ট কামুক পুরুষ ও লাঞ্ছিতা নারীর কথাই বলতে চেয়েছেন তাঁর কাব্যে, কেবল কালের অনুরোধে তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছে ধর্মের আবরণ। ধর্মের এই অনাবশ্যক অংশটুকু বাদ দিলেই কৃষ্ণকথা পরিণত হতে পারত বিশুদ্ধ মানবকথায়, এবং বাঙালি পাঠক সেদিনই লাভ করতে পারত আধুনিক সাহিত্যের স্বাদ।
===চরিত্রবিচার: কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি===
আখ্যানধর্মী সাহিত্যে চরিত্র এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাহিনি স্থূল ঘটনামাত্রের বিবরণ নয়, তার পিছনে থাকে পাত্রপাত্রীর সচেতন চিন্তা ও ক্রিয়া। চরিত্র বিবর্তিত হয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কখনও ঘটনা চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, কখনও চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে ঘটনাকে। এইভাবে তৈরি হয় দ্বন্দ্বময়তা, আখ্যানে আসে গতি। ঘটনা ও চরিত্রের আপেক্ষিক প্রাধান্য বিচার করলে দেখা যায়, মধ্যযুগের কবিরা ঘটনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, চরিত্রের অন্তঃরহস্য উদ্ঘাটনে ততটা যত্নবান হননি। অথচ চরিত্র-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তাঁদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হত, যেহেতু তাঁদের কাব্যের আখ্যানবৃত্ত ছিল পূর্বনির্ধারিত। অল্প যে কয়েকজন কবি এর ব্যতিক্রম বড়ু চণ্ডীদাস তাঁদের অন্যতম। আখ্যান-বিন্যাসে যেমন তিনি পুরাণকে অতিক্রম করে মৌলিকতার সাক্ষর রেখেছেন, তেমনই চরিত্রগুলিও তাঁর হাতে পেয়েছে অন্য মাত্রা।
====কৃষ্ণ====
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রটি সম্পর্কে শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ''মধ্যযুগের কবি ও কাব্য'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শ্রেষ্ঠত্বের সবটুকু আত্মসাৎ করিয়াছে রাধা। যাহার নাম কীর্তন করিতে কাব্যটির রচনা সেই শ্রীকৃষ্ণই উহার দোষের আশ্রয়। কাব্যটির যত কিছু দুর্নাম কৃষ্ণের জন্যই।” এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে দুটি কথা বলা যায়। প্রথমত, বড়ু চণ্ডীদাস যে কৃষ্ণের মাহাত্ম্যকীর্তনের জন্য কাব্য রচনা করেননি তার প্রমাণ ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এই পাওয়া যায়। তাছাড়া এই কাব্যের নামকরণও যে কবিই করেছেন, তার কোনও উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, কাব্যের দোষ কাব্য-বর্ণিত কোনও চরিত্রের স্বভাব বা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না, করে অলংকারশাস্ত্রে কথিত নানা মানদণ্ডের উপরে। রসাভাসে বা অঙ্গীরসের পরিস্ফুটনে বাধা সৃষ্টি হলে কাব্যে দোষ দেখা যায়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' এইসব ত্রুটি থেকে মুক্ত। আসলে এই কাব্যের কৃষ্ণ জয়দেবের ধীরললিত নায়ক কিংবা চৈতন্য-পরবর্তী যুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্বময় কৃষ্ণ নয় বলে পাঠকের অভ্যস্থ রসসিদ্ধ সংস্কারে আঘাত লাগে। এই কৃষ্ণ শাস্ত্রবর্ণিত দেবতা নয়, বরং কবির সমাজবোধ-প্রসূত রক্তমাংসের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে দেবত্বের মোড়কে তিনি তাঁর যুগের লম্পট মানবিকতাবোধশূন্য কামুক পুরুষকেই হাজির করেছেন কাব্যের কাঠামোয়। অর্থাৎ কৃষ্ণ চরিত্র চিত্রণে কবিকে দুই দিক সামলে চলতে হয়েছে। একদিকে তাঁকে রক্ষা করতে হয়েছে কৃষ্ণের প্রথাগত দেবতা এবং অনুদিকে তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে তাঁর সমকালের সাধারণ মানুষের বাস্তব আচরণকে। এইভাবে জোড়াতালি দিতে গিয়ে তিনি যে সব দিকে সঙ্গতি রক্ষা করতে পেরেছেন তা নয়, তবে তাঁর চেষ্টার মধ্যে যে আন্তরিকতা ও অভিনবত্ব ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জন্মখণ্ড থেকে রাধাবিরহ পর্যন্ত সর্বত্রই কৃষ্ণের উপস্থিতি। তবে প্রথম দিকে সেই উপস্থিতি যতটা সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ, শেষ দিকে তা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে কৃষ্ণকে অবলম্বন করে মুখ্যত রাধা চরিত্রেরই বিকাশ দেখিয়েছেন কবি।
জন্মখণ্ডের কৃষ্ণ ঐশী ভাবান্বিত এক পরম সত্তা। পুরাণপুরুষের আবির্ভাব কাহিনি এখানে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে পুরাণের অনুসরণ করেই। কৃষ্ণের প্রথাগত দেবত্ব রক্ষা করা হয়েছে পুতনা-বধ, যমলার্জুন ভঙ্গ ও কেশী দানব বিনাশের পৌরাণিক কাহিনির অবতারণায়।
ভাগবতের এই ঐশ্বর্যময় কৃষ্ণ তাম্বুলখণ্ডে এসে হঠাৎ প্রকৃতি বদল করে ফেলে। এখান থেকেই সে পরিপূর্ণ গ্রাম্য গোপযুবক। সে উদ্ধত, হঠকারী, একগুঁয়ে, হৃদয়হীন ও নারীদেহ-লোলুপ। ভূ-ভার হরণের জন্য যে তার আবির্ভাব সে কথা সে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপবর্ণনা শুনে সে এক লালসাদীপ্ত কামুকে পরিণত। তার সমস্ত প্রচেষ্টার মধ্যে রাধাকে করায়ত্ত করার বাসনাই প্রকট। প্রথমে তাম্বুল প্রেরণ করে সে ভদ্রভাবে মিলনের প্রস্তাব জানায়, রাধা তা অপমান করে প্রত্যাখ্যান করলে সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেয় ছলে বলে কৌশলে করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়ে। এই দুটি খণ্ডে তো বটেই, ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডেও কৃষ্ণের দেবত্ব তলানিতে এসে ঠেকে যখন সে ‘সুরতি’ লাভের লোভে সমস্ত মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে রাধার দই-দুধের ভার বহন করে এবং তার মাথায় ছত্রধারণ করে।
বৃন্দাবনখণ্ডের কৃষ্ণ কিছুটা জয়দেব-অনুসারী, তবু কবি এখানে কৃষ্ণ চরিত্রে বিশিষ্টতা এনেছেন। জয়দেবের কাব্যভাষার অনুবাদ যেন কৃষ্ণের মুখে, “তোহ্মে সে মোহোর রতন ভূষণ তোহ্মে সে মোহোর জীবন”। আবার জয়দেবের কৃষ্ণ রাধাকে ত্যাগ করে অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে বিহার করলেও বড়ু চণ্ডীদাসের কৃষ্ণ রাধার অনুরোধে গোপিনীদের সঙ্গে বিহাররত।
কালীয়দমনখণ্ডে কবি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে নিয়ে যান পুরাণবৃত্তে। জলক্রীয়ায় ইচ্ছুক কৃষ্ণ বীরত্ব সহকারে বিষাক্ত জলে নেমে দর্পের সঙ্গে কালীয়নাগ দমন করে। ভাগবতের কাহিনি হলেও দুষ্ট কৃষ্ণের আর-এক রূপ পাওয়া যায় বস্ত্রহরণখণ্ডে। কবি গ্রাম্য আচরণে অভ্যস্থ যৌবনলোভী যুবকের ছবি এঁকেছেন এখানে। রাধার আকুতিতে তার বসন ফিরিয়ে দিলেও কৃষ্ণ হার গোপন রাখে। রাধা অভিযোগ জানান যশোদার কাছে। মায়ের কাছে ভর্ৎসিত কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে সে বাণখণ্ডে হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়ে রাধাকে বাণে সংজ্ঞাহীন করে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের এই পর্যায় থেকে দেখা যায়, রাধার প্রতি কৃষ্ণের পূর্বের আকর্ষণ প্রায় তিরোহিত। এর সঙ্গত কারণ কবি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। যে যৌন-আকাঙ্ক্ষা প্রথমাবধি কৃষ্ণকে চালিত করেছে, এখন তার পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে কৃষ্ণ রাধার প্রতি বিগতস্পৃহ হয়ে পড়েছে। ‘কামী’ কৃষ্ণ এখন ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণে পরিণত। তাই রাধার সামান্য অপরাধ সে ক্ষমা করতে পারে না। তুচ্ছ কারণে সে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না রাধার কাছ থেকে। কৃষ্ণের এই নির্মমতা সত্যই সমালোচনার যোগ্য। তাই দেখা যায়, যে বড়ায়ি এতদিন কৃষ্ণকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে রাধার সতীত্বের দর্প চূর্ণ করতে সাহায্য করেছে, এখন সেই বর্ষীয়সী অভিভাবিকাই তিরস্কার করছে ‘দেব বনমালী’ রাধাকে সংজ্ঞাহীন করে দিয়েছে বলে। বড়ায়ি ভর্ৎসনা না করলে কৃষ্ণ রাধার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনত কিনা সন্দেহ।
রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের এই শীতলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে। এতক্ষণ কৃষ্ণের আচরণ অভব্য ও অশালীন ছিল বটে, কিন্তু শিশুসুলভ ছিল না। কিন্তু বংশীখণ্ডে দেখা গেল পূর্বাপরসঙ্গতিবিহীন এক কৃষ্ণকে। সে নিস্পৃহ চিত্তে একাকী বৃন্দাবনে বসে বাঁশি বাজায়। সে বাঁশির শব্দে রাধার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণকে না পেয়ে বড়ায়ির পরামর্শে রাধা বাঁশি চুরি করে। বাঁশি না পেয়ে কৃষ্ণ অবোধ বালকের মতো কাঁদতে থাকে। শেষে বড়ায়ির বুদ্ধিতে করজোড়ে রাধা ও গোপীদের কাছে করুণ স্বরে বাঁশি ফেরৎ চায় সে। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণ চরিত্রের পূর্বের গাম্ভীর্যটুকু সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে এখানে।
রাধাবিরহেও কৃষ্ণ চরিত্র একই রকম সামঞ্জস্যহীন। রাধার বিষয়ে তার ক্রমবর্ধমান অনীহা খণ্ডটির প্রথম ও শেষ দিকে বজায় থাকলেও মধ্যাংশে, বিশেষত মিলনের পর, কৃষ্ণের আচরণ বিস্ময়করভাবে অন্য রকম। বড়ায়ির অনুরোধেই কৃষ্ণ মথুরা ছেড়ে বৃন্দাবনে এসেছে কেবল রাধার সঙ্গে মিলিত হতে। লক্ষণীয়, কৃষ্ণ এবার নিষ্ঠুর হয়েও পুরোপুরি নির্মম হতে পারেনি। মিলনকালে তো বটেই, মিলনের পরেও কৃষ্ণের কয়েকটি আচরণ বেশ অপ্রত্যাশিত। সে তৎক্ষণাৎ স্থান পরিত্যাগ করে না, রতিক্লান্ত সঙ্গিনীর পরিচর্যা করে:
<poem>
:: নব কিশলয়ত শয্যা রচিল।
:: নিজ উরুতলে তাক নিশ্চলে রাখিল।।
</poem>
নিদ্রিতা রাধার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্যও কৃষ্ণের কত আয়াস। মথুরায় যাওয়ার আগে বড়ায়ির হাতে রাধাকে অর্পণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে যায় সে। কামুক কৃষ্ণের এই হঠাৎ জেগে-ওঠা কর্তব্যবোধের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমগ্র ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কেবল এই অংশটুকুতে প্রেমিক কৃষ্ণ এক ঝলক উঁকি দিয়েই চিরতরে হারিয়ে যায়। গ্রন্থ শেষ হয়েছে রাধার প্রতি বিতৃষ্ণ কৃষ্ণের উক্তিতে:
<poem>
:: শতকী না কর বড়ায়ি বোঁলো মা তোহ্মরে।
:: জায়িতেঁ না ফুরে মন নাম শুণী তারে।।
:: যত দুখ দিল মোরে তোম্ভার গোচরে।
:: হেন মন কৈলোঁ আর না দেখিবোঁ তারে।।
</poem>
কৃষ্ণের এই হৃদয়হীন উক্তি ও আচরণ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কারণ, এ কাব্যে সে স্বর্গের দেবতা নয়, দেবতার খোলসে ঢাকা রক্তমাংসের কামতাড়িত দোষগুণান্বিত পার্থিব মানুষ।
====রাধা====
বড়ু চণ্ডীদাসের খ্যাতি মূলত তাঁর রাধা চরিত্রটির জন্য। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যের রাধা তত্ত্ব বা পুরাণ-সম্ভূত চরিত্র নয়, একজন সামান্যা নারী। কিন্তু সৃষ্টিকৌশলে সে হয়ে উঠেছে অসামান্যা। প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে রাধার নাম নেই; অর্বাচীন পুরাণেও তথ্যে নানা পার্থক্য দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস রাধার জন্মেতিহাস রচনা করেছেন নিজের মতো করে। বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী “কাহ্নাঞির সম্ভোগ কারণে” দেবতাদের নির্দেশে রাধা দেহ ধারণ করে মর্ত্যে আবির্ভূতা। কিন্তু স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কাব্যের দ্বন্দ্ব আকর্ষণীয় করতে কবি তাকে করেছেন আত্মবিস্মৃত। লোকশ্রুতিতে রাধা নপুংসক আইহনের পত্নী। সেই লোকশ্রুতি অনুসারেই কবি অল্পবয়সী বিবাহিতা রাধার দাম্পত্যজীবনের ছবি এঁকেছেন। সেই সূত্রে রাধার চারপাশে তৈরি হয়েছে একটি সামাজিক পরিচিতির বলয়, বাস্তব সংসারের রমণীর লৌকিক সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, রাগ-দেষ, আবেগ-আর্তি, বিশ্বাস-সংস্কার তার মধ্যে নিহিত। অথচ বড়ু চণ্ডীদাস যাঁর দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত সেই জয়দেবের কাব্যে রাধা কল্পলোকসম্ভব রোম্যান্টিক নায়িকার গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেনি। আসলে বাস্তব-সচেতন জীবনশিল্পীর চোখ দিয়েই কাব্যের চরিত্রকে দেখতে চেয়েছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস; কোনও তত্ত্ব, আবেগ বা ভাবাতিরেক তাঁকে চালনা করেনি। এইজন্য পদাবলির চণ্ডীদাসের রাধা কেবল কৃষ্ণনাম শ্রবণেই মিলনোৎকণ্ঠায় কালযাপন করেন, কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা সতীত্ব-সংস্কারের তাড়নায় প্রথমে কৃষ্ণের কুপ্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। রাধার এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কারণ কবি তাকে পঞ্চদশ শতকের বাংলার পুরুষশাসিত সমাজে স্থাপন করে তার সংকট, সীমাবদ্ধতা, আনন্দ, আবেগ, ক্রোধ, মোহ ইত্যাদিকে মূর্ত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। একজন দক্ষ মনস্তাত্ত্বিক শিল্পীর মতো এই চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনেও যত্নবান হয়েছেন তিনি। কৃষ্ণের অনাবৃত কামবাসনার সূত্রে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে যৌন-মনস্তত্ত্বও। এক রতি-অনভিজ্ঞা নারীর ক্রমশ দেহসুখের মধ্যে দিয়ে প্রেমের অমরাবতীতে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রাপথ চিত্রিত হয়েছে এখানে। প্রেম শিকড়হীন কল্পলতা বা নিরালম্ব কোনও মানসিক আবেগ নয়, তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে দেহভাবনা—এই বিশ্বাসে ভর করেই কবি রাধাকে রূপ দিয়েছেন, নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন তার সঙ্গতিপূর্ণ বিবর্তন।
বড়ু চণ্ডীদাস রাধার উদ্দেশ্যে যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন, তাতেই রাধার রূপলাবণ্যের কমনীয়তা ধরা পড়েছে। নাবালিকা কুলবধূ এই রাধা ‘শিরীষকুসুম কোঁঅলী’, ‘অদ্ভুত কনকপুতলী’ ও ‘তীনভুবনজন মোহিনী’। কিন্তু সাধারণ গোপরমণী হিসেবে সংসার নির্বাহ করতে মথুরার হাটে তাকে দই-দুধ বেচতে যেতে হয়। তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত বড়ায়ির। এই বড়ায়ির মুখে রাধার রূপলাবণ্যের কথা শুনে কৃষ্ণ তাম্বুল দিয়ে মিলনের প্রস্তাব জানালে সতীত্ব-সংস্কারে আবদ্ধা রাধা ক্ষিপ্ত হয়। বড়ায়িকে সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়:
<poem>
:: ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর আছে সুলক্ষণ দেহ।
:: নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা।।
</poem>
বীরপত্নী হওয়ার গর্বও তার কম নয়। সে বড়ায়িকে প্রহার করে তাম্বুলে লাথি মেরে প্রকারান্তরে কৃষ্ণকেও অপমান করে। বস্তুত দেহ-মনের দুর্বলতাহীন এই সতীত্ববোধ ভারতীয় নারীর চিরকালের সম্পদ। রাধার আত্মমর্যাদাপূর্ণ বলিষ্ঠ ঘোষণা তাকে স্বতন্ত্র নারীব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। কিন্তু যে সমাজ স্বৈরাচারী পুরুষের অধীনে, সেই সমাজে নারীর এই স্বাধীন অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। রাধার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কৃষ্ণে একে কামাতুর, তার উপর সামান্য নাবালিকা কর্তৃক অপমানিত। লাঞ্ছিতা বড়ায়িও তারই পক্ষে। অতএব দানখণ্ডে প্রবল তর্কাতর্কির পর কৃষ্ণের গায়ের জোরের কাছে সহজেই হার হয় রাধার। মথুরার ঘাটে কপট দানী কৃষ্ণ জোর করে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়। মিলনের পূর্বে সে কৃষ্ণকে বারবার সাবধান করে দেয় যেন তার অঙ্গসজ্জা নষ্ট না হয়। অর্থাৎ এই মিলনকে সে গোপন রাখতে চায়। নৌকাখণ্ডে আবার ছলনাময় কৃষ্ণের ফাঁদে ধরা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয় রাধাকে। তবে এবার ভয় ও লজ্জা মিশ্রিত এক আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার মনে। অনিচ্ছা ও ক্ষীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাধার মনে কোথাও যেন মিলনসুখের অঙ্কুর দেখা দেয়: “রাধার মনত তবেঁ জাগিল মদন”। তাই এবারের মিলনের কথা রাধা গোপন করে বড়ায়ির কাছে, কৃষ্ণের অত্যাচারের কথা চেপে গিয়ে বরং তার উপকারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে:
<poem>
:: ডুবিআঁ মরিতোঁ যবেঁ না থাকিত কাহ্নে।
:: আত্মা লআঁ সান্তরিআঁ রাখিল পরাণে।।
:: এবার কাহ্নাঞিঁ বড় কৈল উপকার।
:: জরমেঁ সুঝিতেঁ নারোঁ এ গুণ তাহার।।
</poem>
এখন থেকে রাধা কৃষ্ণের কাছে তার মূল্য বোধে, অনুমান করতে পারে কৃষ্ণের দুর্বলতাও। সেই অভিজ্ঞতাকেই রাধা এবার দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডে। ‘সুরতি’ দানের লোভ দেখিয়ে ভার ও ছত্র বহন করায় বটে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রত্যাশা পূরণ করে না। আবার এটাও লক্ষণীয় যে, এক নপুংসকের স্ত্রী হিসেবে উদ্ভিন্নযৌবনা রাধার মধ্যে পরপুরুষের দেহসম্বন্ধের ফলে জাত কামবাসনা পরিতৃপ্তির জন্য অন্য কোনও বৈধ পথও খোলা নেই। অতএব নৌকাখণ্ডে অঙ্কুরিত দেহচেতনা এবার বৃন্দাবনখণ্ডে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। কৃষ্ণ নয়, এবার রাধা নিজেই মিলনাকাঙ্ক্ষী হয়ে বড়ায়ির কাছে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। এমনকি বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্য শাশুড়ির অনুমতি লাভে নতুন কৌশল ফাঁদে। কৃষ্ণ অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে বিহার করলে রাধার মনে মানের উদয় হয়। প্রেমে অধিকারবোধ না জন্মালে তথা প্রেম পরিপক্ক না হলে এই মান বা ঈর্ষা জাগ্রত হওয়া সম্ভব নয়। কালীয়দমনখণ্ডে আরও একধাপ এগিয়ে যায় রাধা। কৃষ্ণ মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লে আতঙ্কিত রাধা সর্বসমক্ষে ‘পরাণ পতী’ বলে উল্লেখ করে; কৃষ্ণবিহনে যে তার ধন-জন, জীবন-যৌবন সবই বিফল সে-কথাও জানায় বিলাপের কালে।
পরবর্তী দুই খণ্ডে অবশ্য রাধা চরিত্র একটু খাপছাড়া। কেউ কেউ একে “মানের এক এক পর্যায়” বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু হারখণ্ডে যশোদার কাছে রাধার নালিশ জানানোর ঘটনাটিকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। সম্ভবত কাহিনির প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চরিত্রাঙ্কন করতে গিয়েই এই ত্রুটি ঘটেছে। যাই হোক, যশোদা কর্তৃক তিরস্কৃত কৃষ্ণ এবার নির্মম হয়ে ওঠে এবং পূর্বসম্বন্ধ একপ্রকার বিস্মৃত হয়েই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফুলশর দিয়ে রাধাকে মূর্চ্ছিত করে। পরবর্তী দুই খণ্ডে যে মিলন-ব্যাকুল রাধাকে দেখা যায়, সেও এই পুষ্পধনুর অদৃশ্য প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে। কারণ, এর আগে রাধাকে এতটা বিহ্বল হতে দেখা যায়নি। এবার তার দ্বিধা, সংকোচ, জড়তা কিছুই নেই। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বংশীখণ্ডের ও রাধাবিরহের রাধা তীব্রভাবে দেহবাসনাকেই তুলে ধরেছে। কৃষ্ণের মোহনবাঁশির স্বর তাকে উন্মনা করে, মিলনে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু কোথাও প্রিয়তমকে না পেয়ে সুযোগ বুঝে বাঁশি লুকিয়ে রেখে মনের যন্ত্রণা লাঘব করতে চায় সে। আবার কৃষ্ণের আকুল অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাঁশি ফেরৎ দিতেও সে দ্বিধা করে না।
রাধাবিরহের অধিকাংশ পদেই ক্রন্দনরতা রাধার বিরহের দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রাধাবিরহ অংশে রাধার যে বেদনা তাহা নিতান্ত ব্যক্তিগত বেদনা নয়। বেদনার সুর ব্যক্তিকে অতিক্রম করিয়া সর্বকালের সর্বদেশের বিরহ-বেদনার সুরের সহিত মিলিত হইয়াছে।” এই রাধার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে পদাবলির ভাবতন্ময়া পূর্বরাগাশ্রিতা রাধার। কিন্তু এই পর্যায়েও রাধার আবেগ দেহকে অতিক্রম করে অপার্থিব প্রেমের পথে অগ্রসর হতে পারেনি। প্রমাণ বড়ায়ির উক্তি, কৃষ্ণের বিদ্রূপ এবং রাধার নিজের আক্ষেপ। রাধা যখন বারবার কাতর হয়ে কৃষ্ণকে এনে দেওয়ার অনুরোধ জানায়, তখন অভিজ্ঞা বৃদ্ধা বড়ায়ি তার এই সুগভীর আর্তির পিছনে কিসের উত্তেজনা তা বুঝতে পারে। একদিন যে কৃষ্ণের মিলন-প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, এখন তাকে আঘাত দিয়ে বড়ায়ি বলে:
<poem>
:: এবেঁ ঘুসঘুসাআঁ পোড়ে তোর মন।
:: পোটলী বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন।।
</poem>
রাধা বড়ায়ির কাছে যে কথা জানিয়ে কৃষ্ণকে আনার অনুরোধ করেছে সেগুলির মধ্যে কয়েকটি এইরকম: "আয়িস ল বড়ায়ি রাখহ পরাণ সহিতেঁ নারোঁ মনমথবাণ।।", "ঝাঁট করি কাহ্নাঞিঁ আনাওঁ। রতি সুখে রজনী পোহাওঁ।।", "পীন কঠিন উচ তনে কাহ্নাঞি পাইলেঁ দিবোঁ আলিঙ্গনে।।", "উন্নত যৌবন মোর দিনে দিনে শেষ"। এগুলি কামোন্মত্ত বিহ্বল দেহসুখপ্রত্যাশী নারীর কথা, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। রাধাবিরহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পদে ‘যৌবন’, ‘মনমথ’ ও ‘সুরতী’ শব্দ তিনটি বারবার ব্যবহার করে কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্জলা দেহকামনা কেমন করে বেষ্টন করে আছে যুবতী রাধাকে। রাধার অনুরোধে বড়ায়ি গিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ে এলে সে যেভাবে রাধার সঙ্গে বাক্যবিনিময় করেছে, তাতে দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার মদনপীড়াটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। নইলে সে বিদ্রূপ করে নপুংসক আইহনের কথা তুলে বলত না, “ঘরে গিআঁ সেব তোহ্মে আইহন পতী”।
কিন্তু শেষপর্যন্ত বহু অনুরোধে একবার মিলন এবং চিরজীবনের জন্য নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কিছুই জোটে না রাধার। এই সমাজের নারীভাগ্যই যেন রাধার এক দুঃখময় জীবনবৃত্তে প্রতিবিম্বিত। ড. সত্যবতী গিরি তাই লিখেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের কামনার বলিমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।... তার মন যখন পারিবারিক ও সামাজি পরিবেশের প্রথাবদ্ধ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্বের অবস্থানে আনন্দিত, তখন নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য এক পুরুষ তার অনিচ্ছুক শরীরের উপর বলাৎকার করেছে। আর সেই কারণেই সরল সুস্থ নারীর মন ও শরীর দুই-ই যখন সেই পুরুষকে পাওয়ার জন্য আকুল, তখন সে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত।... অনিচ্ছুক বা ইচ্ছুক রাধার উভয় প্রান্তই এই সমাজে নারীভাগ্যের সীমানা। কৃষ্ণের হাতে আত্মসমর্পণের অনিচ্ছা প্রকাশে সে বিদ্রোহিনী, আবার আত্মনিবেদনে ইচ্ছুক রাধাও সামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহিনী। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই তার বিদ্রোহ সফল নয়। সে সামন্ত-শাসিত বাঙালি সমাজের প্রথম নতজানু বিদ্রোহিনী।”
====বড়ায়ি====
রূপ গোস্বামী তাঁর ''উজ্জ্বলনীলমণি'' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলায় সহায়িকা সখীর ভূমিকা বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর বড়ায়ির আবির্ভাব সেই গ্রন্থের অনেক পূর্বে। অবশ্য ''গীতগোবিন্দম্''-এ নাগরিক রুচিসম্পন্না সখীদের দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাস গ্রামীণ পটভূমির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সখীর বিকল্পে এনেছেন বড়ায়িকে। সে একাধারে দূতী, সখী ও অভিভাবিকা। এই তিন ভূমিকার সমাহারে বড়ায়ি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় চরিত্র। দামোদর গুপ্তের ''কুট্টিনীমতম্'' অথবা বাৎস্যায়নের ''কামসূত্রম্''-এ নিসৃষ্টার্থা দূতীর ধারণা পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের বড়ায়ি অবশ্য কবির দেখা গ্রাম্য কুট্টিনী, যারা সেকালে এই জাতীয় গোপন সম্পর্ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিল। বহু পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্রের ''নীলদর্পণ'' নাটকের পদী ময়রাণীর চরিত্রেও এই-জাতীয় চরিত্রের ছায়া দেখা যায়। তাই অনুমান করা যায়, একদা গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের বয়স্কা রমণীদের দেখা যেয়, যারা অর্থের বিনিময়ে অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ঘটাতো অথবা কামুক পুরুষের কাছে এনে দিত তার আকাঙ্ক্ষিতা নারীকে।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' কাব্যে বড়ায়ির একটি সামাজিক পরিচয় আছে। সে রাধার মায়ের পিসি। সেই অর্থে সম্পর্কে রাধার দিদিমা বা বড়-আয়ি। সেই থেকেই সম্ভবত ‘বড়ায়ি’ নামটি এসেছে। তার বেশভূষা, চেহারা ও অঙ্গভঙ্গি বর্ণনায় কবি বেশ হাস্যরস সঞ্চারিত করেছেন। রাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইহন-জননী তাকে নিয়ে এসেছে রাধার পিত্রালয় থেকে। তার কাজ নাবালিকা বধূর পরিচর্যা, মথুরার হাটে নিয়ে যাওয়া এবং সর্বক্ষণ তার সঙ্গ দেওয়া। একবার বনপথে রাধা চোখের আড়ালে চলে গেলে ‘গরু রাখোলা’ কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপবর্ণনা করে সে তার হদিশ জানতে চায়। সে-কথা শুনে ‘কামী’ কৃষ্ণ রাধার রূপে আকৃষ্ট হয়ে এবং বড়ায়ির হাতে তাম্বুল প্রেরণ করে। বড়ায়ি যে দূতীগিরিতে নিপুণা ও সফল তার উল্লেখ আছে বড়ায়ির নিজের উক্তিতেই। কিন্তু সেই সাফল্যে সম্ভবত প্রথম আঘাত রাধার অস্বীকৃতি। শুধু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান নয়, বড়ায়িকে মাটিতে ফেলে প্রহার করে রাধা। বড়ায়ির মনে জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। কৃষ্ণই হয়ে ওঠে তার অবলম্বন। পরবর্তী দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ছত্রখণ্ড প্রভৃতি অংশের প্রত্যেকটিতেই তাই বড়ায়ি কৃষ্ণের পক্ষাবলম্বী হয়েছে নাবালিকার দর্পচূর্ণ করতে।
কিন্তু বড়ায়ি কেন এহেন অসামাজিক সম্পর্কের প্রস্তাব নিয়ে আসতে রাজি হয়েছিল সেটিও বিবেচ্য। একজন সমালোচকের মতে, নপুংসক-পত্নী রাধার বিড়ম্বিত জীবনের প্রতি ছিল বড়ায়ির গভীর সমবেদনা। রতিসুখ-বঞ্চিয়া নারীর শুষ্ক জীবনকে পূর্ণ ও সরস করার অভিলাষেই সে সম্মত হয়েছিল কৃষ্ণের অশালীন প্রস্তাবে। তাই দানখণ্ডে ও নৌকাখণ্ডে সে রাধার করা অমপানের প্রতিশোধ নিলেও বৃন্দাবনখণ্ডে এগিয়ে আসে রাধাকে সাহায্য করতে। দেহসুখ-বাসনায় উদ্বেল রাধার শাশুড়ির কাছ থেকে বাক্-কৌশলে সে অনুমতি আদায় করে। আবার বাণখণ্ডে কৃষ্ণ রাধাকে বাণের আঘাতে মূর্চ্ছিত করলে বড়ায়ি কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করে। এই ঘটনা থেকে বড়ায়ি চরিত্রের আর-একটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মধ্যে নিরপেক্ষতাবোধও দুর্লভ নয়। রাধা ও কৃষ্ণ দুজনেই তাঁর স্নেহভাজন। ফলে যাকে যখন বঞ্চিত বা পীড়িত বলে মনে হয়েছে বড়ায়ি নির্দ্বিধায় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার মনোব্যথা লঘু করার ক্ষেত্রে বড়ায়ির ভূমিকা অনবদ্য। এই পর্যায়ের বড়ায়ি যেন ''গীতগোবিন্দম্''-এর সহায়িকা সখী। কখনও সে নানা যুক্তিতর্কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, কখন বাঁশি চুরি করার পরামর্শ দেয়, কখনও রাধার আর্তিতে বিগলিত হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হয়, কখনও মূর্চ্ছিতা রাধার চেতনা ফিরিয়ে আনতে তার সুশ্রুষা করে, আবার কখনও মথুরায় গিয়ে আহ্বান করে কৃষ্ণকে। এখন রাধার যাবতীয় দুঃখ-নিবেদনের আধার হয় বড়ায়ি। কৃষ্ণও তার মনের ক্ষোভ ব্যক্ত করে এই বড়ায়ির কাছেই। সে রাধার দেওয়া অপমান ভুলতে পারছে না, আর তার রাধাতে আসক্তি নেই। কেবল বড়ায়ির অনুরোধেই সে শেষবারের মতো বৃন্দাবনে এসে মিলিত হয় রাধার সঙ্গে। সম্ভোগের পর নিদ্রিতা রাধার প্রতি যত্ন নিতে বলে যায় বড়ায়িকে। বড়ায়ি তাই কেবল দূতী বা সখী নয়, একই সঙ্গে সে কর্তব্যপরায়ণা অভিভাবিকাও।
সমগ্র আখ্যান থেকে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম-সংঘটনের ক্ষেত্রে বড়ায়ির সক্রিয়তাই সর্বাধিক।। দুই পক্ষের মধ্যে যখনই কোনও সংকট, অনীহা, দ্বন্দ্ব, ভুল-বোঝাবুঝি উপস্থিত হয়েছে, বড়ায়ি তখন তার কূটবুদ্ধি, অভিভাবিকা-সুলভ পরামর্শ, সখীসুলভ সহমর্মিতা, পরিজনতুল্য স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছে। এই বড়ায়ি যেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রধান পরিচালক। লৌকিক প্রেমের কাব্যে কবির উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধ মানবরস পরিবেশন। তাই অলংকারশাস্ত্রে কথিত নিষ্প্রাণ কুট্টিনী চরিত্র নয়, কবি নিজ কল্পনার গুণে বড়ায়িকে করে তুলেছেন রক্তমাংসের এমন এক জীবন্ত মানুষ, যার মধ্যে আত্মগর্ব, প্রতিহিংসা-পরায়ণতা, বুদ্ধির প্রখরতা, বিপুল চরিত্রাভিজ্ঞতা সবই আছে, সেই সঙ্গে আছে পীড়িত ও বঞ্চিতের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধও। গোড়ার দিকে ‘কুটিল’, ‘কপটকুশলা’ বিশেষণে ভূষিতা এই বৃদ্ধা তাই অনায়াসেই হয়ে উঠেছে এক গভীর ব্যঞ্জনাময় চরিত্র। এই অনন্য চরিত্রের অনুকরণ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি।
===প্রকরণ===
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সংরূপগত শ্রেণিবিচার সম্বন্ধেও মতানৈক্য আছে। Genre বা সংরূপ হল কোনও নির্দিষ্ট শিল্পাঙ্গিক, যা সাহিত্যকর্মকে একটি শ্রেণি থেকে আর-একটি শ্রেণিতে পৃথক করতে সমর্থ হয়। সব রচনা সমানভাবে রূপপ্রাপ্ত হয় না। তাই ভাবের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকলেও কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প ইত্যাদি সাহিত্যপ্রকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন আস্বাদন অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। প্রত্যেকটি আঙ্গিকেরই স্বতন্ত্র মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলির আবির্ভাবও বিশেষ বিশেষ সময়ে পৃথক পৃথক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে থাকে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর গোত্রনির্ণয়ে প্রায় সকল সমালোচককেই থমকে যেতে হয়েছে। কারণ, এই রচনা কোনও একটি বিশেষ সংরূপের বৈশিষ্ট্য আত্মীকরণ করে আবির্ভূত হয়নি। বরং এর মধ্যে লক্ষিত হয়েছে মিশ্র রূপের সমাবেশ। এটা খুবই নিশ্চিত যে, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানমূলক রচনা ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''। ‘কাব্য’ হিসেবেই এর পরিচিতি সর্বাধিক। কিন্তু বাংলা ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাসের কোনও আদর্শ ছিল কিনা, অন্তত পরবর্তীকালের আবিষ্কৃত গ্রন্থাবলির মধ্যে তার কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায় না। তবে জয়দেবের ''গীতগোবিন্দম্''-এর কাছে তিনি যে বিষয়-ভাবনা ও আঙ্গিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ঋণী তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বস্তুত শিল্পাঙ্গিক হিসেবে জয়দেবের রচনাটি ছিল অভিনব। যতদূর সম্ভব তিনি লোকনাট্যের রীতি অনুসরণে গীতিনাট্যের পালা রচনা করেছিলেন। এই সংরূপটিকে জয়দেব নির্দেশ করেছিলেন ‘গীতপ্রবন্ধম্’ বলে। কিন্তু কেবল গান নয়, সঙ্গে কবির বর্ণনা এবং ঘটনাশ্রিত পাত্রপাত্রীদের উক্তি-প্রত্যুক্তিও গ্রথিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। সব মিলিয়ে ''গীতগোবিন্দম্'' এক বিচিত্র শ্রেণির গ্রন্থ, যা সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যেই দুর্লভ। অনুপুঙ্ক্ষ বিচার করলে দেখা যায়, বড়ু চণ্ডীদাসের রচনাতেও সেই আখ্যান-বিবৃতি, নাটকীয়তা ও গীতিধর্মিতার সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।
বড়ু চণ্ডীদাস মুখ্যত ভাগবতীয় কাহিনির প্রসিদ্ধ কাঠামোয় তাঁর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-আখ্যানটিকে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরাগমন পর্যন্ত বৃন্দাবনের ঘটনাগুলিই এতে বিবৃত। অথচ বিবরণের প্রচলিত বর্ণনাত্মক পদ্ধতিকে একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে না নিয়ে তিনি বৈচিত্র্য এনেছেন নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। নাটক সংলাপ-নির্ভর একটি স্বতন্ত্র সংরূপ, যা অখণ্ড সমগ্রতায় বিধৃত হয়। নাটকের প্রাণ হল দ্বন্দ্ব। তীব্র গতিতে তা প্রার্থিত পরিণামের দিকে ছুটে চলে। নাটকের প্রধান গুণ বাস্তবধর্মিতা। এর চরিত্রগুলি যত বেশি রক্তমাংসের হয়, ততই সাহিত্য হিসেবে নাটক দর্শকের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর তেরোটি খণ্ডে আখ্যান যেভাবে এগিয়েছে তাতে যথেষ্ট নাটকীয় উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। জন্মখণ্ডের বিবরণটিকে ধরা যেতে পারে সংস্কৃত নাটকের সূচক বা প্রস্তাবনার মতো, যেখানে নাটকের মুখ্য কুশীলবদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর দীর্ঘ বারোটি খণ্ড জুড়ে তাদেরই নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, মানসিক সংকট, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও বিচিত্র প্রকার ভাব ও আবেগের বিস্তার। প্রতিটি খণ্ড এমনভাবে স্থান ও কালের পরম্পরায় সজ্জিত যে, প্রত্যেকটিকে একটি ঘটমান নাট্যবৃত্তের ক্রমিক দৃশ্যায়ন বলে মনে হওয়াও সম্ভব। ঘটনার সঙ্গে উত্থান-পতনে নাটকীয় চরিত্রগুলির যে বিবর্তন ঘটে এখানে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে সে অপেক্ষিত মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তিটি বড়ু চণ্ডীদাস তুলে ধরেছেন রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রে। মিহির চৌধুরী কামিল্যা তাঁর সম্পাদিত ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত'' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি নাবালিকা, যে দেহজ মিলন সম্পর্কে অনভিজ্ঞা, পরপুরুষ সম্পর্কে প্রচণ্ড ভীতা, আত্মসম্ভমময়ী এবং নিজের স্বামীকুল, পিতৃকুল সম্পর্কে গর্বিতা, সেই একাদশবর্ষীয়া বালিকা এক নির্লজ্জ, কামাতুর, গ্রাম্য গোপবালকের বারংবার অবৈধ পীড়নে কেমন করে ধীরে ধীরে মর্মদাহী যন্ত্রণার ভিতর দিয়া পীড়নকারীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো, বড়ু চণ্ডীদাস তার একটি উপভোগ্য কাহিনী নির্মাণ করেছেন।” (পৃ. ৫৬) তাম্বুলখণ্ডের স্বামী-গর্বিতা যে নারী একদা বলেছিল, “নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা”, সেই স্বীয় অবস্থানে সানন্দিতা সুস্থিতা পূর্ণযুবতীকে দিয়ে আখ্যানের শেষে কবি বলিয়ে নেন:
<poem>
:: ধরন না জাএ বড়ায়ি আহ্মার যৌবন।
:: প্রাণ রাখি আনি দেহ নান্দের নন্দন।।
</poem>
চরিত্রের এই বিবর্তন অনেকগুলি ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটেছে। কবি নাট্যকার-সুলভ দক্ষতায় সমগ্র বৃত্তের মধ্যে সেই কার্য-কারণ সম্পর্ক রক্ষা করে প্রার্থিত পরিণামের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে কৃষ্ণ চরিত্রটিকে প্রথম থেকেই করে তুলেছেন নারীসঙ্গলোভী এক কামুক পুরুষ। রাধাকে দৈহিক ভাবে পাওয়ার জন্য সে নানারকম ছলনা, প্রতারণা, অভিনয় ও নীচতার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। রাধার সঙ্গে বারবার মিলিত হয়ে অন্তরের তৃষ্ণার উপশম ঘটে তার। অতঃপর ‘গততৃষ্ণ’ কৃষ্ণ তুচ্ছ অজুহাতে মিথ্যা অভিযোগে সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্না কৃষ্ণসঙ্গাভিলাষী রাধাকে নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করে চলে যায়। আত্যন্তিক আসক্তি থেকে পূর্ণ অনাসক্তি—কৃষ্ণের এই বিপরীতধর্মী অবস্থান নানা নাটকীয় পরিস্থিতিতে অল্প অল্প করে এগিয়েছে। নাটক অভিনয়যোগ্য মঞ্চনির্ভর সাহিত্যধারা। তারও শেষ গন্তব্য সেই রস। বর্ণিত আখ্যানটি আধুনিক দৃষ্টিতে স্থূল, গ্রাম্য ও অমার্জিত ঠেকতে পারে, কিন্তু এর খাঁটি মানবিক রসে কোথাও কোনও সন্দেহ উপস্থিত হয় না। নাটকের উদ্দেশ্যে এই রস সৃষ্টি করা এবং সেই দিক থেকে বড়ু চণ্ডীদাস সম্পূর্ণ সফল। নাটকের মুখ্য অবলম্বন তথা বহিরঙ্গের চিহ্ন হল সংলাপ। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এও দেখা যায় ৪১৮টি পদের মধ্যে মাত্র ৪২টি পদ কবির বিবৃবি, অবশিষ্ট পৌনে চারশো পদ কোনও না কোনও চরিত্রের উক্তি বা স্বগতোক্তি। সংলাপের মধ্যেও আছে পাত্রপাত্রী ও পরিস্থিতিগত বৈচিত্র্য। যেমন, দানখণ্ডে কৃষ্ণের উক্তিতে অশালীন প্রস্তাব থাকলেও তার ভাষাগত অভিব্যক্তিটি গ্রাম্যতাদোষ থেকে মুক্ত। অন্যদিকে রাধার সংলাপে যে ধার ও তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করা যায়, তা গ্রাম্য নারীর ভাষা ও প্রবচনে সমৃদ্ধ এবং তার অন্তরের ঘৃণা ও অস্বীকৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। আবার বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ভাষায় আবেগধর্মিতা প্রবলভাবে উপস্থিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মাত্র তিনটি মুখ্য চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নাটককে অলংকারশাস্ত্রে ‘বীথি’ বলা হয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এর সঙ্গে এই নাট্যশ্রেণির সাদৃশ্য দেখা যায়। এতে পরিবেশিত শৃঙ্গার রসের আধিক্যের নিরিখে কেউ কেউ একে জাগের গান অথবা ঝুমুর গানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাগের গান ‘ধামালি’ বলে কথিত। এই গানে সঙ্গমকামনার বিষয়টিই মুখ্য। ঝুমুর গানে থাকে দুটি দল, যারা পারস্পরিক উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে আখ্যানটিকে গতিময় করে তোলে। এই দুইয়ের কিছু কিছু লক্ষণ থাকলেও ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' সম্পূর্ণত লোকরীতির রচনা নয়। বরং ড. সুকুমার সেন ‘লগনী’, ‘দণ্ডক’, ‘প্রকীণ্ণক’ ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগের সূত্রে এটিকে ‘নাটগীত’ শ্রেণির রচনা বলে মনে করেন। তিনি আরও অনুমান করেন, মধ্যযুগে এই পালা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সম্ভবত পুতুলনাচ হত। ‘পঞ্চালিকা’ অর্থে পুতুল ধরলে এর প্রকৃত অভিধা হয় ‘নাটগীত পঞ্চালিকা’। দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, বস্ত্রহরণখণ্ড, রাধাবিরহ প্রভৃতি অংশে যেভাবে রাধাকৃষ্ণের দৈহিক সম্ভোগের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব পাত্রপাত্রীর দ্বারা তার অভিনয় নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। অতএব এর নাট্যধর্মিতা ও মঞ্চযোগ্যতা স্বীকার করে নিলে পুতুলনাচের সম্ভাবনার কথাও অবশ্যই মানতে হয়।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ নাট্যধর্ম ব্যাপক পরিমাণে থাকলেও এটিকে কোনওমতেই বিশুদ্ধ নাটক বলা চলে না। প্রথাসিদ্ধ নাটকের অবয়বে এটি লেখা হয়নি। বরং যে কৌশলে সংলাপগুলিকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, তাতে এর বর্ণনাত্মক স্বভাবটিই ধরা পড়ে। একটি নিটোল গল্প সাজিয়ে-গুছিয়ে বলেছেন কবি। পাত্রপাত্রীর অঙ্গভঙ্গি, ক্রিয়া, মনের কথা ইত্যাদিকে সংলাপের পাশাপাশি নিজের কথার মাধ্যমেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এই রীতি নাটকের নয়, কথাসাহিত্যের; আরও নির্দিষ্ট করে বললে উপন্যাসের। এই ভঙ্গিটিই আদ্যন্ত দৃশ্যমান সমগ্র গ্রন্থে। বৃহদায়তন আখ্যানকে যেমন কথাসাহিত্যিক একাধিক অধ্যায়ে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত করে ঘটনার এক-একটি পর্যায় নির্মাণ করেন, এখানে খণ্ডবিভাগ মোটামুটি তারই অনুকল্পে সাজানো। জন্মখণ্ডে তথ্যমূলক বিবরণই প্রধান। এরপর তাম্বুলখণ্ড থেকে বাণখণ্ড পর্যন্ত গল্প চলেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে। তারপর আবার স্তিমিত হয়ে পড়েছে আখ্যানের গতি। পরিসংখ্যান অনুসারে, সমগ্র আখ্যানে মোট ৪২টি পদ কবির উক্তি। এতে পরস্প-বিচ্ছিন্ন ক্রিয়া ও ঘটনাগুলিকে এক সূত্রে গেঁথে তোলার প্রয়াস লক্ষিত। আর আছে ১৬১টি সংস্কৃত শ্লোক। এই শ্লোকগুলির বেশ কয়েকটি কবির উক্তি তথা নির্ভেজাল বিবৃতি। ঘটনার উল্লম্ফনকে ধরার জন্য এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এগুলিতে প্রধান তিন চরিত্রের স্বভাব ও আচরণ সম্পর্কে ছোটো ছোটো অথচ তীক্ষ্ণ মন্তব্য করা হয়েছে, যা নাট্যধর্মকে কিছুটা ক্ষুণ্ণ করে কথাসাহিত্যের বিশ্লেষণধর্মিতাকে চিনিয়ে দেয়। ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ বড়ু চণ্ডীদাস যে আলাদা করে বর্ণনাধর্মিতার দিকে দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন, তার বিশেষ প্রমাণ এই শ্লোকগুলিই।
''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ গীতিলক্ষণও খুব স্পষ্ট। নাটকীয়তা ও বর্ণনাধর্মিতার সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়ে প্রসঙ্গ অনুসারে গীতিকবিতার সুর অনুরণিত হয়েছে এতে। রচনার প্রথমাংশে লোকসংগীত ঝুমুরের প্রভাব অনেকেই স্বীকার করেন। কিন্তু এর শেষাংশে তা রীতিমতো গীতিকাব্যিক মূচ্ছনার সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে দুটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথম, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব রচনাই সংগীত-নির্ভর। গেয়ে পরিবেশনের উদ্দেশ্যেই এগুলি রচিত হত। কাব্য হিসেবে তাই এগুলি গেয়কাব্য। দ্বিতীয়ত, মধ্যযুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি বলে কবির ব্যক্তিগত স্বকীয় ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটনের কোনও জায়গা ছিল না। তবে নিজের অন্তরঙ্গ অনুভূতি কিংবা উপলব্ধিকে আখ্যান-বিধৃত চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে কোনও বাধা ছিল না। বস্তুত তাই লক্ষ্য করা যায় ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ। বিশেষত বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে রাধার ব্যক্তিচিত্তের অন্তর্গূঢ় বেদনাই রূপলাভ করেছে গীতকাব্যের ভাষায় ও সুরে। ব্যক্তিগত এই যন্ত্রণা প্রকাশের সূত্রেই হয়তো একসঙ্গে বাঁধা পড়তে পারে বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসের কৃষ্ণপ্রেম-উন্মাদিনী শ্রীরাধিকা। কেউ কেউ বংশীখণ্ডের “কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কুলে” পদটিকে গীতিকাব্যিক উচ্ছ্বাসের চূড়ান্ত নিদর্শন বলে মনে করেন। এই পদটির আখ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টাও হয়েছে; যদিও রাধা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে অন্য সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয়। যাই হোক, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'' যে একদা আসরে গাইবার জন্যই লেখা হয়েছিল তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ প্রতিটি পদের সূচনায় বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর উল্লেখ। গাইবার সময় সুরের একঘেয়েমি এড়ানোর জন্য বৈচিত্র্যময় রাগ ব্যবহারের নির্দেশ করে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শিল্পসচেতনতার পরিচয়ই দিয়েছেন। একই সঙ্গে রয়েছে তালের উল্লেখও। রাগ ও তালের এহেন প্রয়োগ দেখে তাঁকে সংগীত-বিশারদও ধরা যেতে পারে। সব মিলিয়ে ৩২টি রাগ-রাগিণীর উল্লেখ করেছেন তিনি। এগুলির মধ্যে পাহাড়িয়া রাগে রচিত পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। অন্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রামগিরি, গুজ্জরী, কোড়া, ধানুষী, দেশাগ, মালব, ভাটিয়ালী, মল্লার, দেশবরাড়ী, বেলাবলী, আহের, ভৈরবী, ললিত, মালবশ্রী, বসন্ত, বিভাস ইত্যাদি। তালের মধ্যে আছে যতি, রূপক, ক্রীড়া, একতালী, আঠতালা ইত্যাদি। সংগীতবিদ রাজ্যেশ্বর মিত্র এই গ্রন্থের গীতিমূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “এ গ্রন্থটি কী কাব্য, কী সংগীত, কী গীতিনাট্য সব দিক থেকেই রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রাচীন সংগীত কলার অত্যুৎকৃষ্ট পরিচায়ক।” যাই হোক, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন''-এ কোনও একটি নির্দিষ্ট সংরূপ তার বিশেষ লক্ষণ নিয়ে উপস্থিত নেই। বরং এটি বিবেচনা করা যায় যথেষ্ট লাট্যোপাদান-সমৃদ্ধ গীতিধর্মাশ্রয়ী আদিরসাত্মক আখ্যানকাব্য হিসেবে। এই মিশ্র অথচ গুণান্বিত সংরূপটির অনুসরণ পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর কখনও দেখা যায়নি।
seyyo7gcjqzwr13gfljlxx1xybdqdnn
ব্যবহারকারী আলাপ:Sepo26
3
27267
85932
2025-07-10T17:40:20Z
KanikBot
8129
স্বাগতম!
85932
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ১৭:৪০, ১০ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
1vem2qu0irq7tqi4o96tdgp5fvisxsr
ব্যবহারকারী আলাপ:Tanvir hasan jakaria
3
27268
85933
2025-07-10T20:40:23Z
KanikBot
8129
স্বাগতম!
85933
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ২০:৪০, ১০ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
7dvolah1fl5ras0r56i4lhlrmh6zk2e
ব্যবহারকারী আলাপ:MatthewEdits1225
3
27269
85934
2025-07-10T22:40:21Z
KanikBot
8129
স্বাগতম!
85934
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ২২:৪০, ১০ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
s6dg0ufn3m58w23jmfvhmfuhvatwuri
ব্যবহারকারী আলাপ:Habibur67
3
27270
85943
2025-07-11T10:40:18Z
KanikBot
8129
স্বাগতম!
85943
wikitext
text/x-wiki
== বাংলা উইকিবইয়ে স্বাগত ==
{{স্বাগত/২য় সংস্করণ}} ১০:৪০, ১১ জুলাই ২০২৫ (ইউটিসি)
a1w10jrlmdmiztbfvhwbpo7znma38oa